যাওয়া

১.
সোমনাথবাবু কাউকে ছাড়েন না, সবাই তাকে ছেড়ে যায়। জন্মের পরে নৌকা ডুবিতে বাবা তাকে ছেড়ে গেছেন। দশ বছর বয়সে তিন দিনের জরে মা। এখানে সেখানে ঘুরে তার বেড়ে ওঠা।

মা যাবার পরে হারুন মেকানিকের গ্যারাজে কাজ জুটেছিল। টানা ষোল বছর কাজ করেছেন। হারুন মেকানিক আজব মানুষ- মুখভরা গালি মনভরা দয়া। তাকে একটা ছোট দোকান করে দিয়েছিলেন। এক বর্ষার রাতে হারুন মেকানিকের হার্টের মেকানিজম ফেল করল, চলে গেলেন।

হারুন মেকানিক যাবার আগে তাকে বিয়ে করিয়েছিলেন। সুখের সংসার। ঘর আলো করে দুই মেয়ে এলো- মায়া আর ছায়া। মেয়েদের বিয়ের আগে তাদের মা বিদায় নিল। বড় মেয়ে মেট্রিক পরীক্ষা না দিয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেল, ভুবন দাসের ছেলের সাথে বর্ডার টপকে ওপারে। বাপের সাথে কোন যোগাযোগই রাখল না।

ছোট মেয়েকে সাধ্যমত ধুমধামের সাথে বিয়ে দিয়েছেন। সে বাপকে ছেড়ে গিয়ে সুখে আছে, শান্তিতে আছে। মেয়ের ঘরে দুটো নাতি- একটার বয়স দশ বছর অন্যটার সাত। প্রতি মাসে অবশ্য এক দুবার বেড়াতে আসে। বাড়িকে মুখর করে তুলে। তারপর স্তব্দ করে চলে যায়।

সবাই সোমনাথবাবুকে ছেড়ে গেছে। তবে পনের বছর বয়সে ধরা মদ খাওয়ার নেশাটা একমাত্র রয়ে গেছে। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে পান করেন। ঘন্টা দুয়েক চুপচাপ বসে থাকেন। কখনও অতিরিক্ত পান করেন না, মাতাল হন না, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারান না। শুধু মনে ও মগজে এক ধরনের ঝিমঝিম শান্তি অনুভব করেন, কষ্ট অনুভব করেন, স্মৃতি রোমন্থন করেন।

২.
আজ সকালে ছোট মেয়ে বড় নাতিটাকে নিয়ে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সিএনজি চেপে তার কাছে বেড়াতে আসছিল, বাস চাপা দিয়েছে। ছোট নাতি আর মেয়ের জামাই হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। তারাও হয়তো চলে যাবে।

রাত দশটা। তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরছেন। হেঁটে হেঁটে। সারাদিন গরম ছিল, এখন টিপটিপ বৃষ্টি। শীতল নিশিহাওয়া। আজিজের দোকান থেকে কেরু এণ্ড কোং-এর একটা পাইট কিনে পাঞ্জাবির পকেটে রাখলেন। ঘরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। পকেটে রাখা পাইটের বোতলে হাত বুলাতে বুলাতে হাঁটতে লাগলেন। ছোট মেয়ে আর বড় নাতির কথা মনে হচ্ছে- ভিতর থেকে কান্না উঠে আসছে। কখনও মনে হচ্ছে রাতের ঢাকার নির্জন পথে ওরা সাথে সাথে হাঁটছে। পরক্ষণেই মগজ বলছে- মায়া, সব মায়া।

সবাই তাকে ছেড়ে চলে যায়, তিনি কাকে ছেড়ে যাবেন বুঝতে পারছেন না। তীব্র অভিমানে পকেট থেকে বোতলটি বেড় করে রাস্তায় ছুড়ে ফেললেন। রাতের নির্জনতায় শব্দ তুলে কাঁচের বোতল ভেঙ্গে চুর হয়ে গেল, বৃষ্টিস্নাত পথে গড়াল মদ। তিনি পঞ্চাশ বছরের সম্পর্ক ভাঙ্গলেন, মদকে পথে ছেড়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন।

৩.
রাত আড়াইটায় সোমনাথবাবু বাড়ি ফিরলেন। সারাদিনের ক্লান্তি মুছতে স্নান করলেন। এখন আর ঘুম হবেনা। চেয়ারে গা এলিয়ে দিলেন। পায়ে ব্যাথা অনুভব করছেন। আরামের জন্য টেবিলে পা তুলতে গিয়ে বিস্মিত হলেন – পকেট থেকে ছুড়ে ভেঙ্গে ফেলা পাইটের বোতলটি দিব্যি টেবিলের উপরে রয়েছে, তার জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি মদ ছাড়তে চেয়েছেন, মদ তাকে ছাড়ে নাই। সবাই ছেড়ে যায় না, ছেড়ে যেতে পারেনা।

7 thoughts on “যাওয়া

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।