বিআরটিসি বাস। দু’টি বাস মাঝখানে জোড়া লেগে আছে ট্রেনের দুই বগির মতো। ঢাকার দিকে চলছে। সকাল দশটা। যাত্রীদের তেমন ভিড় নেই। যাত্রীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে।
দু’জন মহিলা যাত্রী পরবর্তী স্টপেজ থেকে উঠলেন। ভার্সিটি স্টুডেন্ট। খালি দেখে পাশাপাশি দুই সিটে বসেন তাঁরা। একই সময়ে একজন ভ্রাম্যমান হকার বাসে ওঠে। পাথর বিক্রি করে। এই রুটে প্রায়ই তাকে দেখা যায়। সে নিজের পসরা হাতে নিয়ে গুনাগুণ বর্ণনার কাজে লেগে গেলো। অলস যাত্রীরা যার যার চিন্তায় মগ্ন থেকেও বাধ্য হয়ে হকারের পাথরের গুনাগুণ কিছু কিছু শুনতে থাকে। দু’একজন হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। এমন একজনের হাতে দিয়ে হকার বেশ জোর গলাতেই জানায়,
– ভাই, পাথরে ভাগ্য ফিরে। বিশ্বাস না হলে একবার পরখ করে দেখুন।
তাঁর এই কথায় আর থাকতে না পেরে এক মধ্যবয়সী ততোধিক জোর গলায় জানান,
– এই ব্যাটা, এই সব আউল ফাউল কথা কেন বলছিস? পাথরে কি ভাগ্য ফেরে বল আমাকে?
হকার বিব্রত হয় না। ওর বহুদিনের অনুশীলনকৃত মুখের হাসি একটুও ম্লান হয় না। সে বক্তার সামনে যেয়ে নরম সুরে উত্তর দেয়,
– মামা, আপনি কি কখনো ইউজ করেছেন? একবার ইউজ করে দেখেন। খোদার কসম, অবশ্যই ভাগ্য ফিরবে।
ওর কথা শুনে উচ্চস্বরে হেসে উঠেন মধ্যবয়সী যাত্রী। তিনি আশেপাশে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা যাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বলেন,
– শুনুন ভাইয়েরা, এই পাথর বিক্রেতা আমাকে বলছে পাথরে অবশ্যই ভাগ্য ফিরে। আমাকে বলুন, যদি ভাগ্য ফিরবেই, তবে এতগুলো পাথরের মালিক হয়ে সে কেনো এই বাসে বাসে হকারি করছে? ওর তো কোটিপতি হয়ে যাবার কথা!
তাঁর কথায় বাসের ভিতরে মৃদু শোরগোল ওঠে। মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানায় কয়েকজন। এক যুবক তো টিটকারি মেরে জানায়,
– আংকেল, যে বিক্রী করে তাঁর বোধহয় ভাগ্য ফেরার নিয়ম নাই। কি মামা (হকারের দিকে তাকিয়ে), এটাই তো?
হকার আর কথা বলে না। যে যে যাত্রীর কাছে দেখবার জন্য সে পাথর দিয়েছিলো, সেগুলি সংগ্রহ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। মধ্যবয়স্ককে বোধহয় গল্পে পেয়েছিলো। তাই তিনি থামেন না। বলে যান,
– আমার এক বন্ধু গেলো সৌদি আরবে। হজ্জ করতে। যাবার আগে এলো আমার কাছে। জানতে চাইলো আমার জন্য কি আনবে। বললাম আমার নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) লাল আকিক পরতেন। তো সুন্নত হিসেবে আমি পরতে চাই। আমার জন্য একটা রক্ত আকিক এবং একটা টাইগার পাথর মদিনা শরীফের মার্কেট থেকে নিয়ে এসো পারলে।
এ পর্যন্ত বলে তিনি একটু থামলে ওনার পাশের যুবক ফস করে জানতে চায়,
– তারপর? তিনি কি পাথর আনলেন?
যুবকের দিকে একপলক তাকান মধ্যবয়স্ক। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে উত্তর দেন,
– হ্যা ভাই। এনেছিলো সে। তবে না আনলেই বোধহয় ভালো ছিলো?
– কেনো? এ কথা বলছেন কেনো?
– পাথর হাতে পাবার একদিন পরে এক ভরি রুপা দিয়ে বানিয়ে দুই আঙ্গুলে পরলাম। তৃতীয় দিনে আমার চাকরিটাই চলে গেলো!
– বাহ! চমৎকার ভাগ্য ফিরলো আপনার।
সবাই হাসলেও কোথায় যেনো একটা বিষাদের সুর বেজে রইলো। কেউ কেউ অনুভব করে মনের ভিতরেই ম্রিয়মান হয়ে রইলো। আর এসবের ফাঁকতালে সেই হকার কখন যেনো বাস থেকে নেমে গেছে, টের পায় না কেউ।
সদ্য কিশোরী পর্যায় পার হয়েছে, এমন একজন আধুনিকা সদ্য যুবতীকে নিয়ে এক যুবক উঠলো। দুই ভার্সিটি স্টুডেন্টের সিটের সামনে সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে পড়লো। যুবকটি পিছনের একটি সিটে আগেই বসে পড়েছে। মেয়েটিকে সে ডাকতেই কেমন যেন আহ্লাদী স্বরে মেয়েটি ওখানে দাঁড়িয়েই ঢং করতে লাগলো। সেগুলি দেখে ভার্সিটি স্টুডেন্ট মেয়ে দু’টির পিছনে বসা দুই যুবকের একজন অল্প আওয়াজে বলে উঠলো,
– মাগী।
তবে ভার্সিটি স্টুডেন্ট মেয়ে দু’জনের একজন শুনে ফেলে শব্দটি। সে পিছু তাকিয়ে বক্তা যুবককে দেখে। আবার মুখ ফিরিয়ে নিতে নিতে মেয়েটি ভাবে, ‘এরাই শিক্ষিত সমাজের অংশ। অথচ এদের মনের ভিতরে কতটা কদর্যতা লুকিয়ে আছে। এরা আসলে খোলসধারী। মাকাল ফল। সার্টিফিকেটের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া এদের দ্বারা এই সমাজের কিছুই হয় না। এরাই আবার যার যার পরিবারের কর্তা হয়। সেই পরিবারের নারীরা কি এদের সাথে বাস করে কখনো নিরাপদ অনুভব করবে?’
একজন নারী আরেক নারীর প্রতি তীর্যক মন্তব্যে কষ্ট পেতে থাকে। কিন্তু এই পুরুষপ্রধান সমাজে (যদিও নেতৃত্বে এখন নারী} কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কি-ই বা করার আছে তাদের?
________________________
#একদিন_বিআরটিসি_বাসে_অণুগল্প
উঠে যাবার আগে আগে আপনার অনুগল্পটি পেয়ে গেলাম মহ. আল মামুন ভাই। কিছু বলার নাই। অহর্নিশ এমন দৃশ্যের দেখা পথে ঘাটে পাই। কে যে সুস্থ্য আর আমরা কারা অসুস্থ্য পাশে বসে থেকেও বুঝে উঠতে পারি না।
সহমত আপনার সাথে প্রিয় কবিদা'। আমাদের মানষিকতার অবক্ষয় ছাড়া আর কিছু নয়। শুভেচ্ছা রইলো…

‘এরাই শিক্ষিত সমাজের অংশ। অথচ এদের মনের ভিতরে কতটা কদর্যতা লুকিয়ে আছে। এরা আসলে খোলসধারী। মাকাল ফল। সার্টিফিকেটের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া এদের দ্বারা এই সমাজের কিছুই হয় না। এরাই আবার যার যার পরিবারের কর্তা হয়। সেই পরিবারের নারীরা কি এদের সাথে বাস করে কখনো নিরাপদ অনুভব করবে?’
…. বাস্তবতা।
ধন্যবাদ ভাই সহমত পোষণের জন্য। পারিবারিক গন্ডিতেই আসল শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা উচিত অভিভাবকদের। তাহলেই যদি কিছু পরিবর্তনসম্ভব হয়।
শুভেচ্ছা এবং অনেক ভালোবাসা আপনার জন্য।
কোলকাতার বাস ট্রাম কোখায় এমন নেই সেটাই জানি না। এরই মাঝে আমাদের জীবন।
জি দিদি, এর ভিতরেই আমাদের নারীদের জীবন বয়ে চলে। খুবই দুঃখজনক। এর পরিবর্তন হওয়া দরকার। শুভেচ্ছা রইলো।
