সঞ্জীবনী বুবাই এবং নিম গাছ

আমাদের বাসার সামনের দিকে এক চিলতে উঠান ছিল, এক চিলতেই। সেই উঠানে জাম গাছের পাশাপাশি নিম গাছ ছিল। জাম গাছের ব্যাস, ব্যাসার্ধে নিম গাছকে অন্ত্যজ মনে হত। আমাদের সবার দৃষ্টি জাম গাছের দিকে ছিল, অর্থাৎ জাম গাছ ঘিরে আমরা যেভাবে শোর তুলতাম সে তুলনায় নিম গাছের দিকে ফিরেও তাকাতাম না।

জাম মৌসুমি ফল, স্থায়িত্ব খুব বেশি নয়। তবু বৈশাখ এবং জ্যৈষ্ঠ মাস জামের মাস; জিহ্বা রঙিন করতে জামের কোন বিকল্প নেই। এই দুই মাস জাম গাছের তলায় উৎসব হত, আমাদের সেই এক চিলতে উঠান জাম কলরবে সরব হয়ে উঠতো।

পক্ষান্তরে পাশের নিম গাছ নিজের আভিজাত্যহীনতায় এই দুই মাস আরো কুঁকড়ে যেত। আমাদের জীবনে জামের প্রয়োজন থাকলেও নিমের প্রয়োজন তেমনভাবে কোনদিন অনুভব করিনি। নিম ঔষধি গাছ কিন্তু অসুখ হলে আমরা সোজা ডাক্তারের চেম্বারে দৌড় লাগাই, নিমের কোন চিন্তা মাথায় আসে না।

ছোটবেলা অসুখ-বিসুখ আমার লেগেই থাকতো, খোস পাঁচড়া, সর্দি কাশি নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল। আমি প্রায় সময়ই মাটিময় থাকতাম, অর্থাৎ মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খুব ভালো লাগতো। আম্মা কিংবা বড় আপা হয়তো আমাকে গোসল করিয়ে স্নো পাউডার মাখিয়ে বাবু সাজিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসিয়ে রেখে গেছেন। তারা ফিরে আসতে আসতে দেখা গেল আমি যুদ্ধ জয় করে বারান্দায় উঠে আসছি। আমার গায়ে এবং কাপড়ে কাদামাখা। গতকাল বৃষ্টির পরে উঠানে যে পানি জমেছিল এইমাত্র সেখান থেকে সাঁতরে এলাম।

আমাকে পুনরায় গোসল করানো অহেতুক ভেবে বড় আপা অথবা আম্মা টাওয়াল ভিজিয়ে গা মুছে দিতেন। আমি আমার জগতে খুব সুখী ছিলাম খোস পাঁচড়া, সর্দি কাশি তেমন কাহিল করতে পারত না। যদিও আমার নাসিকা অন্তহীন নদীর মত ছিল তবু যেকোনো জলাধার আমাকে আকর্ষণ করত, সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়তাম, সেটা উঠানের গর্ত হলেও।

একবার আমাকে বেশ বড়সড়ো অসুখে ধরলো, সারা গায়ে গুটি গুটি ফোড়া দেখা গেল। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার বলল পানি বসন্ত। বসন্ত যদিও আমার পছন্দের ঋতু ছিল কিন্তু এই বসন্ত কোনভাবেই পছন্দ হলো না। সারা গায়ে চুলকানি, দিনে দুই তিনবার জ্বর আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে ফেলল। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এই অসুখের কারণে আমি মাটি থেকে দূরে আছি, বাসার কেউ আমাকে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে দিচ্ছে না। আমি ডাকঘরের অমলের মত জানালায় বসে তৃষিত দৃষ্টিতে উঠানে চেয়ে থাকি যেখানে গতকালের বৃষ্টি এখনো জমে আছে।

পানি বসন্তের যত রকম ঔষধ তখনকার সময়ে উপলব্ধ ছিল সব ব্যবহার করে দেখা হয়ে গেছে, কাজে লাগছে না। এলোপ্যাথিক ছাড়াও হোমিওপাত, কবিরাজি প্রয়োগ করে দেখা হচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না। আমাদের বাসায় আম্মার যে সহকারি ছিলেন আমরা সবাই থাকি ‘বুবাই’ বলে ডাকতাম। ‘বুবাই’ অর্থ বড় বোন। আমার জন্মের পরে আম্মা কিছুদিন সুতিকা রোগে ভুগেছিলেন। তখন আমাকে রক্ষণাবেক্ষণ, লালন পালন করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন এই ‘বুবাই’।

আমার অসুখে পুনরায় ক্রাতা হয়ে এলেন এই ‘বুবাই’। তিনি আম্মাকে বনজ সমাধান বাতলে দিলেন। তখনই নিম গাছের প্রয়োজন পড়লো। যে নিমগাছ বছরের পর বছর অবহেলিত ছিল, সেই নিম গাছ আমাকে রক্ষা করতে এগিয়ে এলো। গরম পানিতে নিম পাতা ভিজিয়ে রেখে সেই রস হালকা প্রলেপে সারা গায়ে মাখিয়ে নিলে পানি বসন্ত উপশম হয়। অন্তত আমার জন্য এই টোটকা খুবই কার্যকরী ছিল।

আমার মারাত্মক রকম পানি বসন্ত হয়েছিল, সারা গায়ে চামড়া দেখা যেত না এমন। আমার এই অসুখে আব্বা, আম্মার চোখে মুখে দুশ্চিন্তার রেখা দেখা দিয়েছিল। আমি হাত পা নাড়ছি, কাপড়ে কাদামাটি মাখছি অর্থাৎ বাসা জেগে আছে, আমি মনমরা হয়ে বসে আছি অর্থ বাসা বড় কোন বিপদে পড়েছে। আব্বা, আম্মা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছিলেন বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে।

‘বুবাই’ এবং নিমের বদান্যতায় বড় বিপদ থেকে রক্ষা পেলাম। যে নিম গাছের প্রতি আমাদের অবহেলার শেষ ছিল না সেই নিম গাছ আমাদের প্রার্থনা পেতে থাকলো বিশেষ করে আব্বা, আম্মার।

আমরা এখন নিয়মিত নিমের পরিচর্যা করি, আগাছা উপড়ে ফেলি, পানি ঢালি। নিম গাছ দীর্ঘদিন আমাদের এক চিলতে উঠানের গৌরব ছিল। তাকে আমরা প্রচুর কাজে লাগিয়েছি। খোস পাঁচড়া, পেটের পীড়া, ত্বকের নানায় সমস্যার তার স্মরণাপন্ন হয়েছি সে সাধ্যমত উপশম দিয়েছে। কালের পরিক্রমায় সেও একদিন চলে যায়, জাম গাছ আগেই গিয়েছিল। সেই এক চিলতে উঠান আর নেই, ইটের দালান তার দাপট দেখিয়ে জাম নিমকে সাবার করেছে।

পরবর্তীতে আমার আর পানি বসন্ত হয়নি। অনেকদিন পরে আমার ছেলের যখন পানি বসন্ত হল দেখলাম সেও আমার মত ছটফট করছে। ডাক্তারের পরামর্শে ক্যালামাইন লাগিয়েও যখন উপশম হচ্ছে না তখন ইচ্ছে করলো উড়াল দেই পেড়ে আনি কিছু নিমপাতা। কিন্তু চাইলেই উড়াল দেওয়া যায় না, নিম গাছও আর অপেক্ষায় বসে নেই…

1 thought on “সঞ্জীবনী বুবাই এবং নিম গাছ

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।