৪.
মণ্ডল পাড়ার মোরে এসে অটো ছেড়ে দিতে হলো। তিন চার মিনিটের পথ হেঁটে যেতে হবে। বৃষ্টি বাড়ছে কমছে কিন্তু থামছে না। আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরাতেই বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমলো। হাঁটতে শুরু করলাম।
বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট টানার অন্যরকম মজা আছে, স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর এ খাদ্যটি তার ভয়াবহ সকল উপকরণ নিয়েই কখনো কখনো স্বর্গীয় হয়ে উঠতে পারে। সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় এসে কলবেলে চাপ দিলাম, দরজা খুললো রুবাই,
– মামা, তুমি তো ভিজে গেছো!
– বৃষ্টির দিন, ইচ্ছে না হলেও একটু আধটু ভিজতে হয়।
– তুমি ইচ্ছে করেই ভিজেছো..
– এখন জেরা করবি না ঘরে ঢুকতে দিবি!
আপা ছুটে এলেন, হাতে তোয়ালে, পৃথিবীর সকল বিরক্তিকে কণ্ঠে জমা করে বললেন,
– বৃষ্টি কমলে আসা যেত না! পুরো ভিজে গেছিস।
– পুরো ভিজিনি, কিছুটা ভিজে গেছি, ওটা কিছু নয়।
– কিছু নয় বললেই হলো, কাপড় চেঞ্জ কর।
– ধ্যাত, আপা, কি যে বলো! শরীরের তাপে পাঁচ মিনিটে সব শুকিয়ে যাবে।
– ফের জ্বর বাঁধিয়েছিস।
– হু। আমি বাঁধাইনি, জ্বরই আমাকে বাঁধিয়েছে। এখন ছাড়ছি না বলে চলে যেতে পারছে না।
– ফাজলামি করবি না, আমি তোর বড় বোন, বিয়াইন না। টাওয়েল ধর।
আপা বিরক্ত হয়ে নিজে ঘরে গেলেন, রুবাই আমার চুল মুছে দিতে দিতে বললো,
– মামা, দুপুরে তো খেয়ে আসোনি, ভুনা খিচুড়ি খাও। সাথে আছে ইলিশ ভাজা, শুটকি ভর্তা, আমের আচার আর মুরগির ঝাল ভুনা।
মেনু শুনেই জিভে পানি চলে এসেছে, পেটে জেগেছে রাক্ষসের ক্ষিধে। মন অহং মেশানো স্বরে বলে উঠলো, ‘তোমাকে কেন্দ্র করেই এই আয়োজন, তুমি কতটা গুরুত্বপূর্ণ দেখো।’ বহুদিন ধরে মাথার ভেতর বাস করেন এক ছদ্মবেশী সুফী, তিনি মোলায়েম স্বরে বললেন, ‘নফসের জালে যে আটকে যায়, নিয়তি তাকে নফসের রাজ্যেই পাঠায়। তার আর মনসুখিয়ায় যাওয়া হয়না!’ রুবাই আবার বলে,
– ডাইনিং টেবিলে বসো মামা, আমি খাবার গরম করে আনছি।
– না রে মা, খাবো না।
– কেনো!
– আজ আমার খুব রবীন্দ্রনাথ পাচ্ছে, তিনি বলেছেন, ‘ আমি বহু বাসনায় খিচুড়ি যে চাই/ বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে..’
– হিহিহি.. রবি ঠাকুর এমনটা বলেছেন..
– হ্যা, উনি আরও বলেছেন, ‘না চাহিতে মোরে যা করেছ দান/ খিচুড়ি ইলিশ শুটকির গান..
অট্টহাসি চাপার চেষ্টা করতে করতে রুবাই বললো,
– হিহিহি.. তুমি না মামা! .. হিহিহি
ওর চুলে হাত বুলিয়ে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করি,
– এত জরুরী তলব কেনো মা!
রুবাইয়ের কণ্ঠে বিষন্নতা গোপনের ব্যর্থ চেষ্টা,
– জানো মামা, আমি খুব বোকা..
– কে বললো?
– সবাই বলে, আমিও বুঝতে পারি।
– কিভাবে বুঝতে পারিস!
– এটা বোঝা যায়, তুমিও তো জানো আমি বোকা, জানো না!
দীর্ঘশ্বাস গোপন না করেই বললাম,
– মা গো, তুই ভুল জানিস, আমি মোটেও তোকে বোকা বলে মনে করি না।
অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুবাই, এতক্ষণ চোখ ছলছল করছিল, এখন এক ফোঁটা করে অশ্রু চোখের নিচে নেমে এসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় স্থির হয়ে আছে।
কত আর বয়স ওর- এখনো সতেরো অতিক্রম করেনি। এই বয়সে মান-অভিমানগুলো তীব্র হয়, বুঝা-পড়াগুলো হয় আবেগে টইটম্বুর। চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলাম,
– তুই কি আমার কথা বিশ্বাস করছিস না!
– বিশ্বাসও করছি না, অবিশ্বাসও করছি না। বিভ্রান্ত হচ্ছি। বোকারা সবকিছুতে বিভ্রান্ত হয়– তাই না মামা!
কঠিন একটা ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া যায়, তা ঠিক হবে না, চোখের পানি গাল বেয়ে ঠোঁটের কাছে নেমে এসেছে, মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নিলাম,
– শোন, আগে চোখ মুছ, এরপর তোর বিভ্রান্তি কাটাচ্ছি।
বাচ্চাদের মত দুই হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছলো, যেনো কিছুই হয়নি এমন কণ্ঠে বললাম,
– আমার কথা শুনলে তুই’ও আমাকে বোকা বলতে পারিস।
ঠোঁটে হাসির হালকা আভাস এনে বললো,
– আমি কক্ষনও তোমাকে বোকা বলবো না, কক্ষনো না।
নিশ্চিন্ত হবার ভঙ্গিতে বললাম,
– তুই যেহেতু আমাকে বোকা বলবি না, তবে তোকে মন খুলে সব বলা যায়। খুব ভালো করে শুনে রাখ- এই পৃথিবীতে একজনও বোকা মানুষ নেই, একজনও নয়। তবে জাত বেকুব অনেক আছে, এছাড়া প্রতিটি মানুষই জীবনে কখনো না কখনো বেকুবি করে- কেউ কম, কেউ বেশী।
– বোকা আর বেকুব কি এক নয়, মামা?
– মোটেও এক নয়। ধর, একজন জানে আগুনে হাত দিলে পুড়বে, এরপরও সে আগুনে আঙুল বাড়িয়ে দিলো এবং পুড়লো, এটা কিন্তু বোকামীও নয়, বেকুবিও নয়।
– তবে এটা কি?
– এটাকে বলতে পারিস বিশ্বাসের ওপর কৌতূহলের জয়। কিন্তু সে যদি ফের কৌতূহলের বশে আগুনে হাত দেয় তবে সেটা বেকুবি। আবার আগুনে অন্য রকম ঝাপ দেওয়াও আছে।
রুবাই কিছুটা বিভ্রান্ত, পৃথিবীতে অসংখ্য সুন্দর দৃশ্য আছে, প্রবল শোকেরও মাধুর্য মিশ্রিত নিরব সৌন্দর্য আছে, ষোলো সতেরো-আঠারো বছরের কোনো বালিকার ভেজা চুল, কান্নায় ফোলা চোখ, ঠোঁটে হাসির মৃদু আভাস, দৃষ্টিতে বিভ্রান্তি মিলেমিশে এক সুন্দরতম অবয়ব। রুবাইয়ের প্রশ্ন,
– আগুনে অন্য রকম ঝাপ দেওয়া মানে?
– পুড়বে জেনেও কাউকে বাঁচাতে আগুনে ঝাপ দেওয়া, একে তুই বেকুবি মিশ্রিত মহত্ত্ব বলতে পারিস। এখন বল, তুই কি বেকুব!
– নাহ, মামা। তুমি যা বললে তাতে আমাকে বেকুব বলা যায় না, তবে বোকা তো অবশ্যই।
– বেশ কথা তুই বোকা, দুই একটা বোকামির কথা বল তো, মা..
রুবাই বলতে শুরু করলো,
– মানুষকে খুব সহজে বিশ্বাস করি.. আর গভীর ভাবে চিন্তা করতে পারি না.. আমার কথা কাউকে ভালো করে বুঝাতে পারিনা আর..
– আর?
– আর কোনো কিছুই বদলে দিতে পারি না।
– ওহ, এসব! তবে খুব মন দিয়ে শোন..
ওর চেহারায় ফের বিষাদ জমতে শুরু করেছে, আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
– মামা, চা খাবে? চা খেতে খেতে বলো! আমিও খাবো-
– ঠিক আছে, তুই নিজে রান্না করবি। আর চা নিয়ে আসার আগে ভালো করে চোখ ধুয়ে আসবি, তোর চোখে মনে হয় পোকা কামড়াচ্ছে..
রুবাই ‘হিহিহি’ করে হেসে উঠলো,
– তুমি যা বলো না মামা! কান্না পাচ্ছিলো, এখন চোখে পোকার কামড়ের কথা শুনে হাসি পাচ্ছে।
রুবাই চা বানাতে গেল, ওর ঘরটা যত্ম করে গুছানো। টেবিলের ওপর পাঠ্য বই, হুমায়ূন আহমেদ, সমরেশ মজুমদার, সাদাত হোসেন, হ্যারি পটার, টিনটিন জড়াজড়ি করে শেলফে বিশ্রাম নিচ্ছে। উপন্যাসের পাশে জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানের কবিতাসমগ্রসহ আরও ক’জন জনপ্রিয় কবির কবিতার বই। এ বয়সটাই তো কবিতা পাঠের, কবিতা উদযাপনের। ও কি জানে কবিতা পাঠ করতে হয় ক্ষুধার্ত অবস্থায়, শরীরে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে।
অকস্মাৎ মনে হলো- রুবাই কি নিজেকে উপন্যাসের কোনো চরিত্র ভাবতে শুরু করেছে অথবা কবিতার কোনো মানবী- কিছুই অসম্ভব নয়। ওর কষ্টটা কি মনের গভীর থেকে উৎসারিত বা শুধুই কষ্ট বিলাস– চা পান করতে করতেই জানা যাবে।
(অসমাপ্ত)
অবিভাজ্য অণুগল্পটি ভীষণ আগ্রহ নিয়ে পড়ে চলেছি। আমার কাছে অসাধারণ লাগছে। আপনার জন্য একরাশ শুভ কামনা। চলুক …
অনবদ্য প্রকাশ!