সাত
সকাল থেকে এই নিয়ে চার নম্বর ভিখারি। পেট ডুগ্রে গলা সরু একটা ন্যাংটো বাচ্চা কোলে তার মা এসে দাঁড়িয়েছে। বাচ্চাটার দু’নাক দিয়ে মোটা হলদে সিক্নি। মাঝেমাঝে নাক টানলে বেরিয়ে পড়ছে সিক্নির নীচে দুটো লম্বা লাল ঘায়ের দাগ।
প্রতিবার রান্নার চাল নেওয়ার পর হাঁড়ি থেকে যে ছোট দুই মুঠ তুলে একটা কলসিতে রাখা হয়, সেখান থেকে রেকাবিতে চাল নিয়ে ছোড়দা ঢেলে দিল বৌয়ের পেতে ধরা গায়ের কাপড়ে। চালসমেত শাড়ির অংশ কোমরে গুঁজে নিল সে। তখন মনে হল, কোলের মতো তার পেটেও এক সন্তান।
অন্ধ সেজে আসে অনেকে, ভিক্ষে নিয়েই দে হনহন ক’রে হাঁটা; অনেকের হাতটান খুব, এদিক-সেদিক গেছ কি রান্নাঘরের দাওয়া থেকে বাচ্চার তেলমাখার বাটি নয়ত উঠোনে ছেড়ে রাখা হাওয়াই চটি নিয়ে গায়েব হয়ে যাবে। এমন তাদের মরিয়া সাহস, চার-পাঁচ দিন পরে আবার তোমার বাড়ি, আর ভুলুক-ভালুক তাকাচ্ছে, যদি আরও কিছু গ্যাঁড়ানো যায়।
তবু কোনওভাবে দেশ থেকে দেশে লাখ লাখ মানুষের এই মহাঅভিসরণ, তাদের ক্ষিদে, তাদের মাঙনের হাত-পাতা আর অপমানিত হওয়ার পাঠক্রমকে লঘু করা যাবে না। খালি পায়ে বাদাবন পার হয়ে, রেল লাইন টপকে, দিনে কচুরিপানা-ভর্তি পুকুরে গলা পর্যন্ত ডুবে থেকে রাতে গ্রামের পর গ্রামের ঘুম না ভাঙিয়ে পোয়াতি বউ, দুধের শিশু বা অশক্ত বাবাকে আঁকড়ে এই নিঃশব্দ স্থানান্তর! তারপর অনেকের চুপচাপ মরতে থাকা… রাতে ঘুমের মধ্যে যেমন শিউলি ঝ’রে পড়ে আর সকালে উঠে এক একটা বুক-কাঁপানো “বলো হরি, হরিবোল”, কাঁচা বাঁশের চালির ওপর শুয়ে কেউ চলে যাচ্ছে শুঁটি নদীর গায়ে জুবলিঘাটা শ্মশানের দিকে। উদ্বাস্তু জীবনের মতো শুকিয়ে গেছে সেই সুবর্ণবতীও, যেখানে এক সময় চাঁদ সদাগরের ডিঙা ভাসত। অন্যদিকে দুটো চাল, একবাটি ফ্যান বা একটা তামার পয়সার জন্যে কলোনি জুড়ে বিষণ্ণ পদক্ষেপ। ভিখারি এসেছে ভিখারির কাছে ভিক্ষে চাইতে!
চতুর্থ কাঙাল স’রে গেছে কি যায়নি, একটা রব উঠল কলোনির বাঁ হাতে মান্নাপাড়ার দিক থেকে। ওমনি বড় রাস্তার দুপাশে বাড়িগুলো পিটি করার মতো “সাবধান”। মুহূর্তের মধ্যে এক পাল শুয়োরের কালো প্রবাহ এসে পড়ল রাস্তায়। ঘোঁত ঘোঁত শব্দে কান ভ’রে উঠছে, বানের জলের মতো এপাশ-ওপাশের বাড়িতে ঢুকে পড়ছে দু’চারটে, তখন পালের পেছনে যে দুজন রাখাল, তারা মুখে চুঃ চুঃ ক’রে লাঠির প্রহারে তাদের তুলে আনছে রাস্তায়।
ঢেউটা এগিয়ে আসতেই চাঁদের বাড়ির দুদিকের দুই কচুবাগানে “শুয়োরে চেনে কচু” প্রবাদ মনে রেখে বরাহদল আক্রমণ শানাল। ওমনি কলোনির মেয়েরা অভিশাপ দিতে শুরু পশুর পালকে, আর ছেলেরা তেড়ে গেল তাদের পরিচালকদের দিকে। এই কচুবনদুটো কলোনির বেশ কয়েকটা বাড়ির খাদ্যভাণ্ডার — কচুপাতাবাটা, নুন-লংকা মাখা কচুভাতে, কচুর সব্জি দেওয়া ডাল অথবা অল্প সরষের তেল খরচ করতে পারলে কচুর লতির বাটিচচ্চড়ি। আবার, বাড়িতে মূল্যবান অতিথি এসেছে তো সদ্য-গজানো অর্ধেক মোড়া কচুপাতার মধ্যে ডালের পুর দিয়ে ভেজে এক উচ্চপর্যায়ের ঝোল-তরকারি হতে পারে। বাজার করার পয়সা না থাকলেও ঘরে বসে তুমি চার-পাঁচটা রান্নার পদ পেয়ে যাচ্ছ।
কাদাজমিতে ঢুকে জানোয়ারগুলো পড়পড় ক’রে কচুগাছের গোড়া ওপড়াতে শুরু করেছে, এদিকে বাতাসে শিস কেটে লাঠির বাড়ি পড়ছে পিঠে, গোঙাচ্ছে তারা। কষ্টে ঘেমে যাচ্ছে চাঁদের বুক। ভগবান এইমাত্র ম্যাজিক ক’রে তাকে ওই চার-পাঁচ ডজন শুয়োরের কোনও একটা বানিয়ে দিলেন, চাঁদের চাম-মাংস-হাড় কেটে কেটে বসছিল লাঠির পরিত্রাহি সপাংগুলো!
আট
জাঙাল লণ্ডভণ্ড ক’রে এগিয়ে যায় ইতরসমাবেশ, মেয়েদের গজগজানির তখনও বিরাম নেই।
এ এক বড় ঘেন্নার জীব — চাঁদের মা দত্তকাকুর বউকে বলছে।
— কলতলায় সবে ঠাকুরির বাসন নামাইছি, যদি আসে মুখ দিয়ে দিতো, ক’ন দিদি! পাপটা তো আমারই লাগতো?
— কাওরাগো ব’লে-বোঝায় তুমি কিছু কোত্তি পারবা না, শান্তর মা। ওগো আবাহোনও নেই, বিসজ্জোনও নেই।
কায়পুত্র নামে ডাকলে তারা খুশি হয়, তবু সবাই কাওরাই বলবে। মান্নাপাড়া পেরিয়ে বাজারের ঠিক আগে চৌবাড়ি ময়দান, মাঠের গায়ে লাগানো কাওরাপাড়া। হয়ত মেরেকেটে দশ ঘর, পঞ্চাশ মানুষ। সব্বাই তীক্ষ্ণ কালো আর শুঁটকো, ছেলেরা নেংটি প’রে পায়খানা সাফাই করে, পোষা জীবগুলোর মতোই পাঁক ঘেঁটে মাছ ধ’রে বেচে বাজারে, মেয়েরা খাটছে ঠিকে-ঝি। ছেলেপেলে স্কুলে যায় না, সিগারেটের খোল দিয়ে তাস বানিয়ে জুয়ো খ্যালে, বিড়ি টানে, নিজেদের মধ্যে মুখখারাপ আর মাথা-ফাটাফাটি সারাক্ষণ।
বয়স্করা বাড়িতে পচাই আর তাড়ি বানাচ্ছে, পাশ দিয়ে হাঁটলে বোঁটকা গন্ধ পাবে। কিন্তু আজকাল ভদ্র সমাজও সন্ধেবেলা বড় রাস্তা এড়িয়ে ঘন দাঁতনগাছের ঝোপ ঠেলে কাওরাপাড়ায় হাজিরা দেয়। এভাবে কালে-কালে গোটা এলাকাই মাতালের দখলে চলে যাবে — এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে দত্তবাড়ির বউ ঠাকুরের বাসন মেজে ঘরে ওঠে। চাঁদের মা কনিষ্ঠ সন্তানকে নির্দেশ দিচ্ছিল, যা, দিদ্মারে ডাকে নিয়ে যায়। দ্যাখো গে, কলোনির কোন বাড়িতি যেয়ে ব’সে আছেন। এবার সে রান্নাঘরে ঢুকে মায়ের ভাতের থালাটি আগাম সাজিয়ে হাঁড়ির বাকি ভাত নিজের পাতে তুলে নিল। তখনই আজকের ছ’নম্বর ভিখারির শুভ মহরত।
অল্প বয়েসি বউটা রান্নাঘরের গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে দেখে মা দরজার পাল্লা অর্ধেক ভেজিয়ে এক চিলতে মুখ বাড়ায় — কী চাই?
— দুটো ভাত দেবা, মা গো? কাল দুফোরেত্থে কিসু খাইনি।
— নাম কী তোমার?
— মালোতী
ভেজানো পাল্লা দমাস ক’রে খুলে গেল।
— মিথ্যে কথা কও কিসির জন্যি? তুমি তো মোছলমান।
নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
— যাও, একখান কলাপাতা ছিঁড়ে নিয়ে আসো।
পাতিলেবুগাছের নীচে উবু হয়ে বসে পড়ে মালতী… না, মোমতাজ। মা নিজের থালা হাতে বেরিয়ে এসে অর্ধেক ভাত কলাপাতায় ঢেলে দেয়, কুমড়ো-পুঁইশাকের ঘ্যাঁট এক খাবলা রাখে ভাতের পাশে, এবং যে মুসুরির ডাল ঢালে পাতের ওপর, তাতে এমন নিফুটি জল যে পাতা ছাপিয়ে উঠোনের ধুলোয় মিশে যায় ডালের অর্ধেক। লেবুগাছের চারটে পাতা ছিঁড়ে চটকে মেখে খাওয়া সেরে মুখ ধুয়ে মোমতাজ যখন আঁচলে হাত মুছছে, মা গিয়ে সামনে দাঁড়াল :
— তোমরা তো পাকিস্তান থে’ আমাদের খ্যাদায় দিছিলে নিজেরা আরামে থাকপা ব’লে। কিন্তু থাকতি পাল্লে কই? সেই তো হিঁদুগো পেছোন পেছোন ইন্ডিয়ায় চলে আসতি হ’লো!
— কাজ জোটে না মা, ভিক্কেও দেয় না কেউ, কিন্তুক সব্বোনাশ করার লোক আছে। যেই মেয়ে হল অ্যাট্টা, খসোম ছাড়ে দে’ চলি গ্যালো। পাকিস্তান-ইন্ডে দিয়ে আমি কী করবো, পেরানে বাঁচা নিয়ে কথা।
— তোমার মেয়েডা কই?
— সে-কবে তার গোর দেয়া সারা!
ব’লে এমনভাবে উঠোনের একদিকে তর্জনী বাড়ায়, যেন ওখানে খুঁড়লে এখুনি মেয়ের মাটিমাখা হাড়গোড় বেরিয়ে আসবে।
চাঁদ দিদিমাকে খুঁজতে বেরোনোর সময় পেছন ঘুরে দেখছিল — শীতের ফ্যাকাসে দুপুরের ভেতর দাঁড়ানো দুই নারী শূন্য চোখে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে…।
ধারাবাহিক এই পোস্টে সম্মান এবং আপনার জন্য একরাশ শুভকামনা প্রিয় দা।