ধারাবাহিক উপন্যাস : কুসুম-কুমার

Wipe

পর্ব -১০

সময়কে পেছনে ফেলে জীবন এগিয়ে চলে সামনের দিকে। চলতে চলতে পথিক কখনো সখনো অতীত পথের দিকে ফিরে তাকায়। সে পথের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে মনের চোখ দিয়ে দেখে নিতে ভালবাসে।

মিলু স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে আনমনে কখন যেন হারিয়ে যায় সেই পেরিয়ে আসা অতীতের পথে।
প্রথম যেদিন মায়ের হাত ধরে স্কুলে ঢুকেছিল – সে তো প্রায় তিন বছর পার হয়ে গেল।
ইতিমধ্যে দু’দুটো ক্লাস পাস করে ফেলেছে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে। হেডস্যার জগদীশবাবুর হাত থেকে ফার্স্ট হবার পুরস্কার আর আর্শিবাদও পেয়েছে। মিলুর শান্তসৌম্য চেহারা আর গভীর মেধা তাকেও আকৃষ্ট করেছে। প্রতি মূহুর্তে মিলু হেডস্যারের সস্নেহ সহযোগিতা আর উপদেশ পেয়ে এসেছে।
টিফিনে যখন ছেলেরা হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকে মিলু তখন হয়তো স্কুলের লাইব্রেরী ঘরে বসে বই পড়ে গভীর মনযোগে। নয়তো স্কুল মাঠের এক কোণে কোনো গাছের গায়ে শরীর এলিয়ে চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে – বক কিংবা চিল উড়ে যাওয়া। হয়তো অপলক চোখে দেখে পিঁপড়ের সারি কেমন গাছ বেয়ে উঠে যাচ্ছে – নেমে আসছে। নয়তো দেখে নরম সবুজ ঘাসের ভেতর নেচে বেড়ানো ফড়িংয়ের ছোট্ট জীবনকে…

মিলু যে কবিতা লেখে সেটাও চোখ এড়িয়ে যায়নি হেডস্যারের। একদিন তো মিলু শুনে ফেলেছিল – বাবাকে স্যার বলছেন – সত্যানন্দবাবু, আপনার ছেলে তো পড়া লিখতে লিখতে খাতায় কবিতাও লিখে রাখে।
সত্যানন্দও জানেন। বলেন- ও ওর মায়ের ধারাই পেয়েছে।
জগদীশবাবু হেসে বলেন- শুধু মায়ের বলছেন কেন? আপনী, আপনার শ্বশুরমশায় – সবাই তো লেখালেখি করেন। সাহিত্য তো ওর দুই কুলেরই রক্তে আছে। ছোটরা পরিবারের পরিবেশ থেকে প্রেরণা পেয়েই তো বেড়ে ওঠে।

ভাই অশোকও অনেক বড় হয়ে গেছে। সে এখন সব সময় দাদার পেছন পেছন ঘোরে। সুযোগ পেলেই দুই ভাই বেরিয়ে পড়ে। ঘুরে বেড়ায় যেখানে সেখানে। কত রকম খেলাধুলো করে তারা। মার্বেল খেলে। হাডুডু খেলে। ঘুড়ি ওড়ায়। কখনো মিলু রেগে গিয়ে ভাইকে তাড়িয়েও নিয়ে বেড়ায়। আপাত শান্তশিষ্ট মিলুর ভেতরের দুষ্টুমিটাও বড় কম নয়।

এইতো কিছু দিন আগে এক শীতের রাত। মিলু আর অশোক এখন মায়ের কাছে নয়, মামাদাদুর ঘরে ঘুমোয়। এই ঘরটা মিলুর খুব প্রিয়। গোলপাতায় ছাওয়া আটচালা। এর একটি কক্ষে থাকেন ঠাকুরমা আর চিরকুমারী ছোটপিসি আর অন্য কক্ষে ওরা দু’ভাই থাকে মামাদাদুর সাথে।

সহজ বোকাসোকা মামাদাদুর সাথে দুষ্টুমি করতে সেদিন রাতে দু’ভাই পরামর্শ করে ওনার লেপের কোনায় মোটা সুতো বেঁধে দেয়। তারপর সেটা হাতে ধরে ওরা ঘুমোনোর ভান করে শুয়ে থাকে। আর মামাদাদুর লেপটা আস্তে আস্তে টেনে সরিয়ে আনে গায়ের থেকে। দাদু যতবার টানেন, ততবার আলগা হয়ে যেতে থাকে। দাদু খেয়াল করে দেখেন ওরা তো ঘুমচ্ছে। তাহলে? কেন হচ্ছে এরকম? ভূতপ্রেত নয়তো ? কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না মামাদাদু।

পরদিন সকালে কথাগুলো সবাইকে জানালেন তিনি। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না তার কথা।
কুসুমকুমারী কিন্তু সবই বুঝতে পারেন। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসেন। মিলুও জানে, মাকে ফাঁকি দেওয়া তাদের কম্ম নয়।
পরে নিরিবিলি পেয়ে মা অবশ্য ওদের সস্নেহে একটু শাসনও করেন। বলেন- ও রকম করতে নেই বাবা। ওনার বয়েস হয়েছে। শীতে কষ্ট পাবেন, বোঝ না ? আর কখনো ওরকম দুষ্টুমি করবে না।

নানাকথা ভাবতে ভাবতে মিলু কখন যে লাল গির্জার কাছে এসে পড়েছে বুঝতে পারে নি।
হঠাৎ একটা মেয়েলি কন্ঠের ডাকে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসে মিলু।
-মিলুদা, এই মিলুদ! -তুমি এখানে ?
মিলু দেখে মনিয়া লালগির্জার গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। গলায় ঝুলছে ক্রুশ চিহ্নের মালা।

মনিয়ার বাবা ছিলেন পোতুর্গীজ পাদ্রি আর মা বাঙালি হিন্দু। বাবা শৈশবে তাদের ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হলে মা অনেক ঘাটের জল খেয়ে অবশেষে সর্বানন্দ ভবনে মানে মিলুদের বাড়িতে কিছুদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর মিলুর বাবার চেষ্টায় এই লাল গির্জায় সেবিকা হিসেবে কাজ পেয়ে এখানেই চলে আসেন। সেইসূত্রে মিলুদের পরিবারের সাথে মনিয়াদের চেনাজানা। মনিয়ার মা মাঝেমধ্যে ওদের বাড়িরও নানাকাজ বাজ করে দেন।

আসলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে এই পথটা একটু ঘুরপথ। অন্য পথটি ধরেই সাধারণত ওরা আসা যাওয়া করে। মিলু বুঝতে পারে ভুল করে সে চলে এসেছে এপথে। তবু মনিয়াকে সে কথা না বলে একটু মজা করে বলে – ভাবলাম এপথে এলে যদি একবার তোমার সাথে দেখা হয়ে যায় – তাই …

মনিয়া মিলুর থেকে বয়েসে সামান্য ছোট হলেও ভারি বুদ্ধিমতী আর ছটফটে। গাছে চড়া, সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, শাপলাশালুক, পদ্ম তোলা বা বাগান থেকে নানা বুনোফল তোলা – সবেতেই সে ভয়ড়রহীনা এবং চৌকশ। মিলুও কখনো সখনো মনিয়ার সঙ্গী হয় ঘুরে বেড়ায় মাঠঘাট জলাজঙ্গলে। এইতো সেদিন ওরা দুজনে মিলে ভাটফুল তুলতে গিয়েছিল।

মিলুর কথা শুনে মনিয়া মৃদু হাসে। সে জানে মিলু কেমন উদাস আর ভাবুক ছেলে। বুঝতে পারে – মনের ভূলেই সে এসে পড়েছে এপথে। তবু বলে – সত্যি বলছো?
মিলু উত্তর না দিয়ে শুধু একটু হাসে।
-ভেতরে যাবে ? মনিয়া বলে।
– না না। বেশি দেরী হলে মা ভাববেন।
– এসো না একটু। ঐ ঝাউগাছের ওখানে গিয়ে বসি। আর একটু ক্ষণ থাকলে এমন কিছু দেরী হবে না- কাকীমাকে বোলো গির্জেয় গিয়েছিলে। – বলে মিলুর হাতটা ধরে মনিয়া।

গির্জার ভেতরের ঝাউগাছের সারি মিলুর যে বড় প্রিয় -সেটা মনিয়া জানে।
-আচ্ছা, চল তাহলে। কিছুক্ষণ বসেই যাই।
মিলু সম্মতি জানায়।

গির্জার গেট পার হয়ে ওরা দু’জন ঝাউসারির পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে দু’জনে। তারপর মিলু বলে – আর দেরি করবো না। এবার আমাকে বাড়ি যেতে হবে। নয়তো মা চিন্তা করবেন।
মনিয়া আস্তে আস্তে বলে – আচ্ছা চল তাহলে। তোমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিই।
গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনিয়া বলে – মিলুদা, তুমি যখন বড় হয়ে চাকরি করতে কোলকাতায় চলে যাবে, তখন আমার কথা তোমার মনে থাকবে ?
– তোমাদের ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। কোনোদিনও কোথাও যাব না।
মনিয়া মায়া ভরা চোখে মিলুর দিকে তাকায় আর
মিলুও একবার মনিয়ার মুখের দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটে।

শংকর দেবনাথ সম্পর্কে

শংকর দেবনাথ জন্মঃ ২১ অক্টোবর, ১৯৭৪ প্রকাশিত গ্রন্থ - কবিতার বইঃ ১) আত্মহনন অথবা মৈথুন ২) শিয়রে নীলাভ জ্বর ৩) পরকীয়া ঘুম ছড়ার বইঃ ১) দুধমাখা ভাত ২) টক ঝাল তেতো কড়া ৩) ফাটকা কথার টাটকা ছড়া ৪) লাগ ভেল্কি লাগ ৫) রসে কষে ভরা প্রবাদের ছড়া গল্পগ্রন্থঃ ১) দুই শালিকের গল্প ২) গাছের জন্মদিন পিডিএফ ছড়ার বই: ১. ফাটকা কথার টাটকা ছড়া ২. সুজন পাখির কূজন ৩. অথৈ প্রাণের ধারা ৪. ছন্দ মাতে বন্দনাতে ৫. কিম্ভুতকিমাকার ৬. অপ্রচলিত ছড়া ৭. আমার সুকুমার ৮. প্রাণের ঠাকুর ৯. গাছপাগলের পদ্য ১০. ছড়ায় পড়া ১১. শব্দ নিয়ে মজা ১২. ভূত আছে ভূত নেই ১৩) ঠাকুরদাদার বউ ১৪) তাই রে না না ১৫) খুশি মনে পুষি ছড়া ১৬) স্বরবর্ণের ঘর সম্পাদিত পত্রিকাঃ ছোটদের ভোরের পাখি ভেল্কি ছড়াপত্র ঠোঁটকাটা মাসিক ছড়াপত্রিকা পুরষ্কার ও সম্মাননাঃ ১। নিখিলবঙ্গ শিশুসাহিত্য সংসদ প্রদত্ত " কবি কৃত্তিবাস সম্মাননা" -২০১৮ ২। দীনবন্ধু রাখালদাস বিভূতি বিনয় একাডেমি প্রদত্ত " কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকার সাহিত্য সম্মান -২০১৯

4 thoughts on “ধারাবাহিক উপন্যাস : কুসুম-কুমার

  1. আপনার অসাধারণ লেখনীতে ভীষণ রকমের মুগ্ধ হলাম ।

  2. উপন্যাসের এই খণ্ডও পড়লাম প্রিয় কবি। একরাশ শুভেচ্ছা রইলো আপনার জন্য। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।