সাইমন কমিশনের রিপোর্ট – কাজী নজরুল ইসলাম

সাইমন কমিশন বা ইন্ডিয়ান স্ট্যাটু্টরি কমিশন বা ভারতীয় সংবিধানিক কমিশন ছিল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সাতজন সদসবৃন্দের দ্বারা গঠিত কমিশন যারা ১৯২৭ সালে ভারতের সংবিধানিক পুনর্গঠন অধ্যয়ন করতে এসেছিলেন। ভারতে ভারতীয় সমস্যাবলি অনুসন্ধান করে শাসনতান্ত্রিক সংস্কার সম্পর্কে প্রতিবেদন পেশ করার জন্য এই কমিশন গঠন করা হয়েছিল। এই কমিশন ছিল সরকার ও বিরোধীদলীয় সাতজন সংসদ সদস্য নিয়ে গঠিত একটি সংসদীয় কমিশন। সভাপতি স্যার জন সাইমনের নামানুসারে এ কমিশন সাইমন কমিশন নামে বেশি পরিচিত। কাজী নজরুল ইসলাম সাইমন কমিশনের রিপোর্ট নামে ব্যাঙ্গাত্বক একটি কবিতা লিখেন। সেই কবিতা শব্দনীড়ের ব্লগার, পাঠক ও ভিজিটরদের জন্য শেয়ার করলাম। কবিতাটি পড়ে সবাই আনন্দ পাবেন এবং সেই সময়ের ইতিহাসও আপনার মনে উঁকি দেবে।

সাইমন-কমিশনের রিপোর্ট
( প্রথম ভাগঃ ভারতের যাহা দেখিলেন )

কোরাস্– “কি দেখিতে এসে কি দেখিনু শেষে,
রিপোর্ট লেখেন সাইমন,—–
হুটোপুটি ক’রে ছুটোছুটি করে
বুড়োবুড়ী, কাজে নাই মন !

ম্যাদা’ দল আর উদোদল
পায়ে হস্ত বুলায় হর্দ্দম,
পুঁচকে দলের ফচ্ কে ছোঁড়ারা
ছিটাইছে বটে কর্দ্দম !
ত্যক্তের চেয়ে ভক্তই বেশী,
আহাহা ভক্ত বেঁচে থাক্ !
ছোলা ভাজা দেবো, কাঁচকলা দেবো,
নিশ্চয়ই মনে এঁচে রাখ্ ||
আসিয়া ভারতে সান্ কি লইয়া
আসিল ফকির ফোক্ রা,
পিছন হইতে ঠোক্ রায় টাকে
ডেঁপো গোটা কয় ছোক্ রা |
ছেলে যা দেখিনু, ছেলের চাইতে
পিলে বড়, অধিকন্তু—
বৃহত্তম ‘জু’ দেখিনু জীবনে—
প্রথম দু’পেয়ে জন্তু ||
মাথা নাই হেথা, নাই ক হৃদয়,
শুধু পেট আর পিঠ সার,
এত ‘পিঠে’ খেয়ে কেমনে হজম
করে, করে না কো চিৎকার !
ঠুঁটো হাত শুধু চিৎ ক’রে রাখে
শূন্যের পানে তুলিয়া,
বিপদে শ্রীপদ ভরসা, তাহাও
শ্লীপদে গিয়াছে ফুলিয়া ||
মাড়োয়ারী আর ‘মালোয়ারী’ জ্বর
এদের পরম মিত্র,
মরমরদেরে একেবারে মেরে
রাখিছে দেশ পবিত্র !
ইহাদের হরি বন্ধু মোদেরি
“গুড ওল্ড জেন্টল্ ম্যান্”
কুচুরি-পানায় ডোবা ও খানায়
এঁর কৃপা করে ‘ভ্যান্ ভ্যান্’ ||
এদেশের নারী বেজায় অনাড়ী,
পুরুষের হাতে তবলা,
তবলাতে চাঁটি মারিলে সে কাঁদে,
ইহারা কাঁদে না, অবলা !
জরীসাড়ি-মোড়া চকলেট ওরা
বন্দী হেরেম-বাক্সে,
বাহির করিলে খেয়ে নেবে কেউ
কাজেই বাক্সে থাক্ সে ||
ইস্ কুলে, প্রেমে, জ্বরে পড়ে পড়ে
জীবন কাটায় ছেলেরা ;
মাঝে মাঝে করে ভ্রান্ত শিষ্ট
শান্তে লেনিন ভেলেরা |
চোখের চাইতে চশমাই বেশী,
ভাগ্যিস্ ওরা অন্ধ,
নৈলে কখন টানিয়া ধরিত
আমাদের গলা-বন্ধ ||
আমাদের দেখাদেখি কেহ কেহ
করিছে ক্লাবের মেম্-বার,
স্কার্ট্ পরে চাষারা, বাবুরা
বিবি লয়ে যায় চেম্বার !
বিলিতি দাওয়াই ধরিতেছে ক্রমে,
আর বাকী নাই বেশী দিন,
গুড্ বয় হয়ে গিলিছে আফিম,
হুইস্কি, ব্রান্ডি, কুইনিন্ ||
কাফ্রি চেহারা, ইংরিজি দাঁত,
টাই বাঁধে পিছে কাছাতে ;
ভীষণ বম্বু চাষ করে ওরা
অস্ত্র-আইন বাঁচাতে !
চাচা-ভাইপোতে মিল নাই সেথা
আড়াআড়ি টিকি দাড়িতে,
যুদ্ধ বাধাই উহাদেরি দিয়ে,
ধরিয়া আনাই ফাঁড়িতে ||
উহাদের মতো কেলে রং সব
গাছপালা জল আকাশের,
উহাদের গাই মোদেরি গাই-এর
মতো সাদা দুধ দেয় ফের |
কালো চামড়ার ভিতরে ওদের
আমাদেরি মত রক্ত,
এ যদি না হ’ত —-শাশ্বত হ’ত
ও-দেশে মোদের তক্ত !

( দ্বিতীয় ভাগ / ভারতকে যাহা দেখাইলেন )

কোরাস্– “ যীশুখ্রীষ্টের নাই সে ইচ্ছে,
কি করিব বল আমরা |
চাওয়ার অধিক দিয়া ফেলিয়াছি
ভারতে বিলিতি আম্ ড়া ||

চামড়া ওদের আমাদের মতো
কিছুতেই নহে হইবার !
হোয়াইট্-ওয়াশ যা করিয়াছি—তাই
দেখিতেছি নহে রইবার !
আমাদের মত যারা নয় তারা
অমনি র’বে কি ক’রে বল্,
সাদাদের মত কালা অসভ্য
হইবে স্বাধীন ? হরিবল্ !
আঁঠি ত চামড়া বিলিতি আমড়া মন্টেগু দিল চুষিতে,
শাঁস নাই ব’লে কাঁদিল, দিলাম
বিলিতি কুমড়ো তুষিতে |
তাহাতেও যারা খুশী নয়, এত
ভুষি খেয়ে ভরে নাকো পেট,
ঘুষি বরাদ্দ তাহাদের তরে,
ঝুটি ধরে কর মাথা হেঁট ||
পুলিশের লাঠি আরো বড়ো হোক,
আরো যেন তাতে থাকে গিঁঠ,
হস্তেরে ফেল অস্ত্র-আইনে,
ঘর হ’তে তোলা হোক ইঁট
কাগজের শুধু হইয়াছে নোট,
কাগজের হোক রুটিও,
মাথা কেটে দাও, কেটে দাও হাত
থাকে নাকো যেন টুঁটিও ||
যতটুকু দড়ি ছাড়িয়াছে , তাহা
গুটাইয়া লও পুনরায়,
একবার যদি বেড়া ভাঙে, তবে
আর্ বার ধরা হবে দায় !
আরো প্রশস্ত ক’রে দাও পিঠ
ধুর্ম্মুস-পেটা করিয়া,
টিকি ও দাড়ির চায় কর, লহ
নখর দন্ত হরিয়া ||
ও দেশের জলে ম্যালেরিয়া-বিষ ,
উহারা বিলিতি-জল খাক্ |
খেতে দাও তা’দেরে , ওদের
চ্যাঁচায় যে একদল কাক !
পা কেটে ওদের ঠেকো করে দাও,
উহাদের সাথে ছুটিতে,
হার মেনে যায় এরোপ্লেন, পায়ে
গুলি পারে নাকো ফুটিতে ||
শিরীঞ্জ্ লইয়া আরো ফাঁপাইয়া
দাও প্লীহা আর যকৃৎ !
ঢাক কিনে দাও হিঁদুরে ,
মুসলমানে বল, কর বক্ রিদ |
ভাতে নাই কিছু ভিটামিন, ওতে
মদ হোক, ওরা খাক ফেন,
এ স্বাস্থ্যে ভাত বড় ক্ষতিকর,
খুব জোর দুটো শাক দেন ||
অতিশয় বেশী কথা ক’য়ে ক’য়ে
বাড়াতেছে প্যাল্ পিটেশন,
গ্যাস্ পরাইতে কর সশস্ত্র
ডাক্তারে ইন্ ভিটেশন |
মা ভগবতীর সার উহাদের
ব্রেনে আরো দাও পুরিয়া,
যদি থাকে মেরুদন্ড কারুর
দাও তা ভাঙিয়া চুরিয়া ||
বোমা মেরে মেরে পায় নাকো খুঁজে
আজও উদরে ‘ক’ অক্ষর,
এ মেষ কেমনে সভ্য ষাঁড়ের
সহিত হানিবে টক্কর ?
পায়ে ও গলায় ছাড়া ইহাদের
কোনো সে অঙ্গে বল নাই,
ব্যারাম মাফিক ওষুধ দিলাম,
দিলাম কিন্তু ফল নাই ||

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া।

9 thoughts on “সাইমন কমিশনের রিপোর্ট – কাজী নজরুল ইসলাম

  1. পড়িলাম বটে! কি বলিব ভাবিয়া পাইলাম না তাই কিছু না বলাই শ্রেয়!

    1. পড়েছেন তাতেই আনন্দিত।
      আসলে নজরুল তো লা-জবাবই।

  2. এক্কেবারে অজানা ছিলো বিষয়টি স্যার। ঘুণাক্ষরে জানিনি কখনও কাজী নজরুল ইসলাম সাইমন কমিশনের রিপোর্ট নামে এমন অসাধারণ ব্যাঙ্গাত্বক একটি কবিতা লিখেছেন !!

    আপনাকে ইসপেশাল থ্যাঙ্কস দিতেই হয়। দিলাম কিন্তু। নিন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    1. নিলাম। একেবারে হাতপেতে নিলাম।

      সাইমন কমিশনের রিপোর্ট কবিতাটি আগে পড়েছিলাম। পরে মনে সাইমন কমিশন কি এ নিয়ে একটু খোঁজ-খবর নিই। আর ইতিহাসটাও সবার সাথে শেয়ার করতে মন চাইল। আরেকটা বিষয় হল নজরুলের আকাশ আকাশচুম্বী প্রতিভার অনেক বিষয়, অনেক রচনাই আমাদের অজানা।

      অজস্র শুভেচ্ছা রইল স্যার। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

      1. কোন সন্দেহ নেই যে কবি নজরুলের প্রতিভা আকাশচুম্বী। পুনঃ ধন্যবাদ স্যার। :)

    1. আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

  3. জানার কোন শেষ নাই
    জানার চেষ্টা বৃথা তাই?
    কত অজানা জানিলাম
    মধুর সুর শুনিলাম
    আনিয়াছে নতুন পর্ব
    আনু ভাই মোদের গর্ব।

    এ যে একেবারে নজরুল
    ধন্যবাদ।

    1. প্রিয় মালেক ভাই, এই পংক্তিগুলোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।

      নজরুল তো নজরুল। নজরুলের কতটুকুই বা আমরা জানি।

      অনেক শুভেচ্ছা ও ভালবাসা নিবেন https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

      আর ভাল থাকবেন নিরন্তর।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।