ঋণশোধের এওয়ার্ড!
সংবাদপত্রের অফিসে চাকরি করি। প্রতিদিনই অফিস থেকে বের হতে রাত গভীর হয়ে যায়। বাসের জন্য বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। তবে সুবিধে হলো বাস প্রায় ফাঁকা থাকে আর রাস্তাও ফাঁকা। দীর্ঘ যানজটে নাকাল হতে হয় না। আজ কিছুটা ব্যতিক্রম- মাঝরাতেও আগারগাঁও থেকেই যানজটের শুরু।
যানজটের গুষ্ঠি উদ্ধারে ব্যস্ত। এক সুবেশী যুবক এসে পাশের সিটে বসেছে তা খেয়াল করিনি। সামনের এতোগুলো সিট ফাঁকা থাকতেও পাশে এসে বসায় ভীষণ বিরক্ত হলাম। লক্ষ্য করলাম যুবকের গায়ে আকাশী শার্ট আর কালো ইংলিশ ফুলপ্যান্ট। গাঢ় নীল টাই। বোঝাই যাচ্ছে কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে সেলসে কাজ করে।
যানজট ছুটার লক্ষণ না দেখে চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিতেই অসাধারণ মিষ্টি কণ্ঠস্বর-
: আসসালামু আলাইকুম, স্যার।
চোখ মেলে দেখি ওই যুবক, তার সালামের উত্তরে বললাম-
: ওয়ালাইকুম আসসালাম।
যুবকের স্বরে বিনয় গলে পরছে-
: স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, একটা অনুরোধ করতে পারি!
মনে মনে বললাম ‘ধ্যাত!’, কিন্তু ভদ্রতা বজায় রেখে বললাম-
: কি অনুরোধ?
: স্যার, একটা ভুতের গল্প শুনবেন!
প্রচণ্ড বিস্মিত হলাম, সাথে রাগও, মাঝরাতে মশকরা! জানতে চাইলাম-
: হঠাৎ ভুতের গল্প শোনাতে ইচ্ছে হলো কেনো?
: স্যার, এটা আমার ডিউটি। প্লিজ শুনুন স্যার, একটা ভুতের গল্প।
: আমাকে ভুতের গল্প শুনিয়ে আপনার লাভ কি?
: স্যার, আমার টার্গেট প্রতিদিন তিন জনকে ভুতের গল্প শুনিয়ে ভয় দেখানো। গত তিন মাসে মাত্র সাত জনকে ভুতের গল্প শোনাতে পেরেছি। কিন্তু তাদের একজনও ভয় পায়নি। তাই তিন মাসের বেতন আটকে আছে, বউ ছেলে-মেয়ে নিয়ে না খেয়ে দিন কাটছে স্যার।
বেতন আটকে থাকার কষ্ট বাঙালি মাত্রই জানে, তার কষ্ঠে কষ্ঠিত হয়ে বললাম-
: ভুতের গল্প শোনানোর চাকরি! এ আবার কেমন চাকরি!
: স্যার, ইদানিং প্রায় প্রতিটা এফএম রেডিও আর বেশ ক’টা টিভি চ্যানেলে ভুত বিষয়ে অনুষ্ঠান হয়-
: হ্যা, সে অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে আপনার গল্প কে শুনবে!
: কিন্তু স্যার, সেসব গল্প তো শুধুই গল্প। সেসব গল্পে ভুত সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয়া হচ্ছে। এমনসব গল্প প্রচার করছে যে অল্প বয়েসী বাচ্চাদেরও ভুতের ভয় কেটে যাচ্ছে। ভুতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।
তার কথায় সত্যতা আছে, আমার বাচ্চা ছেলেটা এসব অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে এখন আর ভুতকে ভয় পায়না। একটা খালি আড়াইশো গ্রামের সরষে তেলের বোতল বালিশের নিচে নিয়ে ঘুমোয়, রাতে ভুত এলে ধরে আটকে রাখবে বলে। তো সেই যুবকের কাছে জানতে চাইলাম-
: ভুতের ভয় পাওয়া বহাল থাকাটা কি জরুরী?
: স্যার, অবশ্যই জরুরী।
: কেনো জরুরী?
: স্যার, ভয়ই যদি না থাকলো, তবে ভুত থেকে লাভ কি! প্রকৃতির নীতির বিরুদ্ধে যাওয়া কি ঠিক!
তার কথায় বিমোহিত হলাম, জানতে চাইলাম-
: আপনি কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরী করেন? এনজিও’তে কি?
: এনজিও’তে নয় স্যার। আমি জিপিবি’র কর্মী।
মাথায় রক্ত উঠে গেলো, জিপিবি মানে গ্রামীন ফোন, বাংলাদেশ। এই মোবাইল ফোন কোম্পানি ভুতের ভাবমূর্তি রক্ষায় নেমেছে! মিনিটে মিনিটে মেসেজ দিয়ে তাদের আর পোষাচ্ছে না! এখন বাসে বাসে প্যাকেজ বিক্রির ধান্ধা! এর মধ্যে তিন মাস ধরে বেতন দেয় না, ছি: এতো অধ:পতন। রাগ নিয়েই বললাম-
: আপনি জিপিবিতে কাজ করেন- মানে গ্রামীন ফোন বাংলাদেশ?
: দু:খিত স্যার। আমি গ্রামীন ফোনের কর্মী নই, ভুত বিষয়ক অধিকাংশ অনুষ্ঠানই স্পন্সরর করে এই কোম্পানি। এই কোম্পানি আমাদের শত্রুপক্ষ।
বিষ্ময়ে জানতে চাইলাম-
: তবে জিপিবি আবার কোন কোম্পানি!
: স্যার, জিপিবি একটি সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, এর পুরো নাম ‘গোস্ট প্রমোশন ব্যুরো।’ ভুতের ভাবমূর্তি উদ্ধারে আমরা নিরলস কাজ করে যাচ্ছি।
: ভেরি ডিসগাস্টিং! মানুষ খেতে পায়না, আর ভুতের ভাবমূর্তি উদ্ধারে যতসব রং ঢং! ফাজলামোর একটা সীমা থাকা উচিত।
চেঁচিয়েই কথাগুলো বললাম। বাসের ড্রাইভার ও ভিতরের যাত্রীরা ঘটনা বোঝার জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। যুবক কান্না চাপার চেষ্টা করছে-
: সর্যি, স্যার। ভুল হয়ে গেছে। গল্প শুনবেন না বললেই পারতেন। পেটের জ্বালায় এই চাকরী করি, স্যার। ভালো একটা চাকরী পেলে কি আর মাঝরাতে বাসে বাসে ঘুরি, স্যার!
কান্নায় আটকে আসা গলায় সে আরও জানালো-
: ঘরে বউ ছেলেমেয়ে না খেয়ে আছে- তিন মাসের বেতন আটকে আছে। আমার কষ্ট আপনি কি বুঝবেন স্যার! আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়..
যুবক মানুষের কান্না খুব হৃদয়স্পর্শী ব্যাপার। তাকে কি বলে সান্ত্বনা দিবো বুঝতে পারছিনা, যানজটে থেমে আছে বাস। বাসের সকল যাত্রী ও ড্রাইভার আমাদের দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে। সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে যুবক বললো – ‘স্যার, আমরা ভুত হতে পারি, কিন্তু মানসম্মান আমাদেরও আছে…।’ এই কথার পরপর দু’টো ঘটনা ঘটলো- যুবক উড়ে বাসের দরজা দিয়ে বের হয়ে হাওয়ায় মিশে গেলো। এই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে ড্রাইভার জানলা দিয়ে লাফিয়ে দৌড় লাগালো, এক্সিডেন্ট করলে যেমন করে পালায় আর কি!
যানজট ছুটে গেছে। এখনও মাঝ রাস্তায় বাস দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভার ফিরেনি। অন্য বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ ওই সুমধুর কণ্ঠস্বর- ‘স্যার! আমাদের গায়ের চামড়া কেটে পাপোশ বানিয়ে দিলেও আপনার ঋণ শোধ হবেনা। আফসোস! ভুতদের চামড়া নেই। আজ ড্রাইভার যে ডরটা ডরাইছে তাতে জিপিবি’র মহাপরিচালক খুশী হয়ে সবার বকেয়া বেতন পরিশোধ করে দিয়েছেন। একমাসের সমপরিমাণ বোনাসও দিয়েছেন। ভুতের ভাবমূর্তি রক্ষায় আপনাকে জিপিবি ব্রেভারি এওয়ার্ড-এর জন্য মনোনীত করা হয়েছে।’
খুশী হওয়া উচিত, কিন্তু হতে পারছি না। মাথার ভিতর কে যেনো বলছে- ‘এওয়ার্ডের টুটটুট করি। ঋণশোধের গুষ্টি কিলাই, এখন বাড়ি যাবো কিভাবে! ধুত্তোরি…!’
আকারের কারণে নয়; ছোটগল্প এবং অণুগল্পের বেসিক এলেমেন্টস মাথায় রেখে এটাকে ছোটগল্প হিসেবে পড়লাম। দারুণ লেগেছে!
খুব ভালো করেছেন মধ্যাহ্নের আয়োজন ভাই।
অণুগল্পটি পড়লাম। শুভেচ্ছা প্রিয় আবু সাঈদ আহমেদ।
ধন্যবাদ মুরুব্বী ভাই।
রম্য ঘরানার সিরিয়াস লিখায় আপনার জুড়ি খুব কম আছে হরবোলা সাঈদ ভাই।
খুশি হলাম সুমন ভাই।
ইন্টারেস্টিং।
ধন্যবাদ সৌমিত্র ভাই।
কত শত চরিত্র আমাদের আশেপাশে আমাদের সাথে চলে।
ঠিক বলেছেন আপা।
লেখাটি পড়লাম আবু সাঈদ আহমেদ দা।
খুব ভালো করেছেন রিয়া।