নীলমাছি
পায়ের কাছে জানলা খোলা। বাইরে ঝাঝা রোদ। গ্রীষ্ম দুপুরের তালুফাটা গরম। জানালার গ্রীলে তিন চড়ুই শলাপরামর্শ করছে। ধীর গতিতে পাখা ঘুরছে।
কাঁথা মুড়ে শুয়ে আছি। তিন দিন ধরে ভীষণ জ্বর। আবার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। তৃষ্ণা পাচ্ছে, বরফ চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে। জ্বর বাড়ছে আর বিছানাটা কেমন সবুজ মাঠ হয়ে যাচ্ছে। দূর্বা ঘাসের ঘ্রাণ, মাথার কাছে ফুটে আছে ঘাসফুল। ফড়িংয়ের ঝাক উড়ে গেলো- এলোমেলো। একটা চকচকে নীল ডুমো মাছি নাকের কাছে অনেকক্ষণ ভনভনালো। কোথায় উড়ে গিয়ে ফিরে এলো। কাঁথার উপরে বসলো-
: আবার জ্বর বাঁধিয়েছো?
: জ্বর কি ছবির ফ্রেম না পুকুরের ঘাট যে বাঁধাবো?
: হাহাহাহাহা… ভনভনানিতে রাগ করেছো?
উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে মাছি কথা শুরু করলো-
: ভনভনিয়ে কি খুঁজছিলাম জানো?
: কি?
: পাকা ল্যাংড়া আমের রসের ঘ্রাণ।
প্রচন্ড বিরক্ত হলাম-
: আমি কি ল্যাংড়া আম?
: ধ্যাত, ল্যাংড়া আম হবে কেনো! সেই জ্বর জ্বর দুপুরের কথা মনে নেই!
: কোন দুপুরের কথা?
: সেই যে চারদিন আগে তোমার দাদিজান মারা গেছেন। উনার চেহলাম। দুপুরে কয়েকজনকে খাওয়ানো হবে। মা কুঁচো চিংড়ি দিয়ে করলাভাজী, পুঁইশাক দিয়ে বড় চিংড়ি, লাউ দিয়ে ইলিশ মাছ, আলু-বেগুন দিয়ে রুই মাছ রান্না করেছেন। রুইমাছের তরকারীতে জিরা ভেজে গুড়ো করে দিয়েছেন। সজনের ডাল থেকে ধোঁয়া উড়ছে। শোক আর ঘ্রাণে উথলে ওঠা দুপুর। নামাজ শেষে মিলাদ, তারপরে খাওয়ানোর পর্ব শুরু হবে। মনে আছে?
: হ্যা, মনে আছে। তুমি এসব জানো?
: জানবো না কেনো! আমিও যে ছিলাম।
: নীলমাছি, তুমিও ছিলে?
: হুম। সেদিন তোমার বেশ জ্বর। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে মা মাথায় পানি দিচ্ছেন। জ্বর কমছে বাড়ছে, এক্কেবারে ছেড়ে যাচ্ছে না। ঘরের এক কোনে শুয়ে আছো- গুটিশুটি ছোটো মানুষ।
: হুম, গায়ে লেপ। দাদিজানের কাফনের মত শাদা কভার। ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ।
: তোমার স্মৃতি খুব টনটনে। মেহমানদের জন্য ফল আনা হয়েছে- ল্যাংড়া আম, শক্ত কোষের কাঁঠাল আর তরমুজ। বাবা এক টুকুরো আম কেটে তোমার মুখে দিলেন। সেই আমের রস টুপ করে শাদা কাভারে পরলো।
: বাবা মারা গেছেন বাইশ বছর হয়ে এলো। সে কথা থাক, তোমার কথাই বলো-
: গরমে আর ক্ষিধের জ্বালায় অস্থির ছিলাম। চিন্তা না করেই লেপের কভারে পরা দু’তিন ফোঁটা রস খেতে শুরু করলাম। অবাক হয়ে খাওয়া দেখছিলে।
: খাবার দেখছিলাম না, তোমার নীল শরীরে আলোর ঝিলিমিলি দেখছিলাম।
: খাওয়া শেষে ভাবলাম একটু জিরোই। তুমি অসুস্থ বাচ্চা- আমায় কি আর ধরতে পারবে!
: হিসেবে ভুল করেছিলে-!
: হ্যা, ভুল করেছিলাম। হঠাৎ মুঠোর ভিতরে ধরে ফেললে। সে কি ভয়! জীবন হারানোর আশংকা! পায়ে সুতো বেধে আমৃত্যু উড়াবে- ভাবতেই বুক ফেঁটে কান্না এলো।
: আহারে! হাহাহাহাহাহাহা…
: হাসছো কেনো! তখন কি জানতাম যে কয়েক মুহূর্ত দেখে ছেড়ে দিবে!
: আজ সেসব কথা ভনভনাতে এসেছো?
: রূপকথার অভিশাপে অমরত্ব পেয়েছি। মরে যাই- আবার একজীবনের স্মৃতি নিয়ে জন্মাই। আজ দুপুরে সেই দুপুরের কথা মনে হতেই ছুটে এলাম।
: নীল মাছির আগমন, শুভেচ্ছায় স্বাগতম। তা কি দেখলে?
: তোমার মুখে এখনো আমের রসের ঘ্রাণ লেগে আছে।
: এখনো ঘ্রাণ লেগে আছে? কত বছর আগের কথা! সময় চলে গেছে কত!
: ধ্যাত! সময় যাবে কোথায়! সময় তার প্রতিটা বিন্দুতে স্থির।
: নীলমাছি, সময় কোথাও যায়না?
: না, যায়না। সময় প্রতি বিন্দুতে স্মৃতি সঞ্চিত করে রাখে।
: আর আমাদের যে বয়স বাড়ে? দিন ফুরোয়?
: বয়স বাড়বে না কেনো বলো! তোমাদের মানুষ হবার কত তাড়া। পায়ের তলায় সর্ষে। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, শুধু যাওয়া আর যাওয়া।
: সবাই তো যায়, কি যায় না?
: যেয়ে লাভ কি! সময়বিন্দুকে অতিক্রম করে যেতে যেতে একদিন একেবারে থেমে যাওয়া। থেমে যাবার আগে মনে হওয়া- এই ইঁদুর দৌড়, এই দিনযাপন অর্থহীন… সব অর্থহীন! শুনতে পাওয়া কে যেনো ডাকনাম ধরে ডেকে বলে “তোমার না মনসুখিয়া যাবার কথা ছিলো!”
কথা খুঁজে পাইনা। নীল মাছি বিজ্ঞের মত বলে-
: এসব কথা থাক। এত ঘনঘন তীব্র মাথাব্যাথা আর গাঢ় জ্বর আসার লক্ষণ মোটেও ভালো নয়। তুমি কি পুষছো?
: জ্বরের লক্ষণ বিচার পরে করো। ও নীল মাছি, মনসুখিয়ায় কবে যেতে পারবো! ছুঁতে পারবো অভ্রজোনাকের পাখা!
নীল মাছি কোনো উত্তর দেয় না। জ্বর বাড়ছে, তৃষ্ণা তীব্রতর হচ্ছে। ঘরের সিলিং কখন নীলাকাশ হয়ে গেছে। মেঘে মেঘে কত প্রিয়মুখ। সবুজ ঘাসে দাঁড়িয়ে আম কাটছেন বাবা। ধবেধবে শাদা পাঞ্জাবী হাওয়ায় উড়ছে যেন মনসুখিয়ার নিশান।
লিখাটি পড়লাম মি. আবু সাঈদ আহমেদ। খুউবি হৃদয় ছোঁয়া। নিজের মনে হয়।
ধন্যবাদ মুরুব্বী আজাদ ভাই।
অসাধারণ লেখেন আপনি।
ধন্যবাদ কবি রিয়া।
চমৎকার লাগল। মনে হয় কোথাও পড়েছি। বিশেষ করে শুরুর চড়ুইয়ের চিত্রপট বেশ চেনা। শুভ কামনা।
গ্রুপ পোস্টে পড়েছেন মাহবুব আলী ভাই। ধন্যবাদ।
মুগ্ধতা জানালাম হরবোলা আবু সাঈদ আহমেদ ভাই।
ধন্যবাদ সুমন আহমেদ ভাই।
অপার বিষ্ময়।
খুশি হলাম সৌমিত্র ভাই।
অসাধারণ অণুগল্প।
ধন্যবাদ কবি শাকিলা তুবা।
খুব সুন্দর অণুগল্প।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।