লোকাল থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় সকাল ন’টার পরে। একটু বেশীই তৎপর মনে হল তাদের। এর পিছনে কারণ তো অবশ্যই রয়েছে। পুলিশের গাড়িটি দেখে প্রথমে কেউ কেউ সরে যায়। পরে কৌতুহলের কাছে ভয় পরাজিত হলে, তারা আবার ঘুরঘুর শুরু করে। এতক্ষণ মাতম চলছিল ঐ বাড়িতে। এলাকার একেবারে কেন্দ্রস্থলে এমন একটি রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড এলাকার সবাইকে ভীত এবং বিহ্বল করে তুলেছে।
সাদা পোষাকের আইনশৃংখলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরাও ভিড়ের মাঝে মিশে গেলো। সবাই মিলে একটা ‘টিম’ হয়ে কাজ করবে। স্থানীয় থানার ও.সি (ভারপ্রাপ্ত
কর্মকর্তা) নিজেই এসেছেন। জোন এস.পি’র কড়া নির্দেশে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন সদ্য এই থানায় পোষ্টিং পাওয়া কর্মকর্তা।
ঘটনার সময়ে বাড়িতে ‘ভিকটিম’ একাই ছিলেন। অন্যরা এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিল। সকালে দুধওয়ালা দুধ দিতে এসে মেইন দরোজা খোলা পায়। অনেকক্ষণ বেল বাজালেও কেউ না আসায়, সে ভিতরে প্রবেশ করেই বিভৎস্য ব্যাপারটি দেখতে পায়। তাঁর চিৎকার-চেচামেচিতে সকলে জড় হয়। পরে আত্মীয়স্বজনদের খবর দেয়া হয়। তাছাড়া নিহত ব্যক্তি এই এলাকারই। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছাড়াও তারা সকল ভাইয়েরা যার যার নিজের বাড়ি করেছে। অন্য ভাইয়েরা এসে মৃতের স্ত্রী-পুত্রকে ফোন করে জানায়। তারাও এই কিছুক্ষণ হলো এসে পৌঁছেছে।
একজন এ.এস.আই কে ডেকে নিলেন ও.সি মনোয়ার। সে কাছে আসতেই ওকে নিয়ে ‘ডেড-বডি’র কাছে গেলেন। নিজের বেডরুমে ‘ভিকটিম’ একটা কাঠের চেয়ারে বসে আছে। তবে এমনভাবে দেহটা বেঁকেচুরে রয়েছে, প্রথম দেখাতেই তিনি বুঝতে পারলেন, মৃত্যুর আগে অসহ্য শারিরীক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে মানুষটিকে।
একটু কোলাহলের শব্দ কানে যেতেই পিছনে ফিরে তাকান তিনি। মৃতের স্ত্রী হবে বোধহয়। বিলাপ করতে করতে ভিতরে ঢুকবার চেষ্টা করছেন। তাকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে চলে এক যুবক। নিহতের ছেলে হবে হয়তো। এ.এস.আই আগুয়ান মহিলাকে দরজায়ই নিবৃত্ত করে। তাকে তদন্তের কাজে বাঁধা না দিতে অনুরোধ করলে ছেলে মাকে জোর করে বাইরে নিয়ে যায়।
ও.সি সাহেব তাঁর অধীনস্থকে জিজ্ঞেস করেন,
– সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি কর। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টদের খবর দেয়া হয়েছে?
লাশের দিকে তাকিয়ে থাকা এ.এস.আই তার সিনিয়রের দিকে ফিরে উত্তর দেয়,
– স্যার! হ্যা, ফরেনসিক টিম যে কোনো মুহুর্তেই চলে আসবে।
– গুড। প্রথম যে লোকটি ডেড-বডি দেখেছে, তাকে নিয়ে এসো। আর আমরা আসার আগে, এই রুমে কেউ ঢুকেছে কিনা খোঁজ নাও।
– স্যার!
এ.এস.আই বের হয়ে যায়। ও.সি লাশের খুব কাছে যান। নিহতের পরণে লুঙ্গি। উর্ধাঙ্গ খালি। কাঠের চেয়ারের হাতলে দুই হাত চামড়ার স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা। পেরেক দুই হাতের তালু ভেদ করে কাঠের গভীরে প্রবেশ করেছে। যেখানটায় পেরেক ঢুকেছে, তার চারপাশ বৃত্তাকারে কালচে-নীল হয়ে আছে। শুকনা রক্ত দলা হয়ে আছে পেরেক দু’টিকে ঘিরে। মুখে অ্যাডহেসিভ টেপ লাগানো। এজন্যই লোকটির অমানুষিক চিৎকারের আওয়াজ বাইরে কারো কানে যায়নি। লাশের মুখে কোনো আঘাতের চিহ্নও নেই। বাহ্যিকভাবে শরীরের অন্য কোথায়ও আঘাত এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তবে দুই চোখ বিস্ফারিত হয়ে আছে। পিঙ্গল দু’টি মণি স্থির। সেখানে কোনো ভাব নেই। অনুভূতির অনেক উর্ধে চলে গেছে এই মানুষটি। মুখের কসা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ার দাগ দেখতে পান। কালচে রক্ত!
দুধওয়ালাকে বাইরের রুমে দাঁড় করিয়ে রেখেছে এ.এস.আই। দেখতে পেয়ে ওসি মনোয়ার বাইরে আসেন। লোকটি বয়স্ক। চুল সাদা হয়ে আছে। মেহেদির রঙে রাঙ্গানো। মুখে কয়েকদিনের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। সব সাদা। লোকটি নার্ভাস হয়ে আছে। থেকে থেকে জিভ দিয়ে শুকনা ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে।
ওসি লোকটির সামনে এসে দাঁড়াতেই ফরেনসিক টিম পৌঁছে যায়। তাদেরকে নীরবে ভেতরটা নির্দেশ করে ওসি দুধওয়ালাকে নিয়ে ভিতরের আরেকটি রুমের দিকে আগান। মুখে তাঁর প্রসন্ন হাসি। ফর্মাল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া, দুধ বিক্রেতা সেই হাসি দেখে আরও ভড়কে যায়। ঢোক গিলে সে ভাবে, আজ কপালে নিশ্চয়ই খারাবি আছে।
ফরেনসিক টিম তাদের কাজ শেষ করে বের হবার অনেক আগেই ওসি সাহেব দুধ বিক্রেতাকে ছেড়ে দিয়েছেন। লোকটির কাছ থেকে তেমন কিছুই জানা যায়নি। দেখে মনে হচ্ছে, খুনটা গভীর রাতে হয়েছে। আর দুধওয়ালা তার রুটিন মাফিক রোজকার মত আসাতেই সর্বপ্রথম দেখতে পায়। ওকে টুকটাক অনেক কিছু জিজ্ঞেস করেন তিনি। শেষে এ.এস.আই’র কাছে নাম-ঠিকানা লিখিয়ে আপাতত তাকে চলে যেতে বলেন।
লাশ ময়না তদন্তের জন্য নিয়ে যাবার হুকুম দিয়ে বাইরে অপেক্ষমান অন্যদের কাছে ফিরে আসেন ওসি মনোয়ার। এলাকার মেম্বার এবং কাউন্সিলর এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। সেদিকে আগাতেই এস.পি সাহেবের ফোন আসে। দু’জনের ভিতরে কিছুক্ষণ কথা হয়,
– মনোয়ার সাহেব, এবার বলুন?
– স্যার! ভিকটিম সম্পুর্ণ একা ছিলেন ঘটনার সময়। পরিবারের বাকিরা বিয়ের অনুষ্ঠানে ছিল। খুনের মোটিভ এখনো জানা যায়নি। বাড়ি থেকে দামি কোনো কিছুও নেয়া হয়নি। আসলে জিনিসপত্র কিছুই নেয়নি খুনি এমনটাই যতদূর বুঝতে পেরেছি। কোনো ধরণের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। তবে খুনি স্যাডিস্ট কিনা তাও সম্পূর্ণভাবে বুঝা যাচ্ছে না। ময়না তদন্তের রিপোর্ট এলে স্যার বাকিটা জানা যাবে।
– হুমম.. উপর থেকে আমার কাছে বারবার ফোন আসছে। হোমরা-চোমরা কেউ নাকি ভিকটিম?
– না স্যার। সরকারি দলের স্থানীয় নেতা।
এবার কণ্ঠস্বর একটু নিচু করে ওসি তার উপরওয়ালাকে জানায়,
– তবে স্যার, ভিকটিম ‘ড্রাগ রিংয়ের’ একেবারে নিচের সারির একজন। এই এলাকায় ‘ড্রাগ-সাপ্লাইয়ের’ কাজটা সে-ই দেখাশুনা করে। স্থানীয়। এলাকায় পারিবারিক প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেক। থানায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলেও, আমাদের ব্যাড-বুকে তার নাম আছে।
– আমাকে উপরে জবাব দিতে হচ্ছে। যতই ব্যাড-বুকে নাম থাকুক, এর পেছনের মানুষগুলো অনেক ক্ষমতাধর। আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই?
– স্যার!
– আই ওয়ান্ট ইমিডিয়েট অ্যাকশন। যে কোনো ভাবেই হোক, ফাইন্ড আউট দ্য কিলার।
– সকল ফ্যাক্টস একত্রিত করা হচ্ছে। আশাকরি ভাল কিছু জানাতে পারব, স্যার।
– আই ডোন্ট নিড ফ্যাক্টস। আই ওয়ান্ট রেজাল্ট.. গট ইট? আমি খুনিকে চাই।
– স্যার! আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাব।
ওপাশ থেকে লাইন কেটে দেয়া হল। একটু বিরক্ত হন ওসি মনোয়ার। উপস্থিত সকলের দিকে তাকান পালা করে। তার চোখে চোখ পড়তেই সবাই চোখ নামিয়ে নেয়। এটা দেখে মনটা আরো বিষিয়ে উঠে তার। এরা সবাই যেন চোর, চোর স্বভাবের। না হলে চোখ নামিয়ে নেবার কী প্রয়োজন? এরকম দু’একটা ড্রাগ-ডিলার মারা যাওয়াটা সমাজের জন্য নিশ্চয়ই খারাপ নয়। ভালো।
হঠাৎ নিজের দুই ছেলের কথা মনে পড়ে। ওরাও যে কোনো সময় এই ড্রাগের খপ্পরে পড়তে পারে। পলকের তরে একজন বাবা হিসেবে নিজের ভেতরে কেমন এক অসহায় অনুভবে বিলীন হন ওসি মনোয়ার। তবে সেটা সামান্য সময়ের জন্য। একজন পোশাকধারী কর্মকর্তা যখন সামনে আসেন, ভেতরের বাবাটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়।
নিজের মনে এলোমেলো ভাবেন। একা একা। আমাদের সিস্টেম গোড়া থেকেই খোকলা হয়ে আছে। এই থানায় পোষ্টিং নিতে তাকে কোটি টাকার উপরে ঢালতে হয়েছে। কেন ঢেলেছেন?
নিজের প্রশ্নে নিজেই বিব্রত হন। অনেক প্রশ্ন এমন আছে, যেগুলো নিজের কাছেও জানতে চাওয়া যায় না।
হাতের ইশারায় দূরে দাঁড়ানো এ.এস.আই কে ডাকেন।
– খোঁজ নাও তো, কন্ট্রাক্ট কিলাররা কে কোথায় আছে? গত রাতে কোথায় ছিল, তাদের মোবাইল লোকেশণ ট্র্যাক করো কিংবা যা ইচ্ছে তাই করো। কিভাবে কি করবে জানি না। প্রয়োজনে সবাইকে তুলে আনো।
হাগায়ে দাও। কিন্তু আসল সত্যটা আমার জানা চাই।
– স্যার।
নীরবে বেরিয়ে যাওয়া এ.এস.আই’র পেছন দিকটা অনেকক্ষণ ধরে দেখেন ওসি মনোয়ার।
বাজারে। চা’র দোকান। সাদা পোশাকের পুলিশ বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এলাকায় অচেনা কেউ এসেছিল কিনা, নিহত লোকটির কোনো শত্রু আছে কিনা, পারিবারিক সহায় সম্পত্তি নিয়ে নিজেদের ভেতর কোন্দল আছে কিনা- এরকম সকল এঙ্গেল থেকে কৌশলে জানতে চাওয়া হয়। তবে বাঙালি সহজে মুখ খুলতে চায় না। তবে একবার খুললে, তা আর বন্ধও হতে চায় না।
অচেনা কেউ এসেছিল কিনা? এই প্রশ্নের উত্তরে একজনের কথা জানায় তারা। কিন্তু রাতের আঁধারে সেভাবে কেউই মানুষটিকে দেখতে পায়নি। কেউ বলে
লোকটির গালে হাল্কা দাঁড়ি আছে, তো অন্যজন জানায় সে ক্লিন সেভড ছিল। চোখের মণি কেউ কালো বললে, অন্য একজন বলে সেটা নীল ছিল। এভাবে যে যার মত রঙ লাগিয়ে বর্ণনা করে যেতে থাকে। সাদা পোশাকের পুলিশেরা বিরক্ত এবং বিব্রত হয়। শেষে মনে মনে লোকগুলোকে জঘন্য গালি দিয়ে সরে আসে তারা। উপরওয়ালাকে কি জবাব দেবে, ভেবে ভেবে সেটার একটা রুপরেখা দাঁড় করায়।
…
বয়স্ক মানুষটি বাজারের ব্যাগ হাতে সাধারণ এক আবাসিক এলাকার ভাঙ্গা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেন। জায়গায় জায়গায় রাস্তা এতটাই ভাঙ্গা, হাঁটতে কষ্ট হয়
তাঁর। রিক্সা পান নাই। বাধ্য হয়ে হেঁটে আসা। গরমে ঘেমে গেছেন। শ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। হয়ত হাঁফানির টান আছে। কেমন ঘোলা চোখের দৃষ্টি। বেশ মেদ জমেছে শরীরের মধ্য ভাগে। হাঁসফাঁস করার সেটাও একটা কারণ।
রাস্তার দু’পাশের বাড়িগুলোতে এখন অখন্ড অবসর। অনেকেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে কাছের মানুষদের সাথে অলস আড্ডায় মগ্ন। কেউ কেউ তাকিয়ে সাদা চুলের পঞ্চাশোর্ধ মানুষটিকে হেঁটে চলে যেতে দেখে। অচেনা মানুষ। তবে এই নগর জীবনে কে কাকে চেনে? হয়ত প্রতিবেশীই হবে মানুষটি তাদের। চোখ ফিরিয়ে নিতে নিতেই বৃদ্ধ লোকটির কথা ভুলে যায় তারা।
হেঁটে চলা মানুষটি এমনই। মনে রাখবার মত কেউ নন তিনি।
(ক্রমশঃ)
দ্বিতীয় পর্বে এসে অনুমান হয়ে গেলো গল্পটি কোনদিকে এগোবে। গডফাদার কে বা কারা সেই রহস্যের সম্ভবত রাখঢাক উন্মোচন হবে। ধন্যবাদ মি. মামুন। শুভ সকাল।
জি ভাইয়া, তবে গডফাদারের মুখোশ উন্মোচন দেরীতে হবে। সাথে থাকার জন্য শুভেচ্ছা রইলো।

ধন্যবাদ মামুন ভাই। গল্পের এই অংশ পড়লাম। পরের পর্বের অপেক্ষা থাকলো।
স্বাগত তোমায় প্রিয় সুমন। এই পর্বে সাথে থাক্স্র শুভেচ্ছা..
পড়লাম মহ. আল মামুন ভাই। চলুক …
ধন্যবাদ প্রিয় কবিদা'! সাথে থাকার শুভেচ্ছা..

ইন্টারেস্টিং এই দ্বিতীয় পর্ব। পড়ে চলেছি প্রিয় গল্প দা।
ধন্যবাদ রিয়াদি'। পর্বগুলির সাথে থাকার শুভেচ্ছা রইলো..

পড়ে চলেছি।
পর্বগুলির সাথে থাকায় ধন্যবাদ আপনাকে। শুভেচ্ছা..

চলুক মামুন ভাই। ফলো করছি।
ধন্যবাদ ভাই আপনাকে। সাথে থাকায় প্রেরণা পেলাম লেখার। শুভেচ্ছা..

এই পর্বটিও পড়লাম ভাই।
এই পর্বেও সাথে থাকায় ধন্যবাদ আপনাকে। শুভেচ্ছা..
