দ্বিধা

– তুমি কি আমাকে ফিরিয়ে নিতে পারো না!

সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, অফিসে কাজের চাপ নেই। চৌদ্দ তলায় নিজের চেম্বারে বসে আছে মাহমুদ, জানালার পর্দা সরিয়ে বৃষ্টি দেখছে, কানে ধরা মোবাইল সেট। বীথির আকুতি তাকে গ্রাস করে, এক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। স্তব্ধতা কাটিয়ে বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করে,
– তুমি কেনো বারবার ফোন করছো, বীথি? কেনো কাজের মাঝে এমন বিরক্ত করছো!
– তুমি বারবার কল কেটে দিচ্ছো, আমি কি করবো বলো!

মানুষের মস্তিষ্ক দুরন্তগতির রহস্যময় সময় বাহন। ‘তুমি কল কেটে দিচ্ছিলে, আমি কি করবো বলো!’ বলতে বীথির যতটুকু সময় লাগলো, ওই ক’সেকেন্ডের মধ্যে মাহমুদের বহু কিছু মনে পড়ে গেলো। দু’জনের গড়ে তোলা সংসার, তিল তিল করে সাজানো আর সুখ-দুখ উদযাপন। তিন বছরের মাথায় প্রথম সন্তান আরিফের জন্ম হলো। মুরুব্বীদের কথায় দেরী না করে, দুই বছর বিরতি দিয়ে আবার সন্তান নেওয়া, কোল জুড়ে এলো যুথী। চার জনের সংসারে থই থই সুখ। ভাবনায় ছেদ পড়ে বীথির কথায়, মাহমুদের কণ্ঠে কঠোরতা,
– বীথি, আমি কেনো তোমার ফোন রিসিভ করবো?

বীথির কাছে এ প্রশ্নের এক হাজার উত্তর আছে, এর কোনোটাই যথেষ্ট নয়। যুথীর জন্মের পর মাহমুদ চাকরী ছেড়ে নিজে ব্যবসা শুরু করলো- পূঁজির স্বল্পতা শ্রম দিয়ে সমন্বয় করতে গিয়ে মাহমুদের সে কি ব্যস্ততা। সংসারের প্রয়োজনীয় দায়িত্বগুলো পালনে কোনো ফাঁকি দেয়নি। কিন্তু শুধু দায়িত্বপালনই কি সব! বীথির দীর্ঘ দিনগুলো কিভাবে কাটছে একবারও কি ভেবেছে সে। দুপুরে দুই সন্তানকে ঘুম পাড়ানোর পর বিকেল পর্যন্ত অখণ্ড অবসর- এই অবসরে রোজ রোজ একঘেয়ে টিভি সিরিয়াল দেখতে বীথির ভালো লাগে না, সময় কাটাতে মোবাইলে আত্মীয় স্বজন আর বান্ধবীদের সাথে কথা বলে। বীথির সম্বিত ফিরে, মাহমুদের প্রশ্নের উত্তরে বলে,
– আমি জানিনা, মাহমুদ। তোমার সাথে একবার দেখা করতে চাই.., একবার বাচ্চাদের দেখতে চাই।
– এসব কি বলছো বীথি!

বীথি জানে সে কি বলছে, যা বলছে তা স্বাভাবিক নয়। কিন্তু ওই দিনগুলোতে নি:সঙ্গতায় নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া কি খুব বেশী অস্বাভাবিক ছিলো, মোবাইলে সঙ্গ লাভের চেষ্টা করা কি ভুল ছিলো। একটা সময় বান্ধবীরা কি কাজের অজুহাত দিয়ে ফোন কেটে দিত না! কিন্তু কথা বলার নেশায় বীথি আসক্ত, তাই এলোমেলো অনেককেই ফোন দিত। একদিন ফয়সালকেও ফোন দিলো, বহু দিন পর দু’জনে কথা হলো। এমন নয় যে দু’জন খুব কাছের বন্ধু, কাছাকাছি হবার শুরুটা এখান থেকেই।

প্রতিদিনের আলাপে দু’জন এতটা কাছাকাছি হলো যে, এক একটা দুপুরে বাইরে ব্যস্ত জীবন, কোলাহল, ঘরে ঘুমোচ্ছে দুই সন্তান আর গেস্টরুমে দু’জন মানুষ স্পর্শে কাতর, স্পর্শে মুখর। এ পর্যন্ত থাকলে সমস্যা ছিলো না, কিন্তু প্রণয় চরিত্রগতভাবেই অন্ধ। ফয়সাল যেনো এক নি:সঙ্গতা নাশক বড়ি, ওকে ছাড়া বীথির জীবন অর্থহীন। ফয়সালের ক্ষেত্রেও বীথিকে ছাড়া বেঁচে থাকা দায়। এক দুপুরে মাহমুদকে জরুরী বাসায় আসতে বললো বীথি, মাহমুদ ফিরে এসে সবই পেলো বীথিকে ছাড়া। বীথি কিছুই ভুলেনি, মাহমুদের বিস্ময়ে বিব্রত হলেও বীথি বললো,
– মাহমুদ, আমি জানিনা কি বলছি, কিন্তু তুমি একটাবার আমার সাথে দেখা করো, একটাবার বাচ্চাদের দেখতে দাও।

মাহমুদ বুঝতে পারে বীথি কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে, ওর চোখের পানি নাকের পাশ বেয়ে এসে ঠোঁট ছুঁয়েছে। কিন্তু এসবকে সে পাত্তা দিবে না, মোটেই পাত্তা দিবেনা, কঠোর কণ্ঠেই বলে,
– বীথি, তুমি চলে যাওয়ার পর বাচ্চারা খুব কান্না করতো, খেতে চাইতো না। তুমি কখন আসবে জানতে চাইতো। খুব কষ্ট করে বাচ্চাদের ভুলিয়েছি, ওরা তোমাকে ভুলে গেছে, আবার কেনো ওদের মন ভাঙতে চাইছো!

এবার আর বীথি নিজেকে সামলাতে পারলো না, কান্নার দমক সামলাতে সামলাতে বলে,
– আমি ভুল করেছি, একবার…অন্তত একবার বাচ্চাদের দেখতে দাও, কথা বলতে দাও, প্লিজ..।

মাহমুদের ভেতরে তোলপাড় হয়ে যায়, এ কান্না সংক্রামক, এ আকুতি অসহনীয় করুণ, চোখ ভিজে আসে। তবু শান্ত কণ্ঠে বলে,
– তোমার কি টাকা দরকার বীথি?
– মাহমুদ, তোমাকে ছেড়ে আসার পর সবগুলো দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার ঘরে ভাত রান্না করার চালও নেই, কিন্তু টাকা চাইনা, প্লিজ একবার দেখা করো, একবার।

কৌতূহল চাপতে না পেরে মাহমুদ জিজ্ঞেস করে,
– ফয়সাল কই?
– ঘর ছাড়ার সপ্তাহ খানেক পর আর ওকে পাইনি। ও অন্য কাউকে নিয়ে ব্যস্ত আছে হয়তো। দ্বিধা আর অপরাধবোধে পুড়তে পুড়তে তোমাকে জানানোর সাহস পাইনি।

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মাহমুদ, এসব ঘটনা ছায়া ছায়াভাবে তার জানা আছে। যতটা পেরেছে বীথির খোঁজ রেখেছে, কারণ বীথি সম্পর্কে প্রাক্তন স্ত্রী কিন্তু তার সন্তানদের মা, আর মা কখনো প্রাক্তন হয় না। মাহমুদের কণ্ঠে অসাহয়ত্ব ফুটে ওঠে,
– বীথি, তুমি জানো তোমার সাথে দেখা হলে নিজেকে সামলানো সম্ভব নয়, এরপরও কেনো জেদ করছো!
– আমি সন্তানদের কাছে ফিরতে চাই।
– আরিফ আর যুথী খুব ভালো আছে।

বীথি জানে মাহমুদের কাছে বাচ্চারা ভালো আছে। খুব ভালো আছে। কিন্তু সে তো বাচ্চাদের ছাড়া ভালো নেই,
– মাহমুদ, জানি বাচ্চারা খুব ভালো আছে। তুমি বাচ্চাদের জন্য পাগল। কিন্তু তুমি ওদের কাছে ওদের মা’কে ফিরিয়ে দাও, প্লিজ।
– বীথি.. কি বলছো তুমি!

প্রণয় অন্ধ, মোহও অন্ধ। মোহের অন্ধত্ব কেটে যায়, প্রণয়ের অন্ধত্ব সারাজীবনে কাটে না- এ কথা বীথির চেয়ে আর কে ভালো জানে, সে কাতর কণ্ঠে বলে,
– তুমি কি আমাকে ফিরিয়ে নিতে পারো না..

বাইরে বৃষ্টি বাড়ছে, বহুদিন পর এ শহরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। বহুদিন পর এ শহরে দু’জন মানুষ কানে ফোন চেপে চুপ করে আছে, ব্যক্তিগত বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে সংক্রামক দীর্ঘশ্বাস।

.
#গল্প
#গ্রন্থ_যোগি_সোসাইটি
সাঈদ ক’টা অণুগল্প লিখেছিল

4 thoughts on “দ্বিধা

  1. অভাবনীয় এবং অসাধারণ একটি লিখা উপহার। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. পরকিয়ার বিষ এভাবেই খুন করে একটি হাসিখুশি পরিবার।

    দারুণ লাগলো গল্পটি।

  3. অসাধারণ! অসাধারণ! অসাধারণ!”

    মন্তব্য করার জো নেই। শুভকামনা সারাক্ষণ।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।