বৈতরণী হক এর সকল পোস্ট

পরিবর্তনটা আসলেই দরকার

বিন্দু আর শোভনের পরিচয় হয় ঢাকায় একটা কনফারেন্সে। বিন্দু চাকরি করে একটি প্রাইভেট ব্যাংকে আর শোভন বহুজাতিক মোবাইল ফোন কোম্পানিতে। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব তারপর প্রেম অতঃপর বিয়ে। ওদের দুইজনের পরিবার থাকে ঢাকার বাইরে। ওরা দুইজন চাকরি করে, বেশ ভালো করেই দিন চলে যায় তাদের, ধানমন্ডি এলাকাতে দুই বেডরুমের বাসা ভাড়া করে থাকে ওরা।

এবার একটু ওদের পরিবারের কথায় আসা যাক। শোভনের মা-বাবা আর ছোট ভাই থাকে যশোরে, ওর বাবা কলিম সাহেব যশোরে একটি এনজিওতে একাউন্টসে চাকরি করতো আর অবসর নেয়ার পর এখন পূর্বপুরুষের জমি-জমা তদারকি করে। মা মাহবুবা খাতুন গৃহিণী। শোভন পড়ালেখায় ভালো হলেও তার ছোট ভাই সোহান কোনরকমে ডিগ্রী পাস করেছে ,এখন যশোর শহরে একটা সাইবার ক্যাফের দোকান দিয়ে বসেছে, জলি নামের একটা মেয়ের সাথে সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে। জলি এস এস সি পাস করেছে গত বছর তবে এইচ এস সি তে ভর্তি হতে পারেনি আর। এবার বলি বিন্দুর পরিবারের কথা। বিন্দুর বাবা খোরশেদ সাহেব লালমনিরহাট শহরে একটি সরকারি হাই স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক আর মা নার্গিস আরা একি শহরে একটি ছোট সেলাই স্কুলের কর্ণধার।

আর বিন্দুর ছোট ভাই বৃত্ত দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বৃত্ত এমন একজন ডাক্তার হতে চায় যার উদ্দেশ্য শুধু টাকা কামানো নয়, হত দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায় তার সেবার মাধ্যমে। বিন্দু আর শোভনদের পরিবারের মধ্যে শোভনদের অর্থনৈতিক অবস্হা ভালো কারণ তাদের জমি-জমা বেশ আছে গ্রামে আর শোভনের বাবা যশোর শহরে একটু একটু করে জমি-জমা করেছেন। অপরদিকে বিন্দুর বাবা খোরশেদ সাহেব আর মা নার্গিসের লালমনিরহাট শহরের এই পৈতৃক ভাবে পাওয়া পুরোনো দোতালা বাড়িটি ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই বললে চলে। বাড়িটির একতলায় ওরা থাকে আর দোতলা ভাড়া।

তবে এই দম্পতি একটু অন্যরকম। বছরে কিছু টাকা তারা কষ্ট করে হলেও জমাতেন, আগে যখন ছেলেমেয়েরা ছোট ছিলো তাদের নিয়ে যতটা সম্ভব কম খরচের মধ্যে বছরে একবার বেড়াতে যেতেন। বিন্দু আর বৃত্তের অনেক ছোটবেলাতেই কক্সবাজারে যাওয়া হয়ে গিয়েছে। রাংগামাটি, কুষ্টিয়ার লালন শাহের আখড়া, সিলেটের চা-বাগান সব দেখেছে তারা তবে তার জন্য মা-বাবার শর্ত পূরণ করতে হতো ওদের, পরীক্ষায় ভালো ফল করলেই তবে ওদের নিয়ে বেড়াতে যেতো। বলা যেতে পারে বৃত্ত আর বিন্দুর বছরের এই বেড়ানোর জন্য বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম তিন জনের মধ্যে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা থাকতো আর এখন বয়স হয়ে গিয়েছে বলে খোরশেদ আর নার্গিস তেমন ঘোরাঘুরি না করতে পারলেও এদিক-সেদিক সময় পেলেই যান ার তারা এমন করেন কারণ এতে তাদের শরীর-মন দুই প্রফুল্ল থাকে আর কাজের করার ক্ষেত্রে উদ্যম থাকে।

তিন বছরের বিবাহিত জীবনে শোভন আর বিন্দুর বোঝাপড়া বেশ ভালো হয়ে গিয়েছে। রোযার ঈদে ওরা যায় লালমনিরহাটে আর কুরবানি ঈদে যায় যশোরে। আর এর মধ্যে যদি টুকটাক ছুটি পায় সাধ্যের মধ্যে প্যাকেজ পেলে ঘুরে আসে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায়। বছরে যখন ওরা বাড়িতে যায় তখন ওরা সময়টাকে খুব সুন্দর করে কাটায় তাদের পরিবারের সাথে। লালমনিরহাটে গেলে ওরা গাড়ি ভাড়া করে উত্তরবংগের দর্শনীয় জায়গায় বেড়াতে যায় সবাই মিলে, খুব ভালো কাটে দিনগুলো। তবে যশোরে সেটা একবারেই আলাদা। অনেকবার শোভন আর বিন্দু চেয়েছে পরিবারের সবাই মিলে কোথাও বেড়াতে যেতে তবে কোনভাবেই তাতে সায় নেই কলিম আর মাহবুবার। এখন পর্যন্ত সোহান তার শ্বশুড় বাড়ি এক রাতের জন্য যায়নি বিয়ের আট মাস হলেও অথচ সেটা যে খুব দূর তাও না। শোভন আর বিন্দু যশোর শহরে রিক্সা নিয়ে ঘুরতে বের হলেও তাতে থাকে তাদের বিরক্তি। মাহবুবা তো মনেই করে যে সব হলো বিন্দুর বাড়াবাড়ি।

জলির জন্য খারাপ লাগে বিন্দুর। বাচ্চা মেয়ে সারাদিন সংসারের কাজ করার পর সন্ধ্যার সময় যখন একটু টিভি দেখতে বসে বা তার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে তখন কলিম সাহেব মাগরিবের নামায সেরে আসার পথে বাজার থেকে গুড়া মাছ আনেন বা অন্য বাজার আনেন বেশিরভাগ দিনেই আর হুকুম করেন রাতের খাবারে সে মাছ যেন টেবিলে থাকে। অগত্যা জলি বসে মাছ কুটতে আর মাহবুবা রান্না করেন কারণ কলিম সাহেবের মাহবুবার হাতের রান্না মাছ বা মাংশ ছাড়া মুখে উঠেনা। কলিম সাহেব তার স্ত্রী আর ছোট ছেলের বউয়ের জন্য হাজারোটা শক্ত নিয়ম দিয়ে রেখেছেন। বিন্দু শোভনকে বলে তার বাবার সাথে কথা বলতে যেন নিয়মগুলো একটু শিথিল করেন উনি বাড়ির মেয়েদের জন্য। শোভন দায়সারা বলে যেমন চলছে চলুক, দুই দিনের জন্য এসে নাক গলানোর মানে নেই কারণ সে জানে তার বাবা কোনভাবে বদল হবেনা।

তবে বিন্দুর মনে চলে অনেক ভাবনা। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে বাবা বিকেলে স্কুল থেকে আসলে মা সেলাই শিখাতেন মেয়েদেরকে; ছেলে-মেয়েকে বিকালের নাস্তা, স্ত্রীর জন্য চা বানিয়ে দেয়া, রাতের খাবার গরম করে টেবিলে দেয়া, ছুটির দিনে বাসা পরিষ্কার সহ আরো অনেক কাজে সাহায্য করতো বিন্দুর বাবা, মাঝে মাঝে বাবা মাকে নিয়ে সন্ধ্যায় হাটতে যেতো বা রিক্সায় ঘুরতে যেতো একটা অন্যরকম বন্ধুত্ব ছিলো মা-বাবার মধ্যে। অথচ তার শ্বশুড় এখনো তটস্হ করে রাখে তার শাশুড়ীকে, জীবনের এই প্রারম্ভে এসে গরমের মধ্যে বাতের ব্যথা নিয়ে চুলার পাড়ে দাঁড়িয়ে রান্না করতে হয় মাহবুবার, ভোর থেকে রাত পর্যন্ত জলির ফরমায়েশ খাটতে হয় শ্বশুড়-শাশুড়ীর, তিন মাসের গর্ভবতী মেয়েটার দিনে বিশ্রাম করার সুযোগ ও হয়না। যে কাজ ইচ্ছা করলেই বাড়ির কাজের মানুষ করতে পারে নিয়মের জন্য জলিকেই সেটা করতে হয়।আজ শিক্ষায় চাকরিতে স্বাবলম্বী বলে জলির মতো জীবন হয়নি বিন্দুর, বিন্দু ভাবে সোহানের কি একটু ইচ্ছা করেনা বউকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার, রিক্সায় বসে বাদাম খেতে খেতে খুনসুটি করার,কত ই বা বয়স সোহান-জলির। শুধুমাত্র নিয়মের জন্য বিয়ে হতে না হতেই বাচ্চা নিচ্ছে, তারা দুইজন দুইজনকে ঠিক ভাবে চিনতে পারলোনা পর্যন্ত।

একবার বিন্দু সাহস করে কলিম সাহেব আর মাহবুবাকে বলেই বসে যেন উনারা দুইজনে কক্সবাজারে ঘুরে আসেন। বিমান খরচ, হোটেল ভাড়া সব দিবে শোভন আর বিন্দু এমনকি সাথে করে নিয়ে যেতে চাইলো। তাতে আগুন হয়ে গেলেন কলিম সাহেব। বললেন টাকা তার আছে বেড়াতে যাওয়ার কিন্তু এইসব খাতে টাকা নষ্ট উনি করবেন না। বিন্দু ভেবেছিল উনারা গেলে পরে জলি আর সোহানের জন্য সুযোগ হবে বেড়াতে যাওয়ার কিন্তু তা আর হলো কই!

আচ্ছা ভাবুন তো এমন সব নিয়ম দিয়ে কি হবে যেখানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা এতো ফরমাল থাকে, বাজার-সংসার-রান্না এতো সব দায়িত্বের ভিড়ে কি দুইজন মানুষের নিজ ভুবনে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে মন চায়না? কেন মাহবুবা বিরক্ত হয় শোভন আর বিন্দু ঘুরতে গেলে কারণ কলিম সাহেব কখনো তাকে নিয়ে সামনের রাস্তায় ও হাত ধরে হাঁটেননি, জীবনের এই আনন্দ সে কখনো ভোগ করেনি, সংসার,নিয়ম, সন্তান প্রতিপালনে হারিয়ে গিয়েছে মাহবুবার যৌবন। আর তাই উনি ভাবে জলির জীবনটাই স্বাভাবিক, বিন্দুরটা আদিখ্যেতা। আচ্ছা কলিম সাহেব কি পেলেন জীবনে এতো নিয়ম দিয়ে, শোভন জীবনে ভালো করলেও সোহান তো পারলোনা আর এদিকে শোভনটা নিজের পরিবারের হেন নিয়মের জন্য দায়সারা থাকে, এড়িয়ে চলে নিজের পরিবারকে কারণ সে এই অপ্রয়োজনীয় শক্ত নিয়মের পক্ষপাতী না। অপরদিকে খোরশেদ সাহেবের দুই সন্তান সুশিক্ষায় শিক্ষিত, চিন্তায় প্রগতিশীল, মা-বাবার সাথে সুন্দর করে সময় কাটাতে ভালোবাসে।

পরিশেষে এই বলবো, নিয়ম ছাড়া জীবন চলে না তবে সেই নিয়মটা যেন এমন না হয় যা কাছের মানুষকে দূরে ঠেলে দেয়, নিয়মের বেড়াজালে আটকে যেন মানুষ মানুষরূপী যন্ত্র না হয়ে যায়। আবেগ অনুভূতি ছাড়া মানুষ নেই পৃথিবীতে। যেই মানুষগুলো সারাজীবন নিজেদের আবেগকে দমিয়ে রেখেছে, লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছে তারা অন্যের আবেগকে মূল্যায়ন করবে না এটাই স্বাভাবিক। আর তাই বিন্দুও বুঝে মাহবুবাকে। বিন্দু হাল ছাড়েনি। আজো চেষ্টায় আছে কলিম সাহেব আর মাহবুবার দৃষ্টিভংগি বদল করার কারণ বিন্দু চায় খোরশেদ আর নার্গিসের মতো তারা ও একটা সুন্দর দাম্পত্য জীবন পালন করুক কারণ তারাও তার মা-বাবা। তাদের জীবনের প্রভাব পড়বে জলি আর সোহানের উপর। কারণ আজকের জলি আর সোহান তো আগামীদিনের কলিম আর মাহবুবা। পরিবর্তনটা আজ না আসলে আর কখনোই আসবেনা।

সেই পদ্মা নদীর মাঝি

সেই পদ্মা নদীর মাঝি

খুব ছোটবেলায় স্কুলে যখন পড়ি তখন বিটিভিতে কোন এক শুক্রবার দেখিয়েছিল ”পদ্মা নদীর মাঝি” সিনেমাটি। আমার আম্মা আর বড়বোনের আগ্রহ দেখে তখন বুঝেছিলাম যে সিনেমাটি বিশেষ কিছু, তবে আমার যথেষ্ট রকম বিরক্ত লেগেছিল সেইসময় সিনেমাটি দেখে কারণ সেটা বোঝার মত বয়স আমার ছিলোনা। এরপর কেটে গেলো কয়েক বছর এইচ এস সিতে পড়ার সময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই কালজয়ী উপন্যাসটি ছিলো আমাদের পাঠ্যসূচির অন্তর্গত। আমাদের বাংলার শিক্ষিকা খালেদা আপা আমাদের উপন্যাসটি পড়াতেন আর আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। সত্যি বলতে কি তখনো পরিপক্ব ভাবে উপন্যাসটিকে বুঝিনি কেমন জানি কুবেরের উপর রাগ হতো আমার। যাহোক অসংখ্যবার উপন্যাসটি পড়েছি যাতে পরীক্ষায় প্রশ্নের যথার্থ উত্তর করতে পারি তাই। একটি লাইন ভাব সম্প্রসারণের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো বলে মনে পড়ে সেটি হলো “ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্রপল্লীতে…” ।

মানসিক পরিপক্বতা নিয়ে যখন সিনেমাটি দেখি আমার এক অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিলো। ছোটবেলা থেকে আমার বই পড়ার অভ্যাস তেমন নেই পাঠ্যসূচির বাইরে। তারপরো টুকটাক যা পড়েছি তার ভিত্তিতে যেসব সিনেমা বা নাটক দেখেছি এই সিনেমাটি সবথেকে ভালো লেগেছে আমার। ঠিক যেমন পড়েছি তেমন সব কোন অন্যথা নেই। তবে যেই কুবেরকে আমি মালার প্রতারক ভাবতাম এইচ এস সিতে পড়ার সময় তাকে পরে একটু অন্যভাবে চিনলাম। কপিলার মতে কুবের সেই হায় রে পুরুষ যার মধ্যে দায়িত্ব, কর্তব্য, পিতার মন, কামের আকাঙ্ক্ষা, হিংসা সব কাজ করে। এতো কণ্টকময় জীবনে তার মনের খোরাক কপিলা যাকে নিরবে ভাবতে সে ভালোবাসে, পেতে চায় তবে পারিবারিক-সামাজিক দায়বদ্ধতা তাকে আটকে ধরে। যত ব্যাপারটাকে খারাপ লাগুক না কেন এটাই স্বাভাবিক কারণ মালার হাঁটার ক্ষমতা নেই। কুবের তো একজন মানুষ, তার মনের তো কিছু চাহিদা আছে যা সে মালার মাঝে না পেয়ে কপিলার মাঝে খুঁজেছে। স্ত্রী হিসেবে মালাকে নিয়ে সে বেশ ভালো আছে একটার পর একটা সন্তান জন্ম দিয়েই যাচ্ছে তারা তারপরো কুবেরের মন অশান্ত। আপাতদৃষ্টিতে ভাবলে কুবেরকে ভালো মানুষ মনে না হওয়ার কথাই তো। তাই বইয়ের পাতা থেকে টেলিভিশনের পর্দায় না দেখলে কুবেরকে তার অন্তর্নিহিত কথাগুলো সেভাবে আমি অন্তত বুঝতাম না।

আর তাই অসংখ্য শ্রদ্ধা গৌতম ঘোষের জন্য। কি চমৎকার উপস্থাপনা, একেবারে অসাধারণ। মানিক বাবু যদি দেখে যেতে পারতেন তবে কত না খুশি হতেন সিনেমাটি দেখে। যৌথ প্রযোজনার ছবি নিয়ে যেখানে বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী বাছাই নিয়ে ঝড় চলছে এখন সেখানে এই সিনেমাটি একটি আদর্শ হতে পারে। বাংলাদেশের কত শিল্পী এতে অভিনয় করেছে আর অসম্ভব ভালো সবার অভিনয়। বাংলাদেশের শিল্পীরা আর্ট ফিল্মে অতটা পারদর্শী না অনেকে মনে করে তবে পদ্মা নদীর মাঝি দেখলে তেমনটা বলার আর কারো জো থাকবে না আমার বিশ্বাস। পরিশেষে এই বলবো সব মানুষের মন আছে আর সেই মনে চলে হাজারো কথা কখনো সেই কথাগুলো রয়ে যায় অব্যক্ত অনুভূতি হিসেবে। জীবন-সংসার সব কিছুর চাপে মানুষ ভুলে যেতে চায় তার নিজের কথা কারণ ভুলতেই হয়।

কুবেরের মতো অনেকের মনেই থাকে কপিলা তবে কয়জনের সুযোগ থাকে ময়নাদ্বীপে পালিয়ে যাওয়ার? মালা নিয়েই থাকতে হয়, বাবা হিসেবে গোপীকে ভালো পাত্রস্থ করায় চিন্তায় ব্যস্ত থাকতে হয়, সংসার নামক যন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হতে হয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার মুখোমুখি হতে হয়। আর এটাই উপন্যাসের সাথে মানুষের বাস্তব জীবনের তফাত। খেটে খাওয়া, পানিতে ভেজা, চরম দারিদ্র্য নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষ যুগে যুগে ছিলো আর আজো আছে। জীবনযুদ্ধে পরাজিত মানুষগুলো আদিখ্যেতা করে প্রভুকে ডাকার অবকাশ হয়তো পায়না কারণ পেটপূজা করার জন্য প্রাণপণে তাদের ছুটতে হয়। প্রেক্ষাপট বদলেছে তবে মানিক বাবুর সেই কালজয়ী উপন্যাসের পটভূমি আজো গ্রামবাংলার চিরাচরিত দৃশ্য। পদ্মানদীর মাঝিরা কখনো হারিয়ে যায় না। যতদিন পদ্মানদী াছে ততদিন সেই কুবেররা ও থাকবে সেই জেলেপাড়ার (হায়রে)পুরুষদের মাঝে।

_________
বৈতরণী হক।

বাংলাদেশে পার্লার শিল্পের প্রসার

ঢাকাতে সর্বপ্রথম পার্লার প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৬৫ সালে তবে সেটা কোন বাংগালি মালিকানাধীন পার্লার ছিলোনা। স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৭ সালে বাংগালি একজন মহিলা সর্বপ্রথম কাজ শুরু করেন বিউটিশিয়ান হিসেবে। উনার নাম জেরিনা আসগর। উনার প্রতিষ্ঠিত সেই পার্লারের নাম ছিলো লিভিং ডল। এরপর আশি থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত ঢাকা আর চট্টগ্রামের পার্লারগুলো পরিচালিত হতো বেশিরভাগ চাইনিজদের দ্বারা। চট্টগ্রামের লুসি এমন একটি পার্লার যা বহুদিন পর্যন্ত একচেটিয়া ব্যবসা করে গিয়েছে। চাইনিজ মালিকানাধীন এইসব পার্লার গুলো মধ্যবিত্ত শ্রেনীর নারীদের হাতের নাগালের মধ্যে ছিলো না কারণ তাদের ছিলো আকাশ ছোঁয়া সার্ভিস চার্জ।

মূলত এমন দামের কথা মাথায় রেখেই বাংগালি মালিকানাধীন পার্লারগুলোর পথ চলা শুরু হয়েছিলো নব্বইয়ের দশকে। উইমেন্স ওয়ার্ল্ড, গীতিস, ড্রিমস এমন বিখ্যাত কয়েকটি পার্লার যেগুলোর নাম মনে রাখার মতো। তারপর বলা যেতে পারে পারসনা, ফারজানা শাকিল এর কথা। সময়ের স্রোতে এখন বাংলাদেশে প্রায় কয়েক হাজারের উপর পার্লার আছে। শুধুমাত্র ঢাকা আর চট্টগ্রামে সীমাবদ্ধ নেই এই পার্লার ব্যবসা। সম্প্রতি একটি বিদেশি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে যেসব মহিলাদের মাসিক আয় ৫০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ টাকার মধ্যে তাদের মধ্যে প্রায় ৮৮.৩% রেগুলার পার্লার সেবা নিয়ে থাকে। তবে একথা সত্য গ্রামের মেয়েরাও এখন নিয়মিত পার্লারে যায়। গার্মেন্টস কর্মী থেকে শুরু করে বাসার গৃহকর্মী মোটামুটি সবার আনাগোনা থাকে সেখানে। উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তদের মতো দামি সেবা নিতে না পারলে ও ভ্রু প্লাক এর থ্রেডিংয়ের জন্য হলেও তারা যায়। বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গাতেই এখন পার্লার আছে নারীদের সৌন্দর্য রক্ষার জন্য। এক্ষেত্রে পুরুষরাও পিছিয়ে নেই, তাদের জন্য গড়ে উঠেছে বহু পার্লার।

যেসকল পার্লারগুলোতে সুযোগ সুবিধা বেশি থাকে সেগুলো মূলত উচ্চবিত্ত আর উচ্চ মধ্যবিত্ত নারীদের কথা মনে রেখেই গড়ে উঠছে। আর সেক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে নারী উদ্যোক্তারা। ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা মাথায় রেখে পার্লার ব্যবসায় পুঁজি বিনিয়োগ করছে নারীরা। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি, সরকারি চাকরি ছেড়ে নিজের মতো করে মুনাফা লাভের আশায় এই ব্যবসায় বহু নারীরা এগিয়ে আসছে। আবার অনেকে মূল কাজের পাশাপাশি বাড়তি ব্যবসা হিসেবে রেখেছে ব্যবসাটাকে। টুকটাক বেসিক কাজ যেমন প্লাক, থ্রেডিং, ট্রিমিং এর কাজ শিখে স্বল্প পুঁজি দিয়ে অনেকে মহিলা স্বল্প পরিসরের এই ব্যবসা পরিচালনা করে। তবে সেক্ষেত্রে তাদের গ্রাহকরা মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত নারীরাই।

দেশের অন্যান্য জায়গায় বিভিন্নতা না থাকলেও ঢাকা আর চট্টগ্রাম শহরে হেয়ার স্টাইল, মেকাপ বিভিন্ন বিষয় মাথা রেখে বিশেষায়িত পার্লার গড়ে উঠেছে আর এসবের সবকিছুই হচ্ছে নারীদের চাহিদাকে মাথায় রেখে। তবে একটা ব্যাপার লক্ষনীয় যে যে কোন বিশেষায়িত পার্লারে আপনি যান না কেন সেখানে উপজাতি মেয়েদের কাজ করতে দেখা যায়। আর সেক্ষেত্রে মান্দি বা গারো মেয়েদের অংশগ্রহণ সবথেকে বেশি। মারমা, চাকমা, মনিপুরি, তংচইংগা মেয়েরা পার্লার পেশায় থাকলেও সেটা স্হানীয় পর্যায়ে। তবে বৃহত্ পরিসরে কাজ করে গারো মেয়েরাই। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, টাংগাইল, নেত্রকোণা জেলাতেই গারোরা বেশি বাস করে। প্রতিবছর হাজার হাজার গারো মেয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে আড়ি জমায় পার্লারে কাজ করার জন্য।

মূলত কমিউনিটির মধ্যে সহযোগিতা সুলভ মনোভাবের জন্য তাদের এই বিস্তার। একজনের কাজ থেকে আরেক জন ব্যক্তিগত ভাবে কাজ শিখে নেয় তারা। কাজের ক্ষেত্রে ও একজন আরেকজন কে সাহায্য করে চাকরি পেতে। তা ই বলা যেতে পারে গারো মেয়েরা অনেকটা একচেটিয়া পার্লার গুলোর কর্মী হিসেবে। মূলধারার বাংগালি মেয়েরা আগে কম কাজ করলেও আজকাল তারা ও আসছে এই পেশাতে কারণ লাভজনক একটি সেক্টর এখন এটি।

বাংলাদেশ সরকারের একটি আইন অনুসারে পার্লারের মেয়েদের সর্বনিম্ম মজুরি ধরা হয়েছে মাসিক ৩৩০০ টাকা কমপক্ষে। এই মজুরি গার্মেন্টস কর্মীদের থেকে বেশি। বিভিন্ন পার্লার ঘুরে দেখা গিয়েছে যে মেয়েরা এর থেকে বেশি অর্থ উপার্জন করে। যে মেয়েরা ভালো কাজ করে তাদের কে মালিক পক্ষ বেশি মজুরি বা সুবিধা দিয়ে রাখে কারণ তাদের জন্য আছে গ্রাহকদের চাহিদা। আর বেশি মজুরিতে অন্য পার্লারে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় তারা মজুরি বেশি হাঁকানোর সুযোগ ও পেয়ে থাকে।

পার্লারের প্রতুলতা, আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রভাব, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি নিজেকে সুন্দর করে দেখার মাঝে মূলত পার্লার প্রসারের কারণ। এটি একটি লাভজনক খাত। আর বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গারো সম্প্রদায় এবং তাদের সাথে সংশ্লিষ্টরা অন্যান্যরা আর্থিক ভাবে লাভবান হচ্ছে যা তাদের জীবনযাত্রার মান বাড়াচ্ছে। তাদের ছেলেমেয়েরা তুলনামূলক ভালো জীবনের সাথে পরিচিত হচ্ছে, লেখা পড়া করছে যা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনেক ক্ষেত্রে হাইজিন মেইনটেন, ভালো প্রডাক্ট ব্যবহার না করায় গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। কর্মীদের আর মালিকদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয় অনেক সময়। সরকারের আরেকটু সুস্পষ্ট নীতিমালা, সুলভ সার্টিফিকেশন কোর্স, কারিগরি শিক্ষায় বিউটিফিকেশনকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে পার্লার ব্যবসা আরো অনেক দূর অগ্রসর হতে পারবে। গার্মেন্টস একটি খাত যা নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারকে সামনে রেখে। সেই নারী ভিত্তিক আরেকটি খাত এটি। সম্পূর্ণ দেশী পরিসর নিয়ে এই সেক্টর। এই সেক্টরের উন্নয়ন নিঃসন্দেহে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক অবদান রাখতে সক্ষম।

ওগো বিদেশিনী…


বৈতরণী হক, হ্যাম্পশায়ার, ইংল্যান্ড।

২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। আমার মেয়ে হয়নি তখনো। আমি আর আমার হাজবেন্ড ওয়াসি খুব বেড়াতাম তখন। ওয়াসির লম্বা ছুটি থাকায় আট-দশদিনের জন্য চলে গেলাম সুইজারল্যান্ডে। পর্যটন খ্যাত এলাকা ইন্টারলাকেনে কয়েক দিন কাটিয়ে যাত্রা করলাম জেনেভার পথে। জেনেভা যাচ্ছিলাম ট্রেনে। সুযোগ থাকায় ট্রেন বার্ণে আসার সঙ্গে সঙ্গেই হঠাৎ করে আমরা নেমে গেলাম সেখানে যদিও আমাদের প্ল্যানে বার্ণে নামার কথা ছিলোনা। যাহোক তখন ভর দুপুর, আমাদের খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিলো। এক রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। বুফেতে খাবার নেওয়ার সময় খেয়াল করলাম একজন বৃদ্ধ মহিলা আমাকে অনেক সময় ধরে বেশ দূর থেকে মনোযোগ দিয়ে দেখছেন। হঠাৎ উনি আমার কাছে এসে বললেন আমি বাংলাদেশি মেয়ে কিনা। আমি খুব অবাক হয়ে জানতে চাইলাম কি করে বুঝলেন আমি বাংলাদেশি মেয়ে। উনি হেসে বললো আমার চোখ দেখে উনি বুঝতে পেরেছেন। এই কথা শুনে আমি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ওখানে ভারতীয় মেয়েদের অভাব নেই বরং বাংলাদেশি খুব কম। সাদা সুইস বৃদ্ধার মুখে নির্দিষ্ট করে বাংলাদেশের নাম শুনে মনে দোলা লাগার তো কথাই।

কিন্তু পরে উনি আমাদের যা শোনালেন তা আমার মনে আজো নাড়া দিয়েই চলেছে। ৮৪ বছরের মহিলা (২০১৫ সালের কথা) পাশে বসে আমাদের সঙ্গে জীবনের কত কথাই না বললেন। মহিলার যখন ৬০ বছর তখন উনি তাঁর থেকে ২৫ বছরের ছোট এক সুইজারল্যান্ড প্রবাসী বাংলাদেশি ছেলেকে বিয়ে করেছিল। দীর্ঘ আট বছর সংসার করার পর উনার মনে হয়েছিল লোকটার জীবন এভাবে যেতে পারেনা তার সঙ্গে থেকে লোকটা সুখী হতে পারছেনা স্বাভাবিক ভাবে উনি বুঝতে পারছিলেন। তাই উনি স্বেচ্ছায় লোকটিকে ডিভোর্স করে দেন। ওই লোক পরে বাংলাদেশি এক মেয়েকে বিয়ে করেছেন, হয়েছেন দুই ছেলের বাবা। বৃদ্ধার তখন পর্যন্ত তার প্রাক্তন স্বামীর বাড়িতে যাতায়াত ছিলো আর উনি খুব খুশি যে তার স্বামী তার পরের স্ত্রী আর ছেলেদের নিয়ে সুখে আছেন। মজার কথা হলো সেই দুই ছেলে তাদের সৎ মাকে দাদী বলে ডাকে।

উনি যখন আমাদের সব বলছিলেন আমি উনার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। আমি ওই ভদ্রলোকের কথা জানিনা কেন উনি পঁচিশ বছরের বড় সুইস মহিলাকে বিয়ে করেছিল তা নিয়ে গবেষণা করতেও চাইনা শুধু বুঝতে পারলাম যে ৮৪ বছরের মহিলা লোকটাকে খুব ভালোবাসে। এত দিন পর এত বছর পর উনি যেভাবে স্মরণ করছিলো সব তাতে বুঝাই যায় তার ভালোবাসার গভীরতা কতখানি, বৃদ্ধার চোখে মনে হচ্ছে আলো জ্বলছে ওই লোকটার কথা বলতে বলতে। লোকটার প্রতি বিন্দুমাত্র অভিযোগ নাই, রীতিমত লোকের প্রশংসায় মুখর। কথা শুনে বোঝাই যাচ্ছিল অযথা লোকটাকে আঁকড়ে ধরে না রেখে মুক্ত করে দিয়েছিল লোকটার সুখের জন্য। মহিলা বাংলাদেশে কখনো আসেননি তবে তার সাবেক স্বামীর মুখে শুনেছেন বাংলাদেশের কথা। তা নিয়েও উনি অনেক গল্প বললেন। খুব ইচ্ছা করছিলো উনার সঙ্গে আরো কিছু সময় কাটানোর তবে ট্রেনের সময় হয়ে যাওয়াতে তা পারিনি। ভাগ্যিস সেদিন কোন কারণ ছাড়াই বার্ণে নেমেছিলাম তা না হলে এমন একটা অন্যরকম ভালোবাসার কথা জানতামই তো না!

নাটক সিনেমাতে আমি এইরকম কাহিনী দেখলে সবসময় ফ্রেন্ড আর কাজিনদের সঙ্গে মজা করে বলতাম সত্যিকার ভালোবাসা জাতি, ধর্ম, বয়স নির্বিশেষ- কথাগুলো বলতাম আর হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়তাম। কিন্তু এই বিদেশিনীকে না দেখলে বুঝতাম না যে ভালোবাসা আসলেই সবকিছুর উপরে আর ভালোবাসা প্রাপ্তি কখনো ত্যাগেও মিলে।

জানিনা সেই সুইস বৃদ্ধা বেঁচে আছে কিনা, বেঁচে থাকলে কেমন আছে। যেখানেই ভালো থাক হে বিদেশিনী- আমার মনে সবসময়ের জন্য এক সুন্দর স্মৃতি তুমি, তোমার জন্য আজীবন আমার মনে জমে থাকবে অকৃত্রিম শ্র্দ্ধা আর ভালোবাসা।

ছবি: শিল্পী কনক চাঁপার ফেইসবুক থেকে।

লোভ

(গি দ্য মোঁপাসা একজন ফরাসি সাহিত্যিক। খুব ছোটবেলায় তাঁর লেখা একটি ছোট গল্পের বংগানুবাদ পড়েছিলাম যা আমার মনে এখনো দাগ কেটে আছে। আমার আজকের গল্পটা সেই গল্পের ছায়া অবলম্বনে আমার মতো করে লিখার চেষ্টা করছি)।

কলি অপূর্ব সুন্দরী একজন মেয়ে, বয়স হবে ২০ কি ২১। কলির বাবা একজন স্বল্প বেতনের সরকারী কর্মচারী। কলি বুঝে আর জানে সে অপূর্ব সুন্দরী আর তার জন্য খুব অহংকার কাজ করে তার মধ্যে। সে কখনো মেনে নিতে পারেনা নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আর দৈন্যতা। বরাবর সে চেয়েছে বড়লোক পরিবারের মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে। কলির চাহিদা পূরণের জন্য তার মা-বাবাকে করতে হয় অনেক কষ্ট, কলি কোনদিন ও ছাড় দেয়না তার ছোট বোন মলির কথা চিন্তা করে। বড্ড জেদি আর স্বার্থপর মেয়ে কলি।

কলি লেখাপড়ায় বিশেষ মনোযোগী না আর তা হবেই বা কেনো। সে তো জানে সে মহা সুন্দরী, পাড়ার ছেলেরা তার জন্য সব পাগল ভালো বিয়ে ওর এমনিতেই হবে। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর ভালো কোথাও চান্স না পেয়ে সে তার বাবাকে চাপ দিতে লাগলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য। কলির গরীব বাবা উপায় না পেয়ে দেশের কিছু জমি বিক্রি করে আনলো মেয়ের প্রথম সেমিস্টারের টাকা দেয়ার জন্য আর চেষ্টা করছিলো আরো কিছু জমি বিক্রি করার পরের সেমিস্টারের টাকা দেয়ার।

এর প্রায় ৫ কি ৬ মাস পর কলিদের পরিবারে ঘটে গেলো এক বড় দুর্ঘটনা। কলির বাবা হঠাত্ করে মারা যান। কলির মা আফরোজা পড়ে যান বিশাল বিপাকে। কি করে চালাবেন তিনি সংসার, সরকারী বাসা ছেড়ে ভাড়া বাসায় দুই মেয়ে নিয়ে কেমন করে থাকবেন এই ঢাকা শহরে! আফরোজার ভাই আফতাব এসে তাদের নিয়ে গেলেন দেশের বাড়ি নরসিংদিতে। মলিকে ভর্তি করে দিলেন সেখানে স্কুলে। কিন্তু কলি তার কি হবে? যা হবার তাই কলির বাবা মফিজ মিয়ার পরিবার রাজি হলোনা আর কোন সম্পত্তি দিতে তাদের কথা আগেই তাদের ভাগের জমি বেচে টাকা নিয়ে গিয়েছে মফিজ। অগত্যা পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেলো কলির। আফতাব উঠে পড়ে লাগলেন কলির বিয়ে দেয়ার জন্য।
কলি খুব সুন্দরী বলে আফতাবের কষ্ট হলোনা ভালো পাত্র পেতে। ইশতি নামের এক ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হলো কলির। মাস্টার্স পাস ছেলে, একটা ভালো ওষুধ কোম্পানিতে রিপ্রেসএন্টেটিভের চাকরি করে। যে আয় তার কলিকে নিয়ে ঢাকা শহরে খেয়ে পরে ভালোই থাকবে। কলির এই বিয়েতে তেমন মত ছিলোনা। তার তো স্বপ্ন ছিলো অনেক বড়লোকের ব উ হবে, দামি কাপড় গয়না পরবে কিন্তু ইশতির সাথে বিয়ে হলে তো মামুলি জীবন কাটাতে হবে। কি আর করা উপায়ন্তর না দেখে ইশতিকেই বিয়ে করলো কলি।
ইশতি ভদ্র ছেলে, নম্র। কলিকে খুব ভালোবাসে। তবে কলির কাছে এই বিয়েটা একটা সমঝোতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ইশতি সামর্থ্যনুযায়ী কলিকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যায়, কাপড় কিনে দেয় তাতে কলির সন্তুষ্টি আসেনা। দুইজন মানুষের ঘরের কাজ তাও সে করে না পাছে তার রং কালো হয়ে যায়, হাতের আংগুলে কড়া পড়ে যায় পাছে চেহারাতে ক্লান্তির ছাপ আসে!

এমন করে চলে যাচ্ছিল তাদের দিনগুলি। এমন সময় ইশতি একদিন অফিস থেকে এসে বললো যে তাদের কোম্পানির মালিক সব স্টাফদের জন্য একটা বড় পার্টি দিবেন কোম্পানির অনেক লাভ হয়েছে বলে।
ব্যস শুরু হয়ে গেলো কলির চিন্তা। এতো বড় পার্টি আর এমন হোটেলে সে কোনদিন ও যায়নি। সে এতো সুন্দরী এটাই হবে সুযোগ সবার কাছে নিজেকে প্রকাশ করার। সে ইশতিকে বললো মার্কেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ইশতি নিয়ে যেতে চাইলো নিউমার্কেটে তাতে কি আর কলির মন ভরে।

অগত্যা সে গেলো তার এক বান্ধবীর বাসায় তার নাম ফারাহ, যে কয়দিন ভার্সিটিতে পড়েছিলো ফারাহর সাথে তার বন্ধুত্ব তৈরী হয়েছিলো। কলি ফারাহকে তার সমস্যার কথা খুলে বললো। ফারাহ আলমারি থেকে তার ভালো কিছু শাড়ি আর গয়না বের করে দিলো কলিকে।
ফারাহ: তোর যেটা ভালো লাগে তু দেখে নে।
এর মধ্যে ঝকমক করছে একটা গলার হার আর একজোড়া কানের সেট দেখে খুব লোভ হলো কলির। সেটটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে খুব দামী। সে হাতে নিয়ে দেখতে লাগলো আর এও খেয়াল করলো ফারাহ কেমন জানি ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে কলির সেটা নেয়া দেখে। কলি বেশ বুঝতে পারলো সবকিছুর সাথে এটাও বের হয়ে গিয়েছে অজান্তে তবে ফারাহ দিতে চাচ্ছেনা।
কলি বেশ লোভী সে ভাবলো নিবো যখন ভালোটাই নেই একদিনের জন্যই তো।
কলি: আমি কি এটা নিতে পারি, ঠিক দিয়ে যাবো ফেরত। তুই ভাবিস না একদম।
ফারাহ (একটু ইতস্তত করে): ঠিক আছে নে তবে আমার খুব শখের জিনিস রে। তোর ভাইয়া আমার ম্যারেজ ডেতে গিফট করেছে, সাবধানে পরিস।

কলি: তুই ভাবিস না এটার কোন ক্ষতি হবে না।
এরপর কলি চলে গেলো সব নিয়ে। অনুষ্ঠানের দিন পার্লার থেকে সেজে আসলো আর ফারাহর জিনিসগুলো পরলো। অপূর্ব লাগছিলো কলিকে, একেবারে নায়িকা। সেই পাঁচতারকা হোটেলে সবাই ঘুরে ঘুরে দেখছিলো কলিকে, সবাই তো অবাক ইশতির বউ এতো সুন্দর এ যেন গোবরে পদ্মফুল।
সব বড় বড় লোকরা কলির সাথে কথা বলতে চাইছিলো, কলি বোকা তাদের মনোবাসনা বুঝতে না পেরে তাদের সাথে খুব করে গল্প করছিলো। ইশতি সব বুঝতে পেরে রাতের ডিনার শেষ হওয়ার কিছু পরেই অসুস্হতার নাম করে কলিকে নিয়ে বাসায় আসলো। আর কলির কি রাগ তাতে।

বাসায় এসে কাপড় আর গয়না ছাড়তে ছাড়তে কলি গলায় হাত দিয়ে দেখে হারটি নেই। চিত্কার দিয়ে উঠলো। ইশতি পাগলের মতো ছুটে গেলো হয়তো ক্যাবেই পড়ে গিয়েছে। আবার ছুটে গেলো হোটেলে সে পেলোনা, ক্যাবের নাম্বার জানেনা, অন্ধকারে ড্রাইভারের চেহারাটাও মনে নেই। ভীষণ বিপদে পড়ে গেলো তারা।

তার একদিন পর ফারাহ ফোন দিয়ে বললো জিনিসগুলো ফেরত দিতে কারণ সামনে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান আছে লাগবে সব। কলি আর ইশতি উপায় না দেখে অনুষ্ঠানের কলির এক ছবি নিয়ে গেলো জুয়েলার্সের দোকানে। জুয়ালার্সের লোক বললো ছবি দেখে যে যে সোনা আর হীরা দিয়ে তৈরী এই হারের দাম পড়বে মজুরি সহ তিন লাখ টাকার মতো। ওদের তো মাথায় বাজ। তাও তারা রাজি হয়ে গেলো, এক সপ্তাহের মধ্যে বানিয়ে দিতে হবে তো। অনেক কষ্টে আড়াই লাখে রাজি হলো দোকানদার।
ইশতি অনেক সুদে তাড়াতাড়ি করে একটা লোনের জোগাড় করলো। তারপর গয়না আর বাকি সব জিনিস কলি ফেরত দিয়ে আসলো ফারাহকে। কিন্তু লোনের টাকা দেয়ার জন্য কলিকে করতে হলো অনেক ত্যাগ। খরচ কমানোর জন্য কাজের মানুষ ছাড়িয়ে দিলো নিজেই সব কাজ করে এখন, রেস্টুরেন্টে যাওয়া তো দূর বাসায় সপ্তাহে দুইদিন মাছ বা মাংস রান্না হয়, গত দুই ঈদে নিজে কোন কাপড় নিতে পারেনি এমনকি খরচ হবে বলে তারা বাড়ি পর্যন্ত যায়নি। এমন করে কেটে গেলো দুই বছর। লোনটা ও শেষ প্রায় আসলে সুদের জন্য এতো দেরি হচ্ছে।
ফারাহর সাথে ইচ্ছা করেই যোগাযোগ আর রাখেনি কলি ভয়ে পাছে ফারাহ কোনভাবে টের পায় আসল ঘটনা। এমন একদিন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো কলি। ফারাহ তাকে দেখে গাড়ি থামাতে বললো ড্রাইভারকে।
ফারাহ: আরে কলি কেমন আছিস? একি চেহারা তোর? কোন যোগাযোগ রাখিস না, ফোন করলে ধরিস না কি হয়েছে তোর?
কলি: নারে তেমন কিছুনা। তুই কেমন আছিস?
এমন টুকটাক কথার পর ফারাহ কলিকে জোর করে নিয়ে গেলো কফি শপে। তারপর জানি কি মনে করে কলি সব বললো ফারাহকে। ফারাহ শুনে তো অবাক।
ফারাহ: একি করেছিস তোরা। আমি বলেছি জিনিসটা দামি তবে এটা অনেক দামি ইমিটেশনের গয়না। তোর ভাইয়া বোম্বে থেকে এনেছে। এইসব জু্য়েলারি নায়িকারা পরে। এটা তো সোনাও না বা হীরা না। একবার কানের দুল দিয়ে চেক করে নিতে পারতি। আমাকে কেনো তুই সাহস করে বললিনা?
কলির মাথায় বাজ পড়লো। না জেনে, বুঝে সে নিজে কষ্ট করলো আর ইশতি ও কত কষ্ট করে তার ভুলের জন্য। রিক্সাতে না উঠে, বাসে না চড়ে হাঁটে, খাবারের কষ্ট করে, বাড়ি যায়না খরচের ভয়ে। কলি আজ বুঝতে পারলো তার এতো দিনের ভুল। তার লোভ, অতিরিক্ত মাত্রায় অপ্রয়োজনীয় উচ্চাংক্ষা তার এই পরিণতির জন্য দায়ী। বড় লোভী মানুষ সে, লোভের কারণে সে তার মা-বাবা, বোন, স্বামী সবাইকে কষ্ট দিয়েছে। এটা তার প্রাপ্য ছিলো।
এতোদিন পর সে অনুধাবণ করলো যে কথাটা আসলে মিথ্যা নয়- লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু।

অসহায় সেই মানুষগুলো

২০১৬ সাল। বাংলাদেশ থেকে আসছিলাম ইংল্যান্ডে কাতার এয়ার ওয়েজে, ঢাকা টু দোহা তারপর দোহা টু লন্ডন। ঢাকা থেকে দোহা পর্যন্ত পুরো ফ্লাইট ভরা মানুষ। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক হিসেবে যাচ্ছে আমাদের দেশ থেকে। তাদের কথোপকথনে বুঝলাম অনিশ্চিত জীবন জেনে ও জমিজমা শেষ সম্বল বেচে তারা টাকা কামাতে যাচ্ছে। একজনের বউয়ের আল্ট্রাসনোগ্রাম করতে ৮০০ টাকা লাগবে, সে প্লেনে বসে তার সহযাত্রীকে দুঃখ করে বলছিল কোথা থেকে তার বউ টাকা টা পাবে সে তো দিয়ে আসতে পারে নাই।

তারপর হামাদ এয়ারপোর্টে এক বাংলাদেশি ক্নিনার মেয়ের সাথে কথা হলো। কাজের অল্প বিরতিতে সে আমার সাথে অনেক কথা বললো। বাংলাদেশ থেকে এজেন্টের মাধ্যমে তারা ২ লাখ টাকা খরচ করে আসে আর মাসিক বেতন ১৪৫০ রিয়েল মানে বাংলাদেশি টাকায় ৩০০০০ টাকা। অন্যদিকে পুরুষরা আসে ৪ লাখ টাকা দিয়ে আর বেতন পায় ১২০০ রিয়েল। দুই বছর পরপর চুক্তি বাড়ার কথা যেখানে সিংহভাগ বাংলাদেশিদের চুক্তি বাড়েনা। আরো জানলাম নেপালি শ্রমিকরা সরকারের মাধ্যমে আসে, মেয়ে ছেলে উভয় শ্রমিক জনপ্রতি ১ লাখ টাকার বেশি দেয়না। তাদের বেতন আমাদের দেশের শ্রমিকদের মত হলেও তারা বাড়তি সুবিধা পায় আর তাদের কাজের মেয়াদ ও বাড়ে শুধুমাত্র তাদের দেশের সরকারি তত্পরতার জন্য।

নেপালের মত ছোট একটা দেশ নিজেদেরটা বুঝলে আমাদের দেশ কেন বুঝেনা! আমার ধারণা সব দেশের জন্য নিয়ম এক। বাংলাদেশিদের বেশি টাকা গুণতে হয় কারণ আমাদের দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আর এই ব্যাপারগুলো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো জানলে হয়তো তারা ঝামেলা এড়ানোর জন্য আমাদের দেশ থেকে শ্রমিক নেয়াই বন্ধ করে দিবে। সেবার খেয়াল করে দেখেছিলাম নেপালি, ফিলিপাইন, সাউথ ইন্ডিয়ান শ্রমিক অনেক সে তুলনায় বাংলাদেশি কম ছিলো এয়ারপোর্টে। জানিনা এখন অবস্হার ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে কিনা মাঝে তো গেলো দুইটি বছর।

খুব কষ্ট লেগেছিল মেয়েটির কথা শুনে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে মাসিক আয় করে ১২০০ থেকে ১৫০০ রিয়েল। সেখানে কোনরকমে খেয়ে পরে থাকতে একজনের মাসিক খরচ লাগে কমে ৩০০ রিয়েল। কতো কষ্ট করে তারা দেশে টাকা পাঠায়। হয়তো তাদের পরিবার সেটা অনুধাবণ করতে পারেনা, ভাবে কত ই না আয় করে। প্লেনে বসে সেদিন শুনছিলাম অনেকের কাছে কাজে যেতে না যেতেই পরিবার থেকে কতো আবদার আসছিল।

আসলে যারা মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে যায় তারা বড় বেশি অসহায়। কলুর বলদের মত খাটে পরিবারের মানুষগুলোকে আরাম দেয়ার জন্য। কিন্তু তাদের কষ্ট অনুধাবণ করার জন্য কেউ নেই, কেউ তাদের নূণ্যতম সম্মান ও দিতে চায়না। কে বুঝবে তাদের কষ্ট যেখানে দেশের সরকার তাদের চিন্তা করতে উদাসিনতা দেখায়।