দাম্পত্য জীবনের অতি পরিচিত টুকটাক অণুমুহুর্তগুলো আসলেই অনেক দামী। অনেক আগে নিচের অণুগল্পটি লিখেছিলাম। এরপর অনেক সময় পার হয়েছে। আমিও বদলে গেছি- পেশা এবং বাহ্যিক অবয়বে। কিন্তু ভিতরের অনুভবক্ষম আমি তো সেই একই রয়েছি। যদিও এখনকার অনুভব আর আগের মতো লেখা হয় না। এখন লেখালেখি কেবলি পেশার কারণে। মফস্বল সাংবাদিকের আড়ালে আমি হারিয়ে গেছি।
আমার অনেক প্রিয় অণুগল্পটি আরও একবার শেয়ার করলাম..
★
‘নিজেকে নিজের মতো স্বার্থক করে নাও, সফলতার মাপকাঠি যেহেতু আপেক্ষিক তাই সবার ক্ষেত্রে সফলতা সম্ভব নয়। জীবনের গল্প সুখ-দুঃখের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে। এটাই তো জীবন।’
খুব প্রিয় এবং কাছের একজন মানুষ বলেছিলেন কথাগুলো। বাসায় এলে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসলেই দুনিয়ার চিন্তা-ভাবনা মাথায় জুড়ে বসে শাহেদের। পাশের সোফায় এবং ডিভানে বসে হিন্দী সিরিয়ালে মগ্ন ওর পরিবারের অন্যরা।
ওর কাছের মানুষদের চিন্তাগুলো কি তাদের নিজ নিজ ভূবন গড়ে নেয়ায়, সেখানে শাহেদের অবাধ যাতায়াত নেই দেখেই বোধহয়, ডাইনিং টেবিলে বসলেই তাঁর নিজ চিন্তাগুলি ওকে সঙ্গ দেয়? বন্ধুর মত!
চিন্তাবন্ধু নাম দেয়া যায় কি একে?
একবার বউয়ের দিকে তাকায়। সে তখন টিভির পর্দায়। বড় মেয়ে মোবাইলে ব্যস্ত। তবে এর ভিতর দিয়ে পর্দার চরিত্রগুলিতে মনোনিবেশ, কি মা’র সাথে টুকরো আলাপ- সিরিয়াল সংক্রান্তই বেশীরভাগ। এরা এক একজন ‘সিরিয়াল বিশেষজ্ঞ’। মেয়ে যে আসলে মোবাইলে কি দেখে বা চালায়, শাহেদ আজকাল ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
ছোট ছেলেও ব্যস্ত। এরা দু’ভাইবোন সারাদিন ইংরেজি f আকৃতির মত ডিসপ্লের দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকে। অফিস যাওয়া আসার পথে, এমন বাসভর্তি f দের চোখে পড়ে আজকাল শাহেদের।
ছেলে এখন গেমস খেলছে।
ওদের সবার একটা আলাদা জগত গড়ে উঠেছে। শাহেদের জগত কোনটা? সে তো এদেরকে নিয়েই এক জগতের সন্ধানে জীবন পার করছে। ওরা কি ভিন্ন জগতের বাসিন্দা? ওদের প্রবেশ পথে কি শাহেদের জন্য এমন সাইনবোর্ড ঝুলানো থাকে ‘No Tresspassing’?
অফিস দিনের প্রায় চৌদ্দ ঘন্টা খেয়ে ফেলে যাওয়া আসা মিলিয়ে। বাকিটুকুতে যা সময় দেয়া সবাইকে। হাতে থাকে বন্ধের দিন। ঘুমকাতুরে শাহেদ আবার বন্ধের দিনে ঘুমে কাটায় প্রায় দিনের অর্ধেক।
‘এই সাইনবোর্ডের দায় তোমার কি নেই একটু ও?’
নিরবে ভাতের দলা নাড়াচাড়া করছে দেখে টিভির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে মিলি জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো? রান্না ভাল হয়নি নাকি?
শাহেদ নিরুত্তর থেকে মাখানো ভাতের এক দলা মুখে দেয়। উত্তরের অপেক্ষায় থাকে মিলি। একটু কি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে সে? সিরিয়ালের ‘ক্রুশিয়াল মোমেন্ট’ চলে যাচ্ছে? ভ্রুর হাল্কা কুঁঞ্চন কেন তবে? অবশ্য আজকাল শাহেদ অনেক ভুলভাল দেখে। বকে এবং ভাবেও সেভাবে নিজের মনে।
এত ভুল কেন জীবনে? মস্তিষ্কের প্রশ্নের উত্তর দেয় না মন। মিলি কিছু জিজ্ঞেস করায় মন আর সে, দু’জনেই ওর দিকে ফিরে তাকায়,
– অফিসের হোটেলের রান্না খেয়ে খেয়ে এখন আমার রান্না ভাল লাগছে না আর?
ভাতের প্লেট একটু দূরে ঠেলে দেয় শাহেদ। বাউলে পানি ঢেলে হাত ধোয়। প্লাস্টিকের বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি পান করে। তৃষ্ণা মেটে?
এরপর মিলির দিকে তাকিয়ে বলে,
– সিরিয়ালগুলিতে আজকাল এসবও শিখাচ্ছে নাকি?
– মানে?
নাকের উপরটা গিরগিটির শরীরের মত লাল হয়ে উঠে মিলির। এক্ষুনি রেগে যাবে। শাহেদ সামাল দেয় এই বলে,
– তুমি ভাল করেই জানো যে তোমার রান্নার সামনে আর কেউ দাঁড়াতে পারে না আমার কাছে। তারপরও আউল ফাউল কথা কেন বলো?
আগের রঙ ফিরে পায় নাকটি। তবে ওখানেই সব শেষ হয় না। সিরিয়াল গুরুত্ব হারিয়েছে নারীর কাছে! সে এখন আবেগী হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। যখন মিলি জানায়,
– দেখলাম তো, কখনো তোমার খাবার হোটেল থেকে কিছু এনেছ আমাদের জন্য?
‘আমাদের জন্য’ শব্দ দুটি বলা কি ছেলেমেয়েদেরকেও নিজের দিকে টানার অপচেষ্টা?
তবে সে সফল হয়। ওর দুই বাচ্চার কান হরিণের মত। সবসময় খাড়া এবং সজাগ থাকে। তবে এদের সাথে হরিণের পার্থক্য এক জায়গায়, হরিণ যে কোনো তুচ্ছাতিতুচ্ছ শব্দের উৎস খুঁজে বের করতে সজাগ হয়। ছেলে আর মেয়ে, তাদের বাবার বিপক্ষে যায় এমন সব কথায় f পজিশন থেকে I অবস্থানে চলে আসে।
এদিকে, দুই ছেলেমেয়েকে পাশে নিয়ে আক্রমনে নামে মিলি,
– বৃহস্পতিবার দুপুরে খাও না তো, তরকারিটা আমাদের জন্য নিয়ে এলেও তো পারো? বিল তো দেয়াই লাগে।
এবার অসহ্য লাগে শাহেদের মিলির কথাবার্তাগুলো। মস্তিষ্ক বিপদ সংকেত দেয়। ক্রোধ বিপদজনক সীমার দিকে এগিয়ে চলেছে। শাহেদের ইচ্ছে করে মিলিকে এগুলি বলতে,
– তুই আর তোর মা হলি খয়রাতির জাত। জীবনে খাওয়া ছাড়া কিছু বুঝলি না?
বউয়ের মা’কে এক্ষেত্রে বেশীরভাগ সময়েই অহেতুক টেনে আনা হয়। যঅদিও ভদ্রমহিলারা বেশীরভাগ সময়েই আরোপিত অভিযোগের সাথে সামান্যটুকুরও সংশ্রব রাখেন না। তারপরও বউকে কথার আঘাতে তীব্রভাবে ঘায়েল করতেই ওনাদেরকে আনার লোভটুকু স্বামীরা কেন জানি সম্বরণ করতে পারে না।
কিন্তু মিলির দিকে তাকাতেই সব ভুলে যায় শাহেদ । নাকের নিচটা ঘেমে ভিজে আছে মিলির। তীক্ষ্ণ চোখে শাহেদকে দেখছে সে। ফ্যানের বাতাসে চুল উড়ছে তাঁর। অবাধ্য দু’একটা চুল চোখের উপর পড়েই সরে যাচ্ছে। ডান গালের তিল! এসব কিছু মিলিয়ে মিলিকে দেখে শাহেদের রাগ পড়ে যায়.. ধীরে ধীরে। সেই অদৃশ্য সাইনবোর্ডটির অস্তিত্ব এই মুহুর্তে আর অনুভব করে না সে একটুও!
মিলিও কি শাহেদের এখনকার পরিবর্তনটুকু লক্ষ্য করছে?
মিলিকে ধরে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে শাহেদের। আপনাতেই শাহেদের টোন চেঞ্জ হয়ে যায়, নিজেও টের পায়না কিভাবে কি বলছে সে,
– আসলে টানাটানির ভয়ে আনি না আমি। অন্য কিছু না।
মিলি অবাক হয়! লোকটা একটুও গালাগাল করলো না আজ! কিন্তু ক্রোধের শুরুটার সকল উপসর্গ শুরু হয়েছিল। দেখেছেও সে। আবার কেন জানি তীক্ষ্ণ রেখাগুলো সমান হয়ে মিলিয়েও যায়। ঐ দু’টি চোখে সেই প্রথম দিনের ভাললাগার চমক এই কিছুক্ষণ আগে দেখেছে সে। শাহেদের চোখে।
চোখ?
কোন চোখ?
একজন পুরুষের কতগুলি চোখ থাকে?
তবে শাহেদের চোখে তাকালে সেই প্রথম থেকেই নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেবার ইচ্ছে হতো মিলির! আজ বহুদিন পর সেই ইচ্ছেটার জন্ম হচ্ছে দেখে মিলিও অবাক হয়। ওর পুড়ে যেতে ইচ্ছে করে!
‘নাহ! আমার মানুষটা আমাকে এখনো আগের মত ফিল করে! আমিও করি। ওকে আমার আরো সময় দেয়া দরকার।’
নিজের খোলস বদলে এক অতিপরিচিত মিলি উঠে দাঁড়ায়। শাহেদকে জিজ্ঞেস করে,
– চলো, হাঁটতে বের হই। তুমিই তো বলো সবসময়- after dinner walk half a mile, কি? বলো না?
মেয়ে এবং ছেলের অবাক চাহনির সামনে শাহেদ দাঁড়িয়ে মিলির প্রশ্নের উত্তর দেয়,
– হ্যা 🙂 বলেছি অনেকবার আমি। চলো, বের হই।
রাতের প্রথম প্রহরে নির্জন পিচ ঢালা পথে, এক জোড়া নব-দম্পতি হাত ধরে হেঁটে চলে। কিছুক্ষণ আগে ওদের খোলস বদল হয়েছে। হৃদয়ের পলেস্তারা খসে খসে- হৃদয়গুলো নতুন হৃদয়ে পরিণত হয়।
হৃদয়ের পুনর্গঠন!
পুনর্জনম বললে ভুল হবে কি?
হৃদয়ের পুনর্গঠন!
শুভ সকাল মি. মামুন। 
পুনর্জনম বললে ভুল হবে কি? ___ মনে হয় না।
দারুণ লেখা।।।
খুব সুন্দর প্রকাশ ।