রীতা রায় মিঠু এর সকল পোস্ট

একা অবসরে কল্পনায় আমি বিশ্ব ভ্রমণ করি

ritt

একখানা পুরানো খাতার ছেঁড়া পাতা নজরে এলো। ভাঁজ খুলে দেখি ছেঁড়া কাগজে লেখা আছে, বাঁধা ধরা লেখাপড়ার প্রতি কোনকালেই আমার খুব বেশী আগ্রহ ছিল না। স্মৃতিশক্তি প্রখর হওয়ায় বাড়তি সুবিধা ছিল, স্কুলের পড়া একবার দু’বার পড়লেই মনে থাকতো। তাই স্কুলের পড়া নিয়ে কখনও টেনশান করিনি।

আমার ভালো লাগতো রূপকথার গল্প পড়তে। নতুন বছরে নতুন বই হাতে পাওয়া মাত্র ইংলিশ র‍্যাপিড রিডার বই থেকে সবগুলো গল্প পড়ে ফেলতাম। মায়ের ছিল গল্পের বই পড়ার প্রচন্ড নেশা। আমার মেজদাদা আর আমি, এই দু’ভাইবোন পেয়েছিলাম মায়ের চরিত্রের এই দিক। আমাদের ঘরে আসবাবপত্রের বাহুল্য ছিল না, যে ক’খানা কাঠের চেয়ার, তক্তপোশ, টেবিল ছিল, সেগুলোতে ছিল না কোনো নান্দনিক সৌন্দর্য্য, শোয়া-বসার প্রয়োজন মেটাতে যথেষ্ট ছিল। এইসব সস্তা দামের আসবাবপত্রের মাঝে একটি সস্তা কিন্তু খুবই মূল্যবান ছোট বুকসেলফ ছিল।

সেই ছোট বুকসেলফে অনেক বড়ো বড়ো গল্পের বই সাজানো থাকতো। বেশীর ভাগ বই ছিল স্বদেশী আন্দোলনের উপর লেখা। আমার মা আর মেজদাদা পড়তো সেইসব স্বদেশী আন্দোলনের বইগুলো। আমার মা কেন স্বদেশী আন্দোলনের বইগুলো পড়তে এত ভালোবাসতেন তা আমার জানা নেই। ইদানিং মনে হয়, মা সাধারণ পরিবারে জন্মালেও মন মানসিকতায় উনি গৃহী ছিলেন না। তাঁর মাঝে প্রবল দেশাত্মবোধ ছিল, চলনে-বলনে প্রতিবাদী ছিলেন, ব্যক্তিত্ব ছিল কঠিন। রান্নায় পারদর্শী হলেও গৃহকর্মে সুনিপুন ছিলেন না। উনার ভালো লাগতো গল্পের বইয়ের মাঝে ডুবে থাকতে। পেশায় শিক্ষক ছিলেন তাই বইখাতা নিয়েই উনার সময় কেটে যেত।
আমাদের সাথে রাজা রাণী, ভূত পেত্নীর গল্প করেননি। সব সময় ক্ষুদিরাম, মাস্টার দা, প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়া, বিনয়, বাঘা যতীন, বাদল, দীনেশ প্রমুখদের জীবনের গল্প করতেন, আমরা ভাইবোন মন্ত্রমুগ্ধের মত এঁদের গল্প শুনতাম।

আমার মেজদাদা বয়সে আমার চেয়ে তিন বছরের বড় হলেও সে ছোটবেলা থেকেই মায়ের সঞ্চিত বইগুলো অনায়াসে পড়তো। মা কিছুই বলতো না, আর আমি মায়ের মুখের গল্প শুনেই সন্তুষ্ট থাকতাম, অত মোটা বইগুলো পড়ে দেখার ইচ্ছে হতো না। ঐ যে বললাম, আমার ভালো লাগতো রূপকথার গল্প। ঠাকুরমার ঝুলি থেকে রাক্ষস ক্ষোকসের গল্প গোগ্রাসে গিলতাম। আমার সংগ্রহে একটামাত্র বিদেশী রূপকথার গল্পের বই ছিল, ‘সোভিয়েত দেশের নানাজাতির রূপকথা’।

আমাদের ছোটকাকা এই বইটি উপহার দিয়েছিলেন মেজদাকে। মেজদা বইটা দিয়েছে আমাকে। আমার উপর মায়ের কড়া শাসন ছিল, ঘরে থাকতে হবে, পাড়া বেড়ানো যাবে না। তাই ঘরে থেকে সোভিয়েত দেশের নানাজাতির রূপকথা বইটিই বার বার পড়তাম। রূপকথার গল্প পড়ে আমার একটা উপকার হয়েছে, আমি কল্পনা করতে শিখেছি।

যখনই একা থাকতাম, চলে যেতাম রূপকথার রাজ্যে। রূপকথার চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠতো। দিনে দুপুরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি, কোনো একদিন চলে যাব চাষীর ছেলে ইভানের বাড়িতে, নয়তো দেখে আসবো পগাতিক গরোশেককে। এভাবেই কল্পনায় বিদেশ যাওয়ার জন্য স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করি।

আজও সেই অভ্যাস রয়ে গেছে। একা অবসরে কল্পনায় আমি বিশ্ব ভ্রমণ করি।

rit

মিথীলার জন্মদিনে সকলের কাছে মিথীলার জন্য আশির্বাদ চাই

376t প্রতি বছর মিথীলার জন্মদিনে একই কথা আমি লিখি, মিথীলার জন্মের পর কেঁদেছিলাম। লিখি, কারণ এটাই আমার কৃত অপরাধের জন্য নিজেকে শাস্তি দেয়ার উপায়। ১৯৯৯ সালের ১০ই সেপ্টেম্বরের সকাল ৯টায় সিজারিয়ান অপারেশানের মাধ্যমে যখন আমার তৃতীয় কন্যার জন্ম হলো, আমি খুব কেঁদেছিলাম। কেঁদেছিলাম কারণ, প্রথম দুই কন্যার জন্মের পর “দুটি সন্তানই যথেষ্ট” ভেবে দুই সন্তান নিয়েই জীবন কাটাবো সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তারপরেও খাঁটি বাঙালি মায়ের মনে এক টুকরো আক্ষেপ ছিলো, দুটি কন্যা না হয়ে যদি আমার কন্যা এবং পুত্র দুইই থাকতো, তাহলে দুজন দুরকম মানুষ হতো।

কে আমায় বেশি ভালোবাসতো! পুত্র নাকি কন্যা? নিশ্চয়ই কন্যা তার বাবাকে বেশি ভালোবাসতো, পুত্র বেশি ভালোবাসতো তার মাকে। কিন্তু আমার তো দুটোই কন্যা, পুত্র সন্তান কেমন হয় ভেবে তো লাভ নেই! দুই কন্যা নিয়েই আমরা সুখী ছিলাম। ওরা একটু বড়ো হতে অস্ট্রেলিয়ার ইমিগ্রেশন ভিসা নিয়ে মেলবোর্ন চলে গেলাম। মেলবোর্নের আলো বাতাসে দুই কন্যাই লেখাপড়া নাচ গান আবৃত্তি অংকনে তুখোড় হয়ে উঠছিল। দুই কন্যার মেধার প্রকাশ দেখতে দেখতে কখন যে পুত্র সন্তানের জন্য আক্ষেপ মিটে গেলো টেরই পাইনি। এরপর অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট হাতে আমরা আবার দেশে ফিরে এলাম। দেশে ফিরেই আমি একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে যোগ দেই। অই স্কুলে ক্লাস ওয়ান- টু’র ক্লাস টিচার হিসেবে সারাক্ষণ বাচ্চাদের মাঝেই কেটে যেতো।

বাচ্চাদের মাঝে থাকতে থাকতেই দ্বিতীয় কন্যার জন্মের আট বছর পর তৃতীয় সন্তানের অপ্রত্যাশিত আগমন টের পেলাম। ভাবলাম, না চাইতেই যখন ঈশ্বর আরেকটি সন্তান আমার কাছে পাঠাচ্ছেন, নিশ্চয়ই পুত্রসন্তান হবে।
ঈশ্বর তো ভক্তের মনের কথা জানেন, আমি যে আগে খুব চাইতাম আমার একটা ছেলে একটা মেয়ে হলে ভালো হতো! তাই বোধ হয় ঈশ্বর এবার পুত্র সন্তান পাঠাচ্ছেন। এদিকে ভয়ও পাচ্ছিলাম ভেবে, প্রথম দুটি সিজারিয়ান অপারেশানের পর তৃতীয় বারেও নিশ্চয়ই সিজারিয়ান অপারেশান হবে! পর পর তিন বার সিজারিয়ান অপারেশন হলে আমিই যদি মরে যাই! মনকে বুঝ দিলাম, আমি তো দুই কন্যা নিয়েই সুখে ছিলাম, পুত্রের কথা ভুলেও গেছিলাম। তারপরেও ঈশ্বর যখন পাঠাচ্ছেন পুত্রকে, ঈশ্বরই রক্ষা করবেন।

প্রায় ভুলে যাওয়া পুত্র সন্তানের ইচ্ছে আবার আমার মনকে চাঙ্গা করে তুললো। আমি পুত্রের মুখ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে নয় মাস কাটিয়ে দিলাম। দুই কন্যার অফিশিয়াল নামের আদ্যক্ষর ঋ, আর পুত্রের বাপের নামের আদ্যক্ষর জ। আমি ঋ এবং জ দিয়ে পুত্রের নাম বের করতে ব্যস্ত, কন্যার নাম খুঁজিই নি। ডাক্তার হাফিজ যখন সিজারিয়ান অপারেশন করে তৃতীয় কন্যার আগমন ঘোষণা করলেন, আমি ভেবেছি ডাক্তার আমার সাথে মজা করছে। আমার শিয়রে দাঁড়ানো ডা: হাসি ভাবীর দিকে তাকালাম, ভাবী আমার হাতে একটু চাপ দিয়ে ইশারায় বললো, মেয়ে হয়েছে।

আমার মনে হলো, ঈশ্বর আমার সাথে ঠাট্টা করেছেন, অকারণে ঈশ্বর আমার সাথে চরম ফাঁকিবাজি করলেন! ঈশ্বরের প্রতি প্রচন্ড অভিমানে অপারেশান টেবিলেই আমার দুই চোখ ফেটে জল এলো। আমি একেবারে চুপ হয়ে গেলাম। হাসি ভাবী আমার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলে চলেছেন, মৌটুসির আম্মু, কাঁদছেন কেন? কী সুন্দর পুতুলের মতো বেবি হয়েছে। আমি তখন কারো সাথে কথা বলতে রাজী নই। সেই যে কান্না শুরু হলো, অঝোরে দুই চোখ দিয়ে জল গড়াতেই লাগলো। কেবিনে উপস্থিত- অনুপস্থিত আত্মীয় বান্ধব স্বজন সকলেই ধরে নিলো, ছেলে সন্তানের আশায় আমি তৃতীয়বার বাচ্চা নিয়েছি, তৃতীয় বারেও মেয়ে হওয়ায় আমি এভাবে কাঁদছি।

তাদের কারোরই জানার কথা নয়, আমি ঈশ্বরের সাথে অভিমান করে কাঁদছি। আমি তো খুশিই ছিলাম দুই কন্যা নিয়ে, পুত্র যদি ভাগ্যে নাই তবে কেন ঈশ্বর আমায় এত বছর পরে আরেকটা মেয়ে দিয়ে আত্মীয় বন্ধুদের কাছে হাসির পাত্র সাজিয়ে দিলো! আমার আত্মীয় স্বজনেরা অবশ্য মনে মনে যেটাই বলুক, আমার সামনে সকলেই ভালো কথা বলেছে। তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে, তৃতীয় কন্যার জন্ম বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার, আর কন্যা যদি হয় এমন চাঁদের মতো, তাহলে পাঁচ কন্যাতেও ক্ষতি নেই! বর্তমান যুগে মেয়েরাই ছেলের চেয়ে ভালো হয়, মেয়ে বিয়ে দিলে এখন জামাই ছেলে হয়ে যায়! কারো কোনো আশার বাণী, উচ্ছ্বাসের বাণীই আমার অভিমান ভাঙাতে পারেনি।

তৃতীয় দিনে আমার সমস্ত অভিমান ভেঙে সত্যিকারের বোধ জেগেছিলো মায়ের দুটো কথায়। মা বলেছিলো, “মিঠু তুই যে এভাবে কানতেছিস, তুই তো ঈশ্বরের দানকে অবজ্ঞা করছিস। ফুলের মতো শিশুটা নয় মাস তোর পেটে বড়ো হলো, এখন তারে দেখে তুই এমন মরাকান্না জুড়ে দিছিস, ঈশ্বর নাকি তোরে অপমান করেছে! এই ছোট্ট শিশুটা তো মান অপমান কিছুই বোঝে না। সে তোর কোলে এসেছে আর তুই কিনা মরা কান্না কেঁদে দুই দিন বয়সের শিশুটাকে অপমান করতেছিস। বেশী বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু ভগবান অসন্তুষ্ট হবেন। কান্না বন্ধ কর। তৃতীয় মেয়ে হইছে বলে কানতেছিস, দুই মেয়ে যখন কলেজ ইউনিভার্সিটি চলে যাইবো, এই তিন নাম্বার মেয়েই তোর মাঝবয়সে একলা সময়ের সাথী হবে।”

মায়ের কথায় আমি ঝাঁকুনি খেলাম। ছোট্টো শিশুটির নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে মরমে মরে যেতে ইচ্ছে করলো। বাড়ি ফিরলাম। দুই কন্যার ডাক নামের আদ্যক্ষর ম। আমার দাদু নাম পাঠালো মধুমিতা, মামাতো ভাই নাম দিলো মুর্ছনা, আরও কয়েকটি নাম। কোনো নামই আমার মনে ধরে না। বাবা তো জানতে পেরেছে তৃতীয়বার কন্যা সন্তান পেয়ে আমার পাগলামির কথা। আমাকে খুশি করার জন্য সবাই চেষ্টা করছে, আমার সিংহ পুরুষ বাবাও চেষ্টা করলো খুশি করতে। বললো, তোর মেয়ের নাম রাখ মিথীলা। ব্যস, মিথীলা নাম মনে ধরে গেলো আমার। এটাও ভাবলাম, আমার মায়ের কথায় যে বাচ্চার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছি, আমার বাবার দেয়া নামে ওকে ডাকবো।

এবার মিথীলার জন্য অফিশিয়াল নাম রাখতে হবে। আমি তো ছেলের নাম ঠিক করে রেখেছিলাম, ক্লিনিকে তো বাচ্চার নাম দিতে হবে। আমি তো তখন কেঁদেই আকুল, কন্যার বাবা চট করে কন্যার নাম দিয়েছে আয়ুষী। যখন আমি ধাতস্থ হয়েছি, আয়ুষী নাম বাতিল করে দিয়েছি। বড় দুই কন্যা ঋত্বিকা ঋজয়া, ছোটোটার নামও তো ঋ দিয়ে হতে হবে। ঝট করে মনে হলো, ঋষিজা। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, মা আত্মজা মানে যদি আমার কন্যা হয়, তাহলে ঋষিজা তো ঋষির কন্যা হবে।
মা বলল, হ্যাঁ। বললাম, আমি তো দজ্জাল মা হলেই কি, কন্যার বাবা তো সাক্ষাৎ ঋষি। তাহলে ওতো ঋষির কন্যাই হলো, ওর নাম হোক ঋষিজা। ঋষিজা রায় মিথীলা।

মিথীলা হয়ে গেলো ওর দুই দিদির খেলার পুতুল। মিথীলাকে আমি বড়ো করে তোলার সুযোগই পেলাম না। ওর দুই দিদি কলেজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মিথীলাকে নিজেদের মন মতো খাইয়ে সাজিয়ে বড়ো করেছে। এরপর দুই দিদিই যখন কলেজ ইউনিভার্সিটি চলে গেলো, আমাদের ফাঁকা বাড়িতে মিথীলাই হয়ে গেলো বুড়ো বাবা মায়ের জিয়নকাঠি। আমার মায়ের কথাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। বড় দুই কন্যা বাপ সোহাগি হলেও মিথীলা রয়ে গেলো মা সোহাগি হয়ে। মেয়ের হাতের সেবা যত্ন পাওয়ার জন্য আমাকে বুড়ো হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি।

মিথীলা যখন ক্লাস ফোরে পড়ে, তখন থেকেই ও আমাকে ঘরের কাজে হেল্প করে। মাঝরাতে চা বানিয়ে খাওয়ায়, কাজ থেকে মাথা ব্যথা নিয়ে ফিরলে মাথা টিপে দেয়। আমি বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত মিথীলা না খেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করে। রান্নাঘর পরিষ্কার করা, কাপড়চোপড় গোছানো, ঘর গোছানো, খাবার দাবার গরম করা– প্রতিটি বিরক্তিকর কাজ মিথীলা অসীম ধৈর্যের সাথে করে।

মিথীলার জন্মের সময় আমার বয়স পঁয়ত্রিশ। একটা ভয় ছিলো, পারবো তো মিথীলার পায়ের তলায় মাটি এনে দিতে! বেঁচে থাকবো তো ততোদিন! মিথীলা যখন স্কুল গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ করে এমোরি ইউনিভার্সিটিতে আন্ডারগ্রাড করতে যাবে, ওর বয়স ১৮ হয়নি। ওকে ডেকে বললাম, মা গো, তুমি আমার অধিক বয়সের সন্তান। তোমার দুই দিদি আমাকে যতদিন পেয়েছে, তুমি তার চেয়ে অনেক কম সময় আমাকে পাবে।

তুমি যখন লেখাপড়া শেষ করে চাকরি বাকরি করবে, বিয়ে করে সংসার করবে— আমি হয়তো ততদিন বেঁচে থাকবো না। ভালো কিছু দেখলে, ভালো কিছু পেলে তুমি হয়তো মনে মনে আফসোস করবে, মা থাকলে মাকেও দেখাতাম। হয়তো ভাববে, মায়ের খুব শখ ছিলো অনেক আরাম বিলাসে থাকার। মা থাকলে মাকে অনেক আরাম দিতে পারতাম। যখনই তোমার আফসোস হবে, তুমি আমার আজকের কথা স্মরণ করো। তুমি অলরেডি আমাকে সারাজীবনের সুখ দিয়েছো মিথীলা। যখন সুখ তোমার কাছে আসবে, তুমি সুখটা উপভোগ করবে। তোমার দেহটা তো আমার দেহ থেকেই তৈরি হয়েছে, তাই তুমি সুখি হলেই আমার সুখ।

এখন মিথীলা ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি শেষ করে চাকরির জগতে ঢুকে গেছে। ওর দুই দিদি কবেই পড়াশুনা শেষ করে যার যার প্রফেশন নিয়ে ব্যস্ত। এত ব্যস্ততার মধ্যেও ওরা মিথীলার জন্য মন প্রাণ উজাড় করে দেয়। আর মিথীলা? সত্যিই মিথীলা ঈশ্বরের পাঠানো এক পরম উপহার। মিথীলা সত্যিই আমার একলা সময়ের অনেক বড়ো অবলম্বন। আমি আজও নিজের কাছেই নিজে লজ্জিত হই আমার তৃতীয় কন্যার আগমনে কেঁদেছিলাম বলে। আজও নিজের কাছেই নিজে দুঃখ প্রকাশ করি সেদিনের কৃতকার্যের জন্য।

মিথীলা চাকরি শুরু করার পর আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। মিথীলা ওর বেতন থেকে আমাকে হাতখরচ বাবদ টাকা দেয়। কয়েক মাসের টাকা একসাথে একটা খামের ভেতর ভরে এতো ভদ্রভাবে বিনয়ের সাথে খামটা আমার হাতে দেয়, আমার চোখে জল চলে আসে। এটাও বলে, মা এই খাম থেকে টাকা নিয়ে তুমি খরচ করবে। তোমার তো ওয়ালমার্টে গেলেই শুধু গাছ কিনতে ইচ্ছে করে, বাসনকোসন কিনতে ইচ্ছে করে, তুমি কিনবে।
টাকা ফুরিয়ে গেলে আমাকে বলবে, টাকা জমিয়ে রাখবে না।

গত মাসে ওয়াশিংটন ডিসি বেড়াতে গেলাম মিশার কাছে, মিথীলা আমাকে নিয়ে কত জায়গা বেড়ালো। সাজগোজের দোকান সেফোরাতে গেছিলো নিজের জন্য পারফিউম কিনতে। কয়েক বছর আগে সেফোরা থেকে আমার মামাতো বোন টুম্পা অনেক দাম দিয়ে আমাকে একটা লিপস্টিক কিনে দিয়েছিলো। তখন মিথীলা স্কুলে পড়ে, লিপস্টিকটা আমার এতো প্রিয় ছিলো, কিন্তু কোথায় যে হারিয়ে গেছে!

এরপর থেকে আমি ওয়ালমার্ট থেকেই লিপস্টিক কিনি রেগুলার ব্র্যান্ডের। সেদিন সেফোরাতে গিয়ে মিথীলার মনে পড়েছে লিপস্টিকটার কথা। আমাকে তখনই সেই একই রঙের লিপস্টিক কিনে দিলো, কনসেলার কিনে দিলো। আমার কেবলই মনে পড়ছিলো মায়ের কথাগুলো। সেদিন আমার কান্না থামাতে মা তিরস্কার করে যে কথাগুলো বলেছিলো, মায়ের সেদিনের তিরস্কারের কথাগুলোই আমার জন্য আশির্বাদ হয়ে গেছে!

মিথীলা করোনার সময়টাতে এনভায়রনমেন্টাল হেলথ এবং কেমিস্ট্রি, দুই সাবজেক্টে অনার্স কমপ্লিট করেছে এবং গত বছর এনভায়রনমেন্টাল হেলথে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছে। পাঁচ বছরের পড়া সোয়া চার বছরে কমপ্লিট।
মিথীলাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম পিএইচডি করতে চায় কিনা! মিথীলা দুই হাত জোড় করে, ‘ না, মা আর পড়তে পারবো না” বলে দিয়েছে! তাতে আমি একটু আশাহত হয়েছি।

আমি চেয়েছিলাম আমাদের মেয়েরা ওদের বাবার মতো পড়ুয়া হোক, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিন কন্যাই তাদের মায়ের মতো লেখাপড়া বিমুখ হয়েছে, কী আর করা! গত বছর চাকরি খোঁজার আগে আমি বলেছি, মিথ তোমার পড়া শেষ, কিছুদিন বাবা মায়ের সাথে সময় কাটাও। চাকরিতে ঢুকে গেলে সারাজীবন ক্যালেন্ডারের পাতা আর ঘড়ির কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। বাবা মায়ের সাথে নিরলস সময় কাটানোর সুযোগ পাবে না! পাপা ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে দুই মাসের জন্য ভারত যাচ্ছে, আমিও যাচ্ছি।
তুমিও চলো, আমরা ভারত ঘুরে আসি।

তীর্থ ক্ষেত্রে যাবো, গঙ্গায় ডুব দিয়ে মনের যত কালি, গ্লানি সব বিসর্জন দিয়ে আসবো। তুমি ইয়াং জেনারেশনের প্রতিনিধি, বুড়ো বাবা মায়ের সাথে থাকলে অজানা অচেনা জায়গায় আমরা মনে বল পাবো। তাছাড়া তুই সবার আদরে আহ্লাদে বড়ো হয়েছিস বলে জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে চোখের সামনে দেখিসনি। আমাদের সাথে তুইও ভারতে চল, এরপর বাংলাদেশেও নিয়ে যাবো।

জীবন কি, জীবনের পথ কেমন, জীবনের পথ চলতে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা কত ঠোক্কর খায়, সব নিজের চোখে দেখে আসবি। অভিজ্ঞতা হওয়া দরকার। মিথীলা মহানন্দে রাজী হয়েছে। গত বছর এই সময়ে আমরা ভারতের উত্তরাখণ্ডের রাজধানী দেরাদুন পৌঁছেছি। দেরাদুন থেকে তীর্থক্ষেত্র হরিদ্বার, ঋষিকেশ ঘুরেছি, দিল্লী আগ্রা জয়পুর আজমের ঘুরেছি, কলকাতার দুর্গাপূজা দেখেছি, আপনজনদের সাথে দেখা করেছি। মিথীলা দারুণ এনজয় করেছে। লাক্সারি বাসেও যেমন চড়েছে, ভীড়ের ট্রেন, টেম্পো গাড়ি, ভ্যান রিক্সাও চড়েছে।

376 গত বছর মিথীলার জন্মদিনে আমরা দেরাদুন ছিলাম। এই বছর মিথীলা আছে ওয়াশিংটন ডিসিতে মিশার কাছে। মিশা দুই দিন আগে থেকেই মিথীলাকে প্রতিদিন ট্রিট দিচ্ছে। মৌটুসি ডালাস থেকে ট্রিট পাঠাচ্ছে। মিথীলা ভোজন রসিক। নানা স্বাদের খাবার পেলে মিথীলা খুশি হয়। ওর দুই দিদি সেভাবেই ওকে ট্রিট দেয়।

আমি যখন লেখাটি শেষ করে এনেছি, দেখি ঘড়িতে রাত এগারো, অর্থাৎ ভার্জিনিয়ায় রাত ১২টা। লেখা থামিয়ে মিথীলাকে ফোন করলাম। এক রিং হতেই মিথীলা কল রিসিভ করেছে। আমি সেই চিরাচরিত প্রথায় গান গেয়ে মিথীলাকে হ্যাপি বার্থডে বললাম। মিথীলা বললো, মা এবার তো তোমার গান দ্য বেস্ট হয়েছে। আমি তো রেকর্ড করতে পারিনি! দ্য বেস্ট হওয়ার কারণটা বলে দেই: মিথীলাকে একেক জন একেক নামে ডাকে। আমি প্রতিটা নাম মেনশন করে গানে গানে উইশ করেছি। এতো অল্পেই মিথীলা এতো বেশি খুশি হয়।

প্রতি বছর জন্মদিনে একই কথা আমি লিখি, অই যে মিথীলার জন্মের পর কেঁদেছিলাম। লিখি, কারণ এটাই আমার কৃত অপরাধের জন্য নিজেকে শাস্তি দেয়ার উপায়। আমার একটাই চাওয়া, জীবনে যদি ভালো কিছু করে থাকি, তার পুরস্কার হিসেবে ঈশ্বর যেনো আমাদের তিন কন্যাকে সুস্থদেহে দীর্ঘজীবী করেন। মিথীলার জন্মদিনে সকলের কাছে মিথীলার জন্য আশির্বাদ চাই।

ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার

rty আমি ততদিনে ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের কাজ ভালোবাসতে শুরু করেছি এবং বহাল তবিয়তে কাজ করছি। ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে আমাদের কাজ হচ্ছে ফোন সার্ভিস নিতে আগ্রহী গ্রাহকদের সহযোগিতা করা। এবং আমি তা অতি আনন্দের সাথে করার চেষ্টা করি। এই কাজ করতে করতে অল্প অসুন্দরের পাশাপাশি অনেক সুন্দর সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়।

অসুন্দর কিছুই আমি মনে রাখি না।
আর সুন্দর যা কিছু দেখি সবই চিন্তা চেতনা স্মৃতিতে জমা রাখি।

আমেরিকায় এসে তো এমনিতেই চারপাশ সুন্দর দেখি। আর ওয়ালমার্টে চাকরি করতে করতে সুন্দর সুন্দর মানুষজনও দেখি, মানুষজনের কাজকর্ম দেখে সুন্দর সুন্দর অভিজ্ঞতাও হয়। আমেরিকার ইয়াং জেনারেশান হচ্ছে হুজুগে টাইপ। ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে খুব কম আমেরিকান, তারা চিন্তা করে জীবনের বর্তমান মুহূর্ত নিয়ে। আমাদের দেশে ভিটে মাটি বিক্রি করে হলেও বাবা মা চায় সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। আর আমেরিকায় ইয়াং জেনারেশান ঘটি বাটি বিক্রি করে হলেও লেটেস্ট মডেলের গাড়ি, জুতো আর লেটেস্ট মডেলের ফোন কিনবে! এই জিনিসগুলোর প্রতি এদের কী যে নেশা!
★***********************★

আজ আমাদের কাছে ফোন সার্ভিস নিতে এসেছে অনেকেই। তাদের মধ্যে দুটো ভিন্ন অভিজ্ঞতা হলো। যাদের দেখা পেলাম, তাদের সাথে গল্প করে মনটা ভালো লাগায় ভরে গেছে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরেও ভালো লাগার রেশটা ছিলো।

এক হোয়াইট আমেরিকান ভদ্রমহিলা, বয়স আনুমানিক ৫৩ বা ৫৪ বছর হতে পারে, এসেছিলো ফোনের নেটওয়ার্কের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে। যদিও এটা বিভিন্ন ফোন কোম্পানির টাওয়ারের সমস্যা, তবুও আমাদের গ্রাহক আমাদের লক্ষ্মী তাই ফোন কোম্পানির হয়ে আমিই এই কথাগুলো ভদ্রমহিলাকে বুঝিয়ে বললাম। ভদ্রমহিলা ফোনের নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণ জানার পর এটা নিয়ে আর কথা বললেন না, চলেও গেলেন না। ভাবলাম, আরও কিছু জানতে চায়। ভদ্রমহিলার কাছে জানতে চাইলাম, আর কিছু জানতে চায় কিনা।

না, তিনি আর কিছু জানতে চায় না। শুধু বললো যে, আমার ইংলিশ উচ্চারণ নাকি তার কাছে খুব ভালো লেগেছে। পরবর্তী প্রশ্ন ছিলো আমি কোন্ দেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনেই ভদ্রমহিলা, ‘এমিলি এমিলি শীগগীর আসো’ বলে ডাকতেই যে এসে হাজির হলো আমাদের সামনে, অপূর্ব সুন্দরী ২৪-২৫ বছর বয়সী এক তরুণী। একেবারে আমাদের দেশের মেয়েদের মতো অভিব্যক্তি চেহারায়। মুখে সলজ্জ হাসি, কী অমায়িক ভাব চেহারাতে! ভদ্রমহিলা যখন জানলেন যে, আমি বাংলায় কথা কই, খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, এমিলিও বাংলা বলতে পারে!

আমেরিকান তরুণী বাংলা বলতে পারে শুনেই তো আমার চোখ ছানাবড়া! ভদ্রমহিলা জানালেন, এমিলি কলকাতায় থেকেছে এক বছর। অই এক বছরে বাংলা পড়তে ও লিখতে শিখেছে, বলতে তো পারেই। উনার দেয়া তথ্যের সত্যতা জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রমাণ করার জন্যই হয়তো তিনি এমিলিকে অনুরোধ করতে লাগলেন আমার সাথে বাংলায় কথা বলার জন্য। এমিলি নামের সুন্দরী মেয়েটি বাঙালি মেয়েদের মতোই খুব লজ্জা পাচ্ছিলো! আমিই পরিস্থিতি সহজ করে দিলাম, বাংলায় বললাম, এমিলি তুমি কথা শুরু করো।

এমিলি স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণে বললো, “আমার নাম এমিলি, কলকাতাতে আমার স্বামীর সাথে এক বছর ছিলাম। ওখানে গড়িয়াহাটে থেকেছি। আধুনিক শিশু শিক্ষা বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম আমি। আজ আমি খুব আশ্চর্য্য হয়েছি এই ওয়ালমার্টে একজন বাঙালিকে দেখতে পেয়ে”। এমিলির বাংলা শুনে আমার আক্কেলগুড়ুম! মাত্র এক বছর বাংলা পড়ে এমন শুদ্ধ বাংলা বলতে আমি অন্ততঃ কাউকে দেখিনি। আমি এমিলির সলজ্জ মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।

বাংলাতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘এমিলি, তোমার সাথের মানুষটি তোমার কে হন?”

এমিলি বললো, ‘উনি আমার শাশুড়ী। আচ্ছা রীতা আন্টি, আপনি কি রান্নাও করেন এখানে? সব বাঙালি খাবার রান্না করেন?”

এমিলির কথা শুনে আমার জ্ঞান হারানোর অবস্থা। এই মেয়ে আমাকে আন্টি ডাকছে! বুঝলাম সে অলরেডী শিখেছে, আমাদের দেশে কাউকে নাম ধরে ডাকার রেওয়াজ নেই, তাই সে আমার নামের ব্যাজ থেকে নামটি নিয়ে সাথে আন্টি যোগ করে ফেলেছে। বাঙালি নারীর যে রান্নাবান্নাই প্রধান কাজ, এটাও সে জেনে গেছে! তাকে জানালাম যে আমি প্রতিদিন রান্না করি, এবং বাঙালি খাবার রান্না করি।

এমিলির শাশুড়ী এবার জানালেন যে উনারা মিসিসিপির অধিবাসী নন, উনারা এসেছেন ইন্ডিয়ানা থেকে। বললাম, তাই তো বলি, আমার ইংরেজি উচ্চারণ কেন তোমার পছন্দ হয়েছে! মিসিসিপির মানুষ তো আমার ইংরেজি উচ্চারণ কিছুই বোঝে না, আমিও মিসিসিপির ইংলিশ কিচ্ছু বুঝি না। মিসিসিপির মানুষদের সাথে কথা বলতে বলতে আমি ইংলিশই ভুলে যাচ্ছি— বলে হেসে ফেললাম।

এমিলির শাশুড়িও খুব হাসলেন। স্বীকার করলেন, সাউদার্ন ইংলিশ উনিও বলতে পারেন না, বুঝতেও পারেন না! ওরা মিসিসিপিতে এসেছে কারণ এমিলির স্বামী, অর্থাৎ ভদ্রমহিলার ছেলের চাকরির পোস্টিং হয়েছে মিসিসিপি এয়ারবেসে, তাই ছেলে- বৌমার কাছে উনি বেড়াতে এসেছেন। ভদ্রমহিলা বললেন, তাঁর ছেলে ফুল ব্রাইট স্কলারশীপ পেয়ে ইন্ডিয়াতে গিয়েছিল উচ্চ শিক্ষার জন্য, সাথে এমিলিও গেছে। এমিলি কলকাতায় বসে থাকেনি, শিশু শিক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করেছে। এক বছরে ওরা দুজনেই যতখানি বাংলা শিখেছে, এখানে ফিরে এসে কারো সাথে বাংলা চর্চা করার সুযোগ পাচ্ছে না বলে দুজনেই খুব আপসেট ছিলো।

আজ আমার দেখা পেয়ে ভদ্রমহিলা মহাখুশি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন আমার মত একজন খাঁটি বাঙালির খোঁজ পেয়ে গেছেন বলে। আর চিন্তা নেই, ছেলেকে গিয়ে বলবেন বাংলা চর্চা করার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। উনার ফোন নাম্বার দিলেন, এমিলির ফোন নাম্বার দিলেন এবং আমার ফোন নাম্বার নিলেন। ফিরে যাওয়ার সময় ভদ্রমহিলা ইংলিশে ধন্যবাদ জানালো এবং অনুরোধ করে বললো, আমি যেনো মাঝে মাঝে ফোনে এমিলির খোঁজ নেই। আর এমিলি বাংলায় বললো, আবার কথা হবে রিটা আন্টি!

এমিলিরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কালো এক তরুণ এলো নতুন ফোন সার্ভিস কন্ট্র্যাক্ট নিতে। তখনও আমিই ছিলাম ডিউটিতে। কেউ নতুন ফোন সার্ভিস নিতে চাইলে আমাদের প্রথম কাজ হলো, গ্রাহকের ক্রেডিট হিস্ট্রি চেক করা। গ্রাহকের সমস্ত পারসোন্যাল ইনফর্মেশান কম্পিউটারে সাবমিট করার পর ক্রেডিট ব্যুরো থেকে রেজাল্ট আসে। সেই রেজাল্টের ভিত্তিতেই ঠিক হয় গ্রাহককে কোনো ডিপোজিট মানি জমা দিতে হবে কিনা।
ক্রেডিট হিস্ট্রি চেক করার কথা শুনে তরুণ একটু আমতা আমতা করছিলো।

তাকে বুঝিয়ে বললাম যে এটা ফোন কোম্পানিগুলোর বেঁধে দেয়া নিয়ম। ক্রেডিট স্কোর ভালো হলে গ্রাহককে কোনো ডিপোজিট মানি জমা দিতে হয় না। আর ক্রেডিট স্কোর খুব ভালো না হলে কিছু ডিপোজিট দিতে হয়। এক বছর সার্ভিস কন্টিনিউ করতে পারলে ডিপোজিট মানি ওরা মান্থলি বিলের সাথে ব্যালেন্স করে দেয়। সব শুনে তরুণ আধ ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবে বলে চলে গেলো। আধঘন্টা বাদে সে সত্যিই ফিরে এলো, এবার একা আসেনি। সাদা আমেরিকান সুন্দরী এক মেয়েকে বগলদাবা করে এনেছে।

অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে দেখলাম, এরা প্রেমিক- প্রেমিকা। ইদানিং প্রায়ই দেখি কালো ছেলেদের সাথে সাদা মেয়েকে গলাগলি করে চলতে। কিনতু সাদা ছেলের পাশে কালো মেয়ে এখনও দেখিনি। কে জানে, এদেশেও হয়তো সাদা চামড়ার কদর বেশী! বাচ্চা মেয়ে, কেমন অভিমানী অভিমানী মুখ করে পাশে দাঁড়িয়েছে। ছেলেটির ক্রেডিট স্কোর চেক করে দেখলাম দুই ফোন লাইনের জন্য তাকে জমা দিতে হবে ৬০০ ডলার ডিপোজিট।
এবার ফোন পছন্দ করার পালা। মেয়েটি পছন্দ করেছে ‘ আইফোন ফোর’। দুই বছরের জন্য কন্ট্রাক্ট, প্রতি আইফোন ফোরের জন্য দিতে হবে আরও ৯০ ডলার।

টাকার পরিমাণ শোনার পর ছেলেটির মুখের চেহারা করুণ হয়ে গেলো। আমি তাকে অন্য ফোন পছন্দ করতে বললাম, যেগুলো দামে একটু সস্তা হবে। কিন্তু অভিমানী বালিকার জেদ, ‘আইফোন ফোর’ দিতেই হবে তাকে।ছেলেটি মেয়েটির দিকে অনুনয়ের চোখে তাকাতেই মেয়ে মুখ ঘুরিয়ে ছেলেটির পাশ ছেড়ে সোজা হাঁটা দিলো। ছেলেটি উতলা হয়ে বললো, বেইবি ফিরে আসো, তোমার পছন্দের ফোনই নেয়া হবে। বলেই আমাকে বললো, ঠিক আছে, আমি ৬০০ ডলার ডিপোজিট দিবো। ছেলেটিকে বললাম যে, তুমি তো অনেক বড়লোক মনে হয়, নাহলে ৬০০ ডলার ডিপোজিট দেয়া তো সোজা কথা না!

সে বললো, আমি খুবই সাধারণ মানুষ, কিনতু আমার ফিঁয়াসেকে এত ভালোবাসি যে এই টাকার পরিমাণ তুচ্ছ আমার কাছে। শেষ পর্যন্ত প্রিয়ার আবদারে সে ৬০০ ডলার ডিপোজিট, ২০০ ডলার ফোনের জন্য , ৮০ ডলার একটিভেশান ফি দিয়ে দুটি ‘আইফোন ফোর’ নিতেই মেয়েটির মুখ অনিন্দ্য সুন্দর হাসিতে ভরে গেলো। তরুণ যখন চুক্তিপত্রে সাইন করছিলো, আমি জানতে চাইলাম তারা কবে বিয়ে করতে যাচ্ছে। সাথে সাথে তরুণ বললো, ‘এই ডিসেম্বারে আমরা বিয়ে করবো”

আর মেয়েটি ধীরে সুস্থে বললো, “আমি এখনও জানিনা কবে বিয়ে করবো। এক বছর আগে আমাদের এমগেজমেন্ট হয়েছে, আরও সময় দরকার বিয়ের ডিসিশান নিতে।” মেয়েটির বয়স ১৮, ছেলেটির বয়স তো আমি আগেই জেনেছি ২৬ বছর। মনে মনে স্বীকার করতেই হলো, এই জগত সংসারে সব দেশেই মেয়েরা খুব হিসেবী হয় এবং ছেলেরা হয় বেহিসেবী। ছেলেদের সাথে সম্পর্ক তৈরির আগে প্রায় প্রতিটি মেয়ে সম্পর্কের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়, সম্পর্ক চলকালেও সম্পর্কের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় সম্পর্কটা রাখবে কিনা।

*এবং পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখলে জানা যাবে, বেশীর ভাগ প্রেমিক- প্রেমিকার ব্রেক আপ হয় প্রেমিকার হিসেবী স্বভাবের কারণে, আর ছেলে-মেয়ের বিবাহিত সম্পর্ক ভেঙে যায় ছেলেদের বেহিসাবী স্বভাবের কারণে।* চুক্তিপত্র সাইন হয়ে যেতেই দেখি মেয়েটির মুখে হাসির বন্যা দেখা গেলো, ছেলেটির মুখেও প্রশ্রয়ের এক অপূর্ব হাসি। আমার দেখে এত ভালো লাগলো যে ছেলেটিকে বলেই ফেললাম, ‘জীবনে টাকা আসে টাকা চলেও যায়, কিনতু এমন মুহুর্ত বার বার আসে না। তোমাদের সুখী সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা রইলো”।

বাড়ি ফিরে আমার স্বামীর কাছে এমিলি আর তার শাশুড়ির গল্প করলাম। কিছুক্ষণ পরে আমার স্বামী বললেন যেনো নেক্সট ছুটির দিনে এমিলি, তার বর আর এমিলির শাশুড়িকে আমাদের বাড়িতে ডিনারের নেমন্তন্ন করি।
মনে পড়ে গেল, এমিলির শাশুড়ীও আমাকে বলেছিল, মাঝে মাঝে যেনো এমিলির খোঁজ খবর নেই!★★

কিন্তু আমি এমিলির শাশুড়ির দেয়া ফোন নাম্বার লেখা কাগজের টুকরোটি আর খুঁজে পাইনি। খুব সম্ভবতঃ এমিলির শাশুড়িও আমার ফোন নাম্বার লেখা কাগজটি খুঁজে পাননি।

তাই আমাদের আর কখনো কথা হয়নি।

— ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার

সেই ৩০শে মে!

nn মে মাস ১৯৮১। আমাদের এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আমি নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজের ছাত্রী ছিলাম এবং আমার সিট মহিলা কলেজেই পড়েছিলো। তখন দেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। আমি রাজনীতি বুঝতাম না, ছাত্র রাজনীতিও বুঝতাম না। জিয়াউর রহমানকে অপছন্দ করতাম, কারণ বড়োদের মুখে শুনতাম যে বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জিয়াউর রহমান জড়িত এবং বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা মুছে তিনি বিসমিল্লাহ যোগ করেছেন। সংবিধানে বিসমিল্লাহ যোগ করার অর্থ, রাষ্ট্রের মুসলমানি হয়ে যাওয়া, অন্য ধর্মের নাগরিকের অধিকার খর্ব হওয়া, মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে যাওয়া।

পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর এমনিতেই বাংলাদেশে আওয়ামীপন্থী জনগণ মানসিকভাবে কুঁকড়ে গেছিলো। এরপর যখন জিয়াউর রহমান সাহেব সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা কেটে বিসমিল্লাহ যোগ করে দিলো, তাতে প্রতিবেশী মুসলমানদের খুব উল্লসিত হতে দেখে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে ভয়, ক্ষোভ, সন্দেহ, অবিশ্বাস জন্ম নিতে শুরু করে। আমরা জানতাম, সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা থাকলে রাষ্ট্রের সকল ধর্মের অনুসারীদের সর্বক্ষেত্রে সম অধিকার থাকে, রাষ্ট্রের জনগণ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী হয়।

কিন্তু জিয়াউর রহমান ধর্ম নিরপেক্ষতা কেটে বিসমিল্লাহ যোগ করার পর থেকেই যেনো আমরা বাঙালি পরিচয় হারিয়ে মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান আলাদা নামে পরিচিত হয়ে গেলাম। এবং অবশ্যই বিসমিল্লাহর জোরে মুসলমানরা এক দেশের এক মাটির সন্তান হয়েও আমাদের চোখে ‘ সুপিরিয়র’ হয়ে গেলো। কথা আরো আছে, জিয়াউর রহমান শুধু রাষ্ট্রের গায়ে বিসমিল্লাহ লাগিয়ে ক্ষান্ত হননি, পাকিস্তানের অনুকরণে আমাদের জাতীয়তা ‘বাঙালি’ মুছে দিয়ে বাংলাদেশী করে দিলেন। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান মুছে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ করে দিলেন। ফলে অলিখিতভাবেই শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, কমপিটিটিভ পরীক্ষায় অমুসলিম ক্যান্ডিডেটরা মেধা থাকা সত্ত্বেও শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের বৈষম্যের কারণে অনেক পেছনে পড়ে থাকতো।

তখন কেউ কল্পনাই করতে পারতো না, অমুসলিম কেউ এসএসসি এইচএসসিতে প্রথম দ্বিতীয় স্থান পাবে! বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্টেও দেখা যেতো, প্রচন্ড মেধাবী কোনো শিক্ষার্থী ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ার দাবীদার, কিন্তু অমুসলিম নামের কারণে তাকে শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে দেয়া হতো না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জিয়াউর রহমানের শাসনকালে দেশে যে পরিবেশ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটানো হয়েছে, তাতে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু নামে দুটো প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে। সংখ্যাগুরুরা নিজেদের যতই সুপিরিয়র ভাবতে শুরু করলো, সংখ্যালঘুদের মাঝে ততই ইনসিকিউরিটি, ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স জন্ম নিতে শুরু করলো।

হীনমন্যতাবোধ নিয়ে আর যাই হোক, শান্তিতে অথবা স্বস্তিতে বাঁচা যায় না। সংখ্যালঘুদের হীনমন্যতাবোধ নিয়ে বাঁচার কষ্টটা জিয়াউর রহমানের হাত দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। উঠতি তারুণ্যে এমন পরিবেশ পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমানকে পছন্দ করার কোনো কারণ ছিলো না আমার। রাজনীতি না বুঝেও জিয়াউর রহমান যে ভিলেন ছিলেন, সেটা বুঝতাম।

১৯৮১ সালের মে মাসের কথা বলছিলাম, আমাদের এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। খুব সম্ভবত বাংলা অথবা ইংলিশ পরীক্ষা ছিলো সেদিন। মহিলা কলেজ কেন্দ্রে বসে পরীক্ষা দিচ্ছি। হঠাৎ কলেজ করিডোরে কিছু চেঁচামেচি শুনতে পেলাম। ব্যাপার বুঝে ওঠার আগেই পাশের তোলারাম কলেজের কিছু ছাত্র জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে দিতেই আমাদের হলরুমে প্রবেশ করলো। তারা নিজেদের পরিচয় দিলো ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে, নেতৃত্বে ছিলো শামীম ওসমান ( তরুণ নেতা)। জিয়াউর রহমানের কোনো একটা কালা কানুনের বিরুদ্ধে সংক্ষেপে বক্তৃতা দিলো, এরপর বললো, পরীক্ষা দেয়া যাবে না। এবার এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল।

আমাদের খাতাগুলো দ্রুত গতিতে টান দিয়ে নিয়ে ইনভিজিলেটরের কাছে দিয়ে ওরা পাশের রুমে চলে গেলো। আমি খুব থ্রিল ফিল করছিলাম, তাৎক্ষণিকভাবে খুব খুশি হয়েছি পরীক্ষা দিতে হলো না বলে। উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে মাথাতেই আসেনি এটা এইচএসসি পরীক্ষা, পরীক্ষা দিতে না পারলে এক বছর লস হয়ে যাবে, বছর লস করলে আমার বাবা আছাড় দিবে আমাকে। আমি ভাবছিলাম, জিয়াউর রহমানের আমলে ছাত্রলীগ বলে কেউ আছে তাইই তো জানতাম না। এরা কোথা থেকে এলো, আর কী সাহস এদের! কয়েকটা ছেলে ঘরে ঢুকে আমাদের পরীক্ষা বন্ধ করে দিলো!

বাসায় যেতে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম বাবার কাছে কি জবাব দেবো। মনে মনে বলছিলাম, আমার তো কোনো দোষ নেই। এক বছর লস হয়ে যাবে! বাবাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, এই এক বছর আরো ভালো করে পড়তে পারবো, পরের বছর ডাবল ভালো রেজাল্ট হবে! বাসায় ফিরে শুনি, পরীক্ষার হলে গোলমালের সংবাদ অনেক আগেই তারা পেয়ে গেছে। ওরা নাকি খোঁজ নিতে জনে জনে জিজ্ঞেস করছিলো, আমরা সুস্থ আছি কিনা।
আমাকে বাসায় আস্ত ফিরতে দেখে বাবা মা’কে নিশ্চিন্ত হতে দেখে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

পরীক্ষা দিতে হবে না, আমার এই আনন্দ বিকেলেই নিরানন্দ হয়ে গেলো। জানা গেলো, এইচএসসি পরীক্ষা চলবে। আজ যে পরীক্ষা দেয়া গেলো না, তা নিয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে। তবে আমাদের সিট নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজ থেকে ঢাকা কলেজে স্থানান্তর করা হয়েছে। আমার সকল আশার গুড়েবালি, সকল থ্রিল ওখানেই ঠান্ডা। উলটো পরীক্ষার হল নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা কলেজে নেয়াকে মরার উপর খাঁড়ার ঘা মনে হলো।

বিকেলবেলায় মুখ কালো করে ঢাকা রওনা দিলাম। আমার দাদা ঢাকা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে থাকেন। ঠিক হলো, ঢাকায় দাদার বাসায় থেকেই পরীক্ষা দিতে হবে আমাকে।

সেদিন ৩০ শে মে, ঢাকা কলেজের পরীক্ষার হলে কেমিস্ট্রি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ করিডোরে শিক্ষকদের দ্রুত হাঁটাহাঁটি, শিক্ষকদের মধ্যে ফিসফাস, গুঞ্জন! আমাদের রুমের ইনভিজিলেটর রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গেলেন। লেখা থামিয়ে আমি বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ দরজার কাছাকাছি বেঞ্চে বসা এক পরীক্ষার্থী বলে ফেললো, জিয়াউর রহমানকে মেরে ফেলছে। মেয়েটির কথা শেষ হওয়ার আগেই ইনভিজিলেটর ত্রস্ত পায়ে রুমে ঢুকে দ্রুত বললেন, আজ পরীক্ষা হবে না, তোমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাও।

আবার উত্তেজনা, থ্রিলিং ব্যাপার। পরীক্ষা দিতে হবে না। তখনো ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারছিলাম না। বরং ক্লাসরুমের অধিকাংশ পরীক্ষার্থীর মুখ ভয়ার্ত দেখা গেলেও আমার কেনো জানি ভয় বা দুঃখ হচ্ছিলো না!
মনে হয়েছিলো, “এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিলো। উচিত শিক্ষা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত থাকার ফল হাতে নাতে পেয়েছে।”

কারো অপমৃত্যুতে আমার মতো সাধারণ মানবিক বোধসম্পন্ন কারোর মনে স্বস্তি আসার কথা নয়! তবে আমি যে সময়ের কথা বলেছি, ওটা ছিলো আমার উঠতি তারুণ্যের শুরু। মানবিকতা বোধ জাগ্রত হওয়ার বয়স, অসাম্প্রদায়িক চেতনা শেখার বয়স। সেই বয়সে আমি বুকে বয়ে বেড়াচ্ছিলাম বঙ্গবন্ধুর (পরিবারসহ) নির্মম হত্যাকাণ্ডের দুঃসহ স্মৃতি, বুকে সৃষ্টি হচ্ছিলো সংবিধানে বিসমিল্লাহ যুক্ত হওয়ার ফলে আমার অমুসলিম পরিচয়ে অনিরাপত্তা বোধ— এবং এর সাথে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিটি জিয়াউর রহমান। ঐ বয়সে তাই জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার ঘটনায় ঐটুকুই মনে হয়েছিলো, যেমন কর্ম তেমন ফল”! ওটাই ছিলো ঐ বয়সের ধর্ম।

** আমার পরীক্ষা বাতিলের আনন্দ আবারও নিরানন্দ হয়ে গেছিলো। দুই দিন পরেই আবার পরীক্ষা শুরু হয় এবং হুড়মুড়িয়ে শেষও হয়। তবে পর পর দুই বার পরীক্ষা বাতিল হয়েও বাতিল হলো না, পরীক্ষা কেন্দ্র আমার কলেজ থেকে টেনে ঢাকা কলেজে নিয়ে যাওয়ার ধকল আমি নিতে পারিনি, ফার্স্ট ডিভিশন হারিয়ে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে কোনোমতে বাবার সামনে দাঁড়িয়েছি! এটাও আমার প্রাপ্য ছিলো, পরীক্ষা দিতে বসেও যে মেয়ে রাজনীতির হিসেব নিকেশ করে, তার তো পরীক্ষায় পাশই করার কথা ছিলো না! যেমন কর্ম তেমন ফল পেয়েছি।**

**জিয়াউর রহমানের নিহত হওয়ার ঘটনায় আজও আমার শোক হয় না। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযুদ্ধের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম উদারতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
নিজে হাতে বঙ্গবন্ধুর বুকে গুলি ছোঁড়েন নাই, তবে বঙ্গবন্ধুর বুক গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়ার ম্যাপ এঁকে দিতে উনি প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছেন। উনি ক্ষমতায় যেভাবেই যাক, ক্ষমতায় গিয়েই হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করিয়েছেন। উনি বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে বাঙালি, ধর্ম নিরপেক্ষতা মুছে দিয়ে বাংলার জনগণকে শতভাগে বিভক্ত করেছেন।

বাংলাদেশ আজ কোথায় পৌঁছানোর কথা, জিয়াউর রহমানের স্বার্থলোভী, কুচক্রীপনার পাঁকে পড়ে বাংলাদেশ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে! সেই যে সংবিধান থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা কেটে বিসমিল্লাহ যোগ করে বাংলাদেশের সংবিধানের বুকে, অমুসলিম নাগরিকদের বুকে চিরস্থায়ী ক্ষত করে দিলেন, এরপরে কত রাজা এলো, কেউ আমাদের সেই ক্ষত সারানোর চেষ্টা করলো না। উলটো পরের রাজা এসে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম করে দিলো। এরপরেও কত রাজা এলো, বাংলাদেশটা আর আগের মতো হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টানের হলো না, বাংলাদেশটা মুসলমানেরই রয়ে গেলো। অথচ মুক্তিযুদ্ধটা করেছিলো বাংলার মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

আর স্বাধীনতার বাহান্ন বছর পরেও মাতৃভূমিতে একই মায়ের সন্তান হয়েও আমরা মুসলমানদের বৈমাত্রেয় ভাই বোন হিসেবেই জীবন কাটিয়ে গেলাম।

**বঙ্গবন্ধু আজ নিজের গ্রামের মাটিতে বাবা মায়ের পাশে নিদ্রিত আছেন, আর জিয়াউর রহমানের লাশেরই হদিস পাওয়া যায়নি। দেশের সাথে, দেশের জনগণের সাথে এমন বেইমানি করেছেন যিনি, তাঁর পরিণতি তো এমনই হওয়ার কথা। **

মনে পড়ে!

out. ৩০শে জানুয়ারি, ২০১১।
ওয়ালমার্ট কানেকশন সেন্টারে কাজ করছিলাম। এক বুড়ি মহিলা এলো উনার একটা ফোন লাইনের সার্ভিস দুই বছরের জন্য নবায়ন করাতে। আমি সিম কার্ডটা চাইলাম, বুড়িমা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট বের করে আমায় দিলেন। আমি প্যাকেট খুলে সিমকার্ড বের করে কার্ডের সিমকার্ডের কুড়ি ডিজিট নাম্বার কমপিউটারে এন্ট্রি করছি আর ভাবছি, দুই বছরের জন্য চুক্তি নবায়ন করলে বুড়িমা একটা ফ্রি ফোন পাবে। বেশ ভালো হবে, এই পুরনো হয়ে যাওয়া চকোলেট বার পালটে একেবারে নতুন স্মার্ট টাচ ফোন পাবে।

বুঝতে পারছি না, বুড়িমা আদৌ ফোনের স্ক্রিন টাচ করে ফোন ব্যবহার করতে পারবে কিনা! একটু এদিক ওদিক হলেই ফোন নিয়ে ছুটে আসবে, “এটা কী ফোন দিয়েছো? স্ক্রিন লাইট জ্বলে না, আঙুল টাচ করার আগেই ফোনের কী-প্যাড চলে যায়!” ডিসপ্লেতে সাজানো ফোন দেখিয়ে বুড়িমাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন্ ফোন সেটটা তোমার পছন্দ? বুড়িমা বললো, আমার নতুন ফোন চাই না, এই পুরানো ফোনটাই থাকুক।

বললাম, নতুন ফোনের জন্য তোমাকে পয়সা দিতে হবে না, ফ্রি। বুড়িমা বলে, ফ্রি ফোন চাই না। আমার এই পুরানো ফোনটাই ভালো। এটা আমার স্বামীর ফোন। বললাম, হ্যাঁ, স্বামীর ফোন তাতে সমস্যা কি! তুমি এই ফোন কোম্পানির সম্মানিত গ্রাহক, দুই বছরের জন্য ফোন সার্ভিস নবায়ন করছো, তাই ফোন কোম্পানি তোমাকে নতুন ফোন উপহার হিসেবে দিচ্ছে। পুরানো ফোনটাও তোমার কাছেই থাকবে, স্বামীর জন্য বরং নতুন ফোনটাই নিয়ে যাও। নতুন ফোন হাতে পেয়ে নিশ্চয়ই তিনি খুশি হবেন। খুব সহজ এটার ব্যবহার, আমি শিখিয়ে দিবো।

বুড়িমা বললো, রিটা তোমার আন্তরিক ব্যবহারের জন্য অনেক ধন্যবাদ। আসলে আমার স্বামী এক মাস আগে মারা গেছেন। তার ফোন লাইনটা দুই বছরের জন্য রিনিউ করাতে এসেছি যাতে আমার কখনো মনে না হয়, মানুষটা নেই! আমি যতো দিন বেঁচে আছি, আমার হাজব্যান্ডের ফোনটাও থাকবে, এবং এই ফোনটাই থাকবে। আমার স্বামীর দেহ এখন মাটির নীচে, ধীরে ধীরে তাঁর দেহ মাটিতে মিশে যাবে। কিন্তু এই ফোনটার গায়ে আমার স্বামীর হাতের পরশ লেগে আছে, তাই না? যতদিন ফোনটা আমার কাছে থাকবে, ফোনের গায়ে আমার স্বামীর হাতের স্পর্শটুকু তো বেঁচে থাকবে।

নতুন ফোন নিলে তো নতুন ফোনের গায়ে আমার স্বামীর পরশ পাবো না! বুড়িমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললাম, আমি দুঃখিত। না বুঝে তোমায় কষ্ট দিয়ে ফেলেছি! বুড়িমা উলটো আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, তুমি দুঃখিত হবে কেন! তুমি তো ভুল করোনি, বরং আমাকে উসকে দিতে চেয়েছো, নতুন স্মার্ট ফোন নিয়ে বুড়োকে যেন চমকে দেই! আমারই কপাল খারাপ, অল্পের জন্য বুড়োকে চমকে দেয়ার সুযোগ হারালাম— বলে কী সুন্দর হাসি দিলো।
*************************

** ১২ বছর পর আজ হঠাৎ করেই সেদিনের বুড়িমার কথা মনে পড়ে গেলো। বুড়িমা কি আজও বেঁচে আছে? বেঁচে থাকলে কি আজও তার স্বামীর ফোনটা হাতে নিয়ে স্বামীর স্পর্শ অনুভব করে? নাকি এখন বুড়ো বুড়ি স্বর্গের বাগানে পাশাপাশি বসে পৃথিবীতে কাটিয়ে যাওয়া সুখের স্মৃতি নিয়ে খুনসুটি করছে!

–ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার

ট্রেজার বক্স!

out.t ২০১২ সালে মা মারা যায়। মায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার পর আমি আমেরিকা ফিরে আসি। ফেরার সময় ছোটো একটা স্যুটকেসে মায়ের কিছু শাড়ি, শেষ বিছানার চাদর, বালিশের ওয়ার, হাসপাতালে ওটিতে নেয়ার আগে মায়ের হাত থেকে খুলে রাখা শাঁখা পলা চুড়ি, মায়ের কপালের টিপ, হাসপাতালের বেডে মায়ের মাথা আঁচড়ে দেয়ার সময় ঝরে পড়া তিন চারটি সোনালি চুল, মায়ের ব্যবহার করা ওয়ারিদের ফোনটা, মায়ের দেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার আগে কাগজে নেয়া মায়ের পায়ের আলতা মাখা ছাপ এবং আরও কিছু মেমেন্টোর সাথে মায়ের নিজস্ব একটা ট্রেজার বক্স এনেছিলাম।

সুটকেসটা এনে রেখে দিয়েছিলাম আমার বিছানার পাশের টেবিলের নীচে, আর খুলিনি। বাবা মারা গেলো ২০২০ সালে। এই বছর দেশে গেলাম, আমেরিকা ফেরার সময় বাবার বহু ব্যবহৃত একটা শার্ট, একটা লুংগি আর একটা মাফলার হাত ব্যাগে ভরে এনেছি। বাবার শার্ট লুংগি মাফলার মায়ের জিনিস ভর্তি সুটকেসে ভরে রাখবো ভেবে ১১ বছর পর আজ সুটকেসটা খুলেছি। সেখানে পেলাম মায়ের দুটো শাড়ি পাকিস্তান আমলের, এখনও ঝকঝকে। একটা কালো নক্সি পাড়ের, অন্যটা লাল আর রূপালি জরির নক্সি পাড়ের।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, এই শাড়িগুলো পরে মা স্কুলে যেতো। শাড়ির পাড়ের সাথে রঙ মিলিয়ে ব্লাউজ পরতো। আরেকটা শাড়ি মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতা থাকতে মা রঙ তুলি দিয়ে ডিজাইন করেছিল, বলতো ফেব্রিকের শাড়ি। সে সময় তিনটা ভয়েলের থানে মা রঙ তুলি দিয়ে এঁকেছিলো। একটা ছিলো সাদা থানের উপর, একটা হাল্কা কমলা, আরেকটা হালকা বেগুনি থানের উপর করা। সাদা আর কমলা শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে, হাল্কা বেগুনি শাড়িটা আমার খুব পছন্দের ছিলো বলেই হয়তো মা এই শাড়িটা তুলে রেখেছিলো।

একটা শাড়ি পেয়েছি, আমাদের বিয়ের পর আমার উত্তম বেলী রোড থেকে শাড়িটা কিনে মা’কে দিয়েছিলো। জামাইয়ের দেয়া প্রথম শাড়ি, মা রেখে দিয়েছিলো। আড়ং থেকে কেনা কাপড়ের তৈরি একটা পেন এন্ড পেপার হোল্ডার খুঁজে পেলাম। এটিও মা’কে দিয়েছিলো আমার উত্তম, মা তুলে রেখেছিলো। সুটকেসে কয়েকটা ছোটো রঙিন টাওয়েল পেলাম। আমিই হয়তো আমেরিকা থেকে নিয়ে গেছিলাম। মা কত যত্ন করে রেখেছে। আমার বাবা মা’কে ভালোবেসে যখন যা দিয়েছি, মা ভালোবাসার জিনিস ভালোবেসে গ্রহণ করেছেন, ভালোবেসে আগলে রেখেছেন।

কখনো বলেননি, সস্তার জিনিস দিয়েছি, কখনো বলেননি সেইলে কেনা জিনিস দিয়েছি, কখনো বলেননি ডেট এক্সপায়ার্ড জিনিস দিয়েছি। মা জিনিস হাতে নিয়ে সেখানে মেয়ে, জামাই আর নাতনিদের ভালোবাসা অনুভব করতেন, জিনিসের গায়ে দামের ট্যাগ খুঁজতেন না, এক্সপিরেশন ডেট খুঁজতেন না। এই জন্যই মায়ের ট্রেজার বক্সে থাকা শত বছরের পুরানো জিনিস আজও জ্বল জ্বল করছে।

আজই প্রথম মায়ের ট্রেজার বক্সটা খুলে দেখলাম। ট্রেজার বক্স ঠাসা অমূল্য রতন। একটা কৌটোর মুখ খুলতেই বের হলো লুডুর গুটি আর ছক্কা পাঞ্জা। এই গুটি আর ছক্কা পাঞ্জাটা মায়ের তরুণী বয়সের, যখন মা অবসরে তার ননদ জায়েদের সাথে অবসরে লুডু খেলতো। একটা কৌটো খুলে পাওয়া গেলো বেশ কিছু ঝকঝকে সেফটি পিন, পঁচিশ বছর আগে অস্ট্রেলিয়া থেকে এনে দিয়েছিলাম। আরেক পাউচে পাওয়া গেলো অন্য সাইজের আরও কিছু সেফটি পিন, কখনো আমিই হয়তো আমেরিকা থেকে নিয়ে গেছিলাম। একটি ছোটো কৌটো ভর্তি চকচকে এক টাকার কয়েন। তিনটি ছোটো ছোটো পাউচ আমার মেজো কন্যা মিশা দিয়েছিলো দিদাকে। প্রতিটি পাউচে আছে নতুন একশো টাকার নোট। পেলাম একটা সানগ্লাস, এটাও মিশা দিয়েছিলো দিদাকে। আমেরিকা থেকে দেশে যাওয়ার সময় মিশা সবসময় ওর দিদার জন্য টুকিটাকি হাবিজাবি অনেক কিছু নিতো। আমাদের কারোরই ধারণা ছিলো না, মা প্রতিটি জিনিস এতো যত্ন করে ট্রেজার বক্সে রেখে দিতো।

বক্সের ভেতর এবার পেলাম একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট। প্যাকেট খুলে একটা একটা জিনিস বের করি আর থমকে যাই! প্যাকেটের ভেতর সব কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা, খুব সম্ভব আমার জন্যই মা এই প্যাকেটটা রেখেছিলো। কারণ মা জানতো একমাত্র আমিই স্মৃতিচারণ করতে ভালোবাসি, হাতড়ে হাতড়ে স্মৃতি খুঁজি, স্মৃতি কুড়াতে ভালোবাসি। প্লাস্টিকের প্যাকেটের ভেতর থেকে বের করলাম ছোটো একটা পকেট এলবাম। এলবামে আমাদের আনন্দময় বিভিন্ন সময়ের ছবি যেখানে মা আছে, আমার মেয়েরা আছে, মাসি পিসী ঠাকুমা আছে।

ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, আমার জীবন থেকে আনন্দময় সবই হারিয়ে যাবে মা জানতো, তাই ছবিগুলো যত্ন করে তুলে রেখেছে আমার জন্য। পেলাম প্রফেশনাল জ্যোতিষী দিয়ে তৈরি করা আমার দুই মেয়ে মৌটুসি আর মিশার কোষ্ঠি, খুব যত্ন করে রাখা। মা কেনো নাতনিদের কোষ্ঠি করিয়েছিলো কে জানে! মা তো জানতেও পারেনি, মায়ের আদরের নাতনিদের কোষ্ঠিতে কি লেখা ছিলো! দুটো এনভেলাপ পেলাম, একটিতে আমার টিচার্স ট্রেনিং কলেজের রেজিস্ট্রেশন কার্ড, আরেকটিতে বিএড পরীক্ষার প্রবেশ পত্র। দেখে আমার দুই চোখ ফেটে জল এলো। মায়ের ট্রেজার বক্সে আমার বিএডের রেজাল্টের কপি নেই, তাই প্রমাণ নেই তিন কন্যা জন্মের পর বিএড করেছি, বিএড পরীক্ষায় ৭৯৩ পেয়েছি।

আরও অনেক কাগজপত্রের মাঝে তিনটা আলাদা ছোটো প্যাকেট পেলাম, পত্রিকার কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে লাল সূতো দিয়ে বাঁধা। এক প্যাকেটের গায়ে মায়ের নাম লেখা, আরেক প্যাকেটের গায়ে আমার নাম লেখা, তৃতীয় প্যাকেটের গায়ে দাদু দিদিমার নাম লেখা। মায়ের নামের প্যাকেট খুললাম আগে, বেরিয়ে এলো মায়ের বিভিন্ন বয়সের পাসপোর্ট সাইজের ছবি। তেতাল্লিশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে বিভিন্ন সময় পাসপোর্ট সাইজের ছবি তুলতে হয়েছে।

একটা ছবি মায়ের প্রথম বয়সের, পরের গুলো আরও পরের। প্রথম বয়সের ছবিটায় মা’কে দেখে মনেই হয় না, এটা আমার সুন্দরী মা। আমার মায়ের উপরের পাটির সামনের দুটো দাঁত একটু উঁচু ছিলো, আর ঠোঁট দুটো পাতলা ছিলো বলে দাঁত দুটো দেখা যেতো। ছবি তোলার সময় ঠোঁট চেপে দাঁত ঢাকতে গেলে আমার সুন্দরী মায়ের চেহারা বদলে অসুন্দরী হয়ে যেতো। সেই ছবির চেহারা মায়েরও পছন্দ হতো না, আমারও না। এইজন্য মা প্রয়োজন ছাড়া কক্ষনো ছবি তুলতো না।

আজ আমার মায়ের সব বয়সের ছবিগুলোই খুব সুন্দর লাগলো। মা’কে কত বলেছি, মা দাঁত দেখা যাক। তোমার সামনের দাঁতদুটো দেখেই তোমাকে চিনি, ঠোঁট চেপে দাঁত ঢাকতে হবে কেনো! তবুও মা ছবি তোলার সময় সিরিয়াস হয়ে যেতো। একটা ছবি দেখে আমি আজ ফিদা হয়ে গেলাম। পাকিস্তান আমলে তোলা ছবি। মায়ের পরনে সেই শাড়ি, গলায় সেই ঝিনুক লকেটের হার। এই শাড়িটা ছিলো আমার খুব পছন্দের, নাম দিয়েছিলাম ইস্পাহানি শাড়ি। কারণ পাকিস্তান আমলে আমাদের বাসায় যে ইস্পাহানি চায়ের সাদা সবুজ বাক্স আসতো, এই শাড়ির প্রিন্টটা দেখতে ইস্পাহানি চায়ের প্যাকেটের মতো লাগতো।

মুক্তিযুদ্ধের পরে এই শাড়িটা আমি আর দেখিনি। মা’কে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম, ইস্পাহানি শাড়িটার কথা। মা বুঝতেও পারতো না, ইসপাহানি শাড়ি কোনটা। আমি মনে করিয়ে দিতাম, অই যে ‘৭০ সালে আমরা প্লেনে চড়ে কলিকাতা গেলাম, তুমি ইস্পাহানি শাড়িটা পরেছিলা। অইটাই ইস্পাহানি শাড়ি। মা বলতো, কি জানি কি কস, ইসপাহানি শাড়ি, বাপের জন্মেও এমন নাম শুনি নাই। নিশ্চয়ই ছিঁড়ে গেছে। আর মায়ের গলার এই হারটার কথা অনেক মনে পড়ে। ঝিনুকের উপর জোড়া ময়ুর ডিজাইনের লকেট। আমার বিয়ের সময় মায়ের যত গয়না ছিলো, সব ভেঙে আমার বিয়ের গয়না গড়িয়ে দিয়েছে। ঝিনুক লকেটওয়ালা এই হারটাও ভাঙতে হয়েছিলো।
এই একটা ছবি আমাকে আজ এতো কাঁদালো!

এরপর খুললাম আমার নামের প্যাকেট। এখানেও পাসপোর্ট সাইজের ছবি, ক্লাস এইটে যখন পড়ি, আমার পাসপোর্ট করানোর জন্য এই ছবি তোলা হয়েছিলো। তখন কী বেকুব ছিলাম আমি, বারো- তেরো বছরের এক কিশোরীকে তার মা বললো, শাড়ি পরে ছবি তোল। অমনি কিশোরী মায়ের শাড়ি পরে, মাথার চুল টেনে ঝুঁটি বেঁধে, চোখে কাজল, কপালে কাজলের বড় টিকা, গলায় পুঁতির মালা পরে ছবি উঠালো! কী বোকা দেখাচ্ছিলো ছবিতে, ভাগ্যিস দালাল বলেছিলো, এই ছবি দিয়ে পাসপোর্ট হবে না। আমি বললেই আমার মেয়েরা পাসপোর্টের জন্য তুলতো এভাবে ছবি? অথচ মায়ের কথায় আমি শাড়ি পরে স্টুডিয়োতে গিয়ে ছবি তুলেছি। এত বছর পর নিজের ছবি দেখে নিজেই খিলখিল করে হেসে ফেলেছি।

এরপর দাদু দিদিমার প্যাকেট খুললাম। সেখানে দাদুর একটা ছবি, দিদিমার তিন বয়সের তিনটা ছবি। একটা ছবিতে দিদিমার স্বাক্ষর আছে, শ্রী চারুলতা রায়। স্বাক্ষর পড়ে খুশিও হলাম, হেসেও দিলাম। আমার দিদিমা ঠাকুমা দুজনেই প্রাইমারি স্কুল পাশ। এটা আমার কাছে অত্যন্ত গর্বের, কোন্ আমলের নারী উনারা, বেঁচে থাকলে দিদিমার বয়স আজ একশ তিন হতো, ঠাকুমার হতো একশ বিশ। দিদিমার স্বাক্ষরে নিজের নামের আগে শ্রীমতি না লিখে শ্রী লিখেছে দেখে হাসি পেয়েছে। ঠিকই আছে, শ্রীমতি হলেও আমার দিদিমা শ্রীমতিদের মতো মিনমিনে ছিলেন না, চলনে বলনে ঠাটে বাটে শ্রী মহাশয়দের মতোই তেজস্বী ছিলেন।

মনে পড়ে গেলো, দিদিমা আর মা পাকিস্তান আমলে কত যে বেড়াতো, প্রায় দিন মা মেয়ে রিকশায় চড়ে চলে যেতো সিনেমা দেখতে, আমার সব মনে আছে কারণ দিদিমা আর মা যেখানেই যেতো আমাকে সাথে নিতো।
আরেকটা ছবি পেলাম, মায়ের মামার ছবি। পোশাকে দাঁড়ানোর ভংগিতে কী স্মার্ট মায়ের মামা! দেশ স্বাধীনের পর আমাদের হাল দেখে কে বলবে, আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষগুলো চলনে বলনে শিক্ষায় সম্পদে কতখানি পরিপূর্ণ ছিলো! পেলাম আমার মিশা কন্যার হাতে লেখা চিঠি। অস্ট্রেলিয়া থাকতে মিশা ওর দিদা দাদুকে খুব মিস করতো, তাই চিঠি লিখতো।

পাঁচ বছরের মিশা বাংলা বর্ণ পরিচয় ছাড়াই বাংলায় চিঠি লিখতো, এটা দিদার কাছে হয়তো অষ্টমাশ্চর্য বিষয় ছিলো তাই ট্রেজার বক্সে চিঠিগুলো রেখে দিয়েছে। মিশা চিঠির শেষে ‘ইতি মিশা’ না লিখে লিখতো, ‘ইতিহাস মিশা’! সেই থেকে মিশার নাম হয়ে গেছিলো, ইতিহাস মিশা। চিঠি দুটো দেখে আবার ঝাঁপিয়ে কান্না এলো। আমাদের সে-ই প্রাণোচ্ছল পাগলি আহ্লাদী মিশা আজ সত্যিই ইতিহাস মিশা হয়ে গেছে! জীবনের বাস্তবতা ইতিহাস মিশাকে পুরো বদলে দিয়েছে। আমার পাসপোর্ট সাইজের কিশোরী বয়সের ছবিগুলো পত্রিকার যে কাগজ দিয়ে মোড়ানো ছিলো, সেই কাগজে বড় হরফে লেখা,” গ্রন্থমেলা অনন্য সুন্দর, বিশ্বে নন্দিত”!

এটা পড়ে আমার অদ্ভুত এক ভাবের উদয় হলো। মা একই সময়ে বিভিন্ন জনের ছবি কাগজে মুড়িয়ে তিন সেট প্যাকেট বানিয়েছে, আমার ছবির প্যাকেটটা কিভাবে গ্রন্থমেলার মোড়কে ঢুকে গেলো!
তবে কি সেদিনই নির্ধারিত হয়ে গেছিলো, আমার লেখা বই একদিন এই অনন্য গ্রন্থমেলায় ঠাঁই পাবে!

মায়ের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই!
আরও কত স্মৃতি মায়ের ট্রেজার বক্সে। আমাদের অস্ট্রেলিয়ার ছবি, মৌটুসির নাচের ছবি, হারমোনিয়াম বাজিয়ে মৌটুসী ফাংশনে গান গাইছে, ছোট্টো মিশা আমি আজ কানাই মাস্টার আবৃত্তি করছে, পুতুলের মতো দেখতে মিশা—-

মিথীলার ছবি, ছোট্টো মিথীলার কত ছবি—-
ছবিগুলো দেখে মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেলো। ট্রেজার বক্সটা সযতনে আবার সুটকেসে রেখে সুটকেসের ডালা বন্ধ করে দিলাম।

ভালোবাসা যেথায় বিরাজ করে!

r03 একটা ভালোবাসার গল্প বলি।
অদিতি পাল টুম্পাকে আমার ফেসবুক সিনিয়র-জুনিয়র বন্ধুদের অনেকেই আমার নিলাজি কইন্যা নামে চিনে। আমার নিলাজি কইন্যা টুম্পা, সেই ছোট্টো বেলা থেকে আমাকে মামী বলে চিনেছে জেনেছে ভালোবেসেছে।
টুম্পার মা’কে আমি কমলদি ডাকি, কমলদি আমাকে বৌদি ডাকে। আমার উত্তম যখন কেমিস্ট্রির লেকচারার হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলো, কমলদি থার্ড ইয়ারের ছাত্রী। তখন থেকে উত্তমকে স্যার ডাকা শুরু, উনার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্যার ডেকেছেন।

কমলদিরা মাস্টার্স শেষ করার আগেই স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে কানাডা চলে যায় পিএইচডি করতে। এরপর স্যারের সাথে কমলদির আবার দেখা হয় গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসে। কমলদি সেখানে সিনিয়র কেমিস্ট হিসেবে কর্মরত, স্যার যোগ দিলেন আরএনডি বিভাগের প্রধান হিসেবে। কমলদি এক বিকেলে পরীর মতো ফুটফুটে এক বাচ্চাকে নিয়ে আমাদের কোয়ার্টারে এলেন স্যারের বউ বাচ্চার সাথে দেখা করতে। আমি তখন সবে জাহাঙ্গীরনগর থেকে কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স শেষ করেছি। একই সাবজেক্টের স্যারের পুচকি বউকে কমলদি বৌদি ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আর পুচকে পরীটাকে বললেন, টুম্পা এই যে তোমার মামী, আর আমার স্যার হচ্ছেন তোমার মামা। আর মৌটুসি তোমার বন্ধু।

প্রথম দিনেই দুই বছরের ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা পরীটা আমাকে ভালোবেসে ফেললো। মামী ওর ধ্যান জ্ঞান ভালোবাসা। এরপর মিশা জন্ম নিলো, ততদিনে কমলদি ঢাকা আরেক ফার্মাসিউটিক্যালসে জয়েন করেছেন।
টুম্পার সাথে সহজে দেখা হয় না, কিনতু টুম্পা আমাকে ভোলে না।

এরপর আমরা ঢাকা চলে এলাম, অস্ট্রেলিয়া গেলাম, অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরলাম, আবার আমেরিকা চলে এলাম। ততদিনে কমলদি আমার শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধু, দিদি, আপনার জন হয়ে গেছে। আর টুম্পা? মামার সাথে খাতির নাই, মামার বউ মামী হয়ে গেছে ওর বন্ধু গাইড ফিলোসোফার আরও আরও অনেক কিছু। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার টুম্পা কলেজ জীবন থেকেই চুপি চুপি ভালোবেসেছে ওরই ক্লাসফ্রেন্ড পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার এবং থিয়েটার কর্মী সুদর্শন সঞ্জীবকে। চুপি চুপি নয়, ভালোবাসার কথা মামীকে জানিয়েছে। সেই থেকে আদর করে ওকে আমি নিলাজি কইন্যা ডাকি।

পৃথিবীতে এখনও একমাত্র এই নিলাজি কইন্যাটি আমাকে নি:শর্ত নি:স্বার্থভাবে ভালোবাসে। আমি যদি ওর কাছে কাঠফাটা রোদে এক পশলা বৃষ্টি চাই, ও মেঘ খুঁড়ে আমার জন্য বৃষ্টি নিয়ে আসবে। আমি যদি ওর কাছে ডুমুরের ফুল চাই, বাঘের দুধ চাই, ও যেখান থেকে পারুক আমার জন্য সব নিয়ে আসবে। সাত বছর আগে সঞ্জীবের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে, ওর বিয়েতে যাবো বলেই আমি বাংলাদেশে গেছিলাম। কমলদি অঞ্জনদা আর টুম্পা মিলে সে কি আদর আর সম্মান দিয়েছে আমাকে, কেউ বিশ্বাসই করবে না যে ওদের সাথে আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই!

সঞ্জীব টুম্পার ঘরে একটা পরীর মত বাচ্চা এসেছে, উচ্চশিক্ষার জন্য ওরা এখন লন্ডন চলে গেছে। এটুকু ছিলো ভালোবাসার ভূমিকা, এবার উপসংহার।

ক্যান্সারের থাবায় কমলদি মারা গেছেন গত বছর অক্টোবার মাসে, আমি তখন দেরাদুনে ছিলাম। কমলদি যখন হসপিটালে ছিলেন, ফেসবুকে টুম্পার আহাজারি দেখে বিমর্ষ বোধ করতাম, আবার কখনো আশার কথা শুনলে মনটা আনন্দে ভরে যেতো। অথচ আমি টুম্পাকে কল দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করতাম না। মাঝে মাঝে মেসেঞ্জারে পজিটিভ মেসেজ পাঠাতাম, ফিংগার ক্রস করতাম যেন কমলদি সেরে ওঠে। আমারই মেয়ের বয়সী টুম্পা, আজ মাকে যমের হাত থেকে রক্ষা করতে কী যুদ্ধটাই করছে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধটা টুম্পা জিততে পারেনি, ধরে রাখতে পারেনি ওর প্রাণপ্রিয় মা”কে। সেদিনও টুম্পা বলেছে, মামী মায়ের কষ্ট দেখতে পারছি না। তুমি একটু ঠাকুরকে বলো না, তোমার কমলদিকে ভালো করে দিতে। তোমাকে তোমার কমলদি এত ভালোবাসে, তোমার কথা ভগবান শুনবে।

সেই বিকেলে আমি সবে শিখ মন্দিরে প্রার্থনা করে এসেছি, ” হে ঈশ্বর, কমলদির দেহের কষ্ট কমুক, কমলদি দেহে আরাম পাক। গেস্ট হাউজে ঢুকতেই বাংলাদেশ থেকে টুম্পার ফোন, ” মামী গো, মা তো চলে গেলো”! ব্যস এরপর টুম্পার সাথে আর কথা হয়নি। এবার বাংলাদেশে গেলাম। টুম্পা লন্ডনে, ওর বাবা মানে অঞ্জনদা নিজের বাড়িতে। আমি অঞ্জনদার সাথে দেখা করতে যাবো শুনে টুম্পা আমাকে আগেই বলেছিলো, মামী, আমি নাই তো কি হয়েছে, ঘরে তোমার কমলদি আছে। তুমি তোমার কমলদির বিছানায় বসবে, কমলদির ছবিতে হাত বুলিয়ে দিও। তোমার কমলদি কিন্তু খুব খুশি হবে। আমি গেছি, কমলদির শূন্য ঘরে শূন্য বিছানায় বসেছি। অঞ্জনদার সাথে কথা বলছি, লন্ডন থেকে টুম্পা ভিডিও কল দিয়েছে ওর বাবাকে। ভিডিও কলেই কী কান্না, ওর কান্না দেখে মনে হচ্ছিলো আমার মৌটুসি কাঁদছে!

কান্না থামলো, ওর বাবাকে বললো, বাবা মায়ের আলমারির দরজা খোলো। মেয়ের নির্দেশ পালন করলেন অঞ্জনদা। এবার টুম্পা আমাকে বললো, মামী, এই আলমারিতে মায়ের শাড়ি শাল আরও অনেক কিছু রাখা আছে। তুমি তোমার পছন্দমতো মায়ের একটা শাড়ি নাও, আমি চাই মায়ের একটা চিহ্ন তোমার কাছে থাকুক। মা খুব ভালোবাসতো তোমাকে, তুমি মায়ের চিহ্ন নিয়ে যাও।

বললাম, টুম্পা শাড়ি নিতে হবে না। মায়ের চিহ্ন সযত্নে থাকুক তোর জন্য। কমলদি আমার হৃদয়ে থাকবে।
টুম্পা বললো, মামী তুমিও তো আমার মা, মায়ের চেয়ে তো কম না। প্লিজ, আমি চাই মায়ের একটা শাড়ি তুমি নাও।

আলমারির দরজা অর্ধেক খোলা, ভেতরে অন্ধকার। অঞ্জনদা সবে ফোনের টর্চ জ্বালিয়েছেন যেন আমি আলমারির ভেতরটা দেখতে পাই। আমি অঞ্জনদাকে থামিয়ে দিলাম। আলমারির অন্ধকার তাকে হাত ঢুকিয়ে প্রথম যে প্যাকেটে হাত স্পর্শ করলো, সেই প্যাকেটটাই টেনে নিলাম। প্যাকেটের গায়ে আলো পড়তেই আমি চমকে গেলাম। শাড়ির গায়ে লেখা, ” ভালোবাসি মা”! আমার চোখের সামনের দেয়ালে কমলদির যে ছবিটা আছে, এই শাড়িটাই উনার পরনে। টুম্পা বললো, মামী, এই শাড়িটা গত বছর মা’কে মাদার’স ডেতে দিয়েছিলাম। এটাই আমার দেয়া শেষ শাড়ি, এটাই মায়ের শেষ ছবি। এরপর তো মাকে নিয়ে হাসপাতাল আর বাসা করেই কেটে গেলো।

অনেকক্ষণ চোখের জল আটকে রেখেছিলাম, আর আটকাতে পারলাম না। চোখ ভিজে গেলো। টুম্পাকে বললাম, তুই একটু আগেই বললি, আমি তোর মায়ের চেয়ে কম না। এইজন্যই বোধ হয়, এই শাড়িটাই আমার হাতে এসেছে। আমেরিকা ফিরে এসেছি। শাড়িটা খুব যত্ন করে রেখেছি।

আজ এসেছে সেই লগন। ‘ভালোবাসি মা’ শাড়িটা পরে ভিডিও কল করেছি টুম্পাকে। গত পরশু টুম্পার বাবা লন্ডন গেছেন মেয়ে জামাই নাতনির সাথে দেখা করতে। মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য গেছেন, তাই টুম্পা সপরিবারে বাবাকে নিয়ে লন্ডন শহর ঘুরছে। ভিডিও কলে আমাকে ওর মায়ের শাড়িতে দেখে কী যে খুশি, কী যে খুশি। বললাম, ‘ভালোবাসি মা’ শাড়ি আর টিপ পরে নেপালি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ খেতে যাচ্ছি। এই প্রথম মনে হলো, সন্তানের কাছে মাদার’স ডের মান রাখতে পেরেছি।

মুক্তিযোদ্ধা আলীম ভাই

mithuu মুক্তিযোদ্ধা আলীম ভাই আমাদের খুব ভালো বন্ধু। পেশায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, থাকেন আমাদের শহর থেকে তিরিশ মাইল দূরের আরেক শহরে। সপ্তাহে কমপক্ষে দুই দিন আলীম ভাই আমাদের বাড়িতে আসেন। আমার উত্তমকে তিনি রঞ্জুদা ডাকেন, আমাকে মিঠু। খুব সহজ সরল মনের এক মানুষ আলীম ভাই, আমাদের বাড়িতে আসলেই নাকি উনার মনে হয়, আপন ভাইয়ের বাড়িতে এসেছেন। রঞ্জুদার সাথে বসে রাজনীতির গল্প, অর্থনীতির গল্প করেন, টিভি তো চলতেই থাকে, খুব ভালো মুভি থাকলে একসাথে দেখেন। দেশী খাবার, দেশী ভাষায় গল্প চলতেই থাকে। আমি উনার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো শুনি। আমার লেখা ” চোখ যায় যদ্দুর’ বইটায় উপহার বাণীতে উনাকে মুক্তিযোদ্ধা সম্বোধন করেছিলাম, খুশীতে আলীম ভাইয়ের চোখে জল চলে এসেছিলো।

আমাদের বাড়িতে আলীম ভাই সকালেই আসুন অথবা বিকেলে, সন্ধ্যেবেলাটা উনি মিস করেন না। কারণ সন্ধ্যেবেলায় আমি মাথায় ঘোমটা দিয়ে প্রদীপ আর ধূপকাঠি হাতে সারাবাড়িতে সন্ধ্যাবাতি দেখাই। আমাকে এই সাজে নাকি খুব পবিত্র স্নিগ্ধ মমতাময়ী মায়ের মতো দেখায়। সারা ঘরে বাতি দেখানোর পর প্রদীপ আলীম ভাইয়ের সামনে নিয়ে ধরতে হয়, আলীম ভাই দুই হাত উপুর করে প্রদীপের শিখায় হাত দুটো বুলিয়ে তা নিজের মাথায় আর গায়ে মাখেন। এটা উনি করবেনই, আমি একবার ভুল করে প্রদীপ উনার কাছে না নিয়েই ঠাকুরঘরে ফিরে যাচ্ছিলাম। আলীম ভাই আমার নাম ধরে ডেকে বললেন, মিঠু আজ তো আমি প্রদীপের আলো পাইলাম না!

সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে সারাবাড়ি আলো দেখানোর এই দৃশ্যটা নাকি আলীম ভাইকে উনার শৈশবে টেনে নিয়ে যায়। উনার ছেলেবেলায় উনার নানীকে, আম্মাকে দেখেছেন মাথায় কাপড় দিয়ে সন্ধ্যাবেলায় বাতি জ্বালিয়ে সারাবাড়ি দেখাতেন। আর উনাদের প্রতিবেশী হিন্দু বাড়িতে দেখতেন, মাসিমা কাকিমারা প্রদীপের শিখা বাচ্চাদের মাথায় গায়ে বুলিয়ে দেয়। আলীম ভাইয়ের কাছে এই দৃশ্যটা খুব ভালো লাগতো। আমাকে সন্ধ্যাবেলায় এই সাজে দেখে উনার ছেলেবেলার নানী আম্মা মাসিমা কাকিমাদের কথা মনে পড়ে!

গতকালও আলীম ভাই এসেছিলেন দুপুরের আগে রঞ্জুদার সাথে দেখা করতে। রঞ্জুদা কোলোনোস্কোপি করিয়ে বাড়ি ফিরেছেন, তাই রঞ্জুদার শরীর কেমন তা দেখতে আসা। এসেই বললেন, আরে আমার রঞ্জুদা তো একদম ফিট আছে। চলেন রঞ্জুদা, আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে আমরা আজ রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে আসি। আমি বললাম, আলীম ভাই, আমি তো পেঁয়াজ দিয়ে৷ চিনিগুড়া চাল আর মুসুরের ডালের খিঁচুড়ি রেঁধে ফেলেছি, আলুভাজা ডিমভাজা দিয়ে খিঁচুড়ি খান। রেস্টুরেন্টে অন্য একদিন খাওয়া যাবে। আইটেমের নাম শুনেই আলীম ভাই আবার শৈশবে চলে গেলো। আরে মিঠু, আমার আম্মা মুসুরের ডাইলের খিঁচুড়ি রানতো, সাথে ডিম ভাজা। আহা, অমৃত।

তারপর যথারীতি সন্ধ্যা হয়ে এলো, আমি পূজার পোশাক পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে সারা বাড়ি দেখিয়ে আলীম ভাইয়ের সামনে প্রদীপ ধরলাম। আলীম ভাই প্রদীপের শিখা মাথায় গায়ে মেখে বললো, আচ্ছা মিঠু, আমার আম্মা খালা নানীকে দেখেছি সন্ধ্যার আগেই কাপড় পালটে ঠিক এমন করেই ঘোমটা দিয়ে অজু করে নামাজ পড়তে বসতো। আপনি তো আধুনিক যুগের মেয়ে, আপনিও সন্ধ্যার পূজার সময় মাথায় ঘোমটা দেন, তার মানে হিন্দু মুসলমানের একই নিয়ম? দুই ধর্মেই মাথায় কাপড় দিতে হয় সবাইরে?

বললাম, ধর্ম দুইটা হলে কি হবে, মাথায় কাপড় দিয়ে যাঁরে স্মরণ করি, তিনি তো এক এবং অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা। আমরা দুই ধর্মের মানুষেরা নিজেরা কাইজ্জা ঝগড়া করে তাঁরে দুই নামে ডাকি। তাতে তো উনার শ্রেষ্ঠত্ব দুই ভাগ হয় না। দিনের একটা সময়ে তো দুই ধর্মের মানুষই আল্লাহ আর ভগবান নামের একই সৃষ্টিকর্তার কাছে মাথা নত করে কিছু সময়ের জন্য আত্মনিবেদন করে। সারাদিনের করা ভুল ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চায়, সকলের মঙ্গল কামনা করে। আসলে সৃষ্টিকর্তার ঊদ্দেশ্যে মাথা নত করার সময় মাথায় ঘোমটা দিতে হয় চুলগুলো ঢেকে রাখার জন্য, নইলে মনটাকে পুরোপুরি সঁপে দেয়া যায় না, মাথার চুল মুখের সামনে পিছনে এসে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটায়।

এই জন্যই হিন্দু মুসলমান সকল নারীই সন্ধ্যাবেলা আরাধনা অথবা নামাজ পড়ার সময় মাথায় ঘোমটা দেয়, অই সময়ে তাদের দিকে তাকালে আপনার মতো অনেকেরই মনটায় পবিত্র বোধ হয়। আলীম ভাই শুধু বললেন, ফ্যানটাসটিক। দারুণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। চলেন, তাইলে কালকেই রেস্টুরেন্টে খেতে যাই, নেপালি রেস্টুরেন্টে।

বললাম, আলীম ভাই, আমাকে এই সাজে দেখলেই আপনার আম্মার কথা মনে পড়ে। আগামী রবিবার মাদার’স ডে। রবিবারেই বরং রেস্টুরেন্টে খাওয়ান, একজন মা হিসেবে নিজেকে সম্মানিত বোধ করার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাই না।

ফেলনা থেকে খেলনা!

34 সেদিন ওয়ালমার্ট গার্ডেন সেন্টারে গেছিলাম, সস্তা দামের বেশ কিছু ফুলের চারা ট্রলিতে তুলেছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, গার্ডেন সেন্টারের ফ্লোরে জল কাদায় মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে এই রঙিন পাতাগুলো। এসোসিয়েট যখন গাছে জল দিয়েছে জলের আঘাতে কিছু পাতা ছিঁড়ে পড়ে গেছে। আমি জলকাদা থেকে প্রায় নেতিয়ে যাওয়া পাতাগুলো তুলে নিলাম। একজন এসোসিয়েটকে দেখিয়ে বললাম, এগুলো আবার টবে পুঁতে দাও, বেঁচে যাবে।

এসোসিয়েট বললো, ধুর এগুলো আরেকটু পরে বস্তায় ভরে ফেলে দেবো। আমি ওগুলো এসোসিয়েটের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে অন্য ফুলের চারার সাথে বাড়ি নিয়ে এলাম। বাড়িতে এনে পচা-ভালো সবকয়টা পাতাকে অনেক কসরত করে ঠিকই বাঁচিয়ে ফেলেছি। আগামীকাল আমার উত্তমের কোলনোস্কোপির তারিখ, আজ তাকে সারাদিন তরল খাবার খেতে হবে। তাই আজ রান্নাবান্নার ঝামেলা ছিলো না, উত্তমের জন্য সুগন্ধি লিকার চা, মুসুরের ডালের ক্লিয়ার স্যুপ আর মুরগির ক্লিয়ার স্যুপ বানাতেই চূলা অফ। জি বাংলার সিরিয়ালগুলোও বিকেলের আগেই দেখা হয়ে গেছে।

মনটা ফুরফুরে লাগছিলো তাই। বসে গেলাম কমপিউটারে। মাথার মধ্যে অনেক চাপ, কত লেখা জমে আছে, শুরুই করতে পারছিলাম না। আজ শুরু করলাম, একটা লেখা শেষ করতেই দেহ থেকে ক্লান্তি চলে গেলো। খেয়াল হলো, আজ সারাদিনে ঘুমও আসেনি। তার মানে, আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছি। সন্ধ্যের পর মনে হলো, সৃজনশীল কিছু করা যাক। আমি ভুলেই গেছিলাম, কৈশোরে আমাদের সাদামাটা সংসারে আমি নিজের মনেই মূল্যহীন কিছু জিনিসপাতি জোগাড় করে অমূল্য শিল্পকর্ম তৈরি করতাম। যেমন আমাদের ঘরে সোফাসেট ছিলো না৷ টিভি ছিলো না, ফ্রিজ তো ছিলোই না, ছোটো একটা বুকসেলফ ছাড়া দর্শনীয় কিছুই ছিলো না। বুকসেলফটাও মায়ের গল্পের বইয়ে ঠাসা থাকতো, বুকসেলফের উপর ফুলদানি রাখার জায়গাও ছিলো না।

অথচ আমার খুব ইচ্ছে করতো সুন্দর সুন্দর জিনিস দিয়ে ঘর সাজাই। কিন্তু কি দিয়ে সাজাবো, বই দিয়ে তো ঘর সাজানো যায় না। আমরা তখন কালি কলম দিয়ে লিখতাম। কালি থাকতো দোয়াতে, দোয়াত খালি হয়ে গেলে আমার মামীকে দিয়ে দিতাম। মামী ফেরিওয়ালার কাছে পুরানো কাগজ, কালির দোয়াত সের দরে বিক্রি করে দিতো। একদিন মাথায় এলো, আমাদের ফুলদানি নেই, শো কেইস নেই। তাতে কি, কালির দোয়াত আছে, কাপ প্লেট, আয়না চিরুনি জবাকুসুম তেলের বোতল, বসন্ত মালতী লোশন, মায়ের সিঁদুরের কৌটো, তিব্বত স্নো, পন্ডস পাউডারের কৌটা রাখার জন্য তারজালি দেয়া তিন তাকের একট মিটসেফ তো আছে।

34j কালির দোয়াতটাকেই তো ফুলদানি বানাতে পারি, তাজা ফুল কোথায় পাবো, প্লাস্টিকের ফুল আমার পছন্দ না। স্কুলের মাঠে দেখেছি মাঠ জুড়ে দূর্বা ফুল, কাশফুলের মতোই দেখতে। নিয়ে এলাম এক মোঠা দূর্বা ফুল। কালির দোয়াতে দূর্বাফুল ভরে মিটসেফের উপরের তাকে বসাতেই মনে হলো, আমাদের সাদামাটা ঘরটাকে খুব সুন্দর লাগছে। এর কয়দিন পর রান্নাঘর থেকে মায়ের ডাক এলো। মায়ের স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে, একা হাতে রান্নার কাজ কুলিয়ে উঠতে না পারলেই মা আমাকে ডাকতো। ছোটোবেলা থেকেই রান্নাঘর আমার খুব প্রিয় স্থান, মন্দিরের মতো। কাজেই মা ডাকলে আমি খুশি হতাম।

সেদিন মা’কে ডিম ভেঙে ফেটিয়ে দিতে হবে। প্রথম ডিমটা হাত ফসকে পড়ে ঠাস করে ফেটে গেলো। আমার হড়বড় কাজে মা অসন্তুষ্ট হলো। তাই দ্বিতীয় ডিমটা খুব সাবধানে একটু একটু করে ফাটানোর চেষ্টা করতে গিয়েই মনে হলো, ডিমের খোসাটা আস্ত রেখে যদি ডিমটা ভাঙতে পারি, তাহলে এই খোসাটার গায়ে পেন্সিল দিয়ে এঁকে পুতুলের মুখ বানাতে পারবো।

যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিলো। সব হিন্দু বাড়িতে তখন এঁটোকাঁটা আমিষ নিরামিষ বাছবিচার করা হতো। সেই হিসেবে ডিম আমিষ, রান্নাঘর থেকে ডিম কোনোভাবেই পড়ার টেবিলে যাওয়ার কথা নয়। কারণ পড়ার টেবিলে বই পুস্তক থাকে, সেখানে দেবী সরস্বতীর অধিষ্ঠান। আমিষ তো পড়ার টেবিলে যেতে পারবে না, পড়ার টেবিল ছাড়া আমি ডিমের খোসায় চিত্রকর্ম করবো কি করে! আমার একটা সুবিধা ছিলো। এঁটোবাসি মাও মানতেন, তবে খুব কড়া বাছবিচার করতেন না। জামায় ভাত পড়লে আমার মামী যেখানে অই জামা পাল্টাতে বাধ্য করতো, মা সেটা করতো না। ভাতটা ঝেড়ে জামার অই জায়গাটা একটু জল দিয়ে মুছে ফেললেই সাতখুন মাফ। আর আমার ভাইদের বেলায় ওটুকুও করতে হতো না, ছেলেদের বেলায় সব ভুলই ক্ষমার যোগ্য ভুল।

তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, স্কুলে যাওয়ার আগে নিজের টিফিন নিজেই বানিয়ে নেই। রুটি আলুভাজা, কখনো ঘি দিয়ে রুটি মাখিয়ে তার উপর চিনি ছড়িয়ে নেয়া, সবই নিজেকে করতে হতো। মা একা হাতে মাছ তরকারি কেটে, মশলা বেটে সকাল দুপুরের রান্না সেরে সকাল ১১টার স্কুল ধরতো। আমার টিফিন কি হবে, এসব দিকে নজর দিতে পারতো না। তাই ডিমের খোসার গায়ে ছবি আঁকবো না কি করবো, ডিমের খোসা পড়ার টেবিলে তুলবো না ফেলে দিবো, এসব দিকে মায়ের নজর ছিলো না। ডিমের খোসাগুলো ধুয়ে মিটসেফের এক কোণে শুকাতে দিয়ে স্কুলে চলে গেলাম। স্কুল থেকে ফিরেই বসে গেলাম ডিমের খোসা নিয়ে। মায়ের কাছে পরীক্ষার খাতা দেখার জন্য লাল নীল রঙের পেন্সিল ছিলো। সেই লাল নীল পেন্সিল আর আমার কাজল পেন্সিল দিয়ে এঁকে ফেললাম একটা মেয়ের মুখ, একটা ছেলের মুখ। নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

সেই দূর্বা ফুলের দোয়াতের পাশে সাজিয়ে রাখলাম ডিমের শিল্পকর্ম। আমার শিল্পকর্ম নিয়ে ঘরের কেউ মাথা ঘামাতো না। তবে এরপর যতবার ডিম ভাঙার দরকার হতো, হয় মা আমাকে ডাকতো, নয়তো মা নিজেই যত্ন করে ডিমের খোসা আস্ত রেখে ডিম ভেঙে খোসাগুলো আমার জন্য তুলে রাখতো। এরপর তো আমার চিত্রকর্ম শুধু ছেলে আর মেয়ের মুখে সীমাবদ্ধ থাকলো না। ডিমের খোসাতেই লাল নীল কালো পেন্সিলে আকাশ পাখি নদী গোলাপ ফুল কত কি যে এঁকেছি আর অই মিটসেফে সাজিয়ে রেখেছি।

ক্লাস টেনে উঠতেই ডিমের খোসা পর্ব শেষ, ততদিনে নতুন শিল্পকর্ম শুরু করেছি। চাল ডাল কালোজিরা মেথি মৌরি দিয়ে গ্রিটিং কার্ড বানানোর চেষ্টা। আর্ট পেপার তো তখন ছিলোই, স্কুল থেকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম, গ্রাফ আঁকার জন্য তো স্কুল থেকেই আর্ট পেপার দেয়া হতো। আর্ট পেপারের বাড়তি টুকরোগুলো ফেলে দিতে মন চাইতো না। তখনই কার্ড বানানোর চিন্তা মাথায় এলো।

আর্ট পেপার দুই ভাঁজ করে কার্ডের মতো শেইপ করে কার্ডের উপরে আঠা দিয়ে তার উপর মুসুরের ডাল, চাল, কালোজিরা জিরা মেথি দিয়ে এতো সুন্দর সুন্দর ডিজাইন করতাম। কেউ ছিলো না আমার যাকে গ্রিটিং কার্ড দেয়া যায়। আমিই বানাতাম, আমার কাছেই রেখে দিতাম।

আজ এতো বছর বাদে সেই কৈশোরের কথা মনে পড়ে গেলো। রান্নাঘরে গেছি, ছোটো একটা জলের খালি বোতল দেখতে পেলাম। বোতলটা ট্র‍্যাশ ক্যানে ফেলতে গিয়েও থেমে গেলাম। মাথার ভেতর কৈশোর জেগে উঠেছে। পেঁয়াজ কাটার ছুরি দিয়ে বোতলটাকে কাটলাম। কায়দা করে ফুলদানির মতো একটা অবয়ব বানালাম। এরপর মাটি দিয়ে, বেঁচে ওঠা রঙ বাহারের পাতা দিয়ে তৈরি করে ফেললাম ইন্ডোর প্ল্যান্ট পট। টেবিলে ছিলো অর্কিডের শুকনো পাপড়ি, দুটো পাপড়ি লাগিয়ে দিলাম পটের গায়ে।

ফেলনা থেকে খেলনা বানানোর সাথে সাথে আমার ভেতরে হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠলো।

উজ্জ্বল স্মৃতির উজ্জ্বল গল্প!

rty ২০১৭ সালের কথা। মৃত্যুপথযাত্রী বাবা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরেছেন। হসপিটাল থেকে একটু সুস্থ করে চলৎশক্তি রহিত বাবাকে বাড়িতে আনা হয়েছে। বাবার চার সন্তানই বাবার সামনে উপস্থিত। নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন এবং তিন সুপুত্র আর হাড়জ্বালানো কন্যাটিকে সারাক্ষণ চোখের সামনে দেখতে পেয়ে রাশভারী রাগী স্বভাবের বাবা শিশুর মতো সহজ সরল হয়ে উঠেছেন। চেষ্টা করছেন শোয়া অবস্থায় কারো সাহায্য ছাড়া নিজে নিজে এপাশ ওপাশ করতে। হাড় জ্বালানো কন্যা সামনে থাকলে বাবা নিজে নিজে শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করেন, কন্যার কাছে প্রমাণ করতে চান, ৯০ বছর বয়সেও বাবা কারো সাহায্য ছাড়াই চলতে পারেন!

বিশেষ করে যখনই তাঁর পুত্রদের কাছে পান, নিজে নিজেই শোয়া থেকে উঠে বসেন। পুত্ররা বাবার কেরামতি দেখে অবাক হয়, আশ্বস্ত হয়। সাথে যোগ হয়েছে, কথা বলা। শিশু যখন নতুন কথা বলতে শিখে, সারাক্ষণ টর টর করে, বাবাও তেমনি। হাসপাতালে তো অচেতন ছিলেন দিনের পর দিন, তাই নতুন জীবন ফিরে পেতেই কত রকমের কথা বাবার ঠোঁটের আগায় চলে আসতো! কন্যাকে কিছুটা সমঝে চললেও পুত্রদের কাউকে কাছাকাছি পেলেই কাছে ডেকে গল্প করতো।

সেদিনও বড়ো পুত্র, মেজো পুত্রকে বাবার কক্ষে প্রবেশ করতে দেখেই বাবা নিজে নিজেই শোয়া থেকে উঠে বসেছেন। বড়ো পুত্রের হাতে চানাচুর মুড়ি ভর্তি বাটি, বাবাকেও সাধলো মুড়ি। বাবা শিশুর মত উচ্ছ্বল হয়ে সাধু চলিত মিলিয়ে বলল, “অবশ্যই খামু। এমন সুযোগ জীবনে আর আসিবে না। আমার বিদেশ ফেরত পুত্র নিজের বাটি থেকে আমাকে চানাচুর মুড়ি খাওয়াচ্ছে “।
বাবার কথা শুনে আমরা খুব মজা পাচ্ছিলাম।

এরপর দুই পুত্রকে কাছে বসালেন, দুই পুত্রের সাথে বাবা তাঁর ছেলেবেলার গল্প জুড়ে দিলেন। বাবার ছোটো পুত্র তখন নরসিংদী কলেজে অধ্যাপনা নিয়ে ব্যস্ত, আর আমি দুই কান খোলা রেখে পাশের ঘরে ল্যাপটপ খুলে বসেছি এবং বাবা পুত্রের গালগল্প শুনছি। বাবার বলা গল্প থেকে বাবার জীবনের না-বলা অনেক তথ্য উদ্ধার করলাম।

** বাবার ঠাকুরদাদা ছিলেন অঞ্চলের নামকরা তালুকদার, ঠাকুরদাদার মেজাজও ছিলো তালুকদারি। বিশাল বাড়ি, বাড়ি ভর্তি জ্ঞাতি গুষ্ঠি, ভাই বোন স্বজনের মেলা। ঠাকুরদাদার বয়স বাড়ে, বয়স বাড়ে, বয়স বাড়ে সেই সাথে ধীরে ধীরে তালুকদারি চলে যায়, স্বজনের ভীড় কমে যায় শুধু বংশের তালুকদারী তেজটাই রয়ে যায়। সেই তেজই পুরুষানুক্রমে বাবার মধ্যেও এসেছে। এরপর বললো, বাবার বাপ কাকাদের গল্প। নিজের বাবার সাথে বেশী সময় কাটানোর সুযোগ হয়নি, কারণ বাবার বয়স যখন তেরো, বাবার বাবা মারা যান।

এক পুরুষে তালুকদারি ফুরিয়ে গেলেও, তালুকদার বাড়ির ছেলেমেয়েদের জেঠা, কাকা পিসীদের সাথে মধুর সম্পর্ক টিকে ছিলো। বাবার ছিলেন পাঁচ কাকা। সোনা কাকা, ধন কাকা, সুন্দর কাকা, সেইজা কাকা, দুদু কাকা।
বাবার সকল কাকাদের তালুকদারি তেজ থাকলেও সেইজা কাকা ছিলেন ব্যতিক্রম। সেইজা কাকা জলের মতো সরল সহজ। সেইজা কাকা ছিলেন গ্রামের শত বর্ষ পুরনো স্কুলের শিক্ষক। সেইজা কাকার মধ্যে শিশুতোষ সরলতা ছিলো। ফলে ছোটো ছোটো ভাতিজা ভাতিজি ভাগ্নের সাথে খুব ভাব ছিলো।

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই ভাতিজা ভাতিজিদের হাঁক পেড়ে ডাকতেন। স্কুলে শিক্ষক রুমে যে সকল গল্প শুনে আসতেন, বাড়ি ফিরে ভাতিজাদের সাথে সেসব গল্প করতেন। সেই সব শোনা গল্পের মধ্যে একটা গল্পের কথা বাবার আজও মনে আছে। গল্পটা এমনঃ

লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কে ডি ঘোষ মহাশয়। যে সময়ের কথা, তখন ভারতবর্ষের গ্রামবাংলার বিভিন্ন স্কুলের ইন্সপেকশনে বিলাত থেকে আসতেন বড়ো বড়ো স্কুল কলেজের শিক্ষকরা। একবার এক স্কুলের ইন্সপেকশানে এসে কে ডি ঘোষ মহাশয় চুপি চুপি পেছনের দরজা দিয়ে শ্রেণীকক্ষে ঢুকে ছাত্রদের সারিতে একেবারে পেছনের বেঞ্চে বসলেন। সেই ক্লাসে শিক্ষক মহাশয় তখন ছাত্রদের একেকজনকে দাঁড় করিয়ে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছেন, উত্তর সঠিক না হলে উনার হাতের বেত ছাত্রের পিঠে মারছেন।
এক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন,
“জগা, বল দেখি, চিরুনি মানে কি?
জগা প্রথমে কিছু বলে না, ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
শিক্ষক হুংকার ছাড়েন, চিরুনি মানে বলতে না পারলে বেত পিঠে ভাঙবো।
জগা বলে, “চিরনি মানে ফারুনি”
শিক্ষক তেড়ে আসেন, “কী বললি? চিরুনি মানে ফারুনি? আমার সাথে রসিকতা?”

জগার পিঠে বেত পড়ার আগেই ছাত্রদের মাঝ থেকে ইন্সপেক্টর কে ডি ঘোষ উঠে দাঁড়ালেন, শিক্ষককে বলেন, ” থামুন। এই ছাত্রকে বেত্রাঘাত করবেন কেন? সে কী ভুল বলেছে? চিরুনি মানে সে সঠিকই বলেছে। চিরুনি মানে তো ফারুনিই হয়। কাঠ চেরা হয় যা দিয়ে, তাকে বলে চিরুনি। কাঠ চেরা মানে কাঠ ফাড়া। তাহলে আপনিই বলুন, চিরুনির আরেক অর্থ কি দাঁড়ায়? এই ছাত্রটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। সে তার বুদ্ধি দিয়ে চিরুনির সমার্থক শব্দ বের করেছে। কোথায় তাকে পুরষ্কৃত করবেন, তা নয়, তাকে তিরস্কার করছেন!”

**জগা নামের সেদিনের বালক পরবর্তিতে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু হয়েছিলেন।**
বাবা গল্পে আরও যোগ করলেন,
“আমরা যখন প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম, এই ইন্সপেক্টর কে ডি ঘোষ কিন্তু আমাদের স্কুল ইন্সপেকশানেও আসতেন। এবার বুঝে দ্যাখ্, তখনকার দিনের শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন ছিলো! অক্সফোর্ডে যিনি অধ্যাপনা করেছেন, তিনি গ্রামের স্কুল ইন্সপেকশানে আসতেন। ভাবতে পারিস? আর দুই পাতা ইংলিশ পড়ে আজকালের পোলাপান ডক্টরেট ডিগ্রীর গরম দেখায়!”

কিছুদিন পর বাবা হামাগুড়ি দিয়ে বিছানা থেকে নেমে নিজে নিজেই চেয়ারে বসেন, নিজে হাতে ভাত মেখে খান, চায়ের কাপে চুমুক দেন, আমাদের আশ্বস্ত করেন খুব তাড়াতাড়ি তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটবেন। আমরা চার ভাইবোন আবার যার যার ঘরে ফিরে যাই। বড়দা আর আমি চলে আসি বাবার দেশের বাইরে যার যার নিজের দেশে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমি আবার দেশে যাই। ততোদিনে বাবা আবার আগের ফর্ম ফিরে পেয়েছেন। ঘরে নিয়মিত ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করেন, পত্রিকা পড়েন, কন্যার লেখা বই শিয়রে রেখে ঘুমান।
************************
**বাবা আমাদের ছোটোবেলায় নিজেই আমাদের প্রত্যেককে ইংলিশ পড়াতেন। পড়ানোর সময় যখন কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড হার্ভার্ডের নাম বলতেন, বাবার গলার স্বরে ঝরে পড়তো সমীহ, মুগ্ধতা। সাধ্য তো ছিলো না ওখানে যাওয়ার, হয়তো মনে মনে কল্পনার জাল বুনতেন, হয়তো সাধ হতো কেমব্রিজ অক্সফোর্ডের মাটি ছুঁয়ে দেখার!

২০১৯ সালের জুলাইয়ের শেষে ছয়দিনের সফরে বন্ধু বন্যা আর আমি লন্ডন গেছিলাম। আমার মাসতুতো বোনের বাড়িতে উঠেছি। বোনের বর প্রথম দিনেই আমাদেরকে নিয়ে গেছিলেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে।
কেমব্রিজে পৌঁছে প্রথমেই যাঁর মুখ মনে পড়েছিলো, তিনি আমার বাবা। প্রচুর ছবি তুলেছিলাম। ফেসবুকে তখন ব্যান ছিলাম তাই ছবিগুলো পোস্ট করতে পারিনি। ছবিগুলো পোস্ট করতে পারলে হয়তো আমার মেজদা অথবা ছোটো ভাই বাবাকে কেমব্রিজের ক্যাম্পাসে দাঁড়ানো বাবার হাড়জ্বালানো কন্যার ছবি দেখাতে পারতো!

আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, ২০২১ সালে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বাবার সাথে সেলিব্রেট করবো! তখন কেমব্রিজের ছবি, কুইন ভিক্টোরিয়ার বাড়ির ছবি, বাকিংহাম প্যালেসের ছবি দেখাবো! ২০২০ সালের সেপ্টেমবারে বাবা মারা যান। আসলে কিছু কিছু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়! এবং সেটাই ভালো। স্বপ্নের অতীত বর্তমান ভবিষ্যত নিয়ে খেলা করতে করতেই আমার অবসর সময় বেশ কেটে যায়।

মৃত্যু বুঝি আসে!

ghj

মৃত্যু এখন আমাদের দলে হানা দিতে শুরু করেছে। মৃত্যু এলে মরে যেতে হয়। যদি কখনো সুযোগ না পাই, কয়েকটা কথা এখানেই বলে রাখি। আমি সাধারণত জেনে বুঝে ইচ্ছে করে কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করি না, কারো মনে আঘাত দেয়ার সুযোগ খুঁজি না, মনের অজান্তেও কারো ক্ষতি করি না।

হ্যাঁ মতে না মিললে একটু ঝাঁজিয়ে উঠি, অভিমান করি, দুই দিন গাল ফুলিয়ে রাখি। তারপরেও আমার আচরণে, কথায় কেউ কেউ নিশ্চয়ই মনে ব্যথা পায়। আমি যদি বুঝতে পারি আমার উপর কারো অভিমান হয়েছে অথবা আমার কোনো কথায় আহত হয়েছে, আমি অনুতপ্ত হই, তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেই। আমি তো দেবী নই, শয়তানও নই। রক্ত মাংসে তৈরি মানুষ। অসৎ নই ঠিক, তার পরেও কাজে কথায় ভুল ভ্রান্তি তো হয়ই।

ফেসবুকে সম মানসিকতার নারী পুরুষ কয়েকজন মিলে আমাদের একটা বন্ধু পরিবার গড়ে উঠেছে। সেই পরিবারে বয়সে আমার চেয়ে বড়ো সদস্য আছেন, বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোটো সদস্য আছে, আর আমরা কাছাকাছি বয়সীরা তো আছিই। ২০১৯ সালে দেশে যাওয়ার পর আমাদের দলের প্রায় সকলের সাথেই দেখা হয়েছে, আড্ডা হয়েছে।

কয়েক মাস পর সেই দল থেকে প্রথম চলে গেলেন মাসুদ করিম ভাই। মাসুদ করিম ভাই চলে যাওয়ায় ধাক্কা খেয়েছি প্রচন্ড, কারণ আমেরিকা ফিরে আসার দিন মাসুদ ভাই খুব করে চাইছিলেন আমার সাথে একটু দেখা করার জন্য। আমেরিকা ফেরার দিন আমি এমনিতেই মানসিকভাবে কাতর থাকি, তাই মাসুদ ভাইয়ের সাথে বাইরে কোথাও বসে চা খাওয়ার চিন্তাই করিনি। মাসুদ ভাই হাল ছাড়েননি, তিনি রাত বারোটার সময় এয়ারপোর্টে গিয়ে আমার সাথে দেখা করতে চাইলেন। উনার এই আকুলতার প্রতি আমি সম্মান দেখাতে পারিনি। বরং রাত বারোটায় উনি এয়ারপোর্টে এসে আবার বাসায় ফিরতে উনার কষ্ট হবে ভেবেছিলাম, তাই উনাকে এয়ারপোর্টে আসতে মানা করেছি।

তার কয়েকমাস পরেই মাসুদ ভাই মারা যান। মাসুদ ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে মর্মাহত হওয়ার পাশাপাশি খুব গ্লানি বোধ হয়েছিলো। মাসুদ ভাই কি মৃত্যুর গন্ধ টের পেয়েছিলেন, তাই কি শেষবার দেখা করতে চেয়েছিলেন! আহারে, আমার ব্যবহারে উনি নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছিলেন। এরপর সব কিছু মোটামুটি ঠিক চলছিল। করোনা এসেই আবার সব লন্ডভন্ড করে দিলো।
আমার আর দেশে যাওয়া হলো না।
২০২২ পর্যন্ত আমাদের দলের সকলেই ভালো ছিলো, কেউ কেউ করোনা আক্রান্ত হয়েও ফাইট দিয়ে সুস্থ হয়ে গেছে।

২০২৩ চলে এলো, চার বছর পেরিয়ে গেছে দেশে যাইনি। এত লম্বা সময় দেশে না যাওয়ার রেকর্ড আমার নেই। বাবাকে দেখতে যেতাম, ২০২০ সালে বাবা চলে যাওয়ার পর কি তবে আমার দেশে যাওয়ার তাড়া কমে গেছে? না, তা নয়। দেশে আমি এমনিতেই যাই, দেশে আমার ভালো লাগে, ধূলা বালি মশা মাছির সাথেই তো বড়ো হয়েছি, তাই ধূলা বালি, রাস্তা ভর্তি গিজগিজ করা মানুষেই আমি অভ্যস্ত। মাত্রই ভাবছিলাম আবার দেশে যাওয়ার কথা। সবার সাথে দেখা হবে, আড্ডা হবে। এবার আর কারো মনে ব্যথা দেয়ার মতো কাজ করবো না। সবাই মিলে মাসুদ ভাইয়ের জন্য একটু প্রার্থনা করবো।

শফি আজিম ভাই, আখতার ভাই, জাহিদ ভাই, ইদু ভাই, আতাউর ভাই, সুজিত দাদা প্রমুখ সকলেই আমার বন্ধু হিতাকাঙ্ক্ষী পরমাত্মীয়। কত দিন উনাদের সাথে দেখা হয় না, মেসেঞ্জারে মাঝে মধ্যে কথা হয়। এবার দেশে গেলে প্রত্যেকের বাড়িতে আমি নিজে গিয়ে দেখা করবো, আড্ডা দেবো।

ওমা, জানুয়ারির ১০ তারিখে আমার অতি প্রিয়জন ছোটো মেসোর মৃত্যুসংবাদ হজম করতে পারিনি, ১১ তারিখেই হাসপাতাল থেকে শফি ভাইয়ের স্ট্যাটাস, উনি হাসপাতালে।
অথচ আগের দিনই আমাকে উনি মেসোর মৃত্যুতে সমবেদনা জানিয়েছেন!

ইনবক্সে মেসেজ দিলাম, দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন, দেশে এসে জমিয়ে আড্ডা দেবো। শফি ভাই সাথে সাথে আমার কমেন্টে লাভ ইমো দিয়ে উত্তরে লিখলেন, হৃদযন্ত্র বিকল হতে হতে এই যাত্রায় বেঁচে গেছি রে দিদি।

সেই শফি ভাই ১৫ তারিখে মারা গেলেন। শফি ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদে ইদু ভাই শোক প্রকাশ করে কমেন্ট দিলেন। আতাউর ভাই গত পরশু দিনের আগের দিন ইদু ভাইয়ের বাসায় গেছেন, গল্পগুজব করেছেন৷ চা খেয়ে ফেরার সময় ইদু ভাই নিজেই আতাউর ভাইয়ের সাথে সেলফি তুললেন। তার পরদিন আতাউর ভাই শুনলেন, ইদু ভাই হাসপাতালের আইসিইউতে। আর আজ ইদু ভাইও চলে গেলেন।

এবার আমার ভয় করছে। মৃত্যু আমাদের দলের সীমানা চিনে ফেলেছে। হাতের কাছে যাকে পাবে, খপ করে ধরবে আর ঝোলার ভেতর ভরবে। এখন আর মৃত্যু সংবাদে আশ্চর্য হবো না। মৃত্যুকে আমার বেজায় ভয়, মৃত্যু থেকে পালিয়ে থাকতে চাই, তারপরেও জানি, মৃত্যু একদিন আমায় ঠিকই ধরে ফেলবে।

মৃত্যু যখন আমায় ধরে ফেলবে তখন তো কারো কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগও দিবে না! তাই এখানেই আজ আমি তাদের কাছে ক্ষমা চাইছি, আমার অনিচ্ছাকৃত ভুলে, আচরণে, কথায় যারা মনে ব্যথা পেয়েছেন।

আপনাদের ক্ষমা আমার মনের শক্তি। আগে ভাগেই সকলের কাছে ক্ষমা চাইছি কারণ মৃত্যু যখন আমায় ধরবে, আমি যেনো নির্ভয়ে হাসিমুখে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারি।

ছবি স্মৃতি

out.dtttt ছবিটি আমারই, ক্লাস নাইনে ওঠার পর তোলা হয়েছিলো। নবম শ্রেণীতে উঠলেই বোর্ডে নাম রেজিষ্ট্রেশন করতে হয়, তখন পাসপোর্ট সাইজ ছবি লাগে। খুব তড়িঘড়ি করে ছবিটি তুলতে হয়েছিলো। মার মা আমাদের ছবি তোলাতে ডি আই টি মার্কেটের প্রিন্স স্টুডিওতে নিয়ে যেতো।

সেদিন প্রিন্স স্টুডিওতে আমাকে নিয়ে যাওয়ার কেউ ছিলো না। মায়ের কথামতো আমি একা একাই চলে গেছিলাম ‘নাজ’ স্টুডিওতে। যদিও নাজ স্টুডিওতে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না। কারণ আমরা জানতাম, নাজ স্টুডিওতে ভালো ছবি তোলে না। আমার বাবা নিজের পাসপোর্টের জন্য ছবি তুলতে মা’কে কিছুই না বলে মাতবরি করে নাজ স্টুডিওতে গিয়েছিলো। বাবার ছবি দেখে আমরা বাবার সামনে তো কিছু বলিনি, আড়ালে হাসতে হাসতে শেষ। পুরা বাংলা সিনেমার ভিলেন তুলিপের মতো লাগছিলো।

সেই আমাকেই কিনা যেতে হলো ‘নাজ’ স্টুডিওতে!

আমার ছবি দেখে হাসার বদলে রাগে জেদে আমি নাঁকি কান্না শুরু করেছিলাম। “আমার চেহারা এইরকম না। আমার এই ছবি চাই না” — বলে রাগে গনগন করছিলাম। মা তারপর সান্ত্বনা দিয়েছিল, আরে এই ছবি তো রেজিস্ট্রেশন ফর্মে লাগবে, তোর বাবার মতো এই ছবি তো পাসপোর্টে দিতাম না। তোর পাসপোর্টের ছবি প্রিন্স স্টুডিওতে গিয়ে তুলিস।

আজ ছবিটা দেখে হিসেব করলাম, প্রায় চুয়াল্লিশ বছর আগের ছবি! অথচ মনে হয় সেদিন। ছবির সাথে আমার চেহারার মিল না থাকলেও বাম চোখের তিলটা ঠিকই দেখা যাচ্ছে। আর মাথা ভর্তি চুলের চিহ্ন!

পরনে ছিলো পলিয়েস্টার কাপড় দিয়ে তৈরি জামা, দুর্গাপূজার সময় কাদির মামার কাছ থেকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানানো। জামাটার ছিলো ঘটি হাতা, আর কোটের মতো কলার।

( কাদির মামাঃ আমার মামার বন্ধু, সেই হিসেবে আমাদের মামা।
কাদির মামা পাড়ার একমাত্র দর্জি, যাঁর আলাদা দোকান ঘর ছিলো না। রাস্তার ধারেই নিজের ঘর। সেই ঘরের জানালা ঘেঁষে পা মেশিন বসানো ছিল। স্কুলে আসা যাওয়ার পথে দেখতাম, কাদির মামা ঘট ঘট করে রাজ্যের জামা প্যান্ট সেলাই করছে, আর ঘরে কাদির মামার বউ, বাচ্চারা যার যার কাজ করছে। )

চুয়াল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে, স্কুলে যাওয়ার পথটা আছে তবে বদলে গেছে।
কাদির মামা বেঁচে আছেন কিনা জানি না, তবে কাদির মামার সেই রাস্তার ধারে টিনের ঘরটা নেই, ঘরের চিহ্নও নেই।
রাস্তার দুই পাশে এতো বড়ো বড়ো দালান, ফ্ল্যাট বাড়ি উঠে গেছে, কাদির মামার ঘরটা ঠিক কোন্ জায়গায় ছিলো, সেই নিশানাও হারিয়ে গেছে!

ট্রেজার!

riiitu

অনেক কাল আগলে রেখেছি তিন কন্যার স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটি লাইফে জেতা রাশি রাশি ট্রফি মেডেল সার্টিফিকেট। তিন কন্যারই একাডেমিক শিক্ষা জীবন আপাতত শেষ, এবার তাদের যত অর্জন সবই প্রত্যেকের নামে নামে র‍্যাপ আপ করা শুরু করেছি। বাড়ির বিভিন্ন স্পটে সাজানো ছিলো ট্রফিগুলো, বিভিন্ন কক্ষে যখন যেখানে পা দেবো মেয়েদের সাফল্যের স্বীকৃতি যেনো আমার চোখে পড়ে।

আজ সকালে যখন আমার বুক শেলফে সাজানো ঝকঝকে ট্রফিগুলো সরিয়ে আনছিলাম, এক কোণে পুরানো কালচে রঙের একটা ট্রফির দিকে নজর চলে গেলো। কালচে হয়ে যাওয়া ট্রফিটা আমার, বাংলাদেশে মায়ের কাছে ছিলো। দশ বছর আগে মা মারা গেলো, আমার ট্রফির গুরুত্ব ফুরিয়ে গেলো। মা চলে যাওয়ার পর আমি ট্রফিটা সাথে করে এনেছিলাম।

কারণ এই ট্রফির গুরুত্ব আর কেউ বুঝবে না, আমার বাবাও না। আমার বাবা শুধু একাডেমিক সার্টিফিকেটের গুরুত্ব দিতো, নাচ গান খেলাধূলা অভিনয় নিয়ে মাথা ঘামাতো না। ট্রফিটা মিসিসিপিতে এনে আমার উত্তম এবং কন্যাদের দেখিয়েছিলাম। তখন মিথীলা ছোটো, ট্রফির গুরুত্ব বুঝে ওঠেনি। মেয়েরা নিজেদের ট্রফিই ঠিক করে রাখে না, মায়ের ট্রফি নিয়ে আর কতটুকু উৎসাহ দেখাবে! তবে মুখে ওয়াও বলে এপ্রিসিয়েট করেছিলো।আমিও ট্রফিটা বুক শেলফের এক কোণে রেখে দিয়েছিলাম।

আজ কত কথা মনে পড়ছে। ছোট্টো বাড়ির চারদিকে স্মৃতির পাহাড় জমেছে। আজকাল নির্মোহ হতে চাইছি। স্মৃতি টিতি জমিয়ে রাখলে নির্মোহ হওয়া যাবে না। ঘরবাড়ি থেকে অতিরিক্ত জিনিস সরিয়ে ফেলতে চাইছি, আমার এই কাজে মিথীলা খুব হেল্প করছে। আমার এই ছোটো কন্যাটি একটু অন্যরকম, আধুনিক যুগের হয়েও পুরানোকে অস্বীকার করে না। বুড়ো মানুষ, ছেঁড়া কাঁথা, ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবি থেকে শুরু করে বাঙালির ডাল ভাত মাছ সুক্তো শাক সবই অন্তর দিয়ে গ্রহণ করার চেষ্টা করে।

এইজন্য আমি মিথীলার সাথে অনেক গল্প করি, আমার অনেক অনুভূতি শেয়ার করি, আমার ব্যথা বেদনা আনন্দ পাওয়া না পাওয়ার গল্প সবই শেয়ার করি। আমার নিত্য দিনের কাজে মিথীলা নিজ থেকে হেল্প করে। আমার পায়ে ব্যথা, গায়ে ব্যথা হলে ও অস্থির হয়ে যায় কিভাবে আমার ব্যথা কমাবে! রাবারের ফিতা বেঁধে আমার পায়ের এক্সারসাইজ করতে দিয়েছে থেরাপিস্ট, লেটেক্সে আমার কঠিন এলার্জি। থেরাপিস্টের দেয়া ফিতা পায়ে বাঁধলেই আমার সারা শরীরে চুলকানি শুরু হয়।

মিথীলা ছবি দেখে দেখে রাবারের ফিতে ছাড়াই আমার পায়ের এক্সারসাইজ করিয়ে দেয়। আমি আর্জেন্টিনার পাঁড় সাপোর্টার, মিথীলা ব্রাজিলের সাপোর্টার। প্রথম খেলাতেই আর্জেন্টিনা হেরে গেছে। আমার উত্তম কুমার অলরেডি বলছে, ধুর! ধুর! মিথীলা জানে, আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেছে, তাছাড়া ফেসবুকে ব্রাজিল সমর্থকদের ট্রল সহ্য করতে পারবো না। সাথে সাথে ও বসে গেলো ক্যালকুলেশন করতে। যেদিন আর্জেন্টিনা হারলো, সেদিনই ও বললো, ” মা, চিন্তা করো না। এখনও আর্জেন্টিনার চান্স আছে। যদি পোল্যান্ড আর মেক্সিকোর খেলা ড্র হয়, তবেই আর্জেন্টিনার পথ সহজ হয়ে যাবে। এবং আমি উইশ করি, পোল্যান্ড মেক্সিকো খেলা ড্র হবে”!
এবং সত্যি সত্যি পোল্যান্ড মেক্সিকো খেলা ড্র হলো!

ট্রফিটা হাতে নিলাম, মিথীলার সবে ঘুম ভেঙেছে। চাকরি শুরু করার আগে ইচ্ছেমতো ঘুমিয়ে নিচ্ছে। মিথীলা চোখ মেলেই দেখে আমি ওদের ট্রফি গুছাচ্ছি।
“মা, আমাকে ডাকোনি কেন? তুমি একা ঘর পরিষ্কার শুরু করেছো” বলে সে তড়বড় করে বিছানা থেকে নামার চেষ্টা করলো। আমার হাতে ধরা ট্রফির গায়ে লেখা সমস্ত লেখা কালচে হয়ে গেছে। বুঝতে পারছিলাম না, ট্রফিটা কত আগের! এটা কি স্কুলে পেয়েছিলাম না-কি ইউনিভার্সিটিতে! টিস্যু পেপার দিয়ে ঘষে ঘষে মুছলাম ট্রফিটা। এক পিঠে লেখা, নওয়াব ফয়জুন্নেসা হলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার নাম।
ততক্ষণে মিথীলার চোখ পড়েছে ট্রফিটার দিকে। জানতে চাইলো, কিসের ট্রফি।
বললাম, ইউনিভার্সিটির বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পাওয়া। এবং এই ট্রফিটা পেয়েছিলাম, ‘তিন পায়ে দৌড়’ রেইসে দ্বিতীয় পুরস্কার হিসেবে।

বাসায় যখন ট্রফি আনলাম, মায়ের মুখে সে কি হাসি! সেই ট্রফিটাই মা যত্ন করে রেখে দিয়েছিলো তাঁর ট্রেজার বক্সে! পরের বছর প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলাম ‘যেমন খুশী সাজো’ ইভেন্টে। অই ইভেন্টের ট্রফিটা মনে হয় হারিয়ে গেছে! মিথীলা অবাক হয়ে গেলো! ” মা, তুমি ইউনিভার্সিটিতে খেলাধূলা করতে? তুমি দৌড়াতে? কমপিটিশনেও পার্টিসিপেট করেছো, ট্রফি জিতেছো! আমি তো কিছুই জানি না। তুমি কখনো বলোনি কেন?
বললাম, ইউনিভার্সিটি কেন, আমি তো স্কুলেও ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পার্টিসিপেট করতাম, পুরষ্কারও পেয়েছি। শুধু তো খেলাধুলা নয়, আমি ইন্টার স্কুল, ইন্টার কলেজ প্রবন্ধ লেখা প্রতিযোগিতা, বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, বিজ্ঞান মেলা সবকিছুতে পার্টিসিপেট করেছি এবং প্রায় সবগুলোতে প্রথম পুরষ্কার পেয়েছি।

মিথীলা তখনও অবাক।
বললাম, আমার গান শেখার খুব শখ ছিলো। গান শেখার সুযোগ পেলে গানেও পুরষ্কার পেতাম। গান না শিখেই আমি সুর তাল লয় ঠিক রেখে গান গাইতাম। যখন টিচার্স ট্রেনিং কলেজে বি এড করি, তখন কলেজের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় কবিতা আবৃত্তি করে প্রথম স্থান পেয়েছি, খালি গলায় গান গেয়ে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছি।
মিথীলা অবাক।

*** বললাম, আমাদের দেশে মেয়েরা যতই টেলেন্টেড হোক, বিয়ের পর তার টেলেন্ট রান্নাঘরের ভাতের হাঁড়িতে মিশে যায়। আর সেই মেয়ের স্বামী যদি বড়ো কোনো বৃক্ষ হয়, তাহলে সেই মেয়ের টেলেন্ট তার স্বামী বৃক্ষের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়!***

জানো মিথীলা, এই যে তোমাদের এতো টেলেন্ট, বলতে গেলে তোমরা তিনজনই মাল্টি টেলেন্টেড। নাচ গান আবৃত্তি আর্ট রাইটিং স্পীচ –সবকিছুতেই তোমাদের দখল আছে, তোমাদের পারফরম্যান্স দেখে সবাই ওয়াও ওয়াও বলে। আর প্রশ্ন করে, এমন অজ পাঁড়াগাঁয়ে থেকেও কোথা থেকে তোমরা এত দিকে সমৃদ্ধ হলে! প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হই না। শুধু মনে মনে আমার স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির সময়ে ফিরে দেখি, উত্তর পেয়ে যাই।
এই যে তুমি বাংলায় কথা বলো, বাংলা পড়তে চেষ্টা করো, এটাও তো তোমার এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি যা তুমি আমার কাছ থেকে পেয়েছো।

মিশা কোথাও নাচ শিখেনি, অথচ দেখো মিশা কতো ভালো নাচ করে। ও এখন নাচের ট্রেইনার হিসেবেও কাজ করে। জানো, আমার খুব মনে পড়ে ছোটোবেলার কথা। আমাকে তো দিদা স্কুল আর ঘরের বাইরে কোথাও যেতে দিতো না। ছুটির দিনে সবাই যখন বাইরে চলে যেতো আমি কি করতাম জানো! আলনা থেকে দিদার শাড়ি নিয়ে পরতাম, এরপর একা ঘরে টিভিতে দেখা নায়িকাদের মতো অভিনয় করে গান গাইতাম, গানের সাথে নাচতাম। শাড়িও পরতাম নাচের মেয়েদের মতো করে। এবং আমি জানি, আমি খুব ভালো নাচতাম। লেখাপড়ার চেয়েও আমার ভালো লাগতো গান গাইতে, নাচতে, আয়নায় তাকিয়ে নায়িকাদের মতো অভিনয় করতে।
এখন মনে হয়, মিশা আমার ভেতর ঘুমিয়ে থাকা নাচের স্কিল পেয়েছে। আমি খুব পরিশ্রম করেছি তোমাদের এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিগুলো এক্সপোজ করার কাজে,
আমার বাবা মায়ের বোধ হয় সেই সুযোগ ছিলো না আমার সুপ্ত প্রতিভাকে প্রকাশ হতে দেয়া।

**আজ আমাকে দেখলে কেউ বলবে না, আমিও বাবা মায়ের মাল্টি টেলেন্টেড মেয়ে ছিলাম।**
ভাগ্যিস আমার মা এই ট্রফিটা কোনোমতে তার ট্রেজার বক্সে আগলে রেখেছিলো! নাহলে তো আমার সকল এচিভমেন্ট স্মৃতির আড়ালে চলে যেতো। প্রমাণ ছাড়া আমি তো তোমাদের বলতেই পারতাম না আমার এচিভমেন্টের কথা! মিথীলা বলে, মা তুমি এখনও মাল্টি টেলেন্টেড আছো। পাপার শেডে তুমি কভারড না। এখনও তুমি কত কাজ করো, সেভেনটিন ইয়ারস তুমি ওয়ালমার্টে সাকসেসফুল্লি চাকরি করেছো, রিটায়ার করার পরেও এখনও ম্যানেজার তোমাকে আবার ফিরে যেতে বলে।

তুমি ব্লগার, তুমি রাইটার, তুমি ভালো ফেসবুকার, তুমি দারুণ কুক, এত কিছু সামলে তুমি একজন পারফেক্ট হোম মেকার। কালচে হয়ে যাওয়া ট্রফিটা কোথায় রাখা যায় ভাবছিলাম। মিথীলা বললো, এই ট্রফিটা তুমি আমাদের ট্রফির সাথে রাখো। এতোদিন দিদা তোমার ট্রফিটা যত্ন করেছে, এখন আমরা তোমার ট্রফিটা যত্ন করবো। মা আর মেয়েদের ট্রফি এক সাথে থাকবে, আমরা যত্নে রাখবো।
এটা আমাদের প্লেজেন্ট ডিউটি।

ডাক্তারের চেম্বার, হোলি বাইবেল এবং

313 গত পরশু গেছিলাম আমার ডাক্তার জেরল্ড টার্নারের কাছে রুটিন চেক আপ করাতে। তখনই তাঁকে বললাম ডান পায়ের সমস্যার কথা। এবং বললাম শহরের দ্য বেস্ট অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে রেফার করতে। ডাঃ টার্নার আমাকে যার কাছে রেফার করলেন, তার নাম জেমস হার্ট। এবং ডাঃ টার্নার অভাবনীয় দ্রুততার সাথে আজকের জন্য এপয়েন্টমেন্ট ব্যবস্থা করে দিলেন।

আজ সকাল ১০ টায় মিথীলাকে নিয়ে গেলাম অর্থোপেডিক্স ক্লিনিকে। বিশাল বড়ো পার্কিং গ্রাউন্ড দেখে মিথীলা অবাক, একটা ছোটো শহরে অর্থোপেডিক্স ক্লিনিকে এতো গাড়ি! বললাম, তোর মা ছাড়াও এই শহরে লুলা ল্যাংড়া মানুষের সংখ্যাই বেশী। লুলা ল্যাংড়া শব্দ দুটোর বিদ্রুপাত্মক ব্যবহার সম্পর্কে মিথীলার ধারণা নেই। তাই নিশ্চিন্তে শব্দ দুটো ইউজ করলাম।

যাই হোক, অন্যান্য ফরমালিটিজ শেষ করে নার্সের সাথে ডাঃ জেমসের কক্ষে এসে পৌঁছেছি। নার্স বলে গেলো, দশ মিনিটের মধ্যেই ডাঃ হার্ট আসছেন। মাঝারি সাইজের বর্গাকৃতি কক্ষ, দরজা দিয়ে ঢুকলে হাতের বাম পাশে ডাক্তারের জন্য নির্দিষ্ট একটি টেবিল একটি চেয়ার, কক্ষের মাঝখানে আয়রন রডের তৈরি রোলিং বেড, রোলিং বেডের শিয়রের বাম পাশে রোগীর জন্য একটি চেয়ার, বেডের ডান পাশে আরেকটি চেয়ার।
কক্ষের দুধ সাদা রঙ চার দেয়ালের তিন দেয়ালে তিনটি পেইন্টিং। দুই মিনিটেই কক্ষের চেহারা দেখে নিলাম, সুন্দর ছিমছাম।

আমার জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে মিথীলাকে বললাম আরেক চেয়ারে বসতে। ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই ডাক্তারের জন্য সাজানো টেবিলে নজর গেলো। ছোটো টেবিলের এক কোণে সবুজ রঙের একখানা ফাইল, সাদা রঙের ফাইল অর্গানাইজার আছে। আর আছে পবিত্র গ্রন্থ বাইবেল। আমার চোখটা আটকে গেলো বাইবেলের উপর। সবুজ রঙের ফাইলের পাশেই বাইবেল রাখা, ডাক্তার এবং রোগী উভয়ের চোখ বরাবর।
আমেরিকায় যত্র তত্র বাইবেল গ্রন্থ সাজানো থাকে। গির্জায় তো থাকেই, গির্জা ছাড়াও যে কোনো সরকারি বেসরকারি অফিস আদালত, হাসপাতালে, ডাক্তারের চেম্বারে, ক্লিনিকের অফিস, গ্রসারি শপের কাউন্টার, বাস টার্মিনালের ওয়েটিং রুম, স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির অফিস- লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি, হাইওয়ে ধরে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝেই রেস্ট এরিয়া থাকে, সেই রেস্ট এরিয়ার অফিসরুমে সেন্টার টেবিলে বাইবেল থাকে। কোথায় থাকে না, সেটাই ভাবছি।

বাইবেল সাজানো থাকে বলেই যে সবাই বাইবেল খুলে বসে থাকে তা নয়। বাইবেলের পাশ থেকে হয়তো ফ্যাশন সংক্রান্ত কোনো ম্যাগাজিন কেউ তুলে নেয়, কেউ তুলে নেয় টাইম ম্যাগাজিন। বাইবেল দেখেছি সর্বত্র কিন্তু কাউকেই বাইবেল হাতে নিয়ে বসতে দেখিনি। এই যে যেখানে সেখানে বাইবেল সাজানো থাকে, বাইবেলের পাশেই হয়তো উন্মুক্ত পা কোনো মডেলের ছবিওয়ালা ম্যাগাজিন পড়ে আছে, বাইবেল না তুলে কেউ হয়তো ম্যাগাজিন থেকে উন্মুক্ত পা মডেলের ছবি দেখছে, তা নিয়ে কোনো খৃষ্টানের মাথা ব্যথা নেই, আপত্তি নেই, অনুভূতিতে আঘাত নেই, গির্জার কোনো ফাদারের চোখ রাঙানি নেই।

গ্রন্থ সবই পবিত্র, গ্রন্থ পড়ার জন্য সাজানো থাকে। ম্যাগাজিনও পড়ার জন্য, নভেলও পড়ার জন্য, ফ্যাশন রান্না বিষয়ক ম্যাগাজিনও পড়ার জন্য, বাইবেলও পড়ার জন্য। যার যেটা প্রয়োজন সে সেটা পড়বে। আমাদের দেশে এটা ভাবা যায় না। আমেরিকায় মদের দোকানেও বাইবেল থাকে, কেউ এর মধ্যে কোনো অন্যায় খোঁজে না। আর আমাদের দেশে পবিত্র কোরান গ্রন্থ নিয়ে কত অপ রাজনীতি চলে।

আমেরিকায় খৃষ্টান ছাড়াও মুচি মেথর গোয়ালা হিন্দু বৌদ্ধ নাস্তিক আস্তিক যে কারো হাতেই বাইবেল থাকতে পারে, যে কারো বাড়িতে বাইবেল থাকতে পারে। তাতে বাইবেলের সম্মান হানি হয় না। পাদ্রীরা তো বাইবেল পড়ার জন্য এরে তারে ফ্রি বাইবেল দিতে চায়। যাকে দিচ্ছে সে হিন্দু না মুসলমান তা জানতে চায় না। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ঘরে বাইবেল দেখে তাদের জাত যায় না। অথচ আমাদের দেশে কথায় কথায় কোরানের অবমাননা

হয়েছে ধুয়া তোলা হয়, তাতে কত মানুষের প্রাণ যায় মান যায় ঘর বাড়ি যায়, ব্যবসা বাণিজ্য জায়গা জমি যায়, নারীদের সম্মান যায় এমনকি গোয়াল থেকে গরু বাছুর ছাগলও লুট হয়ে যায়! পবিত্র গ্রন্থ বাইবেলের দিকে চোখ রেখে দশ মিনিটের মধ্যেই আমেরিকা আর বাংলাদেশ ঘুরে ফেললাম। তখনই সাত ফিটের কাছাকাছি উচ্চতা, গৌর বর্ণ, ছিপছিপে গড়ন, বয়স ত্রিশের কোঠায় সৌম্য দর্শন ডাঃ জেমস হার্ট হাসিমুখে প্রবেশ করলেন।
হাসিখুশি মানুষ দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। আর হাসিখুশি মানুষটি যদি হয় সুপুরুষ অথবা সুন্দরী ডাক্তার, ওষুধ দেয়ার আগেই আমার রোগ যন্ত্রণা কমে যায়।

ডাঃ হাসিমুখেই চোখের তারা আমার আর মিথীলার দিকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন, কে রোগী? প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিলেন, যেহেতু হাঁটুর প্রবলেম তাহলে তুমিই রোগী এবং তুমি রিটা রয়? আমার সাথে কথা বলে ডিটেলস জানার পর ডাক্তার বললেন, তোমার হাঁটু পরীক্ষা করে দেখার আগে বলছি, এক্সরে রিপোর্ট বলছে তোমার এংকেলে বাজে ধরনের ফ্র‍্যাকচার হয়েছে, লিগামেন্ট তো ছিঁড়ে গেছেই হাড়েও ফ্র‍্যাকচার হয়েছে।
এরপর আমাকে রোলিং বেডে উঠে পেছনের রেস্ট সীটে হেলান দিয়ে পা সামনের দিকে ছড়িয়ে বসতে বলা হলো।

আমি পা ছড়াতে গিয়েও সোজা করে ছড়াচ্ছি না দেখে জেমস ভাবলেন পায়ে ব্যথা। বললাম, না পায়ে ব্যথা নেই। পা সোজা মেলতে চাইছি না কারণ টেবিলে হোলি বাইবেল রাখা আছে। আমার পা সোজা করলে বাইবেলের দিকে হয়ে যায়। ডাক্তার বললেন, তাতে কি। হোলি বাইবেল তো হোলি প্লেইসে রাখা আছে, আর তোমার পা আছে বেডে। তুমি তো টেবিলে পা রাখছো না!
আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমেরিকান ডাক্তারের ধর্মীয় অনুভূতির মাত্রার সাথে বাংলাদেশী আমার ধর্মীয় অনুভূতির মাত্রা তো মিলবে না।

আমাদের দেশে শিবের মাথায় পবিত্র কোরানের ফেইক ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার অজুহাতে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়! সেই আমাকে যদি পবিত্র বাইবেলের দিকে পা ছড়িয়ে বসতে বলা হয়, আমার তো অস্বস্তি হবেই। ডাক্তার এবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে আলগোছে বাইবেলটি তুলে ফাইল অর্গানাইজারের উপর রেখে দিলেন। তারপর হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললেন, এবার নিশ্চিন্তে পা লম্বা করে বসো।

ডাক্তারের অমায়িকতায় আমার হাঁটু ব্যথা সেরে গেছে। ডাক্তার আমার হাঁটু যতভাবেই টুইস্ট করে পরীক্ষা করছে, আমার ব্যথা লাগছে না। এমনকি এংকেলেও ব্যথা নেই। ডাক্তার বললেন, তোমার এংকেল যেহেতু তোমায় তেমন বদার করছে না, আপাতত তোমাকে কিছু এক্সারসাইজ দেখিয়ে দেয়া হবে, বাড়িতে করবে। আশা করি, আগামী ছয় মাসের মধ্যে এংকেল ঠিক হয়ে যাবে। এবার আসি হাঁটুর প্রশ্নে। হাঁটুতে মেজর কোনো সমস্যা নেই। আর্থ্রাইটিসের লক্ষণ আছে, এক্সরেতেও তেমন সিগনিফিকেন্ট সমস্যা দেখা যাচ্ছে না। টিস্যুতে একটু রাবিং স্পট দেখা যাচ্ছে যার কারণে অল্প ইনফ্লামেশন আছে।

আপাতত এন্টি ইনফ্লামেটরি মেডিসিন দেবো দিনে একটা, আর হাঁটুর এক্সারসাইজ। এক মাস পর আবার আসবে, তখন রেজাল্ট দেখবো।
কি, তোমার কিছু বলার আছে?
বললাম, ডাঃ টার্নারকে অনুরোধ করেছিলাম শহরের বেস্ট অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে রেফার করতে। ডাঃ টার্নার আমাকে বেস্ট সার্জনের কাছেই পাঠিয়েছেন।

আমার এই কথাতে জেমস হার্ট বিনয়ের সাথে মাথা এমনভাবে ঝুঁকিয়ে ধন্যবাদ বললেন, আমার মনে হলো, আমার সন্তানের বয়সী এই ডাক্তারটিকে প্রণাম করি।
ডাঃ জেমস হার্টের নির্দেশে ফিজিও থেরাপিস্ট লাল এবং নীল রঙের ব্যান্ড দিয়ে আমায় এংকেল ( লাল ব্যান্ড) আর হাঁটুর ব্যায়াম ( নীল ব্যান্ড) দেখিয়ে দিলেন, শিখিয়ে দিলেন এবং এংকেল ও হাঁটুর ব্যায়ামের ছবি ছাপিয়ে ব্যান্ড সহ ছবিগুলো দিয়ে দিলেন।

মায়ের গন্ধ! … আজও খুঁজি, আজও পাই

Screenshot আমার মা সারাজীবন চুলে নারকেল তেল মাখতেন। শ্যাম্পু করতে দেখিনি, মাঝে মাঝে জেট পাউডার জলে গুলে তা দিয়ে মাথার চুল ধুতেন। চুল শুকিয়ে ঝরঝরে হওয়ার সাথে সাথে তেলের শিশি নিয়ে বসতেন, চুল ভিজিয়ে তেল দিতেন। আমার মা কখনও গায়ে মুখে লোশান ক্রিম বা স্নো মাখেননি। পন্ডস পাউডার অথবা কিউটিকোরা পাউডার মুখে গলায় ঘাড়ে মেখে কপালে সিঁথিতে সিঁদুর দিতেন, হয়ে যেত সাজগোজ।

সবার মায়েরই আলাদা একটা গন্ধ আছে। সেই গন্ধ দিয়েই সন্তান তার মা’কে চিনতে পারে। জন্মের পর শিশু তার মায়ের কোলে থেকে যে গন্ধটা পায়, সেই গন্ধটাই তার মায়ের গন্ধ। আমার মায়ের গন্ধ ছিল মাথায় থাকা নারকেল তেল, আর গায়ে জড়িয়ে থাকা ব্লাউজ শাড়ি হতে আসা ন্যাপথলিনের গন্ধ মিলে মিশে ককটেল ধরণের একটা গন্ধ। এই গন্ধের বর্ণনা হয় না, এই গন্ধের সাথে ফুল ফল পারফিউমের গন্ধের মিল হয় না, এটা আমার মায়ের গন্ধ। গন্ধটা এমন ছিল যে, কেউ যদি একশটা একই রকম শাড়ি দিয়ে আমায় বলতো, গন্ধ শুঁকে বের করো কোন্ শাড়িটা তোমার মায়ের।

আমি প্রতিটি শাড়ি শুঁকে শুঁকে ঠিক বের করে ফেলতে পারতাম, কোন্ শাড়িটা আমার মায়ের। মায়ের বালিশের ওয়ার, গামছা বিছানার চাদরে ছিল আরেকরকম গন্ধ, শাড়ির গন্ধের থেকে আলাদা। এই গন্ধে নারকেল তেলের পুরানো গন্ধ মিশে থাকতো। ওটাও ছিল মায়ের গন্ধ, আমার মায়ের গন্ধ। আমার মাসি মামী পিসীদের জামাকাপড়, গামছা বালিশ থেকে অমন গন্ধ আসতো না।

২০১২ সালে বিনা নোটিশে আমার মা মারা যান।
মায়ের বয়স হয়েছিল পঁচাত্তর, কিন্তু মায়ের দেহ ছিল সতেজ সুঠাম, মৃত্যুর জন্য তখনও মায়ের দেহ মন তৈরী হয়নি। তারপরেও মা’কে চলে যেতে হয়েছে। বিনা নোটিশে মৃত্যুটা হয়েছে বলেই আমরা মায়ের মৃত্যুটাকে সহজ কঠিন কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারিনি। মায়ের মৃত্যুর পর এক বছর উদভ্রান্তের মত আমি চলেছি। রান্না খাওয়া চাকরি সংসার সবই করেছি, কিন্তু কিছুই স্বাভাবিকভাবে করিনি।

ওয়ালমার্টে কাজের ফ্লোরে আছি, ঝরঝর করে চোখ থেকে জল পড়ছে। কাস্টমারের সাথে কথা বলছি, চোখ জলে ভিজে যাচ্ছে। ঐ সময়টা আমি সুযোগ পেলেই সবার অলক্ষ্যে নিরালা স্থান খুঁজে নিজের মত হাঁটতাম আর মনে মনে মায়ের সাথে কথা বলতাম। একদিন কাজের ফাঁকে অমনই নিরালায় হাঁটছিলাম, পেছন থেকে হালকা বাতাসের ঝাপটা আমার কান ঘেঁষে চলে গেলো। সেই বাতাসের ঝাপটায় আমার মায়ের গন্ধ ছিল। মায়ের বালিশে গামছায় বিছানার চাদরে যে গন্ধটা ছিলো, মায়ের সেই গন্ধটা। নারকেল তেলের পুরনো গন্ধের মত, ওটার ব্র্যান্ড নেম ছিল, ‘আমার মায়ের গন্ধ’।

সেদিন একবার নয়, দুই তিনবার মায়ের গন্ধটা নাকে এসে লাগলো। অমন বেদিশা সময়েও আমি দিশা ফিরে পেয়েছিলাম। প্রথমবার গন্ধ নাকে আসতেই খুঁজছিলাম গন্ধের উৎস। এটা তো হতে পারেনা যে এক বছর পর স্বর্গ থেকে মা বাতাসে ভেসে এসেছে! তাহলে মায়ের গন্ধ কোথা থেকে আসতে পারে! ঘাড় থেকে আমার চুলের গুছি টেনে নাকে ছোঁয়ালাম, সেখানে আমেরিকান শ্যাম্পুর গন্ধ। আমি মাথায় তেল দেই না, তেলের গন্ধ আসবে কোত্থেকে! বিয়ের আগে হলেও কথা ছিল, তখন মায়ের নির্দেশে চুলে জবজবে করে তেল দিতেই হতো, সেটাওতো নারকেল তেল নয়। আমার মাথার চুলে মাখা হতো জবাকুসুম তেল। আমি দাঁড়িয়েছিলাম ইলেকট্রনিক ডিপার্টমেন্টের টিভি আইলের সামনে, সেখানে তেল স্নো পাউডার সামগ্রীও সাজানো নেই। তাহলে মায়ের গন্ধটা এলো কোথা থেকে, তবে কি মনের ভুল!

ঠিক তেমন সময় আরেকবার, আরও একবার মায়ের গন্ধের ঝাপটা আমার নাকে ছুঁয়ে গেলো! আশেপাশে আর কেউ ছিলোও না যে তাদের গায়ের গন্ধ বাতাসে আসছে। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো! তবে কি সত্যিই মা বাতাসের সাথে ভেসে আমায় ছুঁয়ে দিতে এসেছিলো! মা কি স্বর্গে বসে দেখতে পায় যে, আমি ওয়ালমার্টে কাজের ফাঁকেই আনমনা হয়ে মা’কে খুঁজি, মায়ের জন্য কাঁদি! তাই মা বলে গেলো, আমি আছি!
মায়ের গন্ধটা এরপর অনেকদিন আর পাইনি। মায়ের কথা ভেবে এখন উনমনাও হই না। তবে খুব একাকী বোধ করি।

দশ বছর পেরিয়ে গেছে মা নেই, গত দশ বছরে প্রতি দিন টের পেয়েছি, আমি কতখানি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছি। এখনও চোখে জল আসে, তবে সব সময় আসে না। প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে, ঘুম থেকে উঠে শিয়রের কাছে রাখা মায়ের ছবিতে হাত ছুঁয়ে প্রণাম করি। ভক্তিতে গদগদ হয়ে এই কাজটা করি না। মায়ায় মমতায় ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে এই কাজটা করি। মনে হয়, মা আছে। এখন আমার আর মনে হয় না, মা নেই।

বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো, মনটা অস্থির। অস্থির সময়ে আগে মা’কে ফোন করতাম। মায়ের সাথে চেঁচামেচি করতাম, চোপা করতাম, মা’কে বকতাম সবই করতাম, এরপর মায়ের কাছ থেকে পাওয়া উপদেশ বাণী নিয়ে অস্থির মনটাকে সুস্থির করতাম। এখন তো মা নেই, কার সাথে চোপা করব? মাসীর সাথে, পিসীর সাথে, মামীর সাথে, কাকীর সাথে? তাঁদের সাথে চোপা করলে তাঁরা দ্বিতীয় দিন আর আমার সাথে কথা বলবে? মোটেও না। রাগারাগি, গলাবাজি মায়ের সাথে করা যায়, আর কারো সাথে না। একমাত্র মায়েরাই বুঝতে পারে ছেলে মেয়ের অস্থিরতা।

মেয়ে কেন এত চেঁচামেচি করছে, মায়ের সাথে চোপা করছে তা মা ছাড়া কার এত দায় পড়েছে বুঝতে চাওয়ার! আমার অস্থিরতা কমানোর মানুষটা দশ বছর হয়ে গেলো নেই, তাই আমি সুস্থির হতে পারি না। আমার পারিবারিক জীবনে, ব্যক্তি জীবনে কতইতো উঠা নামা চলে, সবই মনের ভেতর চেপে রাখি। মনের ভেতর চাপি আর ভাবি, মা যদি থাকতো, মা’কে ফোন করে সব খুলে বলতাম। মা নিশ্চয়ই আমায় ইতিবাচক কথা বলে মন খুশি করে দিত। সকল পুরানো কলিগদের সাথে মায়ের যোগাযোগ ছিল, তাছাড়া স্কুলের আয়া ছিল কয়েকজন যারা মাঝে মাঝে আমার মায়ের কাছে এসে কোথায় কার পরিবারে কি কি ঘটেছে তার বার্তা শুনিয়ে যেতো। সেগুলো থেকেই মা আমার কাছে কোট করতো।

মা হয়তো বলতো, ” থাক, যা হইছে হইছে, এত ভেবে করবি কি? ঐ তো আমাদের শিউলি টিচারের কথা শুনলাম, আঞ্জুমান আরা আপার কথাও শুনলাম। তাগোও একই সমস্যা। আজকাইল এই রকম ঘটনা আকছার ঘটে। এইসব দুশ্চিন্তা মাথা থিকা ঝাইড়া ফালাইয়া সংসারে মন দে”।
নাহ! মা চলে যাওয়ার পর এখন কেউ আমায় কিছু বলে না, আমিও কাউকে কিছু বলি না।
মনে মনে মা’কে মিস করি।

এভাবেই দিন কাটে, মায়ের গন্ধও ভুলে গেছি। আজ দুপুরের দিকে ডিভানে শুয়ে টিভিতে জি বাংলায় রাণী রাসমণি’ দেখছিলাম। আমি এই ধারাবাহিকগুলো পছন্দ করি। দুই শত বছর আগের ঘটনাগুলোর নাট্যরূপ, এগুলো দেখে হুবহু না হোক, কিছু তো ইতিহাসের গন্ধ পাই। ঠিক সেই সময় আমার নাকে মায়ের গন্ধ এসে ছুঁয়ে গেলো!

চমকাইনি, আরেকবার পেলাম গন্ধটা। শাড়ি ব্লাউজ পাউডারের গন্ধ নয়, সেই নারকেল তেলের পুরনো গন্ধ যা মায়ের বালিশ, গামছা, বিছানার চাদর থেকে আসতো। মনে পড়ে গেলো, শৈশব কৈশোর যৌবনের শুরুর দিকে প্রতি রবিবার এবং গরমের ছুটির দুপুরে মা গল্পের বই নিয়ে শুতো। আমি মায়ের বালিশে মাথা দিয়ে শুতাম, আর মায়ের তেলে ভেজা চুল নিয়ে খেলা করতাম। সেই থেকেই ঐ গন্ধটাই আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে গেছে।

আজ আর চারদিক খুঁজিনি, কোথা থেকে গন্ধ আসে বলে। অভ্যাসবশে নিজের চুলের গুছিতে নাক দিলাম, শ্যাম্পুর গন্ধ। থাক, মায়ের গন্ধ মায়েরই থাক। মায়ের গন্ধ কেন আমার চুলে আসবে? আমার মনটা যে এত অস্থির, তাতো মা স্বর্গ থেকে দেখতেই পায়। মা’কে মিস করি, আজও মিস করি। তাই মা মাঝে মাঝেই আমায় ছুঁয়ে যায়, এবং প্রতি বার বলে যায়, “আমি আছি”।

.
‘ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার’—- ( আর্কাইভ থেকে )