ছিন্নপত্রে কীভাবে এমন পরিণত ও আধুনিকমনস্ক রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাই তার নেপথ্য কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তি, পাঠাভ্যাস ও প্রকৃতি প্রেমের কথা জেনে ছিলাম। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে কারণটি সেটি হচ্ছে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর তথা বুড়ির প্রতি রবীন্দ্রনাথের অপ্রতিরোধ্য টান। অন্য কারো সাক্ষ্য মানার দরকার নেই, চিঠিগুলো পড়তে-পড়তে যে কেউ দেখতে পাবেন, ‘যার সঙ্গে দুটো কথা কয়ে প্রাণ সঞ্চয় করা যায়’। তিনি ছিলেন প্রাপয়িত্রী ইন্দিরা দেবী স্বয়ং। তার মধ্যে তরুণ কাকা রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন ‘বেশ একটু পরিণত মনুষ্যত্ব।’
“আমি অন্তরে অসভ্য, অভদ্র। আমার জন্য কোথাও কি একটা ভারি সুন্দর অরাজকতা নেই? কতকগুলো খ্যাপা লোকের আনন্দমেলা নেই?”
১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর উদ্দেশে একটি চিঠিতে এই পঙক্তি ক’টি লিখে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর মনে হবে কী বকছেন তিনি!
আজ ২০১০ সালেও ক’জন বাঙালি কবি সাহিত্যিক এমন করে পারবেন বলতে? যদি হঠাৎ বলেও ফেলেন ‘অসভ্য, অভদ্র’ নিজেকে, লজ্জা পেয়ে যাবেন হয়তো, ভাববেন- যে কী বকছেন তিনি !!
১১৮ বছর পরও আমরা কি আছি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে?
“মানুষ কি লোহার কল যে ঠিক নিয়ম অনুসারে চলবে? মানুষের মনের এত বিচিত্র এবং বিস্তৃত কাণ্ড-কারখানা। তার এত দিকে গতি। এবং এত রকমের অধিকার যে এ দিকে-ও দিকে হেলতেই হবে। সেই তার জীবনের লক্ষণ, তার মনুষ্যত্বের চিহ্ন, তার জড়ত্বের প্রতিবাদ। এই দ্বিধা, এই দুর্বলতা যার নেই তার মন নিতান্ত সংকীর্ণ এবং কঠিন এবং জীবন বিহীন। যাকে আমরা প্রবৃত্তি বলি এবং যার প্রতি আমরা সর্বদাই কটু ভাষা প্রয়োগ করি সেই তো আমাদের জীবনের গতিশক্তি।”
ভাইঝি ইন্দিরার উদ্দেশে যুবক রবির এই চিঠি ১৮৯০ সালের ১০ই অক্টোবর লেখা। কিন্তু এইসব এ কালেরই কথা। চিরকালেরই কথা আসলে, কিন্তু এখনও আমরা ততটা অভ্যস্ত হতে পারিনি এমন কথায়। দ্বিধা-দুর্বলতাকে মেনে নিতে আমাদের এখনও চরম আপত্তি। একই রকম উপলব্ধি হলেও দু-একজন বাদে আমাদের লিখকরা এমন কথা লিখার মতো সৎ বা সাহসী হন না। তাই যেতে ইচ্ছা হয় কখনো-কখনো আর সব লেখককে এক পাশে সরিয়ে রেখে ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৫ সালের যুবক রবীন্দ্রনাথের কাছে। যখন তাঁর বয়স ২৬ থেকে ৩৪। ভেবে অবাকই লাগে, যখন তাঁর চারপাশের লিখার জগতে চিন্তার জগতে কূপমণ্ডূকতা, হিংসা-দ্বেষ আর কুটিলতা (দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে চাইলে অনেক পৃষ্ঠার এক বই লিখতে হবে) তখন রবীন্দ্রনাথের মাথায় কী করে প্রবেশ করেছিল আভঁ-গার্দের আলো? একটি কারণ যদি অসাধারণ বুদ্ধিবৃত্তি বা গভীর উপলব্ধি শক্তি হয়ে থাকে, অন্যটি নিশ্চয় পড়াশোনা। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রকৃতি প্রীতি। শেক্সপিয়ারের ‘কিং লিয়র’ লেখা হয়েছিল আরও অনেক বছর আগে, যাতে রয়েছে দুর্বিষহ যন্ত্রণা, সংশয়, প্রকৃত বাস্তব তথা অধিকতর বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার উপাদান। হ্যামলেট নাটকেও আমরা পেয়েছি প্রাজ্ঞ নায়কের প্রচণ্ড দ্বিধাপীড়িত কাতরতার চালচিত্র। জীবনের নিরর্থকতা, হাস্যকরতা নিয়েও বহুকাল ধরেই কবিতা, গান, নকশা-পালা লেখা হয়ে আসছিল বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই তার কিছু বয়ান। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায় কি পড়েছিল ছাপ খানিকটা সে বোধের-ভাবনারও? ১৮৯১ সালের ২০ জুন যুবা রবীন্দ্রনাথের কলমে এসেছিল এই পংক্তিগুলো :
“আমি তো পূর্বেই বলেছি জীবনটা একটা গম্ভীর বিদ্রুপ, এর মজাটা একটু বোঝা শক্ত। কারণ যাকে নিয়ে মজা করা হয়, মজার রসটা সে তেমন গ্রহণ করতে পারে না। এই মনে করো দুপুর রাত্রে খাটে শুয়ে আছি, হঠাৎ পৃথিবীটা ধরে এমনি নাড়া দিলে যে কে কোথায় পালাবে পথ পায় না। মতলবটা খুব নতুন রকমের এবং মজাটা খুব আকষ্মিক তার আর সন্দেহ নেই। বড়ো বড়ো সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকদের অর্ধেক রাত্রে উর্দ্ধশ্বাসে অসম্বৃত অবস্থায় বিছানার বাইরে দৌঁড় করানো কি কম কৌতুক ! এবং দুটো-একটা সদ্যোনিদ্রোত্থিত হতবুদ্ধি নিরীহ লোকের মাথার উপরে বাড়ির আস্ত ছাদটা ভেঙে আনা কি কম ঠাট্টা! হতভাগ্য লোকটা যেদিন ব্যাংকে চেক লিখে রাজমিস্ত্রীর বিল শোধ করছিল, রহস্যপ্রিয়া প্রকৃতি সেইদিন বসে কত হেসেছিল!”
লক্ষ্য করা যায়, রবীন্দ্রনাথ এখানে রহস্যপ্রিয়া প্রকৃতির কথা বলেছেন, ঈশ্বরের কথা নয়। তবে জীবনটাকে যে ‘একটা গম্ভীর বিদ্রুপ’ বলেছেন তিনি, বলতে পেরেছেন একশো বছরেরও আগে এটাই আমাদের মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করে। পরের দিনের পরের দিন রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন:
“এক দল আছে তারা ছটফট করে ‘জগতের সকল কথা জানতে পারছি নে কেন’, আর এক দল ছটফটিয়ে মরে ‘মনের সকল ভাব প্রকাশ করতে পারছি নে কেন’। মাঝের থেকে জগতের কথা জগতেই থেকে যায় এবং অন্তরের কথা অন্তরেই থাকে।”
কৃতজ্ঞতায়ঃ আলতাফ হোসেন।
অবাক বাংলাদেশ, রবীন্দ্রনাথ, সাহিত্য। পদ্মা পাড়ের মানুষ ব্লগ থেকে সবিনয়ে শেয়ার করা হলো।