(শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে একটি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ ষষ্ঠ পর্ব।)
পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী জুটি ইস্কান্দার মির্জা ও লিয়াকত আলি খানের শাসনকাল ছিল গণতান্ত্রিক। যদিও রাষ্ট্রের ঘোষিত নাম ছিল ইসলামিক স্টেট অব পাকিস্তান। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত এক অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে যেতে হয়েছিল। এই সময়ে ছয় জন প্রধানমন্ত্রী পদ পেয়েছেন এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে অপসৃত হয়েছেন।
গণতন্ত্রের এই দুরবস্থা সৃষ্টির জন্য আপাতদৃষ্টিতে সেখানকার ভঙ্গুর শাসনকাঠামো কে দায়ী করা হলেও আসলে এর পেছনে ছিল আমেরিকার আগ্রাসনের ইচ্ছা। পাকিস্তানে গণতন্ত্র কায়েম থাকলে সেখানকার সিস্টেম কে দিয়ে নিজের স্বার্থে কাজ করানো সম্ভব নয় জেনেই ১৯৫৮ তে জেনারেল আইয়ুব খান কে দিয়ে ক্যু ঘটিয়ে শাসনযন্ত্র দখল করানো হলো।
কিন্তু মিলিটারি স্বৈরশাসনের ওপরে ভরসা রাখলেও সেখানে মৌলবাদকে কাজে লাগানোর প্রয়োজন তখনো পড়েনি। ধর্মপালন সব দেশেই সাধারণ মানুষের এক অবশ্য পালনীয় কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে এই ধারণা সেই প্রাচীন কাল থেকেই মনের মধ্যে বাসা বেঁধে আছে। কিন্তু ধর্মপ্রচারকরা সব ধর্মেই কখনো হানাহানির কথা বলেননি। সর্বদাই শান্তির কথা, পবিত্রতার কথা, সৌহার্দ্যের কথা বলেছেন। অথচ সেই মহাপুরুষদের বাণী বিকৃত করে একদল কুচক্রী সেই সময়েই সক্রিয় হচ্ছিল ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে। কিন্তু রাষ্ট্র তখনো তাদের কাজে লাগায়নি।
আইয়ুবের দেখানো রাস্তা ধরেই ক্ষমতায় এলেন ইয়াহিয়া খান – জুলফিকার আলি ভুট্টো জুটি। আর ক্ষমতায় এসেই উপনিবেশ পূর্বের ওপরে শোষনের মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন তাঁরা। এদিকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দুনিয়া জুড়ে প্রতিবাদের সামনে সংসদ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু চালে একটু ভুল হয়ে গেল।
আয়তন অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের সাংসদ সংখ্যা যে নীতিনির্ধারক হয়ে উঠতে পারে এই গণনা সম্ভবত স্বৈরশাসকরা করেন নি। দেশের দুই অঞ্চলেই তখন পাকিস্তান মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কুশাসনের জন্য জমেছে ব্যাপক ক্ষোভ। তরতর করে বাড়ছে আওয়ামী লিগের জনপ্রিয়তা। মুসলিম লীগের বিরোধী সব দলই তখন গ্রহণযোগ্য। আর এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির মধ্যেই হলো নির্বাচন।
হরেকরকম দুর্নীতির আশ্রয় নিলেও শেষরক্ষা হলোনা। ক্ষমতা হস্তান্তর অবশ্যম্ভাবী জেনে সক্রিয় হয়ে উঠলো গণতন্ত্র বিরোধী সবকটি অশুভ শক্তি। যেনতেনপ্রকারে নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক সাংসদপদ বিজয়ী আওয়ামী লিগ এবং বিরোধী জোটকে ক্ষমতায় আসা আটকাতে তড়িঘড়ি কারারুদ্ধ করা হলো শেখ মুজিবর রহমান সহ প্রথম সারির নেতাদের। আলোচনার সব প্রয়াস ভেস্তে দেওয়া হলো ইচ্ছাকৃত ভাবে। পূর্বের উপনিবেশে পাকিস্তানের যেসব এজেন্সি তাদের স্বার্থরক্ষায় নিযুক্ত ছিলো, যেমন আলবদর, রাজাকার ইত্যাদি এই সংগঠনগুলোর শক্তিবর্ধন করে দেশব্যাপী বিক্ষোভ প্রতিরোধের কাজে সামিল করা হল। আর নামানো হল সেনাবাহিনী। ঠিক সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে পাকিস্তান মৌলানা ভাসানী সহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের চেষ্টা করেও গ্রেপ্তার করতে পারে নি। ভাসানী ভারতে পালিয়ে এসে জনমত ও রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলেন।
একদিকে পূর্ব পাকিস্তানের পিষ্ট বাঙালি হাতে তুলে নিচ্ছিল রাইফেল অন্যদিকে কূটনৈতিক দৌত্য চালিয়ে পূর্বের অংশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্তা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়ে গেল। মজার ব্যাপার এই ভীষণ দুর্দিনে কোনো পীড়িত মানুষের মনে ধর্মের নামে অধর্মের বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবনা উঁকি দিতে পারেনি কারণ সেই সময়ে লড়াইয়ের মুখ্য চরিত্রে যাঁরা ছিলেন তাঁরা কেউ মৌলবাদী ছিলেন না।
(আবার কাল)
মৌলানা ভাসানী সহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের চেষ্টা করেও গ্রেপ্তার করতে পারে নি। ভাসানী ভারতে পালিয়ে এসে জনমত ও রাজনৈতিক সমর্থন আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলেন।
একদিকে পূর্ব পাকিস্তানের পিষ্ট বাঙালি হাতে তুলে নিচ্ছিল রাইফেল অন্যদিকে কূটনৈতিক দৌত্য চালিয়ে পূর্বের অংশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্তা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়ে গেল।