অবিভাজ্য |পর্ব ৬-৭| মনসুখিয়া সিরিজ

৬.
মেরিন ড্রাইভ, এক্সোটিক সাম্পান হোটেলের চার তলা, বারান্দায় তিন জন বসে আছি। সি ভিউ বারান্দা, অনেক দূর পর্যন্ত সমুদ্র দেখা যায়, খুব দূর থেকে ছোট ছোট ঢেউ একের সাথে এক যোগ হতে হতে ধেয়ে আসছে, সাদা ফেনা নিয়ে আছড়ে পড়ছে তটে, আবার ফিরে যাচ্ছে।

মা বললেন,
– এভাবে রুবাইকে আনা কি ঠিক হলো! আমিও তো এতকিছু জানতাম না।
– সব কিছু ঠিক হতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই, মা। তবে শাফাকাতের কাছে একটা চিঠি দিয়ে এসেছি, আজ আপাকে পৌছে দিবে।
– চিঠিতে কি লিখেছো?
– বেশি কিছু নয়।

পকেট থেকে ডুপ্লিকেট কপি বের করে মা’কে দিলাম, চিঠিতে লেখা আছে-

প্রিয় আপা,
সালাম নিও।
জানি তুমি আর দুলাভাই হন্যে হয়ে রুবাইকে খুঁজছো। থানা থেকে পীর-ফকিরের বাড়ি কিছুই বাদ রাখনি। রুবাই ছোট থাকতে সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিলেই পারতে, এখন রুবাই আর রাফির মতামত ছাড়া সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিতে পারো কি না- নিজেদের প্রশ্ন কোরো। এই যে দু’জনে একসাথে রুবাইকে খুঁজছো, একে অপরকে সামলাচ্ছো, হাত ধরে কাঁদছো- এডজাস্টমেন্টের কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো!

চিন্তা কোরো না, রুবাই ভালো আছে।
ইতি
রুবাইয়ের মামা
এক্সোটিক সাম্পান, কক্সবাজার।

রুবাই জানতে চাইলো,
– এ চিঠি পড়ে বাবা-মা কি সিদ্ধান্ত বদলাবেন?
– জানিনা রে মা। তবে বিপদ মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায়, পরস্পরকে নতুন করে চিনতে শেখায়। বিপন্নতায় আর সঙ্কটে মানুষের পারস্পরিক দূরত্ব কমে আসে। তাই আশা করতে পারিস- হয়তো কাল সকালেই দেখবি তোর বাবা-মা কক্সবাজারে চলে এসেছেন।

রুবাই বিশ্বাস করতে পারছে না,
– যদি না আসে?
– তবে আর কি, তোকে নিয়ে মনসুখিয়ায় চলে যাবো।
– মনসুখিয়াটা আবার কোথায়?
– মনসুখিয়া আছে মনসুখিয়ায়। যাবার হলে তোকে জানাবো।

মা পান চিবুচ্ছেন। রুবাই নানুর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। সমুদ্রে সন্ধ্যা নামছে, বারান্দা থেকে ঢেউয়ের গড়ে ওঠা আর ভেঙে পড়া দেখছি, ফেনিল স্রোতের আছড়ে পড়া আর ফিরে যাওয়া দেখছি। ভিকারুননিসা একদিন গুনগুনিয়ে গেয়েছিলো ‘আমি মন ভেজাবো ঢেউয়ের মেলায় /তোমার হাতটি ধরে।’ তারপর সমুদ্র দেখার কত যে ছেলেমানুষী পরিকল্পনা, দু’জনে হাত ধরে সারারাত সৈকতে বসে চন্দ্রযাপনের স্বপ্ন। সমুদ্রে সে আসে কি না জানা নেই, বহু আগেই সে নটর ডেমের কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছে হাত।

৭.
আপাকে দেওয়া চিঠির খামে গ্রিন লাইনের তিনটা টিকিটও ছিলো। আজ সকালেই রাফিকে নিয়ে আপা আর দুলাভাই এক্সোটিক সাম্পানে উপস্থিত হয়েছেন।

রুবাইয়ের মুখোমুখি হতেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বাবা-মা’র সে কি কান্না। আপা এক ফাঁকে উঠে এসে আমার দু’গালে চড় কষিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন।

এসব কান্না সংক্রামক, তাই ‘কাজ আছে’ অজুহাতে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। ছোট ট্রাভেল ব্যাগটা আগেই রিসেপশনে রেখে এসেছি, এখন নিরবে প্রস্থানের পালা।

মেরিন ড্রাইভ ধরে অটো ছুটছে। পথ ফিসফিসিয়ে বলে, ওগো মানুষ, আজও তোমাকে মনসুখিয়া ডাকেনি! একটা মাত্র মানুষ জীবন, ফুরিয়ে যাচ্ছে, মনসুখিয়া কি জানেনি!

পথের কানে কানে বলি, চাঁদের আলো আমাকে অসংখ্যবার খুন করেছে, রোদও খুন করেছে। এই ঢেউ, নোনা হাওয়া, সাদা ফেনাও বারবার ছিন্নবিচ্ছিন্ন করেছে, এমন কি তুমিও খুন করেছো। জানো পথ, মৃত্যুর প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু যেদিন মনসুখিয়া আমায় খুন করলো, সেদিন জানলাম খুন হওয়াই বেঁচে থাকা। মনসুখিয়া যদি একবার ডাকে, চিরদিনের জন্য খুন করে, ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে উড়িয়ে দেয় হাওয়ায় হাওয়ায় তবে বেঁচে যাই।

পথ সুধায়,
– মনসুখিয়া জানে?
– মনসুখিয়া সব জানে, তবু ডাকে না, তার নিরবতা জুড়ে অভিমান খেলা করে।
পথ আবার ফিসফিসিয়ে জানতে চায়,
– মানুষ, যাচ্ছো কোথাও!
পথের কানে কানে বলি,
– আমার সকল যাওয়াই মনসুখিয়ার দিকে যাওয়া।
– আমাকেও সঙ্গে নিও, নিবে তো!

এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না, হাতের ডানপাশে সবুজ পাহাড়ের সারি, বায়ে মুখর সমুদ্র। পথকে বলি,
– ওগো পথ, যদি মনসুখিয়া ডাকার আগেই হারিয়ে যাই, যদি সকল দিন ফুরোয় আমার
তবে মনসুখিয়াকে বোলো, তার ডাক শুনবার অপেক্ষায় থেকে থেকে যে পথ হয়ে গেছে, সে’ই আমি।

(শেষ)

1 thought on “অবিভাজ্য |পর্ব ৬-৭| মনসুখিয়া সিরিজ

  1. একটি সফল অণুগল্পের পরিসমাপ্তি। অশেষ শুভ কামনা স্যার। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।