মামুনের অণুগল্প : খেলা খেলা সারাবেলা

নিজে পিতা হয়ে পিতার অনুভবে আব্বাজানের ভালোবাসাটুকু যে অনুভবে এসেছে, তাকে কি জানাতে পারলাম? তাকে আর জানানোই হলো না। যাদের বাবা এখনও কাছে আছেন, বাবার আরও কাছে যান, তাকে অনুভব করান আপনার প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা আপনার অনুভবে এসেছে।

ভিন্ন এক জেলা শহরে চাকরি করি তখন। পরিবারের সদস্যরা থাকে আরেক শহরে। সপ্তাহে উইকেন্ডে বাসায় আসি। বাকি দিনগুলি মধ্যবর্তী এক ‘নো-ম্যানস ল্যান্ড’ এর বাসিন্দা আমি। একদিন অফিসে ব্যস্ত। লাঞ্চের ঠিক আগ মুহুর্তে বউ এর ফোন এলো। রিসিভ করলাম,
– কি ব্যাপার? আজ পৌঁছায়ে ফোন করলে না যে?

প্রতি শনিবার বাসা থেকে সেই ভিন্ন শহরের রুমে পৌঁছে আগে বউকে ফোন দেই। সামনে কোরবানির ঈদ। সেদিন গরুর ট্রাকের কারণে সৃষ্ট জ্যাম এর হাত থেকে রক্ষা পেতে, আমার যাতায়াতের নিয়মিত রুট চান্দোরা না গিয়ে বাইপাইল থেকে টার্ণ নিয়ে নরসিংহপুর দিয়ে কাশিমপুর হয়ে কোনাবাড়ি এসেছি। সাধারণত প্রতিবার সকাল ৭ টার পরে পৌঁছাই। সেইদিন ৬ টা ১৫ তে রুমে। এরপর আর বউকে ফোন করতে মনে নেই।

আর বউও সেটা মনে করিয়ে দিলো ঠিক ১টার সময়!
হয়তো অপেক্ষা করেছে, আমি ফোন করি কিনা?
যেভাবে অপেক্ষা করে থাকে, হাসলে ওর গালে এখনও টোল পড়ে কিনা, এটা দেখে ওকে কিছু একটা বলি। কোনো এক ভালো মুডে থাকাকালীন এক সুবর্ণক্ষনে সে জানিয়েছিল আমায়!

কিন্তু আমি জেনেও ওকে বলি না। অপেক্ষায় রাখি।
যাইহোক, আমি ঠিকভাবে পৌঁছলাম কিনা বউয়ের এটা জানার ব্যকুলতা আমাকে অনুভবের গভীরে স্পর্শ করায়। সাভারে থেকেও ওর এই কেয়ারটুকু, কোনাবাড়িতে অবস্থানরত অফিসে ব্যস্ত আমার গালে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে যায়। কেমন এক ভালোলাগার বিহ্বলতায় ডুবে যেতে থাকি আমি।

এরকম আরও এক পরশ পাই আমি খুলনা থেকে…

গাজীপুর ও ইপিজেডে শ্রমিক আন্দোলন চলছে। বিভিন্ন গার্মেন্টসে ভাংচুর চলছে। মিডিয়ার মাধ্যমে সারা দেশ জেনে গেছে। কিন্তু আমি কেমন আছি কাছের মানুষদের অনেকেরই সেটা জানার জন্য তেমন ব্যাকুলতা দেখি না।

হঠাৎ আম্মার ফোন,
– তোর ওখানে কোনো সমস্যা নাই তো?
– না মাদার, আমাদের ফ্যাক্টরী রাস্তা থেকে অনেক ভিতরে। সমস্যা নাই।
– তারপরও সতর্ক থাকিস।

মাত্র তো এই কয়েকটি কথা। তবুও এখান থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূর থেকে আম্মার এই আদর মাখা কেয়ারটুকু ইথারে ভেসে ভেসে আমার মন-প্রাণ জুড়িয়ে দেয়।

আমাকে ঘিরে আমার মা আর বউ এর এই উৎকণ্ঠা আমাকে কোথায় যেন নিয়ে যায়…। আরেক বুধবার রুটিনের বাইরে গিয়ে সাভারের বাসায় এলাম। কোরবানির গরু’র ট্রাক থেকে পুলিশের প্রকাশ্য চাঁদাবাজির কারণে ২ ঘন্টার পথ সাড়ে ৪ ঘন্টা লাগিয়ে যখন বাসায় ফিরলাম, ভিতরে প্রচন্ড ক্রোধ ছিলো। ক্রোধ নিজের ওপর। কেন জন্মালাম এই দেশে?

সে রাতে আমার ছোট কন্যা কি কারণে যেন একটু পাকামো করে বসেছিলো। বকা দিলাম। সচরাচর আমার এই কন্যাটিকে আমি কিছু বলি না। সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত সে নাকি কান্না করেছিলো (ওর মায়ের সাথে সে রাতে ঘুমায়। তার মা আমাকে পরে বলেছে)। আমিও ভিতরে ভিতরে অস্থির বোধ করেছি। রাতে ঘুমের ভিতর বার বার চমকে উঠেছি।

বৃহস্পতিবার অফিসে এসে কোনাবাড়ী থেকে খুব ভালো একটা খেলনা কিনে আনালাম। একটা অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেতে আমিও ‘ঘুষ’ নামক এই “অধিকাংশ জনপ্রিয়” জিনিস কে ব্যবহার করলাম।

বৃহস্পতিবার আমার বাসায় ফেরার দিন। অফিসের কলিগেরা সবাই দিনটিকে ‘বউ দিবস’ হিসেবেই পালন করতাম। যাইহোক, সেই বৃহস্পতিবারটিকে আমি বউ দিবস থেকে ‘ছোট কন্যা’ দিবসে পরিণত করতে চাইলাম।

সে রাতে বাসায় ফিরে দুই বাপ-বেটি সব কাজ বাদ দিয়ে খেলনা নিয়ে পড়ে রইলাম। ওর মনের গ্লানি-কষ্ট সেদিন রাতেই কান্নার সাথে ধুয়ে গেছিল। আর আমার বুকের ভিতর যে ভারী জিনিসটা ছিল, তাও ওর সাথে ছেলেমানুষি করতে করতে শেষ হল। মেয়ের সাথে বসে অবচেতনে ভাবনা-চিন্তায় আমি স্মৃতির অনেক আগে ফিরে গেলাম। মনে পড়লো আমাদের আব্বাজানও আমাকে এমন ‘ঘুষ’ দিয়েছেন।
একবার না। অ…নে…ক বার। তখন তার সেই দেয়াটা ওভাবে বুঝে আসে নাই।

কিন্তু সেদিন নিজের ভিতরের এক পিতার কর্মকাণ্ড এবং তার এ সংক্রান্ত অনুভব আমাকে আমার পিতার অনুভবকে নতুনভাবে অনুভব করালো।

তখন সবে ‘পাওয়ারড গ্লাস’ ব্যবহার করতে শুরু করেছি। কখন যে চশমার কাঁচ ঘোলা হয়ে উঠেছে টের পাইনি। যখন অনুভবে এলো, চোরের মত এদিক সেদিক দেখে কান্নাটুকু লুকিয়ে ফেললাম। কিন্তু মনের ভিতরে আব্বার জন্য যে বোবা কান্না জমাট বাধা তা কি লুকোতে পারলাম?

নিজে পিতা হয়ে পিতার অনুভবে আব্বাজানের ভালোবাসাটুকু যে অনুভবে এসেছে, তাকে কি জানাতে পারলাম? তাকে আর জানানোই হলো না। :(

একান্ত কাছের মানুষদের সাথে সহাবস্থানের টুকরো টুকরো ভালোবাসার মোড়কে যে অফুরন্ত মায়া জড়ানো, তাদের সেই মায়ার মোহ নিজে অনুভব করার জন্য এক জীবন আসলেই খুব অল্প সময়। অবেলায় কেটে যায় মনুষ্য জীবন খেলায় খেলায় অবহেলায়।

মামুন সম্পর্কে

একজন মানুষ, আজীবন একাকি। লেখালেখির শুরু সেই ছেলেবেলায়। ক্যাডেট কলেজের বন্দী জীবনের একচিলতে 'রিফ্রেশমেন্ট' হিসেবে এই সাহিত্যচর্চাকে কাছে টেনেছিলাম। এরপর দীর্ঘ বিরতি... নিজের চল্লিশ বছরে এসে আবারো লেখালখি ফেসবুকে। পরে ব্লগে প্রবেশ। তারপর সময়ের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেয়া। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ তে 'অপেক্ষা' নামের প্রথম গল্পগ্রন্থ দিয়ে লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। বইমেলা ২০১৭ তে তিনটি গ্রন্থ- 'ছায়াসঙ্গী'- দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ, 'ঘুঙ্গরু আর মেঙ্গরু'- উপন্যাস এবং 'শেষ তৈলচিত্র'- কাব্যগ্রন্থ নিয়ে সাহিত্যের প্রধান তিনটি প্ল্যাটফর্মে নিজের নাম রেখেছি। কাজ চলছে ১০০০ অণুগল্প নিয়ে 'অণুগল্প সংকলন' নামের গ্রন্থটির। পেশাগত জীবনে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। একজন অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ, প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। পোষাক শিল্পের কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। লেখালেখির পাশাপাশি সাংবাদিকতা করছি। লেখার ক্ষমতা আমি আমার ঈশ্বরের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছি। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখেই যেতে হবে আমাকে।

8 thoughts on “মামুনের অণুগল্প : খেলা খেলা সারাবেলা

  1. একান্ত কাছের মানুষদের সাথে সহাবস্থানের টুকরো টুকরো ভালোবাসার মোড়কে যে অফুরন্ত মায়া জড়ানো, তাদের সেই মায়ার মোহ নিজে অনুভব করার জন্য এক জীবন আসলেই খুব অল্প সময়। অবেলায় কেটে যায় মনুষ্য জীবন খেলায় খেলায় অবহেলায়। বড্ডো ছোট এই জীবন মি. মামুন। :(

  2. এক জীবনের অভাবনীয় মায়া ভরা গল্প মামুন ভাই। গল্প নয়; জীবনের খণ্ড খণ্ড প্রাপ্তি। 

  3. খেলা খেলা সারাবেলা। এভাবেই সাঁঝবেলা। ভাল থাকুন প্রিয় গল্প দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  4. ভালোবাসাময় ভালোবাসায় আচ্ছন্ন থাকুন মহ. আল মামুন ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  5. মুগ্ধ হলাম মামুন ভাই। আপনার গল্প গুলো জীবনের সাথে মিলে যায়।

  6. হৃদয় নিংড়ানো গল্প,চোখের পানি ধরে রাখা কার সাধ্য। 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।