আবু সাঈদ আহমেদ এর সকল পোস্ট

গল্প: কবুতরের বুক

একটা পাতাও বাকী নেই ঝরার মত, শীতের এখন অখণ্ড বিশ্রাম। মাঘ মাসের মাঝামাঝি, শীত যেনো এক পাখি, ডানা মেলার অপেক্ষারত, বিকেলের মনমরা রোদে ঠোঁট দিয়ে পালক পরিচ্ছন্নতায় মগ্ন, মাঝে মাঝে পাখা ঝাপটে শিরায় শিরায় সঞ্চালন করে উষ্ণতা, দীর্ঘ উড়ালের আগে কুয়াশার রাত্রিস্নানে ধুয়ে ফেলতে চায় সমস্ত ঝরা পাতার ক্ষয়ে যাওয়ার ঘ্রাণ।

সকাল ১১টা, রিসোর্টের বাংলোর বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চা পান করছে মিজান। বাংলোর চারদিকে অরণ্য, বারান্দার সামনেও ঝরে আছে পাতা, বারান্দায় কোনো পাতা নেই, পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে। মিজানের কাছে এই পরিচ্ছন্নতা বড় অশোভন লাগে, এই পরিচ্ছন্নতা ঘোষণা করছে- অরণ্যের অংশ হয়েও রিসোর্ট অরণ্য নয়, বাংলো এক বেমানান দখলদার মাত্র।

চারদিকে শুনশান নিরবতা, অরণ্যের স্বর ছাড়া আর কোনো সুর নেই, চা’য়ে চুমুক দেবার মৃদু শব্দও কানে লাগে। নিঃশব্দে চা পানের চেষ্টা করছে মিজান, কাপের যে পাশটায় চুমুক দিচ্ছে, ওই পাশে উপর থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত নেমে এসেছে চা’য়ের সরু রেখা, বহুবার চেষ্টা করেছে চুমুকের ফাঁক গলে চা যেন না বেরোয়, কৌশল বুঝেছে কিন্তু আয়ত্ব করতে পারেনি।

আইভোরি স্টোনের ঘোলা আভার সাদা কাপ, একপাশে দুটো সবুজ পাতা আর গোলাপি রঙের ফুলের নকশা, ঘোলা আভায় ধূসর অন্য পাশটায় সদ্য গড়িয়ে নামতে নামতে থমকে যাওয়া চা শুকিয়ে এসেছে- ঝড়াপাতা রঙ, কালচে খয়েরী। চায়ের রেখা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকায় মিজান, বাংলোর বারান্দা থেকে একটু দূরে পলাশ গাছ, গাছটার ছায়ায় একটা বনবিড়াল থমকে দাঁড়িয়ে আছে, পলকহীন তাকেই দেখছে। চোখাচোখি হতেই, ক’মুহুর্ত দু’জনেই স্থির, বনবিড়ালটা অনিচ্ছায় চোখ সরিয়ে নিলো, হাই তুললো, ধীর পায়ে চলতে শুরু করলো, পায়ের চাপে হাঁটার তালে খুব মৃদ শব্দ হচ্ছে মঅশ…মঅশ.. মঅশ.. মঅশ..। চায়ের কাপ পর্যবেক্ষণে ফের মন দেয় মিজান।

কাপে লেগে থাকা চায়ের দাগ জমাট বাধছে, ওই দাগে বারবার চোখ যায়, সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দেয় মিজান, বুঝতে চেষ্টা করে ঠিক কবে চুমুর ফাঁক গলে চুইয়ে পড়েছিল দুই ফোটা দূরত্ব, দিবা আর ওর মাঝে দাগ হয়ে ঢুকেছিলো সীমান্ত! দিবার কথা মনে পড়তেই মিজানের মন ও শরীর ঝমঝমিয়ে ওঠে, মাথার ভেতর জেগে ওঠে মালিবাগে দুই রুমের ফ্ল্যাট, ছুটির দুপুর, কলিংবেল বাজছে, বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই বিস্ময়, দিবা দাঁড়িয়ে আছে, অবাক করে দেওয়ার তৃপ্তিতে হাসছে।

‘দেখতে এলাম ছুটির দিনে তুমি কি রান্না করেছো?’ বলতে বলতে ঘরে ঢুকে দিবা। ছুটির দিনে মিজানকে আলসেমিতে পায়, সকালে বাজার করে বটে, কিন্তু আগে বেচে যাওয়া ফ্রিজে রাখা খাবারে দিনটা কাটিয়ে দেয়, শুধু বিকেলটাতে, যে ছুটির বিকেলগুলোতে দিবার সময় হয়, দু’জনে দেখা করে, কোনো রেস্টুরেন্টে বসে, প্রেম আর খাওয়া দুটোই চলে। আজ দিবার সাথে দেখা হবে না বলে সকালে বাজার করা হয়নি, ফ্রিজে যা ছিলো একটু আগে খেয়েছে, ঘুমাবার আয়োজন করছিল- তখনই বেজে উঠেছে কল বেল। এই প্রথম দিবা ঘরে এলো, কিন্তু ঘরে খাবার কিছুই নেই।

দিবা সোফায় বসে, নীলচে বেগুনি জামদানী শাড়িতে ওকে অন্য রকম সুন্দর লাগছে। ঈষৎ মোটা ঠোঁটে কায়দা করে পার্পল শেডের লিপিস্টিক মাখায় চেহারায় এক ধরণের গাম্ভীর্য এসেছে। নাকের ডগায় এক বিন্দু ঘাম, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম- আশ্বিনের গরমে পাঁচ তলায় সিড়ি বেয়ে উঠায় গাল দুটোতেও লালের ছোপ লেগেছে। রেশমের মত উজ্জ্বল চুল, খোলা, কাঁধ স্পর্শ করেছে। ওর হাসি বলেই চলছে, ‘কেমন সারপ্রাইজ দিলাম!.. কেমন সারপ্রাইজ দিলাম!…’ টানা টানা দুই চোখেও ছড়িয়ে পড়েছে হাসির সংক্রমণ।

‘দিবা, তুমি কি খাবে- তেহারি না কাচ্চি?’ বলে মিজান স্যান্ডো গেঞ্জির ওপর শার্ট পরে বোতাম লাগায়, দিবা মাথা নাড়ে- ‘থাক, কিছু খাবো না’। তবুও মিজান দরজার দিকে পা বাড়ায়, দিবা উঠে দাঁড়ায়, পিছন থেকে এগিয়ে আসে, মিজানের হাত টেনে ধরে, সামান্য বিরক্তি নিয়ে বলে ‘বলেছি তো থাক। কি বলেছি না!’ মিজান ঘাড় ফিরিয়ে চোখে চোখ রাখে, ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখোমুখি আর তখনই, না তখনই নয়, সময়ের পাল্লায় অপরিমাপযোগ্য দীর্ঘ মুহুর্ত ধরে ঘটনাটা ঘটে চলে, যখন ঘোর কাটে, তখনও মিজানের মুঠোয় থরথরিয়ে কাঁপছে কবুতরের এক জোড়া বুক– অনাবৃত, খোসা ছাড়ানো ভাজা বাদাম দানা রঙ।

‘স্যার, আজ লাঞ্চের মেনুতে সাদা ভাত, আলু ফুলকপি সিম মটরশুটি মিলিয়ে ভাজি, মুরগির মাংসের তরকারি, আলু বেগুন দিয়ে রুই মাছের তরকারি আর ডাল’, কোলাহলহীন এক ছুটির দুপুরের স্মৃতিবিম্ব টোপ গিলে ফেলা মাছের ঘাই ও ছটফটানো পর্যন্ত প্রসারিত হবার আগেই থমকে যায়, ওয়েটার যোগ করে, ‘স্যার, আপনার কি এই মেনুতে চলবে? বাবুর্চি কি অন্যকিছু রান্না করবে?’ মিজানের চোখে ভাসে তরকারির বাটিতে রুইমাছে মাথা, অসমাপ্ত ত্রিভুজ যেন, ছিপের টোপ গিলে ফেলার পর ঘাই আর কাতর ছটফটানি। অঅন্যমনস্ক মিজানের দিকে ওয়েটার হাসিমুখে তাকিয়ে আছে, সে জানে ভিআইপি গেস্টদের সাথে তাড়াহুড়ো করতে নেই।

দুই যুগ আগের কথা, হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর মিজানুর রহমান চৌধুরী তখন শুধুই ডাক্তার মিজান, প্র‍্যাক্টিস শুরুর দুই বছরের মাথায় সবেমাত্র অল্প বিস্তর নাম ছড়াতে শুরু করেছে। বিভিন্ন রোগের রোগী আসে- মৌসুমী জ্বর হতে কর্কটরোগ, মানসিক ভারসাম্যহীনতা হতে যৌন দুর্বলতা, কিছুই বাদ যায় না। একদিন চেম্বার বন্ধ করার ঠিক আগের মুহুর্তে অসুস্থ মা’কে নিয়ে এলো একুশ কি বাইশ বছর বয়সী এক ছিমছাম মেয়ে। রোগী দেখে, যতটূকু অভিজ্ঞতা, তাতে মিজান বুঝল অবস্থা গুরুতর, এমন রোগীকে সিনিয়র ডাক্তারের কাছে রেফার করে দেওয়াই উত্তম। তবু সে কিছু জরুরী পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিলো, ওষুধও দিলো, দ্রুত পরীক্ষাগুলো করে রিপোর্টসহ দেখা করার পরামর্শও দিল।

রোগী বিদায় হওয়ার পর ডাক্তার মিজানের মনে জিজ্ঞাসা তৈরী হয় কেনো রোগীকে সিনিয়র কারো কাছে রেফার না করে নিজেই চিকিৎসা দিচ্ছি, রোগী অপেক্ষা রোগীর এটেন্ডেন্ট কি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, মেয়েটার কথায় বা চাহনিতে বা আচরণে বা সব মিলিয়ে এমন কিছু কি আছে যা এড়ানো যায়নি, অথবা গভীর দৃষ্টির মেয়েটাকে বারবার দেখার জন্যই মা’কে চিকিৎসা দেওয়া– উত্তর বেশী দিন খুঁজতে হয়নি, সিনিয়র ডাক্তারের কাছে মায়ের চিকিৎসার ভার তুলে দিয়ে নির্ভার হয়েছিল মিজান, মাঝের অল্প ক’দিনে দিবা নামের মেয়েটার সাথে সম্পর্ক গাঢ়ত্বের পথে অগ্রসর হতে শুরু করেছিল, গড়িয়েছিল মালিবাগের ওই ছুটির দুপুর পর্যন্ত, তারপর আরও কিছুটা পথ।

নাম ছড়ানোর ব্যস্ততায় দিবার সাথে দূরত্ব বাড়ছে- এটা মিজান বুঝতে পারছিল, কিন্তু দু’জনের দূরত্বের মধ্যস্থিত শূন্য স্থানে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র একাউন্টেন্ট সীমান্ত এটে যাবে — এতটা ব্যবধান নির্মিত হয়ে গেছে, বুঝেনি। ব্যস্ততা আর সময়ের অভাবের মাঝেও এক একটা দিন, কবুতরের কম্পিত বুক আর টোপ গেলা অসমাপ্ত ত্রিভূজের মত রুইয়ের মাথার ঘাই ও ছটফটানি চলছিল, তাতে উত্তাপ ছিলো, প্রাণ ছিলো, শুধু প্রণয়ের দায়বদ্ধতা ছিল না। ডাক্তার মিজান থেকে প্রফেসর মিজানুর রহমান চৌধুরী হবার পথে সবার আগে দিবাকে হারিয়েছে, দিবা তাকে দায়মুক্ত করে দিয়েছিল।

ওয়েটারকে উত্তর না দিয়ে মিজান ডাকে, ‘অনিকা.. অনিকাআআআ.., মাই সুইট বেইবি…’, ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলো উনিশ বিশ বছরের এক মেয়ে, সদ্য ঘুম ভাঙা, লাবন্যে পূর্ণ মুখশ্রী, এক চিলতে হাসিতে মাঘীরোদের উষ্ণতা ছড়িয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে মিজানের চোখে চোখ রাখে, মিজান জানতে চায়, ‘নাস্তায় কি খাবে? লাঞ্চের মেনুতে আজ প্লেন রাইস, মিক্সড ভেজিটেবল, চিকেন অর রুই মাছের কারি- চলবে তোমার!’ একটু ভেবে ‘হ্যা’ সূচক মাথা নেড়ে ঘরে যেতে যেতে অনিকা বলে, ‘ব্রেকফাস্টে দু স্লাইস ব্রেড, জ্যাম আর এক মগ কফি দিতে বলো।’

প্রতি বছরই ক’টা ওষুধ কোম্পানি নামজাদা ডাক্তারদের দেশের বাইরে প্লেজার ট্রিপের অফার দেয়, ব্যবস্থা করে, কোনো রকম রাখঢাক না রেখেই বলে, ‘স্যার, ফ্যামিলি নিয়ে যাবেন না কোম্পানিয়ন দিবো!’ ডাক্তার মিজান এসব অফার পেত না, প্রফেসর মিজানুর চৌধুরী একাধিক অফার পায়। একেক বছর একেক কোম্পানির অফার গ্রহন করে, সবসময়ই পরিবারের কাউকে না কাউকে সঙ্গে নেয়- কখনো বউ, কখনো ছেলে, কখনো দুই মেয়ে। এবারই ব্যতিক্রম, প্লেজার ট্রিপ ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান কোম্পানিওনের ব্যবস্থা করেছে, সঙ্গে এসেছে সোসাইটি গার্ল অনিকা।

লাঞ্চ শেষ, মিজান বিছানার ডালায় হেলান দিয়ে আধশোয়া, বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে শুয়েছে অনিকা, গায়ে ফিনফিনে গাউন, অনিকার চুলে বিলি কাটছে মিজান,
– অনিকা, তুমি যে এখানে এসেছো, তোমার বাবা-মা জানেন?
– হ্যা, তারা জানে অফিসের ট্রেইনিংয়ে এসেছি। প্রতিমাসেই আমার একবার এমন ট্রেইনিং থাকে।

দুপুর গড়াচ্ছে বিকেলে, অরণ্যে ভর করেছে আলাস্য, ঘুঘু ডাকছে, ফালি ফালি রোদের টুকরোয় মাখামাখি অচেনা বিষাদ, ঘরে ঘন হয়ে এসেছে অনিকার শ্বাস, বায়ান্ন বছর বয়সী মিজানের মুঠোয় থরথরিয়ে কাঁপছে একজোড়া কবুতরের বুক- অনাবৃত, বাদাম রঙা। মিজানের শরীরে লেপ্টে যেতে যেতে অনিকা বলে, তুমি কি দিবাকে চেনো, বেইব! আমার মা হয়, সে বলে, প্রফেসর মিজানুর রহমান চৌধুরী মানে তুমি আমার বাবা হতে পারতে।’

চারদিকে শুনশান নিরবতা, অরণ্যের স্বর ছাড়া আর কোনো সুর নেই। একটা পাতাও বাকী নেই ঝরার মত, শীতের এখন অখণ্ড বিশ্রাম।

অবিভাজ্য |পর্ব ৬-৭| মনসুখিয়া সিরিজ

৬.
মেরিন ড্রাইভ, এক্সোটিক সাম্পান হোটেলের চার তলা, বারান্দায় তিন জন বসে আছি। সি ভিউ বারান্দা, অনেক দূর পর্যন্ত সমুদ্র দেখা যায়, খুব দূর থেকে ছোট ছোট ঢেউ একের সাথে এক যোগ হতে হতে ধেয়ে আসছে, সাদা ফেনা নিয়ে আছড়ে পড়ছে তটে, আবার ফিরে যাচ্ছে।

মা বললেন,
– এভাবে রুবাইকে আনা কি ঠিক হলো! আমিও তো এতকিছু জানতাম না।
– সব কিছু ঠিক হতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই, মা। তবে শাফাকাতের কাছে একটা চিঠি দিয়ে এসেছি, আজ আপাকে পৌছে দিবে।
– চিঠিতে কি লিখেছো?
– বেশি কিছু নয়।

পকেট থেকে ডুপ্লিকেট কপি বের করে মা’কে দিলাম, চিঠিতে লেখা আছে-

প্রিয় আপা,
সালাম নিও।
জানি তুমি আর দুলাভাই হন্যে হয়ে রুবাইকে খুঁজছো। থানা থেকে পীর-ফকিরের বাড়ি কিছুই বাদ রাখনি। রুবাই ছোট থাকতে সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিলেই পারতে, এখন রুবাই আর রাফির মতামত ছাড়া সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিতে পারো কি না- নিজেদের প্রশ্ন কোরো। এই যে দু’জনে একসাথে রুবাইকে খুঁজছো, একে অপরকে সামলাচ্ছো, হাত ধরে কাঁদছো- এডজাস্টমেন্টের কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো!

চিন্তা কোরো না, রুবাই ভালো আছে।
ইতি
রুবাইয়ের মামা
এক্সোটিক সাম্পান, কক্সবাজার।

রুবাই জানতে চাইলো,
– এ চিঠি পড়ে বাবা-মা কি সিদ্ধান্ত বদলাবেন?
– জানিনা রে মা। তবে বিপদ মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায়, পরস্পরকে নতুন করে চিনতে শেখায়। বিপন্নতায় আর সঙ্কটে মানুষের পারস্পরিক দূরত্ব কমে আসে। তাই আশা করতে পারিস- হয়তো কাল সকালেই দেখবি তোর বাবা-মা কক্সবাজারে চলে এসেছেন।

রুবাই বিশ্বাস করতে পারছে না,
– যদি না আসে?
– তবে আর কি, তোকে নিয়ে মনসুখিয়ায় চলে যাবো।
– মনসুখিয়াটা আবার কোথায়?
– মনসুখিয়া আছে মনসুখিয়ায়। যাবার হলে তোকে জানাবো।

মা পান চিবুচ্ছেন। রুবাই নানুর চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। সমুদ্রে সন্ধ্যা নামছে, বারান্দা থেকে ঢেউয়ের গড়ে ওঠা আর ভেঙে পড়া দেখছি, ফেনিল স্রোতের আছড়ে পড়া আর ফিরে যাওয়া দেখছি। ভিকারুননিসা একদিন গুনগুনিয়ে গেয়েছিলো ‘আমি মন ভেজাবো ঢেউয়ের মেলায় /তোমার হাতটি ধরে।’ তারপর সমুদ্র দেখার কত যে ছেলেমানুষী পরিকল্পনা, দু’জনে হাত ধরে সারারাত সৈকতে বসে চন্দ্রযাপনের স্বপ্ন। সমুদ্রে সে আসে কি না জানা নেই, বহু আগেই সে নটর ডেমের কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছে হাত।

৭.
আপাকে দেওয়া চিঠির খামে গ্রিন লাইনের তিনটা টিকিটও ছিলো। আজ সকালেই রাফিকে নিয়ে আপা আর দুলাভাই এক্সোটিক সাম্পানে উপস্থিত হয়েছেন।

রুবাইয়ের মুখোমুখি হতেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বাবা-মা’র সে কি কান্না। আপা এক ফাঁকে উঠে এসে আমার দু’গালে চড় কষিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন।

এসব কান্না সংক্রামক, তাই ‘কাজ আছে’ অজুহাতে রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। ছোট ট্রাভেল ব্যাগটা আগেই রিসেপশনে রেখে এসেছি, এখন নিরবে প্রস্থানের পালা।

মেরিন ড্রাইভ ধরে অটো ছুটছে। পথ ফিসফিসিয়ে বলে, ওগো মানুষ, আজও তোমাকে মনসুখিয়া ডাকেনি! একটা মাত্র মানুষ জীবন, ফুরিয়ে যাচ্ছে, মনসুখিয়া কি জানেনি!

পথের কানে কানে বলি, চাঁদের আলো আমাকে অসংখ্যবার খুন করেছে, রোদও খুন করেছে। এই ঢেউ, নোনা হাওয়া, সাদা ফেনাও বারবার ছিন্নবিচ্ছিন্ন করেছে, এমন কি তুমিও খুন করেছো। জানো পথ, মৃত্যুর প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু যেদিন মনসুখিয়া আমায় খুন করলো, সেদিন জানলাম খুন হওয়াই বেঁচে থাকা। মনসুখিয়া যদি একবার ডাকে, চিরদিনের জন্য খুন করে, ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে উড়িয়ে দেয় হাওয়ায় হাওয়ায় তবে বেঁচে যাই।

পথ সুধায়,
– মনসুখিয়া জানে?
– মনসুখিয়া সব জানে, তবু ডাকে না, তার নিরবতা জুড়ে অভিমান খেলা করে।
পথ আবার ফিসফিসিয়ে জানতে চায়,
– মানুষ, যাচ্ছো কোথাও!
পথের কানে কানে বলি,
– আমার সকল যাওয়াই মনসুখিয়ার দিকে যাওয়া।
– আমাকেও সঙ্গে নিও, নিবে তো!

এসব প্রশ্নের উত্তর হয় না, হাতের ডানপাশে সবুজ পাহাড়ের সারি, বায়ে মুখর সমুদ্র। পথকে বলি,
– ওগো পথ, যদি মনসুখিয়া ডাকার আগেই হারিয়ে যাই, যদি সকল দিন ফুরোয় আমার
তবে মনসুখিয়াকে বোলো, তার ডাক শুনবার অপেক্ষায় থেকে থেকে যে পথ হয়ে গেছে, সে’ই আমি।

(শেষ)

অবিভাজ্য/পর্ব-৫ [মনসুখিয়া সিরিজ]

তিন তলার গ্রিল দেওয়া বারান্দায় বসে আছি, রুবাই চা বানিয়ে এনেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস বললাম,
– রুবাই, তুই বোকা বা বেকুব- এ আলোচনা পরে হবে। আগে বল তো কি হয়েছে!

নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে বললো,
– তুমি সত্যিই কিছু জানো না!
– না।
– বাবা আর মা সেপারেট হয়ে যাচ্ছেন।
– বলিস কি!
– হ্যা। গত সপ্তাহে ব্যারিস্টার আংকেল এসেছিলেন। আমার সাথে, রাফির সাথে কথা বলেছেন। রাফি তো ছোট, একবার বাবার কাছে থাকবে একবার মায়ের কাছে- এ ভেবে খুব আনন্দে আছে।

রুবাইয়ের অবস্থা এখন আজকের বৃষ্টির মত, ওর কান্না বাড়ছে কমছে, মাঝে মাঝে থামছেও, কিন্তু চেহারায় মেঘের মত কান্না জমে আছে।

রুবাইকে বলা যায়, বাবা-মার সেপারেশন একটি স্বাভাবিক ঘটনা, এতে কান্নাকাটি করার কিছু নেই। দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক ও প্রাপ্ত মনষ্ক মানুষ সিপারেশনের সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। নিজের পিঠ চাপড়ে নিজেকে বলতে পারে ‘যা সিমরান যা, জি লে আপ্নি জিন্দেগি’। তাদের এ সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, সেপারেশন বিষয়টা এতই সরল! দু’জন মানুষের মধ্যে নৈকট্য গাঢ় হতে যেমন সময় দরকার হয়, তেমন দূরত্ব তৈরী হতেও সময়ের প্রয়োজন। ইচ্ছাতে হোক বা অনিচ্ছাতে, দীর্ঘ দিনের সংসার যাপনে একে অন্যের অংশে পরিণত হয়।

পুরুষ এলবাট্রস তরুণ বয়সে সাড়া না পাওয়া পর্যন্ত একাধিক নারীকে প্রেম নিবেদন করে, কিন্তু জোড় বাধার পর আর বিচ্ছিন্ন হয় না, একে অপরের অংশ ও অংশীদার হয়ে ওঠে। সঙ্গী মারা গেলে একা একাই কাটিয়ে দেয় বাকীটা জীবন। মানুষ মহান ও মানবিক, মানুষ বিবেচক ও বুদ্ধিমান, মানুষ এলবাট্রস নয়। মানুষের নৈকট্যের সম্পর্কেই থাকে ফাঁক ও ফাঁকি, সুপ্ত থাকে বিচ্ছেদবৃক্ষের বীজ!

রুবাইয়ের বাবা-মা’র সেপারেশনের কথা শুনে ভীষণ অপ্রস্তুত হলাম, জিজ্ঞেস করলাম,
– তোর বাবা-মা’র সিদ্ধান্ত কি চূড়ান্ত?
– হ্যা। আমি অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু তাদের বুঝাতে পারিনি। তারা আমাকে ভুল বুঝেছে, আমার ওপর রাগ করেছে, বকেছেও।
– তোর বাবা-মা সেপারেশনের সিদ্ধান্ত নিলো কেনো?
– তাদের না কি এডজাস্ট হচ্ছে না।
– এতদিন পর এডজাস্টমেন্টের সমস্যা!

সংসার মানেই স্যাক্রিফাইস আর কম্প্রোমাইজের সিম্ফোনি, পরস্পরের স্পেসে পরস্পরকে সুষম স্পেস বন্টনের শিল্প। রুবাইয়ের বাবা-মার বিশ বছরের সুখের সংসার, সাত হাজার তিন’শ দিন একসাথে কাটানোর পর, পরস্পরের শ্বাসের ঘ্রাণ পর্যন্ত মুখস্থ হয়ে যাবার পর এডজাস্টমেন্টে সমস্যা!

মানুষ সঙ্গী হিসেবে বেটার হাফকে কামনা করে না, কামনা করে ‘পারফেক্ট ওয়ান’কে। পারফেক্ট ওয়ানকে খুঁজতে গিয়ে ‘বেটার ওয়ান’কে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করে। কেউ কেউ এক বেটার ওয়ান হতে আরেক বেটার ওয়ানে আশ্রয় নেয়, তারপর আবার আরেক নতুন বেটার ওয়ান। এই চক্রে যোগ দেওয়ার পরিস্থিতি আপা-দুলাভায়ের নেই। রুবাই বড় হয়েছে, রাফিও ছোট নয়- এখন শুধু দু’জনের টোনাটুনির সংসার নয়। সেপারেশনের পক্ষে বিপক্ষে রুবাই-রাফির মতামতও গুরুত্বপূর্ণ।

ভাবনায় ছেদ পরে, রুবাইয়ের কণ্ঠে কাতরতা,
– মামা, তুমি একটা কিছু করো।
– আমার কিছু করার নেই। বেকুবদের বুঝানো যায়, কিন্তু জ্ঞানী বেকুবদের বোঝায় এমন সাধ্য কারো নেই। ঘটনা শুনে মনে হচ্ছে তোর বাবা মা’র এখন মেধা বেশী বুদ্ধি কম অবস্থা, এদের কে বুঝাবে বল!
– তবুও মামা কিছু একটা কি করা যায় না! তুমি কি করতে পারো না! আমার সুসাইড করতে ইচ্ছে করছে।

রুবাইয়ের চোখে তাকালাম, পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে বাবা-মা’র অফুরন্ত আদরে বড় হয়েছে। বাবা মা আলাদা থাকবেন, নিয়ম মেনে ক’দিন মা’র সাথে আর ক’দিন বাবার সাথে থাকতে হবে- এটা মেনে নিতে পারছে না। বাবা-মা ওর কাছে অবিচ্ছেদ্য অবিভক্ত সত্বা, ওর পক্ষে এমন বিভাজন মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।

সবচে বড় কথা বাবার পাশে একজন নতুন মা অথবা মায়ের পাশে একজন নতুন বাবার কথা ভেবেই কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। জেলা শহরের মফস্বলীয় পারিবারিক বন্ধন আর সামাজিক সংস্কৃতি এখনও এসব সহজে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। রুবাইকে বললাম,
– সুসাইড করে কোনো লাভ হবে না। শুধু তুই মরে যাবি। ভুত হয়ে বাবা-মা’কে ভয়ও দেখাতে পারবি না, যে ভীতু তুই। তবে তুই একটা ঝুঁকি নিতে পারিস।
– কি ঝুঁকি মামা!
– কাল রাতে সাদা কাগজে লিখবি ‘প্রিয় বাবা ও মা, তোমাদের সেপারেশনের আগে আমিই সেপারেটেড হয়ে গেলাম।’ তারপর পরশু ভোরে বিছানার ওপর চিঠিটা চাপা দিয়ে মোড়ে চলে আসবি। নানু আর মামার সাথে তুই কক্সবাজারে বেড়াতে যাবি।

রুবাই এডভেঞ্চারের ঘ্রাণ পেয়েছে,
– নানু তো আম্মুকে জানিয়ে দিবে!
– তুই নানুকে কিছু বলিস না, আমিও বলবো না। যাওয়ার দিন তোকে তুলে নিলে নানু জানবে। তখন সব খুলে বলা যাবে।
– আচ্ছা মামা, কাপড় তো নিবো।
– না রে মা, তবে ধরা পরে যাবি। প্ল্যান ভেস্তে যাবে।

রুবাই কি ভাবছে বুঝা গেলো না, শান্ত স্বরে বললো,
– এতে কাজ হবে?
– হতেও পারে, না’ও হতে পারে। তুই তো ক’টা দিন আনন্দে কাটাতে পারবি, ওটাই কম কি!
– মামা, আরেক কাপ চা খাবে?
– দে, সাথে একটা নাপা দিস তো মা।
– জ্বর আসছে আবার!
– হুম, মাথা ব্যাথাও বাড়ছে।

বারান্দায় বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছি। রুবাই বিষণ্ন দৃষ্টিতে ইলেক্ট্রিকের তারের দিকে তাকিয়ে আছে। ভিজে জবুথবু তিনটা কাক তারে বসে আছে, বৃষ্টির এই মন হুহু করা বিকেলে ওদের আর কোথাও যাওয়ার নেই।

(অসমাপ্ত)

অবিভাজ্য (পর্ব ৪)/ [মনসুখিয়া সিরিজ]

৪.
মণ্ডল পাড়ার মোরে এসে অটো ছেড়ে দিতে হলো। তিন চার মিনিটের পথ হেঁটে যেতে হবে। বৃষ্টি বাড়ছে কমছে কিন্তু থামছে না। আয়েশ করে একটা সিগারেট ধরাতেই বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমলো। হাঁটতে শুরু করলাম।

বৃষ্টিতে হাঁটতে হাঁটতে সিগারেট টানার অন্যরকম মজা আছে, স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর এ খাদ্যটি তার ভয়াবহ সকল উপকরণ নিয়েই কখনো কখনো স্বর্গীয় হয়ে উঠতে পারে। সিঁড়ি বেয়ে তিন তলায় এসে কলবেলে চাপ দিলাম, দরজা খুললো রুবাই,
– মামা, তুমি তো ভিজে গেছো!
– বৃষ্টির দিন, ইচ্ছে না হলেও একটু আধটু ভিজতে হয়।
– তুমি ইচ্ছে করেই ভিজেছো..
– এখন জেরা করবি না ঘরে ঢুকতে দিবি!

আপা ছুটে এলেন, হাতে তোয়ালে, পৃথিবীর সকল বিরক্তিকে কণ্ঠে জমা করে বললেন,
– বৃষ্টি কমলে আসা যেত না! পুরো ভিজে গেছিস।
– পুরো ভিজিনি, কিছুটা ভিজে গেছি, ওটা কিছু নয়।
– কিছু নয় বললেই হলো, কাপড় চেঞ্জ কর।
– ধ্যাত, আপা, কি যে বলো! শরীরের তাপে পাঁচ মিনিটে সব শুকিয়ে যাবে।
– ফের জ্বর বাঁধিয়েছিস।
– হু। আমি বাঁধাইনি, জ্বরই আমাকে বাঁধিয়েছে। এখন ছাড়ছি না বলে চলে যেতে পারছে না।
– ফাজলামি করবি না, আমি তোর বড় বোন, বিয়াইন না। টাওয়েল ধর।

আপা বিরক্ত হয়ে নিজে ঘরে গেলেন, রুবাই আমার চুল মুছে দিতে দিতে বললো,
– মামা, দুপুরে তো খেয়ে আসোনি, ভুনা খিচুড়ি খাও। সাথে আছে ইলিশ ভাজা, শুটকি ভর্তা, আমের আচার আর মুরগির ঝাল ভুনা।

মেনু শুনেই জিভে পানি চলে এসেছে, পেটে জেগেছে রাক্ষসের ক্ষিধে। মন অহং মেশানো স্বরে বলে উঠলো, ‘তোমাকে কেন্দ্র করেই এই আয়োজন, তুমি কতটা গুরুত্বপূর্ণ দেখো।’ বহুদিন ধরে মাথার ভেতর বাস করেন এক ছদ্মবেশী সুফী, তিনি মোলায়েম স্বরে বললেন, ‘নফসের জালে যে আটকে যায়, নিয়তি তাকে নফসের রাজ্যেই পাঠায়। তার আর মনসুখিয়ায় যাওয়া হয়না!’ রুবাই আবার বলে,
– ডাইনিং টেবিলে বসো মামা, আমি খাবার গরম করে আনছি।
– না রে মা, খাবো না।
– কেনো!
– আজ আমার খুব রবীন্দ্রনাথ পাচ্ছে, তিনি বলেছেন, ‘ আমি বহু বাসনায় খিচুড়ি যে চাই/ বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে..’
– হিহিহি.. রবি ঠাকুর এমনটা বলেছেন..
– হ্যা, উনি আরও বলেছেন, ‘না চাহিতে মোরে যা করেছ দান/ খিচুড়ি ইলিশ শুটকির গান..

অট্টহাসি চাপার চেষ্টা করতে করতে রুবাই বললো,
– হিহিহি.. তুমি না মামা! .. হিহিহি

ওর চুলে হাত বুলিয়ে কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করি,
– এত জরুরী তলব কেনো মা!
রুবাইয়ের কণ্ঠে বিষন্নতা গোপনের ব্যর্থ চেষ্টা,
– জানো মামা, আমি খুব বোকা..
– কে বললো?
– সবাই বলে, আমিও বুঝতে পারি।
– কিভাবে বুঝতে পারিস!
– এটা বোঝা যায়, তুমিও তো জানো আমি বোকা, জানো না!

দীর্ঘশ্বাস গোপন না করেই বললাম,
– মা গো, তুই ভুল জানিস, আমি মোটেও তোকে বোকা বলে মনে করি না।
অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুবাই, এতক্ষণ চোখ ছলছল করছিল, এখন এক ফোঁটা করে অশ্রু চোখের নিচে নেমে এসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় স্থির হয়ে আছে।

কত আর বয়স ওর- এখনো সতেরো অতিক্রম করেনি। এই বয়সে মান-অভিমানগুলো তীব্র হয়, বুঝা-পড়াগুলো হয় আবেগে টইটম্বুর। চোখে চোখ রেখে জানতে চাইলাম,
– তুই কি আমার কথা বিশ্বাস করছিস না!
– বিশ্বাসও করছি না, অবিশ্বাসও করছি না। বিভ্রান্ত হচ্ছি। বোকারা সবকিছুতে বিভ্রান্ত হয়– তাই না মামা!

কঠিন একটা ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া যায়, তা ঠিক হবে না, চোখের পানি গাল বেয়ে ঠোঁটের কাছে নেমে এসেছে, মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নিলাম,
– শোন, আগে চোখ মুছ, এরপর তোর বিভ্রান্তি কাটাচ্ছি।

বাচ্চাদের মত দুই হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছলো, যেনো কিছুই হয়নি এমন কণ্ঠে বললাম,
– আমার কথা শুনলে তুই’ও আমাকে বোকা বলতে পারিস।

ঠোঁটে হাসির হালকা আভাস এনে বললো,
– আমি কক্ষনও তোমাকে বোকা বলবো না, কক্ষনো না।

নিশ্চিন্ত হবার ভঙ্গিতে বললাম,
– তুই যেহেতু আমাকে বোকা বলবি না, তবে তোকে মন খুলে সব বলা যায়। খুব ভালো করে শুনে রাখ- এই পৃথিবীতে একজনও বোকা মানুষ নেই, একজনও নয়। তবে জাত বেকুব অনেক আছে, এছাড়া প্রতিটি মানুষই জীবনে কখনো না কখনো বেকুবি করে- কেউ কম, কেউ বেশী।
– বোকা আর বেকুব কি এক নয়, মামা?
– মোটেও এক নয়। ধর, একজন জানে আগুনে হাত দিলে পুড়বে, এরপরও সে আগুনে আঙুল বাড়িয়ে দিলো এবং পুড়লো, এটা কিন্তু বোকামীও নয়, বেকুবিও নয়।
– তবে এটা কি?
– এটাকে বলতে পারিস বিশ্বাসের ওপর কৌতূহলের জয়। কিন্তু সে যদি ফের কৌতূহলের বশে আগুনে হাত দেয় তবে সেটা বেকুবি। আবার আগুনে অন্য রকম ঝাপ দেওয়াও আছে।

রুবাই কিছুটা বিভ্রান্ত, পৃথিবীতে অসংখ্য সুন্দর দৃশ্য আছে, প্রবল শোকেরও মাধুর্য মিশ্রিত নিরব সৌন্দর্য আছে, ষোলো সতেরো-আঠারো বছরের কোনো বালিকার ভেজা চুল, কান্নায় ফোলা চোখ, ঠোঁটে হাসির মৃদু আভাস, দৃষ্টিতে বিভ্রান্তি মিলেমিশে এক সুন্দরতম অবয়ব। রুবাইয়ের প্রশ্ন,
– আগুনে অন্য রকম ঝাপ দেওয়া মানে?
– পুড়বে জেনেও কাউকে বাঁচাতে আগুনে ঝাপ দেওয়া, একে তুই বেকুবি মিশ্রিত মহত্ত্ব বলতে পারিস। এখন বল, তুই কি বেকুব!
– নাহ, মামা। তুমি যা বললে তাতে আমাকে বেকুব বলা যায় না, তবে বোকা তো অবশ্যই।
– বেশ কথা তুই বোকা, দুই একটা বোকামির কথা বল তো, মা..

রুবাই বলতে শুরু করলো,
– মানুষকে খুব সহজে বিশ্বাস করি.. আর গভীর ভাবে চিন্তা করতে পারি না.. আমার কথা কাউকে ভালো করে বুঝাতে পারিনা আর..
– আর?
– আর কোনো কিছুই বদলে দিতে পারি না।
– ওহ, এসব! তবে খুব মন দিয়ে শোন..

ওর চেহারায় ফের বিষাদ জমতে শুরু করেছে, আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
– মামা, চা খাবে? চা খেতে খেতে বলো! আমিও খাবো-
– ঠিক আছে, তুই নিজে রান্না করবি। আর চা নিয়ে আসার আগে ভালো করে চোখ ধুয়ে আসবি, তোর চোখে মনে হয় পোকা কামড়াচ্ছে..
রুবাই ‘হিহিহি’ করে হেসে উঠলো,
– তুমি যা বলো না মামা! কান্না পাচ্ছিলো, এখন চোখে পোকার কামড়ের কথা শুনে হাসি পাচ্ছে।

রুবাই চা বানাতে গেল, ওর ঘরটা যত্ম করে গুছানো। টেবিলের ওপর পাঠ্য বই, হুমায়ূন আহমেদ, সমরেশ মজুমদার, সাদাত হোসেন, হ্যারি পটার, টিনটিন জড়াজড়ি করে শেলফে বিশ্রাম নিচ্ছে। উপন্যাসের পাশে জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমানের কবিতাসমগ্রসহ আরও ক’জন জনপ্রিয় কবির কবিতার বই। এ বয়সটাই তো কবিতা পাঠের, কবিতা উদযাপনের। ও কি জানে কবিতা পাঠ করতে হয় ক্ষুধার্ত অবস্থায়, শরীরে ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে।

অকস্মাৎ মনে হলো- রুবাই কি নিজেকে উপন্যাসের কোনো চরিত্র ভাবতে শুরু করেছে অথবা কবিতার কোনো মানবী- কিছুই অসম্ভব নয়। ওর কষ্টটা কি মনের গভীর থেকে উৎসারিত বা শুধুই কষ্ট বিলাস– চা পান করতে করতেই জানা যাবে।

(অসমাপ্ত)

অবিভাজ্য (পর্ব ১ হতে ৩)/ [মনসুখিয়া সিরিজ]

১.
বিছানার ডান পাশে পূবের জানালা। রোজ ভোরে দু’টো দোয়েল জানালার কার্নিশে বসে শিস দেয়- তারপর কোথায় যে যায় কে জানে। আজও ঘুম ভেঙেছে দোয়েলের শিসে, আকাশের আলোতে তখনও আবছায়া অন্ধকার।

ব্যাথায় পর্যদুস্ত পা নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে ছাদে উঠে চারদিকে তাকিয়ে ভোর দেখি। প্রতিটা ভোর গভীর মায়াময় ও রহস্যপূর্ণ, প্রতিটা ভোরের শরীরে লেগে থাকে রাতের আভা আর দিনের উচ্ছাসের ঘ্রাণ।

ছাদের এক কোনে পাখিদের জন্য ঝোল মাখা বাসিভাত, সিঁড়ি কোঠার ছাদে খুদকুড়ো ছিটিয়ে দেই- এই নাস্তার আয়োজনের কথা পাখিরা জানে। যে যার সময় মত এসে খায়। এক একটা দিন দেরী হলে চেঁচামিচি করে প্রতিবাদ জানায়, হয়তো তাদের ভাষায় বলে, ‘আজ আবার নাস্তা দিতে দেরী করছো, আমাদের কি কাজকর্ম নেই! অফিস-টফিস নেই না কি!’

ছাদে দুটো বিড়াল শরীর টান করে আয়েশি ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। পাখিরা আগে ভয় পেত, এখন তেমন পাত্তাটাত্তা দেয় না। ওরা জেনে গেছে বিড়ালদের জন্য আলাদা খাবার আছে, তবু যদি ক্ষিধে পায় তবে দুলকি চালে হেটে এসে ঝোল মাখা ভাতে ভাগ বসাবে- অলস দু’টো কখনোই পাখি শিকারের কষ্ট সইতে যাবে না।

ভোর দেখে ছাদ থেকে নামছি, সিঁড়ি সতর্ক করে,
– মানুষ একটু সাবধানে নামো। পায়ে ব্যথা পাবে তো..
– একটু আধটু ব্যথা পাওয়া মন্দ না, কি বলো তুমি!
– একটু আধটু ব্যথা পাওয়া মন্দ নয়, কিন্তু ব্যথা পোষা তো খারাপ অভ্যেস। মানুষ, তুমি ব্যথা পুষছো কেনো!

পা ভেঙে সিঁড়িতে বসি, বলি,
– শোনো সিঁড়ি, আমি কোনো কিছুই পুষছি না। পোষ মানানোর গুণ আমার নেই।

সিঁড়ি হেসে ওঠে,
– এই যে ভোর বেলা পাখিদের খাবার দিচ্ছো, পাখিরা আসছে, তোমাকে ভয় না পেয়ে বিশ্বাস করছে, এটাও তো এক ধরণের পাখি পোষা। বিড়াল দুটো পায়ে পায়ে ঘুরে, বাসায় কবুতরগুলো তোমার হাতে বসে খায়, তুমি হাত বাড়ালেই খরগোশ দম্পতি হাতের তালুতে মাথা ঘষে। সদর দরজার বাইরে বসে থাকে তিন চারটা কুকুর, তুমি বের হলেই সদর রাস্তা পর্যন্ত যেনো গার্ড দিয়ে নিয়ে যায়- ওদেরও তো পুষছো, কি পুষছো না!
– না, গো। ওরা আছে, থাকছে- এটুকুই। যদ্দিন আমার পাশে থাকতে ওদের ভালো লাগবে, তদ্দিন থাক। যেদিন ওদের ইচ্ছে হবে চলে যেতে, যেখানে খুশি চলে যাক, যেখানে খুশি থাক। এটা মোটেও পোষ মানানো নয়।

এ যুক্তি সিঁড়ি মানতে চাইলো না,
– এটা যদি পোষ মানানো না হয় তবে রোজ ভোরে, দুপুর আর রাতে খাবার দেবার জন্য এত উতলা হও কেনো!
– ওরা যে অপেক্ষায় থাকে, আশায় থাকে।

কিছুক্ষণ নিরবতা, নিরবতা ভেঙে জিজ্ঞেস করি,
– সিড়ি, তুমি ভালো আছো তো!
– হ্যা, যদ্দিন চোখের ওপর ছাদ না দিচ্ছো, বেশ ভালো আছি। আকাশের কত যে রঙ, দিনে রাতে আকাশ দেখি। তোমাদের যাওয়া- আসা দেখি, বাতাসের উস্কানিতে নায়লনের রশিতে শুকোতে দেওয়া ক্লিপে আটকানো কাপড়ের উড়ার জন্য ছটফটানো দেখি আর দেখি তোমাদের আসা যাওয়া।
– তোমার দুপাশে শ্যাওলা জমেছে, দুটো ঘাসফুল গাছও জন্মেছে দেখছি!
– হ্যা। শ্যাওলাগুলো পরিস্কার করে দিতে বোলো, ঘাসফুলগুলো থাক।
– তুমি কি ঘাসফুল পুষবে, সিড়ি!

সিড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেললো,
– সবাই তো কত কিছুই পোষে- প্রকাশ্যে গোপনে। আমি না হয় ঘাসফুলই পুষি।

শ্যাওলা পরিস্কার করানোর আশ্বাস দিয়ে নামছি, সিড়ি বললো,
– যাও, একটু ঘুমাও। শেষ রাতে অল্প একটু ঘুমিয়েই জেগে উঠেছো, এত কম ঘুমোলে চলে!

নিচে নেমে কবুতরগুলোকে বাজরা আর খরগোশ দম্পতিকে ঘাস দিয়ে ঘরে ফিরলাম। ঘুম প্রয়োজন, গভীরতম ঘুম। শোয়া মাত্র চোখ ভেঙে ঘুম এলো। বাড়ির আমগাছে ক’টা বুলবুলি ডাকছে, শালিক ঝগড়া করছে- যেনো বহুদূর থেকে এসব শব্দ ভেসে আসছে। মাঝখানে একবার ঘুম ভাঙলো, জানলা দিয়ে ছিটকে আসা রোদ পায়ের ওপর লুটোপুটি খাচ্ছে।

টনেটনে ব্যাথাগ্রস্থ পায়ের ওপর সকালের রোদের নরম উত্তাপ- আহা রে, আহা রে জীবন। ঘুম ঘুম মাথার ভেতর গুলাম আলী গেয়ে উঠলেন- ‘খা কার জখম দোয়া দি হামনে/বাস ইয়ু উমার বিতা দি হামনে.. (আঘাতের বিনিময়ে দোয়া দিয়েছি আমি/আর এভাবে আয়ু যাপন করছি আমি..)।

মাথার কাছে সাইলেন্ট মুডে রাখা মোবাইল সেট হাতে নেই, স্ক্রিনে তাকাই- ছ’টা মিসকল। রুবাই কল করেছিলো। মেসেজ আইকনে ক্লিক করতেই রুবাইয়ের মেসেজ পেলাম- ‘মামা, তোমার সাথে একটু কথা বলা যাবে, জরুরী।’

২.
ফোন শব্দহীন করে রাখার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হলো। নিশ্চয়ই জরুরী কিছু- তা না হলে রুবাই কি এতবার কল করতো! এদিকে ঘুমও জরুরী, পায়ের জখমে নরম উত্তাপ দানের জন্য রোদের প্রতি দোয়া করাও গুরুত্বপূর্ণ –ডিপ্লোম্যাটদের মত সব দিক ঠিক রাখতে শুয়েই কল করলাম, দু’বার রিং হত ধরলো রুবাই,
– আসসালামু আলাইকুম, মামা। তোমাকে কি বিরক্ত করছি!

আজকাল বাচ্চারা ‘তোমাকে কি বিরক্ত করছি!’ ধরণের পশ্চিমা ভদ্রতা খুব শিখছে। শিখে ততটা লাভ হচ্ছে না, বরঞ্চ সঙ্কটে পড়ছে- বাচ্চাগুলো না পারছে চাচা-মামার ওপর পুরোপুরি অধিকার ফলাতে না পারছে অধিকার ছাড়তে। আমার মত মফস্বলের অনাধুনিকদের এসবে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে। রুবাইয়ের উত্তরে বললাম,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। অবশ্যই বিরক্ত করেছিস, খুব বিরক্ত করেছিস..
ওর কণ্ঠে অনুতাপ,
– সর‍্যি মামা, তুমি এখনও ঘুমাচ্ছিলে! সর‍্যি.. আমি বুঝতে পারিনি..
– এখন তোর সর‍্যি শুনে ভাঙা ঘুম জোড়া লাগবে! কেনো ফোন করেছিস বলে ফেল, মা।
– আজ কি একবার আমাদের বাসায় আসতে পারবে?
– বাসায় আসতেই হবে! ফোনে বলা যায় না!
– না, মামা, ফোনে বলা যাবে না। তোমার সমস্যা থাকলে বলো আমিই চলে আসবো।

রুবাই চলে এলে বেশ হত- যন্ত্রণাকাতর পা’টা আরাম পেত। কিন্তু ওকে আসতে বলা মানেই প্রকট ঝামেলাকে দাওয়াত দেওয়া। বারবার বলেছি- এলোমেলো করে রাখাটাও এক ধরণের গুছিয়ে রাখার আর্ট, যারা এলোমেলো করে রাখে তারা জানে কোন জিনিসটা ঠিক কোথায় আছে। কিন্তু এই তত্বের বারোটা বাজিয়ে ও ঘরে এসেই টেবিল গুছাবে, সারা ঘরে এলোমেলো ছড়িয়ে থাকা বইগুলো তুলে শেলফে রাখবে। লেখার কাগজ গুছাবে, পাতা মুড়ে চিহ্ন দিয়ে মাথার কাছে রাখা বইগুলোর ভেতর থেকে পেন্সিল বের করে পেন পটে সাজাবে। ধমক দিলে খিলখিলিয়ে হাসবে।

মেয়ে, ভাগ্নি আর ভাস্তিদের মধ্যে মা ভাবটা প্রবল, আরও প্রবল মুরুব্বীয়ানা, রুবাই এর বাইরে নয়। দ্রুত জবাব দিলাম,
– না রে মা, কষ্ট করে আসার দরকার নেই। আমিই আসবো।
– তোমার পা ভালো আছে তো!
– খুব ভালো আছে। এখন শুয়ে শুয়ে রোদ পান করছে।
– রোদ পান করছে?
– হ্যা, সবাই কি আর গালিব যে শরাব পান করবে!
– হিহিহি, তবে দুপুরে এসো কিন্তু।
– ঠিক আছে, অবশ্যই আসবো। এখন আমি ঘুমাবো, তুই ঠিক সাড়ে বারোটায় কল দিয়ে জাগিয়ে দিবি। যতক্ষণ কল না ধরবো কল দিতেই থাকবি.. দিতেই থাকবি.. দিতেই থাকবি..
– হিহিহি… আচ্ছা মামা..

ফোন রেখে রোদের দিকে মনোযোগ দিলাম- ভীষণ সুন্দর রং। সূর্যটা অগ্নিপিণ্ড, এ রোদ বহুদূর হতে ছুটে আসা হলকা। দীর্ঘ পথযাত্রায় ভস্ম করে দেওয়ার প্রকট ক্ষমতা সে হারিয়েছে, রপ্ত করেছে মুগ্ধ করার কৌশল- আজকের এই রোদ মমতায় জোছনার অধিক।

গৌতম ঘর ছেড়েছিলেন পূর্ণিমায়, বুদ্ধত্ব লাভের পথে পথে পূর্ণিমা থেকে পূর্ণিমায় তাঁর সন্তরণ। আত্মা মুক্তি পেলে দেহ মূল্যহীন এ বিশ্বাসে তিব্বতের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা মৃতদেহ কেটে পাখিদের খাওয়ায়। কি আশ্চর্য, ‘চারিদিকে এখন সকাল—/রোদের নরম রং শিশুর গালের মতো লাল’ সকালে ঘুম প্রত্যাশি মনে কোথা হতে এলেন জ্যোৎস্নামুগ্ধ বুদ্ধ দেব, কোথা হতে এলেন রহস্যময় তিব্বতের সন্ন্যাসী আর আকাশমুখি সৎকার প্রথা!

চোখ বন্ধ করলাম, ঘুম আসুক, প্রবল ঘুম। ঘরে হাওয়া ঢুকছে, হাওয়ার শরীরে পানির ঘ্রাণ– আজ কি বৃষ্টি হবে! মাথার ওপর একঘেয়ে সুরে পাখা ঘুরছে.. চড়ুই ডাকছে, গাছের পাতায় হাওয়ার ঝাপটে খসখসানি, ফেরিওয়ালার সুর.. ‘মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয়/ সকালবেলার রৌদ্রে; কুঁড়েমির আজিকে সময়।’
চোখ জুড়ে ঘুম জমেছে, জড়িয়ে আসছে চোখ, ফোন ফের সাইলেন্ট মুডে রেখে পাশ ফিরলাম, মাছির গানের মত অলস শব্দ তবু সওয়া যায়, চিল চিৎকার নয়।

৩.
‘মা, কল করার প্রয়োজন নেই, জেগেছি।’ রুবাইকে মেসেজ পাঠিলাম। আড়মোড়া ভেঙে জানালার পাশে বসলাম। এখন রোদ নেই, আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে, ‘ঘণ রিমঝিম রিমঝিম নামিল দেয়া’ অবস্থা।এক পশলা বৃষ্টি হয়েও গেছে, ঘুমিয়ে থাকার জন্য বুঝতে পারিনি। জানালার ভিজে গ্রিলে পতনের অপেক্ষায় উন্মুখ বৃষ্টির ফোঁটা। এতটুকু স্বচ্ছ ফোঁটা, তাতেও প্রতিবিম্বিত হচ্ছে বিশাল আকাশ আর বৃক্ষের সবুজ।

এক একটা দিন আসে আলস্য ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না। জড়ত্ব পেয়ে বসে। গাছের নিচে বসে গৌতম ধ্যান করছেন, প্রখর রোদ এসে পড়েছে মাথায়। তাপ বাড়ছে, ধ্যান ভাঙছে না। এক শামুকের মায়া হলো, উঠে এলো মাথায়। গৌতমের একটু আরাম হোক, ধ্যান না ভাঙুক। এরপর ১০৮টা শামুক উঠে এলো, টুপির মত আবৃত করলো গৌতমের মাথা।

গৌতমের ধ্যান ভাঙলো, ততক্ষণে শামুকরা প্রাণ হারিয়ে জড় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এটা গল্প, গ্রিক শিল্পের প্রভাবে বুদ্ধের চুল ঢেউ খেলানো হতে হতে শিল্পীর হাতে শামুকের রূপ নিয়েছে, ভাবুক রচনা করেছে কাহিনী। তবু শামুকের গল্প ভালো লাগে, এক একটা দিন ইচ্ছে করে বুদ্ধের মত ধ্যানমগ্ন না হতে পারি, অন্তত মৃত শামুকের মত অলস হই, আলস্য যাপন করি- এ আর হয় না, বেলা ফুরোয়.. দিন যায়।

বৃষ্টি শুরু হবার আগেই বের হতে হবে। দশ/পনেরো মিনিট মাঝারি ধরণের বৃষ্টি হলেই মফস্বলের এই সরু রাস্তায় পানি জমবে, কসরৎ করেও বেশী দূর যাওয়া যাবে না। পানি নেমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আলস্য ঝেড়ে দ্রুত তৈরী হয়ে নিলাম। দরজার বাইরে এসে চশমা খুলে পকেটে রাখলাম- পাঁচ হাত দূরের জিনিসও এখন ঝাপসা। যতদূর তাকাই সব ঝাপসা, ঝাপসা রঙের নড়াচড়া- যেনো অপটু হাতে নির্মিত এবস্ট্রাকট এনিমেশন।

পাড়ার মোরে এসে জয়নালের দোকানে দাঁড়াই, গোল্ড লিফের প্যাকেটে ভরে পাঁচটা বেনসন লাইট সিগারেট এগিয়ে দেয়। প্রেমিকার সামনে বেনসনের প্যাকেট থেকে সিগারেটে বের করে আগুন ধরিয়ে টান দেওয়া অল্পবয়সী ছেলে ছোকড়াদের ফ্যাশন, আবার প্রেমিকার মিষ্টি ধমকে সিগারেট ফেলে দেওয়ার সম্ভাবনার মুখে বেনসনের মত দামি সিগারেট কেনাও অপচয়। তাই কম দামে যে সিগারেটই কিনুক তাদের প্যাকেটটা চাই বেনসনের। বেনসন কিনেও আমাদের জন্য বরাদ্ধ অন্য ব্রান্ডের প্যাকেট।

– বাই, চা দিমু?
– হু

জয়নাল স্বচ্ছ কাচের কাপে রং চা এগিয়ে দিলো, লিকার কড়া নয় বলে রঙ সোনালি। কাপটা মিনারেল ওয়াটারের মত স্বচ্ছ বলে চায়ের রঙটা আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। এই কাপে অন্য কাউকে চা পরিবেশন করা হয় না, কাপটা শুধুই আমার। কাপটার সাথে জড়িয়ে আছে চার বছর আগের এক মধ্যরাত।

ওই রাতে অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে, আর কোনো শব্দ নেই। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘সঘন গহন রাত্রি, ঝরিছে শ্রাবণধারা’। বৃষ্টির সিম্ফোনি ভেদ করে শোনা গেলো জয়নালের কণ্ঠ, সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বিরতিহীনভাবে ডাকছে ‘বাই, একটু বাইরে আয়েন, বাই..।’ মা দরজা খুলে জানতে চাইলেন, ‘কি হইছে রে জয়নাল?’ জয়নালের কণ্ঠে অসহায়ত্বের স্পষ্ট ছাপ, ‘চাচী, বড় বাই’রে একটু ডাইক্যা দেন।’

তখনও একটা পা প্রায় অকেজো হয়ে যায়নি, চোখের দৃষ্টিসীমাও এখনকার মত করুণ নয়। এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে দ্রুত বের হয়ে এলাম,
– কি হইছে জয়নাল?
– বাই, মাইটারে অহনেই হাসপাতালে লয়া যাইতে হইবো, নাইলে মাইয়াটা বাঁঁচবো না বাই।

প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করলাম না, ঘরে ঢুকে মানিব্যাগ আর মোবাইল নিয়ে মা’কে ‘আমি একটু আসছি’ বলে সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। জয়নালের সাথে নিরবে হাঁটছি, মনে মনে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি- ওর দোকান থেকে সিগারেট কিনি, চা খাই- এইতো সম্পর্ক। অথচ এমন দুর্যোগের রাতে ও আমার কাছেই এলো কেনো।

রাত একটু বাড়লেই মফস্বলে রিকশা পাওয়া কঠিন, একে মধ্যরাত তারপর ওপর টানা বৃষ্টি, বাজারের স্ট্যান্ডেও রিকশা বা অটো কিছুই পাওয়া যাবে না। ক’জন অটো চালকের নাম্বার সেভ করা আছে, প্রথম কলটা দিলাম আতিককে। তিন চারবার রিং হতেই কল রিসিভ হলো,
– ভাই, এত্ত রাইতে ফুন দিছেনযে!
– আতিক, অটো লয়া এক্ষুনি জয়নালের দোকানের সামনে চইলা আয়, দেরী করিস না।

আতিককে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলাম না, কিছু পরিস্থিতিতে কথা বলার সুযোগ দিতে নেই। জয়নালের পাঁজাকোলা করে মেয়েকে এনেছে। ছ/সাত বছর বয়স, পেটের ব্যাথায় কুকড়ে যাচ্ছে, বাচ্চাটার কান্না করতেও কষ্ট হচ্ছে , কোঁকাচ্ছে ‘বাবা গো, ব্যাথা করে.. আমি মইরা যামু, বাবা।’

অবিরাম বর্ষণের মধ্যরাতে মফস্বলের জনশূন্য রাস্তায় এক যন্ত্রণাকাতর শিশুর কাতর কান্না ‘আমি মইরা যামু, বাবা’ কতটা বিদ্ধ করে, এফোঁড়ওফোঁড় করে দিতে পারে তা প্রকাশের ভাষা কারো জানা নেই। সবকিছু ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, ভাষার এ সীমাবদ্ধতা কোনো দিন দূর হবে না।

আতিক দ্রুত চলে আসায় রক্ষা, জেলা সদরের হাসপাতাল দূরে নয়, ঘনঘন হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটছে অটো। জয়নাল মেয়ের পিঠে হাত বুলাচ্ছে আর কাতর স্বরে পাঠ করছে, আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা মিম্মা ইনদাকা ওয়া আফিজ আলাইয়্যা মিন ফাদলিকা ওয়ানছুর আলাইয়্যা রাহমাতাকা ওয়ানজিল আলাইয়্যা বারকাতাকা।’

জয়নালের দোয়া পাঠ শুনছি, জয়নাল এই দোয়ার তরজমা হয়তো জানেনা, জানার দরকার নেই। ওর কাতরতাই বলে দিচ্ছে, হে আল্লাহ! তোমর কাছে যা আছে আমি তাই তোমার কাছে চাই। তোমার অনুগ্রহের একটু ধারা আমার দিকে প্রবাহিত করো আর তোমার রহমতের একটু বৃষ্টি আমার ওপর বর্ষণ করো আর তোমার বরকতসমূহ থেকে একটুখানি আমার প্রতি নাজিল করো।

এমারজেন্সিতে ঢুকতেই ডাক্তার ছুটে এলেন, ইঞ্জেকশন দিয়ে ব্যাথা কমালেন। আতিক নিজের অটোতে বসে ঘুমোচ্ছে। সকাল ৮টায় জরুরী ভিত্তিতে এপেন্ডিসাইটিসের অপারেশন করা হলো। ডাক্তার জয়নালের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভয়ের কিছু নেই।

এক সপ্তাহ পর জয়নাল দোকান খুললো। বিকেলে চা খেতে গেলাম, জয়নাল ড্রয়ার থেকে স্বচ্ছ কাচের দামী একটা কাপ বের করে হাসি মুখে চা বানিয়ে দিলো। বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলাম,
– টং চায়ের দোকানে এই দামী কাপ পোষাইবো, জয়নাল!

জয়নাল হাসি বিস্তৃত করে জানালো,
– এই কাপ খালি আপনের লেগা, বাই। আমার মাইয়া চয়েছ কইরা কিনছে।

এরপর জয়নালের দোকানে অন্য কোনো কাপে আর চা পান করা হয়নি। জয়নালের মেয়ের ‘চয়েছ’ করা কাপে যতবার চা খাই, মাথার ভেতর লুইজ আর্মস্ট্রং মায়াবী কণ্ঠে গেয়ে চলেন-
I hear babies cry
I watch them grow
They’ll learn much more
Than I’ll never know
And I think to myself
What a wonderful world…

চায়ে আয়েশ করে দ্বিতীয় চুমুক দিতেই পেছন থেকে আতিকের কণ্ঠ শোনা গেলো,
– বাই কি সদরে যাইবেন?
– না, মণ্ডল পাড়ায় যামু।
– চলেন, অনেক দিন আপনারে লইয়া যাই না।

পেছনে পার্ক করা অটো জয়নালের দোকানের সামনে নিয়ে এলো, চা শেষ করে বললাম,
– আতিক, বিষ্টি তো আইতাছে, এদ্দূর যাবি!
– আপনারে লয়া যামু, অন্য কেউ অইলে যাইতাম না।
– অন্যরা কি দোষ করলো?
– আপ্নে আর অন্যরা কি এক অইলো!

অটোতে চলতে শুরু করেছে। সিগারেট ধরাই। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। আতিক ওর সুখ দুঃখের কথা বলছে। কিছু কানে ঢুকছে, কিছু ঢুকছে না। মগজের স্তরে স্তরে ঝাঁপি খুলে বসেছে কলেজবেলা- এমন এক একটা বৃষ্টির দিন আরামবাগ থেকে হাঁটতে হাঁটতে রাজারবাগ হয়ে শান্তি নগর পেরিয়ে নটর ডেম পৌছতো বেইলি রোডে। ভিজে জবজবে অবস্থায় সুইসের গেটে দাঁড়ালেই একজন ভিকারুননিসা বেরিয়ে আসতো, তার মুখে একসাথে আনন্দ ও বিরক্তির মেঘমাল্লার, তার কণ্ঠে সাঁঝের ইমন কল্যাণ,
– আবার বৃষ্টিতে এভাবে ভিজেছো নটরডেম, জ্বর আসবে যে!
– তুমি জলপট্টি হলে একটা জীবন জ্বর হয়েই কাটিয়ে দিবো..
– তাই!
– নয় তো কি!

না, একটা মাত্র মানব জীবন জ্বর হয়ে যাপনের চক্রে আটকে যেতে হয়নি, যার জলপট্টি হওয়ার সাধ ছিলো সে অন্য কারো প্যারাসিটামল হওয়ার হাতছানি এড়াতে পারেনি।

(অসমাপ্ত)

অণুগল্প: ছায়াসত্ব

পূর্ণ চাঁদের রাতে জোছনায় দশদিক ভেসে গেলে হাঁপানির টান তুচ্ছ করে দাদি বলতেন, ‘ফকফক্কা চান্নি রাইত, কি ফকফক্কা চান্নি! আমারে দাওয়ায় শোয়াইয়া দাও..।’

মা উঠোনে মাদুর পেতে তার ওপর কয়েকপ্রস্থ সুতির চাদর বিছিয়ে আস্থায়ী জাজিম বানিয়ে দিতেন। বাবা দাদিকে কোলে তুলে এনে জাজিমে শুইয়ে দিতেন। দাদির খনখনে স্বর, শ্বাস টেনে টেনে বলতেন, ‘এত্ত চান্নি, চাইরদিকে এত্ত চান্নি!’

দাদির চোখ দুটো মরে গিয়েছিল বহু বছর আগে। সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকতেন– ঘুম আর জাগরণের মাঝমাঝি পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক জড় পদার্থ বিশেষ। হাঁপানির টানে বুকের দ্রুত ওঠানামা জানান দিত- বেঁচে আছেন। অথচ জোছনার মাঝ রাতে তার প্রবল অস্থিরতা- ‘এত্ত চান্নি! বাইরে এত্ত চান্নি!’

প্রতিক্রিয়াশূন্য ঘোলা চোখে চোখ রেখে আমার কৌতূহল – ‘ও দাদি, কানা চউক্ষে তুমি কি দ্যাহো?’ উত্তরে দাদি বলতেন, ‘দাদাবাই, চান্নি দেহি, এত্ত চান্নি!’ মুখের চামড়ায় সহস্র ভাজ বৃক্ষের মত স্থির, শুধু কণ্ঠে গুপ্তজ্ঞান ফাঁসের সতর্কতা– ‘ও দাদাবাই, দ্যাহতো চান্নিতে কি আমার ছায়া পড়ে? চান্নিতে মরা মাইনষের ছায়া পড়ে না।’

‘দাদি গো, চান্নিতে তোমার জ্বলজ্বইল্লা ছায়া পড়ছে’ বললেই দাদি দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন- ‘আমি চউক্ষে ছায়া দেহি না ক্যান দাদাবাই?’ তার কণ্ঠে গাঢ় আতঙ্ক – ‘এত্ত চান্নিতে আমার ছায়া পড়ছে, চউক্ষে দেহিনা ক্যান!’

দাদি তার সকল ছায়া ও জোছনাপ্রীতিসমেত মারা গেছেন- বহুদিন হলো। আজ প্রখর রোদ, জুম্মার নামাজের সময় সুনসান রাস্তা, রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, আকষ্মাৎ স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে আসা দাদি ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘ও দাদাভাই, তোমারে কইছিলাম চান্নিতে মরা মাইনষের ছায়া পড়ে না, ভুইল্লা গেছ!’

চোখ মেলে দেই- আশ্বিনের আকাশ ঘন নীল। চারদিকে ছড়ানো ছিটানো সাদা সাদা মেঘ। একটা পায়রা উত্তর হতে উড়ে গেল দক্ষিণে, সূর্যের নিচে চক্কর দিচ্ছে ক’টা চিল। নিজের ছায়ার খোঁজে মাটিতে তাকালাম- না, কোনো ছায়া নেই, রোদেও আমার ছায়া পড়ে না।

ছায়াসত্ব

ঘোর

index-1

সারারাত ঘুম আসেনি। ভোরের মসৃণ হাওয়া ঘরে ঢুকতেই মনের ভেতর এক ধরণের মায়া তৈরী হয়, আজও হলো। ভেন্টিলেটরে চড়ুই পাখির কিচিরমিচির, বাইরে দোয়েল পাখির শিস। গায়ে একটা কাঁথা জড়িয়ে নিলাম, শীত করছে। শ্বাসকষ্টটা ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামে গেছে, ফের ঝাপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর জানা নেই, যে মৃত্যুকে ভয় পায়না তাকে বেঁচে থাকার ভয় দেখাতে হয়, যে যন্ত্রণা উপভোগ করে তাকে সুখ দিয়ে বিব্রত করতে হয়। শ্বাসকষ্টের বোকামীর জন্যও মায়া হচ্ছে। চোখ বন্ধ করছি, ঘুম আসছে না, ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি জমাট বাঁধছে তন্দ্রার ঘোর।

বিশাল একটা ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছি আমি আর শুভময়। ঘরের দেয়ালগুলো দুধ সাদা, সিলিংয়ের রং সমুদ্রনীল। একপাশে বইয়ের আলমিরা, আলমিরায় হেলান দেওয়া দুটো গিটার। সিডি প্লেয়ারে সুজাত হুসাইন খানের কণ্ঠে ভর করেছে কবির দাস, সেতারের মখমল রিনিঝিনির সাথে সঙ্গত করে গাইছেন, ‘মোকো কাহা ঢুন্ড রে বান্দে, ম্যায় তো তেরি সাথ রে”, কণ্ঠে দরাজ দরদ নিয়ে গেয়ে যাচ্ছেন একের পর এক গজল, আলাপের ঢংয়ে। প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে, গরম সাদা ভাত আর ঝাল খাসি ভুনা দিয়ে ভাত খাচ্ছি। শুভময় ওর সুখের কথা বলছে, কষ্টের কথা বলছে, দীপান্বিতার সাথে অভিমানের কথা বলছে। এর মাঝেই খুব মন দিয়ে খাচ্ছে, হঠাৎ ওর বামহাতটা আমার কপালে রেখে বললো,
– তোর আবার জ্বর এসছে।
– হয়তো।
– হয় তো না, সত্যিই।
– শুভময়, তুই ভাত খেয়ে নে।

শুভময়ের কণ্ঠে কোমলতা খেলা করে,
– তুই খাবি না!
– না, রে। আর খেতে ভালো লাগছে না। তুই খেয়ে নে শুভময়।
– খেয়েছি, আমি যাই। দরজাটা খুলে দে।

ওর জন্য দরজা খুলতে যাবো, শরীর ব্যাথায় কুকড়ে উঠলাম। চোখ খুলে বিভ্রান্ত, বিছানা জুড়ে রৌদ্র, ঘরে আমি একা। দরজা বন্ধ, শুভময় নেই। কি আশ্চর্য!

আবার ব্যাথা বাড়ছে, মাথার দু’পাশে দুই দিনমুজুর ইটের পরিবর্তে প্রতিটি শিরা উপশিরা আর পেশীগুলো ভাঙছে… ভাঙছে.. ভাঙছে। রাতের নির্জন সালামিনোস স্ট্রিট, দ্রুতগামী একটা গাড়ি মটর সাইকেলে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো, তাদের খুব তাড়া আছে হয়তো। পলকা কাগজের মত ছিটকে পড়লাম অনেকটা দূরে- উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পারলাম না, সেই কবেকার কথা, আজও স্পষ্ট।

স্মৃতির সিনেমোস্কোপে ঘুরছে রিল, এম্বুলেন্সের সাইরেন.. হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্সদের ব্যস্ততা, চোখ খুলে রাখতে পারছি না। আবছায়া হয়ে হাসপাতালের সব মুখ। আবহ সঙ্গীতের মত শুধু বেজে চলেছে গ্রিকভাষী কারো ইংরেজি মন্তব্য “তেক মেন্তাল প্রিপারেশন, ইউ ক্যান নত সারভাইভ..তেক মেন্তাল প্রিপারেশন, ইউ ক্যান নত সারভাইভ… তেক মেন্তাল প্রিপারেশন, ইউ ক্যান নত সারভাইভ… “, তার বয়েসী গ্রীক মুখশ্রী.. ফর্সা মুখ জুড়ে দেবতা ক্রোনোসের মত শাদা দাড়ি.. তার উদ্বিগ্ন দৃষ্টি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে.. চারপাশের সব শব্দ অস্পষ্ট হয়ে আসছে..বোধ তার সকল অহংকার নিয়ে সমর্পিত হচ্ছে বোধহীনতার কাছে। সমর্পনের মাঝখানে উঠে এলো বহুদিন আগের এক ছুটির দিন। বেইলি রোডের ব্যস্ততাশূন্য দুপুর। রোদ মেঘ আর হাওয়ায় মিলেমিশে একাকার বাইরে, সুইসের ভেতর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া। ভিকারুননিসার কণ্ঠে আহ্লাদ,
– নটরডেম, তুমি একদিন নদী দেখাতে নিয়ে যাবে?
– তুমি যাবে?
– হ্যা, যাবো। বুড়িগঙ্গা নদী নয়, অন্য কোনো নদী..। আমার খুব নদী দেখতে ইচ্ছে করছে, তোমার সাথে নদী দেখতে না পেলে ঠিক ঠিক মরে যাবো।

নটরডেম পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকে ভিকারুননিসার চোখে, গাঢ় স্বরে বলে-
– আমার সাথে নদী দেখতে না পেলে মরে যাওয়াটা কাজের কথা নয়।
– জানিনা কিসের কথা, নদী দেখতে না পেলে আমি মরে যাবো, ঠিক ঠিক মরে যাবো।
– ভিকারুনিসা, এই একটা জীবনে আমাদের বহু মরে যাওয়া বাকী, যেখানে সেখানে মরে যাওয়াগুলো অপচয় করা ঠিক না।
বিভ্রান্ত চোখে তাকায় ভিকারুননিসা,
– তোমার কথা বুঝতে পারছি না।
নটরডেম কোনো উত্তর দেয় না, দুজনের গ্লাসে গলে আইসকিউব, কোক আরও শীতল হয়ে আসে। নিরবতা ভেঙে নটরডেম বলে,
– শঙ্খ নদী দেখতে যাবে? তুমি আর আমি।
– শঙ্খ নদী! কোথায় এই নদী!
– বহু দূর! দুপাশে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়, সবুজ যে কত রকমের হতে পারে, পাহাড়ের চূড়োয় কখনো বা মেঘ, আর পাহাড়ের পাদদেশে বয়ে চলা লক্ষ্মী এক নদী- শঙ্খ। তুমি সাঙ্গু নামেও ডাকতে পারো।
– ভীষণ সুন্দর, তাই না!
– হুম।

ভিকারুননিসা মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে,
– ওই নদী কতদূর?
– বান্দরবান।
– ওহ! অনেক দূর?
– হুম।
– নটর ডেম, আমি তোমার হাত ধরে বসে থাকবো, সারাক্ষণ। নদীর তীরে- তোমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাটবো। তুমি কিন্তু বকতে পারবে না।
– বকবো না।
– দেখো, একদিন ঠিক ঠিক যাবো, তোমার সাথেই যাবো।

নটর ডেমের স্বরে দীর্ঘশ্বাস আড়ালের চেষ্টা,
– ততদিন নদী যেনো ডুবে না যায়। ততদিন তুমিও না হারাও।
হেসে ওঠে ভিকারুননিসা,
– হি.. হি.. হি.. আমি হারাবো না। হি.. হি.. হি.. নদী আবার ডুবে না কি!
– নদী ডুববে না কেনো। নদীও ডুবে যায়। শেষতম ভ্রমণ শেষে উড়তে ভুলে যায় পাখি। প্রেম মরে যায়, জেগে থাকে চোরাটান।
– আর?
– বিচ্ছেদ দিগন্তে যায়, বিরহ তত দীর্ঘ নয়।

ভিকারুননিসা দাঁতে নোখ কাটে, নটর ডেমের হাতে হাত রাখে, স্বরে কৌতূহল,
– তোমার খুব মন খারাপ, নটর ডেম?
– নাহ, মন খারাপ না।
– তোমাকে ছাড়া জীবন অর্থহীন, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবেনা তো!

নটর ডেম হেসে ওঠে,
– তুমি কি আমায় ছেড়ে যাবে, ভিকারুননিসা!

বেইলে রোডের ব্যস্ততাশূন্য ছুটির দুপুরে নেমে আসে কি অরণ্যের নির্জনতা! দু’জন দু’জনের চোখে খুঁজে যায় নির্ভরতা, অল্প বয়সের ভুল জানেনা কোনো নির্ভরতাই চিরস্থায়ী নয়। ঝাপসা হয়ে বেইলি রোড, শ্বাসকষ্ট বাড়ছে, মাথার ব্যাথা আরও তীব্র হচ্ছে। চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না। কপালে হাত রাখে শুভময়। জানতে ইচ্ছে করেনা এতক্ষণপর কোথা থেকে এলো, শুভময় বলে,
– তোর জ্বরটা কিন্তু বাড়ছে।
– বাড়ুক।
– কাউকে ডাকি?
– না, কাউকে ডাকতে হবেনা।

শুভময় সিডি প্লেয়ারের ভল্যুউম কমিয়ে দেয়, নিয়াজ মোহম্মদ চৌধুরী গাইছেন “তোমার যাবার সময় বুঝি হয়ে যায়/আমার দেবার কিছু বাকী রয়ে যায়/এভাবে চলে যাবে তুমি।” গান বাজছে, শুভময়ের চেহারাটা ভিকারুননিসার মত হয়ে আসে, অথবা এতক্ষণ সেই ছিলো ছদ্মবেশে, খুব করুণ স্বরে জিজ্ঞেস করে,
– নিজের প্রতি এত অবহেলা কেনো, তোমার?
– জানিনা।
– আমার ওপর রেগে কেনো নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো নটর ডেম?
– আমি কারো ওপর রেগে নেই। নিজেকে কষ্টও দিচ্ছি না।
– দিচ্ছো তো!
– সে তোমার ভুল ধারণা, ভিকারুননিসা। আমার কাছে সবকিছু উপভোগ্য। এমন কি, তুমি যে চলে গেছো তাও আজ উপভোগ্য।
বাইরে একটা কাক ডাকছে, খুব কষ্ট করে মুহুর্তের জন্য চোখ মেলতেই দেখলাম ঘরে রোদ নেই, বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে! অথবা চোখই মেলিনি, সব বিভ্রম। ভিকারুননিসা কথা বলে ওঠে,
– আমার চলে যাওয়া তোমার কাছে উপভোগ্য?
– হুম। তবে, তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিলো সবকিছু অর্থহীন, আমি যেনো এক আমূল ডুবে যাওয়া নদী, শেষতম ডানা ভাঙা পাখি।
– তারপর?
– তারপর বহুদিন পর, ছাই থেকে হয়ে উঠি ফিনিক্স পাখি, মনসুখিয়ার ডাকে।
– মনসুখিয়া কে?

নটর ডেম এ প্রশ্নের উত্তর দেয় না। বহুক্ষণ পর কানের কাছে কথা বলে ওঠে শুভময়, কষ্ট করে তাকাতে দেখি শুভময় নেই। শুভময়ের থাকার কথাও না, ষোলো বছর আগে যে মরে গেছে তার উপস্থিতি শুধুই বিভ্রম। তবু আজ হঠাৎ, বহুদিন পর, সারাদিন থেকে থেকে শুভময় ডাক দিয়ে যাচ্ছে। ভিকারুননিসা জানে, আমি তার নাম কেটে দিয়েছি বহু আগে, তবু কেনো বারবার সে আসে! মোবাইলের মেসেজ এলার্ট বেজে ওঠে, আঙুলের সকল ব্যাথা তুচ্ছ করে মোবাইল সেটটা হাতে নেই, মেসেজ খুলতেই মনের ভেতর ডেকে ওঠে রোদ্ররঙা ফিঙে, প্রিয় অভ্রবকুল লিখেছে, “ইশ! এভাবে কেউ অসুস্থ হয়! সুস্থ হয়ে ওঠো তারাতারি, কি মনসুখিয়ায় যাবে না!” অভ্রবকুল কি জানে সেই আমার মনসুখিয়া! কোনো প্রয়োজন নেই জানার, একটা জীবন কেটে যাক মৌলিক বিভ্রমে।

#মনসুখিয়া-২

প্রণয়চূর্ণ … [মনসুখিয়ার নতুন পর্ব]

index-1

১.
ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা শেষ হয়েছে একদিন আগে। অফুরন্ত অলস অবসর। সকালে দেরী করে ঘুম থেকে জাগবে, তাই একটা টাওয়েল ভাজ করে ল্যান্ডফোনের উপর দিয়ে রেখেছে নটরডেম, যাতে এনালগ সেটের কর্কশ আওয়াজে ঘুম না ভাঙে। ১৯৯২ সালে দেশে ডিজিটাল ফোন ছিলো না। রাত জাগার অভ্যাস তার পুরানো, ঘুম না আসায় বই পড়তে শুরু করেছিলো সে, কখন যে ঘুমের দখলে চলে গেছে বুঝতেও পারেনি। ওর ঘুম হালকা হয়ে এলো ক্রিইইইং… ক্রিইইইং… ক্রিইইইং… শব্দে। বহুক্ষণ বুঝতে পারছিলো না শব্দটা স্বপ্নে হচ্ছে কি ফোন বাজছে। দু’তিনবার থেমে আবার টানা বাজতেই ঘুম ঘুম চোখেই ফোন রিসিভ করলো নটরডেম,
– হ্যালো।

ওপাশে নিরবতা, আরও দু’বার হ্যালো বলতেই ওপাশে কলকলিয়ে উঠলো ভিকারুননিসা,
– হিহিহি… হিহিহি… এই সাত সকালে কে ফোন করেছে বলে মনে করেছো?

প্রিয়তম কণ্ঠ শুনে নটর ডেমের ঘুম কেটে যায়, তবুও ঘুম ঘুম স্বরে বলে,
– ওহ তুমি! আমি ভেবেছিলাম পপি ফোন করেছে।

ফোনের ওপাশে হাসি থেমে যায়, গম্ভীর কণ্ঠ,
– পপি কে?
– কেউ না।
– সত্যি করে বলো, নটরডেম।
– সেটা জানলে তুমি রাগ করতে পারো।
– রাগ করলে করবো, তবুও বলো।
– বাদ দাও।

ভিকারুননিসার কণ্ঠে জেদ,
– বাদ দিবো না, পপি কে? বলো, পপি কে?

অপরাধীর মত স্বরে ঢোক গিলে নটরডেম বলে,
– জানতেই যখন চাইছো তখন বলছি, পপি মানে.. পপি হলো.. পপি ওই যে..
– ঢং করবে না। একটুও ঢং করবে না। পপি কে?
– পপি হলো চিত্রনায়িকা ববিতার ডাক নাম। উনি আমাদের কাছাকাছি বাসায় থাকতেন, তাই নামটা জানা।
– আমাকে বোকা পেয়েছো? উনি তোমাকে ফোন করবেন কেনো?
– স্বপ্ন দেখছিলাম, ববিতা গাইছেন, “ইশারায় শিস দিয়ে আমাকে ডেকো না.. “আর তখনই ফোন বেজে উঠলো যে…

ফোনের ওপাশে বোমা বিস্ফোরণ,
– তুমি একটা.. তুমি একটা.. তুমি একটা..
– হাহাহাহাহাহা, আমি একটা কি?
– তুমি একটা রোগা জাম্বু।
– হাহাহা, এইটুকুই?
– আজ সামনে আসো, তখনই বুঝাবো তুমি আর কী কী।

ভিকারুননিসার সকল অভিমান, রাগ, খুনসুটি নটরডেমের বুকে একরকমের বোধ তৈরী করে। শিরায় শিরায় প্রবাহিত এই সুখের মত অসুখের বিস্তার প্রকাশের যথাযথ শব্দ তার অজানা। ও শুধু অনুভবের গভীরতা বোধ করে, মোহগ্রস্থ হয়। এ জীবন তার সকল অপ্রাপ্তিময় যাপন নিয়েও দোলায়িত হয় সুখে, ভালোলাগায়, আনন্দে আর ভালবাসায়। উচ্ছাস মিশ্রিত সতেজতায় জানতে চায়,
– আজ দেখা হবে? সত্যি!
– শোনো, বাবা কালকের ফ্লাইটে আয়ারল্যান্ড গেছেন। মা’কে কোচিং আর বান্ধবীর বাড়ির কথা বলে আজ সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বাইরে থাকতে পারবো। তুমি আসবে, নটরডেম? কতদিন তোমাকে দেখি না।
– ক’টায় দেখা হচ্ছে?
– সাড়ে তিনটায়, সাগর পাবলিশার্সের সামনে থেকো।
– ভিকারুনিসা, আড়াইটা থেকেই সাগর পাবলিশার্সে থাকবো। কিছু বই কিনবো। এরপর তুমি এলে দু’জন মিলে বেইলি রোড থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাবো, ওখানে দুটো বই জমা দিয়ে নতুন দু’টো বই নিবো। তারপর রিকশায় ঘুরবো।

কলকলিয়ে ওঠে ভিকারুননিসা,
– ঠিক আছে, রোগা জাম্বু হিহিহিহি..
– হাহাহাহা, লাভ্যু পপি।

ফোন রাখতেই নটর ডেমের মনটা বন্ধনহীন অথচ সংযত উল্লাসে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। হঠাৎ করেই চারদিকে সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করে। বিছানায় কুঁচকে যাওয়া চাদরটাকেও মনে হয় শিল্পকর্ম। শুরু হচ্ছে আরেকটা নতুন দিন। দোতলার ছাদের রেলিংয়ে শিস দিচ্ছে দোয়েল। নটরডেম খোলা ছাদে হাটছে, ভোরের ঘ্রাণ নিচ্ছে। ও জানে প্রতিটা ভোরের ঘ্রাণ আলাদা এবং নতুন। সূর্যটা পুরানো হলেও প্রতিদিনের রোদের রঙ ও তেজ নতুন। ছাদের টবে ফোটা বেলী ফুলের ঘ্রাণের সাথে বাখরখানির ঘ্রাণ মিশে যেতেই বুঝতে পারে বাড়ির উল্টোদিকে শমসের চাচার বাখরখানির দোকানে রুটি বানানো শুরু হয়েছে, দোকানের সামনে বসে মাঠা বিক্রি করছে জগৎ কাকা। আর ঘণ্টাখানেক পর রহমান কাকার কনফেকশনারি দোকান থেকে ভেসে আসবে ক্বারী আবদুল বাসিতের কোরআন তেলওয়াতের শব্দ। মনে সরোদের সুরের মত রিনরিনে কৌতূহল জন্মায়- ভোরে ঘুম ভাঙাবে বলে কি ভিকারুননিসা সারারাত জেগে ছিলো, এখন বাজে মাত্র পৌনে ছ’টা।

২.
মা জেগেছেন। নিচ তলায় রান্নাঘর থেকে শব্দ আসছে। সকালে মা’র চেহারায় এক অবর্ণনীয় সুন্দর লাবণ্য খেলা করে। মা’র শরীর থেকে কোমল আভা বিচ্ছুরিত হয়। এই অলৌকিক আভার জন্ম এই পৃথিবীতে নয়- অন্য কোথাও। পুরানো আমলের দোতলার ছাদের উত্তর পাশ থেকে রান্নাঘরটা দেখা যায়। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে মা’কে দেখে নটরডেম। সে জানে রান্নাঘরের ছোট্ট তিন ফিট বাই তিন তিন ফিটের জানালা দিয়ে মা উপরে তাকাবেন, তারপর রান্নাঘরের দরজায় এসে অপার্থিব নান্দনিক একটা হাসি ছড়িয়ে প্রশ্ন করবেন, “চা খাবি, বাপ?” আজও ব্যতিক্রম হলো না, চোখাচোখি হতেই দরজায় এসে হাসি দিয়ে মা জিজ্ঞেস করলেন,
– চা খাবি, বাপ?
– হুম, তুমি খেয়ে অর্ধেকটা দিও।
– নিচে আয়।

নটরডেম সিড়ি ভেঙে নিচে নামে, সিড়িগুলোর একপাশে ফুলের টব, নয়নতারা ফুটে আছে আর ঘাসফুল ফুটবো ফুটবো করছে। মা’র শখের জিনিস, একটা ছোট্ট ডাল ভাঙলেও উনার চোখ এড়ায় না। মা তার পোষা টবের গাছগুলোর সাথে কি কথা বলেন, গাছগুলো কি বলে, “আজ কেউ আমার ফুল ছিঁড়েছে? দেখেছো!” বা “তোমার ছেলে আমার ডাল ভাঙলো কেনো- জিজ্ঞেস করো”। নটরডেমের জানতে ইচ্ছে করে কিন্তু জিজ্ঞেস করতে অস্বস্তি লাগে। নিচে নেমে রান্নাঘরের সিড়িতে বসতেই প্রতিদিনকার মত মা বলেন,
– তোকে আলাদা মগে চা দিচ্ছি রে বাপ।
– না, মা। তোমার মগের অর্ধেকটা খেয়ে দাও।
– কারো এঁটো’টা খেতে হবেনা।
– মা, তোমার খাওয়াটা খাবো। চায়ের সাথে তোমার মুখের জর্দা দেওয়া পানের ঘ্রাণ লেগে থাকে যে, ওমন চা কোথায় পাবো!

মা মনে মনে খুশি হন, বাইরে প্রকাশ করেন না। আজ চা খাওয়ার আগে বললেন,
– আগে নাস্তাটা খেয়ে নে।

মা এক চুলোয় পরোটা ভাজলেন, আরেক চুলোয় মাংসের বাসি তরকারি হালকা আঁচে একটু পোড়াপোড়া করলেন। প্লেট আর বাটিতে সাজিয়ে রান্না ঘরেই খেতে দিলেন। নিচ তলার চৌকো উঠোনে কয়েকটা কাক নেমে এসেছে। এরা রোজ আসে মুড়ি, রুটি, পরোটা বা বাসি ভাতের লোভে। একটা বিড়ালও আসে। নটরডেম পরোটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে তাদের দিকে দিচ্ছে, নিজেও খাচ্ছে। পায়ের সাথে শরীর ঘষছে বিড়ালটা, মা ওকে বাসি ভাত ঝোল মাখিয়ে খেতে দিলেন।

মা আজ ছাই রঙা পাড়ের হালকা নীল জমিনের একটা ঢাকাই শাড়ি পরেছেন। শাড়ি থেকেও মা মা ঘ্রাণ আসছে। নটরডেমের ভীষণ ইচ্ছে করে ভিকারুননিসার কথাটা মা’কে বলে। কিন্তু কথাটা আলজিভ পর্যন্ত এসে থমকে যায়। মা কি কিছু বুঝতে পারছেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
– কিছু বলবি বাপ!
– নাহ।
– আজ কি কোথাও যাবি? তোর জন্য নোনা ইলিশ আলু দিয়ে রান্না করবো ভেবেছি।
– মা, দুপুরে বের হবো। খেয়েই বের হবো। তবে ফিরতে একটু দেরী হবে।
– দেরী হবে! একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস বাবা।
– ৯টার মধ্যে ফিরবো। এরপর এক সপ্তাহ আর কোথাও যাবো না।

নটরডেম নাস্তা করছে, মা নাস্তা বানানো রেখে চা খান আর ওর চুলে বিলি কেটে দেন, নিজের মনেই বলেন,
– মনের ভেতর কি যে লুকিয়ে রাখিস, তা তুইই জানিস, বাপ। আচ্ছা, ভিকারুননিসা কে?
নটরডেমের বুকের ভেতর দশ লাখ সৈন্যের মার্চপাস্ট শুরু হয়, নিজে কে সামলে নিয়ে বলে,
– মা, ধরো ও কেউ না অথবা সবকিছু। কিংবা শুধুই বিভ্রম। তোমাকে একদিন ঠিক ঠিক বলবো।
মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করেন, “এ বড় রঙিন বয়স বাপ, বড় রঙিন বয়স। সুর ভুল হলে মানিয়ে নেওয়া যায়, তাল কাটলেই গণ্ডগোল।”

৩.
কুঁচকানো কালো টি-শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট শরীরে চাপিয়ে নটরডেম আড়াইটা বাজার দশ মিনিট আগে বেইলি রোডে পৌছায়। সাগর পাবলিশার্সে বসে আছেন প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। নটরডেম টানা দু বছর ধরে এই দোকান থেকে বই কিনলেও তাকে কমই দেখেছে। তিনি প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ‘চরমপত্র’ পাঠ করতেন। স্বাধীনতা অর্জনের দেড়যুগ পর স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় বিভিন্ন মঞ্চে ওই সব চরমপত্র পাঠ করা হত, মিছিলের আগে বা পরে চরমপত্র টনিকের মত কাজ করতো, রক্তে দোলা দিত- নটর ডেমের স্পষ্ট মনে আছে। কারণ, ওই সব মিছিলে স্কুলে পড়ুয়া সেও দু’হাত তুলে শ্লোগান দিত, পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তো, পুলিশের লাঠি চার্জ আর কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ার আক্রমণ হতে বাঁচতে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিত, ফের আন্দোলনে নামতো।

সিকদার আমিনুল হকের ‘সতত ডানার মানুষ’ এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমাকে জাগাও’ কবিতার বই দুটো ক্যাশ কাউন্টারে রাখতেই তিনি জিজ্ঞেস করেন,
– তোর পরীক্ষা কেমন হইছে?
– জ্বি, ভালো।
– প্রতি মাসে যে বই কিনোস, টাকা কি বাবার কাছ থেকা নিস?
– না, টিউশনির টাকা থেকে কিনি।
– বাহ! ভালো ভালো।

সামান্য ক’টা কথাতেই নটরডেমের মন ভালো হয়ে যায়। বই কিনে দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ায়। আকাশে মেঘ জমছে, চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। শ্রাবণ মাস, যে কোনো সময় ঝুম বৃষ্টি নামবে। বাতাসটা বৃষ্টির আঁচে ভেজা। আচ্ছা, এই মেঘলা আকাশ দেখে ভিকারুননিসা কি আসবে! বা সে আসার আগেই কি বৃষ্টি নামবে!

৪.
সাড়ে তিনটা বাজতে আরও ত্রিশ মিনিট বাকী, প্রতিটা মিনিটকে ঘণ্টার সমান মনে হচ্ছে। সময়ের নিয়ম সে চলবেই, তাই সাড়ে তিনটাও বাজলো। ভিকারুননিসার দেখা নেই, পৃথিবীর সব বিষাদ নটরডেমের বুকে জমা হয়, চোখে জমে মেঘ। তার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। এর ঠিক আট মিনিট পর ভিকারুননিসা উপস্থিত হয়, মেঘলা দিনে সাদা আর লেমন গ্রিন রঙে ম্যাচ করা ড্রেসে আর খোলা চুলে তাকে নিটোল সুন্দর লাগছে। রিকশা থেকে না নেমে ইশারায় নটর ডেমকে উঠতে বলে। নটরডেম রিকশায় উঠে হুড ফেলে দেয়, সে চায় চারপাশে সবাই দেখুক এক কাঠুরের পাশে বসে আছে রাজকন্যা, এই পৃথিবী সাম্যের।

রিকশা ছুটছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দিকে, হাওয়ার দাপট বেড়েছে। নটরডেমের কেনা বই দু’টো দেখে ভিকারুন নিসা প্রশ্ন করে,
– নটর ডেম, এত বই পড়ো?
– নাহ, বইয়ে শুধু চোখ বুলাই, আমার একমাত্র পাঠ্য তুমি। কিন্তু হায়ারোগ্লিফিক্সে লেখা বলে অনেকটাই বুঝতে পারি না।
– হিহিহি.. আচ্ছা তুমি কি হতে চাও?
– যেমন?
– কেউ ডাক্তার হয়, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বিসিএস ক্যাডার, কেউ লেখক, তুমি?

ভিকারুননিসার চোখে চোখ রেখে নটর ডেম বলে,
– অতো জটিল কিছু হতে চাই না। আমি হতে চাই ধরো তোমার চুলের ক্লিপ, জামার বোতাম, বা গলার চেইনের লকেট! অথবা আমৃত্যু এক জোড়া হুক।
– অসভ্য একটা। খুব অসভ্যতা শিখেছো, তাই না!
– আরে অসভ্যতা নয়, অথবা ধরো তোমার ছায়া। সকালে আর বিকেলে প্রলম্বিত ছায়া, দুপুরে পায়ের নিচে জমাটবদ্ধ, আজকের মত মেঘলা দিনগুলোতে প্রায় অদৃশ্য, দেখাই যায়না এমন।
– অদৃশ্য হতে হবে না, আমি সবসময় তোমায় দেখতে চাই।
– হাহাহা, তবে ছায়া নয়, তোমার স্নানের অশেষ সাবান বা গায়ে মাখার অল সিজন লোশন।

লজ্জায় ভিকারুননিসা কিছুটা বিব্রত হয়ে ওঠে, তার ফর্সা চেহারায় লালাভ আভা, কণ্ঠে কপট শাসন,
– ধ্যাত! চুপ করো। তোমায় আজ অসভ্যতায় পেয়েছে।
– হ্যাঁ, চলো এই একটা জীবন কাটিয়ে দেই অসভ্যতায়- মরে যাই, ফের জন্মাই, সেও অসভ্যতায়।
– ছি: নটরডেম, অসভ্যতা কি ভালো!
সিরিয়াস হয়ে ওঠে নটর ডেম,
– প্রিয় ভিকারুননিসা, তুমি কি জানো অসভ্যতা শব্দটাই সভ্যতার মিথ্যে আবিষ্কার, ফাঁপা আস্ফালন।
– মানে?
– মানে, তুমি যা অসভ্যতা বলছো সেটাও ভিন্ন মাত্রার সভ্যতা। অরণ্যে যে মানুষরা নগ্ন থাকে তাদের সভ্যতার রুচিটা আলাদা, আমরা যারা শরীর ঢেকে রেখে সভ্য হই তাদের রুচিটা আরেক রকম।
– তাই?
– তাই নয় তো কি! যে অরণ্যেবাসী কাঁচা মাংস খায়, সুযোগ পেলে মানুষের মাংস খেতে দ্বিধা করেনা, তারাও হাসে কাঁদে, শিশুদের স্নেহ করে, বুনো জন্তুর আক্রমণ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে সঙ্গী সাথী ও পরিবারের সদস্যদের একা রেখে কাপুরুষের মত পালায় না।
– সত্যি?
– হ্যা, সত্যি। তারাও ভালবাসে, পরস্পরকে আদর করে। তাদের সংসারেও আসে নতুন অতিথি, জন্মের প্রথম কান্নায় আনন্দে ভাসে সংসার, অরণ্যের আদিম চারদিক।

ভিকারুননিসা বিভ্রান্ত স্বরে জানতে চায়,
– নটর ডেম, তুমি আমাকে অসভ্য হওয়ার লোভ দেখাচ্ছো?
– না, লোভ দেখানোটা এক ধরণের সভ্য মানুষের কাজ। অবশ্য লোভকে মানসিক বিকারও বলতে পারো, অসভ্যতা আর মানসিক বিকারে যোজন যোজন ফারাক।
রিকশা চলছে। অফিস ছুটির দিন বলে রাস্তা অনেকটা ফাঁকা। কিছুক্ষণ কারো মুখেই কথা নেই, হাওয়ায় ভিকারুননিসার চুলে মাঝে মাঝেই উড়ে এসে নটরডেমের মুখে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে, নটরডেম ভাবছে এ রিকশা যেনো অনন্তকাল চলতেই থাকে, চলতেই থাকে- একটা জীবন এভাবে কেটে গেলে কোনো ক্ষতি নেই। নিরবতা ভাঙে ভিকারুননিসা, কণ্ঠে কৌতূহল,
– নটরডেম, ওই অসভ্যতায় কি গ্রীষ্মের গরমে ব্যবহারের জন্য ফ্রিজ আছে? এসি?
– নাহ নেই, ওই সভ্যতায় এসব জিনিস খুব বেশী অসভ্য। তাছাড়া ঠাণ্ডা খেলেই তোমার টনসিল ফোলে, তোমার খুব কষ্ট হয়।
– ফুলুক, ঠাণ্ডা খেতে না পেলে মরেই যাবো।
– মরবে না, সেখানে আছে বিশল্যকরণী চুমো।
– হিহিহি, শখ কত! কিন্তু এর আগেই বাবা কান ধরে টেনে নিয়ে আসবে, হু।
– প্রেমিকার বাবা আর বড়ভাইগুলো সভ্যতার সঙ্কট, এক একটা মিনি সাইজ হিটলার।
– হিহিহি।

এলোমেলো কথায় যায় সময়। সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা বাজতেই নটর ডেম বলে,
– চলো তোমাকে বাসা পর্যন্ত দিয়ে আসি।

ভিকারুননিসা কিছু বলে না। নটরডেমের বাম হাতের পাতাটা নিজের ডান হাতে মুঠো করে ধরে রাখে, যেনো আর কখনোই ছাড়বে না। এই স্পর্শ নটরডেমের হৃদয়ে ও মগজে ছড়িয়ে দেয় ভালোলাগার অনুরণন, সুখের মত অসুখ প্লাবন হয়ে আছড়ে পড়ে মনে। নটরডেম প্রার্থনা করে সারাটা জীবন যেনো এভাবে কেটে যায়, দু’জনের পথচলা যেনো কোনোদিন অতীত না হয়। প্রতিদিন যেনো ভিকারুননিসা তাকে ডাকে, মনে মনে ‘সতত ডানার মানুষ’ হতে সে ভিকারুননিসাকে বলে- “অনুকম্পা হলে ডেকে নিও আমায় যে কোন সময়/আমি তো অতীতকাল নই যে ফিরে আসতে পারবো না কখনো।’

৫.
ফিরে আসা সহজ নয়, যতটা সহজ ফিরে যাওয়া। ভিকারুননিসা সাম্যের পৃথিবীতে কাঠুরেকে বাদ দিয়ে খুঁজে পেয়েছিলো রাজপুত্র। সে পেয়েছিলো ক্ষণিকের চটুল প্রেম কোনো এক ঢাকা কলেজের কাছে। প্রেম নেই, তার প্রেমশূন্য সংসার টিকে আছে। অথবা সংসার নয়, সংসারের ফসিল। বহু দিন, বহু বহু দিন অনুকম্পা হয়নি তার, সময় হয়নি তার কাঠুরেকে ডাকার। সভ্যতা ও অসভ্যতা চলেছে যে যার মত, ঘড়ির পেন্ডুলাম দুলেছে দুই দিকে অবিরাম, সময় যাচ্ছে চলে উদ্দেশ্যহীন।

এক তুমুল বর্ষনের রাতে ছাদে উঠে আকুল হয়ে কেঁদেছিল নটরডেম। আত্মহননের শিল্প শিখে নিয়েছিলো সে। প্রতিদিন কতবার যে নিজেকে ভস্ম করে উড়িয়ে দিয়েছে হাওয়ায় হাওয়ায়, অবলীলায়। নিজেকে অবহেলা করতে করতে সে ভুলে গিয়েছিলো অবহেলা কাকে বলে। কত ভোরে মনে হয়েছে ফের বেজে উঠবে টেলিফোন, কিন্তু বাজেনি। নিজেকে হনন আর দহনে ভস্ম করা যার অভ্যাস, তার গোপন করা অযুত দীর্ঘশ্বাস গুমরে ওঠে হাওয়ায় হাওয়ায়। তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে অভ্রবকুল, ডাকে মনসুখিয়া, যার বুক চিরে বয়ে যায় এক নদী, জোছনা রঙা রৌদ্রনদী।

দ্বিধা

– তুমি কি আমাকে ফিরিয়ে নিতে পারো না!

সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, অফিসে কাজের চাপ নেই। চৌদ্দ তলায় নিজের চেম্বারে বসে আছে মাহমুদ, জানালার পর্দা সরিয়ে বৃষ্টি দেখছে, কানে ধরা মোবাইল সেট। বীথির আকুতি তাকে গ্রাস করে, এক মুহুর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। স্তব্ধতা কাটিয়ে বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করে,
– তুমি কেনো বারবার ফোন করছো, বীথি? কেনো কাজের মাঝে এমন বিরক্ত করছো!
– তুমি বারবার কল কেটে দিচ্ছো, আমি কি করবো বলো!

মানুষের মস্তিষ্ক দুরন্তগতির রহস্যময় সময় বাহন। ‘তুমি কল কেটে দিচ্ছিলে, আমি কি করবো বলো!’ বলতে বীথির যতটুকু সময় লাগলো, ওই ক’সেকেন্ডের মধ্যে মাহমুদের বহু কিছু মনে পড়ে গেলো। দু’জনের গড়ে তোলা সংসার, তিল তিল করে সাজানো আর সুখ-দুখ উদযাপন। তিন বছরের মাথায় প্রথম সন্তান আরিফের জন্ম হলো। মুরুব্বীদের কথায় দেরী না করে, দুই বছর বিরতি দিয়ে আবার সন্তান নেওয়া, কোল জুড়ে এলো যুথী। চার জনের সংসারে থই থই সুখ। ভাবনায় ছেদ পড়ে বীথির কথায়, মাহমুদের কণ্ঠে কঠোরতা,
– বীথি, আমি কেনো তোমার ফোন রিসিভ করবো?

বীথির কাছে এ প্রশ্নের এক হাজার উত্তর আছে, এর কোনোটাই যথেষ্ট নয়। যুথীর জন্মের পর মাহমুদ চাকরী ছেড়ে নিজে ব্যবসা শুরু করলো- পূঁজির স্বল্পতা শ্রম দিয়ে সমন্বয় করতে গিয়ে মাহমুদের সে কি ব্যস্ততা। সংসারের প্রয়োজনীয় দায়িত্বগুলো পালনে কোনো ফাঁকি দেয়নি। কিন্তু শুধু দায়িত্বপালনই কি সব! বীথির দীর্ঘ দিনগুলো কিভাবে কাটছে একবারও কি ভেবেছে সে। দুপুরে দুই সন্তানকে ঘুম পাড়ানোর পর বিকেল পর্যন্ত অখণ্ড অবসর- এই অবসরে রোজ রোজ একঘেয়ে টিভি সিরিয়াল দেখতে বীথির ভালো লাগে না, সময় কাটাতে মোবাইলে আত্মীয় স্বজন আর বান্ধবীদের সাথে কথা বলে। বীথির সম্বিত ফিরে, মাহমুদের প্রশ্নের উত্তরে বলে,
– আমি জানিনা, মাহমুদ। তোমার সাথে একবার দেখা করতে চাই.., একবার বাচ্চাদের দেখতে চাই।
– এসব কি বলছো বীথি!

বীথি জানে সে কি বলছে, যা বলছে তা স্বাভাবিক নয়। কিন্তু ওই দিনগুলোতে নি:সঙ্গতায় নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া কি খুব বেশী অস্বাভাবিক ছিলো, মোবাইলে সঙ্গ লাভের চেষ্টা করা কি ভুল ছিলো। একটা সময় বান্ধবীরা কি কাজের অজুহাত দিয়ে ফোন কেটে দিত না! কিন্তু কথা বলার নেশায় বীথি আসক্ত, তাই এলোমেলো অনেককেই ফোন দিত। একদিন ফয়সালকেও ফোন দিলো, বহু দিন পর দু’জনে কথা হলো। এমন নয় যে দু’জন খুব কাছের বন্ধু, কাছাকাছি হবার শুরুটা এখান থেকেই।

প্রতিদিনের আলাপে দু’জন এতটা কাছাকাছি হলো যে, এক একটা দুপুরে বাইরে ব্যস্ত জীবন, কোলাহল, ঘরে ঘুমোচ্ছে দুই সন্তান আর গেস্টরুমে দু’জন মানুষ স্পর্শে কাতর, স্পর্শে মুখর। এ পর্যন্ত থাকলে সমস্যা ছিলো না, কিন্তু প্রণয় চরিত্রগতভাবেই অন্ধ। ফয়সাল যেনো এক নি:সঙ্গতা নাশক বড়ি, ওকে ছাড়া বীথির জীবন অর্থহীন। ফয়সালের ক্ষেত্রেও বীথিকে ছাড়া বেঁচে থাকা দায়। এক দুপুরে মাহমুদকে জরুরী বাসায় আসতে বললো বীথি, মাহমুদ ফিরে এসে সবই পেলো বীথিকে ছাড়া। বীথি কিছুই ভুলেনি, মাহমুদের বিস্ময়ে বিব্রত হলেও বীথি বললো,
– মাহমুদ, আমি জানিনা কি বলছি, কিন্তু তুমি একটাবার আমার সাথে দেখা করো, একটাবার বাচ্চাদের দেখতে দাও।

মাহমুদ বুঝতে পারে বীথি কান্না লুকানোর চেষ্টা করছে, ওর চোখের পানি নাকের পাশ বেয়ে এসে ঠোঁট ছুঁয়েছে। কিন্তু এসবকে সে পাত্তা দিবে না, মোটেই পাত্তা দিবেনা, কঠোর কণ্ঠেই বলে,
– বীথি, তুমি চলে যাওয়ার পর বাচ্চারা খুব কান্না করতো, খেতে চাইতো না। তুমি কখন আসবে জানতে চাইতো। খুব কষ্ট করে বাচ্চাদের ভুলিয়েছি, ওরা তোমাকে ভুলে গেছে, আবার কেনো ওদের মন ভাঙতে চাইছো!

এবার আর বীথি নিজেকে সামলাতে পারলো না, কান্নার দমক সামলাতে সামলাতে বলে,
– আমি ভুল করেছি, একবার…অন্তত একবার বাচ্চাদের দেখতে দাও, কথা বলতে দাও, প্লিজ..।

মাহমুদের ভেতরে তোলপাড় হয়ে যায়, এ কান্না সংক্রামক, এ আকুতি অসহনীয় করুণ, চোখ ভিজে আসে। তবু শান্ত কণ্ঠে বলে,
– তোমার কি টাকা দরকার বীথি?
– মাহমুদ, তোমাকে ছেড়ে আসার পর সবগুলো দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার ঘরে ভাত রান্না করার চালও নেই, কিন্তু টাকা চাইনা, প্লিজ একবার দেখা করো, একবার।

কৌতূহল চাপতে না পেরে মাহমুদ জিজ্ঞেস করে,
– ফয়সাল কই?
– ঘর ছাড়ার সপ্তাহ খানেক পর আর ওকে পাইনি। ও অন্য কাউকে নিয়ে ব্যস্ত আছে হয়তো। দ্বিধা আর অপরাধবোধে পুড়তে পুড়তে তোমাকে জানানোর সাহস পাইনি।

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে মাহমুদ, এসব ঘটনা ছায়া ছায়াভাবে তার জানা আছে। যতটা পেরেছে বীথির খোঁজ রেখেছে, কারণ বীথি সম্পর্কে প্রাক্তন স্ত্রী কিন্তু তার সন্তানদের মা, আর মা কখনো প্রাক্তন হয় না। মাহমুদের কণ্ঠে অসাহয়ত্ব ফুটে ওঠে,
– বীথি, তুমি জানো তোমার সাথে দেখা হলে নিজেকে সামলানো সম্ভব নয়, এরপরও কেনো জেদ করছো!
– আমি সন্তানদের কাছে ফিরতে চাই।
– আরিফ আর যুথী খুব ভালো আছে।

বীথি জানে মাহমুদের কাছে বাচ্চারা ভালো আছে। খুব ভালো আছে। কিন্তু সে তো বাচ্চাদের ছাড়া ভালো নেই,
– মাহমুদ, জানি বাচ্চারা খুব ভালো আছে। তুমি বাচ্চাদের জন্য পাগল। কিন্তু তুমি ওদের কাছে ওদের মা’কে ফিরিয়ে দাও, প্লিজ।
– বীথি.. কি বলছো তুমি!

প্রণয় অন্ধ, মোহও অন্ধ। মোহের অন্ধত্ব কেটে যায়, প্রণয়ের অন্ধত্ব সারাজীবনে কাটে না- এ কথা বীথির চেয়ে আর কে ভালো জানে, সে কাতর কণ্ঠে বলে,
– তুমি কি আমাকে ফিরিয়ে নিতে পারো না..

বাইরে বৃষ্টি বাড়ছে, বহুদিন পর এ শহরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। বহুদিন পর এ শহরে দু’জন মানুষ কানে ফোন চেপে চুপ করে আছে, ব্যক্তিগত বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে সংক্রামক দীর্ঘশ্বাস।

.
#গল্প
#গ্রন্থ_যোগি_সোসাইটি
সাঈদ ক’টা অণুগল্প লিখেছিল

অপ্রমিত অর্বাচীনের বাখোয়াজ: রবি ও নজরুল সম্পর্ক

rabi

বাঙালিরা স্বভাবগতভাবে একজনরে ছোটো না কইরা অন্যজনরে বড় করবার পারে না, আর বাঙালি ব্যবসাও বোঝেনা- এই দুইটা কথাই সইত্য। তা না হইলে আজ সারা দুনিয়ায় ছড়াইয়া যাওয়া ‘একজনরে ছোটো বানাইয়া অন্য জনরে বড় প্রমাণ’এর অভ্যাসটার কপিরাইট দাবী কইরা বহুত ফরেন কারেন্সি আদায় করা যাইতো। এইটা বারবার মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর কাজী নজরুল ইসলামের অন্ধ ভক্তদের আচরণ দেইখা।

রুই মাছের স্বাদ বেশী না বোয়াল মাছের- এই তুলনা অবান্তর, কারণ দুইটা মাছ হইলেও তাগো মধ্যে তুলনা চলেনা। ফল হইলেও জাম্বুরার লগে নারিকেলের তুলনা চলেনা। পাখি হইলেও কোকিলের লগে ঈগলের তুলনা বেমানান। কারণ, তারা নিজ নিজ স্বাদে ও গুণে ইউনিক। সাহিত্যিক হইলেও রবীন্দ্রনাথের লগে নজরুলের বা নজরুলের লগে রবীন্দ্রনাথের তুলনা চলেনা, তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। দুই জনের বয়সের ফারাক প্রায় ৩৮বচ্ছর, এরপরও দুইজনের সম্পর্কটা মুখামুখির আছিলো না, আছিলো পাশাপাশির।

বড় সাহিত্যিক গো সাট্টিফিকেট পাওয়ার লেগা এইকালে যেমুন অনেক লেখক গোপনে বা প্রকাশ্যে চেষ্টাচরিত্ত করে, ওই কালেও করতো। ওই কালের সবচে বড় সাহিত্যিক হইলেন রবীন্দ্রনাথ, নোবেল প্রাইজ পাইছেন, সারা দুনিয়ায় তার পরিচিতি। তার কাছ থেকা একটা সার্ট্টিফিকেট পাইলে আর লাগে কি! রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা বহুত চিঠিতে এই সার্ট্টিফিকেটের আবদারের প্রমাণ আছে। মাগার কাজী নজরুলরে রবীন্দ্রনাথ এমন এক সার্ট্টিফিকেট দিলেন যে, ওই সময়েই অনেকের কলিজা ফাইট্টা খানখান হইয়া গেলো। নিজের লেখা ‘বসন্ত’ গীতি নাট্য উৎসর্গ কইরা দিলেন কারাবন্দী কাজী নজরুলরে, প্রায় ৬৪ বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ ২৪বছর বয়সী নজরুলরে সম্বোধন করলেন কবি বইলা, উৎসর্গে লিখলেন, ‘শ্রীমান কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্নেহভাজনেষু’।

খালি উৎসর্গ করলেও একটা কথা আছিলো, তাগো দু:খ আরও বাড়ায়া দিতে বসন্ত’র একটি কপিতে নিজের নাম স্বাক্ষর কইরা পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে দিয়া রবীন্দ্রনাথ কইলেন, ‘‘তাকে (নজরুল) বোলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে আমার সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বোলো, কবিতা লেখা যেন কোনো কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই।’

রবীন্দ্রনাথের এই ‘বসন্ত’ কাণ্ডে অনেকের কলিজায় গুঁটি বসন্তের জ্বালা শুরু হইলো। তাগো মতে কাজী নজরুলের মতন অপগণ্ড, নিম্নমানের কবিরে বিশ্বকবি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ কবি বইলা সম্বোধন করবেন, স্বীকৃতি দিবেন, এইটা মাইনা নেওয়া যায় না। এই বিশেষজ্ঞদের মোক্ষম জবাব দিলেন রবীন্দ্রনাথ, ‘নজরুলকে আমি গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গপত্রে তাকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করেছি। জানি, তোমাদের মধ্যে যারা এটা অনুমোদন করতে পারেনি, আমার বিশ্বাস তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এ মনোভাব পোষণ করেছে। আজ আমি যদি তরুণ হতাম তাহলে আমার কলমেও ওই সুর থাকত।’ আবার অনশন ভাঙার অনুরোধ কইরা নজরুলরে টেলিগ্রামে লিখলেন, ‘Give up your hunger strike, Our literature claims you’ , এইখানে হাঙ্গার স্ট্রাইক ভাঙার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হইলো- ওরে নজরুল, আমাগো সাহিত্যে তোমারে দরকার।

নজরুলও কিন্তু রবীন্দ্রনাথরে ‘সঞ্চিতা’ উৎসর্গ করছিলেন, সেটা রবীন্দ্রনাথের নজরুলরে ‘বসন্ত’ উৎসর্গের প্রায় আট বচ্ছর পর।

রবীন্দ্রনাথের লগে নজরুলের কথাবার্তা হয় ১৯২১সালে, শান্তি নিকেতনে। এই দুইজনের যোগাযোগের মধ্যিখানে ছিলেন আরেক জ্ঞাণী মানুষ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ষাট, নজরুলের মাত্র একুশ। এর এক বচ্ছর পর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের স্মরণ সভায় সভাপতিত্ব করেন রবীন্দ্রনাথ, নিজের পাশে বসান নজরুলরে। আর যায় কই, লগে লগে জ্ঞানী দর্শক আর মাঝারি ও বাচ্চা সাইজের অতি রবীন্দ্রনাথরা চেইতা উঠলো- রবীন্দ্রনাথের লগে একই মঞ্চে পাশাপাশি বয় নজরুল! রবীন্দ্রনাথ ক্যান আশকারা দিয়া নজরুলের মতন এক ফাঁপা সাহিত্যিকরে ঘাড়ে তুলতাছেন, সে পালায়া যাইতে চাইলেও তারে ডাইকা মঞ্চে তুইলা নিজের পাশে বসাইতাছেন- এই অনাচার তো মানাও যায়না, রবীন্দ্রনাথরে কিছু কওনও যায় না। ধূমকেতুর ম্যানেজার শান্তিপদ সিংহ এই পরিস্থিতিরে কলমে ধইরা রাখছেন এভাবে , ‘বিশ্বকবি মঞ্চে প্রবেশ করলেন এবং প্রায় পিছু পিছু কবি নজরুলও একেবারে মঞ্চের উপর। কবি গুরুর ইঙ্গিতে তাঁর পাশের আসনেই বসলেন। নিচে সেই গুনগুনানি। তাদের হিসাব মতে, কবি গুরুর পাশে বসবার যোগ্যতা নজরুলের নেই। অথচ ঘটনাচক্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের পাশে বসবার সুযোগ পাচ্ছেন বড় বড় সভায়। কি দুর্দৈব!’

রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ উপন্যাস লইয়া সিনেমা বানানো হইবো, পরিচালক নরেশ মিত্র ‘গোরা’ সিনেমার সংগীত পরিচালক হিসাবে চাইলেন নজরুলরে, নজরুলও রাজী হইলেন। মনে রাখতে হইবো নজরুল তখন শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয় জনপ্রিয় গীতিকার ও সুরকার। সিনেমাতো বানানো হইলো, মাগার, গোরা সিনেমার মুক্তি আটকায়া গেলো বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের আপত্তিতে। বোর্ড আপত্তি করলো দুই কারণে, একে তো বোর্ডের অনুমতি না নিয়া রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করা হইছে, তার ওপর সুরও ঠিক নাই। সিনেমার প্রযোজক পরিচালকের মাথায় হাত, ভাড়া করা ট্যাক্সিতে নজরুল ফিল্মের প্রিন্ট আর প্রজেক্টর লয়া ছুটলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। ঘটনা শুইনা রবীন্দ্রনাথ ঠাসকি খাইলেন, অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর করতে করতে নজরুলরে কইলেন, ‘কী কাণ্ড বলো তো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান, আর ওরা কোন আক্কেলে তোমার দোষ ধরে? তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশি বুঝবে? আমার গানের মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে?’

নজরুল আছিলেন গান আর কবিতা পাগল মজলিশি মানুষ। একবার নজরুলের নেতৃত্বে গানের মহড়া চলতাছে, এক পত্রিকার সম্পাদক আইসা গান চায়া রবীন্দ্রনাথরে ছোটো কইরা নজরুলরে বড় করতাছিলেন, যে স্বভাবের কথা লেখার শুরুতেই কইছি। মাগার নজরুলরে তো পাম দিয়া ফুলানো যায় না, তিনি ওই সম্পাদকরে ধমকায়া কইলেন, ‘আমরা যদি কেউ না জন্মাতাম, তাতে কোনো ক্ষতি হতো না, রবীন্দ্রনাথের গান বেদমন্ত্র, তাঁর গান ও কবিতা আমাদের সাত রাজার ধন মানিক। লেখা নিতে এসেছেন, নিয়ে যান, লেখা নিতে এসে এ রকম আমড়াগাছি যেন আর না শুনি।’

রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের এমন চমৎকার সম্পর্কটার মধ্যেও শেষ পর্যন্ত বামহাত ঢুকাইতে সক্ষম হইছিলো একদল লোক, তাগো মুখামুখি দাঁড় করাইতে পারছিলো ওই বদগুলা, আফসোস। ওই সাময়িক ভুল বুঝাবুঝির পরও দুইজনের প্রতি দুইজনের দিলে মোহব্বতের কমতি আছিলো না। ওই কথা আরেকদিন কমুনে, আজ এই পর্যন্তই।

শুভ জন্মদিন প্রিয় কাজী নজরুল ইসলাম।

ঈদগ্রস্থ

index

ইচ্ছে করলে বৃষ্টিটা এড়িয়ে যাওয়া যেত, তার ইচ্ছে করেনি। দ্রুত বাড়ি ফেরার তাড়া, মাথার ভেতর কারা যেনো প্রবল আক্রোশে করাত চালাচ্ছে, ব্যথায় কুকড়ে উঠছে সে। ঘরে ফিরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেই শান্তি, কিন্তু ঘর যে বহুদূর। কত মানুষ আস্ত জীবন কাটিয়ে দেয় বাড়িতে, বাড়ি হতে ঘরের দূরত্বটুকু আর পেরোনো হয় না। চারকোনা বাক্সের দেয়ালে দেয়ালে কত যে বাড়ির ঘর হতে না পারার বেদনার গভীরতম দীর্ঘশ্বাস জমে প্রতিদিন।

বৈশাখ মাস প্রায় শেষ। তপ্ত রোদের দুপুর শেষে হঠাৎ থেমে থেমে বৃষ্টি শুরু। হাওয়ার ঝাপটায় কান্নার সুর, দূরে কোথাও ঝড় হচ্ছে। বৃষ্টির বেগ বাড়ে, মাথার ভেতর যন্ত্রণা বাড়ে, সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে আসে। যানজট কেটে কেটে থেমে থেমে ধীরে এগোতে থাকে রিকশা, মাথার ভেতর তীক্ষ্ম যন্ত্রণায় বদলে যায় দৃশ্যপট। সাড়ে তিন দশক আগের রমজান মাসের দুপুর, ছাদের কোনে বসে বই পড়ছে এক কিশোর। আড় চোখে দেখেছে রোজার দুপুরের ক্ষণিক অবসরে মা সেমাই বানাচ্ছে। ময়দার গোলা হতে এক চিমটি করে নিয়ে দুই আঙুলে তুড়ি বাজানোর মত করলেই তৈরী হয়ে যাচ্ছে সেমাই, প্রতিটা দানা সমান, বাসমতি চালের দানার চাইতে কিছুটা বড়। রোদে ভালো করে শুকোলেই খাবার উপযোগী হবে। হঠাৎ করে সেমায়ের একটা দানা প্রশ্ন করে,
– মানুষ, তোমার কি খুব বেশী যন্ত্রণা হচ্ছে?
– হু
– এমন যে বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছো, যন্ত্রণা তো আরও বাড়বে।
– বাড়ুক, বাড়তে দাও।
সেমাই দানা বিরক্ত হয়,
– ধ্যাত্তরি, তুমি একটা যা তা।

কথা বলতে ভালো লাগছে না। কোনো উত্তর না পেয়ে হতাশ হয় সেমাইদানা। একটু বিরতি নিয়ে মায়াময় স্বরে বলে,
– তোমার প্রচণ্ড যন্ত্রণা দেখে ছেলেবেলা থেকে উঠে এলাম। আমার নাম মনে আছে!
– শব্দশূন্য তুড়ি বাজানোর ঢংয়ে বানাতে হয় বলেই হয়তো তোমার নাম চুটকি সেমাই। ঈদের দিন মুরুব্বীদের কাছে ঘন দুধে ভিজানো তোমার যে খুব কদর ছিলো।

প্রশংসা শুনে বিব্রত হয় চুটকি, কষ্টও পায়,
– আমার সে দিন আর নেই, মানুষ। কে আর আমাকে মনে রেখেছে বলো!
কে কাকে মনে রেখেছে বা ভুলে গেছে- এ হিসাব কোনোদিন মিলে না। প্রসঙ্গ ঘুরাতে বলি,
– তুমি কি খেয়াল করেছো, চুটকি, সেমাই বানাতে বানাতে মাঝে মাঝে মা’র চোখ পানিতে ভরে উঠতো!
– হ্যা। খুব খেয়াল করেছি, কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি।
– বড় ভাইয়া মারা গেলেন মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে, আজ প্রায় ৪২বছর হলো। মা আজও ভুলে যান সে কথা। যখন বিভ্রম কাটে, মনে পড়ে ভাইয়া আর আসবে না, মা’র চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে, তিনি আঁচলে চোখ মুছেন।
– মানুষ, তোমরা এমন কেনো! আনন্দ আর কষ্টে তোমাদের এত মাখামাখি!
– এসবের কারণ জানিনা, জানতে ইচ্ছেও করে না। শুধু জানি, আমাদের ঈদের প্রবল আনন্দ জুড়ে মিশে থাকে গাঢ় বিষাদ।

চুটকি ভেবে পায় না কি বলবে, কিশোরের মনে ভেসে ওঠে বাবার মুখ।

রোজার দিনগুলোতে বাবা অন্যরকম হয়ে যেতেন, খুব বেশী চুপচাপ। তবু রোজার প্রথম সপ্তাহেই শুরু হত কেনাকাটা। কাজের চাপে দশ রোজার পর থেকে দর্জি দোকানে অর্ডার নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। রেডিমেড পোশাকের বাজার তখনও এত রমরমা হয়নি, অভিজাত হয়ে ওঠেনি। আশপাশের তিন চার পাড়ায় মহিউদ্দীন খলিফা’র খুব নামডাক। রোজার শুরুতে তার দোকানে টিনের ছোট্ট সাইনবোর্ড ঝুলতো, কালো রঙের উপর সাদা অক্ষরে লেখা- “অর্ডার নেওয়া বন্ধ”। বাবা বললে চাঁদরাতেও অর্ডার নিতে দ্বিধা করবেন না। তবু দশ রোজার আগেই পৌছে দেওয়া হতো শার্ট আর প্যান্ট পিস। এরপর যে কোনো ছুতোয় মহিউদ্দীন কাকার দর্জি দোকানের সামনে দিয়ে দিনে কয়েকবার ঘুরে আসার বিনে বেতনের চাকরি, হ্যাঙারে ঝোলানো প্যান্ট আর শার্টের ভিড়ে কৌতূহলী চোখে অনুসন্ধান করা নিজের পোশাক।

পনেরো রোজার পর দিন খুব দ্রুত যেত, শুরু হত ঈদের দিন গুণা। কোনো এক দুপুরে বাবা ব্যাগে করে বেশ কিছু শাড়ি এনে মা’র হাতে দিতেন। মা দেখে দেখে বাছাই করতেন কাকে কোনটা মানাবে, কে কোনটা পেলে খুশী হবে। আত্মীয় স্বজন আর নিকট প্রতিবেশীদের ঘরে উপহার হিসেবে পৌছে যেত সেসব শাড়ি। যে সকল আত্মীয় আর নিকট প্রতিবেশীরা খারাপ অবস্থায় আছে, যাদের কাছে ঈদ উদযাপন কিছুটা চাপ হয়ে আসে- তাদের ঘরে পৌছানো শাড়ির সাথে থাকতো ঈদের বাজার আর নগদ অর্থ। প্রতিবেশী এক মাসিমা দুর্গা পূজায় কিশোরকে নতুন কাপড় উপহার দিতেন, তাই তার জন্যও বরাদ্দ ছিলো ঈদ উপহার।

সাতাশ রোজা থেকেই শুরু হত পুরান ঢাকার ঈদ। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন নাজেল শুরু হয়েছিলো রমজান মাসে, সাতাশ রমজানকে ধরা হয় কোরান নাজেলের সেই মহিমান্বিত রাত, লায়লাতুল কদর। ছাব্বিশ রোজার সন্ধ্যা হতেই সাতাশ রোজার শুরু। তাই ইফতার শেষে একটু বিশ্রাম নিয়ে সময়ের আগেই দ্রুত মসজিদে পানে ছোটা। মসজিদ ঘিরে উৎসব উৎসব আমেজ। তারাবী শেষে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে সকল ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে আর সকল মানুষের মঙ্গল কামনায় ইমাম সাহেবের কান্নায় জরো জরো দীর্ঘ মোনাজাত, ‘আমিন’ ‘আমিন’ শব্দে মুখরিত মুসল্লিরা সংক্রমিত কান্নায়। এ কান্না পরম করুণাময়ের কাছে নিজেকে নিবেদনের, এ কান্না বরকতময় রমজানের সাথে পরবর্তী এক বছর বিচ্ছেদের আকুলতার।

কদরের রাতে পুরান ঢাকা ঘুমহীন, ইবাদতে মশগুল সব। তবু সেহেরির সময়ে ধীর পায়ে গান গাইতে গাইতে আসতো কাসিদার দল, পৃথিবীর সব আবেগ তাদের কণ্ঠে, “এয় তিশ দিনকে মেহমা/এয় মাহে রমজা আল বিদা/তুঝে সে থি সারি খুবইয়া/এয় মাহে রমজা আল বিদা…” কখনো বা “হে নামাজি আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ/দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ..”। এই বিশেষ রাতে কাসিদা দলের গানের সুর শুনলেই প্রতিটা বাড়ি থেকে একজন রাস্তায় এসে দাঁড়াত, কাসিদা পার্টি সামনে দিয়ে যাবার সময় দলের সদস্যদের হাতে নগদ টাকা গুঁজে দিত। এটা পারিশ্রমিক নয়, ঈদের তোফা।

ফের ঘোর কেটে যায়, বদলে যায় দৃশ্যপট। মাথার যন্ত্রণার আধিপত্যে শবে কদরের রাত ঝাপসা হয়ে আসে। শরীর কাঁপছে, বোঝা যায় জ্বর আসছে, খুব শীত লাগছে। মাথার ভেতর করাত চলায় বিরাম নেই, কারা তুমুল উল্লাসে হৈ-হুল্লোড় করে কাটছে সকল শিরা-উপশিরা! আত্মা মনকে বলছে, “ঘরে ফেরা না পর্যন্ত এই প্রকট যন্ত্রণা, এই জ্বর, এই শীত ভুলে থাকো… ভুলে থাকো… ভুলে থাকো..।” ভুলিয়ে রাখার জন্যই গায়ের সাথে লেপ্টে যাওয়া ভিজে শার্টটা প্রশ্ন করে,
– মানুষ, তোমার কি মনে আছে মশলার বাজার?
– মনে আছে.. খুব মনে আছে। মা ঈদবাজারের লিস্ট করে দিয়েছেন, বাবার সাথে কিশোরও বাজারে যায়। দু’চোখ ভরে দেখে থরে থরে সাজানো দারুচিনি, এলাচি, লবঙ্গ, গোল মরিচ, তেজ পাতা, শাহি জিরা, কাবাবচিনি, কাঠ বাদাম, পেস্তা বাদাম, জয়ত্রি, জায়ফল, আলু বোখরা, পোস্তদানা, জাফরান আরও কত যে মশলাপাতি।

ফোড়ন কেটে ওঠে বৃষ্টিবিন্দু,
– মশলার নাম শুনেই মন ভরে যায়। মানুষ, আমাকে মনে আছে! আমি তোমার ছেলেবেলার মেঘ, মেঘ হতে ঝরে যাওয়া বৃষ্টি। তোমার সাথে লেপ্টে আছি, তাই বাষ্প হয়ে মিলালেও ফের বৃষ্টি হয়ে ফিরে ফিরে আসি।
-ওহ! তাই না কি!
– হ্যা, তাই। এই দেখো আমার মনে আছে– ঈদের দু’তিন আগে মা তোমাকে কাঞ্চনপুরী নারকোল কিনতে পাঠাতেন, তোমার সে কি উত্তেজনা!
– শুধু কি নারকোল! অনেকটা পথ হেটে গিয়ে ঈদের আগে ক্যাপিটাল কনফেকশনারীর লাচ্ছা সেমাই আনতো কে! বাজারের পাইকারি দোকান থেকে ১নাম্বার ভাজা জর্দা সেমাই কিনতো কে! এরপর ছিলো মেহেদী পাতা কেনা। তিরু ঘোষ কাকার দোকান থেকে টকদই, হালিমের জন্য খাসির মাথা, মাংস আর হরেক রকম ডাল আনতো কে!
– তোমার দেখি সব মনে আছে! আহা, সেই সব ঈদ! ২৯রোজার দিন ইফতারের সময় থেকে তোমাদের সে কি উন্মাদনা, আকাশে খুঁজে বেড়াচ্ছো ঈদের এক ফালি চাঁদ। কে আগে দেখবে এ নিয়ে তুমুল প্রতিযোগিতা।
– হ্যা। আকাশ থেকে চোখ সরানো দায়, ঈদের প্রথম চাঁদ দেখে চাঁদকে সালাম করার ছেলেমানুষির সেইসব দিন…।

বৃষ্টিবিন্দুর কণ্ঠে স্মৃতিকাতর উচ্ছাস,
– চাঁদ উঠার সাথে সাথেই ঈদের শুরু।
– হ্যা। মা এক ফাঁকে মেহেদি বেটে দিতেন। ঈদ অথচ হাতে মেহেদি রং থাকবে না- এ অসম্ভব। ভাই-বোনরা মিলে মেহেদি দেওয়া হত। মেয়েরা হাতে নকশা করে মেহেদি দিতো, ছেলেরা ডান হাতের তালুতে গোল চাঁদ এঁকে আর কনে আঙুলের উপরের কড় রাঙাতো মেহেদিতে।
– হাহাহা, এই মেহেদি নিয়েও প্রতিযোগিতা- কার হাত বেশী লাল হয়।
লেপ্টে থাকা শার্টের কণ্ঠে বিস্ময়,
– এসব যেন বহু আগের রূপকথা!

বৃষ্টিবিন্দু বিরক্ত,
– রূপকথা হবে কেনো! এ যে আমাদের ছেলেবেলার ঈদ গো। চাঁদ উঠলেই পরপর তিনবার বেজে উঠতো সাইরেন। টিভি আর রেডিওতে বাজতো “ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ..।”

প্রবল যন্ত্রণা ভুলে থাকতে বলি,
– সাথে সাথে শুরু হত মা’র ব্যস্ততা। সবার আগে দুধে ভেজাতেন খুরমা, সকালে খুরমা খেয়ে সবাই ঈদের নামাজ আদায় করতে যাবে। এরপর সারা রাত রান্নার ব্যস্ততা। রাত ১২টায় রান্না হত জর্দা সেমাই।

ভেজা শার্টের কণ্ঠে কৌতূহল,
– তারপর!
– ওই রাতেই সেমাই পৌছে দিতে হত আশপাশের আত্মীয় স্বজন আর প্রতিবেশীদের। এরপর রান্নার সব আয়োজন করতে করতে ভোর হয়ে আসতো। ভোরে মা রান্না করতেন পানি খিচুরি, মিষ্টি কুমড়ো দিয়ে গরুর মাংসের ঝাল ঝাল ঝোলওয়ালা তরকারি। ত্রিশ দিন রোজা রাখার পর মুরুব্বীরা ঈদের দিন এ খাবারটা খুব মজা করে খেতেন। ঈদের জামাতের জন্য রওয়ানা করার আগেই রান্নাঘর থেকে ভেসে আসতো সাদা পোলাও আর মুরগির রেজালার ঘ্রাণ।
– এত্ত খাবার!
– এত্ত খাবার কোথায়! আত্মীয় প্রতিবেশীরা ঈদের দিন আসবে, কাউকে খালি মুখে যেতে দেওয়া হবে না- হয় চুটকি, জর্দা বা লাচ্ছা সেমাই খেতে হবে, নয়তো ফিরনি খেতে হবে। মিষ্টিতে রুচি না এলে অল্প করে হলেও খিচুরি বা পোলাও খেতে হবে। ঈদের দিন এসব খেয়ে খেয়ে যারা ক্লান্ত, তাদেরও ছাড় নেই। বড় আপা বানাতেন চটপটি, হালিম আর বোরহানি। প্রায় প্রতিটা বাড়িতেই সাধ্য আর সামর্থ্য মত বিভিন্ন পদ রান্না হত, ঈদের দিন কাউকে খালি মুখে বিদায় দিতে নেই যে।
– কিন্তু যারা বাড়িতে আসতে পারতো না!
– তাদের ঘরে বাটিতে বাটিতে করে পৌছে যেত পছন্দের খাবার, তাদের বাড়ি থেকেও আসতো এমন উপহার। তখন সবাই মোটামুটি জানতো প্রতিবেশী ও নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কে খাবারের কোন পদটা বেশী পছন্দ করে।

বৃষ্টিবিন্দু বলে,
– জানো ভেজাশার্ট, পুরান ঢাকার ঈদ ছিলো অন্যরকম। ভিন্ন ধর্মের প্রতিবেশীরাও যোগ দিত উৎসবে। তারাও আমন্ত্রিত হত, তাদের জন্য রান্না হত মুরগি বা খাশির মাংস আর সাদা পোলাও। তাদের বাড়িতে পৌছে যেত সেমাই।

জ্বর বা শীতে কাঁপতে কাঁপতে দেখতে পাই, সাড়ে তিন দশক আগের ঈদের সকালে জর্দা সেমাই ও ফিরনি নিয়ে এক কিশোর দাঁড়িয়ে আছে সুবীরদের দরজায়। মাসিমা দরজা খুলেই বললেন, “সেমাই দিয়া নাস্তা করুম বইল্যা বইসা আছি, বাবা। তুমি ভিত্রে আইস্যা বসো। চা খাইব্যা! একটু বানাইয়া দেই?” কিশোরের চা খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু বাড়ির ভেতর যায়না, সে জানে সুবীরদের খুব খারাপ সময় চলছে, চা খাওয়ার বিলাসিতা এখন তাদের নেই। টিফিন ক্যারিয়ার খালি করে দিলে কিশোর বলে, “মাসিমা, দুপুর আর রাতের খাবার রান্না করতে মা না করেছে। একটু পর ঈদের খাবার নিয়ে আসবো। আর, আগামীকাল, আপনাদের সবাইকে মা দাওয়াত দিয়েছেন, মা’ই আসতেন, কিন্তু ঘরের যে কাজের চাপ।” মাসিমা মুখে স্বস্তির হাসি এনে তাকান, চোখে বিষন্নতা মিশে থাকে। মেসো “সালাম করলে না, বাবা” বলে খুব সঙ্কোচে পকেটে খুব সামান্য খুচরো টাকা গুঁজে দেন- ঈদ সালামি।

অসহ্য ঘোর হতে যতই মুক্তি চায় মানুষ, তাকে ততই ঘিরে ধরে স্মৃতি। ঈদের সারাটা দিন মা চোখের পানি সামলে রাখেন, কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে মুখে একটা নির্জীব হাসি ধরে রাখেন। ঈদের ক্লান্তিময় বিকেল শেষে সময় যত রাতের দিকে ধায়, মা’র ক্লান্ত মুখে প্রসন্নতার আভা গাঢ় হতে থাকে। তিনি খুব যত্মে খাবার গরম করেন, সুন্দর করে সাজান, ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করেন একসাথে খাবেন বলে। পৃথিবীর সব বিভ্রান্তি কাটে না, কিন্তু বিভ্রম কেটে যায়। মা’র বিভ্রম কাটে, উনার চেহারা বিষাদে ম্লান থেকে ম্লানতর হয়ে আসে। এই সত্যে তিনিও স্থির হন, সন্তান আর কোনোদিন ফিরবে না। যে একেবারে যায়, সে ফিরেনা কখনো।

বাইরে ঈদের খুশি, রাতের মৃদু কোলাহল, শুধু মা’র ঘর থেকে ভেসে আসে হুহু কান্নার একটানা মৃদু আওয়াজ। বারান্দার বাতি নিভিয়ে বাবা ইজিচেয়ারে বসেন, সিগারেট ধরান, কোনো কথা বলেন না। অবছায়াতেও চশমার কাঁচের ভেতর স্পষ্ট দেখা যায় বাবার চোখ- অশ্রুতে টলমল, চোখের সীমানা গড়িয়ে নামতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। বাবাদের যে কাঁদতে নেই।

সবার বয়স বাড়ে, শুধু একজন আটকে থাকে চৌদ্দ বছর আয়ুর সীমায়, তার ফেরা নেই, তার মুছে যাওয়া নেই, না থেকেও সে রয়ে গেছে প্রবলভাবে।
রিকশা ছুটছে, বৃষ্টি কমে এসেছে। থিরথির করে শরীর কাঁপছে, ভেজা কাপড়ের জন্য ঠাণ্ডা লাগছে, চোখ ঘোলা হয়ে আসছে। চারদিক ঘোর ঘোর, হাওয়া এসে কানে কানে বলে,
– মানুষ, মনসুখিয়ায় গেলে তোমারও বয়স বাড়বে না।
– আমি কবে মনসুখিয়ায় যাবো, বলতে পারো হাওয়া?

হাওয়া কিছুই বলেনা, যার বিদায় সন্নিকট, তাকে বিদায় সম্ভাষণ জানানোর মত অনর্থক কাজ আর নেই।

বাংলায় রমজান ১

3117

বাংলাদেশে রমজানের ভিন্ন মাত্রার একটা সৌন্দর্য্য আছে, এটা শুধু বাংলাদেশেই কি না জানিনা। রমজান মাসে এই ছোট ছোট সুন্দর দৃশ্যগুলো দেখি আর ভাবি একটি ধর্মীয় আচার কিভাবে সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, সংস্কৃতির পরিচায়ক হয়ে ওঠে। পুরান ঢাকাসহ দেশের অনভিজাত মহল্লাগুলোতে রমজানের প্রথম রাতেই একটা সাধারণ দৃশ্য দেখা যায়, যে প্রতিবেশী কষ্টে আছে তার বাসায় স্বচ্ছল প্রতিবেশী কিছুটা বাজার পৌছে দিয়েছেন। বাজার পৌছানোর বিষয়টিও আবার শৈল্পিক আন্তরিকতায় পূর্ণ, প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সবচেয়ে ছোট বা বয়স্ক জনের নাম করে কর্তীকে বলা, “বাবা/মা এগুলো ওর/উনার জন্য পাঠিয়েছে, ভালো করে রান্না করে দিতে বলছেন।” এখানেই শেষ নয়, পুরো রমজান জুড়েই চলে এমনটা, ঘরে ভালো কিছু রান্না হলে খুব ছোট বাটিতে করে হলেও চলে যায় পাশের বাড়ির বয়স্ক সদস্যটি বা শিশুটির জন্য। ইফতার বিনিময়ও চলে, ইফতার চলে যায় প্রতিবেশী ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর বাড়িতেও।

রমজানের আরেকটা সৌন্দর্য্য আছে, যারা রোজা রাখেন না বা রাখতে সক্ষম নন এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও রোজদারদের সামনে কিছু খাওয়া বা পান করা থেকে বিরত থাকেন, এমন কি রেস্টুরেন্টের গেটে ঝোলানো থাকে পর্দা। এদিকে আমাদের দেশে একদল হাইব্রিড ধার্মিক আছে যারা রমজানে রেস্টুরেন্ট ও খাবারের দোকান বন্ধ রাখার জন্য আন্দোলন করেন। রেস্টুরেন্ট আর খাবারের দোকান খোলা থাকলে যাদের রোজা রাখতে সমস্যা হয়, তাদের সংযম আর ঈমানের গভীরতা সহজেই অনুভব করা যায়।

রমজানের আরও সৌন্দর্য্য হলো, যারা ধর্মে মনোযোগী নন, তারাও সাধ্যমত দান করেন। যারা সিয়াম পালন করেন তাদের সহায়তা করেন, সম্মান করেন।

ধর্মীয় আচার যখন একই সাথে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে, উৎসব হয়ে ওঠে তখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধিবিধানের কিছুটা ব্যতয় ঘটা স্বাভাবিক। বান্দার এসব অনিচ্ছাকৃত ভুলগুলোও আল্লাহ ক্ষমা করবেন নিশ্চয়ই, কারণ আল্লাহ চরিত্রগতভাবেই মহান ও ক্ষমাশীল।

দান বা সদকা আদায় করলে সত্যিই কি সম্পদ বাড়ে?

unnamed

আরবি ‘সদকাতুন’ শব্দের অর্থ দান। দান দুই প্রকার ওয়াজিব (যার উপর প্রযোজ্য তার জন্য অপরিহার্য) এবং নফল (ইচ্ছাধীন)। আল্লাহ এবং রসুল (সা.) দানের বিনিময়ে শুধু সওয়াব অর্জনের কথাই বলেন নাই, সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়ার নিশ্চয়তাও দিয়েছেন। সদকা আদায় অর্থাৎ দান করলে সম্পদ বৃদ্ধি পাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ, যাকে দান করা হচ্ছে সে ওই টাকাটা খরচ করছে অর্থাৎ টাকাটা রোলিং হচ্ছে, অলস টাকা হিসেবে আটকে থাকছে না। অলস টাকা না থাকায় সমগ্র অর্থনীতিতেই ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হবে এবং এর সুবিধাভোগী হবে সবাই। যৌক্তিক কারণেই যার সম্পদ বেশী তার সম্পদ বৃদ্ধি পাবে আর সুরক্ষিত থাকবে।

বিষয়টি পরিষ্কার করতে খুব সাধারণ একটা উদাহরণ দেই, ইসলামের রীতি অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে প্রতি বছর নির্ধারিত হারে জাকাত দেওয়া ও জমিনে উৎপন্ন শস্যাদির ওশর প্রদান করা ফরজ এবং সামর্থ্য থাকলে প্রতি বছর কোরবানি করা ওয়াজিব। চার বছর আগের হিসেবে বাংলাদেশে আদায়যোগ্য যাকাতের পরিমাণ নূণ্যতম ২৫ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ যাকাত কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে ২৫ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক রোলিং হচ্ছে, এই রোলিংয়ের ফলে গতি পাচ্ছে অর্থনীতি, সুবিধা বঞ্চিত ও দরিদ্ররা লাভবান হচ্ছে এবং এর সুবিধা পাচ্ছেন দাতাসহ সবাই। অন্যদিকে কোরবানির চামড়ার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের চামড়া শিল্প, আর দেশের দরিদ্র মানুষের আমিষের চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ মিটে কোরবানিকে কেন্দ্র করেই। অর্থাৎ দানে যে সম্পদ বৃদ্ধি পায় সে বিষয়টি এভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়, আর নিয়মতান্ত্রিকভাবে আচারগুলো পালন করলে আল্লাহ প্রদত্ত পুরস্কার তো আছেই।

পুনশ্চঃ আমরা চাইলেই আলেম, ইমাম, পাদ্রী, পুরোহিত, রাবি হতে পারবো না। এর জন্য বিষয়ভিত্তিক অধ্যায়ন ও চর্চা প্রয়োজন। কিন্তু ইচ্ছা করলেই মূল ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্ম বিষয়ক বইগুলো পাঠ করতে পারি, আজকাল বাংলায় অনুবাদের অভাব নেই। এর ফলে হবে কি, আমরা আলেম, ইমাম, পাদ্রী, পুরোহিত, রাবি হতে পারবো না ঠিকই, কিন্তু কেউ আমাদের ভুল পথে পরিচালনা করছে কি না তা বুঝতে পারবো এবং প্রশ্ন করতে পারবো।

যে ধর্মের প্রথম ঐশী বাণী “ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক” অর্থাৎ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।’ (এখানে পড়ো মানে শুধু পাঠ করা নয়, জ্ঞান অর্জন করাও বটে) এবং নবী করিম হযরত মোহম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘তালাবুল ইলমি ফারিদাতুন আলা কুল্লি মুসলিম’ অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ, (বায়হাকি : ১৬১৪), ওই ধর্মের অনুসারী হয়ে পাঠ বিমুখ থাকা কি উচিত- বিবেচনাটি আপনার।

প্রতিবেশী কি শুধুই মুসলিম ধর্মাবলম্বী?

Scre

বিভেদ নয়, ইসলাম সম্প্রীতি ধারণ করে। এই সম্প্রীতির চমৎকার প্রমাণ প্রতিবেশীর হক আদায়ের নির্দেশনা। ইসলামে প্রতিবেশী বলতে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলকে বুঝায়। উল্লেখ্য, মুসলিম ও আত্মীয় প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর হক আদায়ের পাশাপাশি মুসলমানের প্রতি মুসলমানের আর আত্মীয়ের প্রতি আত্মীয়ের হকও আদায় করতে হবে। কিন্তু প্রতিবেশীর হকে ভিন্নধর্মাবলম্বী এবং অবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রেও পালন করতে হবে।

‘ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় যে পেটপুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে।’ মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ২৬৯৯; আল আদাবুল মুফরাদ, হাদীস ১১২)। প্রতিবেশী যে ধর্মেরই হোক, সে কষ্টে থাকলে তুলনামূলক স্বচ্ছল প্রতিবেশীদের কষ্ট লাঘবের দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রতিবেশীর পরিধি কতটুকু এ বিষয়েও ধারণা দেওয়া হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের ডানে-বামে, সামনে-পেছনে চল্লিশটি বাড়ি পর্যন্ত প্রতিবেশীর আওতার অন্তর্ভুক্ত। (বোখারি: /২৯০১)

প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা অভাবে আছে তাদের সম্পর্কে আমাদের জানা থাকে। তবে এমনও অনেকে আছে যারা তাদের দুরবস্থা বাইরে প্রকাশ করেনা, সঙ্কোচে কারো কাছে সহায়তাও চায় না। পবিত্র কুরআনে এদেরকে ‘মাহরূম’ অর্থাৎ বঞ্চিত হিসেবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছে, “এবং তাদের সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও মাহরূমের (বঞ্চিতের) হক।” (সূরা যারিয়াত : ১৯) মাহরুম তথা বঞ্চিতদের কাছে এমন পন্থায় সহায়তা (যাকাত, দান) পৌঁছতে হবে যেনো তারা অপমানিত বোধ না করেন।

মসজিদে দান করুন, মাদ্রাসায় দান করুন কিন্তু এর আগে নিশ্চিত হোন প্রতিবেশীর হক আদায় করা হয়েছে কি না। সুরম্য মসজিদে দান করে এসির হাওয়ায় নামাজ আদায় করছেন, মাদ্রাসায় দান করেছেন আর ওই মাদ্রাসায় আপনার জন্য দোয়া হচ্ছে কিন্তু প্রতিবেশীর হক আদায় করা হয়নি- এটি সাধারণ বিবেচনাতেই নীতিগত অপরাধ, আর মুসলিম হিসেবে ধর্মের বিধিবিধানের অবমাননা। আমরা যেনো মনে রাখি কোরআন মজীদের একাধিক সুরায় সালাত আদায় না করার সাথে প্রতিবেশীর হক আদায় না করাকে যুক্ত করে শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে, আরও মনে রাখি যে, হযরত মুহম্মদ (সা:) বলেছেন, আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!!! সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, সে কে হে আল্লাহর রাসূল? রাসূ্লুল্লাহ (সা.) বললেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১৬)।

একই সাথে মনে রাখি প্রতিবেশীর হক আদায়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা অবিশ্বাসী প্রতিবেশীরাও সমানভাবে গণ্য হবেন। বাড়ির পাশের প্রথম বাড়িটি যদি হয় একজন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা নাস্তিকের আর সে যদি থাকে প্রচণ্ড ক্ষুধায় বা অভাবে তবে প্রতিবেশীর হক আদায়ের ক্ষেত্রে সেই অগ্রাধিকার পাবে।

ইসলামে সামাজিক সম্প্রীতিকে গভীর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, অথচ বর্তমানে সম্প্রীতির পরিবর্তে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। এক শ্রেণির আলেম (আল্লাহ তাদের হেদায়েত দান করুন) শুধু যে বিদ্বেষই ছড়ান তা নয়, তারা ওয়াজে বা আলোচনায় বসে নির্ধারণ করে দেন কে বেহশতে যাবে, কে দোজখে, কে মুমিন আর কে কাফের। ইসলামের মূল আদর্শের সাথে এদের যোজন যোজন দূরত্ব।

সামাজিক সম্প্রীতি বজায় থাক, রমজান থেকেই শুরু হোক সম্প্রীতি পালনের চর্চা।

নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যকে নিরাপদ রাখুন

15914

কোভিড পরীক্ষার দীর্ঘ লাইন। সামাজিক দূরত্ব নামক নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়ানোর চেষ্টায় লাইন আরও দীর্ঘ। গরমের কারণে অনেকেই অল্প সময়ের জন্য মাস্ক নাকের নিচে নামিয়ে শ্বাস নিচ্ছেন, আবার মাস্ক ঠিকমত পরছেন। এই আবহাওয়ায় লাইনে দাঁড়ানো বয়স্ক এবং শিশুদের কষ্ট অবর্ণনীয়। এরই মাঝে দুজন যুবক এসে লাইনের মধ্যে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছে। একজনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “করোনা হলে কি করতে হয়?” বাঙালি এসব ক্ষেত্রে সাহায্যে দ্বিধা করে না, তাদের জানালো হলো আগে পরীক্ষা করতে হবে, তারপর চিকিৎসা। পরীক্ষার জন্য কিভাবে রেজিষ্ট্রেশন করতে হবে সেটাও জানানো হলো। কিন্তু আরও দুই তিনজনকে তারা জিজ্ঞেস করলো, “করোনা হলে কি করতে হয়?” তারাও রেজিস্ট্রেশনের কথা বললো। এসব জবাবে সন্তুষ্ট না হয়ে ওই দুই যুবক লাইন ঠেলে কাউন্টারের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– করোনা হইলে কি করতে হইবো?
– আগে টেস্ট করাতে হবে।
– টেস্ট করছি, পজেটিভ আসছে।

কাউন্টার থেকে জানতে চাওয়া হলো,
– রোগী কই?

যুবকদের একজন উত্তর দিলো,
– আমরা দুইজনই রোগী। করোনা টেস্টে পজিটিভ আসছে।

কাউন্টার থেকে তিনজন চেঁচিয়ে উঠলেন,
– আপনাদের মাস্ক কই?
– দমবন্ধ লাগে, পরি নাই।
– আপনারা বাইরে ক্যান?
– বাড়িতে ভাল্লাগে না।

উপরের ঘটনা কল্পনা নয়, শতভাগ বাস্তব। সরকারিভাবে করোনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে সক্ষমতা থাকলে হয়তো তাদের ট্রেস করে সবাইকে পরীক্ষা করা হত। কিন্তু চিকিৎসকদের ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। করোনা পরীক্ষায় পজেটিভ এসেছে এমন লোক বাইরে ঘুরে বেড়ানোর ঘটনা বিরল নয়, আমাদের চারপাশেই আছে। আবার কে করোনা ভাইরাস বহন করছে আর কে করছেনা সেটাও পরীক্ষার আগে বোঝা সম্ভব নয়। তাই যারা লাইনে দাঁড়াচ্ছেন তারা কষ্ট হলেও নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই মাস্কটা খুলবেন না, আর যারা কোভিড পজেটিভ কিন্তু খুব অসুস্থ হননি তাদের ঘরের ভিতর থাকতে ভালো না লাগলেও ঘরে থাকুন। জনে জনে করোনা ভাইরাস দান করায় কোনো কৃতিত্ব নেই।

জনস্বার্থে- নিজে নিরাপদ থাকুন, অন্যকে নিরাপদ রাখুন।