প্রণয়চূর্ণ … [মনসুখিয়ার নতুন পর্ব]

index-1

১.
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হয়েছে একদিন আগে। অফুরন্ত অলস অবসর। সকালে দেরী করে ঘুম থেকে জাগবে, তাই একটা টাওয়েল ভাজ করে ল্যান্ডফোনের উপর দিয়ে রেখেছে নটরডেম, যাতে এনালগ সেটের কর্কশ আওয়াজে ঘুম না ভাঙে। ১৯৯২ সালে দেশে ডিজিটাল ফোন ছিলো না। রাত জাগার অভ্যাস তার পুরানো, ঘুম না আসায় বই পড়তে শুরু করেছিলো সে, কখন যে ঘুমের দখলে চলে গেছে বুঝতেও পারেনি। ওর ঘুম হালকা হয়ে এলো ক্রিইইইং… ক্রিইইইং… ক্রিইইইং… শব্দে। বহুক্ষণ বুঝতে পারছিলো না শব্দটা স্বপ্নে হচ্ছে কি ফোন বাজছে। দু’তিনবার থেমে আবার টানা বাজতেই ঘুম ঘুম চোখেই ফোন রিসিভ করলো নটরডেম,
– হ্যালো।

ওপাশে নিরবতা, আরও দু’বার হ্যালো বলতেই ওপাশে কলকলিয়ে উঠলো ভিকারুননিসা,
– হিহিহি… হিহিহি… এই সাত সকালে কে ফোন করেছে বলে মনে করেছো?

প্রিয়তম কণ্ঠ শুনে নটর ডেমের ঘুম কেটে যায়, তবুও ঘুম ঘুম স্বরে বলে,
– ওহ তুমি! আমি ভেবেছিলাম পপি ফোন করেছে।

ফোনের ওপাশে হাসি থেমে যায়, গম্ভীর কণ্ঠ,
– পপি কে?
– কেউ না।
– সত্যি করে বলো, নটরডেম।
– সেটা জানলে তুমি রাগ করতে পারো।
– রাগ করলে করবো, তবুও বলো।
– বাদ দাও।

ভিকারুননিসার কণ্ঠে জেদ,
– বাদ দিবো না, পপি কে? বলো, পপি কে?

অপরাধীর মত স্বরে ঢোক গিলে নটরডেম বলে,
– জানতেই যখন চাইছো তখন বলছি, পপি মানে.. পপি হলো.. পপি ওই যে..
– ঢং করবে না। একটুও ঢং করবে না। পপি কে?
– পপি হলো চিত্রনায়িকা ববিতার ডাক নাম। উনি আমাদের কাছাকাছি বাসায় থাকতেন, তাই নামটা জানা।
– আমাকে বোকা পেয়েছো? উনি তোমাকে ফোন করবেন কেনো?
– স্বপ্ন দেখছিলাম, ববিতা গাইছেন, “ইশারায় শিস দিয়ে আমাকে ডেকো না.. “আর তখনই ফোন বেজে উঠলো যে…

ফোনের ওপাশে বোমা বিস্ফোরণ,
– তুমি একটা.. তুমি একটা.. তুমি একটা..
– হাহাহাহাহাহা, আমি একটা কি?
– তুমি একটা রোগা জাম্বু।
– হাহাহা, এইটুকুই?
– আজ সামনে আসো, তখনই বুঝাবো তুমি আর কী কী।

ভিকারুননিসার সকল অভিমান, রাগ, খুনসুটি নটরডেমের বুকে একরকমের বোধ তৈরী করে। শিরায় শিরায় প্রবাহিত এই সুখের মত অসুখের বিস্তার প্রকাশের যথাযথ শব্দ তার অজানা। ও শুধু অনুভবের গভীরতা বোধ করে, মোহগ্রস্থ হয়। এ জীবন তার সকল অপ্রাপ্তিময় যাপন নিয়েও দোলায়িত হয় সুখে, ভালোলাগায়, আনন্দে আর ভালবাসায়। উচ্ছাস মিশ্রিত সতেজতায় জানতে চায়,
– আজ দেখা হবে? সত্যি!
– শোনো, বাবা কালকের ফ্লাইটে আয়ারল্যান্ড গেছেন। মা’কে কোচিং আর বান্ধবীর বাড়ির কথা বলে আজ সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বাইরে থাকতে পারবো। তুমি আসবে, নটরডেম? কতদিন তোমাকে দেখি না।
– ক’টায় দেখা হচ্ছে?
– সাড়ে তিনটায়, সাগর পাবলিশার্সের সামনে থেকো।
– ভিকারুনিসা, আড়াইটা থেকেই সাগর পাবলিশার্সে থাকবো। কিছু বই কিনবো। এরপর তুমি এলে দু’জন মিলে বেইলি রোড থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাবো, ওখানে দুটো বই জমা দিয়ে নতুন দু’টো বই নিবো। তারপর রিকশায় ঘুরবো।

কলকলিয়ে ওঠে ভিকারুননিসা,
– ঠিক আছে, রোগা জাম্বু হিহিহিহি..
– হাহাহাহা, লাভ্যু পপি।

ফোন রাখতেই নটর ডেমের মনটা বন্ধনহীন অথচ সংযত উল্লাসে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। হঠাৎ করেই চারদিকে সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করে। বিছানায় কুঁচকে যাওয়া চাদরটাকেও মনে হয় শিল্পকর্ম। শুরু হচ্ছে আরেকটা নতুন দিন। দোতলার ছাদের রেলিংয়ে শিস দিচ্ছে দোয়েল। নটরডেম খোলা ছাদে হাটছে, ভোরের ঘ্রাণ নিচ্ছে। ও জানে প্রতিটা ভোরের ঘ্রাণ আলাদা এবং নতুন। সূর্যটা পুরানো হলেও প্রতিদিনের রোদের রঙ ও তেজ নতুন। ছাদের টবে ফোটা বেলী ফুলের ঘ্রাণের সাথে বাখরখানির ঘ্রাণ মিশে যেতেই বুঝতে পারে বাড়ির উল্টোদিকে শমসের চাচার বাখরখানির দোকানে রুটি বানানো শুরু হয়েছে, দোকানের সামনে বসে মাঠা বিক্রি করছে জগৎ কাকা। আর ঘণ্টাখানেক পর রহমান কাকার কনফেকশনারি দোকান থেকে ভেসে আসবে ক্বারী আবদুল বাসিতের কোরআন তেলওয়াতের শব্দ। মনে সরোদের সুরের মত রিনরিনে কৌতূহল জন্মায়- ভোরে ঘুম ভাঙাবে বলে কি ভিকারুননিসা সারারাত জেগে ছিলো, এখন বাজে মাত্র পৌনে ছ’টা।

২.
মা জেগেছেন। নিচ তলায় রান্নাঘর থেকে শব্দ আসছে। সকালে মা’র চেহারায় এক অবর্ণনীয় সুন্দর লাবণ্য খেলা করে। মা’র শরীর থেকে কোমল আভা বিচ্ছুরিত হয়। এই অলৌকিক আভার জন্ম এই পৃথিবীতে নয়- অন্য কোথাও। পুরানো আমলের দোতলার ছাদের উত্তর পাশ থেকে রান্নাঘরটা দেখা যায়। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে মা’কে দেখে নটরডেম। সে জানে রান্নাঘরের ছোট্ট তিন ফিট বাই তিন তিন ফিটের জানালা দিয়ে মা উপরে তাকাবেন, তারপর রান্নাঘরের দরজায় এসে অপার্থিব নান্দনিক একটা হাসি ছড়িয়ে প্রশ্ন করবেন, “চা খাবি, বাপ?” আজও ব্যতিক্রম হলো না, চোখাচোখি হতেই দরজায় এসে হাসি দিয়ে মা জিজ্ঞেস করলেন,
– চা খাবি, বাপ?
– হুম, তুমি খেয়ে অর্ধেকটা দিও।
– নিচে আয়।

নটরডেম সিড়ি ভেঙে নিচে নামে, সিড়িগুলোর একপাশে ফুলের টব, নয়নতারা ফুটে আছে আর ঘাসফুল ফুটবো ফুটবো করছে। মা’র শখের জিনিস, একটা ছোট্ট ডাল ভাঙলেও উনার চোখ এড়ায় না। মা তার পোষা টবের গাছগুলোর সাথে কি কথা বলেন, গাছগুলো কি বলে, “আজ কেউ আমার ফুল ছিঁড়েছে? দেখেছো!” বা “তোমার ছেলে আমার ডাল ভাঙলো কেনো- জিজ্ঞেস করো”। নটরডেমের জানতে ইচ্ছে করে কিন্তু জিজ্ঞেস করতে অস্বস্তি লাগে। নিচে নেমে রান্নাঘরের সিড়িতে বসতেই প্রতিদিনকার মত মা বলেন,
– তোকে আলাদা মগে চা দিচ্ছি রে বাপ।
– না, মা। তোমার মগের অর্ধেকটা খেয়ে দাও।
– কারো এঁটো’টা খেতে হবেনা।
– মা, তোমার খাওয়াটা খাবো। চায়ের সাথে তোমার মুখের জর্দা দেওয়া পানের ঘ্রাণ লেগে থাকে যে, ওমন চা কোথায় পাবো!

মা মনে মনে খুশি হন, বাইরে প্রকাশ করেন না। আজ চা খাওয়ার আগে বললেন,
– আগে নাস্তাটা খেয়ে নে।

মা এক চুলোয় পরোটা ভাজলেন, আরেক চুলোয় মাংসের বাসি তরকারি হালকা আঁচে একটু পোড়াপোড়া করলেন। প্লেট আর বাটিতে সাজিয়ে রান্না ঘরেই খেতে দিলেন। নিচ তলার চৌকো উঠোনে কয়েকটা কাক নেমে এসেছে। এরা রোজ আসে মুড়ি, রুটি, পরোটা বা বাসি ভাতের লোভে। একটা বিড়ালও আসে। নটরডেম পরোটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে তাদের দিকে দিচ্ছে, নিজেও খাচ্ছে। পায়ের সাথে শরীর ঘষছে বিড়ালটা, মা ওকে বাসি ভাত ঝোল মাখিয়ে খেতে দিলেন।

মা আজ ছাই রঙা পাড়ের হালকা নীল জমিনের একটা ঢাকাই শাড়ি পরেছেন। শাড়ি থেকেও মা মা ঘ্রাণ আসছে। নটরডেমের ভীষণ ইচ্ছে করে ভিকারুননিসার কথাটা মা’কে বলে। কিন্তু কথাটা আলজিভ পর্যন্ত এসে থমকে যায়। মা কি কিছু বুঝতে পারছেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
– কিছু বলবি বাপ!
– নাহ।
– আজ কি কোথাও যাবি? তোর জন্য নোনা ইলিশ আলু দিয়ে রান্না করবো ভেবেছি।
– মা, দুপুরে বের হবো। খেয়েই বের হবো। তবে ফিরতে একটু দেরী হবে।
– দেরী হবে! একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস বাবা।
– ৯টার মধ্যে ফিরবো। এরপর এক সপ্তাহ আর কোথাও যাবো না।

নটরডেম নাস্তা করছে, মা নাস্তা বানানো রেখে চা খান আর ওর চুলে বিলি কেটে দেন, নিজের মনেই বলেন,
– মনের ভেতর কি যে লুকিয়ে রাখিস, তা তুইই জানিস, বাপ। আচ্ছা, ভিকারুননিসা কে?
নটরডেমের বুকের ভেতর দশ লাখ সৈন্যের মার্চপাস্ট শুরু হয়, নিজে কে সামলে নিয়ে বলে,
– মা, ধরো ও কেউ না অথবা সবকিছু। কিংবা শুধুই বিভ্রম। তোমাকে একদিন ঠিক ঠিক বলবো।
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করেন, “এ বড় রঙিন বয়স বাপ, বড় রঙিন বয়স। সুর ভুল হলে মানিয়ে নেওয়া যায়, তাল কাটলেই গণ্ডগোল।”

৩.
কুঁচকানো কালো টি-শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট শরীরে চাপিয়ে নটরডেম আড়াইটা বাজার দশ মিনিট আগে বেইলি রোডে পৌছায়। সাগর পাবলিশার্সে বসে আছেন প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। নটরডেম টানা দু বছর ধরে এই দোকান থেকে বই কিনলেও তাকে কমই দেখেছে। তিনি প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ‘চরমপত্র’ পাঠ করতেন। স্বাধীনতা অর্জনের দেড়যুগ পর স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় বিভিন্ন মঞ্চে ওই সব চরমপত্র পাঠ করা হত, মিছিলের আগে বা পরে চরমপত্র টনিকের মত কাজ করতো, রক্তে দোলা দিত- নটর ডেমের স্পষ্ট মনে আছে। কারণ, ওই সব মিছিলে স্কুলে পড়ুয়া সেও দু’হাত তুলে শ্লোগান দিত, পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তো, পুলিশের লাঠি চার্জ আর কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ার আক্রমণ হতে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিত, ফের আন্দোলনে নামতো।

সিকদার আমিনুল হকের ‘সতত ডানার মানুষ’ এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমাকে জাগাও’ কবিতার বই দুটো ক্যাশ কাউন্টারে রাখতেই তিনি জিজ্ঞেস করেন,
– তোর পরীক্ষা কেমন হইছে?
– জ্বি, ভালো।
– প্রতি মাসে যে বই কিনোস, টাকা কি বাবার কাছ থেকা নিস?
– না, টিউশনির টাকা থেকে কিনি।
– বাহ! ভালো ভালো।

সামান্য ক’টা কথাতেই নটরডেমের মন ভালো হয়ে যায়। বই কিনে দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ায়। আকাশে মেঘ জমছে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। শ্রাবণ মাস, যে কোনো সময় ঝুম বৃষ্টি নামবে। বাতাসটা বৃষ্টির আঁচে ভেজা। আচ্ছা, এই মেঘলা আকাশ দেখে ভিকারুননিসা কি আসবে! বা সে আসার আগেই কি বৃষ্টি নামবে!

৪.
সাড়ে তিনটা বাজতে আরও ত্রিশ মিনিট বাকী, প্রতিটা মিনিটকে ঘণ্টার সমান মনে হচ্ছে। সময়ের নিয়ম সে চলবেই, তাই সাড়ে তিনটাও বাজলো। ভিকারুননিসার দেখা নেই, পৃথিবীর সব বিষাদ নটরডেমের বুকে জমা হয়, চোখে জমে মেঘ। তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। এর ঠিক আট মিনিট পর ভিকারুননিসা উপস্থিত হয়, মেঘলা দিনে সাদা আর লেমন গ্রিন রঙে ম্যাচ করা ড্রেসে আর খোলা চুলে তাকে নিটোল সুন্দর লাগছে। রিকশা থেকে না নেমে ইশারায় নটর ডেমকে উঠতে বলে। নটরডেম রিকশায় উঠে হুড ফেলে দেয়, সে চায় চারপাশে সবাই দেখুক এক কাঠুরের পাশে বসে আছে রাজকন্যা, এই পৃথিবী সাম্যের।

রিকশা ছুটছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দিকে, হাওয়ার দাপট বেড়েছে। নটরডেমের কেনা বই দু’টো দেখে ভিকারুন নিসা প্রশ্ন করে,
– নটর ডেম, এত বই পড়ো?
– নাহ, বইয়ে শুধু চোখ বুলাই, আমার একমাত্র পাঠ্য তুমি। কিন্তু হায়ারোগ্লিফিক্সে লেখা বলে অনেকটাই বুঝতে পারি না।
– হিহিহি.. আচ্ছা তুমি কি হতে চাও?
– যেমন?
– কেউ ডাক্তার হয়, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বিসিএস ক্যাডার, কেউ লেখক, তুমি?

ভিকারুননিসার চোখে চোখ রেখে নটর ডেম বলে,
– অতো জটিল কিছু হতে চাই না। আমি হতে চাই ধরো তোমার চুলের ক্লিপ, জামার বোতাম, বা গলার চেইনের লকেট! অথবা আমৃত্যু এক জোড়া হুক।
– অসভ্য একটা। খুব অসভ্যতা শিখেছো, তাই না!
– আরে অসভ্যতা নয়, অথবা ধরো তোমার ছায়া। সকালে আর বিকেলে প্রলম্বিত ছায়া, দুপুরে পায়ের নিচে জমাটবদ্ধ, আজকের মত মেঘলা দিনগুলোতে প্রায় অদৃশ্য, দেখাই যায়না এমন।
– অদৃশ্য হতে হবে না, আমি সবসময় তোমায় দেখতে চাই।
– হাহাহা, তবে ছায়া নয়, তোমার স্নানের অশেষ সাবান বা গায়ে মাখার অল সিজন লোশন।

লজ্জায় ভিকারুননিসা কিছুটা বিব্রত হয়ে ওঠে, তার ফর্সা চেহারায় লালাভ আভা, কণ্ঠে কপট শাসন,
– ধ্যাত! চুপ করো। তোমায় আজ অসভ্যতায় পেয়েছে।
– হ্যাঁ, চলো এই একটা জীবন কাটিয়ে দেই অসভ্যতায়- মরে যাই, ফের জন্মাই, সেও অসভ্যতায়।
– ছি: নটরডেম, অসভ্যতা কি ভালো!
সিরিয়াস হয়ে ওঠে নটর ডেম,
– প্রিয় ভিকারুননিসা, তুমি কি জানো অসভ্যতা শব্দটাই সভ্যতার মিথ্যে আবিষ্কার, ফাঁপা আস্ফালন।
– মানে?
– মানে, তুমি যা অসভ্যতা বলছো সেটাও ভিন্ন মাত্রার সভ্যতা। অরণ্যে যে মানুষরা নগ্ন থাকে তাদের সভ্যতার রুচিটা আলাদা, আমরা যারা শরীর ঢেকে রেখে সভ্য হই তাদের রুচিটা আরেক রকম।
– তাই?
– তাই নয় তো কি! যে অরণ্যেবাসী কাঁচা মাংস খায়, সুযোগ পেলে মানুষের মাংস খেতে দ্বিধা করেনা, তারাও হাসে কাঁদে, শিশুদের স্নেহ করে, বুনো জন্তুর আক্রমণ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে সঙ্গী সাথী ও পরিবারের সদস্যদের একা রেখে কাপুরুষের মত পালায় না।
– সত্যি?
– হ্যা, সত্যি। তারাও ভালবাসে, পরস্পরকে আদর করে। তাদের সংসারেও আসে নতুন অতিথি, জন্মের প্রথম কান্নায় আনন্দে ভাসে সংসার, অরণ্যের আদিম চারদিক।

ভিকারুননিসা বিভ্রান্ত স্বরে জানতে চায়,
– নটর ডেম, তুমি আমাকে অসভ্য হওয়ার লোভ দেখাচ্ছো?
– না, লোভ দেখানোটা এক ধরণের সভ্য মানুষের কাজ। অবশ্য লোভকে মানসিক বিকারও বলতে পারো, অসভ্যতা আর মানসিক বিকারে যোজন যোজন ফারাক।
রিকশা চলছে। অফিস ছুটির দিন বলে রাস্তা অনেকটা ফাঁকা। কিছুক্ষণ কারো মুখেই কথা নেই, হাওয়ায় ভিকারুননিসার চুলে মাঝে মাঝেই উড়ে এসে নটরডেমের মুখে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে, নটরডেম ভাবছে এ রিকশা যেনো অনন্তকাল চলতেই থাকে, চলতেই থাকে- একটা জীবন এভাবে কেটে গেলে কোনো ক্ষতি নেই। নিরবতা ভাঙে ভিকারুননিসা, কণ্ঠে কৌতূহল,
– নটরডেম, ওই অসভ্যতায় কি গ্রীষ্মের গরমে ব্যবহারের জন্য ফ্রিজ আছে? এসি?
– নাহ নেই, ওই সভ্যতায় এসব জিনিস খুব বেশী অসভ্য। তাছাড়া ঠাণ্ডা খেলেই তোমার টনসিল ফোলে, তোমার খুব কষ্ট হয়।
– ফুলুক, ঠাণ্ডা খেতে না পেলে মরেই যাবো।
– মরবে না, সেখানে আছে বিশল্যকরণী চুমো।
– হিহিহি, শখ কত! কিন্তু এর আগেই বাবা কান ধরে টেনে নিয়ে আসবে, হু।
– প্রেমিকার বাবা আর বড়ভাইগুলো সভ্যতার সঙ্কট, এক একটা মিনি সাইজ হিটলার।
– হিহিহি।

এলোমেলো কথায় যায় সময়। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা বাজতেই নটর ডেম বলে,
– চলো তোমাকে বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসি।

ভিকারুননিসা কিছু বলে না। নটরডেমের বাম হাতের পাতাটা নিজের ডান হাতে মুঠো করে ধরে রাখে, যেনো আর কখনোই ছাড়বে না। এই স্পর্শ নটরডেমের হৃদয়ে ও মগজে ছড়িয়ে দেয় ভালোলাগার অনুরণন, সুখের মত অসুখ প্লাবন হয়ে আছড়ে পড়ে মনে। নটরডেম প্রার্থনা করে সারাটা জীবন যেনো এভাবে কেটে যায়, দু’জনের পথচলা যেনো কোনোদিন অতীত না হয়। প্রতিদিন যেনো ভিকারুননিসা তাকে ডাকে, মনে মনে ‘সতত ডানার মানুষ’ হতে সে ভিকারুননিসাকে বলে- “অনুকম্পা হলে ডেকে নিও আমায় যে কোন সময়/আমি তো অতীতকাল নই যে ফিরে আসতে পারবো না কখনো।’

৫.
ফিরে আসা সহজ নয়, যতটা সহজ ফিরে যাওয়া। ভিকারুননিসা সাম্যের পৃথিবীতে কাঠুরেকে বাদ দিয়ে খুঁজে পেয়েছিলো রাজপুত্র। সে পেয়েছিলো ক্ষণিকের চটুল প্রেম কোনো এক ঢাকা কলেজের কাছে। প্রেম নেই, তার প্রেমশূন্য সংসার টিকে আছে। অথবা সংসার নয়, সংসারের ফসিল। বহু দিন, বহু বহু দিন অনুকম্পা হয়নি তার, সময় হয়নি তার কাঠুরেকে ডাকার। সভ্যতা ও অসভ্যতা চলেছে যে যার মত, ঘড়ির পেন্ডুলাম দুলেছে দুই দিকে অবিরাম, সময় যাচ্ছে চলে উদ্দেশ্যহীন।

এক তুমুল বর্ষনের রাতে ছাদে উঠে আকুল হয়ে কেঁদেছিল নটরডেম। আত্মহননের শিল্প শিখে নিয়েছিলো সে। প্রতিদিন কতবার যে নিজেকে ভস্ম করে উড়িয়ে দিয়েছে হাওয়ায় হাওয়ায়, অবলীলায়। নিজেকে অবহেলা করতে করতে সে ভুলে গিয়েছিলো অবহেলা কাকে বলে। কত ভোরে মনে হয়েছে ফের বেজে উঠবে টেলিফোন, কিন্তু বাজেনি। নিজেকে হনন আর দহনে ভস্ম করা যার অভ্যাস, তার গোপন করা অযুত দীর্ঘশ্বাস গুমরে ওঠে হাওয়ায় হাওয়ায়। তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে অভ্রবকুল, ডাকে মনসুখিয়া, যার বুক চিরে বয়ে যায় এক নদী, জোছনা রঙা রৌদ্রনদী।

3 thoughts on “প্রণয়চূর্ণ … [মনসুখিয়ার নতুন পর্ব]

  1. অণুগল্প পাঠে একরাশ মুগ্ধতা জানালাম আবু সাঈদ আহমেদ। ঈদ মোবারক। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  2. ভালো লেগেছে, দাদা। এমন আরও বড় লেখা পড়তেও ভালো লাগে।
    শুভকামনা সবসময়।

  3. ঈদ মোবারক স্যার। নিরাপদ থাকুন সব সময়। শুভকামনা … https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।