অবিভাজ্য/পর্ব-৫ [মনসুখিয়া সিরিজ]

তিন তলার গ্রিল দেওয়া বারান্দায় বসে আছি, রুবাই চা বানিয়ে এনেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস বললাম,
– রুবাই, তুই বোকা বা বেকুব- এ আলোচনা পরে হবে। আগে বল তো কি হয়েছে!

নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে বললো,
– তুমি সত্যিই কিছু জানো না!
– না।
– বাবা আর মা সেপারেট হয়ে যাচ্ছেন।
– বলিস কি!
– হ্যা। গত সপ্তাহে ব্যারিস্টার আংকেল এসেছিলেন। আমার সাথে, রাফির সাথে কথা বলেছেন। রাফি তো ছোট, একবার বাবার কাছে থাকবে একবার মায়ের কাছে- এ ভেবে খুব আনন্দে আছে।

রুবাইয়ের অবস্থা এখন আজকের বৃষ্টির মত, ওর কান্না বাড়ছে কমছে, মাঝে মাঝে থামছেও, কিন্তু চেহারায় মেঘের মত কান্না জমে আছে।

রুবাইকে বলা যায়, বাবা-মার সেপারেশন একটি স্বাভাবিক ঘটনা, এতে কান্নাকাটি করার কিছু নেই। দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক ও প্রাপ্ত মনষ্ক মানুষ সিপারেশনের সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। নিজের পিঠ চাপড়ে নিজেকে বলতে পারে ‘যা সিমরান যা, জি লে আপ্নি জিন্দেগি’। তাদের এ সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, সেপারেশন বিষয়টা এতই সরল! দু’জন মানুষের মধ্যে নৈকট্য গাঢ় হতে যেমন সময় দরকার হয়, তেমন দূরত্ব তৈরী হতেও সময়ের প্রয়োজন। ইচ্ছাতে হোক বা অনিচ্ছাতে, দীর্ঘ দিনের সংসার যাপনে একে অন্যের অংশে পরিণত হয়।

পুরুষ এলবাট্রস তরুণ বয়সে সাড়া না পাওয়া পর্যন্ত একাধিক নারীকে প্রেম নিবেদন করে, কিন্তু জোড় বাধার পর আর বিচ্ছিন্ন হয় না, একে অপরের অংশ ও অংশীদার হয়ে ওঠে। সঙ্গী মারা গেলে একা একাই কাটিয়ে দেয় বাকীটা জীবন। মানুষ মহান ও মানবিক, মানুষ বিবেচক ও বুদ্ধিমান, মানুষ এলবাট্রস নয়। মানুষের নৈকট্যের সম্পর্কেই থাকে ফাঁক ও ফাঁকি, সুপ্ত থাকে বিচ্ছেদবৃক্ষের বীজ!

রুবাইয়ের বাবা-মা’র সেপারেশনের কথা শুনে ভীষণ অপ্রস্তুত হলাম, জিজ্ঞেস করলাম,
– তোর বাবা-মা’র সিদ্ধান্ত কি চূড়ান্ত?
– হ্যা। আমি অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু তাদের বুঝাতে পারিনি। তারা আমাকে ভুল বুঝেছে, আমার ওপর রাগ করেছে, বকেছেও।
– তোর বাবা-মা সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিলো কেনো?
– তাদের না কি এডজাস্ট হচ্ছে না।
– এতদিন পর এডজাস্টমেন্টের সমস্যা!

সংসার মানেই স্যাক্রিফাইস আর কম্প্রোমাইজের সিম্ফোনি, পরস্পরের স্পেসে পরস্পরকে সুষম স্পেস বন্টনের শিল্প। রুবাইয়ের বাবা-মার বিশ বছরের সুখের সংসার, সাত হাজার তিন’শ দিন একসাথে কাটানোর পর, পরস্পরের শ্বাসের ঘ্রাণ পর্যন্ত মুখস্থ হয়ে যাবার পর এডজাস্টমেন্টে সমস্যা!

মানুষ সঙ্গী হিসেবে বেটার হাফকে কামনা করে না, কামনা করে ‘পারফেক্ট ওয়ান’কে। পারফেক্ট ওয়ানকে খুঁজতে গিয়ে ‘বেটার ওয়ান’কে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করে। কেউ কেউ এক বেটার ওয়ান হতে আরেক বেটার ওয়ানে আশ্রয় নেয়, তারপর আবার আরেক নতুন বেটার ওয়ান। এই চক্রে যোগ দেওয়ার পরিস্থিতি আপা-দুলাভায়ের নেই। রুবাই বড় হয়েছে, রাফিও ছোট নয়- এখন শুধু দু’জনের টোনাটুনির সংসার নয়। সেপারেশনের পক্ষে বিপক্ষে রুবাই-রাফির মতামতও গুরুত্বপূর্ণ।

ভাবনায় ছেদ পরে, রুবাইয়ের কণ্ঠে কাতরতা,
– মামা, তুমি একটা কিছু করো।
– আমার কিছু করার নেই। বেকুবদের বুঝানো যায়, কিন্তু জ্ঞানী বেকুবদের বোঝায় এমন সাধ্য কারো নেই। ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে তোর বাবা মা’র এখন মেধা বেশী বুদ্ধি কম অবস্থা, এদের কে বুঝাবে বল!
– তবুও মামা কিছু একটা কি করা যায় না! তুমি কি করতে পারো না! আমার সুসাইড করতে ইচ্ছে করছে।

রুবাইয়ের চোখে তাকালাম, পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে বাবা-মা’র অফুরন্ত আদরে বড় হয়েছে। বাবা মা আলাদা থাকবেন, নিয়ম মেনে ক’দিন মা’র সাথে আর ক’দিন বাবার সাথে থাকতে হবে- এটা মেনে নিতে পারছে না। বাবা-মা ওর কাছে অবিচ্ছেদ্য অবিভক্ত সত্বা, ওর পক্ষে এমন বিভাজন মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

সবচে বড় কথা বাবার পাশে একজন নতুন মা অথবা মায়ের পাশে একজন নতুন বাবার কথা ভেবেই কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। জেলা শহরের মফস্বলীয় পারিবারিক বন্ধন আর সামাজিক সংস্কৃতি এখনও এসব সহজে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। রুবাইকে বললাম,
– সুসাইড করে কোনো লাভ হবে না। শুধু তুই মরে যাবি। ভুত হয়ে বাবা-মা’কে ভয়ও দেখাতে পারবি না, যে ভীতু তুই। তবে তুই একটা ঝুঁকি নিতে পারিস।
– কি ঝুঁকি মামা!
– কাল রাতে সাদা কাগজে লিখবি ‘প্রিয় বাবা ও মা, তোমাদের সেপারেশনের আগে আমিই সেপারেটেড হয়ে গেলাম।’ তারপর পরশু ভোরে বিছানার ওপর চিঠিটা চাপা দিয়ে মোড়ে চলে আসবি। নানু আর মামার সাথে তুই কক্সবাজারে বেড়াতে যাবি।

রুবাই এডভেঞ্চারের ঘ্রাণ পেয়েছে,
– নানু তো আম্মুকে জানিয়ে দিবে!
– তুই নানুকে কিছু বলিস না, আমিও বলবো না। যাওয়ার দিন তোকে তুলে নিলে নানু জানবে। তখন সব খুলে বলা যাবে।
– আচ্ছা মামা, কাপড় তো নিবো।
– না রে মা, তবে ধরা পরে যাবি। প্ল্যান ভেস্তে যাবে।

রুবাই কি ভাবছে বুঝা গেলো না, শান্ত স্বরে বললো,
– এতে কাজ হবে?
– হতেও পারে, না’ও হতে পারে। তুই তো ক’টা দিন আনন্দে কাটাতে পারবি, ওটাই কম কি!
– মামা, আরেক কাপ চা খাবে?
– দে, সাথে একটা নাপা দিস তো মা।
– জ্বর আসছে আবার!
– হুম, মাথা ব্যাথাও বাড়ছে।

বারান্দায় বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। রুবাই বিষণ্ন দৃষ্টিতে ইলেক্ট্রিকের তারের দিকে তাকিয়ে আছে। ভিজে জবুথবু তিনটা কাক তারে বসে আছে, বৃষ্টির এই মন হুহু করা বিকেলে ওদের আর কোথাও যাওয়ার নেই।

(অসমাপ্ত)

2 thoughts on “অবিভাজ্য/পর্ব-৫ [মনসুখিয়া সিরিজ]

  1. মনসুখিয়া সিরিজ এর এই পর্বেও মুগ্ধপাঠ। শুভকামনা মি. আবু সাঈদ আহমেদ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।