শংকর দেবনাথ এর সকল পোস্ট

শংকর দেবনাথ সম্পর্কে

শংকর দেবনাথ জন্মঃ ২১ অক্টোবর, ১৯৭৪ প্রকাশিত গ্রন্থ - কবিতার বইঃ ১) আত্মহনন অথবা মৈথুন ২) শিয়রে নীলাভ জ্বর ৩) পরকীয়া ঘুম ছড়ার বইঃ ১) দুধমাখা ভাত ২) টক ঝাল তেতো কড়া ৩) ফাটকা কথার টাটকা ছড়া ৪) লাগ ভেল্কি লাগ ৫) রসে কষে ভরা প্রবাদের ছড়া গল্পগ্রন্থঃ ১) দুই শালিকের গল্প ২) গাছের জন্মদিন পিডিএফ ছড়ার বই: ১. ফাটকা কথার টাটকা ছড়া ২. সুজন পাখির কূজন ৩. অথৈ প্রাণের ধারা ৪. ছন্দ মাতে বন্দনাতে ৫. কিম্ভুতকিমাকার ৬. অপ্রচলিত ছড়া ৭. আমার সুকুমার ৮. প্রাণের ঠাকুর ৯. গাছপাগলের পদ্য ১০. ছড়ায় পড়া ১১. শব্দ নিয়ে মজা ১২. ভূত আছে ভূত নেই ১৩) ঠাকুরদাদার বউ ১৪) তাই রে না না ১৫) খুশি মনে পুষি ছড়া ১৬) স্বরবর্ণের ঘর সম্পাদিত পত্রিকাঃ ছোটদের ভোরের পাখি ভেল্কি ছড়াপত্র ঠোঁটকাটা মাসিক ছড়াপত্রিকা পুরষ্কার ও সম্মাননাঃ ১। নিখিলবঙ্গ শিশুসাহিত্য সংসদ প্রদত্ত " কবি কৃত্তিবাস সম্মাননা" -২০১৮ ২। দীনবন্ধু রাখালদাস বিভূতি বিনয় একাডেমি প্রদত্ত " কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকার সাহিত্য সম্মান -২০১৯

ছড়া নিয়ে কড়া কথা

ইদানীং ছড়া ও ছোটদের কবিতা লেখার জোয়ার নেমেছে।

পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে দেখেছি – লেখা আহবান করলে শ’য়ে শ’য়ে লেখা এসে জমা হতে থাকে। অবশ্য তার অধিকাংশ লেখাই পাঠযোগ্য হয় না।

ছন্দ না জেনে বা ব্যাকরণের অংক মেনে আঙুলের কর গুনেগুনে অক্ষর বসিয়ে আর যেনতেন অন্ত্যমিল দিয়ে যা কিছু একটা লিখলেই যে সেটা ছড়া বা ছোটদের কবিতা হয়ে যায় না – এটা আমরা বুঝি না বা জানতে চাই না।

একটা মানোত্তীর্ণ ছড়া বা ছোটদের কবিতা হয়ে উঠতে চাই সহজাত সাবলীল ছন্দবোধ। স্বতঃস্ফূর্ত ও সুষম শব্দ চয়ন। আঙ্গিকের বিভিন্নতার সাথে বিষয় ও উপস্থাপনার নতুনত্ব এবং বিশুদ্ধ ধ্বনিযুক্ত অন্ত্যমিল।

কিন্তু হতাশার বিষয় – আমাদের অধিকাংশ ছড়াকার কবিদের লেখায় এ সব কোনো কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না কোনো ভাবনা-চিন্তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই গতানুগতিকায় গা ভাসিয়ে একদম পড়াশুনো ছাড়াই আমরা লিখে চলেছি একটার পর একটা ছড়া কবিতা। আর ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি সম্পাদকের পিছে পিছে। জান লড়িয়ে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছি সাহিত্য সভায় সভায়। আমরা কি লেখার মান-সচেতন নই, না কি লেখার ভাল-মন্দই বুঝি না ?

এই অশুদ্ধতার জোয়ারে ভেসে ভেসে হারিয়ে যাচ্ছে না কি আমাদের অনেকের লেখা বিশুদ্ধ ছড়া কবিতা ?

শিশু সাহিত্য

অনেক কবি-সাহিত্যিক দেখেছি- শিশুকিশোর সাহিত্যকে তারা বালখিল্যপনা ভেবে হেয় করেন। শিশুসাহিত্যিকদের হীনচোখে দেখেন। অনেক কবি তো ছন্দ-অন্ত্যমিলাশ্রয়ী কবিতাকে পর্যন্ত অচ্ছুৎ ভাবেন। একজন শিশুসাহিত্যসেবক হিসেবে এ ধরণের করুণ অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে। অনেক সাহিতানুষ্ঠানে গিয়ে বা কবি-সাহিত্যিকদের কথায় এর ভুরিভুরি প্রমাণ আমি পেয়েছি।

এমনকী কবিসভায় শিশুসাহিত্যিকগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডাকও পান না। অনেক লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক বড়দের সাহিত্যের পাশে ছোটদের সাহিত্য প্রকাশ করতেও ভয় পান পত্রিকার মান নষ্ট হবার ভয়ে। বড়বড় পত্রিকাওলারা বড়দের সাহিত্যের পাশে ছোটদের উপযোগি সাহিত্য রাখার আগ্রহও দেখান না। সাহিত্যের আলোচনার ক্ষেত্রেও শিশুকিশোর সাহিত্য ও সাহিত্যিকগণ সবসময় অপাঙক্তেয়ই থেকে যান। অথচ ওই সব বড় কবি লেখকগণও যে একদিন ছেলেভুলানো ছড়ার ছন্দে, ঠাকুরমার ঝুলি, পঞ্চতন্ত্রের গল্পের ভাষা আর কল্পনার রঙে মেধা আর মননকে রাঙিয়ে বেড়ে উঠেছেন সেটা বেমালুম ভুলে যান।

তবে বিভিন্ন বইমেলাতে গিয়ে খেয়াল করেছি, বড়দের জন্য লিখিত সাহিত্যের চেয়ে ছোটদের সাহিত্য কম বিক্রিত হয়না।

বরং হয়তো একটু বেশিই হয় মনে হয়। শিশুকিশোর বা তরুণ পাঠকের সংখ্যাও বড়দের তুলনায় কম নয়। আর সাধারণ মেধার পাঠকপাঠিকারা তো বড়দের গল্প কবিতার দুর্বোধ্যতার কারণে রসাস্বাদনে ব্যর্থ হয়ে শিশুকিশোর সাহিত্যই তুলে নেন। সেটা ছাত্রপড়ানোর সুবাদে অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আমি খেয়াল করেছি। মা বাবা নিজে পড়েন না, অথচ তাদের অক্ষরজ্ঞানহীন শিশুকে পড়ে শোনান নানান শিশুসাহিত্য। এরকম ঘটনাও আমি চাক্ষুষ করেছি।

তবু কেন যে এই অবজ্ঞা, বুঝিনা। শিশুকিশোরদের যদি না সাহিত্যমনস্ক করে তোলা যায়, যদি না তাদের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা যায় তাহলে বড়দের সাহিত্য ভবিষ্যতে কারা পড়বে, এটা তথাকথিত বড়বড় কবিলেখকগণ কী ভাবেন?

তাদের দামিদামি ভাষণের ঢাউসঢাউস বইগুলো যতটা না পঠিত হয় তারচেয়ে বেশি পঠিত হয় ছোটদের সাহিত্য। ওগুলো পড়েন শুধুমাত্র কবিলেখকগণ আর অন্যরা কিনলেও তা শুধুমাত্র ঘর সাজানোর জন্য। এরকম কিছু অদ্ভূত প্রমাণও আমি পেয়েছি।

অথচ সাহিত্যের সব বড়বড় পুরস্কারও বড়বড় কবি-সাহিত্যিকদের জন্য। শিশুকিশোর সাহিত্যলেখকগণও সেখানে অবহেলিত। একজন নগন্য শিশুসাহিত্যসেবক হিসেবে আক্ষেপ, আসলে আমরাই আমাদের গাছের গোড়া কেটে আগায় জল ঢেলে গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছি।-

সত্যি মরে পথ্যি ছাড়া

সকল কিছুই নকল এবং
মিথ্যে দেখে দেখে-
চিত্ত জুড়ে নিত্য সবাই
সন্দেহ নেয় মেখে।

সত্যি কি এক রত্তিও নেই
আসল কি নেই কিছু?
উঠছি ভোরে ছুটছি জোরে
মিছের পিছুপিছু!

সন্দেহে মন-দেহের ভিতর
ভাবনা ইতর জাগে-
অবিশ্বাসের বিষ শ্বাস এখন
অবিরতই লাগে।

আসলটাকেও নকল লাগে
ধকল স’য়ে স’য়ে-
সত্যিগুলোও ধুলোয় পড়ে
যাচ্ছে মিছে হয়ে।

সত্যি মরে পথ্যি ছাড়া
আসল মরে ধুঁকে-
মিথ্যে বেড়ায় নৃত্য করে
চিত্তভরা সুখে।

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কুসুম-কুমার

inbound1399152016

পর্ব -১৩
সময়কে পেছনে ফেলে জীবন এগিয়ে চলে সামনের দিকে। চলতে চলতে পথিক কখনো সখনো অতীত পথের দিকে ফিরে তাকায়। সে পথের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে মনের চোখ দিয়ে দেখে নিতে ভালবাসে।

মিলু স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে আনমনে কখন যেন হারিয়ে যায় সেই পেরিয়ে আসা অতীতের পথে।
প্রথম যেদিন মায়ের হাত ধরে স্কুলে ঢুকেছিল – সে তো প্রায় তিন বছর পার হয়ে গেল।
ইতিমধ্যে দু’দুটো ক্লাস পাস করে ফেলেছে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে। হেডস্যার জগদীশবাবুর হাত থেকে ফার্স্ট হবার পুরস্কার আর আর্শিবাদও পেয়েছে। মিলুর শান্তসৌম্য চেহারা, গভীর একাগ্রতা আর মেধা তাকেও আকৃষ্ট করেছে। প্রতি মূহুর্তে মিলু হেডস্যারের সস্নেহ সহযোগিতা আর উপদেশ পেয়ে এসেছে।
টিফিনে যখন ছেলেরা হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকে মিলু তখন হয়তো স্কুলের লাইব্রেরী ঘরে বসে বসে বই পড়ে গভীর মনযোগে। নয়তো স্কুল মাঠের এক কোণে কোনো গাছের গায়ে শরীর এলিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে – বক কিংবা চিলের উড়ে যাওয়া। হয়তো অপলক চোখে দেখে পিঁপড়ের সারি কেমন গাছ বেয়ে উঠে যাচ্ছে – নেমে আসছে। নয়তো দেখে নরম সবুজ ঘাসের ভেতর নেচে বেড়ানো ফড়িংয়ের ছোট্ট জীবনকে…

মিলু যে কবিতা লেখে সেটাও চোখ এড়িয়ে যায়নি হেডস্যারের। একদিন তো মিলু শুনে ফেলেছিল – বাবাকে স্যার বলছেন – সত্যানন্দবাবু, আপনার ছেলে তো পড়া লিখতে লিখতে খাতায় কবিতাও লিখে রাখে।
সত্যানন্দও জানেন। বলেন- ও ওর মায়ের ধারাই পেয়েছে।
জগদীশবাবু হেসে বলেন- শুধু মায়ের বলছেন কেন? আপনী, আপনার শ্বশুরমশায় – সবাই তো লেখালেখি করেন। সাহিত্য তো ওর দুই কুলেরই রক্তে আছে। ছোটরা পরিবারের পরিবেশ থেকে প্রেরণা পেয়েই তো বেড়ে ওঠে।

ভাই অশোকও অনেক বড় হয়ে গেছে। সে এখন সবসময় দাদার পেছন পেছন ঘোরে। সুযোগ পেলেই দুই ভাই বেরিয়ে পড়ে। ঘুরে বেড়ায় যেখানে সেখানে৷ কত রকম খেলাধুলো করে তারা। মার্বেল খেলে। হাডুডু খেলে। ঘুড়ি ওড়ায়। কখনো মিলু রেগে গিয়ে ভাইকে তাড়িয়েও নিয়ে বেড়ায়। আপাত শান্তশিষ্ট মিলুর ভেতরের দুষ্টুমিটাও বড় কম নয়।

এইতো কিছুদিন আগে এক শীতের রাত। মিলু আর অশোক এখন মায়ের কাছে নয়, মামাদাদুর ঘরে ঘুমোয়। এই ঘরটা মিলুর খুব প্রিয়। গোলপাতায় ছাওয়া আটচালা। এর একটি কক্ষে থাকেন ঠাকুরমা আর চিরকুমারী ছোটপিসি আর অন্য কক্ষে ওরা দু’ভাই থাকে মামাদাদুর সাথে।

সহজ বোকাসোকা মামাদাদুর সাথে দুষ্টুমি করতে সেদিন রাতে দু’ভাই পরামর্শ করে ওনার লেপের কোনায় মোটা সুতো বেঁধে দেয়। তারপর সেটা হাতে ধরে ওরা ঘুমোনোর ভান করে শুয়ে থাকে। আর মামাদাদুর লেপটা আস্তে আস্তে টেনে সরিয়ে আনে গায়ের থেকে। দাদু যতবার টানেন, ততবার আলগা হয়ে যেতে থাকে। দাদু খেয়াল করে দেখেন – ওরা তো ঘুমচ্ছে। তাহলে? কেন হচ্ছে এরকম? ভূতপ্রেত নয়তো ? কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না মামাদাদু।

পরদিন সকালে কথাগুলো সবাইকে জানালেন তিনি। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না তার কথা।
কুসুমকুমারী কিন্তু সবই বুঝতে পারেন। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসেন। মিলুও জানে, মাকে ফাঁকি দেওয়া তাদের কম্ম নয়।
পরে নিরিবিলি পেয়ে মা অবশ্য ওদের সস্নেহে একটু শাসনও করেন। বলেন- ও রকম করতে নেই বাবা। ওনার বয়েস হয়েছে। শীতে কষ্ট পাবেন, বোঝ না ? আর কখনো ওরকম দুষ্টুমি করবে না।

নানাকথা ভাবতে ভাবতে মিলু কখন যে লাল গির্জার কাছে এসে পড়েছে বুঝতে পারে নি।
হঠাৎ একটা মেয়েলি কণ্ঠের ডাকে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসে মিলু।
-মিলুদা,এই মিলুদ! -তুমি এখানে ?
মিলু দেখে মনিয়া লালগির্জার গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। গলায় ঝুলছে ক্রুশ চিহ্নের মালা।

মনিয়ার বাবা ছিলেন পোতুর্গীজ পাদ্রি আর মা বাঙালি হিন্দু। বাবা শৈশবে তাদের ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হলে মা অনেক ঘাটের জল খেয়ে অবশেষে সর্বানন্দ ভবনে মানে মিলুদের বাড়িতে কিছুদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর মিলুর বাবার চেষ্টায় এই লাল গির্জায় সেবিকা হিসেবে কাজ পেয়ে এখানেই চলে আসেন। সেই সূত্রে মিলুদের পরিবারের সাথে মনিয়াদের চেনাজানা। মনিয়ার মা মাঝেমধ্যে ওদের বাড়িরও নানাকাজ বাজ করে দেন।

আসলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে এই পথটা একটু ঘুরপথ। অন্য পথটি ধরেই সাধারণত ওরা আসা যাওয়া করে। মিলু বুঝতে পারে ভুল করে সে চলে এসেছে এপথে। তবু মনিয়াকে সে কথা না বলে একটু মজা করে বলে – ভাবলাম এপথে এলে যদি একবার তোমার সাথে দেখা হয়ে যায় – তাই …

মনিয়া মিলুর থেকে বয়েসে সামান্য ছোট হলেও ভারি বুদ্ধিমতী আর ছটফটে। গাছে চড়া, সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, শাপলাশালুক, পদ্ম তোলা বা বাগান থেকে নানা বুনোফল তোলা – সবেতেই সে ভয়ডরহীনা এবং চৌকশ। মিলুও কখনো সখনো মনিয়ার সঙ্গী হয় ঘুরে বেড়ায় মাঠঘাট জলাজঙ্গলে। এইতো সেদিন ওরা দুজনে মিলে ভাটফুল তুলতে গিয়েছিল।

মিলুর কথা শুনে মনিয়া মৃদু হাসে। সে জানে মিলু কেমন উদাস আর ভাবুক ছেলে। বুঝতে পারে – মনের ভূলেই সে এসে পড়েছে এপথে। তবু বলে – সত্যি বলছো?
মিলু উত্তর না দিয়ে শুধু একটু হাসে।
-ভেতরে যাবে ? মনিয়া বলে।
– না না। বেশি দেরী হলে মা ভাববেন।
– এসো না একটু। ঐ ঝাউগাছের ওখানে গিয়ে বসি। আর একটু ক্ষণ থাকলে এমন কিছু দেরী হবে না- কাকীমাকে বোলো গির্জেয় গিয়েছিলে। -বলে মিলুর হাতটা ধরে মনিয়া।

গির্জার ভেতরের ঝাউগাছের সারি মিলুর যে বড় প্রিয় -সেটা মনিয়া জানে।
-আচ্ছা, চল তাহলে। কিছুক্ষণ বসেই যাই।
মিলু সম্মতি জানায়।

গির্জার গেট পার হয়ে ওরা দু’জন ঝাউসারির পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে দু’জনে। তারপর মিলু বলে – আর দেরি করবো না। এবার আমাকে বাড়ি যেতে হবে। নয়তো মা চিন্তা করবেন।
মনিয়া আস্তে আস্তে বলে – আচ্ছা চল তাহলে। তোমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিই।
গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনিয়া বলে – মিলুদা, তুমি যখন বড় হয়ে চাকরি করতে কোলকাতায় চলে যাবে, তখন আমার কথা তোমার মনে থাকবে ?
– তোমাদের ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। কোনোদিনও কোথাও যাব না।
মনিয়া মায়া ভরা চোখে মিলুর দিকে তাকায় আর
মিলুও একবার মনিয়ার মুখের দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে।

ধারাবাহিক উপন্যাস : কুসুম-কুমার

inbound298088869

পর্ব-১২

প্রতি বছরের মত মিলুর ঠাকুরমা এবারও অনেক আমসত্ব দিয়েছেন। আচার করেছেন।
সেগুলো একটা হোগলার চাচের উপর রোদে শুকাতে দিচ্ছেন ঠাকুরমা। সাথে সাহায্য করছে মিলু। পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে অশোক।
মিলুদের বাড়িতে অনেক আমগাছ। আম পাকা শুরু হলে মিলুর প্রতিদিনের নেশা বারবার আমতলাতে যাওয়া। আম কুড়ানো। মাঝে মাঝে গাছি মামুদ আলি এসে আম পেড়ে দিয়ে যায়।
সেই আম পাড়ার সকল পরিবারকে যেমন দেওয়া হয় তেমনি ঠাকুরমা আমসত্ব দেন ও আচার করে রাখেন। সারাবছর ধরে সেসব খাওয়া চলে। মিলু বাবা-কাকার একটা প্রিয় খাবার হল এই আমসত্ব আর দুধ ৷ শেষপাতে এটা না পেলেও তাদের খাওয়াটা যেন পূর্ণ হয় না ৷ মিলুদের খাবার ধরণ আবার অন্য ৷ তারা শুকনো আমসত্ব চুষে চুষে খেতেই বেশি ভালবাসে ৷
আমসত্ব দেওয়া, আচার বানানো- সব ক্ষেত্রেই মিলুর উৎসাহের অন্ত নেই ৷ সে ঠাকুরমায়ের সাথে সবসময়ই থাকে ৷ হাতে হাতে তাকে সাহায্য করে৷ আমের খোসা ছাড়িয়ে দেওয়া, রস বের করা – তারপর সেই রস যাকে আমগোলা বলে – সেসব ঠাকুরমায়ের সাথে উঠোনে নিয়ে যাওয়া – সবকিছুই করে ৷ ছোট ছোট হোগলার চাটাই, কুলো , থালা প্রভৃতিতে ঠাকুরমা সেই গোলার লেপ দেন বারবার ৷ শুকিয়ে গেলে আবার ৷
এবছরের মত আমসত্ব দেওয়া শেষ হয়েছে ৷ এখন সেগুলো ভাল করে গ্রীষ্মের কড়া রোদে শুকিয়ে রাখা হচ্ছে যাতে তাডাতাড়ি নষ্ট হয়ে না যায় ৷
আমসত্বগুলো রোদে দিতে দিতে ঠাকুরমা মিলুকে বলেন- দাদা যাও তো, ঘর থেকে আচারের বয়েমগুলো নিয়ে এসো ৷ ওগুলো তো কাল রোদে দেওয়াই হয়নি ৷
– আচ্ছা – মিলু একছুটে চলে যায় ঘরে | অশোকও যায় দাদার পিছে পিছে ৷ একে একে সব ক’টা আচারের পাত্র নিয়ে আসে ওরা ৷
ঠাকুরমা বলেন-ওপাশে সাজিয়ে দিয়ে দাও ৷

দুই ভাইয়ের দায়িত্ব হল – আমসত্ব আর আচার পাহারা দেওয়া ৷ যাতে কুকুর, বিড়াল বা পাখিটাখি এসে ওগুলো নষ্ট করে না দেয় ৷ এছাড়া আরো একটা কাজ আছে ৷ সেটা হল – এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখে মাঝে মাঝে বয়েমের মুখ খুলে একটু আচার চেখে দেখা কিংবা একটু আমসত্ব ছিঁড়ে মুখে পুরে দেওয়া ৷

মিলুর জেঠিমা পাশ দিয়ে থালাবাসন নিয়ে পুকুরের দিকে যাচ্ছিলেন ৷ দাঁড়িয়ে শ্বাশুড়ি মাকে বললেন – মা , আপনার আচারের বয়েমগুলো তো ভরাই ছিল ৷ ওগুলো অত কমে গেল কী করে? আর আমসত্বগুলোও যেন একটু ছোট ছোট হয়ে গেছে মনে হচ্ছে ৷
ঠাকুরমা সবই জানেন ৷ তবে এতে তিনি মজাই পান ৷ ওনারও ওদের এই লুকিয়ে খেতে দেখে নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায় ৷ কত আটা দুধ থেকে সর তুলে খেয়েছেন মায়ের চোখ এড়িয়ে ৷
তিনি মিলুর দিকে চেয়ে একটু চোখ টিপে হেসে বলেন- রোদে শুকোতে দিলে ওরকম আস্তে আস্তে কমে যায় ৷ কী বলো মিলু দাদা ? তাই না?
পাশেই কুসুমকুমারী রোদে শাড়ি মেলছিলেন ৷ হেসে বললেন –
বাঘের কাছে গরু রাখা –
ধীরেধীরেই গোয়াল ফাঁকা ৷
কুসুমকুমারীর এরকম ছন্দ মিলিয়ে কথা বলার একটা অভ্যাস আছে ৷ আর মজার কথার ক্ষেত্রে তো তার মুখ থেকে যেন ছন্দ মিলের খই ফোটে ৷
ঠাকুরমা হেসে তার বৌমাকে বলেন- সে তুমি ছন্দ দিয়ে যা খুশি বলতে পারো ৷ তবে আমার জিনিস নিয়ে তোমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে ৷ নিজেদের কাজবাজগুলো মন দিয়ে করো গে যাও।
তারপর একগাল হেসে মিলুর দিকে চেয়ে বললেন – তোমাদের কাজ তোমরা মন দিয়ে করে যাও ৷ খেয়াল রেখো- যেন কুকুর বিড়াল উপরে উঠে না পড়ে ৷
মিলু হাঁ সূচক ঘাড় নাড়ে ৷

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কুসুম-কুমার

inb

পর্ব-১১

শীতের সকাল। চারদিকে ঘন কুয়াসা। এই কুয়াসার ভেতর দিয়ে ঘুরতে মিলু খুব ভালবাসে। চারপাশের আবছা পরিবেশটা তার চোখের সামনে এনে দেয় এক অলৌকিক জগতের চিত্রাবলী। অস্পষ্টতার ভেতরে সে যেন খুঁজে পায় কোনো এক সুস্পষ্ট সৌন্দর্য্য।
কুসুমকুমারী ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে যখন দেখেন আজ খুব কুয়াসা পড়েছে- তখন তিনিই মিলুকে ডেকে দেন ঘুম থেকে।
বলেন- ভাল করে কান মাথা ঢেকে বের হও। নয়তো ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।
মিলু সেই ধুসর কুয়াসার ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে উঠোনে আর এক অতীন্দ্রিয় আনন্দ অনুভূতিতে রোমাঞ্চিত হয়ে সুর করে পড়ে চলেছে –
‘O Mary, go and call the cattle home,
And call the cattle home,
And call the cattle home
Across the sands of Dee;’
The western wind was wild and dank with foam,
And all alone went she.’

প্রহ্লাদ গোয়ালা প্রতিদিনের মত আজও দুধ দিতে এসেছে। সে মিলুর সুর করে বলা কথাগুলো শুনে এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। বড় ভালো লেগে যায় তার। তাই দুধ নেবার জন্য কাউকে না ডেকে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় মিলুর দিকে এবং নীরবে শুনতে থাকে।

মিলুর আবৃত্তি শেষ হতেই গোয়ালার মুখ থেকে যেন অবচেতনভাবেই বেরিয়ে আসে-
-তুমি দেহি সুন্দার করগে পড়তে পারো খোকাবাবু।
মিলু হঠাৎ কথার শব্দে চমকে উঠে দেখে আবছা কুয়াসায় তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রহ্লাদ গোয়ালা।
– ও গোয়ালা কাকা, তুমি ? আমি তো ভড়কে গেছিলাম।
মিলু বলে।
– তুমার পড়াডা আমার খুব ভালোই লাগচে খোকাবাবু। হেইডাই মুই খারাইয়া খারাইয়া শুনতে আছিলাম। আর এট্টা পড়বা?
-তুমি শুনবে? তাহলে তো পড়তেই হবে।
বলে মিলু শুরু করে –

আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর,
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে
প্রভাতপাখির গান!
না জানি কেন রে এত দিন পরে
জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠেছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ
রুধিয়া রাখিতে নারি।

মিলুর হঠাৎ উচ্চকন্ঠস্বর শুনে বাড়ির অনেকেই চলে আসেন সেখানে।

পড়া শেষ হলে গোয়ালা বলল – ভারি সুন্দার পড়তে পারো তুমি। আমারে এইরাম মাঝে মধ্যে শুনাইবা তো খোকাবাবু?
মিলু হ্যাঁসূচক ঘাড় নাড়ে। – অবশ্যই শোনাব গোয়ালা কাকা।
আবেগে যেন উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ে গোয়ালা। বলে – তুমি মেলা বড় হইবা খোকাবাবু। মুই তোমারে আশিব্বাদ দেতে আচি।
কুসুমকুমারী আর সত্যানন্দ পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন। ওদের দিকে তাকিয়ে গোয়ালা আবার বলে – কাগো পোলো দ্যাখতে হইব না কত্তামা? মুই কয়ে দিলাম আপনে গো এই পোলায় দশজনার একজন হইব।
ছেলের গর্বে মায়ের বুক ভরে ওঠে এক নির্মল আনন্দে।

ধারাবাহিক উপন্যাস : কুসুম-কুমার

Wipe

পর্ব -১০

সময়কে পেছনে ফেলে জীবন এগিয়ে চলে সামনের দিকে। চলতে চলতে পথিক কখনো সখনো অতীত পথের দিকে ফিরে তাকায়। সে পথের বাঁকে বাঁকে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে মনের চোখ দিয়ে দেখে নিতে ভালবাসে।

মিলু স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে আনমনে কখন যেন হারিয়ে যায় সেই পেরিয়ে আসা অতীতের পথে।
প্রথম যেদিন মায়ের হাত ধরে স্কুলে ঢুকেছিল – সে তো প্রায় তিন বছর পার হয়ে গেল।
ইতিমধ্যে দু’দুটো ক্লাস পাস করে ফেলেছে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে। হেডস্যার জগদীশবাবুর হাত থেকে ফার্স্ট হবার পুরস্কার আর আর্শিবাদও পেয়েছে। মিলুর শান্তসৌম্য চেহারা আর গভীর মেধা তাকেও আকৃষ্ট করেছে। প্রতি মূহুর্তে মিলু হেডস্যারের সস্নেহ সহযোগিতা আর উপদেশ পেয়ে এসেছে।
টিফিনে যখন ছেলেরা হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকে মিলু তখন হয়তো স্কুলের লাইব্রেরী ঘরে বসে বই পড়ে গভীর মনযোগে। নয়তো স্কুল মাঠের এক কোণে কোনো গাছের গায়ে শরীর এলিয়ে চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে – বক কিংবা চিল উড়ে যাওয়া। হয়তো অপলক চোখে দেখে পিঁপড়ের সারি কেমন গাছ বেয়ে উঠে যাচ্ছে – নেমে আসছে। নয়তো দেখে নরম সবুজ ঘাসের ভেতর নেচে বেড়ানো ফড়িংয়ের ছোট্ট জীবনকে…

মিলু যে কবিতা লেখে সেটাও চোখ এড়িয়ে যায়নি হেডস্যারের। একদিন তো মিলু শুনে ফেলেছিল – বাবাকে স্যার বলছেন – সত্যানন্দবাবু, আপনার ছেলে তো পড়া লিখতে লিখতে খাতায় কবিতাও লিখে রাখে।
সত্যানন্দও জানেন। বলেন- ও ওর মায়ের ধারাই পেয়েছে।
জগদীশবাবু হেসে বলেন- শুধু মায়ের বলছেন কেন? আপনী, আপনার শ্বশুরমশায় – সবাই তো লেখালেখি করেন। সাহিত্য তো ওর দুই কুলেরই রক্তে আছে। ছোটরা পরিবারের পরিবেশ থেকে প্রেরণা পেয়েই তো বেড়ে ওঠে।

ভাই অশোকও অনেক বড় হয়ে গেছে। সে এখন সব সময় দাদার পেছন পেছন ঘোরে। সুযোগ পেলেই দুই ভাই বেরিয়ে পড়ে। ঘুরে বেড়ায় যেখানে সেখানে। কত রকম খেলাধুলো করে তারা। মার্বেল খেলে। হাডুডু খেলে। ঘুড়ি ওড়ায়। কখনো মিলু রেগে গিয়ে ভাইকে তাড়িয়েও নিয়ে বেড়ায়। আপাত শান্তশিষ্ট মিলুর ভেতরের দুষ্টুমিটাও বড় কম নয়।

এইতো কিছু দিন আগে এক শীতের রাত। মিলু আর অশোক এখন মায়ের কাছে নয়, মামাদাদুর ঘরে ঘুমোয়। এই ঘরটা মিলুর খুব প্রিয়। গোলপাতায় ছাওয়া আটচালা। এর একটি কক্ষে থাকেন ঠাকুরমা আর চিরকুমারী ছোটপিসি আর অন্য কক্ষে ওরা দু’ভাই থাকে মামাদাদুর সাথে।

সহজ বোকাসোকা মামাদাদুর সাথে দুষ্টুমি করতে সেদিন রাতে দু’ভাই পরামর্শ করে ওনার লেপের কোনায় মোটা সুতো বেঁধে দেয়। তারপর সেটা হাতে ধরে ওরা ঘুমোনোর ভান করে শুয়ে থাকে। আর মামাদাদুর লেপটা আস্তে আস্তে টেনে সরিয়ে আনে গায়ের থেকে। দাদু যতবার টানেন, ততবার আলগা হয়ে যেতে থাকে। দাদু খেয়াল করে দেখেন ওরা তো ঘুমচ্ছে। তাহলে? কেন হচ্ছে এরকম? ভূতপ্রেত নয়তো ? কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না মামাদাদু।

পরদিন সকালে কথাগুলো সবাইকে জানালেন তিনি। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না তার কথা।
কুসুমকুমারী কিন্তু সবই বুঝতে পারেন। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসেন। মিলুও জানে, মাকে ফাঁকি দেওয়া তাদের কম্ম নয়।
পরে নিরিবিলি পেয়ে মা অবশ্য ওদের সস্নেহে একটু শাসনও করেন। বলেন- ও রকম করতে নেই বাবা। ওনার বয়েস হয়েছে। শীতে কষ্ট পাবেন, বোঝ না ? আর কখনো ওরকম দুষ্টুমি করবে না।

নানাকথা ভাবতে ভাবতে মিলু কখন যে লাল গির্জার কাছে এসে পড়েছে বুঝতে পারে নি।
হঠাৎ একটা মেয়েলি কন্ঠের ডাকে স্বাভাবিকতায় ফিরে আসে মিলু।
-মিলুদা, এই মিলুদ! -তুমি এখানে ?
মিলু দেখে মনিয়া লালগির্জার গেটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। গলায় ঝুলছে ক্রুশ চিহ্নের মালা।

মনিয়ার বাবা ছিলেন পোতুর্গীজ পাদ্রি আর মা বাঙালি হিন্দু। বাবা শৈশবে তাদের ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হলে মা অনেক ঘাটের জল খেয়ে অবশেষে সর্বানন্দ ভবনে মানে মিলুদের বাড়িতে কিছুদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর মিলুর বাবার চেষ্টায় এই লাল গির্জায় সেবিকা হিসেবে কাজ পেয়ে এখানেই চলে আসেন। সেইসূত্রে মিলুদের পরিবারের সাথে মনিয়াদের চেনাজানা। মনিয়ার মা মাঝেমধ্যে ওদের বাড়িরও নানাকাজ বাজ করে দেন।

আসলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতে এই পথটা একটু ঘুরপথ। অন্য পথটি ধরেই সাধারণত ওরা আসা যাওয়া করে। মিলু বুঝতে পারে ভুল করে সে চলে এসেছে এপথে। তবু মনিয়াকে সে কথা না বলে একটু মজা করে বলে – ভাবলাম এপথে এলে যদি একবার তোমার সাথে দেখা হয়ে যায় – তাই …

মনিয়া মিলুর থেকে বয়েসে সামান্য ছোট হলেও ভারি বুদ্ধিমতী আর ছটফটে। গাছে চড়া, সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, শাপলাশালুক, পদ্ম তোলা বা বাগান থেকে নানা বুনোফল তোলা – সবেতেই সে ভয়ড়রহীনা এবং চৌকশ। মিলুও কখনো সখনো মনিয়ার সঙ্গী হয় ঘুরে বেড়ায় মাঠঘাট জলাজঙ্গলে। এইতো সেদিন ওরা দুজনে মিলে ভাটফুল তুলতে গিয়েছিল।

মিলুর কথা শুনে মনিয়া মৃদু হাসে। সে জানে মিলু কেমন উদাস আর ভাবুক ছেলে। বুঝতে পারে – মনের ভূলেই সে এসে পড়েছে এপথে। তবু বলে – সত্যি বলছো?
মিলু উত্তর না দিয়ে শুধু একটু হাসে।
-ভেতরে যাবে ? মনিয়া বলে।
– না না। বেশি দেরী হলে মা ভাববেন।
– এসো না একটু। ঐ ঝাউগাছের ওখানে গিয়ে বসি। আর একটু ক্ষণ থাকলে এমন কিছু দেরী হবে না- কাকীমাকে বোলো গির্জেয় গিয়েছিলে। – বলে মিলুর হাতটা ধরে মনিয়া।

গির্জার ভেতরের ঝাউগাছের সারি মিলুর যে বড় প্রিয় -সেটা মনিয়া জানে।
-আচ্ছা, চল তাহলে। কিছুক্ষণ বসেই যাই।
মিলু সম্মতি জানায়।

গির্জার গেট পার হয়ে ওরা দু’জন ঝাউসারির পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে দু’জনে। তারপর মিলু বলে – আর দেরি করবো না। এবার আমাকে বাড়ি যেতে হবে। নয়তো মা চিন্তা করবেন।
মনিয়া আস্তে আস্তে বলে – আচ্ছা চল তাহলে। তোমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিই।
গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনিয়া বলে – মিলুদা, তুমি যখন বড় হয়ে চাকরি করতে কোলকাতায় চলে যাবে, তখন আমার কথা তোমার মনে থাকবে ?
– তোমাদের ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। কোনোদিনও কোথাও যাব না।
মনিয়া মায়া ভরা চোখে মিলুর দিকে তাকায় আর
মিলুও একবার মনিয়ার মুখের দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটে।

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কুসুম-কুমারী

inbound1642887084

পর্ব – ৯

রাতে সত্যানন্দ নিজের পড়ার টেবিলে লেখালেখি করছেন। অশোক ঘুমোচ্ছে। পরিবারের সকলের রাতের খাওয়া হয়ে গেলেও মায়ের রান্নাঘরের কাজ শেষ হয়নি।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিলু গতরাতে মায়ের বলা বেহুলার গল্পটার কথা মনে করছে। চাঁদসওদাগরের মধুকর কালীদহে ডুবে যাওয়ার কথা – বেহুলার মৃত স্বামিকে নিয়ে কলার ভেলার করে ভেসে যাওয়া সেই গাঙ্গুর নদীর কথা – গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে স্বর্গে পৌঁছে দেবসভায় বেহুলার নৃত্যগীতের কথা – মনে করছে আর রোমাঞ্চিত হচ্ছে। কল্পনার চোখের সামনে যেন ভেসে উঠছে চলমান চিত্রের মত সেই সব কাহিনী। দুই তীরের শস্যক্ষেত, সবুজ বনানী যেন সকরুণ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছে উথাল পাথাল ঢেউকে উপেক্ষা করে স্বর্গের খোঁজে ভেসে যাচ্ছে বেহুলার ভেলা।
বেহুলার সাথে সাথে মিলুও যেন কলার ভেলায় ভেসে চলেছে গাঙ্গুরের জলে…

– মিলু, ঘুমিয়েছ ?
মায়ের কন্ঠস্বরে সম্বিত ফিরে পায় মিলু।
বলে – না। তুমি এলে ঘুমোব।

-তোমার ছেলেরা তোমাকে ছাড়া কিছু করতে পারে? হেসে বলেন সত্যানন্দ।

কুসুমকুমারীও হাসেন।
-সে তুমি একদম ঠিক বলেছো। কী আর করা যাবে বলো ?
বলে বিছানায় উঠতে যাচ্ছিলেন কুসুমকুমারী।

কুসুম! – সত্যানন্দ ডাকেন।
– বল। কুসুমকুমারী স্বামির কাছে এগিয়ে যান।
– বলছি, তোমার গল্পটা মনমোহনের খুব পছন্দ হয়েছে। এরকম পৌরাণিক কাহিনি নিয়ে আরো কিছু গল্প লেখার কথাও বলেছে। পরে তোমার সেইসব গল্প নিয়ে একটা বই করবে নাকি ভাবছে।
– বাহবা। ঠাকুরজামাই দেখছি আমাকে নিয়েই পড়ে আছেন।
হাসেন কুসুমকুমারী।

– আমিও একটা প্রবন্ধ লিখলাম আগামি সংখ্যার ব্রহ্মবাদীর জন্য। তুমি একবার দেখে দিলেই ফ্রেস করে প্রেসে পাঠাব।
-তা আমাকে আবার দেখতে হবে কেন ?
-তুমি একবার না দেখে দিলে নিশ্চিন্ত হতে পারি নে।
মৃদু হেসে কুসুমকুমারী বলেন- আচ্ছা দেব।

মিলু খুব মন দিয়ে শুনছিল মা বাবার কথা। বাবা এত বিদ্বান হয়েও মায়ের প্রতি তার এই আস্থা দেখে অবাক হয়। সাথে সাথে গর্ববোধও হয় মায়ের জন্য।

– আর বলছি স্কুলে কাল থেকে নতুন ছাত্র ভর্তি শুরু হবে। আমি হেডস্যার জগদীশবাবুকে বলে রেখেছি। তুমি তোমার সময়মত ছেলেকে ভর্তি করে দিয়ে এসো।
– আমার আবার যেতে হবে কেন ? স্কুলে যাবার সময় তুমি নিয়ে গেলেই তো হয়।
– সে হয়। কিন্তু তোমার ছেলে কি মা ছাড়া যেতে চাইবে?
মজার ছলে হাসলেন সত্যানন্দ।
– আচ্ছা কালই তাহলে তোমার সাথে যাব।

কালই স্কুলে ভর্তি হবে – ভেবে মিলুর মনে যেন একটা ভিন্নতরো আনন্দ আর উত্তেজনা শিহরণ খেলে গেল।
কুসুমকুমারী বিছানায় গেলে মিলু বলে – মা, তাহলে তো কাল সকাল সকালই উঠতে হবে। তাই না?
– সে তুমি তো প্রতিদিনই সকাল সকাল ওঠো। ওরকম সময় উঠলেই হবে। অনেক রাত হল। এখন ঘুমোও।
ছেলের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মা বললেন।

মিলু আর কোনো কথা বলল না।

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কুসুম-কুমার

IMG_20221026_102736

পর্ব -৮

– মিলু দাদা, ও মিলু দাদা!
কারো একটা ডাকার শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন ব্রহ্মানন্দ।
– ও মামুদালি এসেছো? – তা চল বাগানের দিকে।
– শুধু আপনে গেইলে তো হইবে না কত্তাবাবু। আমার যে মিলু দাদারে লাইগবে। – মামুদ আলি বলে।

মামুদ আলি মাইল দেড়েক দূরের গাঁয়ের এক গরীব গাছি। এ বাড়ি সে বাড়ি গাছের ফলাদি পেড়ে দিয়েই তার সংসার চলে। মিলুদের বাড়ীর নারকেল, আম, কাঁঠাল সব ফলাদিও পেড়ে দেওয়ার দায়িত্ব ওর।

গতকাল বিকেল কাকা ব্রহ্মানন্দের সাথে হাঁটতে বের হয়ে মিলু বাড়ির গাছের সুপুরী পাকার কথা জানিয়েছিল কাকাকে। বাড়ির বাগানে কোথায় কোন গাছে কি ফল ধরেছে সবই মিলুর নখদর্পনে। আর এ ব্যাপারে মিলুর কাকা বাবা সবাই মিলুর কাছ থেকে খবরটি নিয়ে নেন।
সুপুরী পাকার কথা শুনে কাকা বলেছিলেন – চল তাহলে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে মামুদালিকে বলে আসি।
মিলুও উৎসাহের সাথে রাজি হয়ে গিয়েছিল মাসুদালিদের গাঁয়ে যেতে।
শহর পেরিয়ে গাঁয়ের কাঁচাপথ কাকা ভাইপো গল্প করতে করতে চলেছিল। হেমন্তের বিকেলের নরম রোদের পরশ বড় ভাল লাগছিল মিলুর। গাঁয়ের রাস্তার দু’পাশে কখনও জলা, কখনও উঁচুজমি। ছড়ানো ছিটানো দূরে কাছে ছোট বড় বাড়ি। নানান রকম গাছগাছালির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে কাকার কাছ থেকে মাঝে মাঝে জেনে নিচ্ছিল কোনটি কী গাছ। বাবলা, হিজল, জিয়ল, তাল, তমালসহ কত বুনোগাছ- বুনোফুল- আর জলায় লাল নীল সাদা-শাপলা, পদ্ম, হোগলা, …
গ্রামের অপরূপ দৃশ্যাবলী মিলুর মনকে অপার মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিয়েছিল।

মামুদ আলি বলে – কত্তাবাবু আমি বাগানে যাইচ্ছি। আপনে আহেন মিলু দাদাকে ডাইক্যে নিয়ে।
মামুদ আলি বাগানের দিকে এগোয়ে পাটের মোটা আলগা পাকের দড়ি দিয়ে তৈরি ফাঁদি হাতে।

মিলুও এতক্ষণ বাগানেই ছিল। উঠোনে কথাবার্তা শুনতে পেয়ে বুঝতে পারে নিশ্চয়ই গাছিদাদা এসে পড়েছে।

মিলুকে হঠাৎ সামনে দেখতে পেয়ে মামুদ আলি সানন্দে বলে – এই যে মিলু দাদা, তুমি এই হেনে ? চল। কও তো কুন কুন গাছে হুবরী পেইক্যেছে ?

ওরা বাগানের ভেতরে ঢুকে পড়ে। মিলুর কাছ থেকে জেনে নিয়ে নিয়ে মামুদ আলি এ গাছ সে গাছ করে করে সুপুরী পেড়ে চলেছে। আর পিছন পিছন মিলু গিয়ে সেগুলো জড়ো করে রাখছে এক জায়গায়।
মামুদ আলির গাছে চড়া দেখে মিলুর মনেও সাধ জাগে গাছে চড়ার। বলে – গাছিদাদা, তুমি কার কাছ থেকে এমন সুন্দর গাছে চড়া শিখেছ?
– সে কী আর মনে আছে? কুন হোট্ট বিলায় শিখ্যেছি।
– আমাকে শিখিয়ে দেবে গাছে চড়া ?
– তুমি শিইখব্যে? কী এর লাইগ্যে? তুমার কি আর গাছে উঠা লাইগবে ?
– সে না লাগে না লাগুক। শিখতে তো আর দোষ নেই।
– আইচ্ছা। হুবরী গুলোন পেইড়ে নি আগে। তারপর শিইখ্যে দেব।

আরে ঐ কামরাঙা গাছটা নড়ছে কেন? হঠাৎ মিলুর চোখে পড়ে দক্ষিণের দিকে যে কামরাঙা গাছটা আছে – সেটার ডালপালা কেমন যেন নড়াচড়া করছে। মনে হচ্ছে কেউ গাছে আছে। প্রচুর ফল ধরেছে গাছে। পেকেওছে কিছু কিছু। গাছটিতে প্রায় সারাবছরই ফল ধরে। কামরাঙা ফলটি দেখতে মিলুর বড় ভাল লাগে।
গাছিদাদা, তুমি এই সারির গাছগুলোর সুপুরী পাড়তে লাগ। আমি একটু ওদিকে যাচ্ছি – বলে মিলু গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় কামরাঙা গাছের দিকে। দক্ষিণ পাশে ওদের বাগানের সীমানার পরেই গাঁয়ের দিকে যাবার রাস্তা। ওখান থেকে একটা সুড়ি পথ বাইরে বেরিয়ে গেছে। পাড়ার অন্য বাড়ির মেয়ে বৌরা ওদের পুকুরে আসে ঐ পথ দিয়ে।

কামরাঙা তলায় গিয়ে দাঁড়ায় মিলু। দেখে গাছে প্রায় ওরই সমবয়সী পাশের বাড়ির সেই শ্যামলা মেয়েটি যাকে মাঝে মাঝেই দেখে পাশের জলা থেকে সন্ধ্যায় এক দল হাঁস তাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি যেতে। ওর সাথে তেমন একটা কথাবার্তা না হলেও অপরিচিত নয়। মেয়েটির শ্যামলা বলেই সকলে শ্যামা বলে ডাকে। তার ভাল নাম তরুলতা কখন যেন গায়ের রঙের আড়ালেই ঢাকা পড়ে গেছে নামটি মিলুর বেশ লাগে।
মিলুকে দেখে একটু ভয় পেয়ে যায় শ্যামা। তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নেমে পড়ার চেষ্টা করে।
মিলু বলে – নামছ কেন? পাড়ো না পাকাপাকা দেখে কয়েকটা!
মিলুর কথায় সাহস পেয়ে মেয়েটি দেখে দেখে কয়েকটা টকটকে হলুদ রঙের কামরাঙা পাড়ে। তারপর কাপডের খোটায় জড়িয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসে।
তুমি নেবে ? – শ্যামা মিলুর দিকে দু’টো কামরাঙা এগিয়ে ধরে।
মিলু মেয়েটির মুখের দিকে তাকায়। কালো হলেও ভারি সুন্দর তো দেখতে শ্যামাকে। এত কাছ থেকে তো কখনো ওকে দেখে নি মিলু। –
শ্যামা আবার বলে – এই দু’টো তুমি নাও আর এই কটা আমি।
মিলু বলে – না, তুমি সবগুলোই নিয়ে যাও।

মেয়েটি মৃদু হেসে মায়াভরা টানাটানা দু’টো চোখ মেলে মিলুর দিকে তাকায়।

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কুসুম-কুমার

inbound1750020987

পর্ব – ৭
মামাবাড়ি থেকে ফেরার পর মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় মিলুর। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকে। দুইদিন বাগানে উঠোনে তেমন একটা ঘোরাঘুরিও করেনি। আজ বিকেলে মায়ের বইয়ের তাক থেকে একটা কবিতার বই হাতে নিয়ে ঠাকুরমার ঘরের দিকে যায়।
ঠাকুরমার এই ঘরটি একটু বেশি নির্জন। শোয়ার সময় ছাড়া ঘরটিতে সারাদিন তেমন কেউ আসে না। কাঠের বেড়া আর গোলপাতার ছাউনি দেওয়া আটচালা ঘরের চারপাশে খোলা বারান্দা। মুল ঘরে দু’টো কক্ষ। একটাতে থাকেন ঠাকুরমা ও মিলুর ছোট পিসিমা স্নেহলতা দাশ। শিক্ষিকা ছোট পিসিমা বিয়ে থা করেন নি। আর অন্যটিতে থাকেন ঠাকুরমার চিরকুমার ভাই মানে মিলুর মামাদাদু।

ঘরটির পেছনের দিকের খোলা বারান্দায় গিয়ে বসে মিলু।
বইটি খোলে। পড়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই যেন মন বসাতে পারছে না বইয়ে। শুধুই মনে পড়ছে মামাবাড়ির ঘোরাঘুরির কথা। দুপুরে সাঁতার শেখার কথা। কলার ভেলায় চড়ে ভেসে বেড়ানোর কথা। জলসিঁড়ি ধানসিড়ি…
বইয়ের পাতার দিকে চোখ আর মন তার ঘুরে বেড়াচ্ছে স্মৃতির পথে পথে।

এদিকে অনেকক্ষণ মিলুকে দেখতে না পেয়ে মা খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছেন। এ ঘর সে ঘর বাগান কোথাও না পেয়ে শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে গিয়ে বলেন- মা, মিলু কি কারো সাথে কোথাও গেছে ? অনেকক্ষণ ধরে ওকে দেখতে পাচ্ছি না।

শ্বাশুড়ি মা মৃদু হেসে বৌমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন তার ঘরের পেছনের দিকে। তিনি অনেক আগেই মিলুকে গুটিগুটি পায়ে পেছনের বারান্দার দিকে যেতে দেখেছেন।
বলেন- দেখো, ঐ যে বই পড়ছে তোমার ছেলে। এবার মনটা শান্ত হয়েছে তো?
– ও এখানে বসে আছে আর আমি সারাবাড়ি খুঁজে খুঁজে হয়রান।
– আমি আগেই দেখেছি। ও একটু একা একা নির্জনে থাকতে চায় বুঝতে পেরে আমি আর বিরক্ত করতে কাছে যাই নি।
ঠাকুরমা বলেন।

মা আস্তে আস্তে ছেলের কাছে যান। ডাকেন – মিলু, সন্ধ্যে হয়ে এল যে। এখন ঘরে চল। পড়তে বসতে হবে।
মিলু শান্ত চোখে মায়ের দিকে তাকায়। কোনো কথা বলে না। বইটি গুটিয়ে নেয়। তারপর সুবোধ বালকের মত ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

ঘরে গিয়ে যথাস্থানে বইটি রাখে।
মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন- মন খারাপ লাগছে বাবা ? মামার কথা মনে পডছে ?
মিলু মায়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসে।

মা ছেলের মনের এই ভাব জানেন। সে যখন কোনো একটা ভাবনার ঘোরে থাকে তখন এরকমই চুপচাপ হয়ে যায়। তিনিও আর বিরক্ত না করে দুইভায়ের জল খাবার আনতে রান্না ঘরের দিকে চলে যান।

মিলুর বাবা ঘরে ঢুকে দু’ভাইকে শান্তশিষ্ট ভাবে বসে থাকতে দেখে বললেন – কী রে, তোমরা চুপচাপ কেন? মা কোথায়?
পোশাক পাল্টাতে পাল্টাতে আবার বললেন – মিলু, তোমার জন্য ফাইভের একটা ইংরিজি বই এনেছি। দেখেছ?

এতক্ষণ বাবার কোনো কথারই সে উত্তর দেয়নি। কিন্তু নতুন বইয়ের কথা শুনে কী যাদুবলে যেন তার মৌনব্রত ভেঙে যায়। চোখে মুখে ফুটে ওঠে খুশির রেখা। কৌতুহল আর উৎসাহের সাথে বলে – ইংরিজি বই ? কই – দেখিনি তো?

এমন সময় মাও ঘরে ঢোকেন দুইহাতে দু’টো খাবারের বাটি ধরে। মিলুর খুশিভরা মুখটা দেখে বুঝতে পারেন নিশ্চয়ই ওকে ওর বাবা এমন কিছু বলেছেন যা ওর পছন্দের। আর তাতেই একনিমেষে ছেলের মন থেকে পালিয়ে গেছে মনখারাপের দুষ্টু ভূতটা।
মাকে দেখতে পেয়েই মিলু বলে – মা, বাবা আমার জন্য নতুন বই এনেছেন – তুমি জানো ? কোথায় রেখেছ?
মা এতক্ষণে বুঝতে পারেন ছেলের হঠাৎ মন ভাল হয়ে যাবার কারণ। তিনি জানেন মিলুর দু’টো জিনিস সবচেয়ে পছন্দের – বই আর প্রকৃতির মধ্যে ঘুরে বেড়ানো।
মৃদু হেসে বলেন- হ্যাঁ, আছে আমার কাছে।
-তা আমাকে তো বলো নি?
আসলে তিনি বিষয়টি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। বললেন – আমার মনে ছিল না বাবা। এইতো এখুনি সেই বইটাই পড়াবো। কিন্তু তার আগে এগুলো খেয়ে নাও দু’ভায়ে।
বলে দু’টো বাটি বাড়িয়ে দিলেন দুই ছেলের দিকে।
মিলু বাটিটা হাতে নিয়ে মুড়ির ভেতরে কয়েকটা নারকেল নাড়ু দেখে খুবই খুশি হল। এই খাবারটি মিলুর ভারি পছন্দের। মা জানেন মিলু একটু মিষ্টি খাবার খেতে বেশি ভালবাসে। তাই ঘরে পিঠে নাড়ু এমন করে রাখেন।
খেতে খেতে মিলু বলে – মা, আর নাড়ু আছে ?
– আছে। কাল আবার খেয়ো।
মিলু আর কথা না বলে খেতে থাকে।

হঠাৎ মেঝ বৌঠান, মেঝ বৌঠান – বলে ডাকতে ডাকতে মনমোহনবাবু ঘরে ঢোকেন।
সত্যানন্দ বলেন- কলকাতা থেকে কখন ফিরলে ?
– এই এখুনি। বৌঠানকে একটা সুখবর জানানোর জন্য সোজা চলে এলাম।
আনন্দ-উত্তেজনায় যেন ফেটে পড়লেন মনমোহন বাবু।
কুসুমকুমারী বলেন- আমার জন্য সুখবর ?
সত্যানন্দ কিছুটা কৌতুহলের সাথে বললেন – কী এমন সুখবর যে বাড়ি না গিয়ে সোজা এখানেই চলে এলে?
-কলকাতা গিয়ে মুকুল পত্রিকার অফিসে গিয়েছিলাম। রামানন্দবাবুকে তো চেনেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। উনি বললেন ওনার প্রকাশিত বর্ণশিক্ষা প্রথম ভাগ বইটির একটি নতুন সংস্করণ করতে চান।
কুসুমকুমারী বলেন- তো?
– তার জন্য আপনাকে কিছু যুক্তাক্ষর বর্জিত ছোট ছোট পদ্য লিখে দিতে হবে। ভাবুন তো, কি সম্মানের কথা। আপনার লেখা শিশুদের পাঠ্য বইয়ে থাকবে!

মায়ের লেখা শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে থাকবে খবরটি শুনেই মিলুর মনটা গর্বে ভরে ওঠে। সোৎসাহে বলে –
আমার মায়ের কবিতা শিশুরা পড়বে ?
-পড়বেই তো! তোমার মা কি আর আর দশজনের মায়ের মত ? আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে বৌঠান ! – মনমোহনবাবু উচ্ছ্বসিত৷
আমি কি পারবো? – কুসুমকুমারীর কন্ঠে সংশয়।
– কেন পারবে না? খুব পারবে।
মিলুর মুখ থেকে সাথে সাথেই কথা কটা বেরিয়ে যায়। আসলে মায়ের প্রতিভা আর যোগ্যতায় মিলুর আস্থা আর বিশ্বাস প্রশ্নাতীত।
সত্যানন্দ একটু মজা করে বলেন- তোমার বড়পুত্র যখন বলছে তখন নিশ্চয়ই পারবে। লেগে যাও।

মায়ের প্রতি ছেলের এই অটুট বিশ্বাস দেখে সত্যানন্দ আর মনমোহন অবাক হয়ে যান। আর ছেলের কাছ থেকে এই দ্বিধাহীন স্বীকৃতি পেয়ে মায়ের দু’চোখও আনন্দাশ্রুতে টলমল করে ওঠে।

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কুসুম-কুমার

IMG_20221024_105711

পর্ব -৬
সকালে একপ্রস্থ মামার সাথে ঘুরে এসেছে মিলু। প্রথম হেমন্তের সকাল। কাঁচাসোনা রোদের নরম পরশ নিতে নিতে ওরা পৌঁছে গিয়েছিল কীর্তনখোলার তীরে। উছলে পড়া নদীর ওপারের মাঠভরা সোনার বরণ পাকা ধান। মিলু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে সেই অনাবিল রূপ সৌন্দর্য্য।
স্টীমারঘাট পেরিয়ে নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে মিলু বলে – মামা নদীটার নাম কীর্তনখোলা হয়েছে কেন জানো ?
– ঠিক জানি না। তবে যেটুকু শুনেছি নদীর পার ঘেঁষেই শহরের সবচেয়ে পুরনো যে হাটটি রয়েছে – সেখানে নাকি এক সময় মাঝে মাঝে কীর্তনের উৎসব হতো। সেই থেকে এই নদীর নাম হয়তো কীর্তনখোলা হয়েছে। কীর্তনখোলার নাম একসময় নাকি জলসিঁড়ি ছিল।
– জলসিঁড়ি : বাহ ভারি সুন্দর নাম তো।
মিলুর নামটা খুব পছন্দ হয়েছে। আমি নদীটিকে জলসিঁড়িই বলব। এত সুন্দর নাম থাকতে কীর্তনখোলা বলব কেন?
– আচ্ছা তাই বলিস।
মিলু মনে মনে বারবার জলসিঁড়ি নামটা বলতে লাগল।
মিলুর জলসিড়ি নামটা খুব পছন্দ হয়েছে বুঝে মামা বললেন – জানিস ঝালকাঠির ওদিকে আর একটা নদীরও ওরকম সিড়ি দিয়ে নাম আছে।
অতি উৎসাহে মিলু বলল- কী নাম তার?
– ধানসিঁড়ি।
বাহ বাহ দারুণ সুন্দর নাম। ধানসিড়ি। জলসিড়ি। ধানসিঁড়ি।
কয়েকবার সুর করে করে আউড়ে নিল নাম দুটি। তারপর বলল – মামা আমাকে তুমি একদিন ধানসিঁড়ি নদীটা দেখাতে নিয়ে যাবে। নাম শুনেই দেখতে খুব ইচ্ছে করছে নদীটাকে।
– ঠিক আছে। যাব একদিন। ওদিকেই তো তোর মামির বাপের বাড়ি।
*****

বাড়ি ফেরার পথে একটি বাঁশবনের পাশে মিলু হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে – মামা দেখ ঐ টা কী?
-কোনটা?
-ঐ যে লতার মত গাছটায় থোকাথোকা দেখাচ্ছে।
মিলু আঙুলের ইশারায় মামাকে দেখায়।
– ও, ওটা তো কুঁচফল। নিবি ? দাঁড়া। তুলে দিচ্ছি।
মামা বাগানের দিকে এগিয়ে গিয়ে কয়েকটা ফল পেড়ে এনে দিলেন ভাগ্নের হাতে।
লালকালো রঙের কুঁচফল পেয়ে মিলু খুব খুশি।
আরো খানিকটা এগোনোর পর একটা বেতবাগানের কাছে এসে মিলুর মামা বললেন – গাছে এক থোকা বেতফল পেকেছে মনে হচ্ছে।
– বেতফল ? মিলুর মনে বিস্ময়।
– হ্যাঁ। পেড়ে আনি।
– মামা সাবধানে যেও। গাছে তো কাটা ভরা।
-জানি।
মামা খুব সাবধানে ছিঁড়ে আনলেন এক গুচ্ছ পাকা বেতফল।
– এগুলো কি খাওয়া যায়? – মিলু জানতে চায়।
-হ্যাঁ। বাড়ি চল। তারপর …
******

এখন বাড়ি এসে সেই কুঁচ আর বেতফল নিয়ে বারান্দায় বসেছে মিলু। পাশে জড়ো হয়েছে মামাতো ভাইবোনেরা। মিলুর প্রায় সমবয়সী মামাতো বোন খুন্তি। যার ভাল নাম লীলাময়ী। সে দুটো কুঁচ হাতে নিয়ে বলে – এই দুটো আমি নেব মিলুদা ?
খুন্তির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মিলু বলে – বাড়ি যাবার আগে সবগুলোই তোমাকে দিয়ে যাব।
খুন্তি খুশি হয়ে মিলুর কাছে সরে বসে বলে- তুমি খুব ভাল মিলুদা।

মা এসে বললেন – ওগুলো এখন রাখো। কত বেলা হল দেখেছো। সেই সকাল থেকে তো মামা ভাগনে মিলে আগান বাগান ঘুরে বেড়াচ্ছো। পেটে কিছু দিতে হবে না কি?
আশেপাশে তাকিয়ে দেখে আবার বলেন- তোর মামা কোথায়?
– মিলু মায়ের কোনো কথাই যেন শুনতে পায়নি। কুঁচ আর বেতফল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কেবলই দেখে যাচ্ছে।
মিলুর দাদামশায় চন্দ্রনাথবাবু গান গাইতে গাইতে বাড়ি ঢুকলেন। বারান্দায় ওদের হাতে কুঁচ ও বেতফল দেখেই গেয়ে উঠলেন-
কুঁচবরণ কইন্যার দেহি কাজলবরণ কেশ
বেশ বেশ বেশ –
আহা বেশ বেশ বেশ।
মরা মাইনষের চোইখ্যের মতন দেইখতা রে ব্যাত ফল
চোইখো আহে জল –
আহা চোইখো আহে জল।

মিলুর মা কুসুমকুমারীর বাবা চন্দ্রনাথ দাশ একজন নামকরা হাসির গানের গীতিকার ও স্বভাব কবি। কথায় কথায় যেন তার ছন্দ নাচে। শব্দে শব্দে মিল যেন অনাবিল আনন্দে ঝরে পড়ে তার মুখ থেকে।

মিলুর মামা বাড়ি ফিরে এলে তাদের সবাইকে খেতে দিলেন মিলুর মামিমা।
খেতে বসে মামা বললেন – মিলু আজ তোকে সাঁতার শেখাতে নিয়ে যাব। সে পুকুরে কলার ভেলাও আছে। তাতেও চড়তে পারবি।
– কী মজা। আমি সাঁতার শিখব। ভেলায় চড়বো।
মিলুর আনন্দ আর দেখে কে ?
আলোকও দাদার দেখাদেখি আধো আধো বোলে বলল – আমিও দাব মামা।
মিলুর মা হেসে বলেন- আর তুমিও পারো দাদা। যেমন মামা তেমন হয়েছে তার ভাগ্নে।

(চলবে)

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কুসুম-কুমার

inbound1934730603

পর্ব – ৫
সন্ধ্যায় মিলু আর অশোক বসে আছে মামাবাড়ির ছাদে তাদের প্রিয় বড় মামা প্রিয়নাথ দাশের সাথে। হাসিখুশি আড্ডা প্রিয় আর শিশুর মত সরল বড় মামা -মামা নয় যেন মিলুর সমবয়সী বন্ধু। যত বায়না সবই এই মামার কাছে। আর ভাগ্নেকে পেলে মামাও সব কিছু ভুলে তাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে থাকেন। মিলুর সাথে একদিকে তার খুবই মিল আছে। প্রকৃতির মাঝে গেলে মিলুর উদাস হয়ে যান। সুযোগ পেলেই ছুটে যান মাঠ ঘন বন জঙ্গল আর নদী খালের কাছে।

মিলু বলে – মামা শুনেছি তোমাদেরও নাকি আমাদের মত অন্য জায়গায় আগে বাড়ি ছিল?
– ঠিক শুনেছিস। তোরা তো ঢাকাইয়া। আমরা কিন্তু খোদ বরিশাইল্যা। আমাদের আগেও এই বরিশালেই বাড়ি ছিল। তবে সে এক গ্রামে। তার নাম গৈলা। আমার বাবা চন্দ্রনাথ দাশ মানে তোর দাদামশায় ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হয়ে বরিশাল ব্রাক্ষ্মসমাজে যোগ দেন। সেই কারণে গ্রামের গোঁড়া হিন্দুরা একঘোরে করে দেয়। নানা অত্যাচার করতে থাকে যাতে আমরা গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হই। এবং তখন থেকেই পৈতৃক ভিটেমাটি ছেড়ে এই বরিশাল শহরেই বসবাস শুরু। তোর মায়ের কিন্তু এই বরিশাল শহরেই জন্ম।

মিলু চুপচাপ শুনছিল। বলল -শুনেছি মা কোলকাতায় পড়াশুনো করেছেন।
– হ্যাঁ। তবে প্রথমে কিছুদিন এখানেই পড়েছে। সে স্কুলটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। তখন ওকে কোলকাতায় পাঠানো হয় পড়তে। সেখানকার বেথুন স্কুলে ফার্ষ্ট ক্লাস অবধি পড়ে, তারপরেই বিয়ে হয়ে যায়।

খাইয়েদাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবেন বলে কুসুমকুমারী এসে অশোককে নিয়ে গেলেন।
মিলু অন্ধকার আকাশের দিকে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে মামাকে বলল – মামা আকাশে কত তারা ফুটেছে, দেখো।
হ্যাঁ, আজ অমাবস্যার রাত তো। তাই …
মামা বললেন – ঐ যে দেখছিস, যে তারাগুলো মিটমিট করছে ওগুলো নক্ষত্র। আর যেগুলো স্থির হয়ে আলো দিচ্ছে, ওগুলো গ্রহ।
মামা ভাগ্নের গল্পের অভিমুখ পালটে গেল।
ভাল করে নিরীক্ষণ করে একটা তারা দেখিয়ে মিলু মামার কাছে জানতে চায় – ঐ যে বড় তারাটি দেখা যাচ্ছে ওটাই কি ধ্রুবতারা ?
মামা সোৎসাহে দেখে নিয়ে বললেন – ঐটা তো ? হ্যাঁ ওটাই ধ্রুবতারা।

বইয়ে গ্রহ তারা নিয়ে কিছুকিছু জানার পরেই মহাকাশ সম্পর্কে মিলুর কৌতূহল বেড়েছে। আজকে এই চাঁদহীন রাতের অন্ধকার মহাকাশের অগুনতি আলোর ফুল তার মনটাকে আরো কৌতূহলী করে তুলেছে।

প্রিয়নাথ তার প্রিয় ভাগ্নেকে আকাশের তারাদের সঙ্গে পরিচয় করাতে শুরু করলেন।
আর মিলুর কল্পনা বিলাসী মন সেই অন্ধকারের পথ ধরে যেন হারিয়ে গেল অনন্ত মহাকাশের নক্ষত্রে নক্ষত্রে।

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কুসুম-কুমার

inbound960020235

পর্ব -৪
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে পত্রিকা পড়ছে মিলু। সন্ধ্যায় মায়ের কাছে দুভাই পড়াশুনো সেরে কিছুক্ষণ ঠাকুরমার এক ছোটভাই মামাদাদুর ঘরে গিয়ে গল্প করে এসেছে। ঠাকুর মায়েরা যখন বিক্রমপুর ছেড়ে এখানে চলে আসেন বাপ মা মরা এই মামাদাদুও তার দিদি-জামাইদাদার সাথে চলে আসেন। ঠাকুরমার থেকে বয়সে অনেক ছোট এই মামাদাদুকে ঠাকুরমা পুত্র স্নেহে বড় করে তুলেছেন। সহজ সরল বোকা বোকা স্বভাবের মানুষটি পুরোপুরিই এই পরিবারের উপর নির্ভরশীল। ঠাকুরমা তার ভাইকে অনেক চেষ্টা করেও বিয়ে করাতে পারেননি। সেই দাদুর সাথে দুষ্টুমি করে বড় মজা পায় মিলু।

বিকেলে বাবা স্কুল থেকে ফিরে মায়ের হাতে মুকুল পত্রিকাটি দিয়ে বলেছিলেন – কুসুম প্রায় একযুগ পরে তোমার আর আমার লেখা একসঙ্গে মুকুলে বেরিয়েছে। তোমার কবিতা আর আমার প্রবন্ধ।
মা হেসে বলেন- তাই? কই দেখি।

বাবার হাত থেকে পত্রিকাটি নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলেন।
বাবা বললেন – মনে আছে ? যে বছর আমাদের বিয়ে হয়ে ছিল সে বছরও একটা সংখ্যায় তোমার আমার লেখা একসঙ্গে ছাপা হয়েছিল।
– তোমার সে কথা মনে আছে?
মা মুচকি হেসে পত্রিকাটি পড়ার টেবিলে রাখলেন। বললেন – রাতে দেখব ক্ষণ। রান্না ঘরে অনেক কাজ পড়ে রয়েছে।
বাবা বললেন – তোমার সাথে আমার কিছু জরুরী আলোচনা আছে। কিন্তু এখন আমারও সময় নেই। এক্ষুনী বের হতে হবে। ব্রাহ্মসমাজের মিটিং রয়েছে। আসতে একটু রাত হতে পারে।
– আচ্ছা ওখানে কি বাবা আসবেন?
কুসুম কুমারী জানতে চান।
সত্যানন্দ বলেন- আসার কথা তো আছে।
-যদি আসেন তো আসতে বলো তো। একবার বাপের বাড়ি যেতে হবে। এবার মহিলা সমিতির মিটিংটা ভাবছি ও বাড়িতেই ফেলব।
– আচ্ছা
বেরিয়ে গেলেন সত্যানন্দ। কুসুমকুমারীও চলে গেলেন নিজের কাজে।

তখন বিছানায় বসে বসে মিলু মা বাবার কথাগুলো শুনেছিল। পত্রিকাটি পড়ার লোভও জেগেছিল মনে।
মায়ের লেখাটি গভীর আগ্রহে পড়ে ফেলে মিলু। কী অদ্ভূত এক মায়াময় লেখা। তারও মনে ইচ্ছে জাগে মায়ের মত কবিতা লিখতে।
খেয়ালই করেনি বাবা কখন ঘরে ঢুকেছেন। জামা কাপড় ছাড়তে ছাড়তে বলেন-কী রে? তুই এখনো ঘুমোস নি?
– না বাবা। এই পত্রিকাটি পড়ছি।
বাবা আর কোনো কথা না বলে পাশে নিজের খাটে গিয়ে বসেন।
একটু পরে ঘুমন্ত অশোককে কোলে নিয়ে কুসুমকুমারী ঘরে ঢোকেন। অশোক এতক্ষণ ঠাকুরমার ঘরেই ছিল। ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে স্বামীকে বলেন- কতক্ষণ এসেছো?
– কিছুক্ষন আগে। তোমার বাবাকে বলে এসেছি। কাল হয়তো আসবেন।
– আচ্ছা। আমি কিন্তু ও বাড়ি গিয়ে এবার সপ্তাহ খানেক থাকব। তুমি গিয়ে আমাদের নিয়ে আসবে।
– ঠিক আছে। তাই হবে।

পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে মিলু মা বাবার কথাবার্তা শুনছিল। মামাবাড়ি যাবার কথা শুনে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। বড় মামার সাথে তার ভারি ভাব। মামার সাথে ঘোরাঘুরি হবে। গল্প হবে – ভালই কাটবে কটা দিন মিলুর।
কুসুমকুমারী স্বামী কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন – বলছি মিলুর ফোর ক্লাসের বই শেষ হয়েছে। এবার ওকে স্কুলে ভর্তি করা যায়।
– আমিও তোমাকে সেটাই বলব ভাবছিলাম। ওকে এবছর আমাদের স্কুলেই ফাইভে ভর্তি করে দেব। নতুন ক্লাস শুরুর তো এখনও দুতিন মাস বাকি আছে। এ কটা দিন তুমি ইংরেজিটার দিকে একটু নজর দাও।
– আচ্ছা
স্কুলে যাবার কথা শুনে মিলুর মনের ভেতর এক অন্যতর খুশির আবেগ খেলা করে যায়।
কুসুমকুমারী নিজের খাটে এসে মিলুর কাছ থেকে পত্রিকাটি নিয়ে উল্টাতে লাগলেন।
কিছুক্ষণ পরে সত্যানন্দ আবার বললেন – কুসুম, মনমোহনের ইচ্ছে ব্রহ্মবাদীর আগামি সংখ্যায় যেন তোমার একটা গদ্য থাকে।
– হ্যাঁ উনি আমাকেও বলেছেন। ভাবছি পৌরাণিক কাহিনি গিয়ে একটা গল্প লিখব।
– বাহ খুব ভাল হবে।

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কুসুম-কুমার

0555

পর্ব – ৩

মিলুর বাবা সত্যানন্দ বরিশাল শহরের ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের শিক্ষক। অল্প বয়সে শিশুদের স্কুলে পাঠানোর পক্ষে নন তিনি। বাড়িতে ভাল মত পাঠ দিয়ে তবেই স্কুলে ভর্তি করতে চান ছেলেদের। তাই স্কুলে যাবার বয়স হলেও মিলুকে স্কুলে ভর্তি না করে বাড়িতেই প্রাথমিক পাঠ দেওয়া চলতে থাকে।
সকাল বেলায় সাংসারিক কাজের চাপে মা ছেলেকে পড়ানোর সুযোগ পান না।
তাই প্রতি সন্ধ্যায় মায়ের কাছে পড়াশুনো করে মিলু। পড়াশুনো সেরে মিলু আর অশোক ঠাকুরমার কাছে বসেছে প্রতি সন্ধ্যার মত আজও। মা রান্নাঘরে ঢুকেছেন রাতের খাবার তৈরীর জন্য। ঠাকুরমা গল্প করছেন তাদের ছেড়ে আসা ভিটেমাটির। অশোক এখনও অবুঝ শিশু। সে ঠাকুরমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েই পড়েছে হয়তো। মিলু কিন্তু গভীর মনযোগে শুনছে।
ঢাকায় পদ্মারই এক শাখানদী কীর্তিনাশার তীরে বিক্রমপুরের গাঁওপাড়া গ্রামে ছিল তাদের আদি বাড়ি। ঠাকুরমা সে সব স্মৃতি ভূলতে পারেননি। তাই সুযোগ পেলেই মেতে ওঠেন রোমন্থনে। গ্রামখানি কীর্তিনাশার জলে তলিয়ে গিয়েছিল।

সেই বিক্রমপুর আর পদ্মা নদীর গল্প, রাজা রাজবল্লভের একুশ চূড়াযুক্ত প্রাসাদ ‘একুশ রত্ন’ – এর গল্প শুনতে শুনতে বালক মিলু হারিয়ে যায় অতীত কল্পনার রাজ্যে।
হঠাৎ ধাক্কা খায় তার স্বপ্নের পথচলাতে।
মিলু দেখে মেঝ পিসেমশাই তাদের সামনে দাঁড়িয়ে। তিনি তার শ্বাশুড়ি মাকে বললেন – মেঝ বৌঠান কী রান্না ঘরে ?
জামাতার হঠাৎ আগমনে প্রথমটায় একটু হতচকিত হয়ে যান শ্বাশুড়ি। সামলে নিয়ে বলেন- তুমি কখন এলে বাবা ?
– এই এলাম। মেঝ বৌঠানকে খুব দরকার। উনি কি রান্না ঘরে ?
– হ্যাঁ।
মিলুর দিকে তাকিয়ে বললেন – যাও তো বাবা তোমার মাকে একবার ডেকে নিয়ে এসো তো।
মিলু মাকে ডাকতে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পরে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে মিলুর মা আসেন। সাথে সাথে মিলুও।
– আরে ঠাকুর জামাই যে। তা এই অসময়ে হঠাৎ আগমনের হেতু কী?
মিলুর মা একটু অবাক হয়েই জানতে চান।
– না এসে আর উপায় আছে ? আপনার কবিতা চাই এক্ষুনী।
– এখন কীভাবে দেব। লেখা আছে নাকি?
– সে জানি নে। পত্রিকা নিয়ে দাদা প্রেসে চলে গেছেন। পান্ডুলিপিতে আপনার লেখা না দেখেই ছুটে এলাম। আপনার লেখা ছাড়া ব্রহ্মবাদী বের হোক সে আমি মেনে নেব না।
– আপনার দাদা আমাকে কয়েকদিন আগে একটা লেখা দিতে বলেছিলেন কিন্তু কাজের চাপে আর লিখে উঠতে পারি নি। এই সংখ্যাটায় আমার লেখা নাইবা থাকলো।
ঠাকুরজামাই মনোমোহনবাবুও নাছোড়বান্দা।
অগত্যা মিলুর মা বললেন – আচ্ছা তাহলে একবার চেষ্টা করে দেখি।
শ্বাশুড়ি মায়ের কোলে ছোট ছেলে ঘুমিয়ে গেছে দেখে – দিন মা ওকে ঘরে শুইয়ে দিই বলে তাকে কোলে তুলে নিলেন।
মনোমোহন বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন – আসুন ঘরে একটু বসবেন ক্ষণ।
ঘরে গিয়ে অশোককে শুইয়ে দিলেন।
ঠাকুর জামাইকে বসার ব্যবস্থা করে দিয়ে
খাতা আর কলম নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।
মিলুও খাতা পেন্সিল নিয়ে ছবি আঁকতে বসে যায়।

মিলুর বাবা সত্যানন্দ বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। তার মেঝ ভগ্নিপতী মনমোহন চক্রবর্ত্তীকে নিয়ে পত্রিকা সম্পাদনার সকল কাজ করেন। এরা দুজনেই বরিশাল ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট মানুষ।
বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে সলজ্জ ভাবে কাগজটি এগিয়ে ধরেন ঠাকুর জামাইয়ের দিকে – দেখুন। ভাল হয়নি। রান্না করতে করতেই লিখলাম।
কাগজখানা হাতে নিয়ে জোরে জোরে পড়তে লাগেন মনোমোহনবাবু –

খোকার বিড়ালছানা

সোনার ছেলে খোকামণি, তিনটি বিড়াল তার,
একদণ্ড নাহি তাদের করবে চোখের আড়।
খেতে শুতে সকল সময় থাকবে তারা কাছে,
না হ’লে কি খোকামণির খাওয়া দাওয়া আছে?
এত আদর পেয়ে পেয়ে বিড়াছানাগুলি,
দাদা, দিদি, মাসি, পিসি সকল গেছে ভুলি।
সোনামুখী, সোহাগিনী, চাঁদের কণা ব’লে
ডাকে খোকা, ছানাগুলি যায় আদরে গলে।
“সোনামুখী” সবার বড় খোকার কোলে বসে,
“সোহাগিনী” ছোটো যেটি বসে মাথার পাশে।
মাঝখানেতে মানে মানে বসে’ “চাঁদের কণা”,
একে একে সবাই কোলে করবে আনাগোনা।

তারপর বললেন – বাহ্ অপূর্ব বৌঠান অপূর্ব। আপনী সত্যি স্বভাবকবি। তা না হলে রান্না করতে করতে এত সুন্দর কবিতা লেখা সম্ভব?
মিলুর মা কিছু একটা বলতে চাইছিলেন কিন্তু সে সুযোগ না দিয়েই মনমোহনবাবু আসি বলেই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যান।

মিলু ছবি আঁকার মাঝেও উৎকণ্ঠার সাথে সমস্ত ঘটনার দিকে খেয়াল রাখছিল। মায়ের এত তাড়াতাড়ি এত সুন্দর একটি কবিতা লিখতে পারার ক্ষমতা দেখে সেও অবাক হল। গর্বিত হল মায়ের জন্য। কোনো কথা সে বলল না। শুধু বিস্ময় ভরা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

ধারাবাহিক উপন্যাসঃ কুসুম-কুমার

IMG_20221018_090555

পর্ব – ২
একান্নবর্তী পরিবারের ছেলে মিলু। মা বাবা কাকা কাকিমা জ্যেঠা জ্যেঠিমা পিসিমা ঠাকুমা খুড়োতো জেঠাতো ভাই বোন মিলে সে যেন হাটখোলা। সারাক্ষণ হই হট্টগোল লেগেই থাকে। কর্মসূত্রে কেউ কেউ বাড়ির বাইরে থাকলেও তাদের আসা-যাওয়া চলত নিয়মিত।
ছোট্ট মিলুর ভালো লাগে না এত ভীড়। নির্জনতায় নীরবে থাকাটাই যেন তার প্রিয়। মা জ্যেঠিমা ঠাকুরমা পিসিমার চোখ এড়িয়ে সে মাঝে মাঝে চলে যায় বাগানে। গাছেদের মাঝে ঘুরে বেড়ায় একাকী। কখনো বা বাড়ির পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপলকে চেয়ে থাকে সামনের মিশনের দিকে। সেখানে সারি সারি ঝাউগাছ তাকে বড় টানে। আবার কখনো উঠোনের এক পাশে দাঁড়িয়ে উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

অবিভক্ত ভারতের পূর্ববাংলার ছোট্ট এক মফস্বল শহর বরিশাল। তারই এক কোণে গ্রামীন পরিবেশে পাঁচ সাত বিঘে জমির ওপর তাদের বিশাল টিনের চাল দেওয়া বাড়ি। চারদিকে ছড়ানো আম-জাম-নারকেল-সুপারী-কাঁঠাল-কলাসহ নাম না জানা অসংখ্য বুনোগাছ আর লতাগুল্ম-ঘাস। বালক মিলুর সাথে এদেরই যেন প্রাণের মিতালী।

পাড়ার সমবয়সীদের সাথে এখনও তার তেমন চেনাজানা হয়নি। কারণ যকৃতের কঠিন অসুখে পড়ে ডাক্তারের পরামর্শে দীর্ঘদিন তাকে বাইরে বাইরে থাকতে হয়েছে। হাওয়া পরিবর্তনের জন্য মা ও মাতামহের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে কলকাতা-দিল্লি-লখনৌসহ পশ্চিমের বিভিন্ন অঞ্চলের স্বাস্থ্যনিবাসে। সে কারণেই হয়তো পড়শি সমবয়সী বা বাড়ির সবার সাথে এখনও সহজ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তাছাড়া সে স্বভাবগতভাবেই নির্জনতা প্রিয়।

আজও বর্ষার পড়ন্ত বেলায় যথারীতি মিলু হাঁটতে হাঁটতে উঠোন পেরিয়ে বাগানের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎই চোখে পড়ে – কেউ একজন উঠোনের ঘাসগুলো কাটছে। সেদিকে এগিয়ে যায় মিলু।

আসলে বর্ষাকালে উঠোনে বড়বড় ঘাস জন্মেছে। বাবা কাজের লোক হিসেবে গাঁয়ের গরীব চাষা ফকিরকে ডেকেছেন সেই ঘাস কাটার জন্য। ফকির কাস্তে হাতে পরিস্কার করছে সেই ঘাসগুলো। মিলু ফকিরকে চেনে। বাড়ির নানা কাজবাজ করতে প্রায়ই সে আসে। মিলুর সাথে তার গল্পসল্পও হয় মাঝেমধ্যে। ফকির কাকাকে মিলুর ভালই লাগে। এই তো সেদিন কাজ করতে করতে ফকির মিলুকে কীর্তিনাশা নদীতে নৌকা বাওয়া ও মাছ ধরার গল্প করেছিল। অবাক হয়ে শুনেছিল মিলু। আর ছোট্ট শিশুমনে ইচ্ছে জেগেছিল – নদীতে নৌকো বেয়ে বেড়ানোর আর ফকির কাকার মত মাছ ধরার। কিন্তু চাপা স্বভাবের মিলু মুখ ফুটে বলে নি সে কথা।

ফকির কাকা মিলুকে দেখে বলে – কী গো দাদাবাবু? তুমি এখানে ?
মিলু বলে – ওগুলো অমন করে কেটে ফেলছো কেন? কেটো না কাকা।
– আপনের বাবা যে আমারে আঙিনে সাফছুতোর করতি কইয়ে গেইছেন দাদাবাবু।
– সবুজ সবুজ ঘাসগুলো কি সুন্দর লাগে দেখতে – আর তুমি…
কাতর কণ্ঠে মিলু বলে – না না ঘাসগুলো তুমি কাটবে না।
-চিন্তা কইরবেন না দাদাবাবু, কিছুদিন পরেই আবার নতুন সবুজ কচিঘাস জম্মাবে।
ফকির বোঝানোর চেষ্টা করে মিলুকে ৷
কে শোনে কার কথা?
– না না তুমি কাটবে না ঘাসগুলো। ওরা বুঝি কষ্ট পায় না ?
ছোট্ট মিলুর কষ্ট যেন কমতেই চায় না।

কথাবার্তা শুনে ঠাকুরমা আর জ্যেঠিমা এগিয়ে আসেন।
অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে তারা মিলুকে ঘরে নিয়ে যান।

(চলবে)