বিভাগের আর্কাইভঃ ব্যক্তিত্ব

নজরুল কাব্যে দ্রোহ, অসাম্প্রদায়িকতা এবং প্রেম

ja

যে কীর্তিমান মহাপুরুষের জন্ম না হলে বাংলা সাহিত্য অপূর্ণ থাকতো, তিনিই আমাদের বাঙ্গালি জাতিসত্তার কবি, প্রাণের কবি, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যার সম্পর্কে অল্প কথায় কিছুমাত্র বলার সাধ্য আমার নেই। এক সমুদ্র জল থেকে এক ‘আজলা ভরে যতটা তুলে আনা যায় ঠিক ততটুকু অথবা তারচেয়েও কিছুটা কম। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস সাহিত্যে প্রতিভার বিচারে তাঁর ধারে কাছেও কেউ নেই। তিনি এক অবিসংবাদিত, অতুলনীয় এবং অলৌকিক প্রতিভার অধিকারী। সাহিত্যের সকল শাখায় যার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল পদচারণা। কবিতা, ছড়া, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস সহ সকল ক্ষেত্রেই তিনি বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। জীবন ও জগতের সুগভীর দর্শন তাঁর লেখনির মাধ্যমে প্রকাশ করে আমাদেরকে ঋণী করে গেছেন। যেই ঋণের দায় পরিশোধ করা আমাদের জন্য অসাধ্য। তবে তাঁর চিন্তা, চেতনা, দর্শন আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে কিছুটা হলেও এই দেনা লাঘবের সুযোগ রয়েছে। চলুন এবার আসা যাক মহাপ্রাণ এই সত্তার বিদ্রোহী সত্তায়। কবি বলেছেন,

“যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ, ভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।” বিদ্রোহী/ কাজী নজরুল ইসলাম —- আজ কোথায় সেই চিরায়ত বিদ্রোহের সুর? যেখানে অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন — সেখানেই কোথায় প্রতিবাদ? তেলবাজ, পদলেহী, চাটুকারদের দৌরাত্ম্য আজ সাহিত্য জগত থেকে শুরু করে সবখানে উন্মাদ জলের মতোন সয়লাব। প্রতিবাদহীন এই নপূংশক সমাজ চারাগাছ থেকে আজ বিশাল মহীরুহ। সবাই কেবল নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। যে যেভাবে পারছে সেভাবেই তিরতির করে উঠে যাচ্ছে খাটের তলা থেকে আগরতলা। পারলে ছুঁয়ে দেয় আকাশ! মানবতার নূণ্যতম বালাই নেই। নেই পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা। মানবিক বোধের দরজা-জানলা বন্ধ করে সবাই যেন মেতে উঠছে অমানবিক এক পৈশাচিক খেলায়। বলতে কিছুমাত্র দ্বিধা নেই যে, এতে করে মানুষ হিসাবে আমরা কেবলই পরাজিত হচ্ছি। কোনো এক অজানা অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। এমন এক অন্ধকূপ অথবা জন্মান্ধ গুহায় নিজের ঠিকানা খুঁজে নিজেই খুঁজে নিচ্ছি যেখান থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। মুক্তির কোনো পথ থাকবেও না।

তবে কি এভাবেই আমরা তলিয়ে যাব? এভাবেই তলিয়ে যেতে থাকব? অথচ গর্ব করার মতোন বিষয় মানুষ হিসাবে আমরাই মহাবিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রাণি! আমাদের পতাকা এখন চাঁদে উড়ছে, মংগলে উড়ছে। ভবিষ্যতে শনি, বুধ, বৃহস্পতি, নেপচুন, প্লুটো সহ ছায়াপথ, গ্যালাক্সি জুড়ে চলতে থাকবে আমাদের জয়রথ। শুধু আফসোস থেকে যাবে এতোকিছুর পরেও আমরা কেবল মানুষ হব না– সত্যিকারের মানুষ! সাম্যের কবি, প্রাণের কবির “মানুষ” কবিতাটির অংশ বিশেষ পড়া যাক—

মানুষ/ কাজী নজরুল ইসলাম
গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।-
পূজারী, দুয়ার খোলো,
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো!’

, হ্যা.. আমরা অবশ্যই মানুষ; তবে তা নামিক মানুষ। নাম সর্বস্ব মানুষ। প্রশ্ন থেকে যায়, এইসব নাম খাওয়া স্ত মানুষ আর ইতর প্রাণির মাঝে কতটুকু পাথর্ক্য আছে? বনের সিংহ নিরীহ হরিণের মাংশ খুবলে খায়, মহিষের তাজা খুনে উৎসব পালন করে। এরাও কেউ নিজের মাংশে হাড়ি চাপায় না, উদরপূর্তি করে না। প্রকৃতির দেয়া নিয়ম-কানুন তারা যথার্থই নেমে চলে। কেবল আমরা মানুষেরা মানুষের রক্তে হাত রাঙাই। ভাই ভাইয়ের অধিকারে খড়গ হস্ত হই, দুর্বলের টুটি চেপে ধরে হাতুড়ি চালাই, শাবল, চালাই, গাইতি চালাই, বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দিই অনাগত স্বপ্ন। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হয়েও কেবল নিজস্ব স্বার্থ এবং পশু প্রবৃত্তির তাগিদে, ক্ষমতা এবং প্রভাব প্রতিপত্তির লিপ্সায় পশুদের সাথে একই কাতারে দাঁড়াই। দাঁড়াতে এতোটুকুও দ্বিধা করি না। এই যদি হয় আমাদের প্রকৃত অবস্থা, তাহলে আমার বলতে দ্বিধা নেই, যে থুতু আজ আমরা অন্যের দিকে নিক্ষেপ করছি, তা একদিন অবশ্যই কালের চক্রে নিজের দিকেই ফিরে আসবে। আসবেই। আসতেই থাকবে। মানবতা, সাম্য এবং মূল্যবোধের অবক্ষয় মানব নামের এই জাতিটিকে নিশ্চিতভাবেই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবে। এতে কোনোরকম সন্দেহ নাই। অসাম্যের বিরুদ্ধে চির সোচ্চার কবি এজন্যই বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে পেরেছেন, “আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশের, এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের।”

নজরুল সত্তায় নারী প্রেম যেন এক চিরজাগ্রত চেতনা। নারীকে ইতিহাসের পানশালা থেকে, নর্দমার পঙ্কিল আবর্ত থেকে হাত ধরে, বুকে আগলে, মাথায় তুলে যে মহাপুরুষ পুরুষের সাথে একই সারিতে এনে দাঁড় করিয়েছেন… তিনিই আমাদের জাতি সত্তার, আমাদের ভালোবাসার কবি, প্রেমের কবি নজরুল। যে নারী একদিন কেবল ছিল পুরুষের সেবাদাসী, পুরুষের শষ্যার নিরীহ এবং নিষ্পৃহ সংগিনী… সেই অবহেলিত, বঞ্চিত, পদদলিত নারী সম্পর্কে তিনি বলেছেন,
বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা-কিছু এল পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।“(উৎস- ‘নারী’ কবিতা)

কী অসাধারণ সরল স্বীকারোক্তি! শুধু তাই নয়, এ যেন শিশ্নধারী প্রবল প্রতাপশালী পুরুষের উঁচু নাকে একটা ঘুষি, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের সুউচ্চ সিংহাসন থেকে পুরুষকে টেনে হিচঁড়ে নারীর কাতারে নামিয়ে আনার নামান্তর। পুরুষের আজন্ম লালিত অহংকার ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার শামিল। ঘরে-বাইরে, সমরে-সংগমে নারীর অবদানের স্বীকৃতি দিতে তিনি আরও বলেছেন,
কোনকালে একা হয়নিকো জয়ী, পূরুষের তরবারী; প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়-লক্ষী নারী।” (উৎস -‘নারী’ কবিতা)।

নারী ও পুরুষের চিরন্তন ভালোবাসার স্বীকৃতি তাঁর লেখায় মানব শরীরের ধমনীতে প্রবাহিত রক্তের মতোন প্রোজ্জ্বল। কিশোর প্রেমের স্মৃতি আওড়াতে তিনি তাঁর “চৈতি হাওয়া” কবিতায় বলেছেন, “হাস্‌তে তুমি দুলিয়ে ডাল/ গোলাপ হ’য়ে ফুটতো গাল”। কী দুর্দান্ত অথচ সাবলীল উপমার মায়াজাল! নারী আর চিরমোহিনী প্রকৃতি যেন একই রুপের চিরন্তন আঁধার। নারী-পুরুষের প্রেম-ভালোবাসার এই স্বীকৃতির পাশাপাশি প্রেমের নামে৷ ভালোবাসার নামের শরীর ভোগ করার বিষয়ে চরম হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, কামনা আর প্রেম দুটি হচ্ছে ম্পুর্ণ আলাদা। কামনা একটা প্রবল সাময়িক উত্তেজনা মাত্র আর প্রেম হচ্ছে ধীর প্রশান্ত ও চিরন্তন।”

তিনিই নজরুল যিনি সারাজীবন সাম্যের গান গেয়েছেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার জয়গান গেয়েছেন, সাম্প্রদায়িক বিষবৃক্ষের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে হুংকার দিয়েছেন। মানুষকে জাত-পাত, সাদা-কালো, উঁচু-নিচু নয়—- কেবলই মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন করেছেন। হৃদয় থেকে প্রতিটি মানুষকে শ্রদ্ধা করেছেন, ভালোবেসেছেন। প্রিয় পাঠক, আসুন প্রিয়কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী কবিতাটির অংশবিশেষ একবার পাঠ করা যাক।

সাম্যবাদী// কাজী নজরুল ইসলাম
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।

এই একটি কবিতাই প্রমাণ করে দেয়, “অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি এবং লেখকদের মধ্যে নি:সন্দেহে কাজী নজরুল ইসলাম শীর্ষস্থানীয়। তিনি তার অসংখ্য কবিতা, গল্প এবং প্রবন্ধে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়েছেন। বিশ্বের সমস্ত মানুষকে মানবতার একই পতাকা তলে সমবেত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন,
“মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ/ এক সে আকাশ মায়ের কোলে/ যেন রবি শশী দোলে/ এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান’।

প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, অসাম্প্রদায়িকতার কবি, মানবতার কবি নজরুলকে বোঝার জন্য কিংবা বোঝানোর জন্য উৎকৃষ্ট উদাহরণ তার সৃষ্টি অসংখ্য এমন চরণ। বিদ্রোহী হয়ে ওঠা বা বিদ্রোহ প্রকাশের ধরন যে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধ থেকে উৎক্ষিপ্ত। মানবসত্তা বিকাশের জয়গান মূলত যে কোনো বিদ্রোহী সুরের সঙ্গেই একাট্টা হয়ে অনুরণিত হয় ব্যক্তিমানসে। যা থেকে প্রথমে দ্রোহ এবং পরবর্তীতে বিদ্রোহী চেতনার জন্ম নেয়। কাজী নজরুল ইসলাম তার সময়কে ভেদ করে এগিয়েছেন। যেটুকু কাব্য ও সাহিত্য চর্চার সময় তিনি পেয়েছেন ব্যক্তি জীবনে; কাজ করে গেছেন সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতার জন্যই।
গাহি সাম্যের গান-, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম-ক্রীশ্চান। এটি নজরুলে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতিচ্ছবি।

নজরুলের মানবসত্ত‍া এবং তার বিদ্রোহ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ নজরুলকে বহুবিধ বিশ্লেষণে ভূষিত করেছেন। যার মধ্যে বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, মানবতার মুক্তিদূত এবং সর্বতোভাবে প্রেমের কবি অন্যতম। শুধু তাই নয় প্রেম প্রকাশের ক্ষেত্রে নজরুলের আরেক ধরনের বিদ্রোহ সামনে ভেসে আসে। যেখানে কখনও প্রেমিকসত্তা নিরঙ্কুশভাবে বিলীন প্রেমাস্পদের কাছে অথবা কখনও বা প্রেমবিদ্রোহ জাগরুক থাকে বিরহের যূপকাষ্ঠে নিজেকে বলি দিয়ে।

আগের বলেছি, বিশাল সমুদ্র থেকে এক আজলা ভরে যতটা জল আনা যায়, আমার আলোচনাও তাই। একজন সত্যিকার মানুষ হিসাবে, একজন কবি-লেখক হিসাবে, একজন শিল্পী হিসাবে, একজন অভিনেতা হিসাবে, একজন প্রেমিক হিসাবে, একজন পিতা হিসাবে, একজন স্বামী হিসাবে নজরুল সত্তার কোনো তুলনা নাই। তাঁর তুলনা কেবল তিনি নিজেই। মানুষকে কতটা ভালোবাসলে একজন মানুষ বলতে পারেন, “মিথ্যা শুনিনি ভাই
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনও মন্দির-কাবা নাই।“

সবশেষে প্রাণের কবি, মন, মানস, বোধের কবি, বাঙালি জাতিসত্তার কবি চির বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।।
——————–

অঞ্জলি লহো হে কবি…

3017

30095 যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে, অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে –

কাজী নজরুল ইসলাম (মে ২৫, ১৮৯৯ – আগস্ট ২৯, ১৯৭৬), (জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ – ভাদ্র ১৪, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ), অগ্রণী বাঙালি কবি, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় বাঙালি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীতস্রষ্টা, দার্শনিক, যিনি বাংলা কাব্যে অগ্রগামী ভূমিকার সঙ্গে সঙ্গে প্রগতিশীল প্রণোদনার জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। আজ তাঁর ৪৬ তম প্রয়াণ দিবস।

পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ – দুই বাংলাতেই তাঁর কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাঁকে বিদ্রোহী কবি নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর কবিতার মূল বিষয়বস্তু ছিল মানুষের ওপর মানুষের অত্যাচার এবং সামাজিক অনাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক হিসেবে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে নজরুল সর্বদাই ছিলেন সোচ্চার। তাঁর কবিতা ও গানে এই মনোভাবই প্রতিফলিত হয়েছে। অগ্নিবীণা হাতে তাঁর প্রবেশ, ধূমকেতুর মতো তাঁর প্রকাশ। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনই জীবনে –- কাজেই “বিদ্রোহী কবি”। তাঁর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে উভয় বাংলাতে প্রতি বৎসর উদযাপিত হয়ে থাকে।

নজরুল এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা ছিল ধর্মীয়। স্থানীয় এক মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজও করেছিলেন। কৈশোরে বিভিন্ন থিয়েটার দলের সাথে কাজ করতে যেয়ে তিনি কবিতা, নাটক এবং সাহিত্য সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার পর তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। এসময় তিনি কলকাতাতেই থাকতেন। এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রকাশ করেন বিদ্রোহী এবং ভাঙার গানের মত কবিতা; ধূমকেতুর মত সাময়িকী। জেলে বন্দী হলে পর লিখেন রাজবন্দীর জবানবন্দী। এই সব সাহিত্যকর্মে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা ছিল সুস্পষ্ট। ধার্মিক মুসলিম সমাজ এবং অবহেলিত ভারতীয় জনগণের সাথে তার বিশেষ সম্পর্ক ছিল।

3023

তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালবাসা, মুক্তি এবং বিদ্রোহ। ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও তিনি লিখেছেন। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। বাংলা কাব্য তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হল ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল। এর পাশাপাশি তিনি অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতিও রচনা করেন। নজরুল প্রায় ৩০০০ গান রচনা এবং অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা “নজরুল গীতি” নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়।

মধ্যবয়সে তিনি পিক্‌স ডিজিজে আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একই সাথে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭২ সালে তিনি সপরিবারে ঢাকা আসেন। এসময় তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।।

3014

শ্রদ্ধেয় মরহুম কবি কাজী নজরুল ইসলামের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।

শ্রদ্ধার সাথে তাঁকে স্মরণ করছি, এবং তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। সেই দিনের সেই দুখু মিয়া যদি পৃথিবীতে না আসতেন, তবে সম্পদশালী বাংলা সাহিত্য তাঁর বিপুলাংশের ঐশ্বর্য্য, সাহিত্যের রত্নভান্ডার হতে বঞ্চিত হতো।

আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসীব করুন।

লেখকঃ দাউদুল ইসলাম
( কবি ও প্রাবন্ধিক )

প্রয়াণের একযুগ! বিনম্র শ্রদ্ধা হে সাহিত্যের জাদুকর হুমায়ুন আহমেদ

fft

আজ (১৯ জুলাই) বাংলার নন্দিত কথাশিল্পী ও চিত্রনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। দেখতে দেখতে কেটে গেল জন নন্দিত এই কথাশিল্পীর প্রয়াণের একটি দশক। ২০১২ সালের আজকের এই দিনে ক্যান্সার চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি নিউইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান জোছনার গল্প কথক কিংবা হিমু-মিসির আলির এই স্রষ্টা। তার মৃত্যু শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী সব বাঙালির হৃদয়ে গভীর শোকের অন্ধকার ছড়িয়ে দিয়েছিল।

মাত্র ৬৪ বছরের জীবনে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কীর্তি রেখেছেন শিল্প-সাহিত্যর প্রায় প্রতিটি শাখা প্রশাখায়। বাংলা সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র ও গান পালাবদলের এ কারিগর ১৯৭২ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ দিয়ে নিজের অস্তিত্বের সাক্ষর রাখেন। তার ‘নন্দিত নরকে’ আর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পাঠ করে আবিষ্ট হয়েছিলেন, সেই আবেশ আজও কাটেনি বাংলা ভাষার পাঠকদের। তিনি তাঁর সাহিত্য দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ রেখেছেন বাংলার মানুষকে, তিনি জয় করে গেছেন একেবারে শাদামাটা বাঙ্গালীর মন কে, আবার উন্নত ঐশ্বর্যিক বাঙ্গালিয়ানাকে। নিজেকে তিনি যেভাবে বাংলা কথাসাহিত্যের অঙ্গনে, টেলিভিশন নাটক আর চলচ্চিত্রাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিরল । তিনি এদেশের সৃজনশীল সাহিত্য প্রকাশনাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বিপুল পাঠকপ্রিয়তা সৃষ্টির মাধ্যমে। ভারতীয় বাংলা গল্প, উপন্যাসে নিমগ্ন পাঠকদের বাংলাদেশি লেখকদের বই পড়তে বাধ্য করেছিলেন তার আশ্চর্য জাদুকরী গল্পের জালে জড়িয়ে। মোহাবিষ্ট পাঠক হুমায়ূন আহমেদের রচনায় মধ্যবিত্ত জীবনের হাসি-কান্নার এমন নিবিড় পরিচয় পেয়েছেন, যেখানে তাদের নিজেদেরই জীবনের ছবি প্রতিবিম্বিত। এক হুমায়ুন আহমেদের পথ ধরে এগিয়ে এসেছেন অসংখ্য প্রতিভা, অসংখ্য মানুষ তার হাত ধরে হয়েছেন অনন্য, একেবারে সাদামাটা মানুষকে তিনি বানিয়ে দিয়েছেন নন্দিত চিত্রতারকা!তাদের অনেকেই হয়েছেন জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পী। আমরা তাঁর সৃষ্টিতে খুঁজে পাই অসাধারণ সব নৈপুণ্য, অনন্য নৈসর্গিক দৃশ্য, জোছনা, খুঁজে পাই আমাদের জীবনের নানান সব ব্যঞ্জনা।

হুমায়ূন আহমেদের অনন্য সৃষ্টি হিমু! সে এক অসাধারণ চরিত্রের নিরন্তর পথ চলা… এক ভিন্ন মেজাজ, ভিন্ন স্টাইল, ভিন্ন রঙ রূপ এর অপূর্ব সমন্বয়, যা আমাদের দেশের বেশিরভাগ তারুণ্য কে ছুঁইয়ে গেছে, আজো ছুঁইয়ে আছে আর আগামী দিনে একিই প্রভাব নিয়ে এই চরিত্রটি টিকে থাকবে।

এদেশে দর্শকনন্দিত নাটকগুলোর একটি বড় অংশ তার সৃষ্টি। তার ছায়াছবিও সমাদৃত হচ্ছে সমানভাবে। প্রয়াণের ছয় বছর পরও বাংলা শিল্প-সাহিত্যের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে চলছে তাঁরই আধিপত্য, তারই রাজত্ব, তারই জয়জয়কার! এখনো সমান তালে সমান ছন্দে বিরাজ করছে হুমায়ুন প্রভাব যা রবীন্দ্র নজরুলের পর আর কেউই খাটাতে সক্ষম হয়নি। হুমায়ূন আহমেদ এর পুস্তুক প্রকাশকদের মতে তার নতুন বা পুরনো সব গ্রন্থই সর্বোচ্চ বিক্রিত বইয়ের তালিকায় স্থান করে নেয়। এই হিসেব মতে হুমায়ুন আহমেদ কে আধুনিক শিল্প সাহিত্যের রিদম বলা ভুল হবেনা।

বাংলা টেলিভিশনের জন্য একের পর এক দর্শকনন্দিত নাটক রচনার পর ১৯৯০-এর গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। ২০০০ সালে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ও ২০০১ সালে ‘দুই দুয়ারী’ দর্শকদের দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পায়। ২০০৩-এ নির্মাণ করেন ‘চন্দ্রকথা’।

এছাড়া ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন ছায়াছবি ‘শ্যামল ছায়া’ , ২০০৬ সালে ‘সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র’ বিভাগে একাডেমী পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে যেটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এবং বেশ কিছু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। একিই বছর মুক্তি পায় ‘৯ নম্বর বিপদ সংকেত’। ২০০৮-এ ‘আমার আছে জল’ চলচ্চিত্রটি তিনি পরিচালনা করেন। ২০১২ সালে তাঁর পরিচালনার সর্বশেষ ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ মুক্তি পায়। যা দেশ-বিদেশে প্রচুর আলোচনায় আসে। তাঁর চলচ্চিত্রের মৌলিক গানগুলো তিনি নিজেই রচনা করেন, যার বেশিরভাগই পায় তুমুল জনপ্রিয়তা।

১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। ডাক নাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার ছোটভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।
তিনি ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক ও ১৯৭২ সালে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ৯০ দশকের মাঝামাঝি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন।

১৯৭৩ সালে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতনি গুলতেকিন খানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ । হুমায়ূন এবং গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলে-মেয়ে। তিন মেয়ে নোভা, শীলা ও বিপাশা আহমেদ এবং ছেলে নুহাশ হুমায়ূন। দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২০০৫ সালে ডিভোর্সের মাধ্যমে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এরপর তিনি অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। এ দম্পতির দুই ছেলে- নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন।

.
লেখকঃ দাউদুল ইসলাম
কবি ও প্রাবন্ধিক।

জিবরাইলের ডানা’র চিত্র এবং চিত্রপট

ffh বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অধ্যাপক শাহেদ আলী বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবী। যিনি সারাজীবন অনেকটা নীরবে-নিভৃতে সাহিত্য সাধনা করে গেছেন। তিনি ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের একজন অন্যতম ভাষাসৈনিক। তিনি একাধারে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, অনুবাদক, গবেষক। তিনি ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ মে সাবেক সিলেট তথা বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম মৌলবী ইসমাইল আলী এবং মাতা আয়েশা খাতুন।

শাহেদ আলীর বাল্য এবং কৈশোরকালও গৌরবময়। তিনি সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা, সিলেট এমসি কলেজ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্যাচেলার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। অত:পর তিনি ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে বগুড়া আজিজুল হক কলেজেের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত মিরপুর বাংলা কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ ও চট্টগ্রাম সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। তিনি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে খেলাফতে রব্বানী পার্টির নমিনেশনে সুনামগঞ্জ থেকে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। অধ্যাপক শাহেদ আলী ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (সাবেক ইসলামিক একাডেমী) প্রতিষ্ঠাতা সচিব ছিলেন। এরপর ১৯৬২ থেকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ ও সংকলন বিভাগের পরিচালকের হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। চল্লিশের দশক থেকেই শাহেদ আলী সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৪-৪৬ খ্রিস্টাব্দে মাসিক প্রভাতি এবং ১৯৪৮-৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকাদ্বয় সুনামের সাথে সম্পাদনা করেন। ১৯৫৫ সালে দৈনিক বুনিয়াদ সম্পাদনা করেন। ইসলামী ফাউন্ডেশনের বিখ্যাত শিশু মাসিক সবুজ পাতার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ১৯৬৩ থেকে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক মিল্লাতের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৩-৬৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমী পত্রিকার সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ইসলামী বিশ্বকোষের সম্পাদনা বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন। অধ্যাপক শাহেদ আলী বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাছাড়া ১৯৪৮-৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সার্বিক কার্যক্রমে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তিনি তমুদ্দন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।

এবার আসা যাক, প্রিয় কথাসাহিত্যিক শাহেদ আলীর সাহিত্যকর্মের নানাবিধ বৈচিত্র্যময় দিক প্রসঙ্গে। ১৯৪০ খ্রি: সওগাত পত্রিকায় শাহেদ আলীর প্রথম গল্প “অশ্রু” প্রকাশিত হয়। এরপর বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ক্রমান্বয়ে গল্প ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হতে থাকে। শাহেদ আলী ছিলেন একজন জীবনধর্মী লেখক। মানব জীবনের গভীর আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, দর্শন তিনি নিঁখুত ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর লেখা :

গল্পগ্রন্থঃ জিবরাইলের ডানা (১৯৫৩), একই সমতলে (১৯৬৩), শা’নযর, (১৯৮৫) অতীত রাতের কাহিনী (১৯৮৬), অমর কাহিনী (১৯৮৭), নতুন জমিদার (১৯৯২), শাহেদ আলীর শ্রেষ্ঠ গল্প, শাহেদ আলীর নির্বাচিত গল্প ইত্যাদি। উপন্যাসঃ হৃদয় নদী (১৯৬৫),

প্রবন্ধ-গবেষণাঃ একমাত্র পথ, তরুণ মুসলিমের ভূমিকা, ফিলিস্তীনে রুশ ভূমিকা, সাম্রাজ্যবাদ ও রাশিয়া, তরুণের সমস্যা, বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান, তাওহীদ, বুদ্ধির ফসল আত্মার আশিষ , ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা, Economics Order Of Islam, জীবন নিরবচ্ছিন্ন, Islam in Bangladesh, জীবনদৃষ্টি বিপর্যয়ের হেতু, অন্যরকম আমেরিকা ইত্যাদি।

শিশুতোষঃ রুহীর প্রথম পাঠ, ছোটদের ইমাম আবু হানিফা, সোনার গাঁয়ের সোনার মানুষ, নাটিকা: বিচার আত্মজীবনী: জীবনকথা অনুবাদ গ্রন্থ: মক্কার পথ, মূল: মুহাম্মাদ আসাদ, ইসলামে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার মূলনীতি, মূল: আল্লামা আসাদ আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিক মানুষ

মূল: কে বি এইচ কোনান্ট ইতিবৃত্ত,
মূলঃ হিরোডাটাস ককেশাসের মহানায়ক
মূলঃ ইমাম শামেলি।
তিনি জীবদ্দশায় অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। এই যেমন: বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৪) ভাষা আন্দোলন পদক (১৯৮১), নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৮৫), লায়ন ক্লাব পদক(১৯৯২), ইসলামিক ফাউণ্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৯) দুবাই সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯২), ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৭) রাগিব রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৮) কেমুসাস সাহিত্য পুরস্কার, জাসাস স্বর্ণপদক (২০০০) তমদ্দুন মজলিস মাতৃভাষা পদক (২০০০) কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (মরণোত্তর, ২০০৩) এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পুরস্কার ইত্যাদি। বহুধা প্রতিভার অধিকার শাহেদ আলী ২০০১ খ্রিস্টাব্দের ৬ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

এবার তাঁর সবচেয়ে আলোচিত এবং আলোড়িত গ্রন্থ “জিবরাইলের ডানা”র চিত্র এবং চিত্রপট প্রসঙ্গে। পঞ্চাশের দশকের জিব্রাইলের ডানা গল্পের মাধ্যমে যে নামটি সবার মনে আলোড়ন তুলেছিল ,তিনি আর কেহ নন, সুনামগঞ্জের হাওরের গর্ব, কথা সাহিত্যিক অধ্যাপক শাহেদ আলী। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে জিব্রাইলের ডানা গল্প পড়তে গিয়ে নামটির সাথে আমার প্রথম পরিচয়। আলোকিত ও আলোচিত ছোটগল্প জিব্‌রাইলের ডানা, যেটা সবার মনে সাড়া জাগিয়েছিল, যারা পড়েছেন তাদের মনে রেখাপাত করে আছে এখনও, সেই গল্পের লেখক এবং সুনামগঞ্জের আলোচিত ভাষাসংগ্রামীদের একজন অধ্যাপক শাহেদ আলী, যিনি শুধু বাংলা সাহিত্যের একজন অমর কথাশিল্পীই নন, তিনি ছিলেন একজন সৃজনশীল অনুবাদ-সাহিত্যিক এবং আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গদ্য লেখক।

তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ জিব্‌রাইলের ডানা যখন প্রকাশিত হয় তখন তিনি প্রচুর প্রশান্তি পান আর সেখানে ফুটিয়ে তোলেন দরিদ্র ঘরের একটি সন্তানের আশা ও আশ্বাসের। তাঁর মনে কোনো ক্ষোভ ছিল না, ছিল সবাইকে আপন করে নেওয়ার এক কোমল মন। জিব্‌রাইলের ডানা গল্প দিয়ে তিনি সাহিত্যে স্থায়ী আসন পেয়েছেন। এই জিব্‌রাইলের ডানা নিয়ে বিশ্বখ্যাত অনেক পরিচালক ছবি করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু কোথাও কোনো সমস্যা ছিল বিধায় তা আর হয়ে ওঠেনি। তবে এ নিয়ে তাঁর কোনো আক্ষেপ ছিল না।

গল্পটি আমি ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে অদ্যাবধি কতোবার যে পাঠ করেছি; তার কোনো ইয়ত্তা নেই। গল্পের নামকরণের ভেতর যেমন একটি ঘোরলাগা ভাব ব্যঞ্জনা আছে, তেমনি ভেতরেও অনন্ত রহস্যের সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক। নবী চরিত্রের নিঁখুত বিনির্মাণের মাধ্যমে লেখক গল্পটিকে নিয়ে গেছেন অনন্য এবং অতুলনীয় এক উচ্চতায়। হালিমা এবং নবী মা এবং পুত্র। ক্রমাগত দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে মহান স্রস্টার প্রতি মা হালিমার মন যখন অভিমানী; তখনই পুত্র নবী একদিন দুই ডানা বিশিষ্ট নুরানি চেহারার কাউকে দেখেন। তার ডানাগুলো ছিল ময়ুরের পেখমের চেয়েও সুন্দর। আসল ঘটনা হল, হালিমা এবং নবী একই সাথে বসেছিল। কিন্তু সেই নুরানি ডানা বিশিষ্ট কাউকে কেবল নবী দেখেছে; কিন্তু হালিমা দেখেনি। আর তাই হালিমার ক্ষত বিক্ষত মন সেটা মানতে রাজি হতে চায়নি। কিন্তু হালিমা মানুক…. কিংবা না মানুক.. নবীর দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি নিশ্চয়ই ফেরেশতা জিবরাইল।

অসংখ্যবার গল্পটি পাঠের পর আমার কাছে মনে হয়েছে “জিবরাইলের ডানা” মুলত একটি ছায়া গল্প। লেখক এখানে প্রতীকী ভাবে শিশুনবী হজরত মুহাম্মদ (সা:) এবং তাঁর দুধমাতা মা হালিমার চরিত্র মাধুর্যের সরাসরি না হলেও প্রতীকী রুপায়নের চেষ্টা করেছেন। যদিও গল্পের ঘটনার সাথে শিশুনবী মুহাম্মদ (সা) এবং মা হালিমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বাস্তবিক অর্থে কোনো মিল নেই। তবুও এর রেশ আছে বলেই আমার বিশ্বাস৷ আর সম্ভবতঃ এখানেই প্রিয় গল্পকার শাহেদ আলীর সার্থকতা। লেখকের প্রিয় রং ছিল নীল। তাই গল্পের নায়িকাকেও তিনি নীল রঙে রঙিন করে তুলেছেন বিভিন্ন গল্পে। তাঁর জিব্‌রাইলের ডানা উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি ও রাশিয়ান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। গল্পটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এবং নিগুঢ় রহস্য, নবী ও তার মা হালিমার কথোপকথনের মাধ্যমে সরল, সহজ এবং হৃদয়গ্রাহী ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন।

গত ২৬ মে ছিল প্রয়াত কথাশিল্পী অধ্যাপক শাহেদ আলীর জন্মদিন। কিন্তু একটি জাতীয় পত্রিকাও এ বিষয়ে কোন লেখা প্রকাশ করেনি। যা অত্যন্ত বেদনার এবং হতাশার। এই উপেক্ষা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাছাড়া আমরা মনে করি, শাহেদ আলীর লেখা নিয়ে আরও বেশি গবেষণা হওয়া উচিত। তাতে করে আমরাই লাভবান হবো।।
————–

নজরুল সাহিত্যে বিদেশি শব্দের প্রভাব

jasim বলা হয় বাংলা সাহিত্যে ধুমকেতুর মতো যার আবির্ভাব, তিনিই হলেন আমাদের জাতিসত্তার প্রধানতম কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ধুমকেতুর সাথে তুলনাটি মোটেই অমুলক নয়। যখন তাঁর লেখালেখির জীবন সবেমাত্র যৌবন ছুঁয়ে যেতে শুরু করেছে, তখন তিনি লেখার ক্ষমতা হারালেন, বাকশক্তি হারালেন। ভাগ্যের এই নিষ্ঠুর পরিহাসে ধুমকেতুর মতো আলো জ্বেলে সহসাই সাহিত্য অঙ্গন থেকে বিদায় নেন। আমরা তথা গোটা বাংলা সাহিত্য বঞ্চিত হলাম ধারালো তলোয়ারের মতো ক্ষুরধার লেখনি থেকে। সাহিত্য প্রেমী সকল মানুষ তখন শোকে কাতর, মুহ্যমান। হয়ত নজরুল সারাজীবন লিখতে পারলে বাংলা সাহিত্য রবি ঠাকুরের পর আরও একটি নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির গৌরব করতে পারতো, অহংকার করতে পারতো। নজরুল কে ছিলেন, আসুন আমরা তার নিজের মুখেই শুনি- ১৯২৭ সালে এক সাহিত্য সভায় তিনি ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন পচা সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভন্ডামি আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে।’

যে কোনো ভাষাতেই অন্য ভাষার শব্দ আত্মীকরণ অস্বাভাবিক কিছু নয়। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ঔপনিবেশিক কিংবা অন্য কোনো কারণে এই আত্মীকরণের ঘটনা ঘটে যাকে। তবে আত্মীকরণের এই প্রভাব সকল কবি, সাহিত্যিকের বেলায় সমান নয়। কারো কারো ক্ষেত্রে এই প্রভাব কম আবার কারো কারো ক্ষেত্রে এই প্রভাব বেশি। সম্ভবতঃ বাংলা সাহিত্যে যার লেখায় বিদেশি শব্দের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি তিনিই হলেন আমাদের প্রাণের কবি, বিদ্রোহী কবি, দ্রোহের কবি, সাম্যের কবি, মানবতার কবি অসাম্প্রদায়িক চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুল অভিধান শব্দসূত্রে জানা যায়, মুসলিম সংস্কৃতির মন, মনন ও চিন্তনের দিকেই শুধু নয়, হিন্দু সংস্কৃতির গভীর থেকে গভীরতর এবং বাঙালি সংস্কৃতির দ্যোতনার দিকেও সবাইকে যিনি উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন, তিনিই আমাদের প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। দেশি-বিদেশি শব্দের নিত্যনতুন বাহারে কিংবা যথার্থ ব্যবহার দিয়ে তিনি সবশ্রেণির পাঠককে বেঁধে রেখেছেন। কখনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে,হুঙ্কার দিয়েছেন আবার কখনও মানবতার জয়গান গেয়েছেন।

তাঁর সাহিত্যকর্মে আরবি-ফারসি শব্দের বেশ ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। যদিও কবি নজরুলের আগেও অনেক কবি এবং লেখক আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন। তবে তা ছিল নিতান্তই সীমিত, সীমিত মাত্রায়। এখানেই নজরুল সত্ত্বার স্বাতন্ত্র্য। তিনি পদ্য, গদ্য, কিংবা গান সবক্ষেত্রেই বিদেশি শব্দের ব্যবহার করেছেন অন্যদের তুলনায় ঢের বেশি। তবে কেবল আরবি-ফারসিই নয়, তিনি উর্দু ও হিন্দি শব্দের ব্যবহারও করেছেন সমানতালে। যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হল, তার ব্যবহৃত এসব শব্দের অধিকাংশই এখন বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে। আবার কিছু শব্দ আছে কোনোভাবেই বাংলার সঙ্গে তাল মিলাতে না পেরে অব্যবহৃতই থেকে গেছে।

এ বিষয়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর বলেছেন, “নজরুল মোল্লা-মৌলবীদের মতো ভালো আরবি-ফার্সী না জানলেও কাব্যের রস আস্বাদন করতে পেরেছিলেন। তার ব্যবহৃত অনেক শব্দই বাংলা ভাষায় যুৎসইভাবে ঠাঁই নিয়েছে। আবার কিছু আরবি-ফার্সী শব্দ ‘সুকৌশলে’ ব্যবহার করলেও তা বাংলা হয়ে উঠেনি। বরং আরবি-ফার্সীই রয়ে গেছে। ‘হিম্মত, জাহান্নাম, ঈমান, জানাজা, আসমান, ইনসান, আহাদ, মুর্দা-ইত্যাদি নজরুল ব্যবহৃত শব্দ এখন পুরোদস্তুর বাংলা। অবশ্য বাংলার বাগ্‌বিধিকে নজরুল উপেক্ষা করেননি, বরং সুসামঞ্জস্যভাবে আরবি-ফার্সী শব্দের বিন্যাস ঘটিয়েছেন। তাই লিখেছেন, ‘নীলিম প্রিয়ার নীলা গুলরুখ লাজুক নেকাবে ঢাকা’, ‘ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ।”

তবে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যে অধিক সংখ্যক আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও কম হয়নি। বাংলা সাহিত্যে চলিত রীতির প্রথম সার্থক রুপকার প্রমথ চৌধুরী বাংলা ভাষার জাতপাত সম্পর্কে বলেছিলেন, “বাংলা সাহিত্য থেকে আরবী-ফার্সী শব্দ বহিষ্কৃত করতে সেই জাতীয় সাহিত্যিকই উৎসুক যারা বাংলা ভাষা জানেন না।” অবশ্য প্রখ্যাত সাহিত্যিক দীনেশচন্দ্র সেন এ বিষয়টি গভীরভাবে অনুধ্যান করে বলেছিলেন “গত পাঁচ, ছয়শত বৎসরের মধ্যে বাংলা ভাষাটা হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের হইয়া গিয়াছে। মুসলমানের ধর্মশাস্ত্র ও সামাজিক আদর্শ অনেকটা আরবী ও ফার্সী সাহিত্যে লিপিবদ্ধ। সেই সাহিত্যের জ্ঞান তাহাদের নিত্যকর্মের জন্য অপরিহার্য। আমাদের যেমন সংস্কৃতের সহিত সম্বন্ধ আছে, আরবী ও ফার্সীর সঙ্গে তাহাদের কতকটা তাই।” দীনেশ চন্দ্রের এই উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। আমি মনে করি, তিনি যথার্থ বলেছেন।

আমিও গভীরভাবে বিশ্বাস করি, আরবি ও ফার্সি শব্দ সমূহে মুসলমানদের ধর্মীয় ও নিজস্ব সংস্কৃতির বিশ্বাসের সাথে গভীর ঐতিহাসিক ও সমন্বয়ের সূত্রটি কাজী নজরুলের ভেতরে ভেতরে কাজ করেছে। অবশ্য এখানেই নজরুলের বিশেষত্ব। কেননা তিনি একাধারে নিজ ধর্মবিশ্বাস এবং সাংস্কৃতিক চেতনা যেভাবে অন্তরে লালন করেছেন, তেমনিভাবেই তিনি নিজধর্মের বাইরে অন্যান্য সকল ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। নিজের ধর্মের গণ্ডির বাইরে এসে অন্য ধর্মের প্রতি নজরুলের এই যে অসাধারণ উদার মানসিকতা তা এতটা প্রবলভাবে অন্য কোনো কবি সাহিত্যের মাঝে পাওয়া যায় না। এমনকি রবীন্দ্রনাথকে মাঝেও না। নজরুল একাধারে বহুভাষাবিদ, গবেষক ও পণ্ডিত র মতো একদিকে যেমন সংস্কৃত ছন্দ অধ্যয়ন করেছিলেন, তেমনি আরবি-ফারসি ভাষা থেকেও প্রচুর শব্দ ছন্দ ও সুর আনয়ন করে বাংলা কাব্য ও সাহিত্যকে মুসলিম ঢঙ্গে সাজাবার প্রয়াসী হয়েছিলেন।
‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সম্পাদক মিস্টার ওয়ার্ডওয়ার্থ সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেন, “কোন একটা ভাষায় অন্যভাষার শব্দ প্রবেশ করবে কিনা; তা লেখকের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। যে সাহিত্যিকেরা অন্যভাষার শব্দ চয়ন করে নিজের ভাষার মধ্যে মিলিয়ে দিতে পারবেন তিনি ততো বড় শক্তিশালী সাহিত্যিক।” সত্যিকার অর্থেও তাই। কিছু সমালোচক সমালোচনা করলেও আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, নজরুল সাহিত্যে বিদেশি শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে।
————————
.
০২/৬/২০২৩। ইনকিলাব সাহিত্য।

আমার রবীন্দ্রনাথ

_11

সদ্য রবীন্দ্র তিথি গেলো। সবাই তাঁকে নিয়ে পোস্ট করছেন। আমারও শখ হলো পোস্টাতে। একটা বছর তিন-চারের পুরোনো, প্রকাশিত লেখা।

আমার রবীন্দ্রনাথ
ভালো বই শিক্ষকের সমান। যে মানুষ বই পড়েন তাঁর অনেক শিক্ষক। আমাদের মাথার উপর অনেক দিকনির্দেশক ছায়ার হাত ছিল। সেইসব হাত আমরা ঠেলে সরিয়েছি। অধীত জ্ঞান আর বিদ্যাকে জীবনে ক’জনই বা প্রয়োগ করতে পারি? শুধু সব অনুভবের অনুভবী সর্বগ্রাসী রবীন্দ্রনাথকে সবটুকু ঠেলে ফেলতে পারি নি।

আজ ঘর-বারের এমন ওলঢাল দেখে তোমাকেই রবিঠাকুর, মনে পড়ে যায় গো ! সামনে – কাছে – দূরে অজস্র যে পথ ও জীবন, – সব দিকেই তোমার বাণীমূর্তি। তোমায় কত সামান্য পড়েছি, কত সামান্য পরিমাণে ভেবেছি। তোমার ভাব আর অনুভবকে ধারণ ও বহন করতে না পারার দীনতা আমার। তবু যেটুকুও ধরা দাও – সে তোমারই প্রসাদ গুণ।

“সহজ পাঠ” দিয়েই জীবনের শুরুতে সুষমাকে চিনেছিলাম। তারপর “শিশু”, “শিশু ভোলানাথ”…! বইএর পাতা থেকে চট করে আঙুলটা সরিয়ে নিয়ে রহস্যময় হাসিটি হেসে, ‘দাঁড়াও, এক্ষুনি আসছি। ততক্ষণ তুমি …” বলেই ধাঁ হয়েছিলে।

তারপর এই অকূল সমুদ্র-তীর। কড়া রোদে পুড়ে যাচ্ছি, তেষ্টায় ছাতি ফাটছে। পা পুড়ে যাচ্ছে তপ্ত বালিতে। কত কথাই বলে চলেছি তোমার উদ্দেশ্যে, সেসব কথার পাতা হাওয়ার পাগল উড়িয়ে দিল এদিক ওদিক। অথচ দেখ, একটা যদি মেঘছায়া দিন হতো ! … ধরো, খুনসুটির বাতাসে চুল উড়ছে – আঁচল উড়ছে… গাছের ডালে সবুজ কচিকাঁচারা কী উজ্জ্বল! আহা! কেন এমন করে পা ভেজানো নীলাম্বুরাশি আমায় খুশী দিল না বলো তো?

শুধু দেহে নয়, মনেও তো বাঁচতে চাওয়া! আমার মনের কোনে – বাইরে দূরে – আমার অতীত বর্তমান ভবিষ্যত – আমার সকাল সন্ধ্যা – আমার গ্রীষ্ম বর্ষা – সব স-ব-খানে, আমার ভাঙা পথের রাঙা ধুলোয় তোমার পদছাপে চোখ রেখে পথের নির্দেশ পেতে চাইলাম। ভাঙা নৌকায় বৈঠাহীন ঝড়ের রাতে তুমি একটিবার এলে না, ব্যর্থ অভিসার! তবু তোমাকেই বিশ্বাস করতে চেয়েছি যে, সবই শেষ পর্যন্ত পরমের দিকে এগিয়ে যায়।

সারা শ্রাবণ মাথায় নিয়ে একা জিওল রাস্তায় গোধূলি ভেঙে চললাম কোনো এক শৃঙ্গজয়ের দিকে তাকিয়ে। তুমি কুপি জ্বেলে দোরে এলে, আর যদিও তোমার খোয়াই সাজানো ভেজা দুয়ারে বসতে পারলাম এক মুহূর্ত, তবু ভবিতব্য এই যে, বর্ষাভেজা হাঁসশরীর সেই গেরস্থালীর পালকই ঝেড়ে চলেছে।

কার জীবন কে যাপন করছে তা-ই বুঝি না! তোমার কুমুদিনীকে মনে পড়ে যায়। জাগরণে কাতরাতে কাতরাতে জ্বালা জ্বালা চোখ খুলে প্রস্তুত হই। তার মতো করে ভাবি যে স্বামীসঙ্গে সফল করে তুলব আজকের যাপন, তোমার লাবণ্যর মতো পেলব করে তুলব – ইহ গচ্ছ ইহ তিষ্ঠ – সে দিনটি। অথচ সেই দম দিয়ে দেওয়া পুতুল। ক্রমাগত ছুট ছুট রান্নাঘর – নিজের ঘর ( নিজের!) – খাবার না দেখেই মুখ থেকে দু-গ্রাস পেটে চালান। তারপর ঘাম মুছতে মুছতে চক-ডাস্টার। যদি পড়াতে চাইলাম কবিতা, কিংবা কম নম্বর পাওয়া মেদুর চোখের ছাত্রীটির মধ্যে ফটিককে দেখে কাশের ডাঁটা চিবুতে চিবুতে নদীর ধারে হাঁটতে চাইলাম, অমনি সিলেবাস দরজার সামনে কড়া চোখে এসে দাঁড়াল। … দিনশেষে দেখি সব প্রস্তুতি গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছেন “মধুসূদন”। তোমার কথা মানলে হয়তো এও ব্যর্থ নয়!

অন্ধকার ঘরে কখনো কখনো তুমি সাগর সেন বা দেবব্রত-র গলায় বেজে চলো। সারারাত। আমি যখন তোমাতেই বাস করি, যখন আবদার করি, সপসপে ভিজে কাঁপতে থাকা আমাকে তুমি শুশ্রূষায় টেনে ভিজে মাথা মুছিয়ে দাও তোয়ালেতে – তখন আমার পিতা তুমি। আমার জ্বরো কপালে জলপট্টি দিয়ে কখনো তো পাশে বসেছ মায়ের মতো! আর ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে যখন বেজেছে, ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু হে প্রিয়’, পরানসখা, আমার হাত ধরে পথ চলার অঙ্গীকার চেয়েছি।

তুমি ‘আসছি’ বলে চলে গেলেও আমি বাধ্য ছাত্রীর মতো সেই পাঠ থেকে তোমার অসীমের দিকে যেতে চেয়েছি – তোমাকেই ছোঁব বলে। সেই এক রহস্যময় হাসি আমার প্রাণে সুর তুলল। নির্জন, একান্ত নিজের দুপুর আর রাতগুলোতে উপভোগ করি তোমার নির্মাণের পাকা কতবেল; সেসব সেই ধুলোবেলা থেকেই সব উপকরণে মজে উঠেছে।

মাটির ঘরের ছোট্ট জানালা দিয়ে একদিন দেখে ফেলেছি “জনহীন প্রান্তর” পার হয়ে “জ্যোৎস্না সমুদ্রের” চাঁদের নৌকো আমার ঘাটে এসে লাগতে। ‘সহজ পাঠ’ কতটা সহজ হলে মদিরতার মউল ফুল ছড়িয়ে পড়ে বালিকা হৃদয়েও। কাল যে ডাল খালি ছিল আজ কী করে ফুলে ভরে বিস্ময়ের পরম্পরায় সে অবাক ঘোর আজও কাটল না। গাছের ভেতর রয়ে গেল সম্ভাবনার কুঁড়ি। বায়োস্কোপে একটার পর একটা পালটে যাওয়া ছবির মতো কবিতায় পরতের পর পরতে কল্পনার দৃশ্যপট খুলে গেছে। আবার গদ্যে অনুপ্রাসের ঠমকে বোষ্টমী, বিশ্বম্ভরবাবু, শম্ভু, নিস্তারিণী দেবীর কাহিনীর রসের ভাঁড় টুপিয়ে হাতের খুদে তালু শুধু ভরে দেয় নি, মনের কোণে ছন্দের মৌমাছিও চাক বেঁধে ফেলেছিল। তাই স্বীকারোক্তির পায়রা উড়িয়ে দিই – মধুর তোমার শেষ যে না পাই -।

তুমি ডাক শুনেছিলে ‘জীবন দেবতার’। আমি আসি তোমার ডাকে। “স্তব্ধ রাতের স্নিগ্ধ সুধা পান করাবে …” – তাই কি ডেকেছ, আমার প্রিয়টি?

আধভাঙা চাঁদ ভাসিয়ে দিচ্ছে চরাচর। পিউ কাঁহা বুকের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা রোদনপুঞ্জ ভেঙে দিচ্ছে কাতরতা দিয়ে। বেদনার সুখ এত মধুর! তুমি এত শেখাও তাকে কী করে আঁজলা ভরে চুমকে পান করতে হয়। বেদনাকে সানন্দ নান্দনিক করে তুলে কতখানি বিশ্বজনীন করা যায় তা তুমিই দেখালে। তবু শিখতে পারি নি, বরং নৈর্ঋতে বা ঈশানের দিকে পালিয়েছি কতবার! তার মুখোমুখি হয়ে চোখে চোখ রেখে দাঁড়াতে পারি নি। তুমি আমার পালিয়ে যাওয়ার পথে পথে গাছ হলে, হাঁফধরা কর্মক্লান্ত চাষির মতো একটু জিরিয়ে নিতে বসেছি তোমারই ছায়াতলে।

তুমি শিখিয়েছ ‘আমি ‘ও ছোট নই। তুমি বললে ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে।’ ‘অসীম ধন’ তোমার হাতে, সে ধনে আমারও যে সত্ত্ব – ইচ্ছাপত্র লিখলে। তাই নিজেকে চিনতে নিজেকেই চিঠি লিখি ; ভাঁজের পর ভাঁজ খুলে, রেখার পর রেখা টেনে সম্পূর্ণ করে দেখতে চাই। এসবের সঙ্গে তোমাকেও পড়ে চলেছি, চিনে চলেছি। তুচ্ছ এই আমার ‘আমি’কে চেনাজানারও শেষ নাই। একটা ক্ষয়া হলদেটে পাতার আকাশের সীমা ছোঁয়ার ক্ষমতা কোথায়?

তোমার কড়ে আঙুল ধরে আসন বগলে ক্ষুদিরাম মাস্টারমশাইএর ধপধপে উঠোনের লেবুতলায় গিয়ে বসেছিলাম। তুমি অপেক্ষায় দূরে দাঁড়িয়ে থাকলে। একদিন বাসস্টপে বাসে তুলে দিয়ে হাত নাড়লে।… বাড়ি ফিরতে দেরি হলে শাসন করলে। তারপর যেদিন জানলা জুড়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার দিন, বুকের ভেতর চাঁদ আটকালো – সেদিন আবার বুঝলাম তোমার কাঁধের বিস্তার। সহর্ষ রাত কাটিয়েছি নির্ঘুম। ডালপালা মেলে তুমিও সারারাত জেগে থেকে প্লাবন সামলালে। আনন্দে – বেদনায় – হতাশায় – জয়ে – পরাজয়ে তুমি আমার কাছে দু-এক কলিতেই ফিরে ফিরে আসো আমার ধারণ ক্ষমতা খুব সামান্য বলে! আমার খরচের বহর, চার্বাক মেনে ঋণের পর ঋণ জমে যায় তোমার কাছে। শুধতে ভারি ভয়েই গেছে! সেই ঋণেই তো জীবন চলছে।

তবু এই দরিদ্র আমি কতবার বলেছি, ‘তোমায় কিছু দেব বলে চায় যে আমার মন / নাই বা তোমার থাকল প্রয়োজন’। দ্যাখো, মন কেমন টুসটুসে হয়ে গেল! ভালো লাগার কবোষ্ণ হাত পাঁজর ছুঁয়ে গেলে চিরকাল কেন কান্না পেল, ঠাকুর?

কবিগুরুর জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি

dduu

বাঙালির আত্মিক মুক্তি ও সার্বিক স্বনির্ভরতার প্রতীক, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষের নায়ক, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬২তম জন্মবার্ষিকী আজ…..

কবিগুরুর জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি –
মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
পার হয়ে আসিলাম
আজি নব প্রভাতের শিখর চুড়ায়;
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
আমার পুরানো নাম। — রবীন্দ্রনাথ

সম্পর্ক নাকি অভিনয়

একটা সম্পর্ক সুন্দর ভাবে চিরকাল অটুট রাখার উপায় কি হতে পারে?
১. প্রতারণা ২. অভিনয় ৩. টাকা ৪. অত্যাচার ৫. বিশ্বাসঘাতকতা ৬. নির্দিষ্ট সময় শেষে পৃথককতা ৭. আর কি হতে পারে…

যা খুঁজে বেড়াচ্ছেন….
১. বিশ্বাস ২. বন্ধুত্ব ৩. ভালোবাসা ৪. সম্মান করা ৫. আস্থা রাখা

যা হয়,
রাগান্বিত বা উত্তেজিত হলে এই সবই ফুড়ুৎ।

হাজার মানুষের ভালোবাসার সম্পর্কের উক্তি দিয়েও সম্পর্ক ঠিকে না কারণ এগুলো সবাই অন্যকে দেখানোর জন্য পড়ে বা বলে কিন্তু কেউ ধারণ করে না।

আসলে সঠিক উপায় টা কি ধর্মীয় বিশ্বাস নাকি অভিনয়? যেখানে আমাদের সময়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা খুবই দরকার না হলে পৃথিবীটা দুর্গন্ধে ভরে যাবে…

আদরের পুসি ও হিন্দুধর্মে বিড়াল সমাচার

n01

ছোটবেলা থেকেই কুকুর, বিড়াল, গরু-ছাগল ভালোবেসে আসছি। এই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত নয়, ঘরের জায়-জিনিস নষ্ট করে ফেলা ইঁদুরও। সময় সময় দুপুরে আর রাতে ভাত খেতে বসলে নিজে খাবার মুখে দেয়ার আগে ঘরের ইঁদুরের জন্য একমুঠো ভাত এক কোণে রেখে দিই। রাতে সবাই ঘুমিয়ে থাকলে ওই একমুঠো ভাত ঘরে উত্তাপ করা ইঁদুরগুলো মিলেমিশে সাবাড় করে ফেলে। আবার রাস্তার একটা কুকুর সামনে আসলে ওকে কিছু খাবার কিনে দিই, কুকুরটা মনের আনন্দে লেজ নেড়ে খায়। একটা বিড়াল সামনে আসলে ওকেও খাওয়াতে মন চায়। কারোর গরু-ছাগল দেখলে সামনে গিয়ে আদর করি, মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। কিন্তু দুঃখের কথা হলো মনের ভেতরে এসব পশু-পাখির বিস্তর ভালোবাসা থাকলেও নিজের বাড়ি-ঘর না থাকার কারণে মনের শখ মনে ভেতর রেখেই চলতে হয়। তারপরও মাঝেমাঝে শত ঝামেলা উপেক্ষা করে ভাড়া বাসায় কুকুর-বিড়াল পুষতে থাকি।

এইতো কয়েক বছর আগে ২০১৬ সালে শখের বশে একটা কুকুর ছানা বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম, ওটাকে পুষবো বলে। কুকুর ছানাটির নামও রেখেছিলাম “ধলু”। কিন্তু নিজের ধর্ম হিন্দু বলে কথা। কুকুর ছানাটি বাসায় নেয়ার পর নিজের সহধর্মিণীর সাথে লেগে গেলো কথা কাটাকাটি, আর হট্টগোল! ছিছিছি, রামরাম, হায় ভগবান হায় ভগবান! তারপরও দমে যাইনি। শেষমেশ ভাড়া বাড়ির আরও আরও ভাড়াটিয়াদের নানা কথা সহ্য করতে না পেরে ধলুকে আর নিজের কাছে রাখতে পারিনি। শেষাবধি ৭দিন পর ধলুকে ধলুর মায়ের কাছেই পৌঁছে দিতে হয়েছিল। তারপর ধলু একসময় অনেক বড় হয়ে গেলেও ওর প্রতি আমার ৭ দিনের ভালোবাসা কিছুতেই ধলু ভুলতে পারেনি। দিনরাত ধলুর ডিউটি ছিলো আমার দেখাশোনা। এভাবে কেটে গেলো প্রায় চারবছর।

n02
আমার আদরের কুকুর ‘ধলু’ এখন পরপারে।

একদিন আমি আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি সপরিবারে বেড়াতে গেলে সেখানে থাকতে হয় ১৫ দিন। এই দিনেক ১৫ দিনই ধলু আমাকে না দেখে খাওয়া-পিনা বাদ দিয়ে শুধু আমার আশায় রাস্তার দিকে চেয়ে থাকতো। এই ১৫ দিন ধলুকে অনেক মানুষে অনেক খাবার কিনে দিয়েছিল। কিন্তু ধলু কারোর কিছুই মুখে দেয়নি। অবশেষে ধলু না খেয়ে থাকতে থাকতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তারপর চিত্তরঞ্জন গুদারা ঘাটের কিছু মাঝি মিলেমিশে ধলুকে শীতলক্ষ্যার মাঝ নদীতে ফেলে দেয়। আমি আত্মীয়ের বাড়ি থেকে এসে ধলুকে দেখতে গুদারা ঘাট গেলে ধলুর মৃত্যুর খবর শুনে রীতিমতো কেঁদেই ফেললাম। তারপর দুচোখের জল ফেলতে ফেলতে বাসায় ফিরে যাই। সেই শোকে আর কখনো কুকুর বিড়াল পুষবো না বলে মনস্থির করি। কিন্তু না পারলাম না। ইদানীং আমাকে একটা বিড়াল ছানার প্রেমে পড়তেই হয়েছে।

গত কয়েক মাস আগে বিড়াল ছানাটি আমার বাসায় ঢোকে। তখন রাত নয়টা। আমিও কর্ম ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরি। বাসায় ফিরে দেখি বাসার সামনে আমার সহধর্মিণী-সহ ভাড়া থাকা বাড়ির আরও আরও মহিলারা জড়ো হয়ে আছে। তা দেখে আমি একটু তাড়াতাড়ি করেই বাসার সামনে গেলাম। বাসার সামনে গিয়ে আমার গিন্নীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ঘটনা কী?’
বললো, “দেহ না বিলাইর বাচ্চাটা খালি আমগো বাসায় ঢুকে। এডারে খেদাইয়া দিলেও যায় না, আবার মে মে কইরা বাসায় ঢুকে। এডারে ধইরা বাড়ির বাইরে দিয়া আহ।”
আমি আমার সহধর্মিণী বা গিন্নীর কথায় কান না দিয়ে বিড়াল ছানাটিকে কোলে তুলে নিয়ে বাইর থেকে ঘরের ভেতর চলে গেলাম। তা দেখে আমার গিন্নী তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে বললো, “হায় ভগবান, কারে কি কইলাম? হেরে কইলাম বাইরে নিয়া ছাইড়া দিতে, আর হে কোলে তুইলা ঘরে আনছে।”
আমি গিন্নীর কথার উত্তর না দিয়ে বিড়াল ছানাটিকে বললাম, ‘আমিতো তোমাকেই খুঁজতেছিলাম। গত রাতে আমি তোমারে স্বপ্নে দেখছি।’
আমার এই কথা শুনে আমার ধার্মিক গিন্নী সামনে এসে বললো, “হাচাই কইছ? হাচাই স্বপ্নে দেখছ?”
বললাম, ‘মিথ্যা কিছু বলিনাই। যা সত্য তা-ই বলছি। ও আজ থেকে আমার ঘরেই থাকবে। যার যার ভাগ্যে যা আছে তা-ই হয়। আমি খাইলে, ও-ও খাবে।’
এসব বলার পর আমার গিন্নী আর কোনকিছু না বলে শুধু বললো, “হাগলে মুতলে আমি ছাপ করতে পারুম না। ওইসব তোমারই করন লাগবো। বুইঝা নিয়েন।”
বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। ওর যা যার করা লাগে, আমি নিজেই করবো। এটার জন্য তোমার কিছু ভাবতে হবে না। তুমি নিশ্চিন্তায় থাকতে পার।’

n03

তারপর দিন বিড়াল ছানাটির কি নাম রাখা যায়, তা নিয়ে গিন্নীর সাথে বৈঠক করলাম। আমি নাম রাখতে চেয়েছিলাম কুকুর ধলুর নামের সাথে মিলিয়ে ‘ধলি’। আমার গিন্নী ভেটো দিয়ে সেই নাম ক্যান্সেল করে গিন্নী আর আমার বড় নাতিন দুইজনে মিলে নাম রাখলো, ‘পুসি’।
বৈঠকে সেই নামই পাস হলো। সেই থেকে বিড়াল ছানাটি ভাড়া বাড়ির সবার কাছে এখন পুসি নামে বেশ পরিচিত। এর চারদিন পর একদিন আচমকা ‘পুসি’ বিছানায় পায়খানা করে ফেলে। এই পায়খানা নিয়ে ঘটে গেলো তেলেসমাতি কারবার। পায়খানা পরিস্কার করা নিয়ে কথা কাটাকাটি, রাগারাগি, লাফালাফি-সহ আরও অনেককিছু। শেষাবধি আমার ধার্মিকের সহধর্মিণী নিজেই ‘পুসি’র পায়খানা পরিস্কার করে বিছানার চাঁদর ধুয়ে দেয়। কিন্তু গিন্নির মনের ভেতরে থেকে যায় ভীষণ ক্ষোভ। সেই ক্ষোভ কাজে লাগায় পরদিন রাতে।

ঘটনাটা ঠিক রোজা শুরু হবার দুইমাস আগে। এই দিনগত রাত তখন প্রায় তিনটা। আমি তখন ঘুমে বিভোর। আমি পরম শান্তিতে যখন নাক টেনে ঘুমাচ্ছিলাম, আমার গিন্নী তখন ‘পুসি’কে ঘরের বাইর করতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ‘পুসি’ তখন আমার পাশেই আমার মতো ঘুমে বিভোর। আমার গিন্নী মায়াদয়া ধূলিসাৎ করে ‘পুসি’কে টেনে নিয়ে ঘরের বাইরে ছেড়ে দিয়ে, ঘরের দরজা বন্ধ করে, বিছানায় এসে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ে। এর কিছুক্ষণ পর ঘরের দরজায় মানুষের দেয়া টোকা। দরজায় টোকা কে-না-কে দিয়ে মা মা বলে ডাকছে। আমার গিন্নী দরজায় টোকার শব্দ আর মা মা ডাক শুনতে পেয়ে হতভম্ব হয়ে ঘরের ভেতর থেকে বলছে, “এই তুমি কে? কিল্লাইগা মা মা কইয়া ডাকতাছ?”
ঘরের বাইর থেকে উত্তর এলো, ‘মা আমি তপন (মানে আমার মৃত ছেলে তপন)। বিড়ালডা কানতাছে। ওরে ঘরে লইয়া যাও।’ আমার গিন্নী নিজের মৃত ছেলের কণ্ঠস্বর শুনে আবারও জিজ্ঞেস করলো, “কেডা তুমি?” আবার উত্তর এলো, ‘মা আমি তপন। বিলাইর বাচ্চাডা ঘরে নিয়া যাও। ও খুব কানতাছে।’
আমার গিন্নী তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে ঘরের দরজা খুলে কাউকে দেখতে পেলো না। দেখল পুসি দরজার সামনে বসে বসে মে মে করছে। পুসি মে মে করতে করতে এক লাপে ঘরে ঢুকে গেলে আমার গিন্নী ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর গিন্নী কাঁপতে কাঁপতে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। আমি ঘুম থেকে জেগে দেখি আমার গিন্নী থরথর করে কাঁপছে! জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে? কাঁপছো কেন?’
আমার গিন্নী কাঁপতে কাঁপতেই ঘটনার বিবরণ খুলে বললো। আমি শুনে বললাম, ‘তাহলে তুমি পুসি’কে ঘরের বাইরে এতো রাতে ছাড়লে কেন?’ প্রশ্নের উত্তর আর মিললো না। এরপর থেকে আমার গিন্নী অন্তত পুসি’কে নিয়ে আর কোনপ্রকার অভিযোগ করেনি। বরং সকাল-সন্ধ্যা পুসি’কে নিজের কোলে-কাঁখেই রাখে। সময়মতো খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, আদরযত্নও ঠিকঠাকমত করতে থাকে।

n04
দোলপূর্ণিমার দিন পুসিকে নিয়ে বাড়ির সবাই রং খেলায় মেতে ওঠে।

এ-র মাঝে একদিন আমার বড় নাতিন পুসি’কে নিয়ে খেলতে থাকে। হঠাৎ মনেহয় পুসি’র অজান্তেই পুসি’র পায়ের নখের আঁচড় নাতিনের হাতে লাগে। সাথে সাথে নাতিনের হাত থেকে আঁচড়ের স্থান থেকে রক্ত বের হতে থাকে। আমি তখন আমার কর্ম ডিউটিতে ব্যস্ত! বাসায় এসে দেখি নাতিনের হাতের অবস্থা। গিন্নীও রেগে-মেগে অস্থির হয়ে বলতে লাগলো, “আমার নাতিনের যদি কিছু হয়, তাহলে বুঝে নিয়েন। তাড়াতাড়ি নাতিনকে নিয়ে হাসপাতালে যাও। জলাতঙ্ক ইনজেকশন দিয়া নিয়া আসো”। গিন্নীর রাগারাগি আমার আর সহ্য হলো না। সাথে সাথে ডাক্তারের পরামর্শ নিলাম। ডাক্তার বললো, ‘কিছুই হবে না ঠিক, কিন্তু মন থেকে তো আর ভয় দূর হবে না, দাদা। তাই হাসপাতাল থেকে জলাতঙ্ক রোগের ইনজেকশন দিয়ে আনেন।
তা-ই হলো। প্রায় ৬০০ টাকার মতো খরচ হলো। তারপর আর যাতে কেউ পুসি’র আঁচড় কামড়ের শিকার হয়ে জলাতঙ্ক আর ধনুষ্টংকার রোগ নিয়ে চিন্তিত না করে, তারজন্য পুসি’কে উপজেলা পশু হাসপাতাল থেকে জলাতঙ্ক, ধনুষ্টংকার প্রতিরোধক ইনজেকশন দিয়ে আনি।

এখন পুসি আগের চেয়ে অনেক বড় হয়েছে। পুসি এখন ঘরে মলমূত্রও ত্যাগ করে না। কোথায় করে তা-ও কেউ দেখে না। আমি দু-এক দিন ওর মলমূত্র ত্যাগ করার দৃশ্য দেখেছিলাম। এখন আর আমি নিজেও দেখি না। কিন্তু ওর মলমূত্র ত্যাগ করার সময় হলে ঘরের সবাই টের পেয়ে থাকি। ঘর বন্ধ থাকলে পুসি ঘরের বন্ধ দরজার সামনে গিয়ে মে মে করতে থাকে। দরজা খুলে দিলেই দে দৌড়। কাজ সেরে আবার নিজে নিজেই ঘরে ফিরে আসে।

আমি দুপুরের বাসায় গিয়ে যদি দেখি যে, পুসি ঘরে নেই। তারপর আমি পুসি পুসি বলে ডাকলেই পুসি যেখানেই থাকুক-না-কেন, আমার সামনে এসে হাজির হয়। রাতে পুসি আমার সাথেই ঘুমিয়ে থাকে। আমাকে ছাড়া অন্যকোনো জায়গায় পুসি রাতে ঘুমায় না। পুসি আমাদের মতো দিনে তিন-চার বেলা খায়। ওর খাবার হলো, মুরগির আঁতুড়ি-ভুঁজড়ি। পুসি’র জন্য এগুলো আমাকেই সংগ্রহ করে রাখতে হয়। আমি ডিউটি থেকে বাসায় আসতে পরিচিত মুরগির দোকান থেকে কেজি খানেক আঁতুড়ি নিয়ে আসি। এরপর ওই আঁতুড়িগুলো কেচি দিয়ে কুচিকুচি করে কেটে ফেলি। তারপর ঐগুলা ভালো করে ধুয়ে হালকা পানি আর অল্প লবণ দিয়ে সিদ্ধ করি। সিদ্ধ হয়ে গেলে পানি ছেঁকে কাটা আঁতুড়িগুলো ঠাণ্ডা করে পুসিকেও কিছু খেতে দিই, বাদবাকি সিদ্ধ আঁতুড়িগুলো ফ্রিজে রেখে দিই। তারপর থেকে পুসি’কে দিনে তিন-চারবার ওই আঁতুড়ি-ভুঁজড়িগোলো খেতে দিলে পুসি মনের আনন্দে লেজ নেড়ে পেটভরে খায়। তাছাড়াও ঘরে রান্না করা মাছ মাংস তো মাঝেমধ্যে থাকেই।

বর্তমানে এভাবেই চলছে পুসি’র দৈনন্দিন জীবন। পুসি’র বিরুদ্ধে এখন আর ঘরে বাইরে কারোর কোনও অভিযোগ নেই। পুসি এখন আমাদের ভাড়া বাড়ি-সহ আশেপাশে আরও বাড়ির সব ছেলে-বুড়োদের আদরের পুসি। যে-না-কেউ এখন পুসি’কে দেখলে কোলে নিতে চায়। আর বাড়ির ছোটছোট ছেলে-মেয়েদের তো খেলার বস্তু হয়ে উঠেছে, আমাদের আদরের পুসি। পুসি এখন মাঝেমধ্যে দু’একটা শিকারও করে দেখাচ্ছে।

ইদানীং পরপর দুটো ইঁদুরের বাচ্চা শিকার করে ফেলেছে। পুসি’র এই শিকার নিয়ে ঘরের গিন্নীর মাঝে একরকম তৎপরতাও দেখা দিয়েছে। এর কারণ হলো, পুসি’র আগমনের আগে ঘরে বাস করা ইঁদুরগুলোকে সকাল-বিকাল খাবার দিয়ে রাখতো। এর ফলস্বরূপ: ঘরে উৎপাত করা ইঁদুরগুলো ঘরের কোনও কাপড়চোপড় কেটে বিনাশ করতো না। এখন পুসি ঘরে থাকার কারণে ঘরের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা ইঁদুরগুলো কোথায় যেন গা-ঢাকা দিয়েছে। তা নিয়ে গিন্নী অনেক সময় আক্ষেপ করে বলে, “আগে সবসময় ইন্দুর দেখা যাইত। অহনে পুসি আহনে ইন্দুর আর চোখে পড়ে না। এতগুলা ইন্দুর কই গেলোগা?”
আবার মাঝেমধ্যে পুসি’কে কোলে নিয়ে গিন্নী বলে, “পুসি ইন্দুরগুলা মারিস না। এগুলা ঘরের ক্ষতি করে না।”

গিন্নীর কথায় পুসি কি বুঝল আর কি না বুঝল জানিনা। তবে এপর্যন্ত আর ঘরের ইঁদুর পুসি’কে মারতে ধরতে দেখিনি। এমনিতেই পুসি অনেক কথাই বুঝে। যেমন কারোর ঘরে যেতে বারণ করলে পুসি আর সে ঘরে যায় না। আবার ধমক দিলে চুপ করে বসে থাকে। চোখ বড় করে ধমক দিলে দৌড়ে ঘরের খাটের নিচে গিয়ে পালায়। সময়-সময় পুসি আহ্লাদ করে গিন্নীর হাতে কামড় দিতে চাইলে, গিন্নী আস্তে করে থাপ্পড় মারলে দ্বিতীয়বার কামড়াতে চায় না। বাড়ির কাউকেও আঁচড় কামড় দেয় না। তবে ঘরে বাইরে দৌড়াদৌড়ি নাচানাচি একটু বেশি করে। সময়-সময় ঘরের তাকে থাকা ডিব্বা-ডাব্বি ফেলে দিয়ে খেলতে থাকে। তা দেখে গিন্নী পুসি’কে ধমক দেয়, মারতেও চায়। কিন্তু পুসি যত দুষ্টুমিই করে থাকুক-না-কেন পুসি-কে মারা যাবে না। এটা আমার বারণ আছে। এর কারণ হলো, পুসি হলো বিড়াল। আর বিড়াল হলো মা ষষ্ঠী দেবীর বাহন, তাই।

পুসি ঘরে আসার পর গিন্নীর ছিছিছি, রাম রাম, হায় ভগবান হায় ভগবান শব্দ শুনে আমি রীতিমতো একটু বিরক্ত হয়েছিলাম। তারপর নেট ঘেঁটে বিড়াল বিষয়ে একরকম তথ্য জোগাড় করলাম। তথ্য সংগ্রহ করে আমার গিন্নীর ছিছিছি, রাম রাম, হায় ভগবান হায় ভগবান বন্ধ করার জন্য মা ষষ্ঠী দেবী ও ষষ্ঠী দেবীর বাহন বিড়াল নিয়ে একটা কাহিনী আমার গিন্নীকে শোনালাম।

n05
ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ।

ষষ্ঠী দেবী ও ষষ্ঠী দেবীর বিড়াল কাহিনী নিম্নরূপ:
❝হিন্দু ঘরের মায়েদের বড়ো প্রিয় দেবী হলো, মা ষষ্ঠীদেবী। তিনি সারা বছর ঘরের ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের ভালো রাখেন। আর সেজন্য মায়েদের কাছে মা ষষ্ঠীর এতো কদর। শিশু জন্মানোর ষষ্ঠ দিনে মা ষষ্ঠীর পুজোর আয়োজন করা হয় গৃহস্থ বাড়িতে। পুজোর উপচারের মধ্যে আবশ্যিকভাবে থাকে দোয়াত-কলম। দিনের বেলায় পুরোহিত ষষ্ঠীপুজো করে চলে যান। আর এদিন স্বয়ং বিধাতা পুরুষ নাকি রাতের বেলায় অলক্ষ্যে এসে শিশুর কপালে লিখে দিয়ে যান তার ভূত-ভবিষ্যৎ।
এই মা ষষ্ঠীর বাহন হলো বিড়াল। ঘর থেকে বিড়াল যতই মাছ চুরি করে খেয়ে যাক, বিড়াল মারা যাবে না। কারণ, মা ষষ্ঠীর কোপ পড়বে। এতএব বিড়াল পাতের মাছ খেয়ে যাক্, অসুবিধে নেই।❞

বিড়াল নিয়ে আরেকটি বিধিনিষেধ আছে। বিড়াল রাস্তা পার হলে আর যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না কেউ এসে সে রাস্তা পেরোচ্ছে। কাজেই ট্র‍্যাফিক পুলিশ কোনো গাড়িকে থামাতে না পারলেও বিড়াল কিন্তু থামিয়ে দেয়।❞

❝ভারতীয় আয়ুর্বেদ মতে, আসলে মেয়েদের বাধক রোগের নাম হলো “ষষ্ঠী।”
আয়ুর্বেদ গ্রন্থ “বৈদ‍্যামৃত” অনুসারে— –
“নেত্রে হস্তে ভবেৎ জ্বালা কোনো চৈব বিশেষত:।
লালা সংযুক্ত রক্তঞ্চ ষষ্ঠী কা বাধক: স্মৃত:।
মানদ্বয়ং এয়ং বাপি ঋতুহীনা ভবেৎ যদি।
কৃশাঙ্গী ষষ্ঠীদোষেণ জায়তে ফলহীনতা।”
চোখে-হাতে জ্বালা, ঋতু: স্রাব অপরিস্কার, বাধক ব‍্যাধিগ্রস্থা সন্তানহীনা নারী ষষ্ঠীরোগিণী।
এর ওষুধ বলা হচ্ছে প্রাচীন কবিরাজী গ্রন্থ “ক্রিয়াকৌমুদী” -র পাতায়—
“পূটদগ্ধ মার্জারসস্থ মেষশৃঙ্গী বচা মধু।
ঘৃতেন সহ পাতব‍্যং শূলং বন্তি ঋতুদ্ভবং।”
অর্থাৎ, ধোঁয়ায় দগ্ধ বিড়ালের হাড়, মেষশৃঙ্গী, বচ ও মধু সমপরিমাণে নিয়ে ঘিয়ের সঙ্গে চেটে খেলে মেয়েদের ঋতুকালীন যন্ত্রণা দূর হয়।❞ ❝তথ্য সংগ্রহ ইন্টারনেট।❞

❝হোমিওপ্যাথি ওষুধ মেফাইটিস্ বিড়াল থেকেই তৈরি হয়, যা মেয়েলি রোগে ব‍্যবহৃত হয়।❞
❝তাছাড়া আয়ুর্বেদ মতে, বাধক ব‍্যাধিগ্রস্থা নারীদের বিড়াল স্পর্শ ফলদায়ক। এতে গর্ভাশয়ে আটকে থাকা ঋতু: স্রাব স্বাভাবিক হয়ে যায়।❞
❝ডিপথেরিয়া রোগ সৃষ্টি করলেও বিড়ালের মধ্যে রয়েছে নারীকে প্রজননক্ষম করে তোলার শক্তি।❞

এসবের জন্যই বিড়াল হয়ে গেছে মা ষষ্ঠীর বাহন‌। তাই হিন্দুদের বিশ্বাস বিড়াল গৃহস্থের বাড়ি বা ঘরে যতই উৎপাত করুক-না-কেন, বিড়ালকে আঘাত করা যাবে না। আর কোনও হিন্দু গৃহস্থের বাড়ি পালিত বিড়াল যদি মারা যায়, তাহলে সেই মৃত বিড়াল সাধু-বৈষ্ণব মারা গেলে যেভাবে সমাধিস্থ করা হয়, সেইভাবেই বিড়ালকে সমাধিস্থ বা কবরস্থ করতে হবে। এটা মা ষষ্ঠী দেবীর বাহন বিড়াল, তাই।

1680967908525
ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ।

হিন্দু ধর্মে জামাই ষষ্ঠী প্রসঙ্গ:
❝জামাই ষষ্ঠী প্রসঙ্গে একটি কাহিনিও প্রচলিত আছে, হিন্দু সমাজে। কথিত রয়েছে, এক গৃহবধূ স্বামী গৃহে নিজে মাছ চুরি করে খেয়ে বার বার দোষ দিতেন এক কালো বিড়ালের ওপর। এর প্রতিশোধ নিতে ছোট বউয়ের বাচ্চা হলেই ওই কালো বিড়ালটি তার সন্তান তুলে লুকিয়ে মা ষষ্ঠীর কাছে দিয়ে আসে। গৃহবধূ তা জানতে পেরে ষষ্ঠী দেবীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন, সে আর কখনো বিড়ালকে মিথ্যা অপবাদ দিবেন না। গৃহবধূর সেই প্রার্থনা মা ষষ্ঠীদেবী শুনলেন। প্রার্থনা শুনে মা ষষ্ঠীদেবী দুই শর্তে তাকে ক্ষমা করেন বলে আশ্বাস দেন।
প্রথম শর্ত হলো, “শুক্ল ষষ্ঠীর দিনে তার পুজো করার আদেশ দেন তিনি।”
দ্বিতীয় শর্ত হলো, “বিড়ালকে তার বাহন হিসেবে সম্মান জানানোর কথা বলেন।”
তারপর ষষ্ঠী দেবীর আরাধনা শুরু করেন ওই গৃহবধূ৷ দেবী তুষ্ট হলে গহীন বনেই সে নিজের সন্তানকে ফিরে পায়। এই জন্যই ষষ্ঠী দেবীর অপর নাম হলো, “অরণ্যষষ্ঠী।”

অন্য দিকে মাছ চুরি করে খাওয়ার জন্য শ্বশুর-শাশুড়ি ওই গৃহবধূর পিতৃগৃহে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। তখন মেয়েকে দেখার জন্য ব্যাকুল মা-বাবা ষষ্ঠীপুজোর দিনে জামাইকে নিমন্ত্রণ জানান। ষষ্ঠী পুজোর দিনে স্বামীর সঙ্গে নিজের বাপের বাড়ি যান ওই মেয়েটি। তার পর থেকেই ষষ্ঠীপুজো পরিণত হয় জামাই ষষ্ঠীতে❞।

আমার যত ভাবনা

পৃথিবীতে শত শত বছর যাবৎ মানুষ বসবাস করছে। কত জন মানুষ তার জীবনের করে যাওয়া স্মৃতি, কৃতিত্ব, নাম বা অর্থ রাখতে পেরেছে আবহমান পর্যন্ত। আমরা যদি প্রত্যেকে কিছু না কিছু ব্যতিক্রম ভালো কিছু করে যাই ভবিষ্যতের জন্য। তাহলে অবশ্যই আমাদের বেঁচে থাকার অর্থ বা নাম থাকবে পরের প্রজন্ম পর্যন্ত। তারাও এটাই করবে ধারাবাহিকতা ধরে রাখার জন্য। এই ভাবে মানুষ তার কাজের কৃতিত্বের শান্তি চিরকাল ভোগ করতে পারবে। পৃথিবীটাও সৃষ্টিশীল হবে। তাহলে হয়তো নিজের সৃষ্টির স্বাদে অন্যকে ঠকানো বা প্রতারণা থেকে দূরে থাকবে। পৃথিবীটাও সুন্দর হবে।

গ্রীক সভ্যতা: উৎস এবং দার্শনিকদের জন্মভূমি

33 গ্রীক সভ্যতা বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং প্রভাবশালী সময়কালের একটি। এটি তার মহান চিন্তাবিদ, শিল্পী, লেখক, দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীদের জন্য বিখ্যাত যারা পশ্চিমা সংস্কৃতির বিকাশে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। গ্রীক সভ্যতার সূচনা এবং প্রাথমিক ইতিহাস পৌরাণিক কাহিনী এবং কিংবদন্তিতে আবৃত, যা কল্পকাহিনী থেকে সত্যকে আলাদা করা কঠিন করে তোলে। যাইহোক, এই নিবন্ধটি গ্রীক সভ্যতার উত্স এবং প্রাথমিক ইতিহাস অন্বেষণ করার চেষ্টা করবে এবং সক্রেটিস এবং প্লেটোর কিছু পটভূমির তথ্য প্রদান করবে, যা প্রাচীন গ্রীক দর্শনের সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে দুটি।

গ্রীক সভ্যতার উৎস এবং প্রাথমিক ইতিহাস
গ্রীক সভ্যতার উৎপত্তি নিওলিথিক যুগে (৬০০০-৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) থেকে পাওয়া যায়, সেই সময়ে গ্রিসে ছোট চাষী সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। এই সম্প্রদায়গুলি ধীরে ধীরে আকার এবং চেতনা ও শক্তি সামর্থের মধ্য দিয়ে নানা রকম শক্তির অপূর্ব জটিলতায় বৃদ্ধি পায় এবং মাইসেনিয়ান সভ্যতার (১৬০০-১১০০বিসি) বিকাশের ভিত্তি তৈরি করে, যা এর উন্নত স্থাপত্য, শিল্প এবং সামরিক দক্ষতা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল।

Mycenaean সভ্যতা অন্ধকার যুগ (১১০০-৮০০বিসি) দ্বারা অনুসরণ করা হয়েছিল, একটি সাংস্কৃতিক পতন এবং উত্থানের সময়, এই সময়ে মাইসেনিয়ানদের অনেক অর্জন হারিয়ে গেছে বা ভুলে গেছে। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে গ্রীস অন্ধকার যুগ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে এবং প্রাচীন কাল (৮০০-৪৮০ বিসি) নামে পরিচিত সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময়ে প্রবেশ করে।

প্রত্নতাত্ত্বিক যুগে, গ্রীস উপনিবেশের সময়কাল অনুভব করেছিল কারণ গ্রীকরা ইতালি, সিসিলি, উত্তর আফ্রিকা এবং কৃষ্ণ সাগর অঞ্চল সহ ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন অংশে স্থানান্তরিত হয়েছিল। এই সম্প্রসারণের ফলে নতুন বাণিজ্য নেটওয়ার্কের বিকাশ ঘটে এবং গ্রীক সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে, যা ভূমধ্যসাগরীয় এবং তার বাইরের সভ্যতাগুলিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল।

প্রত্নতাত্ত্বিক যুগে গ্রীক নগর-রাষ্ট্র বা পলিসের বিকাশও দেখা যায়, যা এর স্বতন্ত্র সরকার, স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং সম্প্রদায়ের দৃঢ় অনুভূতি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল। পলিস ছিল গ্রীক সমাজের মৌলিক একক এবং এটি একটি শহর বা শহর এবং এর আশেপাশের গ্রামাঞ্চল নিয়ে গঠিত।

সক্রেটিস
সক্রেটিস (৪৬৯/৪৭০-৩৯৯বিসি) ছিলেন একজন দার্শনিক যিনি গ্রীক সভ্যতার ধ্রুপদী যুগে বসবাস করতেন। তাকে পশ্চিমা দর্শনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং তার প্রশ্ন করার পদ্ধতির জন্য পরিচিত, যা এখন সক্রেটিক পদ্ধতি নামে পরিচিত।

সক্রেটিস কোন লিখিত কাজ ফেলে যাননি, তাই আমরা তার সম্পর্কে যা জানি তার অনেকটাই আসে তার ছাত্রদের লেখা থেকে, বিশেষ করে প্লেটোর লেখা থেকে। সক্রেটিস তার সহকর্মী নাগরিকদের বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে তীব্র প্রশ্ন করার জন্য পরিচিত ছিলেন, যা প্রায়শই উত্তপ্ত বিতর্ক এবং বিতর্কের দিকে নিয়ে যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা শুধুমাত্র কঠোর প্রশ্ন এবং আত্ম-পরীক্ষার মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে এবং তিনি বিখ্যাতভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে “অপরীক্ষিত জীবন বেঁচে থাকার যোগ্য নয়।”

সক্রেটিসের দর্শন ছিল সত্যের সাধনা এবং নৈতিক চরিত্রের গুরুত্বকে কেন্দ্র করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জ্ঞান এবং পুণ্য পরস্পরের সাথে জড়িত এবং প্রকৃত জ্ঞান শুধুমাত্র একটি পুণ্যময় জীবন যাপনের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। তার নীতির প্রতি সক্রেটিসের প্রতিশ্রুতি এতটাই দৃঢ় ছিল যে তিনি তার বিশ্বাসের সাথে আপস করার পরিবর্তে মৃত্যুবরণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং হেমলক পান করে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলে তিনি বিখ্যাতভাবে এথেন্স থেকে পালাতে অস্বীকার করেছিলেন।

প্লেটো
প্লেটো (৪২৮/৪২৭-৩৪৮/৩৪৭বিসি) সক্রেটিসের একজন ছাত্র ছিলেন এবং তাকে পশ্চিমা ইতিহাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দার্শনিক হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি এথেন্সে একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন, যা পশ্চিমা বিশ্বের উচ্চ শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান।

প্লেটোর দর্শন তার পরামর্শদাতা সক্রেটিসের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা শুধুমাত্র কঠোর প্রশ্ন এবং আত্ম-পরীক্ষার মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে। যাইহোক, প্লেটো সত্যের অন্বেষণে সক্রেটিসের জোরের বাইরে গিয়েছিলেন এবং একটি বিস্তৃত দার্শনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন যা অধিবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র, রাজনীতি এবং জ্ঞানতত্ত্বকে অন্তর্ভুক্ত করে।

প্লেটোর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে একটি হল “প্রজাতন্ত্র”, যা একটি সংলাপ যা ন্যায়বিচারের প্রকৃতি, আদর্শ সমাজ এবং বাস্তবতার প্রকৃতিকে অন্বেষণ করে। “প্রজাতন্ত্র”-এ প্লেটো তার আদর্শ সমাজের একটি বিশদ বিবরণ উপস্থাপন করেছেন, যা তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে দার্শনিক-রাজাদের দ্বারা শাসিত হবে যারা বাস্তবতার প্রকৃত প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান রাখে এবং জ্ঞান ও গুণের সাধনার জন্য গভীর প্রতিশ্রুতি রাখে।

প্লেটো ফর্মের তত্ত্বও তৈরি করেছিলেন, যা বিশ্বাস করে যে শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয় ফর্ম বা ধারণাগুলির একটি রাজ্য রয়েছে যা ভৌত জগতের অন্তর্গত। প্লেটোর মতে, রূপের জ্ঞান হল জ্ঞানের সর্বোচ্চ রূপ, এবং এটি শুধুমাত্র যুক্তি এবং দার্শনিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে।

“প্রজাতন্ত্র” ছাড়াও, প্লেটো আরও অসংখ্য কথোপকথন লিখেছিলেন যা প্রেমের প্রকৃতি, বাস্তবতার প্রকৃতি, জ্ঞান এবং বিশ্বাসের মধ্যে সম্পর্ক এবং আত্মার প্রকৃতি সহ বিস্তৃত দার্শনিক বিষয়গুলি অন্বেষণ করে।

গ্রীক সভ্যতার সূচনা এবং প্রাথমিক ইতিহাস একটি আকর্ষণীয় এবং জটিল বিষয় যা এখনও অনেক বিতর্ক এবং অধ্যয়নের বিষয়। এই সময়কালকে ঘিরে অনেক অনিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও, এটা স্পষ্ট যে গ্রীকরা তাদের শিল্প, সাহিত্য, দর্শন এবং বিজ্ঞানের মাধ্যমে পশ্চিমা সভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।

সক্রেটিস এবং প্লেটো হলেন প্রাচীন গ্রীক দর্শনের দুইজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, এবং তাদের ধারণা এবং শিক্ষাগুলি আজও অধ্যয়ন এবং বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে। সক্রেটিসের প্রশ্ন এবং আত্ম-পরীক্ষার উপর জোর দেওয়া এবং প্লেটোর একটি ব্যাপক দার্শনিক ব্যবস্থার বিকাশ পশ্চিমা দর্শন ও চিন্তাধারার বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

ভূমিকা
প্লেটো এবং সক্রেটিসের জীবন ও কাজ দর্শন, রাজনীতি এবং ধর্মের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। উভয় পুরুষই প্রাচীন গ্রীসে বাস করতেন, একটি মহান বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সময়ে, এবং তাদের ধারণাগুলি আজও পশ্চিমা চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করছে। এই নিবন্ধটি প্লেটো এবং সক্রেটিসের জীবনী, সেইসাথে দর্শন, রাজনীতি এবং ধর্মে তাদের অবদানগুলি অন্বেষণ করবে। উপরন্তু, আমরা যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তারা বসবাস করতেন, এবং কীভাবে তাদের ধারণাগুলি তাদের সময়ের ঘটনা ও ধারণার দ্বারা রূপান্তরিত হয়েছিল তা পরীক্ষা করব।

সক্রেটিসের জীবনী
সক্রেটিস ৪৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসের এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সোফ্রোনিস্কাসের পুত্র, একজন স্টোনমাসন এবং ফেনারেতে, একজন ধাত্রী। তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়, তবে এটি বিশ্বাস করা হয় যে তিনি নিজেকে দর্শনে নিয়োজিত করার আগে পাথর কাটার কাজ করেছিলেন। সক্রেটিস কোন লিখিত কাজ রেখে যাননি, এবং আমরা তার সম্পর্কে যা জানি তার বেশিরভাগই তার ছাত্র প্লেটো এবং জেনোফোনের লেখা থেকে আসে।

সক্রেটিস তার প্রশ্ন করার পদ্ধতির জন্য পরিচিত ছিলেন, যা সক্রেটিক পদ্ধতি নামে পরিচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জ্ঞান আবিষ্কারের সর্বোত্তম উপায় হল সংলাপের মাধ্যমে, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা এবং উত্তর খোঁজার মাধ্যমে। সক্রেটিসের প্রশ্ন প্রায়শই তিনি যাদের সাথে কথা বলেছিলেন তাদের অজ্ঞতা প্রকাশ করে, এবং তিনি তার কথোপকথনকারীদের তাদের নিজস্ব বোঝার অভাব উপলব্ধি করার ক্ষমতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন।

সক্রেটিস তার নৈতিক শিক্ষার জন্যও পরিচিত ছিলেন, যা একটি সৎ জীবন যাপনের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন যে জীবনের উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞান অন্বেষণ করা এবং নৈতিক নীতি অনুসারে জীবনযাপন করা এবং তিনি বিখ্যাতভাবে দাবি করেছিলেন যে “অপরীক্ষিত জীবন বেঁচে থাকার যোগ্য নয়।”

তার শিক্ষা সত্ত্বেও, সক্রেটিসকে এথেন্সে প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থার জন্য হুমকি হিসাবে দেখা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে যুবকদের কলুষিত করার অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তাকে হেমলক পান করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড দর্শনের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত ঘটনাগুলির মধ্যে একটি, এবং এটি শিল্প ও সাহিত্যের অসংখ্য কাজকে অনুপ্রাণিত করেছে।

প্লেটোর জীবনী
প্লেটো ৪২৮/৪২৭খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসের এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একটি অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তার পিতা অ্যারিস্টন ছিলেন এথেন্সের রাজাদের বংশধর। প্লেটো সক্রেটিসের একজন ছাত্র ছিলেন এবং তার প্রাথমিক কাজগুলি মূলত তার শিক্ষকের স্মৃতি সংরক্ষণের সাথে সম্পর্কিত।

সক্রেটিসের মৃত্যুর পর, প্লেটো এথেন্স ছেড়ে ভূমধ্যসাগরে ভ্রমণ করেন। তিনি অন্যান্য দার্শনিকদের সাথে অধ্যয়ন করেছিলেন এবং তার নিজস্ব ধারণা তৈরি করেছিলেন, যা তিনি সংলাপের একটি সিরিজে রেকর্ড করেছিলেন। প্লেটো তার সংলাপের ফর্ম ব্যবহারের জন্য বিখ্যাত, যেখানে চরিত্রগুলি একটি দার্শনিক আলোচনায় জড়িত।

প্লেটোর দর্শন প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হয়েছিল ফর্মের রাজ্য বা ধারণার অস্তিত্বে তার বিশ্বাসের দ্বারা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ভৌত জগৎ হল রূপের জগতের একটি ছায়া, যা চিরন্তন এবং অপরিবর্তনীয়। প্লেটোও আত্মার অমরত্ব এবং পুনর্জন্মের ধারণায় বিশ্বাস করতেন।

প্লেটো এথেন্সে একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা ছিল পশ্চিমা বিশ্বের উচ্চ শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান। একাডেমিটি দার্শনিক অধ্যয়নের কেন্দ্র ছিল এবং এটি সমগ্র গ্রীসের ছাত্রদের আকর্ষণ করত। এর ছাত্রদের মধ্যে অ্যারিস্টটল ছিলেন, যিনি ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক হয়ে উঠবেন।

প্লেটোর রাজনৈতিক দর্শনও ছিল প্রভাবশালী। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ “দ্য রিপাবলিক”-এ তিনি একটি আদর্শ সমাজের জন্য তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন, যা দার্শনিক-রাজাদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল। প্লেটো বিশ্বাস করতেন যে শুধুমাত্র যারা জ্ঞান ও গুণ অর্জন করেছে তারাই শাসন করার উপযুক্ত, এবং তিনি গণতন্ত্রকে একটি ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা হিসাবে দেখেছিলেন যা সহজেই ডেমাগোগদের দ্বারা চালিত হতে পারে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
সক্রেটিস এবং প্লেটো প্রাচীন গ্রীসে মহান বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের সময়ে বাস করতেন। এথেন্স ছিল এই সাংস্কৃতিক নবজাগরণের কেন্দ্র, এবং এটি ছিল আবাসস্থল।

সেনেকার জীবন ও দর্শন
সেনেকা ছিলেন একজন রোমান দার্শনিক, রাষ্ট্রনায়ক এবং ট্র্যাজেডিয়ান যিনি ৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্টোইক দার্শনিকদের একজন হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং তার কাজগুলি পশ্চিমা দর্শনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।

প্রারম্ভিক জীবন এবং শিক্ষা
লুসিয়াস আনায়াস সেনেকা খ্রিস্টপূর্ব ৪ সালে স্পেনের কর্ডোবায় একটি অশ্বারোহী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যেটি সেনেটোরিয়াল শ্রেণীর নীচে একটি সামাজিক শ্রেণী ছিল। তার পিতা, মার্কাস আনাস সেনেকা ছিলেন একজন সুপরিচিত বক্তৃতাবিদ এবং অলঙ্কারশাস্ত্রের শিক্ষক এবং তার মা ছিলেন হেলভিয়া। সেনেকা ছিলেন তার পিতামাতার দ্বিতীয় পুত্র, এবং তার একটি বড় ভাই ছিল, গ্যালিও, যিনি একজন দার্শনিকও ছিলেন।

সেনেকা একটি চমৎকার শিক্ষা লাভ করে, যার মধ্যে অলঙ্কারশাস্ত্র, দর্শন এবং সাহিত্য শেখার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি অ্যাটালাস, সশন এবং প্যাপিরিয়াস ফ্যাবিয়ানাস সহ তার সময়ের সবচেয়ে বিশিষ্ট শিক্ষকদের অধীনে অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি এপিকিউরাস এবং স্টয়িক সহ গ্রীক দার্শনিকদের কাজ দ্বারাও প্রভাবিত ছিলেন।

দার্শনিক ধারণা
সেনেকার দার্শনিক ধারণাগুলি স্টোইসিজম দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, যা গুণ, যুক্তি এবং আত্ম-নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বের উপর জোর দেয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে একটি সুখী জীবনের চাবিকাঠি হল একটি গুণী চরিত্র গড়ে তোলা এবং প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন করা। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে ব্যক্তিদের বাহ্যিক জিনিসের সাথে সংযুক্ত করা উচিত নয়, যেমন সম্পদ বা ক্ষমতা, কারণ তারা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল।

সেনেকার সবচেয়ে বিখ্যাত রচনাগুলির মধ্যে একটি হল “লুসিলিয়াসের চিঠি”, যা তার বন্ধু লুসিলিয়াসকে লেখা চিঠির একটি সংগ্রহ। এই চিঠিগুলিতে কীভাবে ভাল জীবনযাপন করা যায় এবং কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যায় সে সম্পর্কে প্রচুর উপদেশ রয়েছে। সেনেকা “মেডিয়া” সহ বেশ কয়েকটি নাটকও লিখেছেন যা প্রাচীন গ্রীক ট্র্যাজেডির উপর ভিত্তি করে ছিল।

রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এবং নির্বাসন
সেনেকা ৩১ খ্রিস্টাব্দে রোমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন যখন তিনি quaestor নিযুক্ত হন। তিনি ৪০ খ্রিস্টাব্দে একজন ধর্মপ্রচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন এবং ৫৭ খ্রিস্টাব্দে কনসাল নিযুক্ত হন। অফিসে থাকাকালীন তিনি তার সততা এবং সততার জন্য পরিচিত ছিলেন এবং রোমের লোকেরা তাকে সম্মান করতেন।

যাইহোক, সেনেকার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বিতর্কমুক্ত ছিল না। তিনি রোমের সম্রাট ক্লডিয়াসের স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং কয়েক বছরের জন্য কর্সিকা দ্বীপে নির্বাসনে বাধ্য হন। পরে ক্লডিয়াসের উত্তরসূরি নিরো তাকে রোমে ফিরিয়ে আনেন এবং তার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের একজন হয়ে ওঠেন।

মৃত্যু এবং উত্তরাধিকার
নিরোর সাথে সেনেকার সম্পর্ক জটিল ছিল এবং শেষ পর্যন্ত তাকে সম্রাটকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে ফেলা হয়। ৬৫ খ্রিস্টাব্দে, নিরো সেনেকাকে আত্মহত্যা করার নির্দেশ দেন এবং তিনি তার কব্জি কেটে তা করেছিলেন। তার মৃত্যুকে রোমান সাম্রাজ্যের দুর্নীতি ও ক্ষয়ের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।

তার বিতর্কিত জীবন সত্ত্বেও, সেনেকার দার্শনিক ধারণাগুলি পশ্চিমা চিন্তাধারায় স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। যুক্তি, গুণ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের উপর তার জোর আধুনিক নীতিশাস্ত্রের বিকাশে প্রভাবশালী হয়েছে এবং তার নাটকগুলি আজও সঞ্চালিত ও অধ্যয়ন করা অব্যাহত রয়েছে।

তার সময়ের চিন্তাবিদরা
সেনেকা রোমে মহান বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক উত্থানের সময়কালে বসবাস করতেন। তিনি অন্যান্য অনেক বিশিষ্ট দার্শনিক এবং লেখকের সমসাময়িক ছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে:

১. সিসেরো – একজন রাজনীতিবিদ, দার্শনিক এবং বক্তা যিনি রোমান ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবে বিবেচিত।

২. Epictetus – একজন গ্রীক দার্শনিক যিনি শিখিয়েছিলেন যে ব্যক্তিরা তাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা এবং কর্মের উপর মনোযোগ দিয়ে সুখ এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি অর্জন করতে পারে।

৩. লুক্রেটিয়াস – একজন রোমান কবি এবং দার্শনিক যিনি “অন দ্য নেচার অফ থিংস” মহাকাব্য রচনা করেছিলেন, যা মহাবিশ্বের প্রকৃতি এবং এতে মানুষের ভূমিকা অন্বেষণ করেছিল।

৪. প্লুটার্ক – একজন গ্রীক জীবনীকার এবং প্রবন্ধকার যিনি বিখ্যাত গ্রীক এবং রোমানদের জীবন নিয়ে ব্যাপকভাবে লিখেছেন।

৫. সেনেকা এবং তার সমসাময়িক চিন্তাবিদদের ছাড়াও, এই সময়ের মধ্যে অনেক দার্শনিক জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং যারা দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। এখানে তাদের কিছু:

৬. মার্কাস অরেলিয়াস – একজন রোমান সম্রাট এবং দার্শনিক যিনি বিখ্যাত বই “মেডিটেশন” লিখেছিলেন, যা জীবন, মৃত্যু এবং মহাবিশ্বের প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করে।

৭. প্লোটিনাস – একজন দার্শনিক যিনি নিওপ্ল্যাটোনিজমের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা এক, বুদ্ধি এবং আত্মার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিল।

৮. সেক্সটাস এম্পিরিকাস – একজন গ্রীক দার্শনিক যিনি জ্ঞান অর্জনের সম্ভাবনা সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন এবং যুক্তি দিয়েছিলেন যে মানুষের বিশ্ব সম্পর্কে রায় স্থগিত করা উচিত।

৯. আলেকজান্দ্রিয়ার ফিলো – একজন ইহুদি দার্শনিক যিনি ইহুদি ধর্মকে হেলেনিস্টিক দর্শনের সাথে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছিলেন এবং যিনি ঈশ্বর এবং মহাবিশ্বের প্রকৃতির উপর ব্যাপকভাবে লিখেছেন।

এই দার্শনিক এবং চিন্তাবিদরা একটি প্রাণবন্ত বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতির অংশ ছিলেন যা রোমান সাম্রাজ্যকে আকার দিয়েছে এবং আগামী শতাব্দীর জন্য পশ্চিমা চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছে।

শুভ জন্মদিন … রামকিঙ্কর বেইজ

2838aজন্মদিনে শ্রদ্ধা জানিয়ে —
আমার যে লেখাটি অনেকেই চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে সেটিই আবার দিলাম।

রামকিঙ্কর বেইজের জন্ম ১৯০৬ সালের ২৫ মে। পিতা চণ্ডীচরণ, মার নাম সম্পূর্ণা। তাঁদের বাড়ি ছিল বাঁকুড়ায়। পারিবারিক পদবি ছিলো পরামাণিক। রামকিঙ্করই প্রথম বেইজ পদবি চালু করেন তাঁদের পরিবারে। ক্ষৌরকর্ম তাঁদের পারিবারিক পেশা। এই পরিবারে তিনিই সর্বপ্রথম শিল্পের পথে এলেন উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পারিবারিক প্রথা ভেঙে।

রামকিঙ্কর বেইজের শিল্পের চৌহদ্দি ছিল অনেক প্রশস্ত। তেলরং, জলরঙ, ড্রইং, স্কেচ, ভাস্কর্য সহ বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর ছবি এবং ভাস্কর্য দুটোকেই তিনি নিয়ে গেছেন শিল্পসৌকর্যের চূড়ায়। প্রথমদিকে ছবি আঁকার প্রতিই রামকিঙ্করের মনযোগ ছিল বেশি। পরবর্তীতে পূর্ণোদ্যমে শুরু করেন ভাস্কর্য। কখনোই গতানুগতিক, বাঁধাধরা নিয়মে শিল্পসৃষ্টির পক্ষপাতি ছিলেন না তিনি। নিজের তৈরি পথেই চলেছেন সবসময়। প্রতিনিয়তই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। গড়েছেন ভেঙেছেন আবার গড়েছেন; এভাবেই এগিয়ে গেছে তাঁর শিল্প সাধনার পথ। দৃশ্যশিল্পের নতুন শৈলী, টেকনিক অথবা মাধ্যমের সন্ধানে সবসময় খোলা থাকত তাঁর দৃষ্টি।

রামকিঙ্করের গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্যগুলোর বেশিরভাগ শান্তিনিকেতনে। ইউক্যালিপটাস গাছের সারির ভেতর ‘সুজাতা’ কিংবা কলাভবনের ‘সাঁওতাল পরিবার’, ‘বাতিদান” মিলেমিশে অন্যরকম এক দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। তবে শান্তিনিকেতনে করা ‘ধানঝাড়া’ ভাস্কর্যটির কথা উল্লেখ করা যায়। খোলামেলা শারীরিক প্রকাশের জন্য এই ভাস্কর্যটি অনেক গোঁড়া আশ্রমিকের সমালোচনার শিকার হয়েছিল। কিন্তু আশেপাশের সাঁওতাল গ্রামবাসীদের কাছে এটা ছিল খুব প্রিয়। কাজের প্রতি তাঁর একরোখা মনোভাব এবং রবীন্দ্রনাথ নন্দলালের প্রশ্রয়, বিনোদবিহারী সহ অন্যান্য সুহৃদ বন্ধুর সহযোগিতা আর সর্বোপরি তাঁর প্রতি ছাত্রদের শ্রদ্ধা ও সমর্থনের কারণে তাঁর কাজ ঠেকিয়ে রাখা যায় নি। শেষ পর্যন্ত সমালোচকরাই চুপ করে গিয়েছিলেন।

১৯২৫ সালে ছাত্র হিসাবে শান্তিনিকেতনে যোগ দেয়ার পর একই বছর লক্ষ্ণৌর নিখিল ভারত শিল্প প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে রৌপ্যপদক লাভ করেন রামকিঙ্কর। ঐ প্রদর্শনীতে স্বর্ণপদক পান নন্দলাল বসু। ১৯২৭ সালে ভারতের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ স্থানে ঘুরে বেড়ান তিনি। নালন্দা, জয়পুর, চিতোর, উদয়পুরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ভ্রমণ করেন। ফলে প্রাচীন ভারতবর্ষের নানা স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে।

রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয়ের সূত্রে ভিয়েনার ভাস্কর লিজা ভনপট ১৯২৮ সালে ভারত আসেন। রামকিঙ্কর তাঁর কাছে ভাস্কর্যের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ নেন। এর কিছুদিন ভারতে আসেন বিশ্বখ্যাত ভাস্কর রঁদ্যার শিষ্য বুর্দেলের ছাত্রী মাদাম মিলওয়ার্দ। মিলওয়ার্দের সাহচর্য রামকিঙ্করকে নানাভাবে উপকৃত করে। তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক উভয় দিকে তাঁর কাছে শিক্ষালাভ করেন। এরপর বিখ্যাত ইংরেজ ভাস্কর বার্গম্যানের কাছে রিলিফের কাজ শেখেন রামকিঙ্কর।

রামকিঙ্কর এমন একজন শিল্পী যাকে কোন দলে ফেলে মাপা যায় না। তাঁর জীবন ইতিহাস অন্যান্য শিল্পীর চেয়ে একেবারেই অন্যরকম। বাঁকুড়ার এক অখ্যাত পল্লীর দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারের সন্তান রামকিঙ্কর, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দৌঁড়ও তেমন কিছু নয়। যার পারিবারিক পেশা ছিল ক্ষৌরকর্ম। আর শৈশব কাটতো পাশের কুমোর পাড়ায় ঘুরে ঘুরে। কী অদ্ভুত এক নিবিষ্টতায়, শিল্পের প্রতি ভালোবাসায় তিনি হয়ে উঠলেন ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বিশ্বের অগ্রগণ্য এক শিল্পী। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘যাঁরা প্রতিভাশালী তাঁদের কেউ লুকিয়ে রাখতে পারবে না’। আর শান্তিনিকেতনের সাথে তাঁর যোগাযোগটাও নিশ্চয় তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। যদি ঘটনাক্রমে তাঁর সাথে শান্তিনিকেতনের যোগাযোগ না ঘটতো তবুও হয়ত শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশের পথ তিনি খুঁজে পেতেন, খুঁজে নিতেন। কিন্তু যে রামকিঙ্করকে আজ আমরা জানি, ঠিক সেই রামকিঙ্করকে পেতাম না আমরা। শান্তিনিকেতনে তাঁর শিল্পী সত্ত্বা মুক্তির যথার্থ পথ পেয়েছে। এক্ষেত্রে সবার মাথার ওপরে রবীন্দ্রনাথতো ছিলেনই, সহায়ক হিসাবে আরও ছিলেন গুরু নন্দলাল বসু ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রামকিঙ্করের অন্যান্য বিখ্যাত ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে আছে:

প্লাস্টারে করা মা ও ছেলে (১৯২৮), কচ ও দেবযানী (১৯২৯), মিথুন-১ (১৯৩১), মিথুন-২ (১৯৩১), মিথুন-৩ (১৯৩১), সাঁওতাল-সাঁওতাল রমণী (১৯৩৫), সাঁওতাল দম্পতি (১৯৩৫), আলাউদ্দিন খাঁ (১৯৩৫), কংক্রীটে করা সাঁওতাল পরিবার (১৯৩৮), প্লাস্টারে করা রবীন্দ্রনাথের বিমূর্ত ভাস্কর্য (১৯৩৮), সিমেন্টে করা রবীন্দ্রনাথের আরও একটি ভাস্কর্য (১৯৪১), হার্ভেস্টার (১৯৪২), ফেমিন (১৯৪৩), সাঁওতাল নাচ (১৯৪৩), অবনীন্দ্রনাথ (১৯৪৩), সিমেন্টে করা কুলি মাদার (১৯৪৩-৪৪), বিনোদিনী (১৯৪৫), বুদ্ধ (১৯৪৬-৫০ ?), সিমেন্টের দ্য মার্চ (১৯৪৮), ডাণ্ডী মার্চ (১৯৪৮), লেবার মেমরী (১৯৪৮), মা ও ছেলে (১৯৪৯), স্পীড এন্ড গ্রাভিটি (১৯৪৯), শুয়োর (১৯৫২), পিতা-পুত্র ( ১৯৫২), মিলকল (১৯৫৬), গান্ধী (১৯৫৭), শার্পেনার (১৯৫৮?), ম্যান এন্ড হর্স ( ১৯৬০), সুভাসচন্দ্র বসু (১৯৬০-৬১), হর্স হেড (১৯৬২), মহিষ-১ (১৯৬২) কাক ও কোয়েল (১৯৬২), আগুনের জন্ম (১৯৬৩), যক্ষী-১১(১৯৬৩?) মহিষ ও ফোয়ারা (১৯৬৩), মাছ (১৯৬৪), তিমি মাছ (১৯৬৫), নৃত্যরতা নারী (১৯৬৫), লালন ফকির (১৯৬৫), যক্ষ যক্ষী (১৯৬৬), প্রেগন্যান্ট লেডি (১৯৬৭-৬৯), বলিদান (১৯৭৬), রাজপথ (১৯৭৭), রেখা, কলেজ গার্ল, গণেশ, সিটেড লেডি, মা ও শিশু, কুকুর, মা, সেপারেশন, রাহুপ্রেম, প্যাশন, ত্রিভুজ, দ্য ফ্রুট অফ হেভেন, হাসি, বন্ধু ইত্যাদি।

বেশ কিছু প্রতিকৃতি এঁকেছেন রামকিঙ্কর। এগুলো ফরমায়েশি প্রতিকৃতি চিত্রের মত নয়। শুধু ব্যক্তির অবয়বকে ধরে রাখার জন্য এই ছবিগুলো আঁকা হয়নি। এই ছবিগুলোর প্রত্যেকটিতেই ব্যক্তির চেহারার সাথে মিলে মিশে গেছে চরিত্র-প্রকৃতি এবং শিল্পীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর প্রতিকৃতি চিত্রগুলোর মধ্যে ‘স্বপ্নময়ী’, ‘ সোমা যোশী’, ‘বিনোদিনী’, ‘নীলিমা দেবী’ উল্লেখযোগ্য। চারপাশের পরিবেশ প্রকৃতি, মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রা নিয়ে বেশকিছু ছবি আছে রামকিঙ্করের। এই ছবিগুলোতে বিষয়ের চিত্ররূপের সাথে শিল্পীর বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ছবিগুলোর কোনটিতে যুক্ত হয়েছে মিথের প্রতীক কোনটিতে বা এসেছে বিমূর্ত চারিত্র। এই ধরণের ছবির মধ্যে ‘ঘরামি’, ‘ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাম’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

রামকিঙ্করের সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭০ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধিতে সম্মানিত করেন। ১৯৭৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট সম্মাননায় ভূষিত করে।
তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে কলকাতায় নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। যাহোক ১৯৮০ সালের ২৩ মার্চ রামকিঙ্করকে কলকাতার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর চিকিৎসার খরচের দায়িত্ব নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকেও কিছু টাকা দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় মস্তিষ্কে জমে থাকা জল বের করার। ধারণা করা হয় এতে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। ২৬ জুলাই তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হবে। তার আগের দিন মাটি দিয়ে বানালেন ছোট্ট একটি ভাস্কর্য। এটিই তাঁর জীবনের সর্বশেষ শিল্পকর্ম। পরের দিন অস্ত্রোপচার হল। দু‘একদিন সুস্থ ছিলেন। তারপর শুরু হলো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ।

১৯৮০ সালের ২ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়। জীবনের , সৃজনের দীর্ঘ সময় তিনি যেখানে কাটিয়েছিলেন সেই শান্তিনিকেতনেই রচিত হলো তাঁর শেষ শয্যা।

বিংশ শতাব্দীর কবি, নজরুল

28374a

বিংশ শতাব্দীর কবি, নজরুল। মানুষের মুক্তির অভিভাবক। সামন্তবাদের সংকীর্ণতা, অন্ধকারচ্ছন্নতা, দুষ্টবুদ্ধিসম্পন্ন বেষ্টনী ভেঙে বের হয়ে এসেছেন। তাঁর পারঙ্গমতা বোধের অন্তরায়ে শ্রেণি সংগ্রামের কথা বলেছেন। বাংলা সাহিত্যের উৎসব আবহে শিশুদের শৈশবজুড়ে শত পল্লবী শোভা ছড়াচ্ছে। এ সত্য অমলিন। কবি লিখেছেন-

– গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান।
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, আছে ধর্ম জাতি,

– গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাঁধা ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম, খ্রিস্টান।।
মিথ্যা বলিনি ভাই
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির-কাবা নাই’।

ভালোবাসা চির বিদ্রোহী কবি ♥

আজ বিশ্ব চা দিবসেও রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক …

2832

চা-পান ছিল রবীন্দ্রনাথের অন্যতম পছন্দ। প্রতিদিন অন্ধকার থাকতে বনমালীর হাতের তৈরি চা সহযোগেই তাঁর দিন শুরু হত। খুব সকালেই চা পান করতে অভ্যস্ত ছিলেন কবি। শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ যখন থাকতেন তখন খুব ভােরবেলা অন্ধকার থাকতেই উনুন ধরিয়ে কবির জন্য চা করে দিত কবিভৃত্য বনমালী। গুরুদেবের চা ছিল একটু অভিনব। কেটলি ভরা গরম জলে কয়েকটা চা-পাতা ফেলা হত, চায়ে রঙ সামান্য একটু ধরলেই পেয়ালার অর্ধেকটা সেই চা ঢেলে বাকি অর্ধেক দুধে ভর্তি করে নিতেন কবি। দু-চামচ চিনি দিতেন তাতে। চায়ের সঙ্গে আসত মাখন-পাউরুটি, একটু মুড়ি কিংবা আদার কুচি বা গুড় দিয়ে কল বেরােনাে ভিজে মুগ বা ছােলা, কোনওদিন বা একটা আধ সিদ্ধ ডিম।

সকলকে চা পানে উদ্বুদ্ধ করবার জন্য রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে একটা চায়ের আসর গড়েছিলেন যার নাম সুসীম চা-চক্র। এই আসরের একটা ছোট্টো ইতিহাস আছে, আছে নেপথ্যে একটা গানের খবরও।

১৯২৪ সালে চিন ও জাপান পরিভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে আসার সময়ে রবীন্দ্রনাথ চীন থেকে চায়ের সরঞ্জাম, নানা উপকরণ, চা ও নানা রকম খাবার সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। জাপান ও চীনের বিভিন্ন চা-অনুষ্ঠানে অনুপ্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনেও একটি চা-সভা স্থাপন করলেন। চিন ভ্রমণের সময়ে সু সীমো নামে যে তরুণ রবীন্দ্রনাথকে দোভাষী হিসাবে সাহায্য করেছিলেন, তার নাম অনুসারে এই চা-সভার নাম রাখা হল সুসীম চা-চক্র। সুসীম চা-চক্রের উদ্বোধন হয় ২২ শ্রাবণ ১৩৩১ সালে, বর্তমান পাঠভবন অফিসের একতলায় বিদ্যাভবনের লম্বা হল ঘরে। এই উপলক্ষে ওই দিনেই রবীন্দ্রনাথ একটি গান রচনা করেন এবং দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে সমবেত কণ্ঠে সেটি গাওয়া হয়।

”হায় হায় হায় দিন চলি যায়।
চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতকদল চল’ চল’ চল’ হে।।

টগ’বগ’-উচ্ছ্বল কাথলিতল-জল কল’কল’হে।
এল চীনগগন হতে পূর্বপবনস্রোতে শ্যামলরসধরপুঞ্জ।।

শ্রাবণবাসরে রস ঝর’ঝর’ ঝরে, ভুঞ্জ হে ভুঞ্জ দলবল হে।
এস’ পুঁথিপরিচারক তদ্ধিতকারক তারক তুমি কাণ্ডারী।
এস’ গণিতধুরন্ধর কাব্যপুরন্দর ভূবিবরণভাণ্ডারী।
এস’ বিশ্বভারনত শুষ্করুটিনপথ- মরু-পরিচারণক্লান্ত।

এস’ হিসাবপত্তরত্রস্ত তহবিল-মিল-ভুল-গ্রস্ত লোচনপ্রান্ত- ছল’ছল’ হে।
এস’ গীতিবীথিচর তম্বুরকরধর তানতালতলমগ্ন।
এস’ চিত্রী চট’পট’ ফেলি তুলিকপট রেখাবর্ণবিলগ্ন।
এস’ কন্‌স্‌টিট্যুশন- নিয়মবিভূষণ তর্কে অপরিশ্রান্ত।
এস’ কমিটিপলাতক বিধানঘাতক এস’ দিগভ্রান্ত টল’মল’ হে।

বাঙালির জীবনে এমন কোনও বিষয় নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া পড়েনি। তাই চা নিয়ে যে এমন একটি মজার গান লিখবেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই। তিনি জানতেন চা মন ও শরীরের ক্লান্তি দূর করে। তাই তিনি পুঁথি বিশারদ, গণিতবিদ, কাব্যরসিক, চিত্রকর, বাউণ্ডুলে থেকে শুরু করে এমনকী শশব্যস্ত হিসাব রক্ষকদেরকেও কর্মজীবনের গ্লানি ভুলবার জন্য চা পানে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এ বিষয়ে শান্তিনিকেতন পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘পূজনীয় গুরুদেব প্রথমে এই চক্রের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। প্রথমত, ইহা আশ্রমের কর্মী ও অধ্যাপকগণের অবসরসময়ে একটি মিলন ক্ষেত্রের মত হইবে – যেখানে সকলে একত্রিত হইয়া আলাপ-আলোচনায় পরস্পরের যোগসূত্র দৃঢ় করিতে পারিবেন।

দ্বিতীয়ত, চিন দেশের চা-পান একটি আর্টের মধ্যে গণ্য। সেখানে আমাদের দেশের মতো যেমন-তেমন ভাবে সম্পন্ন হয় না। তিনি আশা করেন, চিনের এই দৃষ্টান্ত আমাদের ব্যবহারের মধ্যে একটি সৌষ্ঠব ও সুসঙ্গতি দান করবে।’

শান্তিনিকেতনের উত্তরায়ণে কবির কোণার্ক বাড়ির লাল বারান্দাটি ছিল চায়ের আসরের জন্য বিখ্যাত। গণ্যমান্য অতিথিদের জন্য প্রায়ই এখানে চায়ের টেবিলের বন্দোবস্ত করতে হত। যেবার জওহরলাল সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে এলেন, উঠেছিলেন এই কোণার্ক বাড়িতে। লাল বারান্দাতেই বসল চায়ের আসর। একবার জাপান থেকে এক অতিথি দম্পতি এলেন আশ্রমে। গুরুদেবকে শ্রদ্ধা জানাতে তারা জাপানি প্রথায় ‘টি সেরিমনি’র আয়োজন করেছিলেন এই লাল বারান্দাতেই। সেদিন অতিথি ভদ্রমহিলা নিজে হাতে জাপানি প্রথায় চা তৈরি করে সকলকে পরিবেশন করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ চায়ের কদর বুঝতেন। চা-পান ছিল তাঁর কাজের অন্যতম সঙ্গী। হয়ত তাঁর অনবদ্য সৃজনশীলতার পিছনেও ছিল চায়ের পরোক্ষ প্রভাব।

কবির জীবনে নারী

কবির জীবনে নারী :
______________________

আমরা সবাই জানি তাঁর জীবনে তিনজন নারীর প্রভাব ছিলো সবথেকে বেশি। প্রেমিকাদের জন্য লিখেছেন অজস্র গান, কবিতা, ঘটিয়েছেন নানা ঘটনা। প্রেমের কবিতায় তাঁর তুলনা নেই। ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি প্রেমে পড়েছিলেন বারবার।

কবি যাঁদের প্রেমে পড়েছিলেন, প্রথমেই আসে নার্গিসের কথা। ১৯২১ সালে কবি তাঁর বন্ধু আলী আকবর খানের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলেন কুমিল্লার দৌলতপুরে। সেখানে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সৈয়দা খাতুনের। কবি ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে সবাইকে গান শুনিয়েছিলেন। নজরুলের গানের সুরে মুগ্ধ হলেন সৈয়দা খাতুন আর সৈয়দা খাতুনের রূপে মুগ্ধ নজরুল। কবি প্রেমে পড়ে গেলেন প্রথম দর্শনেই। সৈয়দা খাতুনও সমান আগ্রহে কবির প্রেমে সাড়া দিয়েছিলেন। সৈয়দা খাতুনকে ভালোবেসে কবি তাঁর নামও বদলে দিলেন। তিনি তাঁর নাম দিলেন নার্গিস। নার্গিস ইরানি শব্দ, যা এক সাদা ফুলের নাম। দৌলতপুরে থাকা অবস্থাতেই কবি সিদ্ধান্ত নিলেন, নার্গিসকেই তিনি বিয়ে করবেন। বিয়েও হয়ে গেল কয়েক দিনের মধ্যে। কিন্তু ইতিহাস রচনা করল এক দুঃখের নাটক। বিয়ে হলো ঠিকই, বাসর আর হলো না। কবির কাছে শর্ত রাখা হয়েছিল ঘর জামাই থাকবার। সেই রাতেই কবি অভিমানে বাসর ছেড়ে সেই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। দৌলতপুর থেকে চলে আসেন কুমিল্লায়। কিন্তু কবির সেই অভিমানের কারণ কবি কোনো দিন কাউকে মুখ ফুটে বলেননি।

এর পর যদি কারও নাম আসে, তিনি হলেন মিস ফজিলাতুন্নেসার। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকোত্তর মুসলমান ছাত্রী। ইতিহাস বলে, এই প্রেম ছিল একতরফা, মানে শুধু কাজী নজরুল ইসলামের দিক থেকেই। ফজিলাতুন্নেসার সঙ্গে কবির পরিচয় হয় ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। কবি তখন মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছেন ঢাকায়। কবি একটু-আধটু জ্যোতির্বিদ্যা জানতেন। কাজী মোতাহার হোসেন সে কারণে কবিকে নিয়ে যান ফজিলাতুন্নেসার বাসায়। ব্যস! শুরু হয়ে গেল হাত দেখা। প্রথমে হাতে হাত, পরে চোখে চোখ। কবির মন প্রেমে টালমাটাল হয়ে উঠল। কবি চলে গেলেন ঢাকা ছেড়ে। কিন্তু ফজিলাতুন্নেসা থেকে গেলেন তাঁর মন জুড়ে। তার পর থেকে নজরুল লিখে চললেন একটার পর একটা প্রেমপত্র।

তবে শেষ পর্যন্ত নজরুলের জীবনসঙ্গিনী হয়েছিলেন প্রমীলা সেনগুপ্তা। প্রমীলাদেবীর ডাকনাম ছিল দুলি। জানা যায়, নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় থাকা কালীন প্রমীলাদেবীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পরেন। প্রমীলাদেবীর সঙ্গে তাঁর আলাপ-পরিচয় ক্রমশ প্রেমে পরিণত হয়। তিমি তাঁর এই প্রেমের কথা লিখেছেন, তাঁর ‘বিজয়িনী’ কবিতায়। তাঁদের বিয়ে হয় ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে। বিয়েতে বাধা ছিল একটাই, ধর্ম। বিবাহ-আইনের নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে তাঁদের বিয়েটা হয়েছিল স্ব-স্ব ধর্মপরিচয় বহাল রেখেই। তখন প্রমীলার বয়স ছিল ১৪ আর নজরুলের ২৩। নার্গিসকে উদ্দেশ্য করে কবি লিখেছিলেন, ‘হার-মানা-হার’। অবশেষে সেই ‘হার-মানা-হার’ পড়ালেন প্রমীলা সেনগুপ্তার কণ্ঠে।

দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৬২ সালের ৩০ জুন মৃত্যুবরণ করেন কবিপত্নী প্রমিলা নজরুল। প্রায় ২৩ বছর পক্ষাঘাতগ্রস্থ ছিলেন তিনি। বাকরুদ্ধ অপ্রকৃতিস্থ কবিকে স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ দেন বন্ধু শৈলজানন্দঃ ”নূরু, দুলী আর নেই।” কবি ফ্যাল ফ্যাল করে বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হয়তো চেষ্টা করছিলেন, দুলী কে ছিলো তাঁর জীবনে, মনে করতে।বিষাদাক্রান্ত হয়ে পরে মন। মনে পড়ে কবির অমর গানঃ
‘ঘুমায়েছে ফুল পথের ধুলায় ওগো জাগিও না।’

শুনেছি প্রেম নাকি কবি মানসের প্রধান প্রেরণা। প্রেমিক কবি নজরুলের মন তো প্রেমময় হবেই। আর তাই প্রেম নজরুলের জীবনে এসেছিল বারবার—কখনো ঝড়ের মতো, কখনো নিভৃতে। কখনো রানু সোম (প্রতিভা বসু), কখনো কানন দেবী, আবার কখনো জাহানারা বেগম চৌধুরী, কখনো উমা মৈত্র। কবি বারবার ভেসে গেছেন প্রেমের জোয়ারে।