রীতা রায় মিঠু এর সকল পোস্ট

বেঁচে থাকার স্বপ্ন!

329 গতকাল ছিমছাম চেহারা, রুচিসম্মত সাজ পোশাকে একজন কালো মেম এলেন, ট্রলিতে খাবারের আইটেম। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমার রেজিস্টারে উনি চেক আউট করতে পারবেন কিনা। ট্রলির ভেতরে চোখ বুলিয়ে মনে মনে অবাক হলাম, প্রচুর শাক-সব্জি, ফল, ওটমিল, ননী তোলা দুধের জার। এসমস্ত খাবার কিনে একমাত্র আমি, মেক্সিকানরা এবং ইন্ডিয়ানরা ( এখানে একমাত্র আমি বাংলাদেশী)। সাদা আমেরিকানরাও হেলথি খাবার কিনে তবে আমাদের মত ঘাস পাতা কিনে না, কালো আমেরিকানরা তো শুধু হাই সুগার দেয়া ড্রিংকস, চর্বিযুক্ত খাবার, আর মাংস কিনে। মাংসের কতরকম আইটেম যে কিনে ওরা।

আমি ভদ্রমহিলার জিনিসগুলো চেক আউট করার এক পর্যায়ে বললাম, ” তুমি দেখছি খুব হেলথি ফুড খাও”। মহিলা বললেন, “এ বছর থেকে শুরু করেছি হেলথি ডায়েট, কারণ আমি আমার নাতি নাতনিদের গ্র্যাজুয়েশান দেখে যেতে চাই।”
– তোমার নাতি নাতনিরা কে কোন ক্লাসে পড়ে?
– ওরা এখনও ছোট , ৮, ১০ আর ১৩ বছর বয়স।
– বাহ! নাতি নাতনির গ্র্যাজুয়েশান দেখার ভাবনা থেকে হেলথি ডায়েট শুরু করেছো, কী চমৎকার সিদ্ধান্ত।
– তোমার কি মনে হয় না আমি নাতি নাতনিদের গ্র্যাজুয়েশান পর্যন্ত বাঁচবো?

– বাঁচবেনা মানে? তোমাকে বাঁচতেই হবে। এত সুন্দর চাওয়া! আচ্ছা, খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তোমার ডায়েটে কী পরিবর্তন এনেছো? তুমি কি ঘরে রান্না শুরু করেছো?
– আমি এখন ঘরে রান্না করি, মাংস প্রায় বাদ দিয়েছি, গ্রিলড চিকেন অল্প খাই, শাক সবজি বেশী খাই। ভাজাভুজি বন্ধ, আর সোডা ( কোল্ড ড্রিংকস) এক্কেবারে বাদ, নরমাল ওয়াটার খাই, রেস্টুরেন্টে যাইনা।
– দারুণ! তোমার স্বাস্থ্য খুব সুন্দর, তুমি নিশ্চয়ই আগে থাকতেই খুব স্বাস্থ্য সচেতন ছিলে, নাহলে হঠাৎ করে দৈনন্দিন জীবনে এতবড় চেঞ্জ নিয়ে আসা কঠিন কাজ। আচ্ছা তোমার বয়স কত জানতে পারি?
– আমার বয়স এই মাসেই ৬৭ পূর্ণ হবে।
– মাই গড! তোমাকে দেখে আমি ভেবেছিলাম ৫০-৫১ বছর বয়স হবে। মিসিসিপিতে খুব কম মানুষ দেখেছি যারা সত্যি সত্যি স্বাস্থ্য সচেতন, তুমি ব্যতিক্রম।
– আমি স্বাস্থ্য সচেতন ছিলামনা, কিন্তু এখন মনে হয় আর কিছুদিন বাঁচি, নাতি নাতনিদের গ্র্যাজুয়েশান দেখে যাই।
– তোমার জন্য অনেক শুভকামনা, তুমি নাতি নাতনিদের স্কুল, কলেজ, ইউনিভারসিটির সকল গ্র্যাজুয়েশান অনুষ্ঠানে থাকবে।

কালো মেম বুক ভরা আশা নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দিল।
** আফ্রিকান আমেরিকান জনগণের অধিকাংশই এখনও নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তের পর্যায়ে পড়ে। তাদের এহেন অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য তারা নিজেরাই সত্তর ভাগ দায়ী, বাকী ত্রিশ ভাগ সামাজিক বৈষম্যের কারণে। এই কথাটি বলছি আমার নিজ দায়িত্বে, কারণ আমি নিজে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষ, আমার স্বামীও। আমাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য আমরা দশ ভাগও দায়ী ছিলাম না, কিন্তু আমরা আলোর পথে আসতে চেয়েছি বলেই আলোর দেখা পেয়েছি, আফ্রিকান আমেরিকান জনগণের আটানব্বই ভাগ নিজেদের দুরবস্থার জন্য তামাদি হয়ে যাওয়া বর্ণপ্রথাকে দায়ী করে, সরকারকে দায়ী করে (যদিও আমেরিকান গরীব জনগণ সরকারের কাছ থেকে ফুড স্ট্যাম্প পায়, বাচ্চাদের লেখাপড়ার সুবিধা পায়, কালোদের জন্য সুযোগ অতিরিক্ত কোটাতেও দেয়া আছে, চিকিৎসা সুবিধা পায়।)

কিন্তু ওরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করেনা, ওদের খাদ্যাভ্যাস সুস্বাস্থ্যের পরিপন্থী। ওরা জাংক ফুড বেশী খায়, শাক সবজি খাওনা, জলের পরিবর্তে সারাক্ষণ কোক, ফান্টা খাচ্ছে, ভাজাভুজি খাবার এদের পছন্দ। এদের অধিকাংশই হাই ব্লাড প্রেশার, ব্লাড সুগার, কোলেস্টেরলের ওষুধ খায়। গ্র্যাজুয়েশান দূরের কথা, সমস্ত সুযোগ সুবিধা পেয়েও ওরা স্কুলের গন্ডিটাও পুরোপুরি ডিঙ্গাতে পারেনা। স্কুল পাশের আগেই রেস্টুরেন্টে ওয়েটার, ক্লিনারের কাজ নিয়ে পয়সা উপার্জন করা শুরু করে। খুব কম ছেলেমেয়ে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে, প্রবেশ করেও ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবেনা।

আফ্রিকান আমেরিকানদের গড় আয়ু খুব কম, কারণ ওদের অলস, নেতিবাচক জীবনাভ্যাস। এজন্যই কালকের কালো মেমের বেঁচে থাকার কারণ এবং স্বপ্নের কথা শুনে ভীষণ ভালো লেগেছে। ঈশ্বর যেন ওনার আশা পূর্ণ করেন।**

.
( মুহূর্তে দেখা মানুষ)

ধৈর্যের ফল!

1638 হয়তো অতিরিক্ত যত্ন করে ফেলেছিলাম, তাই ছবির অর্কিডটা ফুল পাতাসহ তিন বছর আগে মরে গেছিলো। টবটার মধ্যে রয়ে গেছিল শুধু কাঠের চিপস।

চোখের সামনে জলজ্যান্ত অর্কিডটা মরে গেলো, কী যে খারাপ লাগছিলো। হাতে ধরে টবটাকে বাইরে ফেলে দিতেও পারিনি। আমি তো এমনিতেও ওয়ালমার্ট থেকে মরে হেজে যাওয়া গাছ সস্তায় কিনে এনে ঠিক বাঁচিয়ে ফেলি। আমার কিচেনল্যান্ডের প্রতিটি গাছ আমার হাতে পুণর্জন্ম পেয়েছে।

তিন বছর আগে মরে যাওয়া অর্কিডের শূন্য টবটা আমাদের বেডরুমের জানালায় অন্যান্য অর্কিডের পাশে রেখে রোদ জল দিয়ে যাচ্ছিলাম। প্রায় পাঁচ মাস পর লক্ষ্য করলাম, কাঠের চিপসের ভেতর থেকে আধা সে:মি সাইজের কালচে সবুজ কিছু বেরিয়ে আসছে। আমি শকড হয়ে গেছিলাম। আমি তো গাছপালা ভালোবাসি, কিন্তু কোন্ গাছের যত্ন কিভাবে নিতে হয় তা জানি না। বিশেষ করে অর্কিড, অর্কিড তো মাটিতে জন্মে না। অর্কিড পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ, অন্য গাছের ডালে ওরা জন্মায়। তাই টবের মধ্যে মাটির পরিবর্তে কাঠের চিপস থাকে।

নিয়ম না জেনে একবার একটা তাজা অর্কিড ছোটো টব থেকে সরিয়ে মাটি ভর্তি বড়ো টবে দিয়েছিলাম। পনের দিনের মধ্যে সেই সবুজ বড়ো বড়ো পাতাসহ অর্কিডটা মরে একেবারে মাটির সাথে মিশে গেলো। তখনই এক বাগান বিশেষজ্ঞ বৌদির কাছ থেকে জেনেছি, অর্কিড নাকি মাটিতে বাঁচে না।

যা বলছিলাম, গত তিন বছরে সেই মরে যাওয়া অর্কিডটা বেঁচে উঠে ছোটো ছোটো তিনটি পাতাও মেলেছে। আমি গত ছয় মাস বাড়িতে ছিলাম না, স্বামীর কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। মিথীলার স্কুল জীবন থেকে বন্ধু এমিলির কাছে দায়িত্ব দিয়ে গেছিলাম সপ্তাহে একদিন ঘরে ঢুকে যেন মানিপ্ল্যান্ট, অর্কিডে জল দিয়ে যায়। মাঝে প্রচন্ড গরমের সময় আমাদের বাড়ির ইলেকট্রিসিটি লাইন দশ দিনের জন্য বন্ধ ছিলো এবং এমিলিও অই সময়ে আসতে পারেনি।

যখন এসেছে, ঘরে ঢুকে দেখে চারদিকে আগুনের মতো গরম, সব লতা পাতা, অর্কিড শুকিয়ে হলুদ হয়ে প্রায় মরে গেছে। আমাকে ফোন করতেই এই সংবাদ শুনে আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এমিলি শুধু সরি সরি বলে চলেছে, ও কেন আরও আগে আসতে পারলো না তার জন্য আফসোস করছে। আমি বললাম, আমরা ফিরে আসা পর্যন্ত তুমি গাছগুলোয় আবার জল দিতে থাকো। আমরা বাড়িতে ফিরেই আমি ঘরের গাছগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সব গাছের বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত অবস্থা। কিন্তু এমিলির দেয়া জল খেয়ে তখনও বেঁচে আছে।

নতুন বছর ২০২৩ এলো। গত তিন মাসে আমার ঘরের মানিপ্ল্যান্ট সবুজ হয়ে লতিয়ে উঠেছে, অর্কিডে আবার ফুলের স্টিক বেরিয়ে ফুল ফুটতেও শুরু করেছে, সেই বেঁচে ওঠা তিন পাতার অর্কিডটাও দেখি দাঁড়াতে শুরু করেছে। অর্কিডের তিন পাতার দিকে তাকিয়ে প্রায়ই ভাবি, এই অর্কিডের পাতা কবে বড়ো হবে, কবে হৃষ্টপুষ্ট হবে তবেই ফুলের স্টিক বের হবে! চার পাঁচ দিন আগে জানালায় থাকা অর্কিডগুলোকে বাথরুমের বেসিনে রেখে স্নান করাচ্ছিলাম, তিন পাতার অর্কিডটাকেও স্নান করিয়েছি।

স্নান শেষে যখন ওদের সবাইকে আবার জানালায় এনে বসিয়েছি, দেখি তিন পাতার অর্কিডে সরু কাঠির মতো একটা নতুন ডালা বের হচ্ছে। এই ডালাগুলোকে আমি চিনি। এটাই ফুলের স্টিক, তবে অর্কিডের স্টিক এতো সরু হয় তা আগে দেখিনি। নতুন বছরে ভাবছিলাম নতুন জন্ম পাওয়া এই তিন পাতার অর্কিড কবে বড়ো হবে, কবে ফুল ফুটবে! আর দশ দিন পরেই কিনা সেই অর্কিডে ফুলের স্টিক বের হলো!

আজ দুপুরে এই ছোট্টো অর্কিডের টবটা বাথরুমে নিয়ে স্নান করালাম। এরপর মিথীলার কাছে নিয়ে এলাম, বললাম ওর পুণর্জন্মের কাহিনী। সব শুনে মিথীলা বিস্মিত! এক দৃষ্টিতে অর্কিডের দিকে তাকিয়ে মুখে বললো, মা, তোমার অনেক ধৈর্য। অনেক ধৈর্য। তুমি একটা মাত্র মানিপ্ল্যান্ট থেকে এতোগুলো পট বানিয়েছো, দুইটা ব্যাম্বু প্ল্যান্ট থেকে এতোগুলো ব্যাম্বু প্ল্যান্ট বানিয়েছো! তুমি চেয়েছিলে মানিপ্ল্যান্ট লতা দিয়ে আমাদের সিঁড়ির রেলিং পেঁচাতে। অলরেডি সেই লতা সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে! আর আর্যর জন্য কত বছর ধরে ফান্ড রেইজ করেই যাচ্ছো। ফান্ড ঠিকমতো না এলে তোমার মন খারাপ হয়, তুমি চিন্তায় পড়ে যাও। তবুও নতুন করে আবার স্টার্ট করো।

আমার মনে হচ্ছে, তোমার অর্কিডটা যেমন বেঁচেছে, নতুন ফ্লাওয়ার স্টিক বেরিয়েছে, আর্যর জন্য তুমি ফান্ড রেইজিং সাকসেসফুল হবে। আর্যও সেরে উঠবে। মিথীলার কথা শুনে আমার চোখে জল এসেছে। বললাম, এই প্রথম আমার পরিবারের কেউ একজন স্পষ্ট করে আমায় চিনলো। মিথীলা, তুমি আমায় ঠিক চিনেছো। বাইরে থেকে আমাকে যতোই হুড়ুমদুড়ুম মনে হোক, ভেতরে আমি অনেক স্থির, আমার অসীম ধৈর্য, এবং আমি লক্ষ্যে স্থির থাকি। এবং আজ আমি বলছি, আমার চেয়েও অনেক বেশী ধৈর্য তোমার। আমাদের কত কঠিন কাজ তুমি করে দাও। মা বাবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, বাজারে নিয়ে যাওয়া, বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, অনলাইনের ভেজাল সামাল দেয়া— কী না করো তুমি!

আর্যর জন্য ফান্ড রেইজ করা অত সহজ হতো না যদি না তুমি রাত জেগে অসীম ধৈর্য নিয়ে বারবার Go Fund Go Fund খুলে দিতে।

স্নো-কোন!

299 ভর দুপুরে আমার উত্তম কুমার গেছেন ইউনিভার্সিটিতে, নতুন ছাত্র ছাত্রীদের অভিষেক অনুষ্ঠানে ঘন্টা দুয়েকের জন্য। একা ঘরে আমি কমপিউটারে ধারাবাহিক ‘সুবর্ণলতা’ দেখছি। কিছুক্ষণ আগে বাইরে থেকে দরজার লক খোলার শব্দ পেয়ে বুঝলাম, অনুষ্ঠান শেষ করে উত্তম ফিরে এসেছেন।

আমি স্ক্রিনে নাটক সিনেমা গান যা-ই দেখি, ভলিউম উঁচুর দিকে থাকে। আমি কথাও বলি উঁচু ভলিউমে যাতে কুড়ি হাত দূরে থাকলেও কারো শুনতে সমস্যা না হয়। আর আমার উত্তম কুমার হয়েছেন আমার উলটো। টিভিতে নাটক দেখছেন অথচ ডায়লগে সাউন্ড নেই, কারো সাথে কথা বলছেন অথচ পাঁচ হাত দূরে থেকে অন্য কেউ শুনতে পাচ্ছে না!

এভাবেই বিয়ের পর ৩৭ বছর উত্তম আর অধম একসাথে থাকতে থাকতে গলার নীচু এবং উঁচু ভলিউমে সমঝোতা হয়ে গেছে। ৩৭ বছরে আরেকটা পরিবর্তন এসেছে। আমরা দুজনেই এখন কথা কম বলি, টিভিতে নাটক সিনেমা দেখি যার যার রুমে বসে অর্থাৎ সাউন্ড ভলিউমের তারতম্য নিয়ে যাতে ঝগড়া না হয় সেই চিন্তা করেই নির্ঝঞ্ঝাট দূরত্বে থাকি! এসব শুনলে মনে হয়, বিয়ের ৩৭ বছর পর স্বামী স্ত্রীতে প্রেম ফুরিয়ে যায়! আমারও তাই মনে হয়, আমাদের মধ্যে প্রেম ফুরিয়ে গেছে মনে হয়!

কিন্তু মাঝে মাঝে উত্তমের ঘর থেকে গান ভেসে আসে, “নীড় ছোটো ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়ো” অথবা “ধন্য আমি ধন্য হে, পাগল তোমার জন্য যে” এমন আরও মন আকুল করা সব গান। এসব গান শুনে আমার মন কেমন করে, ফিরে পেতে ইচ্ছে করে আমাদের প্রথম জীবনের দিনগুলো! আমি বিভ্রান্ত হই, আসলেই কি বিয়ের বয়স দীর্ঘ হলে স্বামী স্ত্রীতে প্রেম ফুরিয়ে যায়! আজও ক্ষণিক আগে দরজা খোলার শব্দ পেয়ে যখন বুঝলাম উত্তম ফিরে এসেছে, সুবর্ণলতায় তখন মেজো বউয়ের মন পাওয়ার জন্য তার স্বামী পেবো বোকা বোকা কান্ড করেই চলেছে।

সব ছাপিয়ে উত্তমের গলা ভেসে এলো। নাটক পজ করে কান খাড়া করলাম উত্তম কি বলছে শোনার জন্য।
শুধোলাম, কি গো, কিছু বলছো?
উত্তম বললো, স্নো কোন খাবে? তোমার জন্য এনেছি।
আমি উত্তমের কথার মানে বুঝিনি বোধ হয়! চেয়ার ছেড়ে উঠে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে শুধোলাম,
কি এনেছো?
– স্নো কোন
– স্নো কোন কি? কোথা থেকে এনেছো? তুমি কি ভার্সিটি থেকে কোথাও গেছিলে?
– না, অন্য কোথাও যাইনি। ওখান থেকেই এনেছি তোমার জন্য। নতুনদের অভিষেক অনুষ্ঠান, স্ন্যাকসের আয়োজন ছিলো। ছেলেমেয়েরা দেখলাম খুব খাচ্ছে এটা, তাই তোমার জন্য নিয়ে এলাম।

আমি তো মুখ হা করে দাঁড়িয়েই আছি, স্নো কোন কাকে বলে তাই জানি না। উত্তম রঙিন বরফ কুচিতে ভরা কাগজের একটা গ্লাস আমার দিকে এগিয়ে দিলো। বললো, অনেক রকম ফ্লেভার ছিলো, আমি দুই রকমের সিরাপ মিশিয়েছি, আমি নিজেই পছন্দ করেছি ফ্লেভার। একটা ম্যাঙ্গো, আরেকটা গ্রেইপ ফ্লেভার। আমি মন্ত্র চালিত অবস্থায় হাত বাড়িয়ে গ্লাসটা নিলাম। বুঝতে পারছিলাম না, আমি টাইম মেশিনে চড়েছি কি না!
টাইম মেশিন কি আমায় ৩৭ বছর পেছনে নিয়ে গেছে! ৩৭ বছর আগে ঠিক এমনটাই হতো, প্রতিদিন এমন ঘটনা ঘটতো।

এমনকি ২২ বছর আগেও ঘটতো এমন ঘটনা। অফিসের কোনো প্রোগ্রাম, উত্তম আমাকে ছাড়া যেতোই না। অফিসে খাওয়া দাওয়া হচ্ছে, উত্তম আমার পছন্দের খাবার প্যাক করে নিয়ে আসতো। কোম্পানির খরচে তিন দিনের অফিস ট্যুরে দুবাই যাচ্ছে টিম, উত্তম নিজের টাকা দিয়ে আমার জন্য টিকেট কিনে আমাকে সাথে নিয়ে গেছে! বাইরে গেছে, ফেরার সময় আমার জন্য স্যুটকেস ভর্তি সুন্দর সুন্দর শাড়ি নিয়ে এসেছে। এসবই হতো দেশে থাকতে, আমেরিকা আসার পর ধীরে ধীরে আমরা মন মননে বুড়ো বাঙালি হয়ে গেছি!

বাঙালি বুড়ো হওয়ার আগেই মন এবং মগজ থেকে প্রেম, রোমান্সের সুইচ দুটো অফ করে দেয়। বুড়ো বাঙালি দম্পতি পরস্পরের প্রতি প্রেমময় আচরণ করছে, প্রেমের কথা বলছে— এ দৃশ্য বিরল। আমার হতবিহ্বল ভাব কেটে গেলো। হাতে পায়ে স্বভাবগত উচ্ছ্বাস বেরিয়ে এলো।
বললাম, এর নাম স্নো কোন? এটা তো ডেসিয়া।
উত্তম বলল, ডেসিয়া আবার কি?
-আমাদের ছোটো বেলায় সাইকেল ভ্যানে বিশাল কাঠের বাক্স নিয়ে আসতো। হাঁক দিতো, ‘ডেসিয়া, ডেসিয়া’!
কাঠের বাক্সে নানা রঙের সিরাপের বোতল সাজানো থাকতো, আইসক্রিমওয়ালা করাতের মধ্যে বরফের চাকা ফেলে ঘষতো, করাতের নীচে বরফের কুচি জমা হতো। সেই বরফকুচি হাত দিয়ে চেপে চেপে কাঠির মধ্যে বসিয়ে তার উপর সিরাপ ঢেলে দিতো। ওটাই ডেসিয়া, এখানে নাম স্নো কোন। এরপর বললাম, তা এত বড়ো কাপ স্নো কোন আমি একা খাবো কেন? তুমি অর্ধেক নাও।
– না না, এটা তোমার জন্যই। বরফ আমার দাঁতে লাগলে দাঁত সিরসির করে।
– এতোকাল পর তুমি আবার সেই আগের মতো অনুষ্ঠান থেকে আমার জন্য কিছুমিছু নিয়ে এলে, আমি তো আনন্দে বেহুঁশ হয়ে গেছি! তোমাকে ছাড়া আনন্দ কার সাথে শেয়ার করবো?
– আমার জন্যও এনেছি, একটা কোকের ক্যান।

তখনও টাইম মেশিন ২২ বছরের পথ পার হয়নি। এক ছুটে উত্তম কুমারকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলাম। খুকীদের মতো নেকু নেকু আবদেরে গলায় বললাম, স্নো কোন-টা খাবো? খেলেই তো সব স্মৃতি হারিয়ে যাবে।
এই স্নো কোন-টা টাইম মেশিন। তুমি আজ আমাকে টাইম মেশিনে তুলে দিয়েছো। স্নো কোন হাতে নিয়ে আমি চলে গেছি আমাদের বাংলাদেশ জীবনে।

ঐ জীবনে আমাদের প্রাণ প্রাচুর্য ছিলো, ভালোবাসা ছিলো, টান ছিলো, রোমান্স ছিলো, আলো ছিলো, মাঝে মাঝে টাকার অভাব ছিলো, কিন্তু কখনও প্রাণের অভাব ছিলো না ——
আমেরিকায় আলো বাড়ি গাড়ি সব আছে শুধু প্রাণ নেই কোথাও।

২১ বছর আগে আমেরিকা এসেছি। ২১ বছর পর আজ নতুন করে আমার দেহে প্রাণের সাড়া পেলাম।

★ সুখ উপস্থিত হয় হঠাৎ, ধরতে পারলেই সুখ তোমার, ধরতে না পারলে সুখ ফুড়ুত।

আমার বিয়ের সাজ কমপ্লিট

2

মিথীলা একবার জিজ্ঞেস করেছিল, “মা বাংলাদেশে বিয়েতে মেকাপ দিয়ে বউয়ের গায়ের রঙ চেঞ্জ করে কেন? জামাইদের গায়ের রঙ চেঞ্জ করে না কেন? কালো বউকে সাদা বানায়, সাদা বউকে কালো বানায় না কেন? তোমাকে কি সাদা বানিয়েছিল?”

উত্তরে আমি বলেছিলাম, আমাদের দেশের অধিকাংশ কালো মেয়েগুলো বোকা। ওরা অযথাই গায়ের রঙ নিয়ে দুঃখ পায়, ওরা নিজেকে নিয়ে অহংকার বোধ করতে জানে না। আরে গায়ের রঙ কি কেউ ইচ্ছে করলেই বদলাতে পারে? কিন্তু চাইলেই গুণ অর্জন করা যায়। আসলে মেয়েগুলোরও দোষ নেই।

আমাদের দেশে মেয়েদের গায়ের রঙের ইমপর্ট্যান্স অনেক বেশী, মেয়েদের গুণের কদর কম। তাই বিয়ের সময় সবাই যেনো বউ দেখে সুন্দরী বলে, সেটা ভেবেই কালো মেয়েরা মেকাপ দিয়ে রঙ বদলায়। আর আমার কথা আলাদা। আমি তো ছোটোবেলা থেকেই বুদ্ধিমতী আর জেদী, তাই ছোটোবেলা থেকেই আমি বলতাম, “কালো, জগতের আলো”!

তাছাড়া আমার বাবা মা কেউই আমার গায়ের রঙ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতো না। বাবা মা শুধু আমার লেখাপড়া নিয়ে চিন্তা করতো, আর আমার রাগ আর জেদ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতো। বিয়ের সময় তোমার পাপা তো অনেক ফর্সা ছিল, আমি কালো ছিলাম। তাতে কি, কালো তো জগতের আলো। তাই বিয়েতে আমাকে মেকাপ দিয়ে সাদা বানায়নি। এমনকি আমার বিয়েতে আমাকে ঘরেই সাজানো হয়েছে। কারণ ঢাকায় বিউটি পার্লার থাকলেও নারায়ণগঞ্জে তখনও বিউটি পার্লারের চল আসেনি।

আমার পিসী আমার পায়ে আলতা, হাতে নেইল পলিশ দিয়ে আলপনা এঁকেছে। আর আমার বন্ধু দীনা চুলে কয়েকটা বেণী করে প্রতিটা বেণীতে তাজা ফুলের মালা পেঁচিয়ে তা দিয়ে ডিজাইনের খোঁপা বেঁধে দিয়েছে। আর তোমার প্রফেসর মামার মেয়ে গোপা চন্দনের আলপনায় আমার মুখ সাজিয়েছে।

জানো তো, তখন নারায়ণগঞ্জে ফুলের দোকানও ছিলো না। বিয়ে হতো কাগজের মালা দিয়ে। আমার বিয়েতে তাজা ফুল, তাজা ফুলের মালা এসেছে। আমার ইউনিভার্সিটির বান্ধবীরা হোস্টেলের বাগান থেকে ফুল এনেছে, আর গোপা ঢাকা ইউনিভার্সিটির কোয়ার্টারের বাগান থেকে ফুল এনে মালা গেঁথেছে।

আরেকটা কথা, আমার স্কিন তো খুব সেনসিটিভ, বিয়ের আগে খুব এলার্জি এটাক হয়েছিলো। তাই গোপা আমার মুখ সাজানোর সময় কোনো ফাউন্ডেশন, ফেস পাউডার ইউজ করেনি। সিমপল পন্ডস পাউডার হাতে ছড়িয়ে সেটাই মুখে হালকা করে দিয়েছে। চোখে গাঢ় কাজল, কপালে লাল টিপ আর চন্দনের আলপনা আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। আমার বিয়ের সাজ কমপ্লিট।

অই সাজ দেখেই সবাই আমাকে সুন্দর বলেছে।”
এরপর আমার বিয়ের এলবাম খুলে আমার ছবি দেখালাম। মিথীলা খুব খুশি আমার বিয়ের ছবি দেখে।

ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার!

29 আজ রবিবার, নভেম্বরের শেষ। আমার কাজের স্কেজিউল ছিলো সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত। যদিও অভ্যাসবশে এখনও সন্ধ্যে সাতটা বলি, আসলে এদেশে শীতকালে বিকেলে ঘড়িতে পাঁচটা বাজতেই সন্ধ্যে নেমে যায়। শীতকালে সাতটার সময় সন্ধ্যে থাকে না, রাত হয়ে যায়।

আজ বিকেলের দিকে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক ( কৃষ্ণাঙ্গ) প্রিপেইড ফোন কিনতে এসেছিলেন। আজ সারাদিন ফটোল্যাবেই কেটেছে আমার। বিকেলে চা বিরতি থেকে ফিরে সবে ইলেক্ট্রনিক ডিপার্টমেন্টের ফ্লোরে এসে দাঁড়িয়েছি। তখনই সেই কৃষ্ণাঙ্গ সাহেব প্রিপেইড ফোন দেখতে চাইলেন। ফোন পছন্দ করে দাম দেয়ার সময় হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন,
— আরে, তোমার নাম রিটা! আমার X- wife এর নামও রিটা!

আমিও অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বললাম, — তাই নাকি! এক্স ওয়াইফের নাম রিটা, তোমার Present wife-এর নাম কি?
ভদ্রলোক মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, দাঁড়াও এক মিনিট। আমার বর্তমান ওয়াইফের নাম পেটে আছে, মুখে আসছে না!

কৃষ্ণাঙ্গ সাহেবের অবস্থা দেখে আমি সত্যিই অবাক হলেও হেসে ফেলেছি। সাহেবের পাশে দাঁড়ানো এক শ্বেতাঙ্গ তরুণ কাস্টমারও হেসে ফেলেছে। এদিকে এক মিনিটেও সাহেবের প্রেজেন্ট ওয়াইফের নাম পেট থেকে মুখে আসছিলো না! ভদ্রলোক খুব বিব্রত ভঙ্গিতে হাসছিলেন। আমি খিল খিল করেই হেসে ফেললাম। বললাম, তোমার এক্স ওয়াইফ তো দারুণ লাকী! তোমার জীবন থেকে সরে গিয়েও তোমার হৃদয় জুড়ে আছে সে।
ভদ্রলোক তখনও মাথা চুলকাচ্ছে।
বললাম, এমনটা সবারই হয়। মাঝে মাঝে অতি প্রিয়জনের নাম মনে পড়ে না! ঘাবড়ে যেয়ো না, তোমার প্রেজেন্ট ওয়াইফ তো আর জানতে পারছে না যে তার নাম তুমি ভুলে গেছো!
— না না ভুলিনি, এখনই মনে পড়বে প্রেজেন্ট ওয়াইফের নাম।
বললাম, আসলে Rita নামের মেয়েরা খুবই পাওয়ারফুল হয়। খারাপই হোক অথবা ভালোই হোক, অত সহজে রিটাকে ভোলা যায় না।
দেখো, তোমার জীবন থেকে এক্স হয়ে গেছে যে রিটা, এখনও তার নামটাই তোমার মনে আছে।
ভদ্রলোক এবার ‘ ইউরেকা ইউরেকা’ ভঙ্গিতে বললেন,– মনে পড়েছে আমার প্রেজেন্ট ওয়াইফের নাম!
ওর নাম রেনে-এ!

বললাম, রে-নে-এ খুব সুন্দর নাম। আমার এক রাশান বন্ধুর নাম ছিলো রে-নে-এ।
সাহেব এবার বললেন, — তুমি কি বিবাহিত?
বললাম, – আমি বিবাহিত। আমার নামও রিটা এবং আমিও একজন পাওয়ারফুল লেডি। তবে আমি যদি কখনো আমার হাজব্যান্ডের এক্স ওয়াইফ হয়ে যাই, সে আমাকে ভুলতে না পারলেও আমার নাম ভুলে যাবে।
ভদ্রলোক বলে, ইমপসিবল! তোমার নাম সে ভুলতেই পারবে না!
হাসতে হাসতে বললাম,– আমি এতোটাই পাওয়ারফুল যে সে আমাকে নাম ধরে ডাকতে ভয় পায়!
– তাহলে তোমার হাজব্যান্ড তোমাকে কি নামে ডাকে?
– ইশারায় ডাকে।
-হোয়াট! ইশারায় ডাকে কেন?
– না, হাতের ইশারায় ডাকে না। সাউন্ড ইশারায় ডাকে।
– সাউন্ড ইশারা কি?
– তোমরা যেভাবে হেলো, হাই সাউন্ডে কাউকে ডাকো, অথবা স্ত্রীকে বেইবি বলো, আমার হাজব্যান্ড ওগুলোকেই একসাথে অনলি একটা সাউন্ড তৈরি করে আমাকে ডাকে।
– স্ট্রেইঞ্জ! সব মিলিয়ে একটা সাউন্ড! শুধু তোমাকে ডাকার জন্য স্পেশাল সাউন্ড ইশারা?
– হ্যাঁ। আমার হাজব্যান্ড আমাকে রিটা ডাকে না, ‘ এই’ বলে আওয়াজ দিলেই আমি বুঝে যাই, আমাকেই ডাকছে!
– আ-ই?
– না, আ-ই না, এ-ই!
– আ-ই সাউন্ডের চেয়ে রিটা ডাকা সহজ নয়?
— তোমার কাছে সহজ, কারণ তুমি এ-ই সাউন্ড করতে পারো না। রিটা নামটা তোমার কাছে এতো সহজ, তারপরেও তুমি এক্স ওয়াইফ রিটার ভয়ে প্রেজেন্ট ওয়াইফের নাম ভুলে গেছো।

আর আমার হাজব্যান্ডের রিটা নামেই এত ভয় যে, আমি এক্স হওয়ার আগেই আমার নাম ভুলে গেছে! কৃষ্ণাঙ্গ সাহেব প্রাণখোলা হাসিতে বলেই ফেললো, তোমার হিউমার সেন্স অত্যন্ত ভালো। ইয়েস, আমার এক্স ওয়াইফ খুবই জাঁদরেল ছিলো। তবে মানুষ হিসেবে সে ভালো।
— এই পৃথিবীর সকল রিটা জাঁদরেল হলেও মানুষ হিসেবে ভালো হয়। আমিও নাকি মানুষ হিসেবে ভালো— আমার হাজব্যান্ড বলেছে।
–সত্যিই রিটা ইজ আ পাওয়ারফুল নেইম, পাওয়ারফুল উয়োম্যান, আমি যেমন জানি তোমার হাজব্যান্ডও নিশ্চয়ই সেটা জানে।

– ‘ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার’ স্ক্রিপ্ট থেকে।

ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার!

2979

“আজ বন্ধু দিবস। এখন পর্যন্ত এক জন বন্ধুকেও শুভেচ্ছা জানাতে পারিনি। কারণ আজ কাজে চলে এসেছি সকাল ৯টায়।

ওয়ালমার্টে কাজের ফ্লোরে থাকলে ফোন ব্যবহার করার নিয়ম নেই। প্রায় কেউই এই নিয়ম মানে না, কিন্তু আমি নিয়ম মানি। আমি আইনকানুন মেনে চলা সভ্য নাগরিক। ওয়ালমার্টের আইন মেনে চলি তাই এখন পর্যন্ত ফেসবুকে ঢুকতে পারিনি, কাউকে হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে উইশও করতে পারিনি। আমি ওয়ালমার্টের ইলেকট্রনিক ডিপার্টমেন্টেই বেশী সময় থাকি, মানে থাকতে হয়। কারণ ফোন, ফটোল্যাব, ইলেকট্রনিকস, ফেব্রিকস, টয়স ডিপার্টমেন্টগুলো গায়ে গায়ে লাগানো এবং সকল কাজের কাজী আমি।

ইলেক্ট্রনিকস ডিপার্টমেন্টে ডিসপ্লে আইলের ওয়ালে বিশাল সাইজের অনেকগুলো টিভি চালু থাকে। টিভিতে বিভিন্ন চ্যানেলের প্রমোশনাল প্রোগ্রাম দেখায়। তার মধ্যে ট্র্যাভেল চ্যানেল অন্যতম। যখন ট্র্যাভেল চ্যানেল দেখায়, আমি কর্ম জগত ভুলে হা করে টিভির দিকে তাকিয়ে থাকি। পৃথিবীর কতো সুন্দর সুন্দর জায়গা দেখায়, আমি দু’চোখ ভরে দেখি। যখন যে জায়গা দেখায়, কল্পনায় নিজেকে সেখানেই আবিষ্কার করি।

সেখানে আমি একা নই, পাশে থাকে ‘সে’। ‘সে’-কে পাশে নিয়ে মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করি পৃথিবীর সৌন্দর্য্য। ‘সে’ আমার নাম জানে, আমি ‘সে’-র নাম জানি না। সে দেখতে কেমন তাও জানি না। শুধু জানি, নির্জন নিরালায় যখন নিজেকে খুঁজে পাই, ঠিক তখন ‘সে’ এসে চুপটি করে আমার বাম পাশে বসে।

‘সে’-র সাথে আমার মনের খুব মিল। দুটিতে পাশাপাশি বসে পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ স্পর্শ অনুভব করি, প্রকৃতির সরবতার সাথে তাল মিলিয়ে আমি গুন গুন করি! যদিও আমি ‘সে’-কে দেখতে পাই না, তবে অনুভব করি ‘সে’ তন্ময় হয়ে আমার গান শোনে। আজও আমি আর ‘সে’ নৌকায় বসে ভেনিসের রূপ দেখছিলাম আর গুন গুন করছিলাম ” দূরে কোথায় দূরে দূরে, আমার মন যে বেড়ায় ঘুরে ঘুরে”

হঠাৎ এক ক্যাঁচ ক্যাঁচ কণ্ঠে ‘এক্সকিউজ মি, আই নিড হেল্প’ শুনে সম্বিত ফিরে পাই!

তখনই আমার বাম পাশ থেকে ‘সে’ হারিয়ে যায়,
আমি ভেনিস থেকে সরাসরি ফিরে আসি কর্মজগতে।
এই কর্মজগত এখন আর ভালো লাগে না। এখানে শান্তিতে আমি আর ‘সে’ দুই দন্ড সময় কাটাতে পারি না! কতোবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, চাকরিটা আজই ছেড়ে দেবো, মুক্ত বিহঙ্গের জীবন বেছে নেবো।

৩৫ বছরের বিবাহিত জীবনে ১৮ বছরের কর্মজীবন, বাকী ১৭ বছর স্বামী কন্যা আত্মীয় পরিজন নিয়ে কেটেছে। কোনো জীবনই খারাপ কাটেনি। চাকরি ছাড়া জীবনে পরিবারের সকলেই ছিলো আমার কাছাকাছি, শুধু ‘সে’ ছিলো না। ‘সে’ ভীড় পছন্দ করে না, কারণ ভীড়ের মাঝে সে আমার কাছে আসতে পারে না, ভীড় থেকে আমাকে আলাদা করতে পারে না। আমি নিজেও পরিবারের মাঝে থাকলে নিজেকে খুঁজি না, অথবা নিজেকে খুঁজে দেখার কথা মনেই পড়ে না! নিজেকে খুঁজলেই তাকে কাছে পেতাম। আসলে আমিও ভীড়ের মাঝে নিজেকে আলাদা করতে পারি না!

শুধু ‘সে’-র কথা ভেবে ভেবে চাকরিটা আর ছাড়া হয় না! অথচ চাকরিটা ছেড়ে দিলেই আবার পরিবারের মাঝে ফিরে আসবো, কাস্টমারের ক্যাঁচোর ম্যাচোরের মাঝে থাকতে হবে না। তবে চাকরি ছেড়ে দিলেই ‘সে’ কে হারিয়ে ফেলবো!

বুঝতে পারি না, আমি কাকে পাশে চাই!
কর্মব্যস্ত আত্মীয় পরিজন নাকি ওয়ালমার্টে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার অলস সময়ে টুপ করে হাজির হওয়া ‘সে’-কে!

শুভ বন্ধু দিবস ‘সে’! তুমি যতক্ষণ আমাকে খুঁজে নিবে, ততক্ষণ আমি তোমার থাকবো।
আজ তোমায় পাঠালাম জুঁই ফুলের সৌরভ। ”

‘ওয়ালমার্ট সুপারসেন্টার’ স্ক্রিপ্ট থেকে।

মন যেতে চায়!

295tt

আমার বড়ো মেয়ে মৌটুসি ঢাকা ওয়াইডাব্লিউসিএ স্কুলে যখন নার্সারিতে পড়তো, স্কুলের ফাংশানে ওর ক্লাসের এক বন্ধুকে নাচ করতে দেখে ওরও নাচ শেখার শখ হলো।

ঐ স্কুলেই নাচের ক্লাসে ওকে ভর্তি করালাম। সপ্তাহে দুইদিন ওকে নাচের ক্লাসে নিয়ে যাই।
টিচার বাচ্চাদের নাচ শেখাতেন, বাচ্চাদের মায়েরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতো।

আমি মায়েদের গল্পে মনোযোগ না দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম নাচের টিচারের দিকে।
টিচার হাতের ইশারায়, হাতের আঙুলের আঁকিবুঁকি দিয়ে নাচের মুদ্রা তৈরি করতেন, আমি মুগ্ধ চোখে দেখতাম।

টিচার যেদিন দুই হাতের আঙুল আর মুঠি দিয়ে ‘পাখি’র মুদ্রা দেখালেন, আমার মাথার ভেতর তোলপাড় শুরু হলো। কোথায় দেখেছি, এমন পাখি কোথায় দেখেছি! কিছুতেই মনে পড়ছিলো না!

মৌটুসি ঘরে ফিরে প্রতিদিন নাচের প্র‍্যাকটিস করার সময় আমাকে বসিয়ে রাখতো। ওর ভুল হলে যেনো ভুলগুলো ঠিক করে দিতে পারি।

‘সুন্দরী কমলা নাচে’ গানের সাথে নাচের মুদ্রা প্র‍্যাকটিস করতে গেলেই হাতের আঙুল আর মুঠি দিয়ে পাখির মুদ্রা করতে হতো।

মৌটুসির হাতের মুদ্রার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একদিন চট করে মনে পড়ে গেলো, এই পাখি কোথায় দেখেছি!

পূর্ব পাকিস্তান আমলে আমরা থাকতাম নারায়ণগঞ্জের নগর খানপুর এলাকায়। তখন আমি খুব ছোটো ছিলাম।
একজন বুড়ো বেহালা বাজিয়ে ভিক্ষে করতো।
বুড়ো আমাদের কোয়ার্টারেও আসতো ভিক্ষে নিতে।
উনার বেহালার মাথাতেই দেখেছি ঠিক এরকম একটা পাখি (কাঠের তৈরি)!

বুড়ো বেহালা বাজাতো, আমি পাখিটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতাম।

পূর্বপাকিস্তান পিরিয়ডের কথা বলছি। তখন পথে ঘাটে খুব বেশী ভিক্ষুক ছিলো না।
যারা ভিক্ষে করতে মানুষজনের বাড়ি যেতো, তারাও একেবারে খালি হাতে ভিক্ষে চাইতো না।

কেউ একতারা দোতারা বাজিয়ে গান শোনাতো, কেউ খোল করতাল বাজিয়ে হরে কৃষ্ণ গেয়ে ভিক্ষে করতো।

একজন ফকির বাবা আসতো, আমরা ডাকতাম ‘ মুশকিল আসান’!
কারণ সেই ফকির বাবা বাড়ির উঠোনে পা দিয়েই জোরে বলতো, মুশকিল আসান। সেই থেকেই ফকির বাবার নাম হয়ে গেলো মুশকিল আসান।
মুশকিল আসান বাবা এসে উঠানে দাঁড়ালেই বাচ্চারা সব ছুটোছুটি করে মুশকিল আসানকে ঘিরে ধরতো।
মুশকিল আসানের পোশাক ছিলো বিশাল আলখাল্লার মতো, কতো রঙের কাপড় জোড়াতালি দিয়ে বানানো। গলায় থাকতো এক গোছা বড়ো দানা পুঁতির মালা।
মুশকিল আসান দুই চোখে কাজল দিতো।
উনার কাঁধে থাকতো ঝোলা, হাতে ধরা থাকতো টিনের পাতে তৈরি ধুনুচি। সেই ধুনুচি থেকে ধোঁয়া বের হতো।

মুশকিল আসান হাঁকডাক, হম্বি তম্বি করতেন না। উঠোনে এসে মুশকিল আসান বলে দাঁড়াতেন, তাতেই সাড়া পড়ে যেতো।

আমরা কাছে গেলে মুশকিল আসান আমাদের সবার কপালে ধুনুচি থেকে ছাইকালির টিপ পরিয়ে দিতেন, তাতেই আমরা খুশি হতাম।

মুশকিল আসান খুব শান্ত হলেও উনাকে আমার ভয় করতো। উনার কাছে গিয়ে টিপ পরতাম ঠিকই, কিন্তু উনার কাঁধে ঝুলানো ঝোলার দিকে তাকালেই মনে হতো, হঠাৎ আমাকে ধরে ঐ ঝোলার ভেতর ভরে ফেলবে।

আরেক জন আসতো গাজীর পট নিয়ে। কাপড়ের ক্যানভাসে রঙ দিয়ে আঁকা কত ছবি। কি কি যেন ছড়া কেটে গান করতো গাজীর পট নিয়ে আসা মানুষটা।

গাজীর পটের লোকটাই মনে হয় আমাদেরকে বিচিত্র সব ছবি দেখিয়ে বলতো, পাপ করলে নরকে যাবে। নরকে যমরাজ কঠিন শাস্তি দেয়। মিথ্যেবাদীদের জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলে, তারপর গরম তেলের কড়াইয়ে ফেলে—- আরও কত ভয়ঙ্কর সব কথা! পটে আঁকা নরকের ছবি দেখাতো।

আরও কয়েকজন সাদা থান পরা বৈষ্ণবী আসতো। তাদের নাকে তিলক আঁকা ছিলো। তারা করতাল বাজিয়ে গান গাইতো,
” প্রভাত সময়কালে শচির আঙিনা মাঝে, গৌর চাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে!”

শচি শুনলেই আমার মনে হতো শচি’দার কথা। আমার দাদা বৌদির নতুন সংসারে কাজ করতো শচি’দা। বড়োরা শচি’দাকে ডাকতো শইচ্চা।

এরপর তো মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। নয় মাস যুদ্ধশেষে দেশ স্বাধীন হলো, নতুন দেশে নতুন জীবন শুরু করতে গিয়ে মাত্র নয় মাস আগের জীবনটা পুরনো হয়ে গেলো, নাকি পূর্ব জনমের স্মৃতি হয়ে হারিয়েই গেলো!

স্বাধীন দেশে প্রতিদিন শত শত ভিক্ষুকের ভীড়ে হারিয়ে গেলো পূর্ব জনমে দেখা বেহালা বাদক বুড়ো, মুশকিল আসান, গাজীর পট, “শচির আঙিনা মাঝে গৌর চাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে” গান গাইয়ে বৈষ্ণবীদের মুখ।

বেহালা বাদক কোথায় হারিয়ে গেছে! পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে তাঁর বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে হয়তো, হয়তো গুলিতে বেহালার মাথায় বসা পাখিটাও ঝাঁঝরা হয়ে গেছিলো!

স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের নতুন জীবনে সকল পুরাতনেরা হারিয়ে গেছিলো! বেহালা বাদকও হারিয়ে গেছিলেন!

পরের শৈশবেই ভুলে গেছিলাম পূর্বের শৈশবের কথা। ভুলে গেছিলাম বেহালা বাদক বুড়োর কথা।

স্বাধীন দেশে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া জীবনের প্রতিটি দিন সংগ্রাম করতে করতেই বড়ো হয়ে গেলাম, নিজের সংসার হলো। পাকিস্তান পিরিয়ডে যে মেয়েটি ছোট্টো ছিলো, বাংলাদেশে সেই মেয়েটির কোলে এলো নতুন ছোট্টো মৌটুসি

*********************

স্বাধীনতার অনেক বছর পর, ছোট্টো মৌটুসিকে নাচের মুদ্রা শেখাতে গিয়ে আমার মনে পড়ে গেলো আমার শৈশবে দেখা কত জনের কথা! বেহালা বাদকের কথা, মুশকিল আসানের কথা, গাজীর পটে আঁকা নরকের ছবি!

**************************
সেই ছোট্টো মৌটুসিও আর ছোটো নেই। আমিও বুড়ো হতে চলেছি।

বুড়ো হতে হতেও যেন বুড়ো হতে পারছি না। গতরাতে আবার সেই বেহালা বাদককে স্বপ্নে দেখলাম!

হয়তো স্বপ্নে দেখিনি, আজকাল ঘোরের মধ্যে থাকি তো, থেকে থেকেই নিষ্পাপ নিষ্কলুষ শৈশবের কথা মনে পড়ে!

হয়তো গতরাতেও ঘোরের মধ্যেই বেহালা বাদকের কথা মনে পড়েছে। মনে পড়েছে সেই কাঠের পাখিটার কথা, যে লেজ ঝুলিয়ে বসে থাকতো বেহালার মাথায়।

পিচার প্ল্যান্ট এবং আলেকজান্দ্রিয়া

295

আর্কাইভ ঘেঁটে পিচার প্ল্যান্টের ছবিটা পেয়েছি।
পিচার প্ল্যান্ট, মানে কলসি গাছ। গাছ থেকে লালচে রঙের ঝুলন্ত বস্তুগুলোই পিচার বা কলসি।

এই গাছের কলসিতে জল রাখা হয় না, এর ভেতর পোকা থাকে। পোকা মাকড় গাছের গায়ে বসলে সেই পোকা কলসির ভেতর পড়ে যায়, সাথে সাথে কলসির মুখ বন্ধ হয়ে যায়।

এই কথাগুলো আমার নয়।

আলেকজান্দ্রিয়া নামে ৮/৯ বছরের মিষ্টি এক বালিকা তার ছোট ভাইকে তথ্যগুলো দিচ্ছিল। পাশে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে আমি শুনছিলাম।

২০১৬ সালের জুলাই মাসে আমি আর উত্তম আরেক বন্ধু দম্পতির সাথে বেড়াতে গেছিলাম নর্থ ক্যারোলাইনা। সেখানে ভ্যান্ডারবিল্ট সাহেবের প্রাসাদ আছে, সেই প্রাসাদের চারদিকে ছড়ানো সাজানো বাগানেই এক জায়গায় অনেকগুলো পিচার প্ল্যান্ট ঝুলছিলো।

আমি বিশাল বাগানের চারদিকে ঘুরছিলাম। তখন পদ্মপুকুরের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। বিশাল বড় পুকুর ভর্তি কত রঙের পদ্ম ফুটে আছে!

দূর থেকে উত্তম আমায় ডাকছিল পিচার প্ল্যান্ট দেখার জন্য।

কিছুক্ষণ আগেই আমি এই পিচার প্ল্যান্টের ছবি তুলেছিলাম। আবার কেন ডাকছে উত্তম!

কাছে আসতেই উত্তম আলেকজান্দ্রিয়াকে দেখিয়ে বলল, দেখো এই বাচ্চাটা গাছ সম্পর্কে কতকিছু জানে।

আমি দেখলাম, কাছাকাছি বয়সী দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে পিচার প্ল্যান্ট দেখছে। মেয়েটি বড়, সে-ই চোখ মুখ ঘুরিয়ে টক টক করে কথা বলছে, আর বাচ্চা ছেলেটি মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছে।

ওদের পাশে দাঁড়িয়ে উত্তমও ওদের কথা শুনছিল।

মেয়েটির নাম আলেকজান্দ্রিয়া, ওর ভাইয়ের নামটা মনে পড়ছে না। আলেকজান্দ্রিয়া খুব গুছিয়ে কথা বলে এবং খুব সম্ভবত কথা বলতে ভালোও বাসে।
আমি যখন আলেকজান্দ্রিয়ার সাথে গল্প করছি, হঠাৎ একজন আমেরিকান নারী আমাকেই জিজ্ঞেস করলো, ” আর ইউ ফ্রম বাংলাদেশ?”

আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, সে কী করে বুঝল আমি বাংলাদেশের মেয়ে!

আমেরিকান মেয়ে বলল, আই এম অলসো ফ্রম বাংলাদেশ।

এবার জানতে চাইলাম, সে বাংলা বলে কিনা।

আমেরিকান মেয়েটি স্পষ্ট বাংলায় বললো, সে বাঙালি। বাংলা তার মাতৃভাষা, তাই বাংলায় কথা বলতে পারে।
তার কথা শুনে নিশ্চিন্তের হাসি হেসে ফেললাম।

মেয়েটির নাম নেলি, ৮৬ সালে আমেরিকায় এসেছে। বিয়ে যাকে করেছে, সে আমেরিকান। আলেকজান্দ্রিয়া আর ওর ভাইয়ের দিকে দেখিয়ে বললো, আমার দুই ছেলেমেয়ে।

ওরা বাংলা বোঝে?

নেলি বললো, আমার বাংলা বোঝে, তবে কেউ বাংলা বলতে পারে না। আমার সাহেব বরও বাংলা বোঝে। আমার সাহেব স্বামীই কিন্তু একটু আগে আমায় ডেকে বলেছে, “দেখো, ঐ ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা মনে হয় বাংলাদেশের, ওদেরকে বাংলায় কথা বলতে শুনেছি মনে হয়।”

বরের মুখে এই কথা শুনেই নেলি আমার কাছে এগিয়ে এসে জানতে চেয়েছিল আমি বাংলাদেশের কিনা।

নেলির বর তখন উত্তমের সাথে গল্প শুরু করেছে, আর আমি গল্প করছি নেলির সাথে।
নেলিকে দেখে কিছুতেই মনে হয় না সে বাঙালি।
ভীষণ নরম স্বভাবের আমেরিকান মেয়ে যেমন হয় দেখতে, নেলি ঠিক তেমন।

সবচেয়ে অবাক হয়েছি আলেকজান্দ্রিয়ার কথা শুনে।
ও আমাকে ইংরেজিতেই জিজ্ঞেস করলো, ” তুমি কি সালোয়ার কামিজ পরেছ? জানো, আমি একটা বাংলা কথা বলতে পারি, “আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
আচ্ছা তুমি কি প্রতিদিন রাইস রান্না করো? আমার মা প্রতিদিন রাইস রান্না করে।”

নেলির ৬ বছরের ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম সে কোনো বাংলা জানে কিনা। ৬ বছরের শিশুবালক হেসে বলল, “শুনতে পাও’?

বললাম, — “শুনতে পাও” কেনো বলো, কাকে বলো?

ছয় বছরের শিশু বললো, মা বলে শুনতে পাও?

নেলি বুঝিয়ে দিল, “আমি যখন বাংলাদেশে কথা বলি, নেটে গোলমাল থাকলে বলি তো, আমার কথা কি শুনতে পাও? সেখান থেকে ও “শুনতে পাও” কথাটা পিক করেছে।

আরও অনেকক্ষণ গল্প করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আমাদের সফরসংগি কমলেশ আর করবী আমাদের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছিল।

নেলির সাহেব বর ইংলিশে বলল, “আমরা খুব সহজে কোন বাংলাদেশির দেখা পাই না। আজ তোমাদের দেখে খুব ভাল লাগল।’

নেলি আর ওর চমৎকার পরিবারকে হাত দেখালাম, ভালোবাসা প্রকাশ করে গার্ডেন থেকে বেরিয়ে এলাম।

পৃথিবীর কত জায়গায় কত বিস্ময় যে অপেক্ষা করে!!

কী লিখি তোমায়!

কী লিখি তোমায়!

সুহৃদ,
মনটা গত কিছুদিন যাবত বিক্ষিপ্ত ভাবনায় কখনও অস্থির, কখনও এলোমেলো থাকছে। মন কিছুতেই বশে আসছেনা। এই যে লাগাতার অস্থিরতা এটা মনের দোষ বা গুণ নয়, মনের উপর লাগাতার সময় পরিবেশ পরিস্থিতির বিভিন্ন মাত্রার যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে, তাতেই মন বেচারা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

মন যখন আমার বশে থাকেনা, আমি নিজেকে তখন বশে আনার চেষ্টা করি। সারাক্ষণ কথা বলি মানুষটা কথাবার্তায় সংযমী হয়ে উঠি, দিনের বেশির ভাগ সময় নীরব থাকি। তাতে মনের খোলা জানালা দিয়ে এলোমেলো ভাবনারা আসে ঠিকই, তবে খুব বেশিক্ষণ স্থায়ীত্ব পায়না।

এই যে আমি এতক্ষণ ধরে লিখে চলেছি, দিকভ্রান্ত শব্দগুলোই জানান দেয় মনের অস্থিরতার কথা। এমন এলোমেলো কথা আমি সাধারণ অবস্থায় বলিনা, ভাবিওনা। বেশি কথা বলি, সারাক্ষণ কথা বলতে ভালো লাগলেও কথা বলার সময় কথা গুছিয়ে বলা আমার অভ্যাস। মন যখন বশে থাকেনা, চাইলেও কথাগুলো গুছিয়ে উঠতে পারিনা বলেই নীরব থাকাকেই শ্রেয় মনে করি।
নীরব থাকারও তো নিয়ম কানুন আছে। চাইলেই নীরব থাকা যায়না। নীরব থাকাকে অনেকে ‘গরিমা, অহঙকার, দম্ভ’ ভেবে মাঝে মাঝে ভুলও করে। এটা নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছি।

খুব ছোটবেলায় আমি শান্ত চুপচাপ থাকতেই পছন্দ করতাম। নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত ক্লাসের বন্ধুদের অনেকেই আমাকে পেছনে ‘ দেমাকি, অহঙ্কারী’ বলতো। পেছনেই বলতো, কারণ মিথ্যে কথা সামনাসামনি বলা কঠিন। তাছাড়া আমাদের ছাত্রজীবনে ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল, ফার্স্ট বয়দের শিক্ষক শিক্ষিকাগণ ভালোবাসতেন, প্রশ্রয়ের চোখে দেখতেন। ফলে তাদের সম্পর্কে যখন তখন বাজে কথা বলে, ‘অহঙ্কারি দেমাগি’ ডেকে কেউই শিক্ষক শিক্ষিকাদের বিরাগভাজন হতে চাইতোনা।

তারপরেও কথা থেমে থাকতোনা। পেছন থেকে যে বলে, সে তো জানেনা পেছন থেকে ফিসফিসিয়ে বললেও সেই কথা সামনের দিকে যায়। কথা পেছন দিকে যায়না। স্বভাব শান্ত থাকাতো আমার দোষ ছিলনা, কিন্তু এই স্বভাবের কারণে সমবয়সীদের কাছে ‘দেমাগি, অহঙ্কারী’র খেতাব পেয়ে মন খারাপ হতো, শান্ত মুখচোরা আমি আরও নীরব হয়ে যেতাম। কিন্তু এভাবেই কতকাল, মানুষ মাত্রেই পরিবর্তন চায়। আমি পরিবর্তিত হতে চেষ্টা করি। শান্ততার বেড়া ভাঙতে চেষ্টা করি, অশান্ত, চঞ্চল হয়ে ওঠার জন্য কিশোরী মনে প্রতিজ্ঞা করতে করতেই একদিন চঞ্চল, কথাবার্তায় কলকল হয়ে উঠি। এবং স্বভাবে এই উত্তরণ ঘটেছিল নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবার পর।

সেই থেকে বলি, কথা বলি, ভাল কথাও বলি মন্দ কথাও বলি। ধর্মের কথা বলি, অধর্মের বিপক্ষে বলি। ন্যায়ের পক্ষে বলি, অন্যায়ের বিপক্ষে বলি। বলতে বলতে বলতে বলতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ি। সেই ক্লান্তিই একসময় আমার মাঝে শিশুকালের শান্ততা, নীরবতা ফিরিয়ে নিয়ে আসে। ফিরিয়ে আনার কিছু নেই, ওগুলো তো ছিলই আমার মধ্যে, চারিত্রিক কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়েই মানুষ জন্মায়। জন্মের সময় নিয়ে আসা বৈশিষ্ট্য হারায়না, নষ্ট হয়না আড়ালে চলে যায় মাত্র। প্রয়োজনে আড়াল সরিয়ে আবার সামনে এসে দাঁড়ায়।

আমার নীরবতাগুলোও আজকাল আড়াল সরিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বলেই আমি নীরব থাকি। যে আমি ফেসবুকে ঘন্টায় ঘন্টায় বড় বড় স্ট্যাটাস লিখে কথার ঝড় তুলতাম, সেই আমি এখন লিখবার মত কোন কথা খুঁজে পাইনা। আগে বিষয় না পেলে নিজে বিষয় বানিয়ে নিতাম। নির্দিষ্ট কোন বিষয় নিয়ে লিখতে না পারলে ওয়ালমার্টে আট ঘন্টা কাজ করতে গিয়ে কি কি অভিজ্ঞতা হলো, তা দিয়েই তিন পৃষ্ঠা লিখে ফেলতাম। সে এক সময় ছিল, তিন চার বছর আগের কথা বলছি, নাওয়া খাওয়া ভুলে লিখতে বসে যেতাম এত ভাল লাগতো লিখতে।

বললাম যে, এখন মন অস্থির তাই নীরব থাকি। অস্থিরতার কারণগুলো খুব স্পষ্ট, আমি শান্তি ভালোবাসি, শান্তিতে আমি একা থাকবো তা নয়, আশেপাশে সকলেই শান্তিতে থাকবে, তবেই আমি শান্তিতে থাকতে পারবো। কথা হচ্ছে, আশেপাশে কেউই শান্তিতে নেই। পৃথিবীর কোন দেশেই নয়, কম বেশি অশান্তি সব দেশে বিরাজমান। আগে শান্তিতে থাকতো বিদ্বান, জ্ঞানী, নিঃসম্বল এবং ধনবানেরা। এখন মূর্খ মার্গ, ধনী দরিদ্র কেউই নিশ্চিন্ত আরামে একটা রাত অন্তত ঘুমাতে পারেনা। যে মানুষটির কোন শত্রু নেই, কোথা থেকে যেন তাকেও শত্রু এসে আঘাত করে। মানুষ শত্রু না পেলে প্রকৃতিই শত্রু হয়ে যায়। হঠাত জলোচ্ছ্বাস, টর্ণেডো, কালবোশেখি ঝড়, বজ্রপাত, ভূমিকম্প সুনামি— প্রকৃতিই কি কম কায়দা জানে শত্রুতা করার!

মানুষ শত্রুর কথা যত কম বলা যায় তত ভাল। কিন্তু আজকাল কারো বলাবলির অপেক্ষায় কেউ থাকেনা। সকলের জীবন অনিশ্চিত হয়ে গেছে। একদল মানুষ রাস্তা বরাবর নিশ্চিন্ত মনে হাঁটছে, ঠিক সে সময় বলা নেই কওয়া নেই অচেনা শত্রু এসে হাজির। চলন্ত ট্রাকটা হয়তো তাদের উপর তুলে দিল, শত্রুর চেহারা দেখার আগেই তারা ট্রাকের চাকার নীচে পিষ্ট হয়ে মরে গেলো। অথবা হয়তো অফিসে বসে কাজ করছে সকলে, কোম্পানির জিএম থেকে শুরু করে গেটের দারোয়ান, এর মধ্যেই কখন বোমা ফাটলো, দারোয়ান থেকে অফিসের জিএম আগুনে ঝলসে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেলো।

এই তো কয়েক মাস আগের কথা রাজীব নামের বাপ মা মরা ছেলে, টিউশনি করে লেখাপড়া করে, কলেজ যাওয়ার পথে বাসে ঝুলন্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কোথা থেকে আরেক বাস এসে এমন চাপা দিল যে হাতটাই ছিঁড়ে গেলো, সেই থেকে সে মারাও গেলো। এগুলো তো অচেনা শত্রুর কথা বললাম, চেনা শত্রুর কথা উঠলে তো আর কথাই নেই। এই ফেসবুকে এসেই অভিজ্ঞতা হয়ে গেলো শত্রুতা কত রকমের হতে পারে! একজনের সাথে মতে মিলেনা, শুরু হয়ে গেলো শত্রুতা। একজন আরেকজনের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়ে যাবে, তা কি করে হয়! শুরু হোক শত্রুতা, ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক সকল জনপ্রিয়তা।

ধর্ম নিয়ে শত্রুতা এখন চরমে, এই শত্রুতা মানুষের জীবন মরণের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে। এই শত্রুতার জের ধরে একজন মারবে, অন্যজন মরবে। আমি আমার ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাস করি, সেও তার ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাস করে। এখানে শত্রুতা হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু তবুও শত্রুতা, প্রাণঘাতী শত্রুতা। কি নিয়ে? দুজনের ধর্মীয় মূল্যবোধ, চিন্তাভাবনা, প্রেক্ষাপটে মিল নেই বলে।

দুজন চিন্তা করে দুভাবে, এটাই শত্রুতার জন্য যথেষ্ট। আমি যে ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাস করি, তোমাকেও তা করতে হবে। তুমি যদি তা না করো তাহলে একদম নীরব থাকবে নয়তো মারা পড়বে। যুক্তি তর্ক করা, যুক্তি খন্ডন করার ভদ্র নীতি রীতি এখানে চলবেনা। হয় মেনে নাও, নয় সরে যাও, মাঝামাঝি কোন অবস্থান বলে আর কিছু নেই বর্তমান সময়ে।

তোমার যুক্তি শোনার ধৈর্য আমার নেই, আমি যে তোমাকে পালটা যুক্তি দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করবো সেই সময়, জ্ঞান, বিদ্যা, ধৈর্য্ কোনটিই আমার নেই। কাজেই উড়ুক ঘুড্ডি আকাশে, চলুক কাটাকুটির খেলা।

এখানেই আমার সমস্যা। পয়সা দিয়ে ঘুড্ডি কিনেছি, সূতোয় মাঞ্জা দিয়েছি, আমার বাড়ির সীমানার আকাশে ঘুড্ডি উড়াচ্ছি। শুধু কাটাকুটি খেলবে বলেই তুমি গায়ে পড়ে এসে আমার ঘুড্ডিটাকে ভোকাট্টা করে দিয়ে উল্লাস ধ্বনি দিতে দিতে চলে যাবে, আর আমি কিনা লাটাইয়ে ছেঁড়া সূতো পেঁচাতে পেঁচাতে ঘুড্ডির জন্য শোক করবো! কেন, কী ক্ষতি হতো তুমি তোমার আকাশে তোমার খুশিতে ঘুড্ডি উড়াতে, আর আমি আমার আকাশে। আমাদের বন্ধুত্বতা না হোক, শত্রুতা তো হতোনা! শত্রু বাড়িয়ে লাভ কি! আমার ঘুড্ডি ভোকাট্টা করে দিয়ে তুমি কি পেলে!

একজন বাষট্টি বছর বয়সী লেখক, পুস্তক প্রকাশককে নিরস্ত্র অবস্থায়, বিনা প্রতিরোধে গুলী করে হত্যা করে কি লাভ হলো! মানুষটা জীবনের অর্ধেকের বেশি কাটিয়ে ফেলেছেন, বাঁচলেই আর কয় বছর বাঁচতেন। বড় জোর কুড়ি বছর, কী ক্ষতি হতো তাঁকে কুড়িটা বছর নিজের মত করে নিজের আকাশে ঘুড়ি উড়াতে দিলে?

এই কথাগুলোই বুকের মাঝে তোলপাড় করে, মাথার ভেতর ভন ভন করে। কেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এত হত্যা, কেন আমেরিকার বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল দেশের এমন বৈরী মনোভাব, কেনইবা বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর বর্তমান- ভবিষ্যত নিয়ে আমেরিকা অযথা মাতবরি করে অশান্তির আগুন বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়তে দিয়েছে! কেনোইবা খোদ আমেরিকার পথে ঘাটে, শপিং মল, স্কুল কলেজে বন্দুক হাতে আততায়ী প্রবেশ করে, কেনইবা নিরপরাধ বাচ্চা বুড়ো শিশুদের হত্যা করে, কী আনন্দ পায়! এগুলো ভেবে খুব কষ্ট হয়, অশান্তি লাগে। অজানা মৃত্যু ভয়ে বুকে কাঁপন ধরে।

আগেও অশান্তি হতো মনে নানা কারণে, ফেসবুক ওপেন করে বসলেই মন ভাল হয়ে যেত। আজকাল আর তা হয়না, আমার আনন্দভুবনে কেমন করে যে এত বিষাদের ছায়া নেমে এসেছে!
ফেসবুকে এখন আমার আর লিখতে ইচ্ছে করেনা। কেমন যেন অচেনা লাগে সব কিছু, অচেনা লাগে সবাইকে। ফেসবুকেও শত্রুতা, ফেসবুকেও ঝগড়া। সব কিছুতেই দুই গ্রুপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এ বলে, আমাকে দেখ, ও বলে, আমাকে দেখো। দুই পক্ষই শক্তির তেজ দেখিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে মরীয়া হয়ে যাচ্ছে।
দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে, ক্রসফায়ারে বিচার বহির্ভুত মানুষ মারা যাচ্ছে, রাজনৈতিক মতবিরোধ চরমে, কেউ কাউকে সম্মান করেনা, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, বর্তমান প্রধান মন্ত্রীকে নিয়ে যার যেমন খুশি নরমে গরমে কথা বলেই যাচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে কথা কাটাকাটি, ধর্ষণ ঘটনায় এক দল ধর্ষিতার পক্ষে, আরেকদল ধর্ষকের পক্ষে বলছে, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার জন্য একদল ফান্ড রেইজ করছে, আরেক দল তাতে বাধা দিচ্ছে, এই থেকে শুরু হয়ে যাচ্ছে একে অপরের প্রতি কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির কুৎসিত প্রতিযোগিতা।

ফেসবুকে এখন আর সুবাতাস বহেনা, এখানে এখন আর পাখি ডাকেনা, নদী কুলকুল শব্দে বয়ে যায়না। ঈদ পূজা নিয়ে প্রাণ খুলে আনন্দ কথা লিখা যায়না, আইডি ব্যান হয়ে যাওয়ার ভয়ে মনের কথাটুকু প্রকাশ করা যায়না।
এখানে ভয়ের বাদশারা রাজত্ব করে, চারদিকে ছোট ছোট ভয়েরা খেলা করে। যারা মানবতাবাদী ছিল তারাও ভালর পক্ষে কথা বলতে ভয় পায়, মন্দের বিপক্ষে কথা বলতেও ভয় পায়। তারা ধর্ষিতার পক্ষে দাঁড়াতেও ভয় পায়, ধর্ষণের বিপক্ষে কিছু বলতেও ভয় পায়।

আমার শৈশবের শান্ততা, নীরবতারা ফিরে ফিরে আসে, ছোটবেলায় অচেনা জায়গায় যেতে ভয় পেতাম, অচেনা মানুষকে ভয় পেতাম। এই ফেসবুক আমার কাছে অন্যরকম লাগে, প্রায়ই অপরিচিত লাগে। অপরিচিতের মাঝে আমি স্বস্তি পাইনা, অচেনার ভীড়ে নিজেকে খুঁজে পাইনা, তাই বোধ হয় আজকাল শৈশবের নীরবতাকেই আঁকড়ে ধরেছি। ব্যথায় মন ভারী হয়ে থাকে, গুছিয়ে কথা বলতে পারা আমিও আর গুছিয়ে বলতে পারিনা আমার কিসের ব্যথা। কবিগুরুর গানের কথাটুকুই মনের ভেতর কেঁদে মরে, “যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা, তোমায় জানাতাম”।

লীলাবালি!

লীলাবালি!

প্রায় ১৯ বছর আগের কথা, মেলবোর্নে ছিলাম, দারুণ সুন্দরী নাহার আপার সাথে পরিচয় হয়। নাহার আপা আমার চেয়ে অনেক সিনিয়র ছিলেন। শুনেছি আপা ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসাইটে সুন্দরী এবং মেধাবী ছাত্রী ছিল। অস্ট্রেলিয়া এসে মাস্টার্স করে আপা তখন ভাল চাকরি করছে।

নাহার আপার একমাত্র মেয়ে জুমানা ছিল মায়ের চেয়েও দুই ডিগ্রি বেশী সুন্দর। গালে টোকা দিলে আবির ঝরে, নাহার আপা এমন ধরণের সুন্দরী। আপার মেয়ে জুমানাও তাই।

নাচ-গান নিয়ে লাফানি ঝাঁপানি করতাম বলে নাহার আপা আমাকে খুব পছন্দ করত, বয়সে আমার চেয়ে বড় হলেও যেহেতু উত্তমকে ঢাবিতে সিনিয়র ভাই এবং পরবর্তিতে লেকচারার হিসেবে দেখেছে, সেই সূত্রে আমাকে ‘বৌদি’ ডাকতো।

তখন বাংলাদেশ সমিতির ব্যানারে কোন একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মহড়া চলছিল। শনিবার আর রবিবারে প্র্যাকটিস চলতো। বাংলাদেশীদের প্রায় সকলেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করেছিল, দুই কন্যা মৌটুসী, মিশাকে নিয়ে আমি তো অংশ নিয়েছিলামই, একমাত্র কন্যা জুমানাকে নিয়ে নাহার আপাও অংশ নিয়েছিল।

কোন এক রবিবারে প্র্যাকটিসে যাওয়ার আগে এক দুপুরে আমাদের বাসায় এলো, আমি নাহার আপার জন্য খাওয়ার আয়োজন করছি আর কলবল কলবল করেই যাচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল হলো নাহার আপার গলায় দুলতে থাকা ক্রিস্টালের মালার প্রতি, আমি ” ওহ মাগো, কী সুন্দর মালা, নাহার আপা, এই মালা আপনার জন্যই তৈরী হয়েছে” বলে হই হই করে উঠলাম।

নাহার আপা জানতে চাইলো, “বৌদি, আপনি কি বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে?”
বলেছি, “হ্যাঁ, কেন বলেন তো”।
নাহার আপা বলল, “একমাত্র মেয়েরা কখনও বড় হয়না, কথায়, চলনে সব সময় আহ্লাদী ভাব একটা থেকেই যায়। লীলাবালি লীলাবালি গানের লীলাবালির সাথে আপনার মিল আছে”।

বললাম, “আমাকে লীলাবালি মনে হয়? মালা সুন্দর বলার সাথে লীলাবালির কি মিল পেলেন”?

নাহার আপা বলে, “আহ্লাদী বলেই সাধারণ ক্রিস্টালের মালা দেখেও এত খুশী, লীলাবালিরা এমনই আহ্লাদি হয়, দাঁড়ান আমি আপনাকে মালাটা দিয়ে দিচ্ছি”।

আমি নাহার আপাকে বললাম, “আমাকে মালা দিলে লাভ নেই, এই মালা তো মালাকার ‘নাহারবালি’র জন্য বানিয়েছে, লীলাবালির জন্য বানায়নি”।

নাহার আপা বলল, “এই যে দেখেন, আহ্লাদিরাই এমন সুন্দর করে কথা বলতে পারে। স্যার মনে হয় আপনার আহ্লাদীপনা খুব এনজয় করে, তাইনা বৌদি?”

বললাম, “আমি যে আহ্লাদী, তাইতো জানলাম এখন”।
-বৌদি, আপনার এই ছটফটে ভাব আমার খুব ভালো লাগে, আমারও ইচ্ছে করে এমন চঞ্চল হতে, কিন্তু আমি চঞ্চল হতে পারিনা।”

আমি মালাটি নাহার আপার গলা থেকে খুলতেই দেইনি, কারণ সুন্দর জিনিস দেখাতেই আমার আনন্দ, হাতে পেয়ে গেলে আনন্দটা আর থাকেনা।

সোনার গহনার প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই, নারী আড্ডায় সোনার গহনা নিয়ে গল্প হবেই, সেই গল্পে আমি নীরব থাকি। কিন্তু রঙ বেরঙের পাথর, মুক্তো, ডায়মন্ড, ক্রিস্টাল বসানো অলঙ্কারের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকতে পারি। তবে ঐ তাকিয়ে থাকা পর্যন্তই আমার আনন্দ, হাতে পেলে আর তাকিয়ে দেখিনা।

ওয়ালমার্টে অনেক ধনী-গরীব মেমসাহেব আসে, আমেরিকার মেমসাহেবরা বাঙ্গালী নারীর মতই অলঙ্কার পছন্দ করে, তাদের অলঙ্কারে সোনা-রূপার চকচকানির চেয়েও বেশী জ্বলজ্বল করে নানা বর্ণের পাথর, হীরে, চুনী, পান্না। আমি চাকরি করি এমনই এক ডিপার্টমেন্টে যেখানে ধনী-দরিদ্র সকলেই আসে, আমেরিকার মানুষ ক্ষিদে পেলে পেটে পাথর বেঁধে থাকতে পারবে কিন্তু মোবাইল ফোন ছাড়া বাঁচবেনা।

মেম সাহেবদের মধ্যে যারা সাদা মেমসাহেব, তাদের গহনাগুলোর দিকে আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, গহনার প্রশংসা করি, গহনার গল্প শুনতে চাই। তাদের সকলেই খুব খুশী হয় গহনার প্রশংসা শুনে, যতটুকু জানতে চেয়েছি, তার চেয়েও অনেক বেশী গল্প বলে ফেলে। আর কালো

মেমসাহেবদের গহনার প্রতি আমার কোন আগ্রহ থাকেনা। কালো মেমসাহেবদের গহনা মানেই ‘গোবদা গাবদা’ ডিজাইনে, কটকটে রঙের সমাহার, একটুক্ষণ তাকালেই আমার মাথা ব্যথা করে।

আজ এক কালো মেমসাহেবকে মোবাইল ফোন পছন্দ করতে সাহায্য করছিলাম, মেমসাহেব আমার মাথাটা খারাপ করে দিচ্ছিলো, মন ঠিক করতে পারছিলনা কোন ফোন নিবে। বার বার কেইস খোলায়, ফোন দেখে, এরপর বলে, ” সরি, এটা না, ওই কেইসের ভেতর থাকা ওই ফোনটা একটু দেখাও”। শেষ পর্যন্ত একটা ফোন নিলো, এরপর শুরু হলো ফোনের জন্য ফোন কেইস খোঁজার পালা। এটা দেখে, ওটা দেখে, আমাকে জিজ্ঞেস করে, ঐ সময় আরেকজন কালো মেমসাহেব মোবাইল কার্টে চড়ে আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো।

গাড়িতে চড়া মেমসাহেব বিশাল দেহের অধিকারি, আজ রবিবার, চার্চ থেকে ফিরেছে তা সাজগোজ দেখেই বুঝা যায়। রবিবারের গল্প আমি অনেকবার করেছি, রবিবারে আমার মন প্রফুল্ল থাকে, কারণ এই বারে সকলেই সাজগোজ করে চার্চে যায়, চার্চ থেকে ফেরার পথে ওয়ালমার্ট ঘুরে যায়। ওদের সাজগোজ দেখানোর জায়গা এই ওয়ালমার্ট, প্রেমে পড়ার জায়গা ওয়ালমার্ট, এক পৃথিবীর ভেতর আরেক পৃথিবী।

কালো মেমসাহেব গাড়ি চালিয়ে আমার কাছাকাছি হতে চোখাচোখি হলো, মুখটা চেনা চেনা লাগছে। অনেক সাজু করলেও খুব মার্জিত সাজ করেছে, গলায় সাদা মুক্তো পুঁতি আর রঙিন পুঁতিতে গাঁথা মালা, হাতে সাদা মুক্তোপুঁতির চার লহরে গাঁথা ব্রেসলেট, আঙ্গুলে বড় সাদা পাথরের আংটি। পরণে সাদা স্কার্ট, নীল-সবুজ-সাদা প্রিন্টের ঢোলাঢালা শার্ট। সব মিলিয়ে স্নিগ্ধ সাজ।

মেমসাহেব আমার দিকে তাকিয়ে পরিচিতের হাসি হেসে বললেন, ” হাই, হাউ আর ইউ সুইট লেডি”

আমিও হেসে প্রতিউত্তর দিলাম, ” হাই! কেমন আছো? বাহ, কী সুন্দর তোমার গলার মালাটা”।

মেমসাহেব বলে, “মালাটা সুন্দর? সত্যি বলছো?”
-বললাম, সত্যি বলছি, খুব সুন্দর।
মেমসাহেব গলা থেকে মালাটা খুলে ফেললো, আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো, “মালাটা তুমি নাও”।

আমি অপ্রস্তুত, বলি, “একী, মালা আমায় দিচ্ছো কেন?”

মেমসাহেব বলে, “তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে, তুমি ভুলে গেছো হয়তো, আমি একদিন টিভি কিনতে এসেছিলাম, ইলেকট্রনিকস ডিপার্টমেন্টে এত্তগুলো অপদার্থ থাকার পরেও কেউ আসেনি আমাকে হেল্প করতে। তুমি এসেছিলে এবং আমাকে অনেক সাহায্য করেছিলে। আমার এত ভালো লেগেছিল তোমার ব্যবহার। তোমার এত ধৈর্য্য, খুব বড় গুণ।”

বললাম, “কী জানি, আমার মনে পড়ছেনা।”
-আমার মনে আছে, আমার তখনই মনে হয়েছিল তোমাকে কিছু একটা উপহার দেই। আজ তুমি নিজেই মালাটি সুন্দর বলে আমাকে উপহার দিতে হেল্প করলে, এটা তোমার প্রাপ্য”।

আমার তখন অস্বস্তি লাগছে, এভাবে কারো কাছ থেকে কিছু নিতে অস্বস্তি হয়, মনে মনে ভাবছিলাম, “নাহার আপার কথাই ঠিক, আমি বড় হইনি, পুঁতির মালা দেখলে এখনও মন টলমল করে উঠে।

কালো মেমসাহেব বলল, “মালাটা তুমি এনজয় করবে, আমাকে মানাচ্ছেওনা, দেখো পরণের এই জামার সাথেও যাচ্ছেনা। তুমি নাও, আমি খুশী হবো।”

মালা হাতে নিলাম, খুব আন্তরিকভাবেই বললাম, “তোমার দেয়া উপহার আমি খুব যত্ন করে রেখে দিব, অনেক ধন্যবাদ তোমায়”।

মালা বাম হাতে পেঁচিয়ে রেখেও মনে শান্তি পাচ্ছিলাম না। চারদিকে সিসিটিভি ক্যামেরা ফিট করা আছে, পান থেকে চুন খসলে চাকরি নট হয়ে যাবে। চাকরি নট হলে আমি আর্থিক সমস্যায় পড়বোনা, কিন্তু লজ্জায় মরে যাব। আমি নিজে থেকে দশবার চাকরি ছাড়তে পারি, কিন্তু আমাকে চাকরি থেকে একবার নট করে দিলে মরে যাব, কারো সামনে দাঁড়াতে পারবোনা। আত্মসম্মানবোধ খুব বেশী টনটনা আমার। জব পলিসিতে আছে, কাস্টমারদের কাছ থেকে কোনরকম উপঢৌকন নেয়া যাবেনা।

মালা হাতে পেঁচিয়ে গেলাম ম্যানেজার স্টেশানে, একজনকে পেলাম। তাকে বললাম সংক্ষেপে যা বলার, ম্যানেজার বলল, “তুমি রাখতে পারো। কেউ ডলার দিতে চাইলে নিওনা”।

শেষে বললাম, মালাটির মূল্য আমার কাছে পয়সায় নয়, আজ রবিবার, ভদ্রমহিলা চার্চ থেকে ফিরেছেন, এক কথায় গলা থেকে মালা খুলে আমাকে যখন দিলেন, আমার মনে হল, মালাটির সাথে স্পিরিচুয়াল ফিলিং জড়িয়ে আছে। ওয়ালমার্টের জব পলিসিতে যদি এই উপহার গ্রহণ অপরাধ বলে ধরা হতো, আমি জানিনা কী করতাম। চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যেতাম, তবুও একজনের ভালোবাসাকে অগ্রাহ্য করতে পারতামনা।

ম্যানেজার হাসি দিয়ে বলল, এটা তো ভালো ইউ ডিড গুড জব, কাস্টমার খুশী হওয়া মানেই আমাদের খুশী। ডলার বাদে যে কোন উপহার নির্দ্বিধায় গ্রহণ করতে পারো।

ম্যানেজারের রুম থেকে বেরিয়ে এলাম ফুরফুরে মন নিয়ে, মনে পড়ে গেলো, ঊনিশ বছর আগের এক দুপুরের কথা, নাহার আপা বলেছিল, “লীলাবালি লীলাবালি, কি দিয়া সাজাইমু তোরে” গান শুনলেই আমার কথা মনে হয়। আহলাদী লীলাবালি আমি।

৩০ শে আগস্ট, ২০১৫

তেতো কথা!

তেতো কথা! “ধর্ষণে টপ লিস্টে আছে আমেরিকা, ইউরোপ, বাংলাদেশ নেই”– কি করে জানলে?
বাংলাদেশে তো ধর্ষণের কেইস হয় না, ধর্ষিতার সমাজে ঠাঁই হয় না, ধর্ষিতার বিয়ে হয় না। ফলে ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয় না। তাই প্রতিদিন কত শত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তার পরিসংখ্যান জানা যায় না। বাংলাদেশে নারী মূর্তিও ধর্ষিত হয়, দেবী প্রতিমাও ধর্ষিতা হয়।

৯৫ বছরের বুড়াও নারীকে তেঁতুল ভেবে জিভে লালা দিয়ে টকর টকর আওয়াজ তোলে, এটাও ধর্ষণ। ধর্ষণ যে করে, সে ধর্ষণের সংজ্ঞা জানেনা, ধর্ষিতা যে হয়, সেই শুধু জানে ধর্ষণের সংজ্ঞা। শফি হুজুরের তেঁতুল তত্ত্বে বাংলাদেশের সকল নারী ধর্ষিত হয়েছিল।

ধর্ষিতার মৃত্যু দেখানো হয় ভালুকের কামড়ে। মেডিক্যাল রিপোর্ট দুই রকম আসে, প্রথমে বলে, ধর্ষণ হয়েছে। দুই দিন পর কবর থেকে গলে যাওয়া দেহ পরীক্ষা করে বলা হয়, ধর্ষণের আলামত নেই। তাহলে??

যাও বা সাহস দেখিয়ে দুটো মেয়ে থানায় গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ দাখিল করলো, তাতেও প্রশ্ন উঠেছে, মেয়ে কেন বাইরে গেলো? মেয়ে কেন ছেলে বন্ধুর নিমন্ত্রণে হোটেলে গেল? ধর্ষণের এক মাস পরে কেন অভিযোগ?

** শিশু পূজা কোন হোটেলে গেছিলো? তনু কোন ছেলের সাথে গেছিলো? মাদ্রাসায় ছোট ছেলেদের বলাৎকার করা হচ্ছে কেন? মাদ্রাসা তো পবিত্র স্থান!
বাকোয়াজদেরও নির্লজ্জতার সীমা থাকা উচিত!**

আমার বন্ধুদের মধ্যে দয়া করে আর কেউ বোকার মত বলো না, “ধর্ষণে আমেরিকা সবার উপরে, বাংলাদেশে ধর্ষণ হয়না।” কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগে!

আমেরিকা ধর্ষণ লিস্টে কেন টপে আছে জানতে চাও? একটা ছোট অভিজ্ঞতার কথা বলি।

ওয়ালমার্টে একদিন কাজের ফাঁকে হাঁটতে হাঁটতে অন্য এক ডিপার্টমেন্টে গেছি। সেখানে পরিচিত এক মেয়ে এসোসিয়েটকে না দেখতে পেয়ে তার সহকর্মীকে ( ছেলে) জিজ্ঞেস করলাম, “আমান্ডা( কল্পিত নাম) আজ আসেনি?”
সহকর্মী বলল, “আমান্ডা আজ পুলিশের কাছে গেছে”।
-কেন?
-গত সন্ধ্যায় ওর এক ছেলে বন্ধু ওর ফ্ল্যাটে বেড়াতে এসেছিল। ড্রিংক করেছে , হাসি গল্প করেছে এরপর নাকি বন্ধু ওকে জোরপূর্ব্বক ফিজিক্যালি এবিউজ করেছে। তাই ও তখনই পুলিশ কল করেছিল। পুলিশ এসে বন্ধুকে নিয়ে যায়। সেটারই রিপোর্ট করতে হবে আজ, তাই ও আজ আসেনি”।

এই কারণেই আমেরিকার নাম সব কিছুর টপে দেখা যায়; কারণ আমেরিকানরা কোন কিছু নিয়ে লুকোছাপা করেনা অথবা লুকোছাপা করে রাখতেও পারে না। সব প্রকাশিত হয়ে পড়ে অথবা বিনা দ্বিধায় যার যার সমস্যা সে জায়গা মত প্রকাশ করে। আইন এদেশে সকলের জন্য প্রযোজ্য।

ধর্ষণ একটি মানসিক ব্যাধি হলেও গর্হিত অপরাধ। পৃথিবীর সব দেশেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আমেরিকাতেও ঘটে, তবে আমেরিকায় ধর্ষিত/ধর্ষিতাকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়না, তাকে ধর্ষকের বিরুদ্ধে আইনি সহায়তা দেয়া হয়, সমাজ তাকে মানসিক এবং মানবিক সাপোর্ট দেয়। ফলে যে কোন ধরণের লাঞ্ছনার অভিযোগ পুলিশি বইয়ে নথিভুক্ত হয়, তাতেই পরিসংখ্যানে ধর্ষণ লিস্টে আমেরিকার নাম টপে, আর আমেরিকার নাম টপে দেখতে পেয়েই গর্বিত বাংলাদেশীরা খুশিতে বগল চাপড়ায়। ১৬ই মে, ২০১৭।

১৬ই মে, ২০১৮ তে পৌঁছে জানতে পারলাম, বাংলাদেশে একটি কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে প্রথমে। এরপর পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছে। শেষে উপায় না দেখে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা করেছে।

হ্যাঁ, আপনাদের কথাই ‘ধ্রুব সত্য, ধর্ষণে আমেরিকা শীর্ষে। কথা সেটা নয়, ধর্ষণে শীর্ষে থাকা অথবা মাঝে থাকা নিয়ে আলোচনা হতে পারেনা। কথা হচ্ছে, ধর্ষণ একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ কিনা! অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধী সনাক্ত হবে কিনা, অপরাধীকে আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে কিনা, অপরাধী শাস্তি পাবে কিনা! আমেরিকা ধর্ষণের শীর্ষে থাকলেও ধর্ষণকে ভয়ঙ্কর অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। আমেরিকায় ধর্ষককে অপরাধী গণ্য করা হয়, ধর্ষিতাকে অপরাধী হিসেবে দেখা হয় না। ধর্ষিতা পরিবারের কাছে, আইনের চোখে, সমাজের চোখে নিগৃহীত হয় না। আমেরিকায় ধর্ষিতা আত্মহত্যা করে না।

এদিক থেকে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান কিন্তু শীর্ষে। এসব দেশে মেয়েরা প্রথমে পুরুষের চোখের দৃষ্টিতে ধর্ষিত হয়, পরে শারীরিকভাবে ধর্ষিত হয়, এরপরের প্রতিক্রিয়ায় মানসিকভাবে ধর্ষিত হয়। তিন ধাপে ধর্ষিত হওয়ার ধকল যে মেয়ে সামলাতে পারেনা, সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

এসব দেশে ধর্ষক পায় বীরের মর্যাদা, ধর্ষিতা পায় অপরাধীর তকমা। লোক জানাজানি হলে ধর্ষিতার কোনদিন বিয়ে হবেনা তাই ধর্ষণের ঘটনার কথা প্রকাশিত হয় না। ঘটনাক্রমে ধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে মিডিয়ায় যে হই চই শুরু হয়, তাতে প্রতিবাদের চেয়েও অনেক বেশি প্রকাশ পায়, মানুষের কৌতূহল।

সকলের রসালো আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেঃ ধর্ষিতা মেয়েটি দেখতে কেমন, সুন্দরী হলেতো ধর্ষিতা হতেই হবে! ধর্ষিতার পরনে কি পোশাক ছিল, শাড়ির আঁচলের ফাঁক গলে পেটের অংশ দেখা গেলেতো ধর্ষিতা হতেই হবে, ধর্ষিতার গায়ে বোরকা ছিল কিন্তু বোরকা ছিল টাইট, ফলে তার দেহের বিশেষ অংশের ভাঁজ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। মেয়েদের বুকের ভাঁজ, কোমরের খাঁজ যদি স্পষ্ট দেখা যায়, ধর্ষিতা না হয়ে উপায় কি!

এসব কৌতূহল, মুখরোচক আলোচনার আড়ালে চলে যায় ধর্ষকের চেহারা, জেগে উঠে ধর্ষিতার মুখ। ধর্ষক আইনের আওতার বাইরে চলে যায়, ধর্ষকদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়না, ধর্ষকের বিচার হয় না। তাই প্রতিদিনের ধর্ষণের ঘটনা নথিপত্রভুক্ত হয়না। এজন্যই ধর্ষণে আমেরিকা শীর্ষে, বাংলাদেশ সর্বনিম্নে।

সকলেই তো পূর্ণিমা শীলের মত সাহসী, আত্মবিশ্বাসী স্বাধীনচেতা হয়ে বড় হয়ে উঠতে পারেনা। গণধর্ষণের শিকার হয়েও যে মেয়ে নিজের পায়ে ভর করে মাথা উঁচু করে সমাজে দাঁড়াতে পারে, তাকে তো ‘সাহসিকা’র খেতাব দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু পূর্ণিমা শীলকে তেমন কোন খেতাবেই সম্মানিত করা হয়নি, বরং পূর্ণিমা শীল নামটিকে রাজনীতির দাবাখেলার গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এতকাল।

বাংলাদেশের মেয়েদের পিতামাতাদেরও এতকালের ঘুণে ধরা চিন্তা ভাবনার বেড়াজাল ছিঁড়তে হবে। তাদের বুঝতে হবে, ধর্ষণের মত পাশবিক ঘটনায় একটি মেয়ে শারীরিক এবং মানসিকভাবে পর্যুদস্ত থাকে। সেসময় মেয়েটির পাশে থেকে তাকে এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা উচিত। নাহলে ঘরের মানুষদের মলিন মুখের ফুঁয়ে তাদের জীবনের আলো নিভে যেতে পারে।

লোকলজ্জার ভয় পাওয়ার পুরাতন নিয়ম ভাঙ্গতে হবে। মেয়েটিতো আপনাদের, তাকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও আপনাদেরই। কন্যাকে দোষ দেয়া নয়, মেয়েটিকে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে সাহস দিন। যদি পারেন ধর্ষক পুরুষটিকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে টেনে এনে গাছের সাথে বেঁধে জুতা পেটা করে বুঝিয়ে দিন, আপনার কন্যাকে অপমান করার ফল কি হয়!

বকফুল!

বকফুল!

ছবিটি একটি ফুলের, ফুলের নাম বকফুল। কিছুদিন আগে গুগলে কি একটা তথ্য বের করতে গিয়ে কেমন করে যে বকফুলের ছবিটা পেয়ে গেলাম। ছবিটা দেখামাত্র হুড়মুড় করে ছুটে আসতে শুরু করলো শৈশবের সকাল, দুপুর আর বিকেল। যে সকাল বিকেল জুড়ে ছিল আমাদের পাশের বাড়ির একটি বকফুল গাছ আর থোকা থোকা বকফুল।

আমরা নারায়ণগঞ্জের আমলাপাড়ায় যে বাড়িটিতে ভাড়াটে হয়ে এসেছিলাম, সে বাড়িতেই কেটে গেছে ৪৭ বছর। ৪৭ বছর আগে আমলাপাড়ার চেহারা ছিল ছিমছাম সুন্দর, আমাদের বাড়িটা ছিল হালকা পাতলা সুন্দর, তিন চারটে উঠোন ছিল সারা বাড়ি জুড়ে। আমরা যে দালানের ঘরে থাকতাম, তার পাশেই ছিল একটানা লম্বা টিনের ঘর, যেখানে কোন পরিবার বাস করতোনা। ওটা ছিল গদি বাড়ি অথবা কাঁচামালের গোডাউন। যাকে আমরা ‘রামধন পসারি’র ঘর বলে জানতাম।

রামধন পসারিতে কোন পরিবার বাস না করলেও এই বাড়ির রান্নাঘরে প্রতিদিন রান্না হতো, সকাল দুপুর কিছু মানুষ খাওয়া দাওয়া করতো।
রান্না করতো একজন মহিলা, খাওয়া দাওয়া করতো যারা তাদের সকলেই পুরুষ। সকাল হলে রামধন পসারিতে প্রাণের শব্দ পাওয়া যেত। পাটা পুতায় মশলা পেষা হচ্ছে, বড় মাছ কাটা হচ্ছে, কড়াইতে গরম তেলে তরকারি পড়ে ছ্যাঁক ছোঁক আওয়াজ হচ্ছে। দুপুর হতেই কাঁসার থালা গ্লাসের টিন টিন ঝিন ঝিন আওয়াজ, কিছু পুরুষের নরম গলায় ” আরেকটু ভাত দেন, মাছের ঝোল এমুন পাতলা হইছে ক্যান” জাতীয় কথা শুনা যেত।

ছোটবেলা থেকেই মানুষের জীবন দেখতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। আমাদের ঘরের জানালায় বসে লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে রামধন পসারির সকাল থেকে দুপুর অবদি যাপিত জীবনের টুকরো অংশ আমি মন প্রাণ দিয়ে দেখতাম।

বিকেল হতেই রামধন পসারি নীরব হয়ে যেত। কোথাও কোন প্রাণের স্পন্দন শোনা যেত না। আসলে রামধন পসারিতে সকাল শুরু হতো যে রমণীর হাতে, সে ছিল রান্নার মাসী। সকাল দুপুরে যারা খেতে বসতো, তারা ছিল রামধন পসারির কর্মচারী। সকাল থেকে বিকেল, কাজ শেষে সকলেই যার যার বাড়ি চলে যেত, রামধন পসারির টিনের ঘরগুলিও নীরব হয়ে যেত।

রামধন পসারি নীরব হয়ে গেলেই আমাদের বাড়ির দুরন্ত কিশোরেরা সরব হয়ে উঠতো। সকাল হতেই দেখে রাখতাম রামধন পসারির টিনের ঘরগুলির মাথা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বকফুল গাছটাকে। সাদা রঙের অর্ধ চন্দ্রাকৃতি থোকা থোকা ফুলে ছেয়ে আছে। তখনতো অর্ধা চন্দ্রাকৃতি শব্দটা মাথায় আসতোনা, আমার মনে হতো গাছে পুলি পিঠা ঝুলছে। পরের বাড়ির গাছে আমার বরাবরই লোভ ছিল। কারো বাড়ির উঠোনে কাঁচামরিচ গাছ লাগিয়েছে, আমার লোভ হতো। ইচ্ছে করতো রাত হলেই চুরী করে নিয়ে আসবো। মনে হতো কিন্তু চুরী করা হতোনা। গাছ চুরী করে লাভ কি, মরিচ গাছ ট্রাংকেও রেখে দেয়া যাবেনা, মরিচ গাছ চিবিয়েও খাওয়া যাবেনা। তাই হাত নিশপিশ করলেও চুরী করা হয়ে উঠতোনা।

তবে রামধন পসারির বকফুল চুরী করা হতো। চুরী করতে যেতো আমার ছোট মাসি, মেজদা আর তার বন্ধু শ্যামল। আমার কাজ ছিল ঘরের জানালায় বসে বকফুল গাছ রেকী করা, আর মেজদা-শ্যামল দুই চোরের কাজ ছিল ছাদ টপকে রামধন পসারির ঘরের টিনের চালে নেমে পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে বকফুল গাছে চড়া। একজন গাছে চড়ে বকফুল ছিঁড়ে আরেকজনের কাছে দিত।ছোট মাসি আর আমি ছাদে দাঁড়িয়ে এই চুরী উৎসব দেখতাম। আমার আবার অল্পে পোষায়না। “মেজদা, আরও পাড়ো, আরো, আরো” করতে থাকতাম। আমার জামার কোচরে, মাসীর জামার কোচরে নিতাম কিছু বকফুল, মেজদার প্যান্টের পকেটে কিছু, শ্যামল চুরী করতে ভালোবাসতো, বকফুলের ভাগ নিতো না।

চুরীর নেশা বড় নেশা। আমাদেরও বকফুল চুরীর নেশা অনেক বড় নেশা ছিল। হলে হবে কি, প্রতিদিন বকফুল বাসায় আনলেই তো আর বিনা প্রশ্নে মা বকফুলের বড়া ভেজে দিতোনা। মায়ের কাছে বকফুল চুরীর কথাও বলা সম্ভব ছিলনা। তাই মাঝে মাঝে মিথ্যে কথা বলতেই হতো। “রামধন পসারির মহিলাটা বলছে ওরা বকফুল খায়না, আমরা যেন নিয়ে আসি”। এমন বললে দোষ থাকে না, মাও বকফুলের বড়া করে দিতে আপত্তি করেনা। পিটালি গোলার মধ্যে বকফুল চুবিয়ে ডুবো তেলে মচমচে করে ভেজে দিত, খেতে কী যে ভাল লাগতো। ভালো তো লাগারই কথা, একে তো ফুলের বড়া তার উপর চুরীর জিনিসে স্বাদ মনে হয় একটু বাড়তি পাওয়া যায়।

মেজদা আর শ্যামলকে বকফুল পাড়তে দেখে চোরের সংখ্যা বেড়ে যেতে লাগলো। পাড়ার অন্য ছেলেরাও এসে যোগ দিতে লাগলো। একটা মাত্র বকফুল গাছ, তাও আমাদের ঘরের লাগোয়া যেহেতু তাই আমাদের দাবী বেশি থাকার কথা। মেজদা আর শ্যামল সেই দাবীতেই মাতব্বরি বেশি করতো।

আমরা অযথাই বকফুল চুরী করতাম। আমরা জানতামই না বকফুল গাছের মালিক এই গাছের খোঁজ রাখেনা। রামধন পসারির রান্নার মহিলা বকফুল নিয়ে মাথা ঘামায় না। যারা দুপুরে খেতে আসতো, তারা ডাল তরকারি মাছের ঝোল দিয়েই খেত, বকফুলের বড়া খাওয়া যায়, এই ব্যাপারটাই হয়তো তাদের জানা ছিলনা। অনেক পড়ে বকফুল চুরী করার সময় রামধন পসারীর কোন একজন কর্মচারী তা দেখে ফেলে, অথবা রান্নার মহিলা দেখে ফেলে। পরে তারা বলে, “এই ফুল আবার খাওয়া যায়? খাওয়া গেলে তোমরা পাইরা লইয়া যাও যত ইচ্ছা”।

যখন জানলাম, চুরী করার দরকার নেই, এমনি এমনিই বকফুল আনা যাবে, তখন থেকেই বকফুল খাওয়ার আগ্রহ কমে গেলো। তাছাড়া মেজদা ইউনিভারসিটিতে চলে গেলো, মাসী বড় হয়ে গেলো, আমি যদিও জানালায় বসে রামধন পসারির সকাল থেকে দুপুরের জীবন পরিক্রমা দেখতাম, সেটাও অনিয়মিত হয়ে যেতে লাগলো। বড় তো আমিও হচ্ছিলাম, স্কুল শেষ করে কলেজে গেলাম, জানালায় বসে থাকার সময় কই। ততদিনে আমার জীবনে সরবতা আসতে শুরু করেছে, সেই ফাঁকে রামধন পসারি ধীরে ধীরে আরও নীরব হয়ে গেছে।

আমলাপাড়ার ঐ ঘরটাতে আমরা ৪৭ বছর ছিলাম। ৪৭ বছর পর পুরো বাড়ির চেহারা বদলে গেছে, আমলাপাড়ার চেহারা বদলে গেছে, আমাদের চেহারা বদলে গেছে। অনেক কিছু হারিয়ে গেছে, সবগুলো উঠোন হারিয়ে গেছে, শ্যামল হারিয়ে গেছে, শৈশবে দেখা সব ভাড়াটে হারিয়ে গেছে, অনেক চেনা মুখ চিরতরে হারিয়ে গেছে। আর সব কিছুর সাথে হারিয়ে গেছে বকফুল গাছটা। রামধন পসারির টিনের লম্বা ঘরটা কালের সাক্ষী হয়ে পুরনো রোগাভোগা চেহারা নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই, তবে শৈশবে দেখা সকাল দুপুর বিকেলের যাপিত জীবন নেই। আর নেই বকফুল গাছটা, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

শুভরাত্রি!

শুভরাত্রি!

গত কয়েকদিনে ‘ক্রসফায়ার’ শব্দটি বহুবার লেখা হয়েছে। শিক্ষিত সচেতনদের অধিকাংশই ক্রসফায়ারের বিপক্ষে, আমিও তাই। গত পনেরো দিনে ক্রসফায়ারে অনেক মানুষ মারা পড়েছে। যারা মারা পড়েছে তাদের সকলেই হয়তো অপরাধী, হয়তো অপরাধী নয়। অপরাধী কে তা নির্ধারিত হয় বিচারালয়ে, যেহেতু ক্রসফায়ারিং-এ হাতের কাছে পেলেই মেরে ফেলা হয়, তাই যে মারা পড়ে তার অপরাধের মাত্রা কতটুকু তা জনসাধারণের জানার উপায় থাকেনা। কাউকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার পর জনসাধারণ পত্র পত্রিকা, ফেসবুক, নানাজনের নানা মন্তব্য থেকে জানতে পারে, যাকে মারা হয়েছে সে ছিল দস্যু বনহুর, সে ছিল জলাতঙ্ক রোগের মত ভয়ঙ্কর। সে সব সময় প্রশাসনের চোখের আড়ালে থাকতো বলে তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। তাকে ক্রসফায়ারে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা।

ক্রসফায়ারের সর্বশেষ ইস্যু কমিশনার একরামুল। কমিশনার একরামুল হত্যা নিয়ে ফেসবুক, মিডিয়া সরগরম। সকলেই জানে, একরামুল হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকে শেষ, অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। সকল মৃত্যুই কারো না কারো কাছে হৃদয় বিদারক ঘটনা, তবে কমিশনার একরামুলের ক্রসফায়ারে মৃত্যু বলে দিচ্ছে, ক্রসফায়ারে শুধু অপরাধীরাই মারা পড়েনা, ক্রসচয়েসের শিকার হয়ে নিরপরাধও মারা পড়ে।

সকলেই বুঝতে পারছে, কমিশনার একরামুল ছিলেন ভুল চয়েসের শিকার। মন্ত্রীও বলেছেন, এমন দুই একটা ভুল হতেই পারে। হ্যাঁ, ভুল হয়, মানুষ মাত্রেই ভুল হয়। তাই বলে মানুষের প্রাণ নিয়ে ভুল খেলা? ভুলের শিকার হয়ে মারা গেলো একরামুল,’ ভুল হয়ে গেছে’ কথায় হতভাগ্য একরামুলের পরিবার পরিজন, সন্তানেরা জীবিত একরামুলকে ফিরে পাবে? নাকি মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় সান্তনা পাবে!

সব ঘটনাই প্রথম কিছুদিন গরম থাকে, ধীরে ধীরে তার উত্তাপ কমে আসে, একসময় শীতল হয়ে যায়। ধারণা করি,আর দুই দিন পর একরামুল হত্যা ঘটনাও শীতল হয়ে যাবে। শীতল হওয়ার আগেই একটা প্রশ্ন মাথায় জেগেছে। শিক্ষিত সচেতন জনগণের অধিকাংশই ক্রসফায়ার পছন্দ না করলেও কিছু সংখ্যক শিক্ষিত লোক কেন ক্রসফায়ার সমর্থন করছে? তারা ক্রসফায়ার সমর্থন করছে এই অজুহাতে, ” মাদক ব্যবসায়ীরা, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা নাকি বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে তরুণ সমাজ যুব সমাজকে মদ, ইয়াবায় আসক্ত করে ফেলেছে। তাই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ক্রসফায়ারে মেরে ফেলাটাই সঠিক কাজ।”

আমি বুঝতে পারিনা, বিচার না করেই, শুধু অনুমানের ভিত্তিতে কাউকে মেরে ফেলা যায়? নাকি মেরে ফেলা উচিত? যেখানে দেশে স্বাধীন বিচার বিভাগ আছে, সন্দেহজনক আসামীকে ধরার জন্য প্রশিক্ষিত পুলিশ বাহিনী আছে, সেখানে ঘরে ঘরে তরুণ তরুণীদের মাদকাসক্ত করার অভিযোগ দেখিয়ে ক্রসফায়ারে কাউকে হত্যা করা যায়? নাকি এই ধরণের হত্যাকে উৎসাহ দেয়া যায়? শিক্ষিত জনেরা কি করে ভুলে যায়, একটি অন্যায় প্রতিহত করতে আরেকটি অন্যায় করা উচিত নয়। একটি ভুল থেকে আরেকটি ভুলের জন্ম হয়।

কেন হবে আমার সন্তান মাদকাসক্ত? কেন ঘরে ঘরে তরুণ তরুণীরা ইয়াবা আসক্ত হবে? এই সকল তরুণ তরুণীদের বাবা মা নেই? বাবা মা তরুণ তরুণীকে ছোটবেলা থেকে সুশিক্ষা দেয়নি? ঘরে ঘরে তরুণ তরুণী, যুব সমাজ কি পারিবারিক শিক্ষা ছাড়াই ছোট থেকে বড় হয়েছে?

সন্তানের মা আমিও। দেশে সংখ্যালঘু ছিলাম, প্রবাসেও সংখ্যালঘু। কাজেই মানসিকভাবে কিছুটা দূর্বল তো ছিলামই, সমস্যা কখনও পিছু ছাড়েনি। সাথে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ছিল। এর মধ্যেই সন্তানদের বড় করেছি। প্রাথমিক শিক্ষা দেয়ার সময়ই সমাজ সম্পর্কে, সমাজের নানাবিধ মানুষ সম্পর্কে সচেতনতামূলক শিক্ষা দিয়েছি। মদ গাঁজা ইয়াবা বিড়ি সিগারেটের খারাপ দিক সম্পর্কে জানিয়েছি। নিজের ভাল মন্দ বুঝে চলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে টিপস দিয়েছি।

এত কিছু শেখানোর পরেও যদি আমার সন্তান বাইরের লোকের হাতছানিতে ভুলে মদ ইয়াবায় আসক্ত হতো, তাহলে বুঝতাম, আমার শিক্ষা দানে ভুল ছিল, ইয়াবা ওয়ালার ভুল ছিল না।

ইয়াবাওয়ালার কাজই ভাল মানুষকে ইয়াবার প্রলোভন দেখানো। আর আমার দায়িত্ব সন্তানকে বলে দেয়া, ইয়াবাওয়ালা মন্দ লোক, তাদের কাছ থেকে যেন দূরে থাকে। এরপরেও যদি আমার সন্তান ইয়াবাওয়ালার প্রলোভনে পারিবারিক শিক্ষা ভুলে ইয়াবাওয়ালার কাছেই ছুটে যায়, প্রাথমিক পরাজয়টা হবে আমার। আমি আমার সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি, অথবা শিক্ষাদানে অবহেলা করেছি। তারপরেও আমি চেষ্টা করবো আমার সন্তানকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে, চেষ্টা করবো ইয়াবাওয়ালার বিরুদ্ধে প্রশাসনকে সজাগ করতে। কখনওই চাইবো না ইয়াবাওয়ালাকে বিনা বিচারে হত্যা করা হোক।

ইয়াবার ব্যবসা বন্ধ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, ইয়াবাওয়ালাকে আইনের আওতায় ধরে আনার দায়িত্ব প্রশাসনের। ইয়াবাওয়ালার অপরাধের বিচার করার দায়িত্ব বিচারালয়ের।

চারদিকে এত দায়িত্ববান মানুষ থাকার পরেও বলবো, সন্তান আমার! সন্তানের মঙ্গল অমঙ্গল, ভাল মন্দ দেখা, সুশিক্ষা দেয়া আমারই দায়িত্ব।

আমার যতটুকু বলার বলে দিয়েছি। আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা আওয়ামীলীগের প্রকৃত কর্মী, শুভানুধ্যায়ী, সমর্থক তাদের কাছে আমার বার্তা পৌঁছে গেছে। তারা বুঝেন, রাজনীতি না করেও আমার মত কিছু মানুষ আছে যারা আওয়ামীলীগের মঙ্গল চায়, আওয়ামীলীগের কাছ থেকে সুশাসন চায়, নাগরিক নিরাপত্তার বাস্তবায়ন চায়।

আওয়ামীলীগের কাছে আমাদের ব্যক্তিগত কোন চাওয়া নেই, কিছু পাওয়ার নেই। তবুও আওয়ামীলীগের নামে মন্দ কিছু শুনলে, আওয়ামীলীগের কেউ ভুল কিছু করলে, ভুল বা মন্দ কিছু ঘটে গেলে চারদিকে যখন নিন্দার ঝড় উঠে, আমাদের খুব খারাপ লাগে। বুকে বড্ড অশান্তি হয়, রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকবো বললেও একেবারে চুপ থাকতে পারিনা। সমালোচনা করে ফেলি আওয়ামীলীগের।

হ্যাঁ, আওয়ামীলীগেরই সমালোচনা করি, কারণ আওয়ামীলীগই জনগণ বান্ধব দল, আওয়ামীলীগই ভুল করে, ভুল ধরিয়ে দিলে ভুল শোধরানোর চেষ্টা করে। আওয়ামীলীগই জনগণের শেষ আশ্রয়, জনগণও আওয়ামীলীগের শেষ আশ্রয়। আর আমি তো আওয়ামী বান্ধব সেই জনগণেরই একজন।

[ এই লেখায় ‘ইয়াবাওয়ালা’ যে কোন মন্দলোকের সিম্বলিক প্রয়োগ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে]

শুভরাত্রি! আগামী সকাল সকলের ভাগ্যে প্রসন্নতা নিয়ে আসুক।

____________
৩রা জুন। ২০১৮

ইলিশ কথা!

ইলিশ কথা!

চায়নিজ গ্রসারি শপ থেকে উত্তম ফোন করে জানতে চেয়েছে, “বুঝলে, এখানে মায়ানমারের ইলিশ আছে, আনব?”

বলি, “অবশ্যই আনো।

– কিন্তু বাংলাদেশের ইলিশ না তো, মায়ানমারের ইলিশ! তেমন স্বাদ কি হবে?

-আরে ছাড়ো তো, মায়ানমারের জনগণের একাংশ যেখানে বাংলাদেশি হয়ে গেছে, ইলিশের বাংলাদেশি হতে সমস্যা কি?

– না, মানে, স্বাদ গন্ধ তো পছন্দ হবে না!

– হবে হবে। রোহিঙ্গারা এখন চাল চলনে, কথায় আচরণে, বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটের হিসাবে বাংলাদেশি হয়ে গেছে না? রোহিঙাদের কি রোহিঙ্গা বলে বাংলাদেশি জনগণ থেকে আলাদা করা যায়?

– আরে দূর, কাজের কথা বলো।

– আরে, কাজের কথাই তো বলছি। তুমি বললে, মায়ানমারের ইলিশ বাংলাদেশি ইলিশের মত সুস্বাদু হবে কিনা! সেই কথাই বলছিলাম। আমরা এখন মায়ানমারের ইলিশে মানুষে সকলেই বাংলাদেশি হয়ে গেছি।
তুমি মায়ানমারের ইলিশ আনো, রান্নার পর বাংলাদেশি হয়ে যাবে।

– বোকার মত কথা বলো না তো!

-হি হি হি!! দিনে দিনে আমরা বাংলাদেশিরা সকলেই বোকা হয়ে গেছি। তাই তো ইলিশের দেশের মাইয়া হয়েও মায়ানমারের ইলিশের কথা শুনে আনন্দে ফুলিশ হয়ে গেছি।
ফোনালাপ শেষ।

উত্তম দুই হাত ভর্তি করে বাজার এনেছে। তার মধ্যে মায়ানমারের ইলিশ আছে। আরও আছে চায়নিজ কলার মোচা, চায়নিজ করলা, এবং ডাটা দিয়ে ইলিশের ঝোল খাওয়ার জন্য চায়নিজ ডাটা।

মনে মনে কই, সবই দেখি নাক বোঁচাদের প্রডাক্ট। বাংলাদেশের প্রডাক্ট কই?

পরক্ষণেই মনে হইল, বাংলাদেশিরা নিজেদের প্রডাক্ট তৈরি করবে কখন! তারা ব্যস্ত অন্যের গোয়ালে ধুঁয়া দিতে! বিশ্বকাপ ফুটবলে নিজের দেশ নাই তা নিয়ে মাথা ব্যথা নাই। তারা ব্রাজিল আর্জেন্টিনার ফুটবলে বাতাস দিতে ব্যস্ত।

নিজের কথাই ধরি না কেন, আমি কি কম ফুলিশ! আর্জেন্টিনা আর্জেন্টিনা করে কম লাফিয়েছি! আর এই যে এখন, মায়ানমারের ইলিশ কোলে নিয়ে বসে আছি।

কই, একবারও তো মনে এলো না, পদ্মার ইলিশ চাই, মায়ানমারের ইলিশ খামুনা। আমি যদি খামুনা কইতাম, উত্তম কি নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে অন্য দেশের ইলিশ কিনতো?

আমি সোনামুখ করে মায়ানমারের ইলিশ খাচ্ছি বলেই তো, বাংলাদেশিরা সোনামুখ করে রোহিঙ্গাদের বুকে টেনে নিয়েছে বলেইতো মায়ানমারের ব্যবসায়ীরা ইলিশ রপ্তানি করছে আমেরিকায় থাকা বাংলাদেশীদের কাছে, আর রোহিঙ্গা রপ্তানি করছে বাংলাদেশে।

পৃথিবীতে ফুলিশরাই পরের জন্য দিওয়ানা, বাকি সকলেই নিজের বিষয়ে সেয়ানা।

দুধমাখা ভাত কাকে খায়!

দুধমাখা ভাত কাকে খায়!

আজ দুধকলা ভাত খাচ্ছি। কত বছর পর দুধকলা ভাত খাচ্ছি তা স্মরণে আসছেনা। যে ছবি মনের পর্দায় ভাসছে তা আমার কৈশোরের। ঐ সময়টাতেই আমরা সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেছি।

সদ্য স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলোর কথা বলছি। আমরা সকালে খেতাম রেশনের চালের আঠালো ভাত আর পাতলা মুসুরের ডাল, দুপুরে খেতাম মোটামুটি ভাল মানের চালের ভাত, সকালের রান্না করা ডাল, সাথে কিছু একটা ভাজাভুজি বা তরকারী আর খুব সাধারণ মাছ, রাতে খেতে হতো আটার রুটি, এক পদের তরকারী, আধসের দুধ রাখা হতো, সেই আধসের দুধ থেকেই আমাদের মা বাদে বাবা আর চার ভাইবোন খেতাম। পেতলের একটা গোল মাথা হাতা ছিল, সেই হাতা দিয়ে এক হাতা দুধ, চিনি রুটি।এই রুটিনে চলতে হয়েছে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত।

ভাইদের নিয়ে সমস্যা হতোনা, আমার তিন ভাই কোনদিন খাওয়ার আইটেম নিয়ে কোন বায়নাক্কা করেনি, মেজদা একটু পেটুক ছিল, সে মাছের টুকরাটা বড় চাইতো, এ ছাড়া আর কোন বায়নাক্কা করতোনা।

খাওয়ার আইটেম নিয়ে বায়নাক্কা করতাম আমি। সকালে ডাল আর আঠা ভাত খাবনা, দুপুরে কোনমতে খেয়ে নিলেও রাতে রুটি খেতে গেলেই আমার গাল ফুলে থাকতো। যেদিন মা তরকারী রানতো না, সেদিন হয়তো ঘি মাখিয়ে চিনি ছড়িয়ে রুটি খেতে দিত, সেদিন ছিল আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন দিন। অন্য প্রতিবেশীদের বাসায় রোজ কলা আসতো, আমাদের বাসায় ফল আসতো শুধুমাত্র গ্রীষ্মকালে, আম আর কাঁঠাল। আমি মনে মনে জেদ করতাম, বাইরে শুধু বলতাম, “আমি ঘি দিয়ে রুটি খামুনা”।

মা জানতো ঝাল তরকারী হলে আর কোন বায়নাক্কা করিনা। কিন্তু সবদিন দুপুরে ভাল তরকারীও রান্না হতোনা, আলু উচ্ছে ভাজা দিয়েতো রুটি খাওয়া যায়না। কে জানে, হয়তো যায়, আমার ভাইগুলো ঠিকই শুধু উচ্ছে ভাজা দিয়েও রুটি খেতে পারতো হয়তো। দুপুরের তরকারী থেকে কিছু বাঁচলে আমাকে দিত। তখন ফ্রিজ ছিলনা, তাই তরকারী বিকেলে জ্বাল দিতে হতো, জ্বাল দেয়া তরকারী আমার ভালো লাগতোনা। খাওয়া নিয়ে অনেক দিগদারী করেছি।

শুধুমাত্র শীতকালে আমার মন ভালো থাকতো। শীতকালে ফুলকপি, বাঁধাকপি পাওয়া যেত, মায়ের হাতের রান্না তরকারীর সে কী স্বাদ! আর ভালো লাগতো যেদিন ইলিশ মাছ রান্না হতো। ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে মা যে তরকারীই রানতো, আহাহা! আমার মনে হতো রাজভোগ খাচ্ছি। কিন্তু সেতো সবসময় নয়।

যেদিন মনমত খাবার না থাকতো, আমার কেবলই মনে হতো, “আমরা কেন গরীব হলাম?”

এর উপর চলতো মায়ের আদর্শ বাণী। “আমার পোলাগুলি অনেক লক্ষ্মী, এই মাইয়া হইতাছে একটা জিদাইল্লা চরিত্র। বাপের সামর্থ্য বুঝতে চায় না, কত যে প্যাকনা মাইয়ার। সকালে আঠা চাউলের ভাত খাইতোনা, রাতে রুটি খাইতোনা। টের তো পাওনা, এই যে পাইতাছস, সেইটা নিয়েই শোকর কর, কত বাড়িতে মানুষ তিনবেলা রেশনের চাউলের ভাত খায়। তোগোরে তো তাও দুপুরে ভাল চাউলের ভাত খাওয়ানো হয়”।

মা’র কথাগুলো শুনলে মনে মনে একটু খারাপ লাগতো। জেদ বাদ দিয়ে খেতে বসতাম। আমি ছোটবেলা থেকেই অমন, শুরুতে অবুঝের মত রেগে যাই, পরে বোধ ফিরে এলে একেবারে মাটি হয়ে যাই।

আমার এই জেদী স্বভাবের কারণে প্রায় সকালে মা আমার জন্য আলাদা কিছু রেঁধে দিত, কেচকি মাছের ভাগা থেকে চিমটি দিয়ে গুঁড়া বাইল্লা, গুঁড়া চিংড়ি সরিয়ে রাখতো, সেগুলো ঝিঙ্গা আর বেগুন দিয়ে ঝাল করে পাতুরি রানতো। আমার জেদ কমে যেত, রাগ জল হয়ে যেত। মাকে তখন অসম্ভব দয়াময়ী মনে হতো।

তবুও একটা অতৃপ্তি থেকেই যেত। আমার দুধকলা ভাত খেতে ইচ্ছে করতো, কিন্তু দুধ কোথায় পাব, আধসের দুধ থেকে দুই বেলা বাবা মায়ের জন্য চা হয়, বাকিটা রাতে খাওয়া হয়। মা দুধ খেতোনা, বাবা আর আমাদের চার ভাইবোনের পাতে ঐ আধসের দুধ থেকেই পেতলের হাতা দিয়ে এক হাতা করে দিত, তাতেই দুধের ভান্ড উজাড় হয়ে যেত।

দুধের আশা ছেড়ে কলার আশাতেই মার কাছ থেকে ঘ্যান ঘ্যান করে চার আনা পয়সা নিতাম, এক দৌড়ে চলে যেতাম আর কে পালের মোড়ে। সেখানে কলার কাঁদি নিয়ে বসতো এক বুড়া, কত রকমের কলা। আমি চার আনা দিয়ে দুইটা চাম্পা কলা কিনতাম। বাসায় এসে সেই চাম্পা কলা আর মুড়ি, চিনি আর জল দিয়ে মেখে খেতাম। মনে হতো দুধ কলা মুড়ি খাচ্ছি, সেটাই অমৃত মনে হতো।

অনেক পরে বুঝতে পেরেছি, ছোটবেলায় কেন আমাদের এত কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। ৭৪ পর্যন্ত নাহয় মেনে নেয়া যেতো, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবস্থা এমনই হয়, কিন্তু ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আমাদের ছোটবেলাটা চিরকালের জন্য সাদা কালো করে দেয়া হয়েছিল।

শিশু বয়সে দুধকলা ভাত খেয়েছি কিনা তা মনে পড়েনা, তবে কৈশোরের জেদ দেখানো বয়সে আশ মিটিয়ে দুধ কলা ভাত আমি খাইনি। তবে দুধ কলা ভাত খাইয়েছি আমার তিন কন্যাকে ছোটবেলায়। রাতের খাবার ওদের জন্য বরাদ্দ ছিল দুধ কলা ভাত। আমি সুর করে ছড়া কাটতাম, ” মামণি মামণি করে মায়, মামণি গেলো কাদের নায়, আয়রে মামণি ঘরে আয়, দুধ মাখা ভাত কাকে খায়”।

আমার বড় কন্যা খুবই বাধ্যের ছিল, আমি যাই খেতে দিতাম নীরবে খেয়ে নিত, কিন্তু মেজো কন্যার চরিত্র আমার মত হওয়ায় সে ছোট বয়সেই জেদ দেখাতো, “আমি দুধকলা ভাত খাব না, আমি মাছ দিয়ে খাব”। রাতের বেলা কে মাছের কাঁটা বেছে খাওয়াতে যাবে, উলটা ঝাঁঝিয়ে বলতাম, “তুই দুধকলা ভাত খাবিনা, তোর ঘাড়ে খাবে”।

মা হাসতো আর বলতো, “তুই জ্বালাইছিলি আমারে, এখন তোর মেয়ে তার শোধ দেয়”।

অনেকটা পথ চলে এসেছি, দুধ সাগরে ডুব দেয়ার মত অবস্থা হয়েছে, কিন্তু দুধ সাগরে ডুব দেয়ার কথা ভুলে যাই। যেই বয়সে দুধ মাখা ভাত খাওয়ার কথা ছিল, সেই বয়সটা আমরা সদ্য স্বাধীন দেশের স্বার্থে জল কলা মুড়ি খেয়ে পার করেছি, তবুও দেশটা আজও দাঁড়াতে পারলোনা! দুধ কলা ভাত কি আর এই বুড়ো বয়সে খাওয়া যায়!