আবু সাঈদ আহমেদ এর সকল পোস্ট

গল্পঃ প্রকৌশল

‘গল্প লেখা মোটেও কঠিন নয়, পুরস্কারের জন্য গল্প লেখা আরও সহজ। কলম আর এ ফোর সাইজের দুটো কাগজ নাও, ফরমুলা শিখিয়ে দিচ্ছি’ বলে নোমান থামে, প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়, লম্বা একটা টান দিয়ে মাছের খাবি খাওয়ার মত করে ধোঁয়া ছেড়ে হাওয়ায় রিং বানানোর চেষ্টা করে। টেবিলের অপর পাশে বসে আছে নবীন লেখিকা হেনা মুস্তারি, সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে নোমানকে দেখছে, মনে মনে বলছে — ‘গল্প লেখা যদি এতই সহজ তবে আপনি লিখেন না কেনো!’

হেনার মনের ভাব টের পায় নোমান, নিজেই একটা কাগজ সামনে টেনে নেয়, কলম দিয়ে দাগ কাটতে কাটতে বলে,
— এ গল্পটা রেজাউলের পরিবারের গল্প। পরিবারের কর্তা রেজাউল দরিদ্র হলে নামের শেষে মিয়া এবং ডাক নাম রেউজ্জা’ করে দিলেই হত। কিন্তু গল্পের প্রয়োজনে রেজাউল দরিদ্র নয়, উচ্চবিত্ত শ্রেণির শহুরে মানুষ। তাই তার নাম হবে ‘রেজাউল করিম’। এদেশে বিত্তবান মানেই প্রভাবশালী, প্রভাবের ভাব ফুটাতে নামের শেষে পদবী ‘চৌধুরী’ বা ‘খান’ যোগ করা প্রয়োজন। রেজাউল করিমের সাথে চৌধুরী পদবীটা মানায়, ওটাই থাক। অবশ্য রেজাউলকে আরও বিশেষ করে তুলতে চাইলে নামের আগে ‘খান মোহম্মদ’ যোগ করা যায়।

হেনা মুস্তারি গল্প লেখার ফরমুলা শুনছে। এ ফরমুলা জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার তরুণ সাহিত্য সম্পাদক নোমানের রসিকতা কি না বুঝতে না পারলেও শুনতে ভালোই লাগছে। হেনা জানতে চায়,
— তবে কি গল্পের পরিবারের কর্তার নাম খান মোহম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী?
— না, না, তা নয়। গল্পে রেজাউল করিমকে দিয়ে কিছু অনৈতিক কাজ করানো হবে। তাই নামের আগে মোহম্মদ যোগ করা ঠিক হবে না।
— সে কি! কেনো! আমাদের দেশে অধিকাংশ পুরুষের নাম শুরু হয় মোহম্মদ দিয়ে, এ প্রথা যতটা না ধর্মীয় তার চাইতে বেশী কালচার। রেজাউলের নামের আগে মোহম্মদ থাকলে সমস্যা কি!

নোমানের মুখে হাসির রেখা, এলোমেলো চুলে আঙুল চালায়, তর্জনী দিয়ে চাঁদি চুলকায়, হাসিটাকে সামান্য বিস্তৃত করে বলে,
— কালচারের অংশ! কিন্তু কালচারের পাহারাদার আমাদের ক’জন প্রধান বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতি কর্মী আর সাহিত্যিকদের নামের আগে মোহম্মদ আছে! নামের আগে সৈয়দ বা আল ব্যবহারে আপত্তি নেই, নামের শেষে আহমেদ, ওসমান, রহমান ব্যবহারেও আপত্তি নেই, প্রথা মেনে নামের শুরুতে মোহম্মদ শব্দের ব্যবহার তেমন কই! সবাই তো আর প্রথাবিরোধী লেখক নন। এদের গল্প উপন্যাসের চরিত্রগুলোর অবস্থা অনেকাংশে একই রকম। রাজনীতিকদের নামের শুরুতেও মোহম্মদের ব্যবহার খুব কম।
— এটা উনাদের ইচ্ছাকৃত নয়, উনাদের নাম যেমন রাখা হয়েছে, তেমনই তো থাকবে।
— হেনা, উনাদের এসএসসি পরীক্ষার সনদপত্র দেখার ইচ্ছে হয়, সাহিত্য করতে এসে রইসুদ্দীনও এদেশে রইসু হয়ে যায়।

হেনা প্রতিবাদ করে ওঠে,
— ভাইয়া, কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করবেন না, উনি আমার খুউউউব প্রিয় লেখক ও বুদ্ধজীবী।
— আমিও উনার বিশেষ ভক্ত। কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করছি না, সমষ্টিগত প্রবণতাকে বুঝাচ্ছি।

হেনা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়, বুঝতে চেষ্টা করে নোমান সত্য বলছে কি না। যুক্তি দিয়ে নোমানকে পরাভূত করতে চায়,
— আশ্চর্যকথা! গল্পের কোনো চরিত্র অনৈতিক কাজ করলে তার নামের শুরুতে ‘মোহম্মদ’ ব্যবহার করা যাবে না!
— যাবে না কেনো, অবশ্যই যাবে। তবে পুরস্কারের জন্য লেখা গল্পতে ব্যবহার না করাই ভালো। ব্যবহার করলে উগ্র ইসলামিস্টদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে, তাদের বক্তব্য হবে মুসলমানদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের জন্য রেজাউলের নামের আগে মোহম্মদ যোগ করা হয়েছে। ইসলামফোবিকরা বলবে, নায়ক মুসলিম বলেই অনৈতিক কাজ করছে, মুসলমান মানেই দুষ্টু। দুই পক্ষের কোনো পক্ষকেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ দেওয়া যাবে না, এমন বিতর্কে পরিচিতি বাড়বে কিন্তু পুরস্কার সুদূরপরাহত।

হেনার কণ্ঠে দ্বিধা,
— এমনিতে তো গল্পের তেমন পাঠক নেই। এ গল্প কি অনেকে পড়বে?

নোমানের স্বরে দৃঢ়তা,
— প্রথমে এ গল্প খুব বেশী পাঠক পড়বে না, সাহিত্য পুরস্কার পেলে অনেকেই পড়বে। গল্প পড়ে তোমার ভক্তরা বলবে ‘অসাধারণ, বাংলা সাহিত্যে এমন গল্প লেখা হয়নি’, প্রতিদ্বন্দ্বীরা বলবে ‘অতি দুর্বল গল্প, এ গল্প পুরস্কার পায় কি করে?’ আর একদল সমালোচক এক জীবনে সঞ্চিত সমস্ত বিরক্তি চেহারায় ফুটিয়ে তুলে প্রশ্ন করবে, ‘এ গল্পে গল্পটা কই?’
— আচ্ছা, বুঝলাম।
— মন দিয়ে ফরমুলার বাকী অংশটা শোনো, গল্পটা রেজাউল করিম চৌধুরীর পরিবারকে ঘিরে। রেজাউলের বয়স সাকুল্যে পঞ্চাশ বছর। এ বয়সেও বলশালী শরীর। নাকের নিচে কলপ দেওয়া পুরু গোঁফ, তার ব্যক্তিত্ব ফোঁটাতে গল্পে গোঁফের ডিটেইলস জরুরী, সাথে মোটা ভ্রু’র ডিটেলস। স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে বিত্তবান ও প্রভাবশালী রেজাউলের সংসার। স্ত্রী চির রুগ্ন এবং প্রায়ই শয্যাশায়ী থাকে, তবে স্বামীর সুকর্ম ও অপকর্ম সবকিছু তার কানে আসে। স্বামীর সুকর্মে আনন্দিত হয়, অপকর্মে ভয়াবহ সব অভিশাপ দেয়।

হেনার নারীবাদী মন বুঝতে চেষ্টা করে রেজাউল করিমের স্ত্রীকেই কেনো রুগ্ন হতে হবে! বলশালী স্বামীর চির রুগ্ন স্ত্রী কি আধিপত্যবাদী সবলের সাথে নিরুপায় দুর্বলের সহাবস্থানের প্রতীক! অথবা স্ত্রীকে রুগ্ন দেখানো কি প্রকৃতপক্ষে নারীকে দুর্বল হিসেবে প্রতিষ্ঠার পুরুষতান্ত্রিক আচরণ! হেনা প্রশ্ন করে,
— স্ত্রীকেই কেনো রুগ্ন দেখাতে হবে?
— এ প্রশ্নের উত্তর তো খুবই সহজ, রুগ্ন স্ত্রীর কাছে ক্ষমতাবান সবল স্বামীর অপকর্ম গোপন থাকছে না। সে সবসময় স্বামীর অপকর্মের প্রতিবাদ করছে, বিদ্রোহ করছে। কিন্তু স্বামী মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না। এ যে আমাদের সোসাইটির প্রতীক, রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের সাথে সাধারণ নাগরিকের সম্পর্কের ঘরোয়া সংস্করণ।
— বুঝতে পারছি।
— ইজমের দায় মেটাতে গল্পে যৌনতা আর নীতিহীনতা মানে মানব চরিত্রের অন্ধকার দিকের কিছু ছিটেফোঁটা মেশাতে হবে, তা না হলে বোদ্ধারা নাক কুঁচকে বলবে গল্পের মধ্যে পোস্ট মর্ডানিজম বা উত্তর আধুনিকতার ছোঁয়া নেই। গল্পে যৌনতার প্রয়োজনে রেজাউলের সংসারে দূর সম্পর্কের এক শালীকে আশ্রয় দাও, ধরা যাক তার নাম ফারজানা। ২৫ বছরের চোখ ধাঁধানো সুন্দরী শালীকে দেখলে রেজাউলের শরীর জেগে ওঠে। স্ত্রীর তীক্ষ্ম নজরদারির জন্য জাগ্রত শরীর বেশীদূর অগ্রসর হতে পারে না। গল্পের এ পর্যায়টাতে একটু ইয়োইয়ো খেলবে, রেজাউল এই বুঝি ঝাপিয়ে পড়ে, এই বুঝি ঝাঁপিয়ে পড়ে পরিস্থিতি তৈরী করবে।

হেনা শব্দ করে হেসে ওঠে। পত্রিকা অফিসে দুপুরের ব্যস্ততায় সুর তুলে যায় হাসি। আশপাশের ডেস্ক থেকে দুই তিনজন চোখ তুলে তাকায়। অফিস বয় টেবিলে দুই কাপ রঙ চা আর প্লেটে চারটা বিস্কিট রেখে যায়, হেনা নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি থামায়,
— শেষ পর্যন্ত ঝাঁপিয়ে পড়বে না!
— পড়বে তো অবশ্যই। তবে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত পাঠককে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্থ অস্থিরতার মধ্যে রাখতে হবে। গল্পে কমপক্ষে একটা দরিদ্র চরিত্র থাকতে হয়, আপাতত আশ্রিত ফারজানা ওই দরিদ্র চরিত্র। এক রাতে রেজাউল পেছন থেকে তাকে ঝাপটে ধরবে বা শাড়ির আঁচল ধরে টান দিবে — এ দু’টো আচরণেই বুনো দস্যুতা আছে, পাঠকের অবদমিত যৌন আকাঙ্ক্ষা দোলায়িত করার স্পন্দন আছে। আর সুরিয়ালিস্টিক করে উপস্থাপন করতে চাইলে এভাবে লিখতে পারো— ফারজানার বুকের ওপর কিছু একটা চেপে বসেছে, শ্বাস নিতে কষ্ট প্রচণ্ড হচ্ছে, বুঝতে পারছে না ও স্বপ্ন দেখছে না জেগে আছে। ঠোঁটে কামড়ের চাপ বাড়তেই তীব্র ব্যথা আর সিগারেটের উৎকট গন্ধটা একসাথে পায়, হাঁসফাঁস করতে করতে ঘরের হালকা আলোয় চোখ মেলে তাকাতেই দেখে ক’সেন্টিমিটার দূরে রেজাউল, না রেজাউল নয়, মাকড়সার বড় বড় চোখ। ওর বুকে লোমশ বিশাল মাকড়সাটা চেপে বসছে, বড় বড় লোমশ পা গুলো শরীরে কিলবিল করছে। মাকড়সার বিষাক্ত লালায় ভরে যাচ্ছে শরীর। ফারজানা হিস্টিরিয়ার রোগীর মত কাঁপছে।

নোমানের বর্ণনায় হেনার শরীর শিরশিরিয়ে ওঠে। ও মাকড়সা খুব ভয় পায়। ওর মনে হচ্ছে চেয়ার বা টেবিলের নিচে একটা মাকড়সা ওত পেতে আছে। সুযোগ পেলেই শরীর বেয়ে উঠতে শুরু করবে। চারদিকের দেয়ালে মাকড়সা আছে কি না দেখে নোমানের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়, এক মুহুর্তেরও কম সময়ের মধ্যে নোমান চোখ ফিরিয়ে নিলেও হেনা বুঝতে পারে নোমান ওর বুকের দিকে তাকিয়ে ছিলো। ওর কাছে নোমানের চোখ দু’টোকে ক’মুহুর্ত মৃত মাছের চোখের মত লাগে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নোমান বলে,
— গল্পের মধ্যে একটু মুক্তিযুদ্ধ মেশাতে হবে। আমাদের দেশে ওটাই ভালো গল্প যার মধ্যে প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিকভাবে দারিদ্র অথবা মুক্তিযুদ্ধ রয়েছে। তুমি রেজাউল করিম খানকে শান্তি কমিটির সদস্য বানিয়ে দাও, স্বাধীনতার পর রঙ বদলে সে আরও ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী হয়েছে।

নোমান সাদা কাগজে আঁকিবুঁকি আঁকছে আর বলে যাচ্ছে,
— কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে হেনা। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে অল্প সংখ্যক মানুষ। তাদের শক্তির উৎস ছিলো পাকবাহিনী। স্বাধীনতা অর্জনের পর পর এদের একটা অংশ রাতারাতি সিক্সটিনথ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা বনে যায়। বড় অংশটা পরাজয় মেনে সাধারণ মানুষের স্রোতে মিশে যায়। আকারে ছোট আরেকটা অংশ যে রাজনৈতিক স্ট্যান্ড থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলো, ওই স্ট্যান্ড থেকে প্রকাশ্যে গোপনে রাজনীতিটা চালু রাখলো। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও তাদের প্রকট উপস্থিতি দেখানো হলে মোটেও প্রশ্ন তোলা যাবে না — তাদের রাজনৈতিক অবস্থান কেনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেছে? এ প্রশ্নও তোলা যাবে না, স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প সংস্কৃতিসহ সব কিছুর বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণ তো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির হাতেই ছিলো, তারা কেনো এদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হলো।

হেনা বিষ্ময় গোপন করে না,
— সত্যি, এ প্রশ্নগুলো মনে আসছিলো। তবে দুটো বিষয় একটু পরিস্কার করেন- সিক্সটিন্থ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা কি? রেজাউলের বয়স পঞ্চাশ বছর, স্বাধীনতার বয়স পঞ্চাশ বছর, রেজাউল শান্তি কমিটির সদস্য হয় কিভাবে?

নোমান নতুন একটা সিগারেট ধরায়, বয়কে আরেক কাপ চা দিতে বলে। মন দিয়ে হেনাকে দেখে— হেনার বয়স কত আর হবে চব্বিশ বা পঁচিশ বছর। অথচ চোখে কিশোরীর উচ্ছসিত সরলতা। কাঁধ ছোঁয়া কুচকুচে কালো কোকড়া চুল, গোল মুখে চাপা নাক আর ফোলা গালের জন্য চোখের সরলতা পুরো মুখাবয়বে সংক্রমিত হয়েছে। কলাপাতা পাড়ের মাখন রঙা মনিপুরী শাড়িতে শ্যামলা হেনাকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, বহু রঙা পালকে আবৃত কৌতূহলী এক ফিঞ্চ পাখি বসে আছে মুখোমুখি। নোমান নরম স্বরে বলে,
— একদল মানুষ যারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিলো বা সম্মুখ সমরে অংশ নেয়নি বা কোনো পক্ষেই ছিলো না, ১৬ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় ধারণ করে, এরাই সিক্সটিনথ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা। তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ, মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর বয়সে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করা সার্টিফিকেটধারী চল্লিশ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া গেলে পঞ্চাশ বছর বয়সী শান্তি কমিটির সদস্য থাকবে না কেনো!
নোমানের তীর্যক বক্তব্যে হেনা আমোদ বোধ করে,
— মানলাম রেজাউল শান্তি কমিটির সদস্য ছিলো। গল্প কি এখানেই শেষ! মানে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বয়স, কিন্তু এখনও সব অপকর্ম স্বাধীনতা বিরোধীরাই করে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা সর্বশক্তি দিয়ে অল্প কিছু স্বাধীনতা বিরোধীকে সামলাতে পারছে না, যুদ্ধ করেই যাচ্ছে যুদ্ধ করেই যাচ্ছে যুদ্ধ করেই যাচ্ছে। মানে মুক্তিযুদ্ধ চলছেই।
— মুক্তিযুদ্ধ একটা চলমান বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ চলতেই থাকবে। কিন্তু এখানে গল্প থামালে বিদগ্ধ পাঠকরা বলবে, টুইস্ট কই! গল্পে টুইস্ট নেই কেনো!
— সত্যিই তো, এ গল্পে টুইস্ট কই?

নোমান মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
— গল্পে টুইস্টের যোগান দিবে রেজাউলের দুই ছেলে। রেজাউল অতি বদ লোক, সে অপরাধের শাস্তি পায়নি, কিন্তু প্রকৃতি চরম প্রতিশোধ নিবে। তুমি তার সবচে প্রিয় সন্তানটাকে হঠাৎ পাগল বানিয়ে দিবে, বদ্ধ পাগল।
— কি বলছেন এসব! প্রকৃতি কি এভাবে প্রতিশোধ নেয়, নোমান ভাই?
— না, নেয় না। প্রকৃতি বা আমাদের সৃষ্টিকর্তা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা সদা বিরক্ত এবং প্রতিশোধ পরায়ণ রগচটা সাইকো নন। পরম মমতায় যে বা যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, সে বা তিনি এতটা উন্মাদ নন যে একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দিবেন।

হেনা চমকে ওঠে,
— এমন করে বলবেন না, বিপদে পড়ে যাবেন। টুইস্ট’টা বলেন?
— প্রথম টুইস্ট রেজাউলের এক সন্তানের পাগল হয়ে যাওয়া। তবে বড় টুইস্টটা দ্বিতীয় ছেলেকে দিয়ে দেখাবে। রেজাউলের দূর সম্পর্কের আশ্রিত শালী ফারজানা এবং দ্বিতীয় ছেলে সমবয়সী, দু’জনের গভীর প্রেম।
— বলেন কি! এ তো মারাত্মক টুইস্ট।
— শুধু টুইস্ট’ই দেখলে, হেনা! এর মধ্যে ট্যাবু ভাঙা আছে, মানব মানবীর দুর্নিবার প্রেম আছে। গল্পের এ পর্যায়ে তুমি রেজাউলের প্রতি ঘৃণাটা গাঢ় করে দিতে পারো— রেজাউল যখন জেনে যায় ছেলের সাথে ফারজানার প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে, তখনই ফারজানার শরীরের প্রতি তার লোভ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে।

গল্পের ফরমুলা হেনার পছন্দ হয়েছে, নিখিলবঙ্গ প্রগতিশীল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য গল্প পাঠানোর শেষ তারিখ আগামী মাসের ২২তারিখ, হাতে প্রায় মাস খানেক সময় রয়েছে। গল্পটা নামিয়ে ফেলা যাবে। হেনা জানতে চায়,
— গল্পের শেষটা কি হবে?
— ফারজানা, রেজাউল বা রেজাউলের দ্বিতীয় ছেলে— এদের যে কোনো একজনকে খুন করে গল্পটা শেষ করা যায়, কিন্তু আরও কিছু অতি জরুরী উপাদান বাকী রয়ে গেছে।
— কি উপাদান?
— সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, দারিদ্রের কষাঘাত, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন।

আকাশ থেকে পড়ার দশা হেনার,
— এক গল্পে এতকিছু! কিভাবে সম্ভব!
— খুব সহজেই সম্ভব। বাবার কু-কর্মের কথা জেনে ফারজানাকে নিয়ে রেজাউলের ছেলে পালাবে। বাস ছুটছে। রেজাউলের ছেলের মনে হবে গত সরকারের আমলে একবার এ রাস্তা দিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলো। ভাঙা রাস্তায় অনবরত ঝাঁকির কারনে পেট ব্যথা হয়ে গিয়েছিলো। এখন কোনো ঝাঁকি নেই, রাস্তাগুলো যেনো মাখন দিয়ে তৈরী। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বাস পদ্মা সেতুতে উঠবে। এই সেতুটার বিরুদ্ধে কত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র যে হলো, সব ষড়যন্ত্র নস্যাত করে প্রধানমন্ত্রী সেতুটা তৈরী করে দিলেন। রেজাউলের ছেলে ফারজানার ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাসের জানালা দিয়ে তারা ভরা আকাশ দেখবে, সে জানে তারার ভিড়ে জেগে আছে স্যাটেলাইট, সে স্যাটেলাইট কি জানে পৃথিবীর সবচে রূপবতী মেয়েটা তার পাশে বসে আছে। বাস পদ্মা সেতু পাড়ি দিচ্ছে, পদ্মার স্রোতে আলোর নান্দনিক খেলা। কাঁধে মাথা রেখে ঘুমের গভীর সমুদ্রে সাবমেরিনের মত ডুব সাতার দিচ্ছে ফারজানা, বাসের স্পিকারে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা গাইছেন ‘এমনি করে যায় যদি দিন যাক না।’

হেনার মনে প্রশ্ন জাগে — নোমান কি রসিকতা করছে! কিন্তু চেহারা দেখে আর কণ্ঠস্বর শুনে তা মনে হচ্ছে না। নোমান এশট্রেতে ঘষে সিগারেটের আগুন নেভায়, ফিল্টারটা ভিতরে ফেলে বলে,
— অসাম্প্রদায়িক চেতনার অংশ হিসেবে রেজাউলের ছেলে এক হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিবে। বন্ধুটি ওদের সেবাযত্মের চূড়ান্ত করবে। কাজী ডেকে বিয়ে পড়াবে। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী মিলে নফল নামাজ আদায় করবে, হিন্দু বন্ধুটি ওই সময় ঘরে দেব-দেবীর মূর্তি ও ছবিগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিবে, যাতে নামাজ আদায়ে সমস্যা না হয়।

— বাহ! বাহ! বেশ বলেছেন। পরের অংশটা মনে হয় ধরতে পারছি। এ সংবাদ রেজাউলের কানে পৌছাবে, রেজাউল ছেলেকে শায়েস্তা করতে হিন্দু পাড়ায় আক্রমণ চালাবে। ঘটনা গড়াবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায়। এই তো?
— ঠিক তাই। হামলার পাশাপাশি অভাবগ্রস্ত হিন্দু মুসলমানদের ফোকাস করে গল্পে দারিদ্রের কষ্টের ছবি আঁকবে। তবে দারিদ্রের কারণ বা রেজাউলের ক্ষমতার উৎস সম্পর্কে কিছু বলা যাবে না। রেজাউল এমনি এমনি ক্ষমতাবান, ক্ষমতাসীন কারো মমতার ছায়া তার ওপর নেই, থাকলেও তা বিরোধী দলের।
— নোমান ভাই, তাই হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭মার্চের ভাষণ কি সত্যিই এই গল্পে প্রাসঙ্গিক? গল্পের প্রয়োজনে ব্যবহার হবে!

নোমান হাই তুলে, মোবাইল অন করে সময় দেখে, সাদা কাগজে আঁকিবুঁকি করতে করতে বলে,
— পুরস্কারের জন্য গল্প লেখা হচ্ছে— এ গল্পে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থাকবে না! গল্পের প্রয়োজনেই তো সবকিছু আসছে, ভাষণও আসবে। হিন্দু পাড়ায় হামলার পর হিন্দু এবং মুসলিম প্রতিবেশীরা মিলে হামলাকারীদের প্রতিরোধ করবে। প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিবে রেজাউলের ছেলে, তার মনে বেজে চলবে বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত কণ্ঠের ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
— গল্পের শেষটা কি হবে?
— গল্পটা বেশ ক’ভাবে শেষ করা যেতে পারে, যেমন রেজাউলের ইন্ধনে সংঘটিত হামলায় ছেলে মারা যাবে, ফারজানাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। অথবা, রেজাউলকে বিষ খাইয়ে হত্যা করে আত্মঘাতী হবে স্ত্রী। আরও ভয়াবহও শেষ হতে পারে, রেজাউলের ছেলে মারা যাবে, ফারজানার গর্ভে বেড়ে উঠবে রেজাউলের সন্তান।

হেনা বলার মত কোনো কথা খুঁজে পায় না, নোমান তাকে উদ্ধার করে,
— গল্পের ঝোপ বুঝে সীমিত পরিমাণে কাফকা, মারকেজ আর চমেস্কির কোপ মারতে হবে। তুমি আগে গল্পটা লিখে ফেলো, তারপর ঝোপ বুঝে বুঝে লাগসই কোপ মারা যাবে।

হেনা হ্যা সূচক মাথা নাড়ে, আগ্রহ ভরে জানতে চায়,
— আচ্ছা, রেজাউলের ছেলে মানে দ্বিতীয় ছেলের নাম কি দিবো? আর, নোমান ভাই, গল্পটা আপনি লিখছেন না কেনো?

কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবে নোমান, চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলে রাখে, হেনার চোখে তাকিয়ে বলে,
— দ্বিতীয় ছেলের নাম দিও নোমান, নোমান করিম। আর রেজাউলের ছেলেদের এমন গল্প লিখতে নেই।

নোমানের এ কথা কি শুধুই টুইস্ট! ইংগিতপূর্ণ রসিকতা! অথবা নিরেট বাস্তবতা— হেনা একই সাথে বিভ্রান্ত, বিস্মিত এবং আশ্চর্যান্বিত। টেবিলের অপরপাশে এ ফোর সাইজের সাদা কাগজের এক পিঠে আঁকিবুঁকি শেষে অপর পিঠে আঁকিবুঁকি কাটছে জনপ্রিয় দৈনিকের তরুণ সাহিত্য সম্পাদক নোমান করিম।

ম্যা’ক্রেটিস

‘২টা মাঝারি সাইজের বুদ্ধিজীবি বিক্রয় করা হবে। ঘাড়ের হাড্ডি নরম, সহজেই সামনের দিকে ঝুঁকে যায়। মেরুদণ্ড ফ্লেক্সিবল। হাতের রেখা মুছে গেছে। দীর্ঘদিন পাম ওয়েল বিক্রি এবং ম্যাসেজ পার্লারে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।’ বুদ্ধিজীবী দু’জন বিমর্ষ দৃষ্টিতে বিজ্ঞাপনটির দিকে তাকিয়ে আছেন। দেশের জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকায় টানা ৩দিন ধরে বিজ্ঞাপনটি ছাপানো হচ্ছে, কিন্তু কেউ যোগাযোগ করেনি। কারোই বুদ্ধিজীবী কেনার আগ্রহ নেই।

চাহিদা হ্রাস পেলে পণ্যের দাম কমে- চাহিদা ও যোগান তত্বের ওপর দীর্ঘ আলোচনা শেষে নির্ধারিত হলো তিন দিন বিরতি দিয়ে ফের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হবে। তবে এবার প্রথম লাইনটার আগে যোগ হবে, ‘একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি।’

নতুন করে বিজ্ঞাপন প্রকাশের দিনেই প্রথম কল এলো। স্পিকার চালু করে কল রিসিভ করলেন বুদ্ধিজীবীদের একজন-

: হ্যালো। কে বলছেন?
: আমি মোয়াজ্জেম। গাবতলী হাটের গরুর লবিস্ট।
: গরুর লবিস্ট মানে!! আপনি কি গরুর দালাল?
: জ্বি, স্যার। ওই একই হইলো।

প্রচণ্ড বিরক্তি এবং তুমুল কৌতূহল নিয়ে বুদ্ধজীবী জানতে চাইলেন-
: আপনি এখানে ফোন করেছেন কেনো?
: স্যার, একটা রিকুয়েস্ট – দয়া কইরা বিজ্ঞাপনটা আর ছাপায়েন না। পেটে লাত্তি মাইরেন না।
: শাট ইউর মাউথ স্টুপিড। আমরা বিজ্ঞাপন ছাপালে তোর সমস্যা কি!

এসব গালিগালাজ গায়ে না মেখে মোয়াজ্জেম কান্নাজড়িত স্বরে বললো-
: স্যার, আপনাদের বিজ্ঞাপনের কারণে ভেড়ার বাজারে ধ্বস নামছে। ছাগলের দাম কইমা গেছে আর
মোয়াজ্জেমকে ‘ফাক ইউ’ বলে গালি দেবার আগেই মোয়াজ্জেম যোগ করল-
: আপনাদের দুইটারে গরুর হাটে বলদ হিসাবে বেঁচতে তুললে ব্রয়লার মুরগির দাম দিয়াও কেউ কিনবো না।

সব কথা গায়ে মাখলে, গুরুত্ব দিলে বুদ্ধিজীবী হওয়া যায় না। বুদ্ধিজীবী হওয়া কি সহজ কথা! বুদ্ধিজীবীতা এক অতিপক্ক কাঁঠাল, কোষ গলে ল্যাদল্যাদে, বহু বিঁচির গর্বে বলীয়ান ভুতি গরুর প্রিয় খাদ্য, মাছির আবাস।

কওওও

এই শহরে কেউ কথা বলেনা, তবু সব কথা ছড়িয়ে যায় কানে কানে।

মন্ত্রী পরিষদ জিরাফের দামে খরগোশ কেনার সিদ্ধান্ত নিতেই রাজ্য জুড়ে হুহু হাওয়া বয়ে যায় –‘চুপ.. চুপ.. চুপ… বিনে পয়সায় তো আর কিনেনি.. চুপ.. চুপ.. চুপ… খরগোশ বড় হলেই জিরাফ হয়…।’ হাওয়া জানে এই শহরে কেউ কথা বলেনা, এই বলা তার অভ্যাসের দায়।

সিংহাসনের গদিতে মখমল লাগানোর জন্য ডলফিনের দামে সমুদ্রটা বেঁচে দেবার আগে রাজা বললেন, ‘মহাকাশে গড়ে তুলবো প্রজাপতির খামার, মেঘে মেঘে বুনে দিবো সমুদ্রের বীজ- এ নিয়ে আর কোনো কথা নয়।’ রাজাও জানেন এই শহরে কেউ কথা বলেনা, এই বলা তার অভ্যাসের দায়।

সেদিন সন্ধ্যায় আকাশ লাল। ক’দিন ধরেই গুমোট গরম চলছিলো। আকাশের লাল ও গুমোটের গরমে এ শহর প্রতিক্রিয়াহীন, শুধু হাওয়ার অস্বস্তি– ‘চুপ.. চুপ.. চুপ.. প্রজাপতির খামারে আগুন লেগেছে, সমুদ্রের বীজগুলোকে ভস্ম করে দিচ্ছে তাপ.. চুপ.. চুপ.. চুপ.. ভস্ম ছড়ালেই সমুদ্র হয়…।’

সন্ধ্যা শেষে নামে বৃষ্টি, তুমুল ঝমঝমিয়ে। রাজবাড়ির দেয়ালে ঠেসে ধরে প্রজাপতিমন্ত্রীকে গুলি করে কারাগার ভাঙা তিন কয়েদী। প্রজাপতি মন্ত্রীর ছটফটানো পাখায় থুথু দিতেই জিরাফ মন্ত্রীর বিশাল গলা শুকোরের মত ছোট হয়ে আসে, তীব্র শ্বাসকষ্টে খাবি খেতে খেতে দেখে রাজাকে গিলে খাচ্ছে ডলফিন। উথাল পাথাল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে রাজপ্রাসাদ।

এই শহরে কেউ কথা বলেনা, তবু সব কথা ছড়িয়ে যায় কানে কানে। তাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হাওয়া সম্বিৎ ফিরে পেতেই বয়ে যায়, বয়ে যেতে যেতে বলে যায় ‘চুপ… চুপ.. চুপ.. … চুপ.. চুপ.. চুপ… চুপ.. চুপ.. চুপ..।’ কথা না বলার অভ্যাস ভুলে বহুদিন পর ডেকে ওঠে এক বউকথা পাখি, ‘কেউ কথা কও.. কেউ কথা কওও.. কওওও…।’

রূপকথাঃ এক যে বাঘ

প্রাপ্তবয়স্কদের রূপকথা, ছোটরা এড়িয়ে যাও-

তারপর হলো কি শিয়াল এসে দেখে বাঘ বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে। বাঘের চোখ বন্ধ, কপালের চামড়া ব্যাথায় কুঁচকে আছে। শিয়াল জিজ্ঞেস করলো,
– বাঘ মামা, কি হয়েছে! পেটে গ্যাসের ট্রাবল না এপেনডিসাইটিসের পেইন?

বাঘ এপাশ-ওপাশ করতে করতেই চোখ খুলে তাকালো, তারপর চোখ বন্ধ করে কাতর স্বরে বললো,
– শিয়াল পণ্ডিত যে! তা কখন এলে?

“পণ্ডিত” বললে শিয়ালের খুব রাগ হয়। তোমরাই বলো, শিয়ালের সেই পণ্ডিতির যুগ কি আর আছে! টকশোজীবী এবং চারুকলা ও বুয়েটের কমার্স বিভাগের বিজ্ঞানীরা এখন সর্ববিষয়ে পণ্ডিতি করে। এসব দেখে শিয়ালের খুব কষ্ট হয়। হাজার বছরের ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে ওরা শিয়াল পণ্ডিতের লাখ বছরের পণ্ডিতির ঐতিহ্যটাও দখল করে নিয়েছে। এপ্লায়েড হিস্ট্রি এন্ড সহমতিয়ান ফিলোসফিতে পিএইচডিধারী ড. শিয়াল তাই নামের শেষে ‘স্যার’ সম্বোধনেই স্বস্তিবোধ করতেন।

সম্প্রতি ঘটেছে আরেক কাণ্ড, তোমাদের মত একদল দুষ্টু কি করেছে শুনো, সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা “স্যার” সম্বোধনটা “ড. শিয়াল”-এর আগে বসিয়ে ভাইরাল করে দিয়েছে। সবাই এখন তাকে ডাকে “স্যার ড. শিয়াল”।এই সম্বোধনে প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি হলেও ‘নাইটহুড’ ছাড়াই ‘স্যার’ বানিয়ে দেওয়ায় শিয়াল কিন্তু দুষ্টদের সকল দুষ্টুমি ক্ষমা করে দিয়েছে। বাঘের প্রশ্নের উত্তরে শিয়াল বললো,
– বাঘমামা, স্যার শিয়ালকে তুমি শিয়াল পণ্ডিত ডাকছো কেনো! শরীর কি বেশী খারাপ! মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে!

শিয়ালের কথায় বাঘ চোখ মেললো। চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে। শিয়ালের চোখে চোখ রেখে হুংকার দিলো,
– মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ। আমি কি ইন্সটিট্যুট অফ চা-ছপ-সিঙ্গারা-সমুচা ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজির ভিসি টাইগারুজ্জামান যে তুমি আমাকে ‘মামা’ সম্বোধন করে ডাকবে! বহুবার বলেছি আমাকে “মাননীয় বাঘমশাই” বা “বিকল্পহীন বনরাজ” বলে ডাকবে, এই নামে ডাকতে সমস্যা হলে “লিডার” বলে ডাকবে।

বাঘের হুংকারের শুরুতেই ঘরের দেয়ালে থাকা দু’টো টিকটিকি আর জানালার বাইরে চড়তে থাকা ক’টা রামছাগল কানখাড়া করেছিল। বাঘের হুংকার শেষ হতেই তারা একসাথে শ্লোগান দিলো, “সহমত লিডার.. সহমত লিডার।” সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের শ্লোগানে বাঘের মন কিছুটা নরম হলো।

তারপর হলো কি, শিয়ালের কানের কাছে মুখ নিয়ে বাঘ ফিসফিসিয়ে বললো,
– ইউ হ্যাভ টু বুঝতে হবে মাই কৌশল অব ক্যারিশমাটিক লিডারশিপ। আমি রোজ লাঞ্চ আর ডিনারে মাটন তেহারি খাচ্ছি তবু রামছাগলরা ‘সহমত লিডার’ শ্লোগান দিচ্ছে। সো, নো হাংকিপাংকি, ডোন্ট কল মি “মামা”, ক্লিয়ার স্যার ড. শিয়াল!”

বাঘের কথায় শিয়াল ভয় পেয়েছে। তবু ভয় না পাওয়ার অভিনয় করে ভক্তি ভয়গদগদ কণ্ঠে বললো,
– সহমত লিডার। এই জঙ্গলে তুমি আমাদের ‘বনবন্ধু।” কেউ পারলে তোমার বিকল্প দেখাক, চ্যালেঞ্জ দিলাম।মাই বক্তব্য কি ইউর কাছে ক্লিয়ার, লিডার!

শিয়ালের কথা শেষ হতেই সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের নেতা-কর্মীরা শ্লোগান দিলো, “সহমত স্যার শিয়াল.. সহমত স্যার শিয়াল.. আমাদের লিডারের কোনো বিকল্প নেই।” শিয়ালের বক্তব্য আর শ্লোগানে বাঘের মন ভালো হলেও শরীর কিন্তু খারাপ। বাঘ আবার এপাশ-ওপাশ করতে শুরু করায় শেয়াল বললো,
– লিডার, চলো তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।

বাঘ হুংকার দিলো,
– ডোন্ট আন্ডার ইস্টিমেট মি, স্যার ড. শিয়াল। আমি আমেরিকার কম্পাউন্ডারের কাছে যাই, ইউরোপের ওয়ার্ড বয়ের কাছে, পাশের জঙ্গলের কবিরাজের কাছে যাই, কিন্তু ইউ হ্যাভ টু বুঝতে হবে, এই জঙ্গলের একটা প্রোটোকল আছে, এখানে ডাক্তারকে হাসপাতালসহ আমার কাছে আসতে হয়।

শিয়াল ‘স্যরি’ বলে দ্রুত ডাক্তারকে ফোন করলো। ডাক্তার পুরো হাসপাতাল কাঁধে চাপিয়ে চলে এলো, বাঘের শরীরে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললো,
– আওয়ার সুপ্রিম লিডার, আপনার ব্লাড প্রেসার হাই। হার্টে ব্লক। মগজে ময়লা (গোবর বলার সাহস পেলো না) জমেছে।

বাঘ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো,
– জঙ্গলের উন্নয়নের চিন্তা করতে করতে ঘুমোতে পারি না। জানো ডাক্তার, জঙ্গলের উন্নয়নের জন্য নিজেকে শেষ করে দিচ্ছি। এখন কি করতে হবে?

ডাক্তার কি না ডাক্তার, চিকিৎসার কথা তাকে বলতেই হবে। তাই সে বললো,
– আওয়ার সুপ্রিম লিডার, এক্কেবারে রেড মিট খাওয়া যাবে না। নো সুগার। কোলেস্টেরল ও ফ্যাটি খাবার নিষিদ্ধ। রাত জেগে জেগে নো হুইস্কি, নো ভদকা, হু। টেনশনও করা যাবে না।

“তেইলে কি আমি এনার্জি বিস্কুট আর মামপানি খায়া বাঁচুম” বলে বাঘ হুংকার দিতে যাচ্ছিলো, কিন্তু এর আগেই ডাক্তার কোমল স্বরে বললো, ‘আওয়ার সুপ্রিম লিডার, উত্তেজিত হবেন না, স্ট্রোক হতে পারে। হার্ট এটাক হতে পারে। কন্ট্রোল ইওরসেল্ফ।” ডাক্তারের কথা শুনে সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের নেতা-কর্মীরা দারুণ উত্তেজনায় দু’বার “সহমত ডাক্তার.. সহমত ডাক্তার.. লিডারের স্ট্রোক আর হার্ট এটাকের বিকল্প নাই.. লিডারের স্ট্রোক আর হার্ট এটাকের বিকল্প নাই” শ্লোগান দিলো এবং ভুল বুঝতে পারার সাথে সাথে দুই হাতে দুই কান ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।

‘কানে ধরার’ ব্যাপারটা দেখে বাঘের উত্তেজনা কিছুটা কমলো,
– ডাক্তার, তবে আমি খাবো কি?
– সুপ্রিম লিডার, আপনি ডায়েট করবেন। সকালে আর রাতে ওটস এন্ড মিল্ক। দুপুরে ভেজিটেবল স্যুপ।

বাঘের মন খুব খারাপ হলো, কিন্তু সুস্থ থাকতে হলে ডাক্তারের কথা মানতেই হবে। বাঘ বললো,
– খাওয়া না হয় ঠিক করলাম। টেনশন কমাবো কিভাবে?

ডাক্তার বললো,
– আওয়ার সুপ্রীম লিডার, আপনার বয়স হয়েছে, বিশ্রাম দরকার। অনেক তো হলো, এবার অন্য কাউকে দায়িত্ব দিয়ে বিশ্রাম নিন।

বাঘ মনে মনে ডাক্তারকে “বিএনপি-জামাত” বলে গাল দিয়ে প্রশ্ন করলো,
– দায়িত্ব তো দিতে চাই, কিন্তু কে নিবে! অন্য কাউকে দায়িত্ব দিবো কিভাবে? আমার ছেলে বা মেয়েকে দায়িত্ব দিলে এই জঙ্গলের বজ্জাতগুলো কি মেনে নিবে?

বাঘ ভেবেছিলো ডাক্তার বলবে “মানবে না কেনো, বজ্জাতগুলোর চৌদ্দ দু গুণে আটাশ গুষ্টি মানবে”, কিন্তু ডাক্তার সঙ্কোচ ও ভয়ে ভয়ে বললো,
– আওয়ার গ্রেট লিডার, আপনি টেনশন করবেন কেনো! একটা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে অনুষ্ঠান হলে জঙ্গলবাসীরা ভোট দিয়ে নিজেদের নেতাকে বাছাই করে নিবে। যাকে বলে ডেমোক্রেটিক সিস্টেম।

ডাক্তারের কথার প্রতিবাদে বাঘ হুংকার দিলো,
– বজ্জাতগুলো সঠিক নেতাকে ভোট দিবে ভেবেছো! সঠিক নেতাকে ভোট দিলে কি দিনের নির্বাচন আমাকে রাতে করাতে হয়? এই জঙ্গলের উন্নয়নে আমি কি না করেছি, তুমিই বলো। আমার কি কোনো বিকল্প আছে?

“উন্নয়নের মাইনকা চিপায়, জনগণের বিঁচি হাঁপায়” বলতে গিয়েও ডাক্তার নিজেকে সামলে নিলো। তবে সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের নেতা-কর্মীরা কান ধরা অবস্থাতেই শ্লোগান দিলো, “সহমত লিডার, আপনার কোনো বিকল্প নাই। সহমত লিডার, আপনার কোনো বিকল্প নাই।”

ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে শিয়াল বললো, “আমাদের বিকল্পহীন বনরাজ থাকতে আবার ইলেকশন কিসের! তোমরা যারা ডাক্তারি করো তাদের বলছি, আমরা কি এমন চিকিৎসা চেয়েছিলাম!”

সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের শ্লোগান এবং স্যার শিয়ালের বক্তব্য বাঘের রাগ বা টেনশন কমাতে পারলো না। নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা শুনলেই এমনিতেই বাঘের টেনশন হয়। ভোটের মৌসুমে টেনশনের সাথে রাগ আর ভয়ও হয়। টেনশন হলে ব্লাডপ্রেশার বাড়ে; ব্লাড প্রেশার বাড়লে রাগ বাড়ে; রাগ বাড়লে আবার টেনশনও বাড়ে- অনেকটা নাইট্রোজেন চক্রের মত (দেখলে আমিও সায়েন্স জানি)।

বাঘের টেনশন বাড়ায় রাগও বাড়ছে.. বাড়ছে.. বাড়ছে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে বাঘ একলাফে ডাক্তারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ডাক্তারকে চেটেপুটে খাওয়ার পর বাঘের রাগ কমলো। রাগ কমায় টেনশন কমলো। টেনশন কমায় ব্লাড প্রেশার প্রায় স্বাভাবিক হলো। ডাক্তারের একটা হাড় শেয়ালের দিকে ছুড়ে দিয়ে বাঘ হাসতে হাসতে বললো,
– স্যার শিয়াল, আমার বয়স হয়েছে। আমি আর রাজা থাকবো না। তোমরা তোমাদের নতুন রাজা বেছে নাও, আমাকে মুক্তি দাও।

শিয়াল মনেমনে “শালার বাঘ, নতুন নেতা বাইছা নিতে গেলে তুই আমারে কি করবি তা কি বুঝি না! আমি কি মফিজ!” বললেও মুখে বললো,
– এমন কথা বইলো না লিডার। এমন কথা বললে উন্নয়ন পাপ দিবে।

বাঘ অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো,
– উন্নয়নেও পাপ দেয়! তা উন্নয়নে কি পাপ দিবে?
শিয়াল এপ্লায়েড হিস্ট্রি বইয়ের পাতা উল্টে একটা পাতা বের করে বললো,
– কবি বলেছেন– উন্নয়নে দিলে পাপ
সবার আগে ভাগে বাপ।”

শিয়ালের কবিতা শুনে সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের নেতা-কর্মীরা বাঘের দিকে তাকাতেই বাঘ বললো,
– শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকতেও ভাগবো না। এর আগে ভাগি নাই, চিকিৎসার জন্য এমাজনের জঙ্গলে গিয়েছিলাম।

সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের নেতা কর্মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই শিয়াল আরেকটা পাতা খুলে উঁচু স্বরে আবৃত্তি করলো,
– হাতেনাতে পড়লে ধরা জনগণের ফান্দে
একটানেতে বিঁচি ছিড়ে ঝুলিয়ে দিবে কান্দে।

এমন পাপের কথা শোনার সাথে সাথে সম্মিলিত টিকটিকি ও রামছাগল জোটের নেতা-কর্মীরা কান ছেড়ে দুই হাতে ব্যক্তিগত ইউটিউবের সাবস্ক্রাইবার বেল-বাটন ঢেকে ফেললো। বাঘও নিজের লেজটা দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে ভিতরে গুটিয়ে নিলো, যেনো ওর বেল বাটন দেখা না যায়।

তারপর হলো কি, বাঘের নির্দেশে সবাই এখন কবিকে খুঁজছে। তোমাদের পরিচিতদের মধ্যে কেউ কবি থাকলে তাকে সাবধানে থাকতে বলবে। আর ডাক্তারের পরিবারের কাউকে চিনলে জানিয়ে দিবে যে ডাক্তার স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে আছে। ভাগ্যিস, আমরা জঙ্গলে থাকি না, আমাদের দেশের মত উন্নত দেশে এমনটা ভাবাও যায় না।

আজ এই পর্যন্তই, মনে রেখো- লোডশেডিং আছে বলেই এমন রূপকথা শুনতে পাচ্ছো, লোডশেডিং নিয়ে কোনো দুষ্টুমি করবে না, হু।

ইঁদুর কলের টোপ

Rat “বুঝলে, দিনে দুটো খেতাম, আজ থেকে একেবারেই ছেড়ে দিলাম” বলে বাবা ম্যাচটা মা’র হাতে ফিরিয়ে দিলেন। মা বহুবার বাবাকে সিগারেট ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেছেন, বাবা ছাড়েন নাই। তবে বাবা শোভনের সামনে সিগারেট খায় না। বাবার শার্টে গন্ধ লেগে থাকে। কড়া গন্ধটা শোভনেরও ভালো লাগে না। বাবা আর সিগারেট খাবে না- এমন সিদ্ধান্তে মা’র খুশি হবার কথা। কিন্তু মা’র চেহারা মলিন হয়ে এলো। মা’র চোখ দু’টো ছলছল করছে। নাকের ডগায় লালচে আভা। মন খুব বেশী খারাপ হলে মা’র নাকের ডগা এমন লাল হয়ে ওঠে। বাবার সিদ্ধান্তে মা’র কষ্ট পাওয়ার কারণটা শোভন ধরতে পারে না। এবার জন্মদিনে গ্রাম থেকে দাদু ফোন করে বলেছেন, “দাদাভাই, তুমি আট বছরে পড়লে! মাশাল্লাহ। তুমি তো বড় হয়ে গেছো।” তবু শোভন বড়দের ব্যাপারগুলো বুঝতে পারে না।

মা মুখ মুছার ছলে শাড়ির আঁচল দিয়ে ভিজে আসা চোখ আর নাকের ডগা মুছেন, কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন “চা খাবে! একটু চা কইরা দেই!” চা বাবার খুব পছন্দ। বাবা মগভর্তি চা হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে বা বিছানায় হেলান দিয়ে ধীরে ধীরে চুমুক দেয়, বই বা পত্রিকা পড়ে, কোনো কোনো রাতে চায়ের মগ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে, বাড়ির সামনের রাস্তাটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে আর আয়েশ করে চা খায়- শোভনের দেখতে খুব ভালো লাগে। শোভনের খুব চা খেতে ইচ্ছে করতো, মা দিতেন না। এখন দেন। যে সকালগুলোতে ঘরে ডিম থাকে না, শোভন নাস্তায় চায়ে পরোটা ভিজিয়ে খায়। শোভনের এখন বাবার সাথে চা খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ওকে বিস্মিত করে বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন, “না, না। এখন কষ্ট করে চা বানাতে হবে না। ভাবছি কাল থেকে সকাল ছাড়া চা খাওয়াটাও বন্ধ করে দিবো, কি বলো!” মা কিছুই বললেন না। বিছানায় বসে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপনের চেষ্টা করলেন, কিন্তু ব্যর্থ হলেন।

বাবা সত্যিই চা খাওয়া ছেড়ে দিবেন- বড়দের কখন যে কি হয় শোভন বুঝতে পারে না। দু’বছর আগে করোনা ভাইরাস এলো– অফিস বন্ধ, স্কুল বন্ধ। বাবা অনেকদিন অফিসে যাননি। ঘরবন্দী বাবা সারারাত ঘুমোতে পারতেন না। চিন্তা করতেন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। তবে শোভনের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। ও বুঝতো বাবা অভিনয় করছে। কারণ বাবার মিথ্যে হাসিতে চেহারার চিন্তারেখাগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠতো। তখন কি সব হিসেব নিকেষ করে বাবা দিনে পাঁচটা সিগারেট থেকে কমদামী দু’টা সিগেরেটে নেমে এসেছিলেন। মা’ও অনেক চিন্তা করতেন। কিন্তু বাবাকে স্বাভাবিক স্বরে বুঝাতেন, “এতো চিন্তা কইরো না তো। চিন্তার চাপে তোমার কিছু হয়া গেলে আমাদের কি অবস্থা হইবো সেইটা ভাইবো! টেনশন কইরা লাভ নাই, দেইখো সব ঠিক হয়া যাইবো।” বাবা শুধুই হাসতেন। আকুল কান্নার মত করুণ সে হাসি! বিষাদমাখা স্বরে মা’কে বলতেন, “হুম, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের যা যাচ্ছে তা এক্কেবারেই যাচ্ছে। তিল তিল করে গড়ে তোলা সঞ্চয়, তোমার গহনা, শোভনের ভবিষ্যতের জন্য ব্যাংকে রাখা ফিক্সড ডিপোজিট- সব.. সব।”

করোনার পর বাবার অফিস খুললো। শোভন ভেবেছিলো সব আগের মত হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই আগের মত হলো না। বাবা আর মা’ও আগের মত হতে পারলেন না। চেষ্টাও করলেন না। শোভনের বিশ্বাস- ও আগের মতই আছে। আবার মনে সন্দেহও জাগে- সবার মত বদলে গেছে। একরাতে আলুভর্তা আর ডাল দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে বললেন, “আর পারছি না। বাড়িটা বদল করতে হবে।” বাড়ি বদলের কথা শুনে শোভনের মন খারাপ হলো। দুই বেড রুমের এই ফ্ল্যাটে শোভনের নিজের একটা রুম আছে। মা খুব সুন্দর করে রুমটা সাজিয়ে দিয়েছেন। রুমের একপাশের দেয়ালে মিকি মাউজ আর মিনি মাউজ হাসছে। বিছানার পাশের দেয়াল আর পুরো সিলিং জুড়ে বাবা ছোট-বড় অনেকগুলো তারা লাগিয়ে দিয়েছেন। তারাগুলো অন্ধকারে মিটমিট করে জ্বলে। রাতে ঘুম ভাঙলে শোভনের মনে হয় ও খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে। রুমের পাশে গ্রিলঘেরা ছোট বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাশের ফ্ল্যাটের রুমনের সাথে কথা হয়। শোভনের মনে পড়ে, রুমনরা গত মাসে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। শোভনদের ফ্ল্যাটে ঢুকার দরজা থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত লম্বা জায়গাটার মাঝখানে মা পর্দা টানিয়ে ড্রইং আর ডাইনিং রুম বানিয়েছেন । এই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে নতুন ফ্ল্যাটে যাওয়ার কি প্রয়োজন শোভন বুঝতে পারে না।

পরের মাসেই বাড়ি ছাড়া হলো। বাড়ি ছাড়ার আগের দিন বাবা সোফাসেট, ডাইনিং টেবিল আর শোভনের খাটটা বিক্রি করে দিলেন। নতুন ফ্ল্যাটের জন্য নতুন সোফাসেট, ডাইনিং টেবিল ও বিছানা কেনা হবে ভেবে শোভন খুশি হয়েছিল। কিন্তু নতুন ফ্ল্যাটে এসে ওর ছোট বুকটা গভীর বিষাদে ডুবে ছিল। এই ফ্ল্যাটে একটা মাত্র বেড রুম। রান্নাঘরের সাথে সামান্য খোলা জায়গায় মা শোভনের পড়ার টেবিলটা গুছিয়ে দিয়েছেন। এই ফ্ল্যাটে শোভনের নিজের রুম নেই- ওর খুব কষ্ট হয়। আবার বাবা-মা’র মাঝখানে ঘুমোতে পারে বলে আনন্দও হয়। স্কুলে যেতে ও আসতে প্রতিদিন সাত তলায় উঠা-নামা করতে হয়। লিফট নেই, ছোট পায়ে অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙে উঠা-নামা করতে কষ্ট হয়। বাবা-মা’র রুমের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকখানি আকাশ আর গলি থেকে বড় রাস্তা পর্যন্ত যাওয়া পথটা স্পষ্ট দেখা যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশে বা রাস্তায় তাকালেই শোভনের মন ভালো হয়ে যায়।

বাড়ি বদলের সাথে আরও অনেক কিছুই বদল গেল। আগের ফ্ল্যাটে থাকতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে শোভনকে নিয়ে বাবা আর মা বেড়াতে যেতেন। মাঝে মাঝে ফাস্টফুডের দোকানে বসে শোভনকে বার্গার বা ক্রিস্পি চিকেন ফ্রাই খাওয়াতেন। মা ফুচকা খেতেন। বাবা শুধু চা খেতেন। এখন এক একটা শুক্রবারে বাবা বলেন, “চল বাবাই, একটু ঘুরে আসি।” পার্কের পাশে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে বাবা প্রশ্ন করেন, “বাবাই, তুই কি খাবি- ঝালমুড়ি, ফুচকা, বার্গার না চিকেন ফ্রাই!” শোভনের বার্গার বা চিকেন ফ্রাই খেতে ইচ্ছে করে। বড়দের অনেক কিছু বুঝতে না পারলেও বাবা কোন উত্তরে স্বস্তিবোধ করবেন তা বুঝতে পারে। শোভন বলে, “ঝালমুড়ি খাবো। কাঁচামরিচ ছাড়া ঝালমুড়ি।” যেদিন বেতন হয়, শোভনের জন্য বাবা বার্গার বা ক্রিস্পি চিকেন ফ্রাই বা পোলাও আনবেনই আনবেন। পোলাও শোভনের খুব প্রিয়, নতুন ফ্ল্যাটে আসার পর ঈদের দিন ছাড়া মা একদিনও পোলাও রান্না করেনি।

মানুষ শিক্ষাশ্রয়ী প্রাণী। শিক্ষাকে আশ্রয় করে মানুষ বেঁচে থাকে। শিক্ষাই মানুষকে শেখায় মানিয়ে নেওয়া এবং মেনে নেওয়া এক নয়। বেঁচে থাকার অনিবার্য ধাওয়ায় অসহনীয় বাস্তবতার সাথে মানুষ মানিয়ে নেয়। না মেনেও মেনে নিতে বাধ্য হয়, অভ্যস্ত হয়। মানিয়ে নিয়ে এবং মেনে নিয়ে বা না মেনে শোভনদের পরিবার অনাবৃত দুঃসময় অতিক্রম করছিলো। নতুন করে শোভনের বাবা একবেলা ছাড়া চা খেতে চাইছে না, চা ও সিগারেটহীনতার সাথে মানিয়ে নিতে চাইছে– শোভনের মা’র মন শঙ্কায় ভরে উঠে। কাঁপাকাঁপা স্বরে জানতে চান, “তুমি আর সিগারেট খাইবা না, এইটা ভালো সিদ্ধান্ত। কিন্তু সবকিছু ছাড়তে ছাড়তে চা’ও একবেলা ছাড়া খাইবা না, এইটা কেমন কথা! কি এমন ঘটছে সেইটা বলবা?”

মা’র প্রশ্ন শুনে শোভনের বাবা বালিশে হেলান দেন। লোডশেডিং চলছে, ফ্যাকাশে চার্জার বাতির আলোয় দেওয়ালে পড়া বাবার ছায়াটাকে আরও ফ্যাকাশে লাগছে। শোভনের চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলেন, “তুমি শোনো নাই, কারা যেনো আমাদের দিকে দুর্ভিক্ষ ছুড়ে দিচ্ছে।”

মা দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন না, স্বাভাবিক স্বরেই বলেন, “দুর্ভিক্ষের আর বাকী আছে কি! জিনিসপত্রের যে দাম, প্রতিটা দানা হিসেব কইরা মুখে তুলতে হইতাছে। মাসে দু’শ চল্লিশ টাকা বাঁচানোর জন্য তুমি সিগারেট ছাইড়া দিবা- ভালো কথা। কও তো আসন্ন দুর্ভিক্ষে বাড়ি ভাড়া, ইলেক্ট্রিসিটি, গ্যাস ও পানির বিল শোধের পর কি আমাদের ডাল-ভাত আর আলুভর্তাটাও ছাইড়া দিতে হইবো!”

শোভনের মনে পড়লো মা ডিম, ব্রয়লার মুরগির মাংস বা চাষের পাঙ্গাস মাছ রান্না করলেও প্রায় দুপুরেই আলুভর্তা, তরকারির ঝোল আর ডাল দিয়ে ভাত খান। বাবা আরও আগে, করোনার সময় থেকে “ভাল্লাগে না” বলে ব্রয়লার মুরগি ও চাষের পাঙ্গাস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। শোভন বুঝতে পারে “ভাল্লাগে না’ নয়, বাবা-মা সংসারের হিসেব মিলাতেই এসব খাবার মুখে তুলেন না, ভাতও কম খান। মা’র প্রশ্নের উত্তরে বাবা বলেন, “কি জানি! ডাল-ভাত আর আলুভর্তাও ছাড়তে হতে পারে, তবে হাওয়া খেয়ে বাঁচা যেতে পারে, দূষিত বাতাস এখনও বিক্রয়যোগ্য পণ্য হয়ে উঠেনি। যাও একটু চা করো, আগামীকাল থেকে একবেলা চা করলেই হবে।”

মা মোম জ্বালিয়ে নিয়ে রান্না ঘরে যায়। কৌতূহলী শোভন প্রশ্ন করে, “বাবা, দুর্ভিক্ষ হলে কি মানুষ মরে যায়? আমরা বাঁঁচবো তো!” বাবা শান্তস্বরে বলেন, “দুর্ভিক্ষে ধনীলোকরা মরে না রে বাবাই। গরীবরা বাঁচে না। আমরা যারা মরার মত বেঁচে আছি আর মরলে একেবারে বেঁচে যাই, ইঁদুর মারার কলে টোপের মত ঝুলি, তারা দুর্ভিক্ষে বাঁচবো কি মরবো – এ বড় জটিল প্রশ্ন। তবে বাঁচি বা মরি গোর আজাব বাড়তেই থাকবে। এসব কথার মানে বড় হলে বুঝবি। রাত হচ্ছে, এখন ঘুমো বাবাই।”

বাবার কথার অর্থ শোভন বুঝে না। তবু ওর মন খারাপ হয়। মনে মনে ভাবে বেঁচে থাকলে দুর্ভিক্ষের পর ওদের কি আরও ছোট আরও উঁচু কোনো লিফটবিহীন ফ্ল্যাটে চলে যেতে হবে যেখানে ওর পড়ার টেবিল রাখার জায়গাটুকুও হবে না। প্রতিদিন পায়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উঁচুতে উঠতে হবে পরদিন ফের নেমে যাওয়ার জন্য! শোভন চোখ বন্ধ করে ঘুমোতে চেষ্টা করে, ঘুম আসে না।

নব টোনাটুনি

index

এক ছিলো টোনা আর এক ছিলো টুনি। একদিন টোনা টুনিকে বললো,
– টুনি, ও টুনিইই..

টুনি হাই তুললো,
– হ্যা, বলো।
– আমার খুব ভাপা পিঠা খেতে ইচ্ছে করছে। খুব ইচ্ছে করছে।

টুনি চোখ পাকিয়ে বললো,
– তোমার কি খেতে ইচ্ছে করছে!
– পিঠা, ভাপা পিঠা।
– তোমার সুগার লেভেল হাই, শরীরে চর্বি জমছে, আর ডায়েট না করে তুমি ভাপা পিঠা খেতে চাইছো! হাও সিলি!!

টোনার মন খুব খারাপ হলো, চোখে পানি চলে এলো, টুনিকে কান্নাভেজা স্বরে বললো,
– তোমার চটপটি খেতে ইচ্ছে হলো, বৃষ্টির মধ্যে আমি গিয়ে কিনে আনিনি! তোমার ফুচকা খেতে ইচ্ছে হলো, তোমাকে কানিবগের ফাইভস্টার ফুচকা খাওয়াইনি! আর আজ আমি দুটো ভাপা পিঠা খেতে চেয়েছি বলে..

“এক্কেবারে ঢং করবে না” বলে টুনি ধমকে উঠলো, এরপর ঠোঁটে পায়ের নোখ কাটতে কাটতে বললো,
– ভাপা পিঠা খাবে বললেই তো বানানো যায়না, এর জন্য জিনিসপত্র লাগে। তুমি ঢং না করে জিনিসপত্র এনে দাও, ভাপা পিঠা বানিয়ে দিচ্ছি।

টোনার মনে খুব আনন্দ, চোখ মুছে জিজ্ঞেস করলো,
– কি জিনিসিপত্র লাগবে?
– চালের গুড়ো লাগবে, গুড় লাগবে, মাওয়া লাগবে, নারকেল লাগবে, মাটির ঢাকনা লাগবে, ওই ঢাকনা বসানোর জন্য হাড়ি লাগবে, গ্যাস সিলিন্ডার লাগবে, আর আমার মোবাইলে ৫জিবি ডাটা লাগবে।

টোনা অবাক,
– ভাপা পিঠা বানাতে ৫জিবি ইন্টারনেট ডাটাও লাগবে?
– হ্যা, লাগবে। বেশী কথা না বলে এখনি বাজারে যাও।

টোনা বাজারে গিয়ে চালের গুড়ো, গুড়, মাওয়া, নারকেল, মাটির ঢাকনা, ঢাকনা বসানোর হাড়ি কিনলো। বাজারের সাথে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে আর টুনির মোবাইলে ৫জিবি ডাটা ভরে বাসায় ফিরলো।

টোনার মনে খুব সুখ, আজ ভাপা পিঠা খাবে। ওইদিকে টুনি ইউটিউবে ঢুকে ভাপা পিঠা বানানোর রেসিপি খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। বারবার আসছে শুধু নুডলসের রেসিপি- নুডলসের খিচুরি, নুডলসের চাটনি, নুডলসের পুড় দিয়ে বেগুনের স্যান্ডুউচ। খুঁজতে খুঁজতে নুডুলস দিয়ে ভাপা পিঠা বানানোর একটা রেসিপি পেয়ে গেলো। ভিডিওটা খুলতেই মনে পড়লো ঘরে নুডলস নেই। এখন টোনাকেও নুডুলস আনার কথা বলা যাবেনা, খুব রাগ করবে। তাই অন্য রেসিপি খুঁজতে শুরু করলো। কথায় বলে, যেখানে মাহফুজের ভয় সেখানে হিরো আলম হয়, অন্য রেসিপি খুঁজতে যেতেই বাফারিং শুরু হলো, ইনারনেটের গতি এক্কেবারে স্লো হয়্র এলোম

টুনি তো বারবার চেষ্টা করছে, বারবার রিলোড দিচ্ছে, কিন্তু নেট কাজই করছে না। এমন সময় পাশের গাছের বাসা থেকে চড়ুই গিন্নি মাথা উঁচিয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলো ,
– টুনি ভাবীইইই, টুনি ভাবীইইই আপনার ইন্টারনেট কি কাজ করছে!
– কি যে বলেন ভাবী, ইউটিউবের ভিডিওটা এক ঘণ্টায়ও ওপেন করতে পারলাম না।
– আমি ‘নাজুক দিল’ সিরিয়ালটা দেখছিলাম, হঠাৎ গেলো বন্ধ হয়ে।
– ওহ, তাই! এদিকে আমি দেখছিলাম ভাপা পিঠার রেসিপিটা।

এ কথা শুনেই চড়ুই গিন্নি চেচিয়ে উঠলো,
– হায় খোদাআআ! ভাবীইইই আপনারা একা একা ভাপা পিঠা খাবেএএএএন! আমাদের কথা মনেই পড়লো না ভাবীইইই, আজ চড়ুই না হয়ে বুলবুলি হলে ঠিকই দাওয়াত দিতেন ভাবীইইইই..
টুনি একটু বিব্রত হলেও নিজেকে সামলে নিলো,
– কি যে বলেন, ভাবী! আপনাকে দাওয়াত দিতে হবে কেনো! আপনি তো ঘরের মানুষ, সবাইকে নিয়ে চলে আসবেন।
– থ্যাঙ্কু ভাবীইইই। আপনার হাতে বানানো ভাপা পিঠা খেতে আমরা তো আসবোই ভাবীইইইই, আমাদের উপরের ডালে কাজিন থাকে, ওর ফ্যামিলিকেও সাথে নিয়ে আসবো, ভাবীইইইইই।

টুনি রেগে মনে মনে “ঢং দেখলে শরীরটা জ্বইল্যা যায়” বললেও, মুখে হাসি মেখে উত্তর দিলো,
– অবশ্যই আসবেন।

চড়ুই গিন্নী বাড়ির ভেতর ঢুকে যেতেই টুনি ধমকের সুরে টোনাকে বললো,
– চড়ুই ভাবী এলে এক্কেবারে রংঢং করবে না, যদি করো তবে চালের গুড়ির ভেতর তোমার মাথা পুরে সিদ্ধ করে মাসালা ভাপা পিঠা বানাবো, মনে থাকে যেনো, হু।

কোকিল পাখির গাওয়া কাকসংগীতের একটা সিডি লো ভলিউমে ছেড়ে দিয়ে টোনা আয়েশ করে শুনছে আর ভাবছে কখন বানানো হবে ভাপা পিঠা। এদিকে বাফারিং হতে হতে টুনির মোবাইলের চার্জ শেষ। মোবাইল সেটটা চার্জে দিয়ে টুনি নারকেল কুড়ালো, গুড় মিহি করে টুকরো টুকরো করলো, চালের গুড়োর সাথে মাওয়া মিশালো, হাড়িতে পানি ভরে চুলোয় বসালো।

সবকিছু ঠিকঠাক করে টুনি মোবাইল অন করলো। মোবাইল অন করে মন খারাপ হয়ে গেলো, দেখে ইন্টারনেট স্পিড তখনও এক্কেবারে কম। যখন মাত্র ভাবতে শুরু করেছে ইউটিউব না খুললে ভাপা পিঠা বানাবে কিভাবে তখনই পূব পাশের বটগাছের চিলটা উপরের ডালে উড়ে এসে বসলো,
– টুনি ভাবী, বাসায় আছেন?

টুনি খুব উচ্ছাসের সাথে উত্তর দিলো,
– ভাইয়াআআআ, এদ্দিন পর আমাকে মনে পড়লো!
– না, ঠিক তা না। রোজই আপনার কথা মনে হয়, কিন্তু..

কথা শেষ করতে না দিয়েই টুনি কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
– থাক থাক, আর বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে বলতে হবে না, ভাইয়ায়ায়ায়া। আপনার মনে তো শুধু ডাহুক ভাবী, পায়রা ভাবীদের কথা, ভাইয়ায়ায়া।আমার মত ছোট্ট টুনির কথা কি আর মনে পড়বে, ভাইয়ায়ায়ায়া।

চিল প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো,
– টুনি ভাবী, ইন্টারনেটের স্পিড কি ঠিক আছে?
– না, ভাইয়ায়ায়া, ঠিক নেই। খুব স্লো, ভাইয়ায়ায়া।

টুনির এমন বিগলিত অবস্থা দেখে টোনা দু’বার পাখা ঝাপটালো। বিষয়টা বুঝতে পেরে চিল টিটকারি মারলো,
– কত স্লো, ভাবী! টোনার মত? প্রতি মৌসুমেই তো আপনার ডিম পারতে দেরী হয়ে যায়।

লজ্জায় লাল হয়ে টুনি বিব্রত হাসি দিলো, চিল প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললো,
– এত আয়োজন কার জন্য?
– আপনার ভায়ের ভাপা পিঠা খেতে খুব ইচ্ছে হয়েছে, ভাইয়ায়ায়া। সব রেডি কিন্তু ইন্টারনেট স্পিড কম বলে পিঠা বানাতে পারছি না, ভাইয়ায়ায়ায়ায়া।

চিল ভিরমি খেয়ে দুটো ঢোক গিলে বিস্ময় প্রকাশ করলো,
– ভাপা পিঠা বানাতেও আজকাল ইন্টারনেট লাগে!
– হ্যা, ভাইয়ায়ায়া, ইউটিউবে রেসিপি না দেখলে পিঠা বানাবো কিভাবে!
– ও আচ্ছা।
– ভাইয়ায়ায়ায়া, আজ কিন্তু আপনার দাওয়াত, না বলতে পারবেন না।
– ঠিক আছে টুনি ভাবী। ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হলেই চলে আসবো।

ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হচ্ছে না দেখে টোনার খুব রাগ হলো, কখন ইন্টারনেট স্পিড ঠিক হবে তা জানতে ও কাস্টমার কেয়ারে ফোন করতেই শালিকের লাস্যময়ী কণ্ঠ,
– আমাদের সার্ভিসে আপনাকে স্বাগতম। মোবাইল রিচার্জের জন্য এক চাপুন, কল রেটের জন্য দুই চাপুন, ইন্টারনেট কেনার জন্য তিন চাপুন, যে কোনো অভিযোগ জানাতে ডিসকানেক্ট বাটন চাপুন।

টোনা ডিসকানেক্ট বাটনে চাপতেই লাইন কেটে গেলো। দ্বিতীয়বার কল সেন্টারে ফোন করতেই ভেসে এলো ফিঙের কণ্ঠ,
“আপনার একাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ ব্যালেন্স নেই, কথা বলতে চাইলে রিচার্জ করুন। দ্রুত ডিম পাড়াতে চাইলে টুনিকে আদর করুন, ইন্টারনেট স্পিড ছাড়া ভাপা পিঠা খেতে চাইলে মা’কে অনুরোধ করুন।”

যোগি সোসাইটি

স্পর্শিয়া আজ স্কুলে যাবে না। কাল ডিনার করতে করতে বাবা বললেন,
– আগামী দু’দিন স্কুলে যাবার দরকার নেই। আমি তাবাসসুম মিসকে জানিয়ে দেবো।

যোগি সোসাইটির শিশুরা স্কুলে ফাঁকি দেয় না, স্কুল ফাঁকিও দেয় না। ঝড় হোক, ঝঞ্ঝা হোক, হরতাল হোক, বৃষ্টি বা প্লাবন হোক স্কুল খোলা থাকলে অভিভাবকরা পৌছে দেবেনই। স্কুলের প্রতি শিশু এবং অভিভাবকদের দায়বদ্ধতা এতটাই গাঢ় যে, বিকেলে কেয়ামত হবে জানলে সকালে শিশুদের স্কুলে পৌছে দিয়ে হেডমিস্ট্রেসকে অনুরোধ করবে, “ম্যাম, আজ দুটো ক্লাশ বেশী করাবেন, প্লিজ। কেয়ামতের পর ক’দিন পড়াশোনা বন্ধ থাকবে কে জানে!”

স্কুলে যেতে না পারায় স্পর্শিয়ার মন খারাপ হওয়া উচিত কিন্তু হচ্ছেনা। ওর মন বিষন্নতায় ভরে আছে। মা অফিসে যাবার আগে ওর মাথায় হাত বুলালেন, মা’র কণ্ঠে উছলে উঠলো আদর,
– স্পর্শি, লক্ষ্মী মা আমার, তুমি এখন সিক্সথ গ্রেডে পড়ো। মানে ক্লাস সিক্স, প্রব্লেম ফিক্সড। তুমি বড় হয়ে গেছো মা, তাই না!
– হুম।
– এই তো আমার লক্ষ্মী মেয়ে, তুমি ওই বিষয়টা খুব ভালো করে ভাবো। তুমি যা বলবে তা’ই হবে।

স্পর্শিয়া হাসি মুখে মাথা দোলায়। মা দু’গালে চুমো খান, বাবা ওকে কোলে তুলে নিয়ে নাকে নাক ঘষে আদর করে দেন। দু’জনে একসাথে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যান। পাঁচতলার এই ১৪শ স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে ওর একা থাকার অভ্যাস আছে। প্রতিদিন দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে একাই তো থাকতে হয়। গ্যারেজ থেকে হর্নের শব্দ আসতেই স্পর্শিয়া এক দৌড়ে বারান্দায় যায়, ওদের পার্ল হোয়াইট রঙের গাড়িটা সদর গেট দিয়ে রাস্তায় বের হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। বাবা আর মা সদর দরজার সামনে গাড়ির গ্লাস নামিয়ে হাত বের করে ‘বাই.. বাই’ জানায়, ও হাত নেড়ে জবাব দেয়।

বাবা আর মা দুই অফিসে চাকরী করেন। একসাথে অফিসে গেলেও মা ফিরেন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় আর বাবা রাত ৮টায়। স্পর্শিয়া জানে আজ বাবাও মা’র সাথে ফিরবেন, সন্ধ্যায় নাশতা করতে করতে তার সিদ্ধান্ত শুনবেন। এরপর সবাই মিলে বাইরে কোথাও ডিনার করবেন। তাই সময় নষ্ট না করে ও ভাবতে শুরু করে। কিন্তু বহু ভেবেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, ছোট্ট মাথায় সব ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

ঘটনার শুরু চার দিন আগে। ওইদিন ছিলো সাপ্তাহিক ছুটি। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বাবা আর মা ফিসফিস করে কথা বললেন। লাঞ্চ করতে বসে মা বললেন,
– স্পর্শিয়া, তোমাকে একটা কথা বলছি, খুব মন দিয়ে শোনো।
– বলো, মামনি।
– তুমি আমাকে ভালোবাসো?
– হুমমম।
– তুমি বাবাকে ভালোবাসো?
– হুমমম।
মা বাবার দিকে তাকালেন, বাবা বললেন,
– বাবা আর মা’ও তোমাকে অন্নেক অন্নেক ভালোবাসে। কিন্তু একটা সমস্যা তৈরী হয়েছে..
– কি সমস্যা, বাবা?
– বাবা আর মা’র এডজাস্ট হচ্ছেনা। এখন থেকে বাবা আর মা আলাদা থাকবে।
– ওহ, আমিও আলাদা থাকবো! একা ফ্ল্যাটে?

স্পর্শিয়ার প্রশ্নে মা মিষ্টি হেসে বললেন,
– না, একা ফ্ল্যাটে থাকার বয়স তোমার হয়নি। তুমি ভেবে বলো মামনির সাথে থাকবে না বাবার সাথে।
– এখনই বলতে হবে?
– না, খুব ভালো করে ভেবে বলো।

ওইদিনের কথোপকথনের পর থেকেই স্পর্শিয়া ভাবছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বাবাকে তার ভালো লাগে, মামনিকে ভালো লাগে আর এই ফ্ল্যাটটাও ভালো লাগে। কাউকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না। ছোট হলেও ওর জানে আছে শেষ পর্যন্ত একজনকেই বেছে নিতে হবে। ওর আর ভাবতে ভালো লাগেনা, ড্রইং রুমে এসে স্মার্ট টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে ঘুরে বেড়ায়।

বাবা মা বাসায় ফিরে স্পর্শিয়ার সিদ্ধান্ত শোনার জন্য তাড়াহুড়ো করেন না। ইভনিং ব্রেকফাস্ট খেতে বসে এই প্রসঙ্গটাই এড়িয়ে যান। রাতে সোসাইটির মালিকানাধীন অভিজাত রেস্তরা ‘যোগিয়ান ডাইন’এ ডিনার করতে করতে বাবা জানতে চান,
– কি ভাবলে মামণি?
– আমি তোমার সাথে থাকবো।

মা জানতে চাইলেন,
– তুমি বাবার সাথে থাকবে?
– তোমার সাথেও থাকবো।

বাবার কণ্ঠে বিরক্তি,
– সেটা তো সম্ভব নয়, মামনি। বাবা বা মা’র মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে, অন্যজনের সাথে ছুটির দিনগুলোতে থাকবে। দু’জনের সাথে তো একসাথে থাকা যাবেনা।

স্পর্শিয়া দৃঢ় উত্তর,
– যাবে।
– কিভাবে?
– ম্যাজিক দিয়ে, আর ওই ম্যাজিকটা আমি জানিইইইই।

মা’র কণ্ঠে রাগ,
– ম্যাজিক বলে কিছু নেই, ম্যাজিক হলো ফাঁকিবাজী।
– মামণি, ম্যাজিক আছে। ম্যাজিকটা সহজ, তোমাকেও শিখিয়ে দিবো।

বাবা আর মা কথা বাড়ান না। স্পর্শিয়ার কথা শুনে ভাবেন কালকের দিনটা যাক, এরপর সিদ্ধান্ত নিবেন। হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু ওখানে তো যোগি সোসাইটিতে বসবাসের যোগ্য করে গড়ে তোলা হবে না। তাই বাবা বা মা- একজনকেই বেছে নিতে হবে ওর।

ম্যাজিক দেখবেন এমনটা আশা করেনি বাবা-মা, কিন্তু পরদিন স্পর্শিয়ার ম্যাজিকে পুরো যোগি সোসাইটি দুলে উঠলো। স্পর্শিয়ার টেবিলে পাওয়া গেলো চিঠি, “বাবা ও মামনি, এই যে দেখো ম্যাজিক, আমি তোমাদের দু’জনের সাথেই আছি আবার কোথাও নেই শুধু আল্লাহর কাছে আছি।” ছোট্ট ডেডবডিটা পাওয়া গেলো বাথটাবে ডুবন্ত, শ্যাম্পুর বোতলের পাশে বাবার স্লিপিং পিলের অনেকগুলো খালি মোড়ক। ম্যাজিকের সম্মোহন কাটতে বাবা-মা’র চোখ অশ্রুতে ভরে এলো।

স্পর্শিয়ার ম্যাজিকের সংবাদ বাতাসে মিশে যোগি সোসাইটির কোনায় কোনায় প্রতিধ্বনি তুললো, সেও ক্ষণিকের জন্য। শুধু যোগি সোসাইটির হর্তাকর্তারা আতঙ্কিত স্বরে প্রশ্ন তুললেন, “সেক্যুলার যোগি সোসাইটির এক শিশুর মাথায় জঙ্গীবাদ ঢুকালো কে?” স্পর্শিয়ার মৃত্যুশোকের কান্না ভুলে হর্তাকর্তার আতঙ্ককে ঘরে ঘরে পৌছে দিলো হাওয়া। একদিনেই বাবা-মা ছাড়া অন্য সবার মন থেকে মুছে গেলো স্পর্শিয়া; যেনো স্পর্শিয়া যোগি সোসাইটির কেউ নয়, স্পর্শিয়া নামে যোগি সোসাইটিতে কেউ কখনো ছিলোই না।

.
#যোগি_সোসাইটি
*অসুস্থতার ঘোরে লেখা।

গোশত

– ঘটনাটা অইলো কালামের, মানে টেকপাড়ার ফোচু কালামের। গ্যাদাকালে বারো মাস ওর নাক দিয়া সর্দি গড়াইতো, হালায় ফোচ ফোচ কইরা নাক টানতো, নাম অয়া গেলো ফোচু কালাম।

আকবর চাচা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বিরক্তির সুরে বলেন,
– ত্যানা প্যাচাও কেলা! ঘটনা কও, মিয়া।
– ফোচুর তো পড়ালেখা অয় নাই। ক্লাস ফাইবে ইনবারসিটি পাস দিয়া কিছুদিন কামকুম করছে। পরে ঢুইকা গেছে ল্যাংড়া মিজানের পাট্টিতে।
– ও। মাগর কলাইম্যার বাপ বহুত ভালা আদমী আছিলো, টাকা আছিলো না হালার কলিজা আছিলো শরীল ভরা। পেটের ভুড়ি ভরা মহব্বত।

রমিজ মাথা দোলায়। আকবর চাচার সামনে আনন্দ বেকারির কাচ্চা বিস্কুটের প্লেট ও চা এগিয়ে দেয়,
– হ, চাচা। আমরা দুপুইর‍্যা রোইদে গাবাইলেও বকতো না।
– কালাইম্যার কথা জানি কি কইতা ছিলা!
– ল্যাংড়া মিজানরে ক্রস ফায়ার দেওনের পর বহুত দিন কালামে ভাগলপুর আছিলো।
– ভাগলপুরে ওর কে থাকে?
– চাচা, ভাগলপুর মানে ভাইগ্যা গেছিলো। পরে ফিরা নিজে ছিনতাই পাট্টি খুলছে।

আকবর চাচা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। আগের মত পঞ্চায়েতের রমরমা থাকলে কালামকে জুতিয়ে সোজা করে ফেলতেন। কিন্তু ওই দিন আর নাই, মুরুব্বীদের শাসন কেউ মানেনা। রমিজ বলতে শুরু করে,
– পনরো বিশ দিন আগে, ওই যে টানা বিষ্টি অইলো, তহন কালামে একটা বড় দাও মারছে।
– বড় দাও মানে?
– ওইদিন বিষ্টির লেগা দোকানপাট আগে আগে বন্ধ অয়া গেছে। রাস্তায় ভিড় নাইক্কা। রাইত দশটায় রাস্তা ফাক্কা।
– তো?
– কালামে একটা রিকশা আটকাইছে। রিকশায় এক বুড়া কই জানি যাইতাছিলো। বুইড়ার পকেটে হাত দিয়া দেখে বহুত টাকা। কালামে টাকা লয়া টানাটানি করনের সময় বুড়ার গলায় চাক্কু দিয়া দিছে পাড়, বুইড়া মাথা কাটা মুরগির মতন ছটফটায়া স্পট ডেড। রিকশাওলা লাশ ফালায়া রিকশা লিয়া দিছে লৌড়।

আকবর চাচা যেনো বিশ্বাস করতে পারছেন না,
– কও কি ভাতিজা!
– হ, চাচা। পুলিশ ঘটনা লিয়া ঘাটায় নাইক্কা। ওইদিকে কালামও বউ লয়া আন্ডার গাউনে গেছে গা। মাগর, ওর অইছে আজীব ব্যারাম। ওর বউ আয়া সাবেত কবিরাজের কাছে বহুত কান্নাকাটি করছে।
– কুন সাবেত! ওই যে জ্বীন পালে!
– হ, চাচা।
– সাবেত হালারে পালে কে, আবার ওই পালবো জ্বীন! ভাতিজা, কালামের ব্যারামটা কি!

রমিজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে কামড় দিয়ে বলে,
– ঘটনার শুরু ছিনতাইয়ের রাইত থেকা। কালামের ঘরে খাওন আছিলো না। ওর ৬বছরের মাইয়াটা গরুর গোশতের ভুনা দিয়া পারোটা খাইবার চাইছিলো। বুইড়ার কাছ থেকা ছিনতাই করা দুইটা ৫শ টাকার বান্ডিল লিয়া বাজারে গিয়া জুম্মনের কাছ থেকে রান আর সিনা মিলায়া গোশত কিনছে। ময়দা আর তেল লিয়া বাড়িতে ফিরছে।

আকবর চাচা বিরক্তি গোপন না করেই বলেন,
– দূর হালায়! তুমি আবার ত্যানা প্যাছাইতাছো কেলা! তোমগো চোদ্দ গুষ্টিতে তো কেউ ত্যানার ব্যবসা করে নাই, তুমি এই অভ্যাস পাইলা কই।

রমিজ কিছুটা বিব্রত হয়, কাঁচুমাচু স্বরে বলে,
– ওর বউ গোশত ভুনা আর পারোটা বানাইছে। পরোটা দিয়া গোশতের টুকরা চাইপ্যা ধইরা মুখে দিয়া চাবাইতে চাবাইতে আৎকা কালামে কয়, “থু: থু: থু: তরে আইন্যা দিলাম গরুর গোশত, তুই বুইড়া মাইনষের গোশত রানলি ক্যান!” বউ তো ভ্যাবাচ্যাকা খায়া গেছে, “বুইড়া মাইনষের গোশত পাইলি কই?” কয়া বউরে দিছে মাইর। বমি কইরা ঘরবাড়ি ভাসায়া দিছে।
– তারপর?
– কালাম অহনে গোশত ছাড়া কিছু খাইবার পারেনা। ওর বউ মুরগি, গরু, খাসি যেইটার গোশত রান্ধে কালাম মুখে দিয়া বমি কইরা দেয়, ওর কাছে সব গোশতই বুইড়া মাইনষের গোশত লাগে।

আকবর চাচা উদাস হয়ে বসে থাকেন, এরপর খুব জোড় দিয়ে বলেন,
– ভাতিজা, ওই রাইতে তুমিও তো কালামের লগে আছিলা। কি আছিলা না!

রমিজ হকচকিয়ে ওঠে। মুহুর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে বিস্কুটে কামড় দিয়ে চিবুতে চিবুতে আকবর চাচার চোখে চোখ রেখে দৃঢ়ভাবে বলে “না”। আকবর চাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিদায় নেন, আর তখনই রমিজের মনে হতে শুরু করে ও বিস্কুট চিবুচ্ছে না, চিবুচ্ছে বুড়ো মানুষের মাংস- নোনতা, শক্ত, স্বাদহীন মাংসের রোয়াগুলো আটকে যাচ্ছে দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে।

পোকা

10 বাবার যা ভুলো মন- তাই বলে এমনটা হবে ভাবেনি মিতুল। নতুন ক্লাসের নতুন নোট বই প্রয়োজন, বাবা বলেছেন আনবেন, ও অপেক্ষায় ছিল। বাবা নোট বইয়ের বদলে একমুঠো উইপোকা কিনে আনলেন, যত্ম করে স্কুলের ব্যাগে ভরে দিলেন।

মিতুল মা’র কাছে শুনেছে বহুদিন আগে বাবা একটা সমুদ্র কিনেছিলেন। সমুদ্রে তখন প্রবল জলোচ্ছাস, প্রতি মুহুর্তে ঢেউয়ের উচ্চতা বাড়ছে, আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। তিনি প্রতিদিন গভীর আগ্রহ নিয়ে সর্বস্বের বিনিময়ে শেয়ার বাজার হতে কেনা সমুদ্রের ঢেউ গুনতেন, উচ্চতা মাপতেন আর ভাবতেন- ঢেউ আকাশ স্পর্শ করলেই সমুদ্রটা বিক্রি করে কিছু জমি কিনবেন।

বিপদের দিনে চাখবেন বলে মা টিনের কৌটায় আশা ভরসার সিরকা মেখে ভাংতি পয়সা ও খুচরো টাকা জমাতেন। সব আশাভরসা খরচ করে মা বাবাকে আরও ক’টা ঢেউ কিনে দিলেন আর স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন- খুব তাড়াতাড়ি একটা চৌকো জমি কেনা হবে। জমির পেছন দিকটায় থাকবে পাকা বাড়ি, সামনে খোলা উঠোন, ওই উঠোনে মিতুল খেলবে। উঠোনের একপাশে বাঁশের মাচায় তরতরিয়ে উঠবে পুঁই আর লাউশাক, কখনও কখনও বড় সিম বা কাকরোল। ছাদের টবে ফুটবে গোলাপ, রাতে ঘ্রাণ ছড়াবে হাস্নুহেনা।

এক সকালে হঠাৎ করেই ক’টা তিমি, হাঙর আর ডলফিন সমুদ্রের সব ঢেউ পান করে গাঙচিল হয়ে উড়ে গেল। সমুদ্র বিক্রয় দপ্তরের ঠিকানাটা রইলো, কিন্তু সমুদ্রের কঙ্কালটাও খুঁজে পাওয়া গেল না। এরপর থেকেই বাবা যেন কেমন হয়ে গেছেন, এই তো সেদিন এক সপ্তাহ চলার মত চাল কিনতে গিয়ে দুই মাসের ক্ষুধা কিনে ফিরলেন।

সবাই নতুন বই নিয়ে স্কুল যায়, নতুন ব্যাগ, নতুন জুতো, নতুন ড্রেস। শুধু মিতুলের পুরানো ব্যাগ, পুরানো জুতো, পুরানো ড্রেস। পুরানো ব্যাগ ভর্তি উইপোকা। একদিন ক্লাশে হাকিম স্যার মিতুলের কাছে নোটবই চাইতেই ও ক’টা উইপোকা স্যারের হাতে তুলে দিলো। স্যার পোকাগুলো ফেরত দিয়ে হতাশ সুরে বললেন, তিন মাসের বেতন বাকী আর তোর বাবা উইপোকা কিনে টাকা ওড়ায়!

মিতুল ঘরে ফিরে মা’কে প্রশ্ন করে , ‘উইপোকার কি অনেক দাম, মা!’ মা আলু দিয়ে পানি ভুনা করছিলেন, হাঁড়িতে লবণ দিতে দিতে জানালেন, ‘আমাদের মত মানুষ ছাড়া আর সবকিছুরই অনেক দাম।’ মা’র উত্তর শুনে মিতুল অবাক হয় না, এ কথা ও বহুবার শুনেছে, স্বগতোক্তি করে, ‘বাবা অনেক দাম দিয়ে কেনো যে উইপোকা কিনলেন!’ মা হাঁড়ির ঢাকনা খুলতেই একরাশ ধোয়া বেরিয়ে এলো, হাড়িভর্তি ফুটন্ত পানিতে আলুর ক’টা টুকরো লাফাচ্ছে, মা ওই দিকে চোখ রেখে বললেন, ‘তোর বাবা উইপোকাও চিনে না, তুই ব্যাগে ঘুনপোকা নিয়ে ঘুরছিস, বাবু।’

ম্যালামাইনের হলদে হয়ে আসা পুরানো প্লেটে দু’মুঠো বাসি ভাতের ওপর এক চিমটি লবণ আর এক কাপ পানি ভুনা ঢেলে মিতুলকে খেতে দিলেন, দীর্ঘশ্বাসের শীতলতা ছুড়ে চুলোর আগুন নিভিয়ে বললেন, ‘ওদের দাঁত বড় হয়ে চোয়াল ফুঁড়ে বেরুবে, এর আগেই ওদের ছেড়ে দিস, বাবু।’
‘দাঁত বড় হতে হতে চোয়াল ফুঁড়ে বেরুবে!’ ভাবতেই মিতুলের গায়ে কাঁটা দেয়। মা বলেছেন ওদের কিছু না কিছু কাটতে হয়, না কাটলে দাঁত বড় হয়, হতেই থাকে- চোয়াল ফুঁড়ে বেরোয়, মগজ ফুরে বেরোয়, তারপর মরে যায়।

উই হোক বা ঘুন, পোকাগুলোকে মুক্তি দিতে হবে। পরদিন ক্লাশে সবাই বই খুলে বসে, মিতুল বসে ব্যাগের জিপার খুলে। জিপার খোলা পেয়ে প্রথমে তিনটা পোকা বেরিয়ে আসে, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর একটা একটা করে পোকা নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে, স্বাধীন আশ্রয়ের সন্ধানে পিলপিল পায়ে হেঁটে যায় এদিকে ওদিকে সেদিকে। ক’টা পোকা ফের ব্যাগে ঢুকে যায়- ওদের গন্তব্য পৃথক।

মিতুল জানে না কী ভীষণ কাণ্ড ঘটে গেছে। পোকাগুলো ছড়িয়ে পড়েছে পুরো স্কুলে। মা পোকাদের প্রসবিত ডিম ফুটে বেরিয়েছে শিশুপোকা। দাঁতের যন্ত্রণায় বড় পোকাগুলো সারাটা দিন কুটকুটকুটকুট করে ক্লাশরুমের দরজা, জানালা আর বেঞ্চ কাটে। ছোট পোকাগুলো মনের আনন্দে কাটাকুটিতে মন দেয়, ওদের দাঁতেখড়ি হয় লাইব্রেরির বই কেটে। ওদেরও দাঁত বড় হয়, ধারালো হয়, ওরা স্কুলের দেয়াল কাটে, ছাদ কাটে, অচল নিয়ম ও দোদুল্যমান আদর্শ কাটে। দিনের কোলাহলে পোকার দন্তচর্চার শব্দ পাওয়া যায় না, রাতের নিরবতায় শোনা যায় কুটকুটকুটকুট… কুটকুটকুটকুট… কুটকুটকুটকুট… যেনো মেশিন চলছে।

ক’মাস পরের কথা, পোকার অক্লান্ত দাঁতের চাপে ঝুরো ঝুরো হয়ে ধুলায় মিশেছে পাঠ্যবই, খসে পড়েছে স্কুলের জানালা, গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে ভেঙে গেছে দরজা, ধ্বসে পড়েছে দেয়াল। স্কুলের শূন্য ভিটায় ঘুঘু চড়ার কথা, কি আশ্চর্য- ধ্বংসস্তুপের ফাঁকফোকর ভেদ করে জন্মেছে ঘাস, ফুটেছে নাম না জানা ফুল, উড়ছে এক ঝাঁক অনিন্দ্যসুন্দর প্রজাপতি।

বৃক্ষছক

Screenshot

মা বুনেছিলেন লাউ গাছ। এক ছুটির দিনে বাবা বেঁধে দিলেন মাচা। মায়ের যত্নে গাছটা তরতরিয়ে বেড়ে উঠল। মাচার ওপরটা ভরে গেলো খসখসে সবুজ পাতায়। একদিন দেখা গেলো মাচার নিচে ঝুলছে নধর নধর লাউ।

মায়ের যত্ন আর থামেনা। গোড়ায় পানি দেন। সার দেন। মাটি নিড়ান। পাতায় পাতায় হাত বুলান। আদর যত্নে আহ্লাদী লাউগুলো বেড়ে ওঠে দ্রুত। মা লাউ দিয়ে শোল মাছ রান্না করেন। আমরা খাই। লাউ-ইলিশ রান্না করেন। আমরা খাই। লাউ চিংড়ি রান্না করেন, আমরা খাই। খুব ঘনঘন আমাদের ঘরে মাছ বা মাংস থাকে না, সেসব দিনগুলোতে মা লাউ দিয়ে ডাল রান্না করেন। আমরা খাই। আমাদের শরীর থেকে লাউয়ের ঘ্রাণ বের হয়। মাচায় লাউ হয়ে ঝুলছি, মা কাটতে আসছেন- মাঝে মাঝে এমন স্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠি। সারারাত জেগে থাকি।

বাবার কাছে টাকা না থাকলে মা বিষন্ন মনে লাউ কেটে দেন। বাবা খুব সঙ্কোচে মায়ের গোপন দীর্ঘশ্বাস লাউ বিক্রি করতে বাজারে নিয়ে যান। যেতে যেতে সস্তা শার্টের রংচটা হাতায় চোখ মুছেন। মা আঁচলে মুখ ঢাকেন, কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে থাকেন। বুকের ব্যথাটা যন্ত্রণা দিলে লাউ গাছের পাশে পিড়ি পেতে বসেন। বড় আপা মা’র মাথায় তেল দিয়ে দেয়, আমি পা টিপে দেই। ব্যাথা চেপে মা হাসেন। মলিন হাসি। মন খারাপ হয়।

বাবার সঙ্কোচ বাড়তে থাকে। মা গাছ লাগিয়ে যান। মা’র যত্নে তিনটে পেঁপে গাছ বেড়ে উঠেছে। পুইশাকে ভরে গেছে আরেকটা মাঁচা। কাকরোল গাছে অনেক কাকরোল ধরেছে। মা যে কি খুশি! এক একদিন লাউ বাদ দিয়ে মা পেঁপে রান্না করেন। এক একদিন পেঁপে বাদ দিয়ে পুঁইশাকের চচ্চরি করেন। এক একদিক সব বাদ দিয়ে কাকরোল ভাজেন। আমরা খাই। একদিন খাচ্ছি, এমন সময় রান্নার পাট চুকিয়ে, গাছের মায়া ছাড়িয়ে মা চলে গেলেন। মা খুব বেশী দূরে যান নাই। খুব কাছাকাছি আছেন। বাড়ির পেছনের পরিত্যক্ত জমিতে আমড়া গাছের নিচে তাকে রোপন করে দিলো সবাই।

আমি রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে আমড়া গাছের নিচে যাই, উঁচু হয়ে থাকা মাটিতে সকাল বিকাল পানি দেই। হাত বুলাই। ওপরের মাটি নেড়ে চেড়ে দেই। ঝরে পড়া পাতা পরিস্কার করি। রোজ ভোরে গিয়ে দেখি- মা গাছের বীজ ফুটে পাতা বের হয়েছে কি না।

স্মৃতি লিখে রাখি

269a

— কি সেলাই করেন!
শীতের রাত, প্রায় সাড়ে ১১টা বাজে, জেলা সদরের নির্জন ফুটপাতে উদোম শরীরে বসা এক লোক, একপাশে মুচিদের ব্যবহার করার মত বাক্স, নিয়নের আলোয় স্যান্ডেল সদৃশ কিছু সেলাই করছিলেন। প্রশ্ন শুনে মাথা না তুলেই উত্তর দিলেন,
— নসীব।
এমন উত্তর আশা করিনি। বিস্ময় কাটিয়ে জানতে চাইলাম,
— কার নসিব!

এবার লোকটি মুখ তুলে তাকালেন। চেহারায় বয়সের ছাপ, পরিচর্যাহীন শাদা দাড়িগোঁফ, ভাঁজপূর্ণ ত্বক, কিন্তু নিয়নের আলোতেও তার চোখ অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। একটু হেসে বললেন,
— কার নসিব সেলাই করি? আপনা নাসিব.. বাবা, আপনা নাসিব..

খেয়াল করলাম, তার উচ্চারিত ‘নসিব’ হঠাৎ করেই ‘নাসিব’ হয়ে গেছে। এসব ছোটো ছোটো পরিবর্তন সবসময়ই কৌতূহলী করে তোলে। তাকে বললাম,
— আপনার পাশে বসে একটু নাসিব সেলানো দেখি?

তিনি মাথা নিচু রেখেই উত্তর দিলেন,
— আপনার ইচ্ছা। আমার নাসিব সেলানো দেইখা কার কি লাভ!

তার পাশে বসলাম৷ প্রায় দশ মিনিট একটা স্যান্ডেলের সোল তিনি সুতো ছাড়া সেলাই করে গেলেন। সেলাই শেষ করে বক্সের ভিতর সোলটা রেখে আরেকটা সোল বের করে সেলাই শুরু করলেন। স্বভাব দোষে প্রশ্ন করলাম,
— এটা কার নাসিব!
— এটা নাসিব না রে বাবা, এটা জিন্দেগী
— কার জিন্দেগী?
— আপনা জিন্দেগী।
পাঁচ মিনিট জিন্দেগী সেলাই করে বক্সে রাখতে বললাম,
— আসেন, শীতের রাতে গরম গরম ভাত খাই।
— তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

বড় হাসপাতাল, রেলস্টেশন, বাস আর লঞ্চ টারমিনাল সংলগ্ন কিছু হোটেল সারারাত খোলা থাকে। এমন এক হোটেলের উদ্দেশ্যে রিকশা নিলাম, তিনিও বসলেন। শীতে কাঁপছি, তিনি নির্বিকার। উনার খাওয়ার অর্ডার দিলাম, আমি ঘরে ফিরে খাবো। খাওয়া শেষে তাকে ভাড়া বাবদ কিছু টাকা সাধলাম, তিনি নিলেন না। ঠোঁটে শিশুর মত হাসি, বললেন,
— আলহামদুলিল্লাহ! টাকা দিয়া কি করবো! টাকা দিয়া নসিব আর জিন্দেগী সেলাই করা যায় না বাবা..

আর কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি হাঁটতে শুরু করলেন, বয়সের তুলনায় দ্রুতই হাঁটছেন। অথবা যারা রাতে নির্জন পথে নিজের নসিব আর জিন্দেগী সেলাই করেন তারা হয়তো দ্রুতই হাঁটেন।

.
স্মৃতি লিখে রাখি| ২৫ডিসেম্বর (২৪ডিসেম্বর দিবাগত রাত)

দোয়েলের মন

: তারপর?
: তারপর দোয়েল পাখিটা উড়তে উড়তে চলে গেছে নীলপরীর দেশে। গিয়ে দেখে নীলপরী রানীর কাপড়ে নীল দিচ্ছে আর ফুলের সুবাস মাখাচ্ছে।
: তারপর?
: এদিকে হয়েছে কি লালপরীতো নীলপরীকে দাওয়াত দিয়েছে। কিন্তু পোলাও মাংস কোপ্তা কাবাব সর্ষে ইলিশ রান্না করবে কিভাবে! সব জিনিসের যা দাম!
: তারপর?
: তখন সাদা প্রজাপতি বলল, ‘শুটকি মাছের ঝাল ভর্তা বানাও, আলুর দম রান্না কর, আম ডাল হলে বেশ হয়, সাথে কাচা মরিচ আর পেয়াজ কুচি তো আছেই। রোজ রোজ মধু খেতে একটুও ভালো লাগে না।’
: তারপর?

: এই না শুনে রাজা বললেন -খাবে তো খাও বেগুন ভাজা আর কাঁচকলা। বেগুন ভাজার কথা শুনে রাণীমা মন খারাপ করলেন। উনার আবার বেগুনে এলার্জি। খুব চুলকানি হয়। কাঁচকলা খেতে হবে বলে রাজপুত্র কান্না শুরু করে দিল। কান্নার ভ্যা ভ্যা শব্দে মন্ত্রীর মুখের লেবেঞ্চুস ধপাস করে মাটিতে পরে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। তাই না দেখে সেনাপতি খুকখুক করে হেসে দিলেন।
: তারপর?
: রাজা বললেন, ‘তাই’তো বলি মন্ত্রীর দাঁতে পোকা কেনো! সেনাপতি, তুমি এক্ষুণি মন্ত্রীর দাতের পোকাগুলোর মাথা কেটে ফেল।’
: তারপর?
: সেনাপতি বলল -মন্ত্রীর মুখে গন্ধ। সামনেই যাওয়া যায় না। লেবেঞ্চুস খেয়ে তিনি দাঁত মাজেন না। তাই শুনে রাজা বললেন, ‘তবে আগে নিজের নাক কাটো। তারপর মন্ত্রীর মুখের পোকার মাথা কাটতে হবেই হবে।’
: তারপর?
: দোয়েল বলল, ‘সবাই দেখি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। টোনা আর টুনি মজা করে পিঠা খাচ্ছে। রাজপুত্র রাজকন্যাকে বিয়ে করবে বলে দৈত্য মারতে যাচ্ছে। রাজা আর তার লোকেরা কাটাকাটি করছে, রাজ্যের প্রজাদের লুটপুটে খাচ্ছে, অত্যাচার করছে। দুয়োরাণী বিউটি পারলারে ফেসিয়াল করছে, সুয়োরানী হার্বাল উপটান মাখছে। বাঘের গলায় হাড় ফুঁটলে বক তা বের করে দিচ্ছে। কিন্তু আমার যে বেশী করে কিশমিশ দেয়া পায়েস খেতে খুব ইচ্ছে করছে সেটা নিয়ে কারো একটুও চিন্তা নেই। আমি কি তোমাদের কেউ নই! আমি কি তোমাদের কিছুই হই না!’
: তারপর?

: এদিকে ছাতা হারিয়ে ব্যাংয়ের মন ভালো নেই। বৃষ্টিতে ভিজে সর্দি লেগেছে। দোয়েলের কথা শুনে সে বলল, ‘ তেপান্তরের মাঠ পেরুলে দুধের সাগর। সেই সাগর পেরুলে মাখনের পাহাড়। নরম নরম মাখনের পাহাড় পার হলে তবেই রূপকথার দেশ। সে রূপকথার দেশেই পোলাও পাওয়া যায়, কোর্মা কোপ্তা পাওয়া যায়, ইলিশ ভাজা আর রুই মাছ ভুনা পাওয়া যায়। পায়েস পাওয়া যায়। ব্যাংয়ের হারানো সিল্কের ছাতাও পাওয়া যায়, ব্যাংয়ের সর্দির ওষুধও পাওয়া যায়।’
: তারপর?
: দোয়েল বলল – আমি যাব রূপকথার দেশে। পায়েস খাবো। লালপরী নীলপরীর জন্য পোলাও কোর্মা আনবো, ব্যাংয়ের জন্য সিল্কের ছাতা আর সর্দির ওষুধও আনবো।
: তারপর?

: জলদস্যু বলে ‘তবে এই নাও রূপকথার দেশে যাবার মানচিত্র, কাঠের জাহাজ আর দূরবীন।’ দোয়েল পাখি মানচিত্র খুলে দূরবীনে চোখ লাগাতেই আম্মু ডাকতে শুরু করেন, বলেন ‘তাড়াতাড়ি উঠো। সেই কখন সকাল হয়েছে। কাজে যেতে হবে। উঠো.., উঠো..।’
: তারপর?
: তারপর দোয়েল পাখিটা সকাল সকাল কাজে যায়। হোটেল ঝাড়ু দেয়, বেঞ্চ আর টেবিলগুলো মুছে। জগে পানি ভরে। নাস্তা করতে আসা লোকগুলোর টেবিলে টেবিলে পরোটা আর সাথে ভাজি, হালুয়া বা ডিম ভাজা দেয়।
: তারপর?
: আম্মুর মত এই লোকগুলোও বুঝতে পারে না দোয়েলের মন প্রতিটা মুহূর্তে রূপকথার দেশে যাবার জন্য ভীষণ ছটফট করে। টেবিলে বিছানো প্লাস্টিকের কভারকে তার মনে হয় রূপকথার দেশে যাবার মানচিত্র, বেঞ্চকে জাহাজ আর গ্লাসগুলোকে দূরবীন।

বিভ্রম

unt

আমরা রজব আলীকে এখনই গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে নামাবো এবং নামার সাথে সাথে সে প্রচণ্ড ধাক্কা খাবে। তাকে এমন ধারণা দেওয়া হয়েছে যে ময়মনসিংহের তুলনায় ঢাকা শহরে শীত কম। অথচ বাস থেকে নেমে সে জমে যেতে শুরু করবে। তার মনে প্রশ্ন জাগবে তাকে কেনো মিথ্যে বলা হলো।

ময়মনসিংহ থেকে যাত্রী নিয়ে যাতায়াত পরিবহনের বাসটা এক ঘণ্টা দেরীতে ঢাকার গাবতলী বাস স্ট্যান্ডে পৌছেছে। দেরীর কারণ ঘন কুয়াশা। ভোর হতে সামান্য দেরী, রজব আলী বাস থেকে নামতেই বরফ মেশানো ঠাণ্ডা হাওয়ার স্রোত অন্ধ আক্রোশে তার শরীরে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সে জমে যাচ্ছে, তবু কেনো মিথ্যে তথ্য দেওয়া হলো এ প্রশ্ন না তুলে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আক্কলের খাইছে মাডি/বাফে ফুতে কামলা খাডি।’

আশ্চর্য! রজব আলী কথা বলছে কেনো! ওর শুধু নিরবে জমে যাওয়ার এবং মনে প্রশ্ন জাগার কথা ছিলো। আপাতত বিষয়টা উপেক্ষা করা যাক, এখন রজবের শরীরে একটা সস্তা দামের খয়েরি রঙের শাল জড়িয়ে দেয়া যাক। শীতের বিরামহীন কামড় সহ্য করতে না পেরে রজব শালে মাথা আর কান ঢেকে নিবে। রজবকে বাস স্ট্যান্ড লাগোয়া চায়ের টং দোকানে যাবে, পরপর দুই কাপ চা খাবে। সূর্য ওঠার অপেক্ষা করবে, কিন্তু কুয়াশা এবং আকাশ ভরা মেঘের কারণে আজ সূর্য উঠবে না।

রজব ঠকঠক করে কাঁপছে। শীতের হাওয়া শরীরে আছড়ে পড়ছে। অগ্রহায়ণ মাসের শেষে হঠাৎ নামা প্রবল শীতের হাওয়ায় সে পাকা ধানের ঘ্রাণ পাচ্ছে। সে জানে এ অসম্ভব—ক্ষেতে ক্ষেতে ধান কাটা প্রায় শেষ, এ শহরে ধানের ঘ্রাণ নিষিদ্ধ না হলেও হাওয়ায় চেপে ঘ্রাণের শহর পর্যন্ত পৌছানো সম্ভব নয়। ঘ্রাণটা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। খয়েরী রংয়ের সস্তা শালে কান আর মাথা মুড়ে সে চায়ের দোকানের দিকে পা বাড়ায়। দুই কাপ চায়ে একটা বনরুটি ভিজিয়ে খায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় বুঝার চেষ্টা করে, কিন্তু সময় ধরতে পারে না। সে নিশ্চিত — কুয়াশার যে ভাবগতিক তাতে সূর্য উঠবে না। সে বিড়ি ধরায়, হাত মুঠ করে ছিলিমের মত টান দিয়ে বিরবির করে বলে, “বিড়ি-মাডি-ছাই/তিন গরিবের ভাই।”

রজবের যা করার কথা নয়, তাই করছে। শুধু ২কাপ চা খাওয়ার কথা সে বনরুটিও খেয়েছে। অপচয় ১০টাকা। শীতের হাওয়ায় বিপর্যস্ত হওয়ার কথা, সে পাকা ধানের ঘ্রাণ পাচ্ছে। সূর্য ওঠার জন্য অপেক্ষা করার কথা, সে ধরে নিয়েছে সূর্য উঠবে না। এবারও তার অবাধ্যতা উপেক্ষা করা যাক। এখন তাকে আবার বাসে তুলে দিবো, গন্তব্য বঙ্গ বাজার। ঝিমুতে ঝিমুতে গন্তব্যে পৌছবে। ওখানে অপেক্ষায় আছে দেশী ভাই হাফিজ। দু’জনে সাক্ষাৎ হবে, কুসুম কুসুম বিষাদে আক্রান্ত হবে এবং নাস্তা খাওয়া শেষে দু’জন মিলে দায়িত্বটা পালন করবে।

রজব নিজের ৪৭বছর বয়সী শরীরটাকে ক্রাচের ওপর ভর করে টানতে টানতে মূল সড়কে এনে দাঁড়ায়। বাসে উঠতে যাবে, হঠাৎ কি মনে হওয়ায় হাঁটতে শুরু করে। এ শহর দেড় দশকে অনেক বদলে গেছে, তবু বলাকা বাসের সাবেক হেল্পার রজব পথ চিনে চিনে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। রজব হাঁটছে, মাথার ভেতর ভাসছে সামাদ হাজীর কলোনি। নিচ তলায় ছোট বারান্দা শেষে একটা ঘর। বারান্দার ডান পাশের কোনে রান্না করছে রোকেয়া। মাথার চুল খোঁপা করে বাঁধা, ফর্সা ঘাড়, গরমে ব্লাউজ ভিজে গেছে। বারান্দার মাঝখানে খেলছে রুখসানা, ওদের প্রথম সন্তান। রজব চোখ বড়বড় করে মেয়েকে বললো, ‘পরের ঘরের পিডা, দাতে লাগে মিডা।’ কথা শেষ হবার আগেই খলখলিয়ে হেসে উঠলো মেয়েটা। বয়স মাত্র ৩ বছর, সব কথাতেই হাসে, চোখ বড় করে বকলে বেশী হাসে।

রজবকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হচ্ছে। ও অদ্ভূত আচরণ করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। বাসে ওঠার কথা, ওঠেনি। ঝিমানোর কথা, না ঝিমিয়ে স্মৃতি কচলাচ্ছে। স্মৃতি কচলানো খুব খারাপ অভ্যেস, একবার শুরু হলে চলতেই থাকে। এক স্মৃতির লেজ ধরে উপস্থিত হয় দশ স্মৃতি, দশটার লেজে লেজে জড়িয়ে থাকে আরও দশটা করে স্মৃতি। কচলানোর সময় নিজের সাথে দেখা হয়ে যায়, তারপর একশো রকম সুখের কথা হাজার রকম কান্নাকাটি। এখন রজবের মনে পড়বে মেয়েকে নিয়ে বাসে করে কতবার সায়েদাবাদ থেকে গাজীপুরে ঘুরতে গেছে। মনে পড়বে দুর্ঘটনায় পা হারানোর কথা, কঁচি হাত বুলিয়ে মেয়েটার বলা — ‘বাজান, তোমার ঠ্যাং কই? কাউয়ায় লয়া গেছে!’ মনে পড়বে অভাবের সংসারের ভাড় বইতে না পেরে মেয়েকে রেখে এক দুপুরে রোকেয়ার পালিয়ে যাওয়া। টিটি পাড়ার সংসার ছেড়ে মেয়েকে নিয়ে গ্রামে ফেরা। মনে পড়বে শরীরটা আস্তে আস্তে অকেজো হওয়ায় সংসারের হাল ধরলো মেয়ে, ঢাকায় রুখসানা গার্মেন্টসে চাকরী নেওয়া। প্রতি মাসে বাবাকে টাকা পাঠানো, নতুন করে সংসার সাজানো শুরু হওয়া। অথচ রজবের এখন এসব ভাববার সময় নয়, ও শুধু ঝিমুবে, ঝিমুতে ঝিমুতে দেখা করবে হাফিজের সাথে। আমরা ওর পায়ে একটু ব্যথা তৈরী করে দেই, ওর বাসে ওঠা জরুরী।

রজব স্মৃতি কচলে হাঁটতে হাঁটতে মোহম্মদপুর পর্যন্ত চলে এসেছে। শহরের ব্যস্ততা এখনো শুরু হয়নি। ঢাকা শহর কি জাগবে না— প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেয়ে রজবের মনে পড়ে আজ শুক্রবার। সাপ্তাহিক ছুটির সাথে যোগ হওয়া শীতের প্রকোপে এ শহর আজ ঘুমে কাতর, যার জাগবার অনিবার্য বাধ্যবাধকতা নেই সে ছাড়া সবাই নিদ্রামগ্ন। রজবের বিড়ির নেশা পেয়েছে, ফুটপাতের এক পাশে দাঁড়িয়ে বিড়ি ধরায় এবং বুঝতে পারে পিঠ ব্যথা করছে। ব্যথায় মাথার শিরাগুলো দপদপ করছে। বিড়ি শেষ করে নিরুপায় হয়ে রজব বাসে ওঠে।

শেষ পর্যন্ত আমরা রজবকে বাসে তুলে দিতে পেরেছি। কিন্তু ওর পায়ে ব্যথা সৃষ্টি করেছি, ও ব্যথা বোধ করছে মাথা আর মেরুদণ্ডে। ওর মাথা ব্যথায় আপাতত আমাদের মাথা ব্যথা হবার কারণ নেই। এটা একদিকে ভালোই হয়েছে, অসুস্থ শরীরে ক্রাচে ভড় করে একটানা এতটা পথ হাঁটার ক্লান্তি এবং মাথা ব্যথার সম্মিলিত আঘাতে তার ঘুম পাবে। সে বাসে বসে ঘুমোক। দ্রুতই হাফিজের সাথে দেখা হবে, দুজনে মিলে কাজ শেষ করবে। কাজ শেষে হাফিজকেও ওর সাথে ময়মনসিংহে মানে গ্রামের বাড়িতে পাঠাবো, প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক মিনিটও এ শহরে ওদের অবস্থান করার সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না।

এই প্রথম রজব অবাধ্যতা না করে বাসের সিটে ঘুমিয়ে পড়লো। বাস বঙ্গবাজারে পৌঁছতে হেল্পার ওকে ডেকে তুললো, বাস থেকে নেমে মনে পড়লো পাঞ্জাবীর পকেটে মোবাইল সেট রয়েছে এবং সেটা বেজে যাচ্ছে। ফোনে যোগাযোগ করে হাফিজের সাথে দেখা হলো। দুই দেশী ভাই পরস্পরকে শক্ত আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে রাখলো কিছুটা সময়।

রজব এবং হাফিজের কুসুম কুসুম বিষাদে আক্রান্ত হওয়ার কথা — কি আশ্চর্য, তা হয়নি। এই না হওয়াটা মেনে নেওয়া যায়, তাছাড়া স্মৃতি কচলানোর মত কুসুম কুসুম বিষাদও গাঢ় হয়ে ভয়াবহ আকার নিতে পারে। এখন তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করিয়ে যে কোনো মূল্যে ওদের এ শহর থেকে বিদায় করতে হবে। বেশী ক্ষণ অবস্থানের সুযোগ দিলে এরা শহরের বাতাসকে দূষিত করে তুলবে।

রজব তার সকল অভাব মেনে নিয়েই পরম মমতায় রুখসানাকে বড় করেছে, নাজমাকে কোলেপিঠে করে বড় করেছে হাফিজ, দু’জন বাচ্চাদের মত হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে — পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া বস্তুগুলো সত্যিই তাদের প্রিয়তম সন্ততির দেহ! অভাবের তাড়নায় গার্মেন্টসে কাজ করতে এসে পুড়ে কুকড়ে যাওয়া প্রতিটি দেহকে মনে হচ্ছে নিজের মেয়ের লাশ, পরক্ষণেই মনে হচ্ছে কোনোটাই তাদের মেয়ের লাশ নয়।

আমরা চেষ্টা করছি রজব আর হাফিজ যে কোনো দু’টা লাশ নিয়ে দ্রুত চলে যাক, দূষিত হবার হাত থেকে রক্ষা পাক শহরের মানবিক বাতাস। এমন নয় যে রুখসানা এবং নাজমার লাশ মূল্যবান, লাশপিছু ক্ষতিপূরণের পরিমাণ সমান। তবু দুই বেকুব মিলে অযথা দেরী করিয়ে দিচ্ছে।

বিভ্রম | গল্প
৫ নভেম্বর ২০২১

গল্পঃ গল্প উৎপাদন

”গল্প লেখা মোটেও কঠিন নয়, পুরস্কারের জন্য গল্প লেখা তো আরও সহজ। কলম আর এ ফোর সাইজের দুটো কাগজ নাও, ফরমুলা শিখিয়ে দিচ্ছি’ বলে নোমান থামে, প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়, লম্বা একটা টান দিয়ে মাছের খাবি খাওয়ার মত করে ধোঁয়া ছেড়ে হাওয়ায় রিং বানানোর চেষ্টা করে । টেবিলের অপর পাশে বসে আছে নবীন লেখিকা হেনা মুস্তারি, সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে নোমানকে দেখছে, মনে মনে বলছে — ‘গল্প লেখা যদি এতই সহজ তবে আপনি লিখেন না কেনো!’

হেনার মনের ভাব টের পায় নোমান, নিজেই একটা কাগজ সামনে টেনে নেয়, কলম দিয়ে দাগ কাটতে কাটতে বলে,
— এ গল্পটা রেজাউলের পরিবারের গল্প। পরিবারের কর্তা রেজাউল দরিদ্র হলে নামের শেষে মিয়া এবং ডাক নাম রেউজ্জা’ করে দিলেই হত। কিন্তু গল্পের প্রয়োজনে রেজাউল দরিদ্র নয়, উচ্চবিত্ত শ্রেণির শহুরে মানুষ। তাই তার নাম হবে ‘রেজাউল করিম’। এদেশে বিত্তবান মানেই প্রভাবশালী, প্রভাবের ভাব ফুটাতে নামের শেষে পদবী ‘চৌধুরী’ বা ‘খান’ যোগ করা প্রয়োজন। রেজাউল করিমের সাথে চৌধুরী পদবীটা মানায়, ওটাই থাক। অবশ্য রেজাউলকে আরও বিশেষ করে তুলতে চাইলে নামের আগে ‘খান মোহম্মদ’ যোগ করা যায়।

হেনা মুস্তারি গল্প লেখার ফরমুলা শুনছে। এ ফরমুলা জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকার তরুণ সাহিত্য সম্পাদক নোমানের রসিকতা কি না বুঝতে না পারলেও শুনতে ভালোই লাগছে। হেনা জানতে চায়,
— তবে কি গল্পের পরিবারের কর্তার নাম খান মোহম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী?
— না, না, তা নয়। গল্পে রেজাউল করিমকে দিয়ে কিছু অনৈতিক কাজ করানো হবে। তাই নামের আগে মোহম্মদ যোগ করা ঠিক হবে না।
— সে কি! কেনো! আমাদের দেশে অধিকাংশ পুরুষের নাম শুরু হয় মোহম্মদ দিয়ে, এ প্রথা যতটা না ধর্মীয় তার চাইতে বেশী কালচার। রেজাউলের নামের আগে মোহম্মদ থাকলে সমস্যা কি!

নোমানের মুখে হাসির রেখা, এলোমেলো চুলে আঙুল চালায়, তর্জনী দিয়ে চাঁদি চুলকায়, হাসিটাকে সামান্য বিস্তৃত করে বলে,
— কালচারের অংশ! কিন্তু কালচারের পাহারাদার আমাদের ক’জন প্রধান বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতি কর্মী আর সাহিত্যিকদের নামের আগে মোহম্মদ আছে! নামের আগে সৈয়দ বা আল ব্যবহারে আপত্তি নেই, নামের শেষে আহমেদ, ওসমান, রহমান ব্যবহারেও আপত্তি নেই, প্রথা মেনে নামের শুরুতে মোহম্মদ শব্দের ব্যবহার তেমন কই! সবাই তো আর প্রথাবিরোধী লেখক নন। এদের গল্প উপন্যাসের চরিত্রগুলোর অবস্থা অনেকাংশে একই রকম। রাজনীতিকদের নামের শুরুতেও মোহম্মদের ব্যবহার তেমন নেই।
— এটা উনাদের ইচ্ছাকৃত নয়, উনাদের নাম যেমন রাখা হয়েছে, তেমনই তো থাকবে।
— হেনা, উনাদের এসএসসি পরীক্ষার সনদপত্র দেখার ইচ্ছে হয়, সাহিত্য করতে এসে রইসুদ্দীনও এদেশে রইসু হয়ে যায়।
হেনা প্রতিবাদ করে ওঠে,
— ভাইয়া, কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করবেন না, উনি আমার খুউউউব প্রিয় লেখক ও বুদ্ধিজীবী।
— আমিও উনার বিশেষ ভক্ত। আমি কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করছি না, সমষ্টিগত প্রবণতাকে বুঝাচ্ছি।
হেনা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়, বুঝতে চেষ্টা করে নোমান সত্য বলছে কি না। যুক্তি দিয়ে নোমানকে পরাভূত করতে চায়,
— আশ্চর্যকথা। গল্পের কোনো চরিত্র অনৈতিক কাজ করলে তার নামের শুরুতে ‘মোহম্মদ’ ব্যবহার করা যাবে না!
— যাবে না কেনো, অবশ্যই যাবে। তবে পুরস্কারের জন্য লেখা গল্পতে ব্যবহার না করাই ভালো। ব্যবহার করলে উগ্র ইসলামিস্টদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগবে, তাদের বক্তব্য হবে মুসলমানদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের জন্য রেজাউলের নামের আগে মোহম্মদ যোগ করা হয়েছে। ইসলামফোবিকরা বলবে, নায়ক মুসলিম বলেই অনৈতিক কাজ করছে, মুসলমান মানেই দুষ্টু। দুই পক্ষের কোনো পক্ষকেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ দেওয়া যাবে না, এমক বিতর্কে পরিচিতি বাড়বে কিন্তু পুরস্কার সুদূরপরাহত।

হেনার কণ্ঠে দ্বিধা,
— এমনিতে তো গল্পের তেমন পাঠক নেই। এ গল্প কি অনেকে পড়বে!

নোমানের স্বরে দৃঢ়তা,
— প্রথমে এ গল্প খুব বেশী পাঠক পড়বে না, সাহিত্য পুরস্কার পেলে অনেকেই পড়বে। গল্প পড়ে তোমার ভক্তরা বলবে ‘অসাধারণ, বাংলা সাহিত্যে আগে এমন গল্প লেখা হয়নি’, প্রতিদ্বন্দ্বীরা বলবে ‘দুর্বল গল্প, এ গল্প পুরস্কার পায় কিভাবে?’ আর একদল সমালোচক এক জীবনের সঞ্চিত সমস্ত বিরক্তি চেহারায় ফুটিয়ে তুলে প্রশ্ন করবে, ‘এ গল্পে গল্পটা কই?’
— আচ্ছা, বুঝলাম।
— মন দিয়ে ফরমুলার বাকী অংশটা শোনো, গল্পেটা রেজাউল করিম চৌধুরীর পরিবারকে ঘিরে। রেজাউলের বয়স সাকুল্যে পঞ্চাশ বছর। এ বয়সেও বলশালী শরীর। নাকের নিচে কলপ দেওয়া পুরু গোঁফ, তার ব্যক্তিত্ব ফোঁটাতে গল্পে গোঁফের ডিটেইলস জরুরী, সাথে মোটা ভ্রু যোগ করা যায়। স্ত্রী আর দুই ছেলেকে নিয়ে বিত্তবান ও প্রভাবশালী রেজাউলের সংসার। স্ত্রী চির রুগ্ন এবং প্রায়ই শয্যাশায়ী থাকলেও স্বামীর সুকর্ম ও অপকর্ম কিছুই তার কানে আসে। স্বামীর সুকর্মে আনন্দিত হয়, অপকর্মে ভয়াবহ সব অভিশাপ দেয়।

হেনার নারীবাদী মন বুঝতে চেষ্টা করে রেজাউল করিমের স্ত্রীকেই কেনো রুগ্ন হতে হবে! বলশালী স্বামীর রুগ্ন স্ত্রী কি আধিপত্যবাদী সবলের সাথে নিরুপায় দুর্বলের সহাবস্থানের প্রতীক। অথবা স্ত্রীকে রুগ্ন দেখানো প্রকৃতপক্ষে নারীকে দুর্বল হিসেবে প্রতিষ্ঠার পুরুষতান্ত্রিক আচরণ। হেনা প্রশ্ন করে,
— স্ত্রীকেই কেনো রুগ্ন দেখাতে হবে?
— আরে এ প্রশ্নের উত্তর তো খুবই সহজ, রুগ্ন স্ত্রীর কাছে ক্ষমতাবান সবল স্বামীর অপকর্ম গোপন থাকছে না। সে সবসময় স্বামীর অপকর্মের প্রতিবাদ করছে, বিদ্রোহ করছে। কিন্তু স্বামী মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না। এ যে আমাদের সোসাইটির প্রতীক, রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের সাথে সাধারণ নাগরিকের সম্পর্কের ঘরোয়া সংস্করণ।
— বুঝতে পারছি।
— ইজমের দায় মেটাতে গল্পে যৌনতা আর নীতিহীনতা মানে মানব চরিত্রের অন্ধাকার দিকের কিছু ছিটেফোঁটা মেশাতে হবে, তা না হলে বোদ্ধারা গল্পের মধ্যে পোস্ট মর্ডানিজম বা উত্তর আধুনিকতা খুঁজে পাবে না। গল্পে যৌনতার প্রয়োজনে রেজাউলের সংসারে দূর সম্পর্কের এক শালীকে আশ্রয় দাও, ধরা যাক তার নাম ফারজানা। ২৫ বছরের চোখ ধাঁধানো সুন্দরী শালীকে দেখলে রেজাউলের শরীর জেগে ওঠে, কিন্তু স্ত্রীর তীক্ষ্ম নজরদারির জন্য জাগ্রত শরীর বেশীদূর অগ্রসর হতে পারে না। গল্পের এ পর্যায়টাতে একটু ইয়োইয়ো খেলতে হবে, রেজাউল এই বুঝি ঝাপিয়ে পড়ে, এই বুঝি ঝাপিয়ে পড়ে পরিস্থিতি।

হেনা শব্দ করে হেসে ওঠে। পত্রিকা অফিসে দুপুরের ব্যস্ততায় সুর তুলে যায় হাসি। পাশের ডেস্ক থেকে দুই একজন চোখ তুলে তাকায়। অফিস বয় টেবিলে দুই কাপ রঙ চা আর প্লেটে চারটা বিস্কিট রেখে যায়, হেনা নিজেকে সামলে নিয়ে হাসি থামায়,
— শেষ পর্যন্ত ঝাপিয়ে পড়বে না!
— পড়বে তো অবশ্যই। তবে পাঠককে কিছুটা অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। গল্পে নূন্যতম একটা দরিদ্র চরিত্র থাকতে হয়, গল্পের এ পর্যায় পর্যন্ত আশ্রিত ফারজানা ওই দরিদ্র চরিত্র। সে রেজাউলের মনোভাব বুঝে কিন্তু ওর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এক রাতে রেজাউল পেছন থেকে তাকে ঝাপটে ধরবে বা শাড়ির আঁচল ধরে টান দিবে। রিয়েলিস্টিক করে উপস্থাপন করতে চাইলে এভাবে লেখা যেতে পারে— ফারজানার বুকের ওপর কিছু একটা চেপে বসেছে, শ্বাস নিতে কষ্ট প্রচণ্ড হচ্ছে, বুঝতে পারছে না স্বপ্ন দেখছে না জেগে আছে। ঠোঁটে কামড়ের চাপ বাড়তেই ব্যথা আর সিগারেটের গন্ধটা একসাথে পায়, হাঁসফাঁস করতে করতে ঘরের হালকা আলোয় চোখ মেলে তাকাতেই দেখে ক’সেন্টিমিটার দূরে রেজাউলের বড় বড় চোখ। মুহুর্তে রেজাউলের চোখ জোড়া টারানটুলা মাকড়সার চোখ হয়ে যায়। ওর বুকে লোমশ বিশাল মাকড়সাটা চেপে বসছে, বড় বড় লোমশ পা গুলো শরীরে কিলবিলিয়ে নড়াচড়া করছে। ফারজানা হিস্টিরিয়ার রোগীর মত কাঁপছে।

নোমানের বর্ণনায় হেনার শরীর শিরশিরিয়ে ওঠে। ও মাকড়সা খুব ভয় পায়। ওর মনে হচ্ছে চেয়ার বা টেবিলের নিচে একটা মাকড়সা ওত পেতে আছে। সুযোগ পেলেই শরীর বেয়ে উঠতে শুরু করবে। চারদিকের দেয়ালে মাকড়সা আছে কি না দেখে নোমানের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়, এক মুহুর্তেরও কম সময়ের মধ্যে নোমান চোখ ফিরিয়ে নিলেও হেনা বুঝতে পারে নোমান ওর বুকের দিকে তাকিয়ে ছিলো। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নোমান বলে,
— গল্পের মধ্যে একটু মুক্তিযুদ্ধ মেশাতে হবে। এক্ষেত্রে রেজাউল করিম খানকে শান্তি কমিটির সদস্য বানিয়ে দাও, স্বাধীনতার পর রঙ বদলে আরও ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী হয়েছে।

নোমান সাদা কাগজে আঁকিবুঁকি আঁকছে আর বলে যাচ্ছে,
— কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে হেনা। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে অল্প সংখ্যক মানুষ। তাদের শক্তির উৎস ছিলো পাকবাহিনী। মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর পর তাদের অনেকে সিক্সটিনথ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায়। বাকীদের মধ্যে অধিকাংশই মূল স্রোতে মিশে গেছে। যারা বাকী রইলো, মানে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থাকা খুব অল্প সংখ্যক মানুষ, তারা যে রাজনৈতিক স্ট্যান্ড থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিলো, ওই স্ট্যান্ড থেকে প্রকাশ্যে গোপনে রাজনীতিটা চালু রাখলো। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও তাদের প্রকট উপস্থিতি দেখানো হলে মোটেও প্রশ্ন তোলা যাবে না — তাদের রাজনৈতিক অবস্থান কেনো উল্লেখযোগ্য মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেছে? এ প্রশ্নও তোলা যাবে না, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প সংস্কৃতিসহ সব কিছুর বিকাশ ও নিয়ন্ত্রণ তো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির হাতেই ছিলো, তারা কেনো এদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হলো।

হেনা বিষ্ময় গোপন করে না,
— সত্যি, এ প্রশ্নগুলো মনে আসছিলো। তবে দুটো বিষয় একটু পরিস্কার করেন- সিক্সটিন্থ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা কি? রেজাউলের বয়স পঞ্চাশ বছর, স্বাধীনতার বয়স পঞ্চাশ বছর, রেজাউল শান্তি কমিটির সদস্য হয় কিভাবে?

নোমান নতুন একটা সিগারেট ধরায়, বয়কে আরেক কাপ চা দিতে বলে। মন দিয়ে হেনাকে দেখে— হেনার বয়স কত আর হবে চব্বিশ বা পঁচিশ বছর। অথচ চোখে কিশোরীর উচ্ছসিত সরলতা। কাঁধ ছোঁয়া কুচকুচে কালো কোকড়া চুল, গোল মুখে চাপা নাক আর ফোলা গালের জন্য চোখের সরলতা পুরো মুখায়বে সংক্রমিত হয়েছে। কলাপাতা পাড়ের মাখন রঙা মনিপুরী শাড়িতে শ্যামলা হেনাকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, যেনো বহু রঙা পালকে আবৃত কৌতূহলী এক ফিঞ্চ পাখি বসে আছে মুখোমুখি। নোমান নরম স্বরে বলে,
— নয় মাস যুদ্ধের পর ১৬ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হতেই একদল মানুষ যারা যুদ্ধের সময় বিপক্ষে ছিলো বা সম্মুখ সমরে অংশ নেয়নি বা কোনো পক্ষেই ছিলো না, তারা রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা বনে গেলো। ডিসেম্বরের ১৬তারিখে রাতারাতি মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছে বলে এদের বলা হয় সিক্সটিনথ ডিভিশনের মুক্তিযোদ্ধা। তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা খুব সহজ, মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর বয়সে যদি সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করা সার্টিফিকেটধারী চল্লিশ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা পাওয়া যায়, তবে পঞ্চাশ বছর বয়সী শান্তি কমিটির সদস্য পাওয়া যাবে না কেনো!

নোমানের তীর্যক বক্তব্যে হেনা আমোদ বোধ করে,
— মানলাম রেজাউল শান্তি কমিটির সদস্য ছিলো। গল্প কি এখানেই শেষ! মানে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বয়স, কিন্তু এখনও সব অপকর্ম স্বাধীনতাবিরোধীরাই করে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা সর্বশক্তি দিয়ে অল্প কিছু স্বাধীনতা বিরোধীকে সামলাতে পারছে না, যুদ্ধ করেই যাচ্ছে যুদ্ধ করেই যাচ্ছে যুদ্ধ করেই যাচ্ছে। মানে মুক্তিযুদ্ধ চলছেই।
— মুক্তিযুদ্ধ একটা চলমান বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ চলতেই থাকবে। কিন্তু এখানে গল্প থামালে বিদগ্ধ পাঠকরা বলবে, টুইস্ট কই! গল্পে টুইস্ট নেই কেনো!
— সত্যিই তো, এ গল্পে টুইস্ট কই?

নোমান মুচকি হাসি দিয়ে বলে,
— গল্পে টুইস্টের যোগান দিতে প্রস্তুত আছে রেজাউলের দুই ছেলে। রেজাউল অতি বদ লোক, সে অপরাধের শাস্তি পায়নি, কিন্তু প্রকৃতি চরম প্রতিশোধ নিয়েছে, তার সবচে প্রিয় সন্তানটাকে হঠাৎ পাগল বানিয়ে দিতে হবে।
— কি বলছেন এসব! প্রকৃতি কি এভাবে প্রতিশোধ নেয়, নোমান ভাই?
— না, নেয় না। প্রকৃতি বলো বা আমাদের সৃষ্টিকর্তা, কেউই কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা সদা বিরক্ত কোনো রগচটা সাইকো নন যে পরম মমতায় যে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তাদের একের অপরাধে অন্যকে শাস্তি দিবেন।

হেনা চমকে ওঠে,
— এভাবে বলবেন না, বিপদে পড়ে যাবেন। টুইস্ট’টা বলেন?
— প্রথম টুইস্ট হলো রেজাউলের এক সন্তানের পাগল হয়ে যাওয়া। তবে বড় টুইস্ট দেখাবে দ্বিতীয় ছেলে। রেজাউলের দূর সম্পর্কের আশ্রিত শালী ফারজানা আর দ্বিতীয় ছেলে সমবয়সী, দু’জনের গভীর প্রেম।
— বলেন কি! এ তো মারাত্মক টুইস্ট।
— শুধু টুইস্ট দেখলে হবেনা। হেনা, এর মধ্যে ট্যাবু ভাঙা আর মানব মানবীর দুর্নিবার প্রেমও দেখতে হবে। একটু ঘৃণাও মাখাতে হবে, রেজাউল জেনে যায় ছেলের সাথে ফারজানার প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে, তখনই ফারজানার শরীরের প্রতি লোভ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে।

গল্পের ফরমুলা হেনার পছন্দ হয়েছে, নিখিলবঙ্গ প্রগতিশীল সাহিত্য পুরস্কারের জন্য গল্প পাঠানোর শেষ তারিখ আগামী মাসের ২২তারিখ, হাতে প্রায় মাস খানেক সময় রয়েছে। গল্পটা নামিয়ে ফেলা যাবে। হেনা জানতে চায়,
— গল্পের শেষ হবে কিভাবে?
— ফারজানা, রেজাউল বা রেজাউলের দ্বিতীয় ছেলে— এদের যে কোনো একজনকে খুন করে গল্পটা শেষ করা যায়, কিন্তু গল্পে যে আরও কিছু উপাদান আনতে হবে।
— কি উপাদান?
— সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, দারিদ্রের কষাঘাত, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন।

আকাশ থেকে পড়ার দশা হেনার,
— এক গল্পে এতকিছু! কিভাবে সম্ভব!
— খুব সহজেই সম্ভব। বাবার কু-কর্মের কথা জেনে ফারজানাকে নিয়ে রেজাউলের ছেলে পালাবে। বাস ছুটছে। কোনো ঝাঁকি নেই। রেজাউলের মনে হবে গত সরকারের আমলে একবার এ রাস্তা দিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলো। ভাঙা রাস্তায় অনবরত ঝাঁকির কারনে পেট ব্যথা হয়ে গিয়েছিলো। আর কিছুক্ষণের মধ্যে পদ্মা সেতুতে উঠবে গাড়ি। এই সেতুটার বিরুদ্ধে কত আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র যে হলো, সব ষড়যন্ত্র নস্যাত করে প্রধানমন্ত্রী সেতুটা তৈরী করে দিলেন। রাস্তাগুলো মনে হয় মাখন দিয়ে তৈরী, কোনো ঝাঁকি নেই। কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোবে ফারজানা, দূর আকাশে তখনও জেগে আছে স্যাটেলাইট, বাসের স্পিকারে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা গাইছেন ‘এমনি করে যায় যদি দিন যাক না।’

হেনার মনে প্রশ্ন জাগে — নোমান কি রসিকতা করছে! কিন্তু চেহারা দেখে আর কণ্ঠস্বর শুনে তা মনে হয় না। নোমান এশট্রেতে ঘষে সিগারেটের আগুন নেভায়, ফিল্টারটা ভিতরে ফেলে বলে,
— অসাম্প্রদায়িক চেতনার অংশ হিসেবে রেজাউলের ছেলে এক হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিবে। বন্ধুটি ওদের সেবাযত্মের চূড়ান্ত করবে। কাজী ডেকে বিয়ে পড়াবে। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী মিলে নফল নামাজ আদায় করবে, হিন্দু বন্ধুটি ওই সময় ঘরে দেব-দেবীর ছবিগুলো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিবে, যাতে নামাজ আদায়ে সমস্যা না হয়।

— বাহ! বাহ! বেশ বলেছেন। পরের অংশটা মনে হয় ধরতে পারছি। এ সংবাদ রেজাউলের কানে পৌছাবে, রেজাউল ছেলেকে শায়েস্তা করতে হিন্দু পাড়ায় আক্রমণ চালাবে। ঘটনা গড়াবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায়। এই তো?
— ঠিক তাই। হামলার পাশাপাশি অভাবগ্রস্ত হিন্দু মুসলমানদের ফোকাস করে গল্পে দারিদ্রের কষ্টের ছবি আঁকতে হবে। তবে দারিদ্রের কারণ বা রেজাউলের ক্ষমতার উৎস সম্পর্কে কিছুই বলা যাবে না। রেজাউল এমনি এমনি ক্ষমতাবান, ক্ষমতাসীনদের কারো মমতার ছায়া তার ওপর নেই, থাকলেও তা বিরোধী দলের।
— নোমান ভাই, তাই হবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭মার্চের ভাষণ কি সত্যিই এই গল্পে প্রাসঙ্গিক? গল্পের প্রয়োজনে ব্যবহার হবে!

নোমান হাই তুলে, মোবাইল অন করে সময় দেখে, সাদা কাগজে আঁকিবুঁকি করতে করতে বলে,
— পুরস্কারের জন্য গল্প লেখা হচ্ছে— এ গল্পে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থাকবে না! গল্পের প্রয়োজনেই তো সবকিছু আসছে, ভাষণও আসবে। হিন্দু পাড়ায় হামলার পর হিন্দু এবং মুসলিম প্রতিবেশীরা মিলে হামলাকারীদের প্রতিরোধ করবে। প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিবে রেজাউলের ছেলে, তার মনে বেজে চলবে বঙ্গবন্ধুর উদাত্ত কণ্ঠের ভাষণ, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
— গল্পের শেষটা কি হবে?
— গল্পটা বেশ ক’ভাবে শেষ করা যেতে পারে, যেমন রেজাউলের ইন্ধনে সংঘটিত হামলায় ছেলে মারা যাবে, ফারজানাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবেনা। অথবা, রেজাউলকে বিষ খাইয়ে হত্যা করে আত্মঘাতী হবে স্ত্রী। আরও ভয়াবহও শেষ হতে পারে, রেজাউলের ছেলে মারা যাবে, ফারজানার গর্ভে বেড়ে উঠবে রেজাউলের সন্তান।

হেনা বলার মত কোনো কথা খুঁজে পায় না, নোমান তাকে উদ্ধার করে,
— গল্পের ঝোপ বুঝে সীমিত পরিমাণে কাফকা, মারকেজ আর চমেস্কির কোপ মারতে হবে। তুমি আগে গল্পটা লিখে ফেলো, তারপর ঝোপ বুঝে বুঝে লাগসই কোপ মারা যাবে।

হেনা হ্যা সূচক মাথা নাড়ে, আগ্রহ ভরে জানতে চায়,
— আচ্ছা, রেজাউলের ছেলে মানে দ্বিতীয় ছেলের নাম কি দিবো? আর, নোমান ভাই, গল্পটা আপনি লিখছেন না কেনো?

কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবে নোমান, চোখ থেকে চশমা খুলে টেবিলে রাখে, হেনার চোখে তাকিয়ে বলে,
— দ্বিতীয় ছেলের নাম দিও নোমান, নোমান করিম। আর রেজাউলের ছেলেদের এমন গল্প লিখতে নেই।

নোমানের এ কথা কি শুধুই টুইস্ট! ইংগিতপূর্ণ রসিকতা! অথবা নিরেট বাস্তবতা— হেনা একই সাথে বিভ্রান্ত, বিস্মিত এবং আশ্চর্যান্বিত। টেবিলের অপরপাশে এ ফোর সাইজের সাদা কাগজের এক পিঠে আঁকিবুঁকি শেষে অপর পিঠে আঁকিবুঁকি কাটছে জনপ্রিয় দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদক নোমান করিম।

.
(প্রায় এক বছর আগের লেখা, আজ উদ্ধারিলাম, ঘষামাজা করিয়া টাইমলাইনে রাখিলাম)

গল্পঃ দ্বান্দ্বিক

Half of me is beautiful
but you were never sure which half.
— Ruth Feldman, “Lilith”

১.
— মাঝে মাঝে তোমাকে ঠিক বুঝতে পারিনা।
মইনুলের কণ্ঠ নির্বিকার,
— এমন হলে, মাঝে মাঝে, বুঝার চেষ্টা না করাই তো ভালো, তাই না!

সোমা কথা খুঁজে পায় না, খুঁজার চেষ্টা করে এমনও নয়, কথা খুঁজা বা কথার পিঠে প্রশ্ন করার সময় এটা নয়, কোনো কথা না বলে মাইনুলের ডান বাহুর ওপর ঘাড় রেখে শোয়। এভাবে শুতে প্রথম প্রথম বেশ অস্বস্তি হত, ঘাড়ে ব্যথাও হত, এখন আর হয় না।

শোবার ঘর, নীল আলোর ডিম লাইট জ্বলছে, মৃদু আলো আর অপাপবিদ্ধ অন্ধকার – একের ওপর অন্যের অধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধে কেউ নিরঙ্কুশ জয়লাভে সমর্থ হয়নি, ছোপ ছোপ আবছায়া, দু’বছরের অভ্যস্ততায় দু’জনের চোখে সয়ে গেছে, চার দেয়ালে বন্দী বিবর্ণ আবছায়ায় দু’জন দু’জনকে স্পষ্ট দেখতে পায়, চোখের অতি ক্ষুদ্রতম ক্ষণের অভিব্যক্তি আর মুখের রেখার সামান্যতম পরিবর্তনও চোখ এড়ায় না, হয়তো এই অবছায়াতেই দু’জন দু’জনকে সবচে ভালো দেখে- আড়ালহীন, আড়ম্বরহীন।

২.
প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগ, ম্যাচ ফিক্সিং ওপেন সিক্রেট ঘটনা, ক্লাবের কর্তারা বলেছিল, ‘ম্যাচটা ছেড়ে দিও, মইনুল। আজ ত্রিশ ওভারের ভেতর অল আউট হতে হবে।’ ক্রিজে মইনুলের ব্যাট এমনভাবে ঝলসে উঠলো, আম্পায়ার ওকে এলবিডব্লু আউট বা স্ট্রাইকিং এন্ডের ব্যাটার ভুল কল দিয়ে রান আউট করার সুযোগ পেলো না, লো স্কোরিং ওয়ান ডে ম্যাচে ২৮ ওভারের মধ্যে জয় নির্ধারিত হয়ে গেল।

পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি উচ্চতার এথলেটিক ফিগার আর শান্ত মুখায়বের এটাকিং পেস বলার মইনুল, ফোর্থ বা ফিফথ ডাউনে নির্ভরযোগ্য স্টাইলিশ ব্যাটার। মাঠের বাইরে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যাওয়া ম্যাচগুলোতে মইনুল বিপজ্জনক খেলোয়াড়, যতবার নির্ভর করা হয়েছে, ফলাফল উলটে গেছে। এ নিয়ে ক্লাব আর বোর্ডের ক’জন কর্তার সাথে মইনুলের সম্পর্ক তিক্ত থেকে তিক্ততর দিকে গড়াচ্ছিল। তবু আশা ছিলো উইকেট ও রানের হিসাবে, দক্ষতা আর যোগ্যতার পরিমাপে জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ পাবে, পলিটিক্যাল ব্যাকিং না থাকায় প্রাথমিক ট্রায়ালেও ডাক পায়নি।

ক্রিকেট ভদ্র লোকের খেলা, ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে যে রাজনীতিটা চলে, ভদ্রলোকরাই করে, তা মোটেও ভদ্রলোকের রাজনীতি নয়- এ ধ্রুব সত্যটা প্রায় প্রতিটি খেলোয়াড় জানে। মইনুল এ রাজনীতির অংশ হতে চায়নি, প্রতিপক্ষও হতে চায়নি, ও বিপ্লবী নয়, নিজের প্রতি ঘটা অবিচারটা কষ্ট হলেও মেনে নিয়ে, মাস্টার্স শেষ করার আগেই বল, ব্যাট আর প্যাড কফিনে বন্দী করে ক্রিকেটের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ইতি ঘটায়।

মাস্টার্স শেষে চাকরীর জন্য মইনুলকে অপেক্ষা করতে হয়নি, দু’বছরের মধ্যে নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছিল। এমন হিরার টুকরা ছেলেকে আর একা রাখে যায় না, কোথায় কোন মেয়ের পাল্লায় পরে, কোন মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে তোলে, এসব দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত পৃথিবীর সকল মায়ের মত ‘যা দিনকাল পড়েছে’ দর্শনে মইনুলের মা’ও সমান বিশ্বাসী, ছেলে কিছু ঘটিয়ে ফেলার আগেই তিনি পাত্রী অনুসন্ধানে ব্যস্ত হলেন।

৩.
প্রতিটি সুখী বাঙালি পরিবারই কি মাতৃপ্রধান, সুখী পরিবারগুলোর প্রশাসনিক প্রধান কি বাবা এবং নির্বাহী প্রধান মা- না, এমন কোনো পরিসংখ্যান বা গবেষণাপত্রের খোঁজ মইনুল পায়নি, তবে এ সূত্র মেনেই ওদের পরিবার আদর্শ সুখী পরিবার। নামজাদা গ্রুপ অব কোম্পানিতে বাবা প্রবেশ করেছিলেন সহকারী হিসাব রক্ষক পদে, এখন চিফ একাউন্টেন্ট, অফিসে হিসেব পত্তর মিলান আর বাড়িতে ইংরেজি থ্রিলার পড়েন, সংসার পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করেন মা। বাবা সপ্তাহে দু’দিন বাজার করেন, সেও মা’র দেয়া লিস্টি মেনে, একটুও এদিক ওদিক হবার জো নেই।

মা’র মাথায় সবসময় ঘোমটা থাকে, পান খাওয়া লালচে ঠোঁটে লেগে থাকে এক চিলতে স্মিত হাসি, প্রশ্রয়ের হাসি নয়, এ হাসি অপরের মাঝে সংক্রমিত হয় না, এ হাসি মোলায়েম হয়েও বুকের গভীরে বিদ্ধ করে। মা হাসিমুখে নিপুণ দক্ষতায় সংসার চালান, নিয়ন্ত্রণের কঠোরতাটা খালি চোখে ধরা প্রায় পড়েই না, কিন্তু এটাও সত্য পরিবারের কারো পক্ষেই তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া সম্ভব নয়। তিন বছর আগের কথা, বড় ফুপু খুব করে চাইছিলেন মইনুলের ছোট বোন মিতুকে ছেলের বউ করতে, বোনের আবদারে ভায়ের মানে বাবার আপত্তি ছিল না, আপত্তি ছিলো মা’র। কিন্তু সে কথা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করেন নাই, এমনভাবে পরিস্থিতি সামাল দিলেন, বড় ফুপু নিজেই আবদার থেকে সরে এলেন, মিতুর বিয়েতে ফুপা হাসি মুখে উকিল পর্যন্ত দিলেন।

এক মাত্র ছেলের জন্য মা পাত্রী দেখতে শুরু করেছিলেন আগেই, অবশ্য একদিন, সাপ্তাহিক ছুটির এক দুপুরে, খাবার টেবিলে এলেবেলে কথার মাঝে, বাবার সামনে হঠাৎ জানতে চাইলেন, ‘তোর কোনো পছন্দ টছন্দ নেই তো! থাকলে বলতে পারিস, বাবা।’ মইনুল ভাত খাওয়া থামিয়ে বিস্মিত দৃষ্টিতে মা’র চোখে তাকায়, বলে, ‘তেমন কেউ থাকলে তো তুমি জানতে, মা। আমি না জানালেও খুঁজে খুঁজে ঠিক বের করে ফেলতে, কি ফেলতে না!’ মা’র হাসি বিস্তৃত হয়, পরম মমতায় রুই মাছের আরেকটা টুকরো মইনুলের প্লেটে তুলে দেন, ‘খা বাবা, নদীর মাছ, কড়া করে ভেজে রান্না করেছি।’

শুধু যে মা’ই পাত্রী দেখছেন এমন নয়, আত্মীয় স্বজন আর বন্ধু বান্ধবরাও পিছিয়ে নেই, অপার উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে যে যার অবস্থান হতে যোগ্য পাত্রীর অনুসন্ধানে এগিয়ে এসেছে। একদিন বন্ধু অপু মা’কে বলল, ‘চাচী, একবার সোমাকে দেখেন। মইনুলের সাথে মানাবে ভালো, বেশ সুন্দরী, হাইট পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি।’

‘বেশ সুন্দরী’ এবং ‘হাইট পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি’ – মা’র কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, এ তথ্যই সোমার প্রতি মা’কে আকৃষ্ট করলো। তিনি মইনুলের সাথে এমন একজনকে জুড়ে দিতে চান, যে সকল দিক দিয়ে মানানসই বা চলনসই হবে না, হবে অদ্বিতীয়া।

৪.
নিজের রূপ সম্পর্কে সোমার সন্দেহ ছিলো না, আর দশজন মেয়ের সাথে দাঁড়ালে ও বিশেষ থেকে বিশেষতর হয়ে ওঠে, এ তার জানা। অনার্স ফার্স্ট ইয়ার পর্যন্ত প্রেমিকের অভাব ছিলো না, সব একতরফা প্রেমিক, ও পাত্তা টাত্তা দেয়নি। সেকেন্ড ইয়ার থেকে কিভাবে যেনো রটতে শুরু করেছিলো সোমা কারো সাথে অঙ্গীকারাবদ্ধ, একতরফা প্রেমিকরা সব আশা ত্যাগ করে দূরে সরে গেল, এক একটা দিন সোমার খুব প্রেম পেত, এক তরফা প্রেমিকদের জন্য মায়া হত, কোনো এক অচেনা প্রেমিকের জন্য বুকে শূন্যতা বোধ করতো- ওই বোধ করা পর্যন্তই।

সোমা অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার অপেক্ষা করছে, তখন হঠাৎ করেই সম্বন্ধটা এলো। পাত্র কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে মাঝারি পদে চাকরি করে, হ্যান্ডসাম, বাজে অভ্যাস নেই, ক্রিকেট খেলতো এক সময়, লেনা-দেনা নেই, পরিবারও ছোট- সম্বন্ধ স্থাপনে অরাজী হওয়ার বা প্রত্যাখানের কোনো গ্রহনযোগ্য যুক্তি পাওয়া গেলো না। সোমার বাবা সহজেই রাজী হলেন, মা মৃদু আপত্তি তুলেছিলেন, ‘ফাইনাল পরীক্ষাটা আগে শেষ হোক, তারপর বিয়ের কথা ভাবা যাবে’, আপত্তি টিকলো না।

ঝামেলা ছাড়া বিয়ে বাঙালির কালচারে নেই, এ বিয়েও ব্যতিক্রম নয়, মইনুলের মা’র কাঁধে চেপে উপস্থিত হলো ঝামেলা, তিনি বিয়ের জন্য এমন তাড়াহুড়ো শুরু করলেন, সোমার ছোট মামা বললেন, ‘এতো তাড়াহুড়ো কেনো! ছেলে কি ড্রাগ এডিক্ট না অস্ত্র মামলার আসামী!’ বিয়ে ভাঙে ভাঙে অবস্থা, সোমার বাবা শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবিলা করলেন।

মইনুলের সাথে বিয়ের কথাবার্তা যখন চলছে, সোমার কোনো বক্তব্য ছিলো না, বাবা-মা’র ওপর সব ভার ছেড়ে দিয়েছিলো, মইনুলকে দেখার পর, কথা বলার পর, মনে হয়েছে এই মানুষটার সাথে একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব, কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

মইনুল আর সোমার সংসার জুড়ে উপছানো সুখ, দু’বছর চলছে, বড় ধরণের ঝগড়া হয়নি, মন খারাপের কারণ ঘটেনি। সোমা ক’বার চেষ্টা করেছে মইনুল রাগাতে, ঝগড়া করতে, মইনুল হাসতে হাসতে বলেছে, ‘আচ্ছা রাগলাম, তুমি এবার ঝগড়া শুরু করো।’ এভাবে কি ঝগড়া শুরু করা যায়, সোমা ওই চেষ্টা বাদ দিয়েছে। মইনুল যে যত্ম নেয়, ওর ইচ্ছার গুরুত্ব দেয়, ভালবাসে, সোমা বেশ উপভোগ করে, কড়ায় গণ্ডায় ফিরিয়ে দিতে চেষ্টা করে।

এক একটা দিন, মইনুলের যে কি হয়, সোমা ঠিক বুঝতে পারে না, কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে প্রশ্ন করে, মইনুল কখনো কখনো প্রশ্নের উত্তর দেয়, এমন উত্তর দেয় যার কোনো অর্থ হয় না, বেশীর ভাগ সময়ই পাশ কাটিয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্নটার মুখোমুখি হলেই, মাইনুলের চোখের অভিব্যক্তি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে, আবছায়াতেও সোমার চোখ এড়ায় না।

৫.
ঘর জুড়ে নরম নীল আলো এবং অন্ধকার, দুইয়ের অবিশুদ্ধ মিশ্রণে বিকশিত আবছায়া বিবসনকে রহস্যময় করে তোলে, বসনকে শৈল্পিক। যুগল হাওয়ায় অজস্র প্রজাপতি উড়ানো শেষে, ফুলকি আঁকা পাখায় পাখায় নিবিড়তম পর্যটন শেষে, পরস্পরের পালকে পালকে ওমের সঞ্চারণ শেষে,
কোমল বাঁকের নদীকে কাচবর্ণ স্বচ্ছ রাতপোশাকে বন্দী করতে করতে মইনুলের চোখে চোখ রাখে সোমা,
— মাঝে মাঝে সত্যিই তোমাকে ঠিক বুঝতে পারিনা, সত্যিই বুঝতে পারি না।
মাইনুল একটা সিগারেট ধরায়, লম্বা টান দেয়, অপর হাতে সোমার বুকের খাঁজে বিলি কাটতে কাটতে বলে,
— কি বুঝতে পারো না।

সোমা বিস্মিত, এই প্রথম জানতে চাইছে মইনুল, বিস্ময় গোপন না করে বলে,
— তুমি.. মানে তুমি মাঝে মাঝে কেমন বদলে যাও, পশুর মত, ওই সময়টাতে তোমার স্পর্শে আদর নয়, ভর করে পাশবিক রাগ আর জান্তব ঘৃণা.. তোমার চোখে.. তোমার চোখে তাকাতে ভীষণ ভয় হয়..

‘হু’ বলে সিগারেটে আরেকটা টান দেয় মইনুল, সোমারও ত্বরা নেই, মইনুলের চোখে একের পর এক অবিভ্যক্তির দ্রুত পরিবর্তন লক্ষ্য করে যায়।

মইনুলের মস্তিষ্কে বা মনের স্ক্রিনে ভাসছে একের পর এক দৃশ্য, ছায়াছবির ট্রেলার যেনো, এক দুপুর, উদোম শরীরে মইনুল ঘুমোচ্ছে, মা ডেকে তুললেন, শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার বুকে এমন নীল দাগ এলো কোথা থেকে?’ মইনুলের উত্তর, ‘পোকার কামড় হবে হয় তো।’ মা বললেন, ‘পোকা দেখছি পিঠে আঁচড়ও কেটেছে, বিষাক্ত পোকা,ওষুধ লাগাও।’

‘বিষাক্ত পোকা’ কথাটার প্রতিবাদ করে মইনুল বলতে চাইলো, ‘বিষাক্ত পোকা নয় মা, নীল পোকাটার নাম দোলা’, মা’র শীতল চোখে তাকিয়ে বলার সাহস হলো না, অথচ দোলার জন্য জীবন বাজি রাখার প্রতিজ্ঞা ছিল।
পোকার দৃশ্য দ্রবীভূত হয়ে গেলো মহম্মদপুরের এক রুমের ফ্ল্যাটে, গোপন সংসার, দোলার সাথে গভীর প্রেম, উন্মাদনা, খুনসুটি, ঝগড়া, এক দিন দেখা না হলেই শ্বাসকষ্টের শুরু, কাজী অফিসে গোপন বিয়ে, প্রিমিয়ার লীগ আর বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলার কারণে আয় রোজগার নেহায়েত মন্দ নয়, সপ্তাহে এক কি দুই দিন ভার্সিটি ফাঁকি, মহম্মদপুরের ফ্ল্যাটে সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজেদের মত কাটানো, এক একটা দিন পোকা পোকা খেলা, মাস্টার্স শেষে মা’কে ম্যানেজ করে দোলাকে ঘরে তোলার স্বপ্ন।

স্বপ্নের দৃশ্য মুছে দেয় ধেয়ে আসা ঢেউ, শুরু হয় নতুন দৃশ্য, প্রবল ঘোর, দোলাময় দিনকাল, ঘরে সাবধানতা, তবু পাঁচ মাসে বার দু’য়েক মা’র চোখে দৃশ্যমান হয় পোকার কামড়, জুম হয়ে আসে মা’র চোখ, দু’বারই মনের ভেতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন মা’র এমন তীক্ষ্ম দৃষ্টি, মুহুর্তের জন্য দাগের দিক হতে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া, চোখে চোখ রেখে উনার শীতল হাসি, কিছুই না বলা, মা’র আচরণে মনের ভেতর সংঘবদ্ধ প্রবল ভয় আর আনন্দ অশেষ।

উজ্জ্বল আলোর বিচ্ছুরণে ঢেকে যায় প্রবল ভয় আর আনন্দ অশেষ, মা’র আবদার — ‘দোলাকে একদিন বাড়িতে নিয়ে আয়, বাবা’, বিব্রত মইনুল, আনন্দে শ্বাসকষ্টের শুরু, আকাশ অনেক নিচে নেমে এসেছে, ঘরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে মেঘ, কিছু না বলে ‘হ্যা’ সূচক মাথা নাড়ানো, বিকেলে কথাটা জানাতেই দোলার করুণ স্বর, ‘সত্যিই তোমার মা আমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলেছেন! কিন্তু উনি তো… উনি তো…’ কথা শেষ না করে দোলার থেমে যাওয়া।

দৃশ্যের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জরুরী বিভাগ, উদ্বেগ আর আহাজারিতে ঠাসাঠাসি, দম বন্ধ হয়ে আসছে, এক পাশে স্ট্রেচারে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে দোলা, রক্তে-মাংসে মাখামাখি, আধ চা চামুচের মত মাথার ঘিলু চুইয়ে পড়েছে স্ট্রেচারে, যে মগজে দোলা সর্বস্ব দিয়ে ধারণ করেছিল মইনুলকে, ওই মগজের অনেকটা ততক্ষণে নীলক্ষেত মোড়ে মিশে গেছে, ঘাতক গাড়ির চাকায় পিষ্ট হতে হতে শুকিয়ে ধুলো হয়ে গেছে। দোলার নিথর হাতটা মুঠোয় পুরার পর, কি আশ্চর্য, মইনুলের চোখে ভেসে উঠে মা’র তীক্ষ্ম দৃষ্টি আর স্বভাবসুলভ স্মিত হাসি মাখানো নির্ভার মুখাবয়ব।

মইনুলের মস্তিষ্ক বা মনের স্ক্রিনে আড়াই মিনিটের শো শেষ হয়, ওর জানা নেই কে দোলাকে খুন করেছিলো, কিভাবে খুন করেছিলো, তবে নিশ্চিত জানে কে খুন করিয়েছিল, ও নিজেকে সংযত রাখতে চেষ্টা করে।
এক একটা সময় মইনুলের অজান্তে মস্তিষ্ক বা মনের ভেতর স্লাইড শো শুরু হয়ে যায়, মনে ভর করে বিকট আক্রোশ, এ আক্রোশের জন্ম বীভৎস অন্ধকারে। মর্মঘাতী আক্রোশে নিমজ্জনের সময়গুলোতে সোমাকেও দোলার খুনি মনে হয়, আঙুলে পিষে পিপঁড়া মারার মত সোমাকে পিষে পিষে খুন করতে ইচ্ছে করে।

ঘরে ছোপ ছোপ অন্ধকার, আলোর প্রতি অন্ধকারের বা অন্ধকারের প্রতি আলোর আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধে এখনও জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়নি, দোলার কথা জানাবে কি জানাবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না মইনুল, জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে মইনুলের চোখে তাকিয়ে আছে সোমা।

.
দ্বান্দ্বিক| গল্প
২৭অক্টোবর২০২১