অণুগল্প : পোষাকি মানুষ

যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। নদীর কূল-কিনারা নাই। দূরে কয়েকটা মাছ ধরার নৌকা। ঢেউয়ের তালে তালে ওঠা-নামা করছে। দিগন্তের যেখানে আকাশ মিশে আছে মনে হচ্ছে, পাশাপাশি দু’টি লবণের কার্গো সেদিক দিয়েই অজানার দিকে এগিয়ে চলেছে। ওদের ঝাপসা অবয়ব ছাপিয়েও কালো রঙ রোদ্রে এতদূর থেকেও চকচক করছে সেকান্দার মাঝির চোখে। বিশাল লঞ্চের ডেকে বসে বসে সে এসব-ই দেখছে। কিন্তু আসলে-ই কি দেখছে? মন তার অন্য কোথাও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মাকড়শার জালে জড়ানো এক বিচ্ছিন্ন প্রদেশ যেন! নিজের ভেতরে থেকেও নিজের নয়।
.
পানি কেটে এগিয়ে চলেছে লঞ্চ। এক দ্বীপ জেলার দিকে। শক্তিশালী ইঞ্জিনের কারণে ডেকেও মৃদু কাঁপন হচ্ছে। কাঁপন সেকান্দারের ভেতরেও। অনুভূতির ভাঙ্গাচুরা.. তিরতির কাঁপনে ঢেউয়ের লঞ্চের স্টিল বডিতে এসে ভেঙ্গে পড়ে ফেনায় পরিণত হওয়া ডেকে বসে যদিও সে দেখতে পারছে না। তবে শুভ্র ফেনা সময়ের ফেলে যাওয়া শ্যাওলার মত পেছনে পড়ে আবারো যেভাবে পানিতে মিশে যায়, মানুষের আশাগুলোও যদি এভাবেই নিরাশার বুক থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে আবারও আশায় পরিণত হতে পারত, বড্ড ভাল হতো। কিন্তু নিরাশার সম্পর্ক ছিন্ন করাটা এতটা সহজ নয়।
.
পাশের যুবকদের কলরবে চিন্তার জাল ছিন্ন হয় সেকান্দারের। একদল যুবক। এরাও রাজধানী থেকে দেশে ফিরছে। মাটির কোলে। প্রাণের টানে। যাত্রাপথের নিরবচ্ছিন্ন অলস সময়কে কাটাতে এরা তাস খেলছে। ওরা বলে ‘ম্যারিজ খেলা’। শহরে এটাকে বলে ‘টুয়েন্টি নাইন’। ওদের দিকে তাকিয়ে সেকান্দার মাঝি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে।
বসা থেকে উঠে শুয়ে-বসা যাত্রীদেরকে সন্তর্পণে ডিঙ্গিয়ে রেলিঙয়ের কাছে যায়। জোর বাতাস স্বস্তির অনুভব এনে দিতে গিয়েও কেন জানি ব্যর্থ হয়। পানিতে ট্রেইল রেখে সামনে এগিয়ে যাওয়া বাহনটির এক ক্ষুদ্র যাত্রী কয়েক ঘন্টা আগের ট্রেইলে ফিরে যায়… …
… …

এম.পি হোস্টেল। সেকান্দার মাঝিকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখা হল। এরপর ভেতরে যাবার অনুমতি মিলে। প্রিয় অতিপরিচিত মানুষটির সামনে যেতেই এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে যায়। এই মানুষটি তাদের উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন। এলাকার সবাই তাকে সেই অনেক আগে থেকে-ই সমর্থন দিয়ে আসছে। সবার সহযোগিতায় এবং একমাত্র প্রার্থী হবার কারণে যেভাবে-ই হোক তিনি সংসদ সদস্য হয়েছেন। তবে কোনভাবে তিনি হয়েছেন, সেটা এলাকার মানুষের কাছে মূখ্য ব্যাপার নয়। তাদের প্রিয় মানুষটি অনেক উপরে উঠেছেন, এতেই তারা খুশী। নিজেদের ছোটখাট আশার বাস্তবায়নের সুপ্ত ইচ্ছে সবার হৃদয়ে বসে গেছে ইতোমধ্যে।
.

সেকান্দার মাঝি সাগরে মাছ ধরে। নিজের ট্রলার নাই। দাদন নিয়ে মাছ ধরা অন্যের নৌকার মাঝি সে। তাদের পূর্বসুরীরাও এই কাজে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার উত্তরসূরীরা ও সেভাবে করবে। এই দ্বীপ জেলার সাধারণ মানুষদের জীবনের নৌকা এভাবেই চলে এসেছে। সামনেও এভাবেই চলত। কিন্তু বাঁধ সাধলেন জনপ্রিয় এই মানুষটি। সাধারণ মানুষদের গতানুগতিক জীবনের প্রবাহকে পালটে দিতে চাইলেন। একদিন এলাকার জনসভায় বললেন যে, তাদের জীবন যেভাবে-ই হোক এই পর্যন্ত এভাবে এসেছে। কিন্তু তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে যেন এমন নিরক্ষর লোনাজলে সংগ্রামী জীবনে অভ্যস্ত হতে না হয়। তাই তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার প্রতি নজর দিতে বললেন। সেকান্দার মাঝির এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ওর জীবনের চাওয়াটা এমন ছিল- ছেলে বড় হয়ে তার থেকেও আরো দক্ষ মাঝি হবে। একসময় নিজের ট্রলার হবে। ১৬ ইঞ্জিন থেকে ৩৬.. এরপর ৭৬ এভাবেই ধীরে ধীরে প্রাচুর্য্য সেকান্দার মাঝিকে ঘিরে থাকবে। স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে কার না মন চায়?
.

কিন্তু নেতার কথা শুনে মনকে প্রবোধ দিয়ে আশার গতিকে অন্য দিকে ডাইভার্ট করে সেকান্দার মাঝি। কষ্ট করে ছেলেকে এস.এস.সি পাস করায়। ছেলের এইচ.এস.সি’র রেজাল্ট বের হতেই নেতা উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে সরাসরি সংসদ সদস্যে পরিণত হন। তখন একদিন সে মাননীয়’র কাছে নিজের এইচ.এস.সি পাস ছেলের চাকরির জন্য অনুরোধ করে। হেসে নেতা জানান, ‘এইটুকু পড়ালেখায় আর কি চাকরি করবে ও। বরং ডিগ্রিটা শেষ করিয়ে আমার কাছে আসিস।‘
.

তখন সেকান্দার মাঝির শরীরের অবস্থাও অনেক ভেঙ্গে পড়েছে। সাগরে যেতে আর আগের মত মন টানে না। তবে বেঁচে থাকতে হলে কাজ তো করতে-ই হবে। এবারে ধার-কর্জ করে ছেলেকে বি.এ পাস করাতে আবারো আশায় বুক বাঁধে। নদীর বুকে অনেক জোয়ার-ভাটা হয়। চাঁদ ডুবে। সুর্য্য ওঠে। একসময় ছেলে পাসও করে। ভাঙ্গা শরীর আরো ভেঙ্গে গেলেও মনটা ইস্পাতের মত তখনো দৃঢ়-ই ছিল সেকান্দার মাঝির।
.

শেষবার যখন নেতার বাসা থেকে ফিরে আসে, মনটা আক্ষরিক অর্থেই ভেঙ্গে যায় তার। বছরের পর বছর একটা আশাকে বুকে লালন করে বেঁচে থাকা একজন সাধারণ মানুষ, যখন স্বপ্ন পূরণের শেষ ধাপে এসে পৌঁছায়-হঠাৎ করে সেই স্বপ্ন ধুলায় মিশে যায় তবে একজন মানুষের আর থাকেটা কি?
.
নিজের ছেলের ব্যাপারে নেতার কাছে কৃত ওয়াদা পূরণের ব্যাপারে বলতেই, নেতা অনেকক্ষণ চুপ থেকে যা বলেন-তাতে সেকান্দার মাঝির নিষ্প্রাণ চোখের ভেতরের আলো একেবারে মিইয়ে যায়।
‘দ্যাখ ভাইগ্না, চাকরি ছেলের হাতের মোয়া না যে চাইলে-ই পাওয়া যায়। কত বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে ছেলেরা রাস্তায় ঘুরতাছে, খবর রাখিস কিছু? আর আমি এতটা উপরে উঠি নাই যে আমার সুপারিশে কারো চাকরি হবে। এখন চাকরি সোনার হরিণ। লাখ লাখ টাকা নিয়েও সুপারিশের অভাবে চাকরি হচ্ছে না এমন মানুষ দেখেছি আমি।‘

একটা ধাক্কা খায় সেকান্দার। হৃদয়ের হার্টবিট অনিয়মিত হয়। কিন্তু মুখে হাসি নিয়ে সে নেতার উদ্দেশ্যে বলে,
– মামু, আমরা তোমারে চিনি। তোমার আশায়-ই তো পোলারে বাপ-দাদার কামে না দিয়া লেহাপড়া শিখাইছি। অহন যদি এই কথা কও, ক্যামনে কি? আমি তো চোক্ষে আন্ধার দেখতাছি…।
‘অপেক্ষা কর আরো। দেখি কি করা যায়। তবে এলাকায়-ই দেখ কিছু করা যায় কিনা। আর আমি এদিকেও দেখছি।‘
– এলাকায় কিছুই করার নাই মামু। পোলাডারে দিয়া অহন মাছ ধরার কামও করান যাবে না। শেখছে কিছু? পড়ালেহা ছাড়া আর কিছু-ই তো শিখাই নাই তোমার কতায়।
.

দু’জন মানুষ একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘক্ষণ। একজনের চোখে বিরক্তি এবং পাশ কাটানো মনোভাব। অন্যজনের চোখে আশাভঙ্গের তীব্র বেদনা। মুহুর্তগুলো কেমন বৈরী বাতাসে পাক খেতে থাকে এম.পি হোস্টেলের এক নিরব কক্ষে। উঠে যাবার আগে সেকান্দার মাঝি আবেগহীন গলায় জানায়,
– মামু, তুমি আর সেই আগের মানুষ নাই। তোমার শইলের এই নতুন পোষাকে তোমারে চেনবার পারতাছি না.. তোমারে অচেনা লাগতাছে। তোমরা এমন হইয়া যাও ক্যান?
… …

সামনে অগাধ জলরাশি। মোচার খোলের মত দুলছে লঞ্চ। তীরের কোনো দেখা নাই। অথৈ পানিতে অসহায়ত্ব মিশে থাকে যেন। সাগরের একজন দক্ষ সেকান্দার মাঝিও এই মুহুর্তে সামান্য নদীর জলের প্রবল তোড়ে খড়-কুটোর মত ভেসে বেড়ায়.. চেনা পথ বড্ড অচেনা লাগে ওর কাছে.. তীরহারা এক ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিতে হবে, তবে দিক জানা নেই ওর।
.. .. ..

একটু পরেই তিনি বের হবেন। প্রধানমন্ত্রীর জনসভা। সেখানে যেতে হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেন একপলক। সাধারণ পোষাকের ওপরের এই বিশেষ পোষাকে নিজেকে অন্যরকম লাগছে। ঠিক তখুনি ঘন্টা কয়েক আগের সেকান্দারের বলা কথাগুলো মনে পড়ে, ‘মামু, তুমি আর সেই আগের মানুষ নাই। তোমার শইলের এই নতুন পোষাকে তোমারে চেনবার পারতাছি না.. তোমারে অচেনা লাগতাছে। তোমরা এমন হইয়া যাও ক্যান?’
.

হ্যা! কেন জানি পোষাকি মানুষটা নিজের ভেতরের মানুষটার থেকে ভিন্নতর হয়ে যায়। চেনা-অচেনার মাঝে ঘুরপাক খায় মানবস্বত্বা। একসময় মানুষটা হারিয়ে যায়। থেকে যায় কেবলি খোলস। যাকে ঢেকে রাখে পোষাক।
.
‘অনেক কিছু-ই এই পোষাকের আড়ালে থেকে আমাদের দ্বারা করা সম্ভব হয় না। কাছের মানুষ সবাই ভাবে, আমরা ইচ্ছে করলেই করতে পারি, কিন্তু করছি না।‘

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ান। সামনে এগিয়ে যান দৃঢ় পদে। পোষাকি মানবেরা একবার ঘুরে দাঁড়ালে আর পিছু ফিরতে চান না।।

________________________

#পোষাকি_মানুষ_অণুগল্প_৪৩৪

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

8 thoughts on “অণুগল্প : পোষাকি মানুষ

  1. অণুগল্পের মূল চরিত্র সেকান্দার মাঝি এবং সংসদ সদস্য। দুটো ক্যারেক্টারেরই সার্থক চিত্রায়ণ। শুভেচ্ছায় শুভ সন্ধ্যা মি. মামুন।

    1. ধন্যবাদ ভাইয়া।

      এই দুটি চরিত্রই আমার খুব কাছের দু'জন মানুষের। দু'জনেই সম্পর্কে মামা আমার। তাই এদেরকে খুব গভীরভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। বাস্তবতাটুকু অনুভবে আসায় না লিখে পারিনি।

       

      শুচেচ্ছা…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  2. অপুর্ব লিখেছেন প্রিয় মামুন ভাই। টাকার ওজন আর ক্ষমতার ওজন সবাই সইতে পারে না। যারা মানুষ তারা সইতে পারে আর যারা অবিকল মানুষের মতো দেখতে তারা সইতে পারে না। আপনার অণুগল্পটি শিক্ষা মূলক বটে। শুভেচ্ছা ও শুভকামনা নিরন্তর!!!!

    1. সহমত ভাই ইলহাম আপনার সাথে।

      ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।

      সংসদ সদস্যের যতদিন না শিক্ষাটা আসবে নিজের 'না পরিবর্তন' হবার বিষয়ে, ততদিনই সেকান্দার মাঝিদের হাহাকার থেকে যাবে।

      ভালো থাকুন সব সময় ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  3. দূর্দান্ত অণুগল্প। শুভেচ্ছা নিন গল্প দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    1. ধন্যবাদ প্রিয় দিদি।

      আপনার জন্যও নিরন্তর শুভ কামনা রইলো। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  4. নদী জীবনের নিদারুণ দৃশ্যপট গদ্যগল্পে। সেকান্দার মাঝি-কে নিয়ে দারুণ একেছেন আপনার অণুগল্পে। অবিরাম ভালবাসা আপনার ধারাবাহিকতায়।

    1. আপনাকেও ধন্যবাদ ভাই সাথে থাকার জন্য। 

      শুভেচ্ছা রইলো… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।