আবৃত্তি_মামুনের_ছোটগল্প

যারা ভালোবাসার গল্প পছন্দ করেন, অনেক আগে লেখা আমার নিচের ছোটগল্পটি সময় থাকলে পড়তে পারেন…

জীবনের এক বিষম সময়ে পারুর সাথে আমার পরিচয়। বেঁচে থাকার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। জীবন এক দুর্বিসহ দূর্ণিবার রুপে আমার সামনে উপস্থিত। শব্দে সেই রুপ আমি ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। এমনই সময় ছিলো তখন।

টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস ছিলো। এভাবে লিখতে গিয়ে লেখকদের এক গ্রুপের সদস্য হয়েছিলাম। আড্ডাবাজি আর লেখালেখির সমালোচনামূখর সময় কাটতো ওখানে। অনেকেই আসতো। সবার সাথে সেভাবে পরিচয় না হলেও, অনেককে মুখ চেনা চিনতাম। তাদের ভিতরে পারুও ছিলো!

তখনো মুঠোফোন যন্ত্রটি এদেশে আসে নাই। অ্যানালগ টেলিফোন দূরালাপনী যন্ত্র হিসেবে একমাত্র বিলাসিতা কিছু কিছু অবস্থাপন্ন মানুষের ঘরে। আমি যে মেসে থাকতাম, সেখানে এই যন্ত্রটি ছিলো। মেস ম্যানেজারের কৃপা দৃষ্টি ছিলো আমার প্রতি। কেন তা জানি না। কখনো জানতেও চেষ্টা করিনি আমি।

একদিন রাতে- ভয়াবহ ঝড়-বৃষ্টির রাত ছিলো সেটা। বিদ্যুত ছিলো না। তখন হারিকেনের অস্পষ্ট আলোয় মেসরুমগুলির বাসিন্দারা নিজেদের যৎসামান্য কাজ চালাতো। আর মোমবাতির অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল আলোর ব্যবহার আমাদের কাছে ছিলো বিলাসিতা। যাইহোক, মেস ম্যানেজার সেই রাতে আমাকে নিচে তলব করলেন। গেলাম।

কালো টেলিফোনের রিসিভারটি অবহেলায় ওনার সামনের নড়বড়ে চারপায়ার ওপরে পড়ে আছে। দাঁত খিলাল করতে করতে সেটার দিকে বাম হাতের অঙ্গুলি হেলন করে আমাকে বললেন,
– তোমার ফোন।

অবাক হলাম। কারণ এই শহরে আমাকে ফোন করার মতো কেউ থাকতে পারে, আমার কল্পনায়ও ছিলো না। বিস্ময়াভিভূত হৃদয়ে রিসিভার কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ঝড়-বৃষ্টির কোলাহলকে ছাপিয়ে মিষ্টি একটা কন্ঠ আমার কানে মধু ঢেলে দিলো!

টেলিফোনের ওপাশের মানূষটির সাথে আলাপ শুরু করতে প্রথমেই নাকি ‘হ্যালো’ বলতে হয়। আমিও ঐ বিজাতীয় শব্দটা উচ্চারণ করলাম। ওপাশ থেকে জলতরঙ্গের মতো দু’টি শব্দ আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছেন?

সেই-ই পারুর সাথে আমার প্রথম আলাপ। বিনা তারে এক অদৃশ্য সংযোগের সেই-ই প্রথম সূত্রপাত।

পারু যে ওর নাম সেটা কীভাবে জানলাম? সে-ই বলেছিলো আমায়। এরপর অনেক জল গড়ালো আমার সেই মফঃস্বল শহরটিকে ঘিরে বয়ে চলা একমাত্র নদীটির বুকের ওপর দিয়ে। দিনের পর দিন, অনেকগুলি রাত আমাকে মেস ম্যানেজার ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তার বিরক্তিভরা ভ্রুকুঠি অগ্রাহ্য করার মত মানসিক শক্তি আমাকে দিয়েছিলো, কালো রিসিভারের ওপাশের পারু নামের অচেনা একটি মেয়ে। নারী বললাম না; কারণ মেয়ে শব্দটি আমার কাছে খুব ভালো লাগতো। নারী বললে এক পূর্ণ যৌবনা সম্পন্ন কাউকে মনে হতো আমার সবসময়।

তবে পারু টেলিফোনে কথা বললেও কখনো ওর আসল পরিচয় তখনো আমাকে জানায় নাই। আমার লেখা কবিতা ওর নাকি খুব ভালো লাগতো! সে আমাকে টেলিফোনে দু’একটা আবৃত্তি করেও শুনিয়েছিলো।

এরপর ওর লেখা চিঠি আমার মেসের ঠিকানায় আসা শুরু হলো। অসাধারণ হস্তাক্ষর! চিঠিগুলির কাগজে কেমন ভালোবাসার ঘ্রাণ জড়িয়ে ছিলো! হাসছেন? হাসুন। ভালোবাসারও নির্দিষ্ট ঘ্রাণ আছে। আপনারা যারা কখনো ভালোবেসেছেন, সহজেই অনুভব করতে পারছেন আমার সেই ঘ্রাণের অনুভূতিটুকু।

আমিও নতুন উদ্যমে পারুকে নিয়ে অনেক অনেক কবিতা লেখা শুরু করলাম। একটা কবিতার কয়েকটা লাইন শুনতে চান? শুনুন তবে,

“প্রিয়দর্শিণী পারু! তুই কেমন আছিস?
তোর বুকের ওম মাখা প্রহরগুলি
এখন আমার শীতল ঘরের ফায়ারপ্লেস!
সেখানে আমি ইচ্ছেমতো পুড়ি-শীতল হই…
তুই কি বুঝিস?”

প্রথম প্রেমের পাগলাটে কিছু অনুভব! তবে আমার মনে ঐ সময় একটাই ইচ্ছে ছিলো। আমার শহরকে আগলে রাখা সেই ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে, এক তারা জ্বলা রাতে, ঘাসের বুকে পাশাপাশি বসে , পারুকে নিয়ে আমার লেখা কবিতা ওর নিজের মুখে আবৃত্তি শোনার!
সেই কথাটি পারুকে লিখে জানালাম। ওর সাথে দেখা করার সেই মাহেন্দ্রক্ষণটির অপেক্ষায় ওর দেবদাস অধীর ভাবে অপেক্ষমাণ। চিঠি চালাচালির সেই সময়ে টেলিফোনে কথা বলাটা কমে গেছিলো। কারণ আমাদের দু”জনের এমন অনেক কথা ছিলো, যেগুলি আমাকে পছন্দ করা সেই মেস ম্যানেজারের সামনেও বলা যেতো না! এমনই সব কথাবার্তা। বুঝতেই পারছেন?

একদিন চিঠিতে পারু জানালো, সে দেখা করবে! সেই অনুভূতি শব্দে কীভাবে প্রকাশ করি বলুন তো? ইঁদুরের শরীরের গন্ধে ভরপুর আমার মেস রুমকে মনে হচ্ছিলো জান্নাতুল ফেরদৌসের সবুজ গালিচাময় স্থান! আমি ভেসে যাচ্ছিলাম… কি করবো,কখন সন্ধ্যা হবে সেই অপেক্ষায় সময়ই যেন কাটছিলো না।

হ্যাঁ! ঠিকই ধরেছেন। আগেই বলেছিলাম, নদীর তীরের সবুজ ঘাসের বুকে পাশাপাশি বসে ওর আবৃত্তি শুনবো।

নির্দিষ্ট সময়ে আমি নির্দিষ্ট স্থানটিতে পৌছালাম। ওখানে আগেই পারু বসে আছে দেখলাম দূর থেকে। কম্পিত হৃদয়ে গুটি গুটি পায়ে ওর সামনে হাজির হলাম। প্রথম প্রেমের প্রথম অভিসার! আমার পারু চুপচাপ বসে আছে। আকাশের তারাগুলির ধার করা আলোয় চারপাশটা দেখার মতো উজ্জ্বলতায় ভরপুর ছিলো। আমি পারুর পাশে বসলাম। ওর শরীর ছাপিয়ে কি এক অজানা সুগন্ধি আমায় গ্রাস করে চলেছিলো। আমি ডুবে যাচ্ছিলাম… ক্রমশঃ এক বিহ্বলতার গভীর থেকে আরো গভীরতর প্রদেশে প্রবেশ করছিলাম! একি ভালো লাগা! একি ভালোবাসা! এমনই অ-অনুভবেয় এক অনুভূতি আমায় গ্রাস করে চলেছিলো।

আমি পারুকে নিয়ে লেখা আমার সেই ঐতিহাসিক কবিতাটি নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা পারুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
– চোখ তোলো! চেয়ে দেখো আমায়।

পারু তাকালো আমার দিকে! নিঃশ্বাস রুদ্ধ এক মুহুর্তে আমার ভিতরের অন্তর্চক্ষু দিয়ে আমি ওর চোখের আলোয় জ্বলে উঠলাম। বললাম,
– নাও, আবৃত্তি করো।

মুহুর্তে দু’টি কম্পমান ঠোঁটের মৃদু নড়াচড়ার সাথে তারা জ্বলা আকাশ থেকে বর্ষণ শুরু হলো। আমার দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকা দু’টি নীল চোখ মুহুর্তে রঙ পালটে কালো হয়ে গেলো দেখলাম। সেখান থেকে বারিধারা টুপ টুপ করে পড়ছে। অবাক বিস্ময়ে আমি কম্পমান পারুর হাত থেকে এক টুকরো কাগজ নিলাম। গুটি গুটি অক্ষরের আমাকে লেখা পারুর শেষ চিঠিতে ছিলো,

– টেলিফোনে তোমার সাথে আমার বান্ধবী কথা বলেছে। আমিই তোমার আসল পারু। আমি কথা বলতে পারি না। আমার ৪ বছর বয়সে গলায় কী যেন হয়েছিল। সেই থেকে আমি বোবা হয়ে গেছি। আমায় ক্ষমা করো গো! আমি আবৃত্তি করে তোমায় শোনাতে পারলাম না!

ভালোবাসার মানুষটির পাশে আমি চুপচাপ স্থানুর মতো বসে রইলাম। সে ও নিশ্চুপ। ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে রাতের নিঃশব্দতাকে আরো নৈঃশব্দের গভীরে নিয়ে চলেছিলো জলের বয়ে চলার শব্দ। হৃদয়ে ভালোবাসায় মাখামাখি হয়ে বইছিলো পারু! আমার পারু! তীব্র ইলেট্রিক ব্লু আলোয় মাখামাখি হয়ে আছে বিশ্বচরাচর। সেই রাতের নীলচে আলোয় পারু এবং আমাকে, হৃদয়ের অধিপতি আমাদের ঈশ্বর – সস্নেহ ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘক্ষণ !!

#আবৃত্তি_মামুনের_ছোটগল্প

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

11 thoughts on “আবৃত্তি_মামুনের_ছোটগল্প

  1. আবেগ তাড়িত হলাম লিখাটি পড়তে গিয়ে। যে কোন লিখা পড়বার সার্থকতা এখানেই মি. মামুন। পাঠক তুষ্টি। স্বচ্ছ লিখা কার না ভালো লাগে !! :)

    1. আপনার মন্তব্যে অভিভূত এবং অনুপ্রাণিত হলাম ভাইয়া। 

      শুভেচ্ছা নিরন্তর। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  2. অভিভূত হলাম মামুন ভাই। 

    1. গল্পটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ প্রিয় ভাই। ভালো থাকুন সবসময়।

      শুভেচ্ছা.. https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  3. মন কেড়ে নিলো লেখাটি মহ. আল মামুন ভাই। মেস জীবনের কথা মনে পড়ে গেলো।

    1. আপনার মন্তব্যে অভিভূত এবং অনুপ্রাণিত হলাম ভাইয়া। 

      শুভেচ্ছা নিরন্তর। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    2. অনেক ধন্যবাদ প্রিয় কবিদা'।

      হ্যা, এখন মেসজীবন আমার কাছে বড্ড নস্টালজিক। শুভেচ্ছা..https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    1. অনেক ধন্যবাদ রিয়া দিদি। শুভেচ্ছা রইলো। ভালো থাকুন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    1. আপনার ভালো লাগা গল্পকারের লেখায় প্রেরণা হলো জানবেন। শুভেচ্ছা নিরন্তর… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif  

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।