২৭শে সেপ্টেম্বর ২০০৯-এ বিশ্ব পর্যটন দিবসে, ইন্ডিয়ার আগ্রায়, মধ্যযুগের সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম ও বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত তাজমহলের ৩৫৫ বছর পূর্তি উৎসব শুরু হয়েছিল। এই উৎসব চলেছে ছয়মাস। তাজমহল এর নাম শোনেননি এ ধরণের মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবেনা। আর এ তাজমহল দেখেননি এ রকম হয়তো একজনও নেই। কেউ সশরীরে না গেলেও ভিউকার্ড, পোস্টার, চলচ্চিত্র, পোষ্ট কার্ড, ফার্স্ট ডে কভার, স্যুভেনির শিট, ডাকটিকেট, ফোনকার্ড ও বই-এ তাজমহলের ছবি অবশ্যই দেখেছেন। বিশ্ববাসীর কাছে তাজমহল একটি দর্শনীয় স্থান এবং এই তাজমহলের মাধ্যমে ইন্ডিয়া বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। তাজমহলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পর্যটকরা অনেক ধরণের উক্তি করেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে আবেদন সৃষ্টিকারী উক্তি করেন বৃটিশ পর্যটক এওয়ার্ড লিয়ার। ১৮৭৪ সালে তিনি বলেছিলেন, আজ থেকে বিশ্ববাসীকে দুটি শ্রেনীতে বিভক্ত করা হোক। একটা শ্রেনী যারা তাজমহল দেখেছে এবং আরেকটি শ্রেনী যারা দেখেনি। … এই উক্তিটি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
তাজমহল দেখাটা আগে যতো সহজ ছিল, এখন ততোটা নেই। কেননা তাজমহল দেখার জন্য বিদেশীদের জন্য ইন্ডিয়া একটা চড়া প্রবেশ মূল্য (৯০০ রুপি) ধার্য করেছে যা সাধারণ পর্যটকদের কাছে গ্রহনযোগ্য বিবেচিত হয়নি। এ কথা ঠিক যে, তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রবেশ মূল্য নির্ধারণ যথাযথ হয়েছে। কিন্তু মূল্যমান নিম্ন মধ্যবিত্তদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখাটা উচিৎ ছিল।
তাজমহল দিল্লি থেকে ২১০ কিলোমিটার দূরে আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত। দিল্লি থেকে ট্রেনে আগ্রায় যেতে দেড় ঘন্টা সময় লাগে। তাজমহলের বয়স নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। কোনো ইতিহাসবিদ বলেন, ১৬৩১ সালে শুরু হয়ে ১৬৫৩ সালে শেষ হয়েছে। আবার কেউ বলছেন, ১৬৩২ সালে নির্মান কাজ শুরু করে ১৬৫৪ সালে সম্পন্ন হয়। এর অধিকাংশের মতে, তাজমহলের নির্মাণ কাজ ১৬৩১ সালে শুরু হয় এবং ১৬৫৩ সালে নির্মাণ সম্পন্ন হয়। কিন্তু কোনো বিতর্ক নেই যে, অমর প্রেমের নিদর্শন হলো তাজমহল।
ফার্সিতে তাজমহল অর্থ প্রাসাদের মুকুট হলেও তাজমহল প্রকৃতপক্ষে একটি স্মৃতি সৌধ। সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র খুররম ১৬১২ সালে ফার্সি-রাজকন্যা আরজুমান্দ বানু বেগমকে বিয়ে করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর বিয়ের দিনই আরজুমান্দ-এর নতুন নাম দেন মমতাজ মহল। ১৬২৭ সালের ২৯শে অক্টোবর সম্রাট জাহাঙ্গীর মারা যান এবং খুররমকে সম্রাট ঘোষনা করা হয়। খুররম ১৬২৮ সালের ৪ঠা ফেব্রয়ারি এক জাঁকজমক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পঞ্চম মোঘল সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তার নতুন নাম রাখা হয় শাহ্জাহান। শাহ্জাহান ও মমতাজ মহল-এর মধ্যে ভালোবাসা এতো গভীর ছিল যে, রাজকার্য থেকে শুরু করে সামরিক অভিযান পর্যন্ত মমতাজ ছিলেন তার স্বামীর অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। তাদের সংসার জীবন ছিল আঠারো বছরের এবং এর মধ্যে তাদের ১৪টি সন্তান লাভ করে। সর্বশেষ সন্তান জন্মলাভের সময় ১৬৩০ সালে বোরহান পুরে সম্রাট শাহ্জাহান-এর সঙ্গে এক সামরিক অভিযানে অবস্থান কালে মমতাজ মহল মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে শাহজাহানের কাছ থেকে মমতাজ চারটি প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন।
প্রথমতঃ সম্রাট শাহ্জাহান তাদের ভালোবাসার পবিত্রতা ও সৌন্দর্যকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য একটা সৌধ নির্মাণ করবেন।
দ্বিতীয়তঃ তিনি আবার বিয়ে করবেন।
তৃতীয়তঃ তিনি ছেলেমেয়েদের প্রতি কখনো রুষ্ট হবেন না।
চতুর্থতঃ প্রতি মৃত্যু বার্ষিকীতে সম্রাট তার সমাধিতে আসবেন।
সম্রাট শাহ্জাহান চারটির মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। মমতাজের মৃত্যুর পর তাকে তপতী নদীর তীরে বোরহান পুরের জয়নাবাদ বাগানে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর ছয় মাস পর মমতাজ মহল-এর মৃতদেহ আগ্রায় নিয়ে আসেন শাহ্জাহান। ১৬৩১ সালে সৌধ নির্মাণের জন্য ডিজাইন আহ্বান করেন এবং ওই বছরই শাহ্জাহান তাজমহল নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০ হাজার লোকের ২২ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৬৫৩ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে তাজমহল প্রতিষ্ঠিত হয়। তাজমহল নির্মাণে, বর্তমান হিসাবে ৪০ লাখ পাউন্ড ব্যয় হয়েছিল।
তাজমহল বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয়। যেমন ভোরবেলায় গোলাপী, দুপুর-বিকেলে দুধ সাদা, চাঁদের ম্লান আলোয় সোনালী এবং ভরা চাঁদের (পূর্ণিমা) আলোয় মুক্তোর মত জ্বল জ্বল করে। এছাড়া বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন রং ধারণ করে। কথিত আছে, পৃথিবীতে যাতে দ্বিতীয় কোন তাজমহল গড়ে না ওঠে সে জন্য সম্রাট শাহ্জাহান কারিগরদের হাতের আঙ্গুল কেটে দিয়েছিলেন এবং অন্ধ করে দিয়েছিলেন।
তাজমহল-এর নকশা কারীর নাম নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তবে যে নামগুলো বেশী উচ্চারিত হয় সেগুলো হলো- ইরানের নামজাদা স্থপতি ওস্তাদ ঈশা, ওস্তাদ আহমদ লাহোরি, ওস্তাদ হামিদ এবং ইতালির জেরোলিমো ভোরানিও। সম্রাট শাহ্জাহান ১৬৬৬ সালের ২২শে জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন এবং তাকে তাজমহলের মাঝখানে একটি ঘরে মমতাজ এর পাশেই সমাহিত করা হয়।
আমার ছায়াতে তোমার হাসিতে
মিলিত ছবি,
তাই নিয়ে আজি পরানে আমার
মেতেছ কবি।
পদে পদে তব আলোর ঝলকে
ভাষা আনে প্রাণে পলকে পলকে,
মোর বাণীরূপ দেখিলাম আজি,
নির্ঝরিণী-
তোমার প্রবাহে মনেরে জাগায়,
নিজেরে চিনি। … রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর