জালাল উদ্দিন মুহম্মদ এর সকল পোস্ট

বাঁশের বাশি এবং

কী দুরন্তপনায়ই না কেটেছে আমাদের শৈশব! স্পষ্ট মনে আছে, একবার বাঁশের গুলতির বায়না ধরেছিলাম বাবার কাছে। বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কাটা হলো, বাঁশ থেকে খাপ বানানো হলো। তিন সূতার পাটের দড়ি পাঁকানো হলো। খাপের দুই পাশে দড়ি টানিয়ে ধনুক আকৃতির গুলতি তৈরি করা হলো। অতঃপর রঙ-বেরঙের মার্বেলের গুলিতে পাখি শিকার বেড়িয়ে পড়া ! আহা কি আনন্দ!

স্কুল থেকে বাসায় যাওয়ার পথে একটা রিকসা ফ্যাক্টরী ছিলো। স্কুল ছুটি হলে এর সামনে দাঁড়িয়ে রিকসা বানানো দেখতাম। সেই বাঁশ কেটে খাপ বানানো, দড়ি টানা দিয়ে বাঁকানো খাপে হুড বানানো, হুডের ঢাকনায় রঙ করা, ব্যাকপ্লেটে নীতিবাক্য লেখা ইত্যাদি। আমার খুব ভালো লাগতো।

তখন বর্ষাকাল। আমরা প্রায় প্রতিদিন ছাতা মাথায় পায়ে হেঁটে স্কুলে যাই। একবার আমার এক সহপাঠী এঁটেল মাটির রাস্তায় পা পিছলে আলুর দম। হাড় দু’টুকরা হয়ে গেলো। আমরা তাকে কোলে করে বাড়ি নিয়ে গেলাম। কবিরাজের ডাক পরলো। তিনি এসে গাছের শিকড় প্যাচিয়ে পায়ে শক্ত ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। কিছুদিন পর হাড় জোড়া লেগে গেলো। কিন্তু হায়! সে সোজা হয়ে হাঁটতে পারলো না। শহরে বড় ডাক্তারের কাছে নেয়া হলো। এক্সরে করা হলো। দেখা গেলো, জোড়া খাপে খাপ হয়নি, হাড়ের উপর হাড় পাশাপাশি জোড়া লেগে গিয়েছিলো। ব্যাপারটা অপারেশনে গড়িয়েছিলো। তারপরও কি এই পা সেই পা হয়!

আমাদের গ্রামে প্রতি শনি ও বুধবারে হাট বসতো। হাটবারে রাস্তার পাশে একটি কুঁজো ছেলে ভিক্ষে করতো। আমরা স্কুলে যাওয়া আসার সময় দেখতাম, সে সুর করে ভিক্ষা চাইতো। একদিন পাশের গ্রামে ফুটবল খেলতে গিয়ে দেখলাম, আসলে ছেলেটি কুঁজো নয়। কিন্তু সে এই ব্যবসা চালিয়ে গেলো। আমি মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে, কলেজ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। বহুদিন আর ছেলেটির সঙ্গে দেখা নেই। হঠাত একদিন দেখি সত্যি সত্যি সে কুঁজো হয়ে গেছে …

আজ প্রায় শেষ বয়সে উপনীত হয়েছি। চাকুরী থেকে অবসরের প্রস্তুতি নিচ্ছি। হাতে সময় জমা হলে বসে বসে অতীত রোমন্থন করি আর ভাবনার সমুদ্রে হাবুডুবু খাই – টেনে বেঁধে রাখলে কেমন করে বাঁশ বাঁকা হয়ে যায়, হাড় অসমানভাবে জোড়া লাগে, অভ্যাসে পিঠ কুঁজো হয়, এমনি আরো কত কি?

আমাদের শিশুরা বড়ই অনুকরণপ্রিয়। তাদেরকে আপনি যা শিখাবেন তাই শিখবে। শিখন অভ্যাসে পরিণত হবে একদিন। আর তারা যখন পুর্ণাংগ মানব/মানবী হয়ে উঠবে তখন আর অভ্যাস বদলানো যাবে না। তাই আমাদের এখনই ভাবতে হবে, আমাদের সন্তানদের আমরা কি শেখাবো; সত্যি না মিথ্যে? অভিনয় না বিনয়? নির্বিচারে বাঁশ ঢোকানো, বাঁশের কেল্লা বানানো, নাকি বাঁশ দিয়ে বাঁশি বানানো?

আমাদের ছেলে মেয়েরা কি শিখছে ? কি অভ্যাস করছে ? ভালো কিছু শিখলে/ অভ্যাস করলে, আলহামদুলিল্লাহ্। কিন্তু আল্লাহ না করুন, নেগেটিভ কোন অভ্যাস গড়ে উঠলে, সেটা পারমানেন্ট কুঁজে পরিণত হবে – এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।

ভুলেও_ভুল_করি_না

ভুলেও_ভুল_করি_না

স্থান, কাল, পাত্র বলে একটা কথা আছে। সবাই সব স্থানে সবসময় সবকিছু করতে পারে না। আমি এমনই বোকা যে, এই কথাটা বুঝতে আমার এক’শ বছর লাগলো !

আমার বউয়ের পক্ষের এক আত্মীয়ের কথা বলি। সম্পর্কে আমি তাঁর জামাই হলেও বেচারা উল্টো আমাকেই শ্বশুর বলে ডাকতেন। শত সুখের ভিড়েও তাঁর মনে দুঃখের সীমা ছিলো না। তাঁর কষ্টের কথা তাঁর মুখ থেকেই শুনুন ;

– শ্বশুর, বলদটারে নিয়ে বড় বিপদে আছি, বলেনতো কি করি?

আমি কিছুই বুঝতে না পেরে বললাম, কার কথা বলছেন মামা ?

তাঁর মুখের মানচিত্র কিছুটা উঁচুনিচু মালভূমির আকার ধারন করলো। বিষাদ না কান্না বুঝা গেলো না। মুখ দিয়ে কিছু অস্পষ্ট উচ্চারণ। আমি যা বুঝলাম, তার অর্থ এরকম – তাঁর ছোট ছেলে লালন সকালে বিকালে লাল, নীল, হলুদ আচরণ করছে। দিনে দু’চারটি নালিশ আসে। শুধু তাই নয়, লালন ব্যাক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কোন শৃঙ্খলাই মানছে না।

আমি বললাম, মামা কোন চিন্তা নেই, লালনকে লালন পালন করার জন্যে শীগগির একটা সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়ে দিন। আলু পটলের মতো সাইজ হয়ে যাবে।

তিনি দু’চোখ বের করে আমার দিকে তাকালেন। আমি ভস্মীভূত হয়ে গেলাম। আমি সাথে সাথেই আমার কথা উঠিয়ে নিয়ে বললাম, মামা আর একটা বুদ্ধি আছে, ওরে বিদেশে পাঠিয়ে দেন।

যেই কথা সেইকাজ। মাস দুইয়ের মধ্যে লালন চলে গেল লন্ডন ( ইংল্যান্ড )।
বছরখানেক পরের কথা। পুরান থানার সেই পুরোনো রেইন ট্রি গাছের নিচে মামার সাথে দেখা। ভয়ে ভয়ে মাথা নিচু করে মামাকে সালাম দিলাম। মামা হাসিমুখে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি কিছু বলার আগেই মুখ খুললেন – শ্বশুর, তুমিতো আচ্ছা দার্শনিক হে।

আমি ভাবলাম, আশ্চর্য! আমি দর্শন শাস্ত্রে মাস্টার্স করেছি, এটা মামা কি করে জানলেন? যাক, মামার সাথে কিছুক্ষণ কথা হলো। যা জানা গেলো তার সারমর্ম এই – লালন বিদেশে গিয়ে আমূল বদলে গেছে। সে নিজে রান্না করছে, নিজে ড্রাইভ করে অফিস করছে, ওভার টাইম করছে, শৃঙ্খলায় এওয়ার্ড পেয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

সেদিন রাতে বাসায় ফিরে আমার ঘুম আসে না। কেমন করে লালন নামের অসভ্যটা এমনটা সভ্য হলো? বিলেতিরা কি এমন মন্ত্র জানে ?

আমার এক বিলেতফেরত বন্ধু বলেছিলো, সেখানে নাকি রাস্তায়, মাঠে, ঘাটে, হোটেলে সব জায়গায় গোপন চোখ পাতা আছে। এমন জাল পাতা আছে, সে নিজের অজান্তে কোন অন্যায় করলেও ধরা পরবে। আবাক কান্ড – পুলিশ ঘুষ নেয় না। ঘরের দরজা খোলা, চুরি হয় না। গাড়িতে কিছু ফেলে আসলে অবলীলায় ফেরত আসে।

আমার কাছে কথাগুলো স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিলো। আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো – আমরা কেন আমাদের ছেলেমেয়েদের মডেল হতে পারছি না ? কিছু শেখাতে পারছি না ? নাকি আমাদের দেশের আলো, বাতাস, পানি দূষিত হয়ে গেছে ? এত সমস্ত ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।

ভাগ্যক্রমে ঘুমের মধ্যে লালনের সাথে দেখা হয়ে গেলো। বললাম – বলোতো লালন, কেন আমরা দেশের বাইরে গিয়ে দ্রুত বদলে যাই, দেশে পারি না ?
লালন বিজ্ঞের মতো হেসে যা উত্তর দিলো তার সারাংশ নিম্নরূপ –

• ওরা কাজকে সম্মান করে ও ভালোবাসে।
• কাউকে কোন উপদেশ দেয়ার আগে নিজে তা অনুশীলন করে।
• সবাই সবাইকে সহযোগিতা করে।
• ওখানে সময়োপযোগী আইন আছে এবং আইনের প্রয়োগ আছে । যিনি আইন / নিয়ম মানবেন না, তার কপালে দুঃখ আছে।

লালন বললো, তাইতো আমরাও কাজ করি, ভুলেও ভুল করি না।

রোদ, বৃষ্টি ও হাওয়ার গল্প

শীতল হাওয়া এসে দুপুরের তপ্ত রোদকে আলতো ছুঁয়ে দিলো। চুমো খেলো কপোলে ও চিবুকে। রোদের গায়ে জেগে উঠে শিহরণ। সবুজ ঘাসেরা চিকচিক করে হাসতে লাগলো। নদীর জলে ঝিলমিল তারা ফুটলো।

তারাভরা নদীর জলে রোদ হাওয়ার যৈবতী খেলা দেখতে আকাশের চাতক ভূমিতে নেমে এলো। মৎস কন্যারা রঙবাহারি শাড়ি পড়ে অভিনন্দন জানালো।

এদিকে জল বাষ্প ছড়িয়ে আকাশকে চিঠি লিখলো। আকাশ খুশিতে সাত রংগের শাড়ি মেলে ধরলো। রোদ হাওয়ার গায়ে জড়িয়ে ধরতেই তা রাঙধনু হলো।

রামধনু শাড়িতে হাওয়া লাজরাঙা হলো। আকাশ টের পেয়ে হাওয়াকে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে রাখলো।

হাওয়াকে হারিয়ে রোদ বেচারার খুব মন খারাপ হলো। সে মনের দুঃখে গান গাইতে লাগলো –
হাওয়া, হাওয়া দেখতে কি পাও?
কাছে এসে আমায় তুমি চুমু দিয়ে যাও।

রোদের ডাক শুনে হাওয়া দৌঁড়াতে লাগলো এবং মেঘের গায়ে আছড়ে পড়লো। মেঘ ভেসে ভেসে কাঁদতে শুরু করলো। আর মেঘের চোখের জলেই বৃষ্টির জন্ম হলো। দেখতে দেখতে বৃষ্টির বোন বর্ষা থৈ থৈ করতে লাগলো।

রোদ বেচারার কষ্টের সীমা নেই। তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যেতে লাগলো। কবে আসবে শরত বাবু? মেঘের কানে কানে বলবে, আর কেঁদো না লক্ষ্মী ছেলে, আবার তুমি হারিয়ে যাও নদীর জলে।

অবশেষে এক সোনালী ভোরে এলো শরত বাবু। রোদের মুখে হাসি ফুটলো। হাওয়া থেকে উড়ে এলো হাওয়া। রোদকে জড়িয়ে ধরে বললো, এইতো আমি এসেছি প্রিয়..।

চাকর ও আয়কর

আপনার বাড়িতে যে কাজ করে, সে আপনার চাকর। আর আমরা যারা সরকারী চাকরী করি তারা সরকারের চাকর। আর সরকার যেহেতু জনগনের টাকায় চলে, সেহেতু জোর গলায় বলা যায়, যারা সরকারের চাকর, পক্ষান্তরে বা সত্যিকারে তারাই জনগনের চাকর।

কানাকে কানা বলতে নেই। এই সূত্রে চাকরকে সেবক বললে তারা মনে মনে খুব সুখ পায়। মনটা গর্বে ফুলে উঠে। চেহারার রশনাই বেড়ে যায়। এ দেখে জনগন মিটি মিটি হাসতেই পারেন।

তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, চাকর সর্বদা চাকরই। তারা ছ-পোষা মানুষ। মাস আনে, মাস খায়। শেষ সপ্তায় অসহায়। এই অসহায় চাকরদের বেতনের বেশ একটা অংশ কেটে নেয়া হয় আয়কর বা ইনকাম ট্যাক্স এর নামে।

আমার ধারনা, ট্যাক্স দেবেন স্বচ্ছলগন। ট্যাক্স দেবেন যাদের আয় উপার্জন ভালো। মনের কো একটা প্রশ্ন বার বার উকি দেয়। প্রশ্নটি হলো দেশে এত স্বচ্ছল টাকার কুমির থাকতে চাকর কেন ট্যাক্স দেবে ?
চাকর মাস গেলে বেতন পাবে, বেতন পেয়ে ছা- পোষবে, রোগ বালাইয়ের চিকিতসা নেয়ার জন্য ঔষধ কিনবে। যৌবন শেষে পেনশন পাবে, পেনশনের টাকার টেনশন দূর করার জন্য কেউ মক্কা যাবে, কেউবা যাবে গয়া বা কাশি। চাকর ট্যাক্স দেবে কোত্থেকে ?

হ্যা দেবে, দিতে তাকে হবেই। বহুল প্রচলিত একটা গল্প মনে পড়ে গেলোঃ
মুনিব – ঈমান আলী, মার কেমন সইতে পারিস ?
চাকর – হুজুর, মোটেই পারি না।
মুনিব – ভেবে দেখ, যদি বেধে মারি ?
চাকর – হুজুর, তবেতো আপনার যত ইচ্ছা …

অস্ত্র

সুন্দরী নারীর সম্মোহনী শক্তির সাথে আমরা প্রায়শ পরিচিত। সুন্দরীর তুলনা শুধু আরেক সুন্দরী। তবে পরজনমে সুন্দরী হয়ে জন্মাতে ইচ্ছে করলে দোষের কি?

ভাবছেন, এ আবার কেমন কথা? কিন্তু সত্যি সত্যি একটু ভেবে দেখুনতো –
সুন্দরী নারীর কারণে কত রাজা হয়েছেন রাজ্যহারা!
কত যুবক জীবন উৎসর্গ করেছে উইপোকার মতো!

এসব তো পুরনো দিনের কথা, ইতিহাস।

আচ্ছা বলুন তো, গাছে তুলে মই কেড়ে নেয়ার সাধ্য কার?
কার হাসি দেখে ন্যাড়া বেলতলায় যায় বার বার ?
মুনি- ঋষির ধ্যান ভাংগে কে?

থাক, এসব কথা। এবার একটা গল্প বলি।
এক যে ছিলো সৎ অফিসার। নাম তার আলী নূর। আলী নূর ঘুষ খায় না, ঘাসও না। মাস যায়, মাছ খায় না। নিবেদিত মানুষ। কাজ অন্ত প্রাণ।

একদিন এক ঠিকাদার এসে বললো, স্যার, আপনি ঘুষ খান না, গুড। তবে কত খান না? হাজার? লাখ?
হাজার লাখ নূরের কাছে পাত্তাই পেল না।

অতঃপর শয়তান গেলো তার বউয়ের কাছে।
মেয়ে মানুষ শাড়ি পছন্দ করে না, গয়না পছন্দ করে না, তাই কি হয়?
বউ কাবু হলো। কিন্তু বউ নূরকে কাবু করতে পরলো না।

এবার এগিয়ে এলো ইবলিশ। সে ঘুষের বদলে পাঠালো এক সুন্দরী ষোড়শী। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো রূপ। তরমুজের ফলার মতো বাঁকানো ঠোঁট।আর সেই মায়াবী হাসি….

নূর নড়লো। নড়লো ফাইলও।

ফাঁদটা কার বা দোষটা কার? আলী নূরের? শয়তানের? রূপের? আবার, রূপ- সৌন্দর্যের কারিগরটাই বা কে? আর কেইবা বানায় বাঁকা ঠোঁটের অস্ত্র?