বুড়োচড়ুই
১.
সবুজ মাঠ। যতদূর চোখ যায় সবুজ ঘাস। কোনো গাছ নেই। লোকালয় নেই। জনপ্রাণী নেই। অপার নীরবতা। মধ্যবিন্দুতে স্থির একা- গন্তব্য মনে নেই। অথচ খুব দ্রুত যেতে হবে।
ঝুপ করে রাত নামে। তীব্র আতংক গ্রাস করে।অন্ধকারের অদেখা দানব তাড়া করছে। টুকরো টুকরো করে গিলে খাবে। জানিনা কখন দৌড়াতে শুরু করেছি– গন্তব্যহীন। দানবের আগুন শ্বাসে পিঠ ঝলসে যাচ্ছে। পা ভারী হয়ে আসছে। খুব কাছে চলে এসেছে দানব..এখনই পিছন থেকে খামচে ধরে খুবলে খুবলে খাবে।
অকস্মাৎ ঘুম ভাঙে, ভয় ভাঙেনা। যেন দুঃস্বপ্নের দানব ঘরের আবছায়ায় ঘাপটি মেরে বসে আছে।
২.
ঘুম ভাঙা স্বপ্নরা ঘুমোয় না, জেগে থাকে। দু:স্বপ্নরা ফিরে ফিরে আসে। পৌনে চারটা বাজে। ঘুম আর আসবেনা। বারান্দায় দাঁড়াই।
শেষ রাতের হাওয়া তুলতুলে নরম। আহ্লাদী, গায়ে গায়ে মাখোমাখো। ল্যাম্পপোস্টের মলিন আলোয় বিষন্ন পথ। তিন কুকুর ঝিমোচ্ছে। আকাশে ছুটির অপেক্ষায় তারার দল। চারদিকের শান্ত নীরবতায় মসৃন ঢেউ তুলে ভেসে আসে ভোরের আজান- খায়রুন মিনান নাউম..খায়রুন মিনান নাউম..।
৩.
মিহি আলোয় দিনের অভাস। ঘরের ঘুলঘুলি হতে বেরিয়ে বারান্দার গ্রীলে বসে ঘুমভাঙা চড়ুই-
: এই যে মানুষ, শুভ সকাল!
: শুভ সকাল! কেমন আছো?
: ভালো নেই গো, মনে ভীষণ জ্বালা।
: হাহাহা, এত্তটুকু চড়ুই! তার আবার মনে জ্বালা!
: আমি ছোট্ট চড়ুই। তাই বলে মন ছোট্ট হবে!- এভাবে বলতে পারলে!
: স্যরি, চড়ুই। মনে জ্বালা কেনো?
: নষ্ট ডিমটা যে আমার ছিলো গো।
: কোন নষ্ট ডিম!
: ঐ যে –
চড়ুই পাখি বারোটা
ডিম পেড়েছ তেরোটা
একটা ডিম নষ্ট
চড়ুই পাখির কষ্ট।
: আহা রে! সে তো বহুকাল আগের চড়ুই পাখির কথা!
: আমি সেই আদ্যিকালের চড়ুই।
বিষ্ময়ের ঘোর কাটেনা-
: আদ্যিকালের চড়ুই? বলো কি!
: হুম। সেই যে বহুকাল আগের এমন ভোরে তোমার মা রান্না ঘর খুললেই এক বিড়াল এসে হাজির হত।
: আরে! তাই তো!
: তোমার মা লাল আটার রুটি বানাতেন। আলু ভাজি করতেন। ছুটির দিনে ঘি মাখানো ময়দার রুটি, সুজির হালুয়া।
: তুমি তখন ছিলে?
: হ্যা, ছিলাম। বাবার হাত ধরে যেতে ইশকুলে। ব্যাগের ভিতরে রঙিন বই, মাথার ভিতরে রাপুনজেল।
: হাহাহা! রাপুনজেলের কথাও জানো?
: জানবো না আবার! সে বয়সে সবাই সুবর্ণরেখা, কাজলরেখা, কলাবতী, সিন্ড্রেলার জন্য পাগল হয়। কিন্তু তোমার চাই রাপুনজেল।
: অবুঝ ছেলেমানুষি!
: ছেলেমানুষি না ছাই! ভেবেছিলে বড় হয়ে ডাইনিবুড়ির কাছে বন্দী সোনালীচুলের রাপুনজেলকে মুক্ত করে দুজনে তারার দেশে চলে যাবে। রাপুনজেলকে খুঁজে পেয়েছ?
: হুম।
: তারার দেশে যাওনি?
: না।
: কেনো?
: এক রাজপুত্র আগেই রাপুনজেলকে জয় করে নিয়েছে। চাষাপুত্র যেতে বড্ড দেরী করে ফেলেছিল।
: আহারে মানুষ! তোমারও তো কষ্ট।
চড়ুইয়ের আদিখ্যেতা সহ্য হয়না, প্রসঙ্গ বদলে বলি-
: বহুকাল আগের একটা নষ্ট ডিমের কষ্ট এখনো বয়ে চলছো?
: খুব প্রিয় কিছু হারানোর কষ্ট ভোলা যায়! রাপুনজেলকে হারানোর কষ্ট ভুলতে পেরেছো?
উত্তর খুঁজে পাইনা। এলেবেলেভাবে জিজ্ঞেস করি-
: আদ্যিকাল হতে এলে কিভাবে?
: কষ্টের তাড়া খেয়ে আদ্যিকাল হতে চলে এসেছি। ঘরের ঘুলঘুলিতে আশ্রয় নিয়েছি।
: কষ্টের তাড়া থেকে বাঁচতে পেরেছ?
: না গো মানুষ, পারি নাই। কষ্ট থেকে বাঁচতে হলে যেতে হবে মনসুখিয়া।
: মনসুখিয়া যাওনি কেনো?
: যাবার পথ চিনি না গো। তুমি খুঁজে পেলে তোমার সাথে সাথে আমিও যাবো। নিবে আমায়?
: তুমি কে যে সাথে নিবো?
: আমি কে! আমি তোমার শনপাপড়ীর ছেলেবেলা, সোনালী চুলের রাপুনজেল, শক্ত করে ধরা বাবার আঙুল, মায়ের আঁচলে বাধা পায়রা মার্কা আধুলি, ঝিমধরা লাটিম, টানধরা চোখদার ঘুড্ডি, লাঠি বিষ্কুট, নানখাটাই, ঝোলা গুড়ের কটকটি— কি নিবে না আমায়?
৪.
সূর্য ওঠে। রোদে চড়ুইয়ের ছোট্ট শরীর ঝিকমিক করে- যেন রাপুনজেলের সোনালী চুল। বাতাসে রুটি আর আলুভাজির ঘ্রাণ। বহুকাল আগের রান্নাঘর হতে মা নাস্তা খেতে ডাকেন। পা বাড়াতেই বারান্দাটা বড় হতে হতে স্বপ্নে দেখা দিগন্তবিস্তৃত মাঠ হয়ে যায়। অদেখা দানব জ্বলজ্যান্ত আলোর ভোরে নতজানু, কষ্টে জারেজার। সে কি দ্বিতীয় সত্বা আমার! চড়ুইয়ের আদ্যিকালের সহচর! সেও খোঁজে মনসুখিয়ার পথ! অভ্রজোনাকের পাখার স্পন্দন!!
সময় ধায়, সকলই ফুরোয়। মনের ভিতরে নীরবতা ভেঙে কে যে গেয়ে চলেন-
” তুমি মোর পাও নাই পাও নাই পরিচয়-
তুমি যারে জানো সে যে কেহ নয়, কেহ নয়।
মালা দাও তারই গলে, শুকায় তা পলে পলে
বায়ু পরশন নাহি সয়
পাও নাই পাও নাই পরিচয়…”
_________________________
গদ্যগ্রন্থ: মনসুখিয়া/আবু সাঈদ আহমেদ।
মনসুখিয়ার পথে … অভ্রজোনাকের পাখার স্পন্দন। অসাধারণ একটি গদ্য পড়লাম।
ধন্যবাদ মুরুব্বী আজাদ ভাই।
অসাধারণ হরবোলা আবু সাঈদ আহমেদ ভাই।
ধন্যবাদ সুমন ভাই।
অসাধারণ ভাই।
ধন্যবাদ কবি শাকিলা তুবা।
ভালোবাসা আবু সাঈদ আহমেদ ভাই।
ধন্যবাদ সৌমিত্র ভাই।
অসাধারণ।
ধন্যবাদ কবি রিয়া।