আন্ডারগ্রাউন্ড শব্দের ১৭টি বাংলা অর্থ আছে গুগল অনুবাদে। কিন্তু ১৭টি বাংলা অর্থের কোনোটাই আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার চরিত্রকে যথাযথ প্রকাশে সক্ষম নয়। আন্ডারগ্রাউন্ড শব্দটি অক্ষত রেখেই এই গোত্রের সংবাদপত্র আর সাংবাদিকতা সম্পর্কে ধারণা দিয়ে যাচ্ছি-
১.
৯০ দশকের আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্রের চরিত্র :
১৯৯১ হতে ৯৪ সাল পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার শ্রেণিভুক্ত বিজ্ঞাপনের ‘আবশ্যক’ শ্রেণিতে প্রায় প্রতিদিন সংবাদদাতা/সাংবাদিক চাই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হত। এসব বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিলো অনেকটা এমন- ‘জাতীয় পর্যায়ের একটি সাহসী সংবাদপত্রের জন্য ‘নির্ভীক সাংবাদিক আবশ্যক। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি/এইচএসসি। অভিজ্ঞতা নিষ্প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ, পরিচয়পত্র, টেপ রেকর্ডার ও ক্যামেরা প্রদান করা হবে। পোস্ট বক্স নং *****’
সাহসী সংবাদপত্রের নির্ভীক সাংবাদিক হতে যারা আবেদন করতেন তাদের কাছে ফিরতি চিঠিতে প্রশিক্ষণ ফি, পরিচয়পত্র ফি দাবি করা হত। এই ফি প্রেরণ করলে টেপরেকর্ডার আর ক্যামেরার মূল্য চাওয়া হত। এসব ফি প্রেরণের পরে আবেদনকারীরা বুঝতে পারতেন যে ‘সাহসী সাংবাদিক’ হতে গিয়ে তারা অসহায়ভাবে প্রতারিত হয়েছেন। কারণ, পত্রিকাটি মোটেও জাতীয় পর্যায়ের নয়, দ্বিতীয়ত পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়না, তৃতীয়ত পত্রিকাটির প্রধান বাণিজ্য হচ্ছে এসএসসি-এইচএসসি অর্থাৎ ১৬ থেকে ১৮বছর বয়সীদের কাছে ‘সাহসী সাংবাদিক’-এর নিয়োগ বাণিজ্য, চতুর্থতঃ পত্রিকাটির আয়ের অন্যতম খাত হচ্ছে চাঁদাবাজী।
২.
আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার রিপোর্টার :
জাফর মীরের নাম শুনেছেন? না শুনলেও কিছু যায় আসেনা। কারণ তিনি বিশাল মাপের ক্রাইম রিপোর্টার। ভাবছেন উনি কোন পত্রিকার রিপোর্টার? পত্রিকার নামও শোনার দরকার নেই। কারণ ঐ পত্রিকার নাম পত্রিকার মালিক কাম সম্পাদক আর তার কাছের ক’জন ছাড়া কেউই শোনেন নাই। পত্রিকাটি দৈনিক হলেও মাসে হয়তো তিন চার দিন প্রিন্ট হয়। কিন্তু তার জন্য তো জাফর মীরের ‘সাহসী সাংবাদিকতা’ বন্ধ হয়ে থাকতে পারেনা।
জাফর মীর যতক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকেন ততক্ষণ গলায় মোটা ফিতে দিয়ে সাংবাদিকের আইডি কার্ড ঝুলিয়ে রাখেন, তার মোটর সাইকেলের সামনে সাধরণের চাইতে বড় করে লিখা থাকে ‘সাংবাদিক’, তিনি থানায় ওসির রুমে সালাম দিয়ে এসে কনস্টেবলের সাথ আড্ডা দেন আর সিগারেট ফুঁকেন। এরই মাঝে থানায় দুই একটা কেসে মধ্যস্ততা করে পকেটে কিছু ভরেন। তারপর সংবাদ অর্থাৎ পার্টি খুঁজে বেড়ান। পার্টিকে সাংবাদিক আর সংবাদপত্রের শক্তি দেখিয়ে ঘটনা চেপে যাওয়ার জন্য টাকা আদায় করেন।
জাফর মীর আয়কৃত টাকার একটা অংশ পত্রিকার সম্পাদক কাম মালিককে প্রদান করেন। আর যেখানে সে নিজে ধান্ধাটা সামাল দিতে পারবেনা সেখানে সম্পাদককে পার্টনার করেন।
জানলে অবাক হবেন যে, এই গোত্রের অনেক সম্পাদক ও সাংবাদিকের নিজের বিলাসবহুল গাড়ী আছে। অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট আছে। ব্যাংক ব্যালেন্স যে আছে তা অনুমান করা যায়। প্রকৃত সাংবাদিকরা যেসব ক্ষমতাবানের কাছে সহজে পৌছতে পারেন না, সেই ক্ষমতাবান আর প্রভাবশালীদের সাথে এই গোত্রের ক’জন সম্পাদক আর সাংবাদিকদের অহরহ উঠবোস।
৩.
আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক :
বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী এবং সেনা প্রধানের পরে যদি ক্ষমতাবান কেউ থাকেন তিনি হলেন আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক। অধিকাংশ আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলোর ক্ষেত্রে মালিক এবং সম্পাদক একজনই। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে- সম্পাদকের পরে নির্বাহী সম্পাদক বা ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক দিয়েও কিছু কিছু আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্রগুলো চলে। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, একুশে টিভির প্রধান নির্বাহী ও সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, এমন কি প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ও সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরীও এত প্রতিপত্তি নিয়ে চলেন না, যে প্রতাপে অধিকাংশ আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার মালিক কাম সম্পাদকরা চলাফেরা করেন।
কর্পোরেট বা সফল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বা নিয়োগপ্রাপ্ত না হলেও এই গোত্রের পত্রিকার পেশাজীবী সম্পাদকরা অধিকাংশই নিজের গাড়িতে চেপে অফিসে আসেন। গাড়ির পিছনের ড্যাশবোর্ডে এমনভাবে নিজ পত্রিকার কয়েকটি কপি রাখেন যেন বাইরে থেকে দেখা যায়, পত্রিকার পাশেই রাখেন ক্ষমতাসীন দলের প্রধান নেত্রীর ছবি সংবলিত স্যুভেনির। নিজের ক্ষমতা বোঝাতে এই সম্পাদকদের কারো কারো গাড়ির ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড সুন্দর করে কভার দিয়ে ঢাকা থাকে সবসময়, যা কখনই খোলা হয়না। ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড সুন্দর করে কভার দিয়ে ঢাকা আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার সম্পাদকদের গাড়ি ফকিরাপুল-সচিবালয়-মতিঝিলের পাশাপাশি অভিজাত গুলশান, বারিধারা, বনানী আর উত্তরাতেও দাপিয়ে বেড়ায়।
এই সম্পাদকদের প্রধান পেশা হচ্ছে তদবীর করা। এছাড়া বিভিন্ন ‘টার্গেট’ নির্ধারণ করে তাদের কাছ থেকে তাদের ভাষায় মোটা অংকের ‘দাও’ মারা।
৪.
ফকিরাপুল ওয়ানস্টপ সার্ভিস :
ফকিরাপুল হচ্ছে বাংলাদেশের প্রধান আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা শিল্পাঞ্চল। ফকিরাপুলেই আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা শিল্প বিকশিত হয়েছে এবং অবারিতভাবে এখনও হচ্ছে। ১২ফুট বাই ১২ফুট অর্থাৎ ১৪৪স্কোয়ার ফিটের একটি রুমে ২০টি দৈনিক পত্রিকার অফিস একমাত্র বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ফকিরাপুলেই সম্ভব। এই অফিসগুলো সবই আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার। অবশ্য, ফকিরাপুলের আশেপাশের এলাকাতেও বেশকিছু আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার অফিস আছে।
৫. এখন প্রশ্ন হলো পত্রিকাগুলোর আয়ের খাত কি?
এই পত্রিকাগুলোর প্রধান আয়ের খাত নিম্নরুপ-
ক. ব্ল্যাক মেইল
খ. তদবির
গ. ডিএফপি করা থাকলে সরকারি বিজ্ঞাপন
ঘ. বেসরকারি বিজ্ঞাপন
ঙ. প্রচার সংখ্যা বেশী দেখিয়ে সরকারি কাগজ বিক্রয় (প্রকাশিত হয় ২০০ কপি, কিন্তু প্রচার সংখ্যা দেখানো হয় ৩০,০০০ হতে ১,০০,০০০ কপি)
চ. ধান্ধা
৬.
আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হয় কিভাবে?*
আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলো প্রকাশের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান আছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পত্রিকার নাম এবং কোন ধরনের সংবাদ যাবে বলে দিলেই তারা চাহিদা মাফিক সংবাদপত্র ছাপিয়ে দেয়। তারাই বিভিন্ন পত্রিকা হতে সংবাদ কপি পেস্ট করে নিজেদের মত সাজিয়ে রাখে। তবে ধান্ধা সংক্রান্ত রিপোর্টগুলো লিখার জন্য আলাদা পারিশ্রমিক প্রদান করতে হয়।
৭.
আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলোর প্রচার সংখ্যা কত?*
আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকাগুলোর প্রচার সংখ্যা নূন্যতম দুইশত। এই পত্রিকাগুলো সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে এবং পত্রিকার ধান্ধা আছে এমন জায়গায় প্রেরণ করা হয়। তবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এই সংখ্যা বাড়তে পারে। সাধারণতঃ কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার প্রচার সংখ্যাই ১০০০-এর উপরে নয়।
৮.
আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা কিভাবে বের করবেন?*
প্রথমেই পত্রিকার একটি ডিক্লারেশন বের করুন অথবা ডিক্লারেশন আছে এমন একটি পত্রিকা কিনে ফেলুন। নিয়মিত প্রকাশিত হয়না এমন ডিক্লারেশন পত্রিকার অভাব নেই। সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে এবার ডিএফপি‘র মিডিয়া লিস্টে নাম তালিকাভুক্ত করতে তিন মাস পত্রিকাটি প্রকাশ করে পৌছে দিন ডিএফপি’সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে। পত্রিকা সম্পাদনা আর সাংবাদিকতা বিষয়ে আপনার ধারণা না থাকলেও সমস্যা নেই। আপনার জন্য আছে ফকিরাপুলের ওয়ানস্টপ সার্ভিস- সম্পাদনা থেকে যথাস্থানে পত্রিকা পৌছে দিবে তারাই আর সেটাও খুব কম খরচে। সব খরচ সহ দুইশত কপি পত্রিকা ছেপে দিবে ফর্মাভেদে ২০০০ থেকে ৩৫০০টাকায় মাত্র।
৯.
প্রকাশ করবেন না কি একটা আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা!! করবেন না কি আন্ডারগ্রাউন্ড সাংবাদিকতা!! ভেবে দেখুন, পৃথিবীর আর কোথাও পত্রিকা প্রকাশে এমন ওয়ানস্টপ সার্ভিস নেই, পত্রিকার এমন মারমার কাটকাট বাণিজ্য নেই।
যে কথা জানে সবে … বলে না ডরে।
অজানা অনেক তথ্য সমৃদ্ধ এই পোস্ট পড়লে আমাদের দীনতাই ফুটে উঠে।
সমাজ সংস্কারকদের এখন সমাজের দায় বইতে হয় না। বরং বিভাজিত করতেই তৎপর।
আমার ধারনা বাংলাদেশের সব পত্রিকার চরিত্রই আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার লেভেলে চলে গেছে।
পত্রিকার মতো সত্যই এমন মারমার কাটকাট বাণিজ্য নেই।
আপনার কথায় যুক্তি আর তথ্য আছে। আপনার দৃষ্টিশক্তি আর বিবেচনা প্রখর।
আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা এমনই।
সৎসাহসী সাংবাদিকদের চেয়ে বর্তমানে অসৎ উদ্দেশ্যের সাংবাদিক অনেক বেশি। তাই সময় সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখা যায় সত্যিকারের ঘটনা না ছাপিয়ে ভিত্তিহীন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংবাদ প্রকাশ করা হয়।
এসব আন্ডারগ্রাউন্ড সাংবাদপত্রের নামগুলো সরকারের রেড লিস্টে থাকা দরকার বলে আমি মনে করি।
আপনার এই পোষ্টটি সময়োপযোগী পোস্ট।
সুযোগের সন্ধানী বা সুযোগের সংবাদপত্র আমার দেশেও কম নেই। চরিত্রও অভিন্ন।
জানতাম না এই সব আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের বিষয় ।
টাকা ইনকামের কত যে ধান্দা আছে এই দেশে –
*

