শান্তির সংসার

28321 শান্তির সংসারে শান্তি হল আকাশের বিজলির মতোন। এই আছে এই নেই। তবুও শান্তির মনে তেমন একটা অশান্তি নেই। ছিলোও না। সে তার স্বামী নাদিমকে খুব ভালোভাবে চিনে। লোকটা মানুষ হিসাবে একেবারে মন্দ না। মনের মধ্যে কোনো জিলাপির প্যাচ নেই। ভোঁতা দা এর মতোন রাগ নেই বললেই চলে। কিন্তু কোনো কারণে হঠাৎ যদি রাগ উঠে তাহলে আর রক্ষা নেই। শান্তিকে পিটিয়ে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে মক্কা পাঠানোর যোগাড় হয়। এখন পর্যন্ত নাদিমের পিটানোতে শান্তির তিন তিনবার হাসপাতাল বাসের সৌভাগ্য হয়েছে। একবার তো একহাত এবং একপায়ের হাড্ডি ভেঙেই গিয়েছিল। সেই থেকে প্লাস্টার করানোর কতটা জ্বালা সে বেশ ভালোই বুঝে। তবুও শান্তি নাদিমের উপর ডোমিনেট করতে ছাড়ে না। অবশ্য অনেকেই তখন নাদিমের সংসার ছাড়ার জন্য শান্তিকে সুপারিশ করেছিল। শান্তি সেসব কানে নেয়নি। শান্তি বরং গর্ব ভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে প্রতিবেশী করিমনকে বলেছিল, তোরা শুধু হের ( নাদিমের) মাইরটা চোখে দেখলি; কিন্তু মাইরের পরে যে শিশুর মতোন হাউমাউ কইরা কাঁদে, আমার দুই পা ধইরা একশ একবার মাফ চায়… সেসব দেখলি না। মাইরের সময় তোরা দশ চোখ বাইর কইরা দেহস, আর অন্যসময় চোখের মধ্যে কালা গামছা প্যাচাইয়া রাহস।

শান্তির স্বামী বেচারা নাদিম ট্রাকের হেলপার। বলা যায়, সেও ট্রাকের মতোই বেপরোয়া। শীত নেই, গ্রীষ্ম নেই সারাদিনই খালি গায়ে থাকে। প্যান্ট পরে না, লুংগি পরে না। একটা হাফপ্যান্টেই দিবারাত্রি ২৪ ঘন্টা চলে। চলতে থাকে। একবার শান্তি নাদিমের জন্য রোজার ঈদে একটা টিশার্ট কিনে এনেছিল। সেকি ভুতুড়ে কাণ্ড! সেই টিশার্ট পরার পর নাদিমের সারাশরীরে বেশুমার চুলকানি। চুলকাতে চুলকাতে দফারফা। তবুও চুলকানি আর থামে না। সেই সুযোগে শান্তিও নাদিমের শরীরে নখের আঁচড় বসিয়ে মাইরের প্রতিশোধ নেয়। কিছুক্ষণ পরে আবার আফসোসও করে। মনে মনে ভাবে, “কাজটা আমি ভালা করি নাই। তওবা… তওবা… । আর কোনোদিন এমন করুম না।”

সেই শান্তি আর নাদিমের বিয়ের আজ তের বছর। শুভ হোক আর অশুভ হোক বিবাহবার্ষিকী বটে! নাদিমের মনে আছে কিনা.. কে জানে, তবে শান্তির ঠিক ঠিক মনে আছে। প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে শান্তি নাদিমকে একটা ঘুষি দিয়েছিলো। আর আজ দিবে তেরটা ঘুষি! বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের এই অভিনব পন্থাটা প্রথম দিন বুঝতে না পারলেও এখন নাদিম মনে মনে প্রস্তুত থাকে। তবে শান্তিকে বুঝতে দেয় না। এই তেরটা বছর বড় কম সময় নয়। যদিও মহাকালের হিসেবে এর কোনো ধর্তব্য নেই। সময় নিজেও একটা চোরা ফাঁদ। একেকজনের কাছে একেকরকম। সুখের সময়গুলো তাড়াতাড়ি যায় আর অ-সুখের সময়গুলো যায় না। যেতে চায় না। এ যেন নাদিমের কুচকুচে কালো শরীরের মতোন। শান্তি যতই ঘষামাজা করে, ততই কালো বের হয়। ফর্সা হয় না। অবশ্য বিবাহের প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন আর শান্তির খারাপ লাগে না। শান্তি জানে, এই কালো মুখই কালো ভ্রমরের মতোন…ওতেই তার বাঁচা… ওতেই তার মরা।

এখন রাত এগারোটা একত্রিশ মিনিট। আর মাত্র ঊনত্রিশ মিনিট পরেই নাদিম-শান্তির তেরতম শুভ বিবাহবার্ষিকী। এই উপলক্ষে শান্তি মাছ, মাংস, মশলা, তেল এসব কিনতে বাজারে গিয়েছিলো। এই একটা দিন অন্তত ভালো খাবার খাওয়া চাই৷ নাদিম অত্যন্ত ভোজনরসিক মানুষ। কিন্তু সাধ্য আর সাধ্যের মধ্যে কেবল গড়মিল। নইলে যে সব খাবার বড়লোকেরা প্রতিদিন খায়… নাদিম-শান্তিও সেসব খাইত। কিছুমাত্র কমতি রাখতো না। আজ বাজারে এসে জিনিসপত্রের দশ তলা উঁচু বিল্ডিং এর মতোন চড়া দাম দেখে শান্তির শরীর ঘামছিল। এখন সে বুঝতে পারছে.. নাদিমকে কিছু একটা কিনে আনতে বললে কেন সে এতো ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে, কোচর-মোচড় করে..। নাদিমের অসহায় মুখের মানচিত্রটা চোখের সামনে ভাসতেই সে দুই চোখ বন্ধ করে দিল। তবুও নাদিমকে চোখের তারা থেকে সরাতে পারলো না। সে কৃষ্ণগহবরের মতো আরও বড় হতে লাগলো। আরও বড়…!

এই যখন শান্তির অবস্থা, ঠিক তখনই দরজায় ঠাস ঠাস করে তিনবার আওয়াজ হল। এই দিগম্বর আওয়াজ শান্তির খুব পরিচিত। নাদিম এসেছে। বাসর ঘরের মতো শান্তির সারা শরীর ঠক ঠক করে কাঁপছে। এই কাঁপা-কাঁপির কোনো মানে শান্তি খুঁজে পেল না। যার সাথে সুখে-দুখে তেরটা বছর… তার এই সামান্য শব্দে এইরকম অযাচিত কাঁপার কোনো মানেই হয় না। শান্তি মনে মনে লজ্জার লাগাম টানতে লাগলো। পারলো না। তবুও সাথে সাথেই দরজা খুলে দিল। কী আচানক ব্যাপার! নাদিমের হাতে মাঝারি সাইজের একটা গিফট বক্স। রেপিং পেপার দিয়ে সুন্দরভাবে মোড়ানো। নাদিমের মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে সাথে সাথেই শান্তি চোখ নামিয়ে নিলো। কালো মুখটি আরও কালো লাগছে। তার সাথে ভর করে আছে কয়েক বস্তা বিষন্নতা, হতাশা আর গ্লানি। শান্তি কিছু একটা বলার জন্য আঁকুপাঁকু করছে। কিন্তু সাহস পেল না। নাদিমও কিছু বলল না। গিফট বক্সটি শান্তির হাতে দিয়ে ধড়াম করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। রাত তখন ঠিক বারোটা বেজে এক মিনিট। শান্তি আকাশ-পাতাল করতে করতে গিফট বক্সটি খুলেই চমকে উঠল। একটা পুতুল। যেন সদ্য জন্ম নেওয়া ফুটফুটে একটি মেয়ে। মুহুর্তেই শান্তির ধবধবে ফর্সা মুখটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে গেল। সে অন্ধকারের সাথে মিশে আছে শান্তির নারী জন্মের আজন্ম হাহাকার। এই তেরো বছরেও নাদিমকে একটি সন্তান উপহার দিতে না পারার হাহাকার….!

শুভ হউক শান্তি ও নাদিমের আগামী বিবাহবার্ষিকী।।

1 thought on “শান্তির সংসার

  1. সুন্দর অণুগল্প উপহার। অভিনন্দন রইলো তাদের জন্য। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।