ইচ্ছা

শৈশবে গাছ হওয়ার ইচ্ছা ছিল। রবী-ঠাকুরের বলাই পড়ে এমন বৃক্ষপ্রেম জেগেছিল যে মনে হত গাছ জীবনই সার্থক। আমাদের পাড়ার এক কোনে মন গাছ ছিল; প্রতিদিন তার নিচে বসে থাকতাম। তার সাথে আলাপ করার চেষ্টা করতাম; জানতে চাইতাম কিভাবে সে বৃক্ষ হল। তার কি কোন দুঃখ ছিল, কোন অপ্রাপ্তি থেকে কি সে বৃক্ষ হয়েছে। এ ব্যাপারে সে কিছুই বলতো না, ব্যক্তিগত প্রশ্নে সে নিশ্চুপ। তার কাছ থেকে স্পষ্ট কোন ধারণা না পেয়ে আমার গাছে রূপান্তর হল না। সে ভাসা ভাসা যা বলেছিল সেটা যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি, তার কথা হচ্ছে গাছে রূপান্তরের প্রাথমিক প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রচুর বসে থাকা, এবং বৃক্ষ সংগে থাকা। তার ছায়ায় যদি দিনে কয়েক ঘন্টা বসে থাকি তবেই ধীরে ধীরে শিকড় গজাবে। প্রথম প্রথম তার কথা সত্য মনে করে তাই করেছি, দিনের অধিকাংশ সময় মন বৃক্ষের নীচে বসে থেকেছি। কয়েক মাসেও যখন শিকড়ের কোন আলামত দেখা গেল না তখন সন্দেহ হল, এভাবে কি সত্যি বৃক্ষ হওয়া যায়। বুঝলাম মন আমাকে মিথ্যা বলছে, বসে থেকে শিকড় গজানোর সম্ভাবনা নেই। বুঝলাম মন আসলে নিঃসঙ্গ, সঙ্গের কাঙাল। আমার সঙ্গের লোভে মিথ্যা বুঝিয়েছে। ধীরে ধীরে বৃক্ষ প্রেম ফিকে হতে থাকল, তবু মনের মায়া ত্যাগ করতে পারলাম না। সময় পেলেই তার সাথে খাজুরে আলাপে মেতে উঠতাম।

কৈশোরে সহপাঠিনীর ওড়না হতে চাইতাম। লাজুক হিসাবে আমার খ্যাতি ছিল। তোৎলামি আমার স্বভাবে ছিল না কিন্তু কোন সহপাঠিনী দশ সেকেন্ডের কথাবার্তায় আমাকে তোৎলা ঠাওর করতো। সহজ প্রশ্নের সহজ উত্তর আমি দিতে পারতাম না, তাই কোন সহপাঠিনীর সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেনি। আমার কোন মেয়ে বন্ধু হবে না নিশ্চিত হলে আমি তাদের ওড়না হয়ে গলায় ঝুলে থাকতে চাইতাম।

যৌবনে পেয়ে বসেছিল পাহাড় প্রেম, দিগন্তে হারিয়ে যেতে ভাল লাগতো। আমাদের পাড়া থেকে নিকটবর্তী পাহাড় দুই মাইল দূরত্বে, প্রতিদিন একবার পাহাড় মাড়াতে না পারলে দিন পূর্ণাঙ্গ হত না। এখন ফিরে গেলে দেখি পাহাড় প্রেমের অন্য কারণ বিদ্যমান। পাহাড়ের পাদদেশে সাদামাটা এক কুঠির ছিল, কুঠিরে সাদামাটা এক তরুণী ছিল। কৈশোরের তোৎলামি অসুখ যখন ধীরে ধীরে সুস্থতায় রূপান্তরিত হচ্ছে তখন টিয়া রঙের এক তরুণী সামনে এসে হাজির। কলেজের কৃষ্ণচূড়ায় একঝাঁক টিয়া আস্তানা গেড়েছে; তাদের কিচিরমিচির, হট্টগোলের মাঝে টিয়া রঙের ওড়না মন কেড়ে নিল। পরবর্তী কালে কলেজের পাশের ক্যাফেতে পাশাপাশি চেয়ারে টিয়া রঙের উৎস জানতে চাইলে তরুণী আমাকে পাহাড়ের পাদদেশে আমন্ত্রণ জানায়। সেই থেকে আমার পাহাড় প্রেম।

সংসারে প্রবেশের মুখে নদী আমাকে মাতিয়ে রেখেছিল, স্ত্রীর নাম নদী তার শখ ছিল নদী ভ্রমণের। তাকে নিয়ে নৌকায় ঘুরে বেড়িয়েছি অনেক, নদী প্রেম এখনো আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। টিয়া রঙের উৎস শেষ পর্যন্ত জানতে পারনি। অন্য জেলার শালিক টিয়া কে উড়িয়ে নিয়ে গেছে, কিছুদিনের জন্য তোৎলামি ফিরে এসেছিল কিন্তু নদীসঙ্গে তা পুরোপুরি মিটে গেছে।

এখন আমার ইচ্ছা সমুদ্রে মিলানোর। আমি আর নদী হাত ধরাধরি করে ছুঁয়ে দিচ্ছি সাগরের জল। ঢেউ এসে টলোমলো পায়ের আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, আমি হাবুডুবু খাচ্ছি। নদী আমাকে টেনে তুলছে, মুমূর্ষু আমাকে দিচ্ছে সঞ্জীবনী চুম্বন।

1 thought on “ইচ্ছা

  1. জীবন অনুভূতির শব্দ সমাহার। শুভ কামনা প্রিয় কবি আবু মকসুদ ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।