হৃদয়ের পোস্টমর্টেম

‘আমার শরীরে ব্রিটেনের রক্ত’ এই কথা শুনে আতকে উঠেছে আমার প্রাণের বন্ধু। যদিও পরিষ্কার কিছু বলেনি তবু বোঝা যায় সে আমাকে লোভী ভাবছে। একটু আরাম-আয়েশ আর ক’টাকার লোভে নিজের শিকড়কে অস্বীকার করে আছি। তার ধারণা আমি আপাদমস্তক একজন লোভী তাই দেশ নিয়ে কোনো কথা আমার খাটে না। দেশ নিয়ে কোন মন্তব্য করা আমার সাজে না।

আমি লোভী অস্বীকার করছি না। একটু ভালো থাকা, ভালো খাওয়া, ভালো পরার লোভ আমাকে দেশান্তরি করেছে এটা অস্বীকার করছি না। কিন্তু এর বিপক্ষে বা পক্ষে আমি হাজারটা যুক্তি দিতে পারি কিন্তু সেসবে না গিয়ে শুধু বলব আমি দেশান্তরি হয়েও এক মুহূর্তের জন্য দেশ ত্যাগ করতে পারিনি। ৩৫ বছর ধরে দেশ থেকে দূরে আছি কিন্তু দেশ আমি থেকে দূরে নেই।

এখনো প্রতিটি সকাল আমি দোয়েলের ভোর দেখি, এখনো প্রতিটি দুপুরে ঘোর লাগা ঘুঘুর ডাক শুনি, এখনো প্রতিটি গোধূলি পশ্চিমের সূর্য হয়ে মনে ধরা দেয়, এখনো প্রতিটি রাত জোনাকির আলো হয়ে লেগে থাকে হাতের তালুতে।

আমি দেশ থেকে দেশান্তরি হয়েছি কিন্তু পালিয়ে আসিনি। দেশ থেকে পালানোর মতো কোনো কারণ ঘটেনি। স্বাভাবিক নিয়মে প্রবাসী হয়েছি কিন্তু আমার মন এখনো প্রবাসে অভ্যস্ত হতে পারেনি।

‘৩৫ বছর ধরে ব্রিটেনে আছি’ স্বাভাবিকভাবেই আমার রক্তে ব্রিটেন ঢুকে গেছে। আমি তাদের নুন খেয়েছি, তাদের ব্রেড, বাটারে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছি। আমি নিমকহারাম নই; আমার জীবনে তাদের অবদান কোনভাবেই অস্বীকার করব না। আমি তাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কুণ্ঠিত নই।

ব্রিটেন আমার রক্তে ঢুকে গেছে বলে বাংলাদেশ নিয়ে মন্তব্য করার কোন অধিকার রাখি না এটা খুবই বালখিল্য চিন্তা বলে আমার মনে হয়। আমি প্রত্যেক বছর কিংবা দু’বছর অন্তর একবার দেশে যাই, লক্ষ্য করেছি যারা ষাট, সত্তর, আশি বছর ধরে বাংলাদেশে আছে তাদের বুকে বাংলাদেশ নেই। তারা বাংলাদেশে থাকে ঠিকই কিন্তু বাংলাদেশ ধারণ করে না। আমি অনেক লোককে জানি যারা দেশের নুন খায় ঠিকই কিন্তু গুণ অন্য দেশের গায়। ১০০ বছর ধরে দেশে থেকেও দেশকে তারা আপন ভাবতে পারেনি।

‘আরাম আয়েসের লোভে দেশান্তরী হয়েছি’ এই বাক্য ১০০ ভাগ সত্য নয়। মানুষ কাজের জন্য, সুবিধার জন্য জায়গা বদল করে। আমিও কিছুটা ভালো সুযোগ সুবিধার জন্য জায়গা বদল করেছি।

দেশান্তর বা জায়গা বদল করলেই দেশের সাথে সম্পর্ক চুকেবুকে যায় না। বরং দেশ থেকে দূরে থাকলে দেশকে আরো গভীর ভাবে পাওয়া যায়, দেশকে আরো গভীরভাবে অনুভব করা যায়। প্রেমের মর্যাদা বিরহী প্রেমিক বুঝে। আমার কাছে দেশের কী মর্যাদা সেটা বুঝতে হলে হৃদয়ের পোস্টমর্টেম করতে হবে কিন্তু সে পোস্টমর্টেমেও দেশের প্রতি গাঢ় ভালোবাসা প্রকাশ পাবে কিনা সন্দেহ থেকে যায়।

ব্রিটেন আমার রক্তে এজন্য আমার বাঙ্গালীত্ব খারিজ হয়ে গেছে এটা সেই ভাবতে পারে যার দেশ প্রেম দোদুল্যমান, যে এখনো দেশ নিয়ে সন্দেহ মুক্ত নয়। যে বাংলাদেশের আলো বাতাসে শ্বাস নেয় কিন্তু অন্য দেশকে মনিব ভেবে সেজদা করে।

বন্ধুর মন্তব্য পড়ে আমার মনে হল সে আস্থাহীনতায় ভুগছে। দেশ নিয়ে সে সন্দেহ মুক্ত হতে পারছে না অথবা অন্য কোন দেশ তার মনে এমন ভাবে আসন গেড়েছে যে সবাইকে তার মত ভাবছে।

দেশ নিয়ে কিংবা দেশ প্রেম নিয়ে যার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ আছে সে হীনম্মন্য হতে বাধ্য, আমরা জানি হীনম্মন্যতা হচ্ছে মানসিক অসুস্থতা। আমার বন্ধুর সুস্থতা কামনা করছি…

1 thought on “হৃদয়ের পোস্টমর্টেম

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।