জলে ভাসা পদ্ম আমি

246710

সামিয়া রেখার সেই স্কুল জীবন থেকে সব সুখ দু:খের অংশীদার। এবার সে বেশ অনেকদিন পর এসেছে।
ছুটির দিনের সকালটা নানা রকম রান্নায় ব্যস্ত থাকল রেখা। সামিয়া কাজে হাত লাগাল। দুপুর দুটোর মধ্যে টেবিল ভরে গেল নানান রং, সুগন্ধ আর স্বাদে। আজ মিনার মাহমুদ কোন এক সংবর্ধনায় গেছেন। বান্ধবীকে পেয়ে রেখা বাসায় থেকে গেছে।

দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় আধশোয়া হয়ে পাশাপাশি বসে অলস আলাপে মন দিলো দুই বান্ধবী।

গল্পের ফাঁকে ফাঁকে বান্ধবীর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল সামিয়া। একটু দ্বিধা নিয়ে শেষে এক সময় বলল, ‘কয়েকদিন আগে এক মহিলা আমার কাছে এসেছিল একটা নতুন বাচ্চা নিয়ে। বাচ্চাটা ওর দরজায় কে যেন রেখে গেছে। ফুটফুটে মেয়েটা। একটু দুর্বল। চোখগুলি বড় বড়। অনেক পাপড়ি। ফর্সা। আমার কাছে আছে। সপ্তাহখানেক হল। আমার ছেলেরা ওকে পেয়ে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।’

রেখার মুখটা সাদাটে হয়ে গেল। চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর আস্তে বলল, ‘মিনার যদি কষ্ট পায়?’

সামিয়া বান্ধবীকে একটু সময় দিল। তারপর সমস্যার ভিতরটা দেখাল বান্ধবীকে।

‘এভাবে থাকলে খারাপ লাগাটা সারাক্ষণ থেকে যাবে। উনার স্বাস্থ্য দেখলাম অনেক খারাপ হয়ে গেছে। তোকেও দুর্বল দেখাচ্ছে। একবার ফেইস করে ফেল। নেহায়েত রিয়্যাক্ট করলে জোর করার কিছু নাই। আমার তো মেয়ে নাই। আমি রেখে দেব।’

সেই রাতটা রেখা ঘুমাতে পারল না। স্বামীকেও কিছু বলতে পারল না।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা ছাড়ার আগে স্বামীর মুখের দিকে তাকাল। জানালা দিয়ে আসা আলো ফ্লোরে পড়ে সারা ঘর আলো হয়ে আছে। মানুষটার ফর্সা মুখটা বাচ্চা ছেলের মুখের মত মায়াভরা। সে অপলক তাকিয়ে রইল।

নিষ্পাপ মুখটার চোখের নিচে কালি দেখে রেখার মনে আবেগ ভরা নদীর বান জাগাল। যে কোন অবস্থায় সে তার স্বামীর সাথে থাকতে চায়। তাকে সুখী দেখতে চায়। আর কাউকে সে তার মানুষের ভাগ দিতে পারবে না। কিছুতেই তাকে ফেলে যেতেও পারবে না। আর কারো সাথে জীবন কাটানোর চিন্তাও সে করতে পারে না।

এত বছরের সঙ্গী! পরম মমতায় দুই হাতে স্বামীর মুখটা বুকে নিয়ে বসে থাকে। সকালের আলোয় রেখার মুখ উজ্জ্বল। সে সিদ্ধান্ত নেয়, বাচ্চাটার কথা স্বামীকে বলবে। ঘুম ভেঙ্গে রেখার আদরটুকু লেখককে বিয়ের সেই প্রথম সময়টাতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়..।

নাশতার টেবিলে স্ত্রীর মুখে বাচ্চাটার কথা শুনে মিনার মাহমুদ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সকালটা মনে পড়ল। ব্যথা আর শান্তি একসাথে অনুভব করলেন।

মন দিয়ে অনুভব করলেন স্ত্রীর মনে সন্তান না পাওয়ার গভীর বেদনা। আবিষ্কার করলেন, সন্তানের জন্য প্রকৃতি তার স্ত্রীর মনে যে অফুরন্ত ভালোবাসা দিয়েছে তা অবলম্বন না পেয়ে লেখককেই আঁকড়ে লতিয়ে উঠেছে!

নতুন বাচ্চাটা এলে তার সেই আদর ভাগাভাগি হবে জেনেও তিনি সস্নেহে স্ত্রীর ইচ্ছায় সম্মতি দিলেন।
অলক্ষ্যে লতার মুখটা কি লেখকের মনে ভেসে উঠল? চিনচিনে একটা ব্যথা?

নাশতা শেষে লেখক ঘর থেকে বের হবার আগে স্ত্রীর মুখ ছুঁয়ে আদর করে হাসলেন, ‘নতুন মানুষ পেয়ে আমাকে ভুলে যাবে নাতো?’

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

2 thoughts on “জলে ভাসা পদ্ম আমি

  1. খুবই পরিচিত এ যেন আমাদের জীবনেরই যাপিত সময়ের অণুগল্প। লিখকের লিখন ভাবশীলতায় একদম আপন আপন লাগলো। অভিনন্দন প্রিয় মামুন। শুভ কামনা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।