সমছু মিয়া এর সকল পোস্ট

আমতলায় ভূতের ভয়

images

১৯৭১ সালের চৈত্র মাস। আমি এবং আমার তিন সহপাঠী মিলে আমরা ঠিক করলাম, খাল সেচে মাছ ধরব। এমনি এক মহান পরিকল্পনা নিয়ে এক দিন হাওরে গেলাম। একটি খালের কিছু অংশ নির্ধারণ করে, দুই দিকে বাঁধ দিয়ে সেচনী দিয়ে পানি সেচা শুরু করেছি। এমন সময় হঠাৎ চেয়ে দেখি আমাদের এক সহপাঠীর বাবা, উনার নাম ছাবু মিয়া, তিনি এসে উপস্থিত। আমরা উনাকে দেখে প্রথমে ভয়ে একটু চমকে উঠি। কিন্তু চাচা আমাদের ভয় ভাঙ্গিয়ে বললেন- “ও ছেলেরা আমি তোমাদেরকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত, সাড়া বাড়ন্তী গ্রাম পাঞ্জাবীরা দখল করে নিয়ে গেল আর তোমরা এখানে মাছ ধরার জন্য পানি সেচ করছ! চল সবাই বাড়িতে চল ওসবের দরকার নেই। বাড়িতে তোমাদের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে”।
ছাবু চাচার কথা শুনে আমরা সবাই হাসতে হাসতে অস্থির। তিনি যে অত্যন্ত রসিক মানুষ সে কথা আমরা সবাই জানি। তার একটা বিশেষ গুন ছিল, কথা বলে কান্নারত মানুষকে হাসাতে পারতেন। ছাবু চাচার হুকুমে তাৎক্ষণিক ভাবে আমরা সব কিছু ফেলে দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেই। পথে যেতে যেতে চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদেরকে এমন করে অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কারণ কি? তখন চাচা বললেন,
আসল কথাটি হলো, আমাদের ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের বাড়ীতে পাঞ্জাবী এসেছে! তাই আশপাশ গ্রামের সবাই আতঙ্কিত। কে জানে, কখন কোন গ্রামে হঠাৎ কোন মসিবত এসে যায়!
এ ভাবেই ছাবু চাচার সাথে কথা বলতে বলতে বাড়িতে আসা মাত্র দেখতে পেলাম গ্রামের কিছু হিন্দু লোক তাদের মূল্যবান জিনিস পত্র বাবার নিকট জমা রাখতে এসেছে, যদি বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয় সেই লক্ষ্যে। কাশি বাড়ির জলধর নাথের ছেলেরা তাদের নৌকাটাও আমাদের পুকুরের মধ্যে ডুবিয়ে রাখছে।

বিকাল বেলা বাড়ির দক্ষিণে অন্যান্য ছেলেদের সাথে খেলতে যাব, এমন সময় পথের দিকে তাকাতেই দেখি আম তৈল গ্রাম থেকে এক হিন্দু পরিবার সোজা আমাদের বাড়িতে ঢুকছে, সাথে সাদা রঙের খুব সুন্দর একটা পোষা কুকুরও ছিল। দেখলাম বাড়িতে ঢুকেই বাবার সাথে কি যেন আলাপ করছে। একদম শেষের কথাটা বুঝতে পেরেছিলাম, ওরা সবাই বর্ডার অতিক্রম করে ভারতে যাবে, তাই ঐ কুকুর যেন তাদের চলার পথে বাধার কারণ না হয়। সে জন্য ওকে আমাদের বাড়িতে রেখে যেতে চায়। বাবার সম্মতি পেয়ে তখন রশি দিয়ে সুপারি গাছের সাথে কুকুরকে বেধে রেখে তারা চলে গেল। হঠাৎ বিনামূল্যে এমন সুন্দর একটা কুকুর পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেলাম। মালিক চলে যাওয়ার সাথে সাথেই কুকুর যে ঘেউ ঘেউ ডাক শুরু করল তা একবারও বন্ধ হচ্ছে না। আমরা ওকে আদর করে খাবার খেতে দিলাম, চেষ্টা করলাম যাতে ঘেউ ঘেউ ডাক বন্ধ করে একটু শান্ত হয়, এতে হয়ে গেল হিতে বিপরীত। সে আরও বেশী করে ঘেউ ঘেউ করে ডাকা শুরু করল, এবং তার চোখ দিয়ে অবিরত অশ্রু বইতে লাগল। সে দিন মালিকের জন্য কুকুরের এই আর্তনাদ কতটা হৃদয়বিদারক ছিল তা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। ওর মুখের কথা বুঝতে না পারলেও মনের কথাটি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম। বাড়ির সবাই ওর একটানা ডাকে বিরক্ত হয়ে গেল, তখন বাবা লোক দিয়ে কুকুরটা ছেড়ে দিলেন। ছাড়া পাওয়া মাত্র ওর মালিক যে দিকে গিয়েছিল ঠিক সে দিকেই ওদের সন্ধানে দৌড়ে চলে গেল, তবে কোথায় গেল সে খবর আর জানা হয়নি। রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমাতে যাব, এমন সময় হারিকেন হাতে নিয়ে আমার খালু এসে উপস্থিত। রাত্রি বেলা হঠাৎ করে খালু কেন আসলেন? এতে সবাই উদ্বিগ্ন, আমারও জানতে ইচ্ছা হল। খালু বললেন, মাসুদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা, আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে গেছে। মাসুদ আমার খালাত ভাই। আইএ পাশ করে সবে মাত্র বিএ ক্লাসে পড়া শুরু করেছেন। এমন সময় সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। এইজন্যে সবাই একটু চিন্তায় পরে গেল।

হানাদার বাহিনী বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পরছে। তাছাড়া ছাত্রদের উপর তাদের আক্রোশটা যে খুব বেশী, এ ব্যাপারটা সবাই বুঝে ফেলেছে। হানাদার বাহিনীর নজরে পরে গেলেন কি? এসব দুশ্চিন্তা নিয়ে পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন। আমার খালু পেশায় প্রাইমারী স্কুলের হেড মাষ্টার, উনার নাম আব্দুল বারিক রইছ, তবে এলাকার মধ্যে রইছ মাষ্টার নামেই পরিচিত। তিনি অত্যন্ত সম্মানী এবং ধার্মিক লোক ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার পাশাপাশি তাহাজ্জুদের নামাজও নিয়মিত আদায় করতেন। দুই সপ্তাহ পরে মাসুদ ভাইয়ের খবর পাওয়া গেল, তিনি ভারতের শিলচরে আছেন। তখন খালু উনার চাচাত ভাইকে সাথে নিয়ে, মাসুদ ভাইয়ের সন্ধানে হানাদার বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে কোন ভাবে ভারতের শিলচরে পৌঁছেন। সেখানে অনেক খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে মাসুদ ভাইয়ের সাথে দেখা হয়। বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য মাসুদ ভাইকে অনেক বোঝালেন, অনুরোধ করলেন খালা কান্নাকাটি করছেন তাও বললেন অর্থাৎ একজন পিতা তার ছেলের মত পরিবর্তনের জন্য যত প্রকার প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয় এর সবটাই প্রয়োগ করলেন কিন্তু মাসুদ ভাই এতে কোন সাড়া দেননি। তিনি তার প্রতিজ্ঞায় অটল রইলেন। তার একটাই কথা, যে দিন দেশ স্বাধীন হবে আর যদি সেদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকি,তখন বাড়িতে ফিরে আসব ইনশাল্লাহ। আপনারা চলে যান শুধু দোয়া করবেন, আমরা যেন এ দেশ স্বাধীন করতে সফল হই। এটা আমাদের ব্রত দয়া করে এর বেশি আর কিছু বলবেন না। নীরবে এসেছেন নীরবেই ফিরে যান আর বাড়ি গিয়ে কাওকে কিছু বলবেন না, মনে করবেন আমাদের মাকে বাঁচাবার জন্য আমাদের এই যুদ্ধ। খালুর সব চেষ্টাই হয়ে গেল অরণ্যে রোদন। নিরাশ হয়ে দুঃখ বেদনা ভরা মন নিয়ে ফিরে এলেও মনে মনে নিশ্চয় একটু সান্ত্বনা পেলেন যে আমার ছেলে দেশের জন্য কাজ করছে, ওকে আমি দেশের জন্য উৎসর্গ করলাম খোদা তুমি ওদের সহায় হও। খালু বাড়িতে ফিরে এলেন। আশ্বিন মাসের শেষ দিকে আমি এবং আমার এক মামাত ভাই খালার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। তাদের বাড়ি দামিয়া গ্রামের মূল রাস্তার উত্তর পাশে। বাড়ির দক্ষিণের দুই তৃতীয়াংশ জাগার মধ্যে পূর্ব এবং পশ্চিমে দুটো ঘর, উত্তরের এক তৃতীয়াংশে বিভিন্ন গাছ গাছালিতে ভরা, দেখতে জঙ্গলের মত, এর এক পাশে খড় রাখার জন্য ছোট একটা ঘর আছে।

খালাদের সংলগ্ন পশ্চিমের বাড়ি রাজা মিয়ার। এর আধ মাইল পশ্চিমে চর্মকার বাড়ির (মুচি) শ্মশান। ওখানে কয়েকটা অশ্বত্থ গাছও আছে তার মধ্যে একটা গাছ অনেক পুরনো। শুনেছি ঐ জায়গা খুবই ভয়ংকর। অনেকেই ভয় পায়। শ্মশানের অশ্বত্থ গাছে অনেক ভুতের বসবাস। রাত্রি বেলা এলাকার লোকজন ভূতের ভয়ে ঐ গাছের নিচ দিয়ে চলাফেরা করে না। বিকাল বেলা আমার বয়সের খালাত দুই ভাই সহ আমরা চার পাঁচ জন বাইরে খেলতে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় খালা আমাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। উঠানের উত্তর পাশে যেতে পারবেনা, বাহিরে অন্য জাগায় গিয়ে খেলাধুলা কর। শুনে খালাকে বললাম কেন? তিনি বললেন- আমাদের খড়ের ঘরের পাশে বড় আম গাছে ভূতে বাসা বেধেছে।
ভূত! একথা শুনে আমি চমকে গেলাম।
খালাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, কখন এবং কিভাবে ঐ গাছে ভূত আসল। খালা বললেন! প্রায় এক মাস হয়, পশ্চিম বাড়ির রাজা মিয়ার সাথে এসেছে। রাজা কোন এক কাজে একদিন জিনার পুর গিয়েছিল রাতে বাড়ি ফেরার সময় ভুলে চর্মকার বাড়ির (মুচি) শ্মশান দিয়ে হেঁটে আসছিল, তখন অশ্বত্থ গাছের ভূতের ছায়া তার উপর পরে আর ওতেই ভুত তার সঙ্গী হয়ে যায়। ওর সাথে সাথে এখানে চলে আসে। এর কয়েক দিন পরেই ঐ ভূত তাকে গলায় ফাঁস লাগিয়ে গাছের ডালে লটকিয়ে মেরে ফেলে। শুনে আমরা বললাম তা হলে ঐ ভূত রাজার বাড়িতে থাকবে কিন্তু আপনাদের আম গাছে কেন? খালা বললেন সে বাড়িতে ভূতের বসবাসযোগ্য উপযুক্ত তেমন কোন বড় গাছ পায় নাই, তাই আমাদের বড় আম গাছটি ওদের বসবাসের জন্য উপযুক্ত বলে বেশি পছন্দ হয়েছে। আর তখন থেকেই তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে ঐ গাছেই জীবন যাপন শুরু করছে। খালাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম-
এসব জানলেন কিভাবে? ভুত কি আপনি নিজের চক্ষে দেখেছেন, বা ওর সাথে কথা হয়েছে!? তিনি বললেন, দেখতে পারি নাই বা কথাও হয়নি, তবে জাহিদ মোল্লাকে এনেছিলাম, তিনি ইস্তেখারার মাধ্যমে সরাসরি ভুতের সাথে আলাপ করে বিস্তারিত বিবরণী আমাদেরকে জানিয়েছেন।

আমাদের কারো কোন ক্ষতি করবেনা বলে উনাকে আশ্বস্ত করেছে, কিন্তু ছোট ছেলেরা সে দিকে খেলাধুলা বা গোলমাল করলে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত হবে আর তখনি রেগে গিয়ে গাছে লটকিয়ে রাখবে এই সব কথা বলে সাবধান করে দিয়েছে। এসব শুনে সত্যিই আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। রাতে ঘুমানোর আগে আমাদের মধ্যে কিছু কিসসা কাহিনী যথারীতি হয়ে থাকে, কিন্তু ঐ দিন ঘুমের প্রস্তুতি সভার প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল “আম গাছের ভূত সমাচার”। কেউ বলছে ভূত দেখতে কি রকম, কালো না ধলো? আহা! যদি কোনোমতে এক বার দেখতে পারতাম! আরেকজন বলছে রাতে ভূতের কথা আলাপ করলে ওরা অনেক দূর থেকেও তা শুনতে পারে। আমি তখন বললাম শুনলে কি হলো, দেয়ালের ভিতর কি ভূত কখনও আসতে পারে? সে রাতে এভাবেই ভুত প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পরি। শেষ রাতে ঘুম ভাঙলে শুনলাম খালা এবং খালু তাহাজ্জুদ নামায পরে মাসুদ ভাইয়ের জন্য আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে দোয়া করছেন। দুই দিন পরে যার যার বাড়িতে চলে আসলাম। ওই সময় শ্রীমঙ্গলের তেলিয়াপারায় হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তি বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ চলছে। আমরা বাড়ি থেকে কামান আর মেশিন গানের আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পেতাম।
দিন যায় রাত আসে। মানুষের জীবন একটা অনিশ্চয়তার মাঝে কাটছে আর এভাবেই এসে গেল ১৬ই ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হয়ে নতুন একটা রাষ্ট্রের সূচনা হল। মুক্তি যোদ্ধা যারা বেঁচে আছেন প্রত্যেকই যার যার বাড়িতে ফিরে আসছেন, কিন্তু মাসুদ ভাইর কোন খবর এখন পর্যন্ত নেই। সবার মনে একটাই সন্দেহ, উনি কি জীবিত আছেন? হঠাৎ একদিন মাসুদ ভাইদের গ্রামের এক মুক্তি সেনা এসে বলল, মাসুদ ভাই বেঁচে আছেন, তবে স্বাধীন হওয়ার সময় তিনি বগুড়া জিলায় ছিলেন, তাই আসতে একটু সময় লাগবে। সত্যই এর দুই দিন পরেই তিনি বাড়িতে ফিরে আসলেন।এই খবর শোনার সাথে সাথেই সকল আত্মীয় স্বজন মাসুদ ভাইকে দেখতে খালার বাড়িতে যান, আমি নিজেও গেলাম।

মাসুদ ভাইর সাথে সকলের কুশল বিনিময় চলছে। উনার গুলিবিদ্ধ পায়ের ক্ষত দেখাচ্ছেন, যুদ্ধকালীন সময়ের বিভিন্ন পরিস্থিতি নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন, তার যুদ্ধের নানা কাহিনী শোনাচ্ছেন! সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আমার বয়সি যারা ছিল তাদের কিন্তু এসব শোনার মোটেই আগ্রহ নেই। আমরা শুধু ভূতের খবর জানার কৌতূহল নিয়ে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি কখন যে খালাকে জিজ্ঞাসা করতে পারব! সেই সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় আছি। দুপুরের আগে চা চক্রের আসরে আবার আলাপ আলোচনা জমে উঠল। এমন সময় এক সুযোগে খালাকে জিজ্ঞাসা করলাম-
-আম গাছের ভূতের খবর কি?
খালা এবার হেসে দিলেন, বললেন- ভূতরা সবাই ছেলে পিলে নিয়ে চলে গেছে!
শুনে একটু থমকে গেলাম! কিভাবে গেল? তাছাড়া জাহিদ মোল্লাকে নাকি বলেছিল সারাজীবন ওখানেই থাকবে।
খালা বললেন- অন্য একজন মোল্লা এনেছিলাম যার তাবিজের শক্তি খুব বেশি, তাই ঐ ভুতেরা এখানে টিকে থাকতে পারে নাই।
জানতে চাইলাম- ঐ মোল্লার নাম কি?
খালা বললেন- নাম হল মুক্তিবাহিনী।
আবার বললাম- ভুত গুলি কি শ্মশানে চলে গেছে?
খালা বললেন- ওখানে যায় নাই, তবে এক দম সোজা পাকিস্তান চলে গেছে।
-পাকিস্তান কেন?
-ওদের আসল বাড়ি হল পাকিস্তানে।
শুনে বিস্মিত হয়ে গেলাম! পাকিস্তানের ভূত এদেশে কি ভাবে আসল?
তিনি বললেন- ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট থেকে ঐ ভূত গুলি এদেশের মাটিতে এসে মানুষের উপর বিভিন্ন প্রকার শোষণ ও নির্যাতন করছিল, ওদের দমন করতে আমাদের মুক্তিবাহিনী গঠন হয়।
-ওরা কি আবার আসবে?
-না! এ মাটিতে কখনও আসতে পারবেনা।
-যদি আসতে চায়?
-চাইলেও পারবেনা, চোখ অন্ধ হয়ে বঙ্গোপসাগরে ডুবে মরবে।
এবার খালার চেহারা মলিন হয়ে গেল, চোখ দিয়ে পানি আসছে, আমাদেরকে আদর করে ডেকে বললেন-
-আমার সোনামণিরা, আমি এত দিন তোমাদেরকে একটা মিথ্যা ভয়ের মধ্যে রেখে ছিলাম, এবার সত্যি কথাটা বলি শোন, আসলে ভূত বলতে কিছুই নেই, আম গাছেও ভূত ছিলনা, শ্মশানে ও ভূত নেই। রাজা মিয়াকেও ভূতে মারে নাই। পারিবারিক দ্বন্দ্বের জের ধরে সে নিজেই গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। যখন ভুতের কথা বলেছিলাম তখন আমার বাড়িতে ঐ আম গাছের পাশে খড়ের ঘরে চার জন মুক্তিবাহিনীকে থাকার জন্য আশ্রয় দিয়েছিলাম। তারা প্রায় বিশ দিনের মত ঐ ঘরে ছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে গেরিলা অপারেশনের জন্য বেরিয়ে যেত এবং ভোর হওয়ার আগেই এখানে ফিরে আসত। আমি এবং তোমাদের খালু ব্যতীত অন্য কেউ এ কথা জানত না। তাদেরকে রান্নাঘর থেকে নিয়মিত খাবার দিয়েছি কিন্তু আমার নিজের সন্তানরাও টের পায়নি। তোমাদের বয়স কম, মনটাও কাঁচা, যদি কোনক্রমে তোমরা দেখে ফেলতে, তখন হয়ত অন্য লোকেরা জেনে যেত, আর এভাবেই মুখে মুখে খবরটা হানাদার বাহিনীর কানে পৌঁছে যেত, তখন ওরা এসে আমাদের সবাইকে মেরে বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে কারবালা বানিয়ে দিত। এ জন্যই আমি সে দিকে যাওয়া থেকে তোমাদের বারণ করেছিলাম।

সেদিন আমার খালার এমন একটা অসাধারণ দুঃসাধ্য কাজের বর্ণনা শুনে উপস্থিত সবাই অত্যন্ত ভীতিজনক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন- কোন ভরসার ভিত্তিতে এত বড় ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্বভার নিয়েছিলেন?
খালা বললেন- তা অবশ্যই জানি, বিষয়টা ছিল খুবই স্পর্শকাতর এবং বিপদজনক, কিন্তু আমার নিজের ছেলেও মুক্তি যুদ্ধে গিয়েছিল, সে তখন দেশের কোন জাগায় কি অবস্থায় ছিল জানিনা, হয়ত আমার মত কোন মা তাকেও একই ভাবে সাহায্য করবে, এই ভেবে আমার হৃদয়ের সকল ব্যাথা বেদনার অনুভূতি নিয়ে আমার নিজ সন্তানের মুখ মনে করে আমি তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। পক্ষান্তরে ওরা যুদ্ধ করছে দেশের জন্য, তাদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা প্রতিটি মানুষের নাগরিক দায়িত্ব।
সে দিন খালা ভূতের উদাহরণ দিয়ে যে তাত্ত্বিক কথা গুলা বলেছিলেন এগুলার তাৎপর্য এখন যে ভাবে বুঝতে পারি তখন কিন্তু পারিনি। ওই যুগের একজন সাধারণ পল্লীবধূ যার যৎসামান্য লেখা পড়া হয়ত ছিল কিন্তু উনি যে কত সাহসী, দূরদর্শী এবং জ্ঞানী ছিলেন তা চিন্তা করলে আশ্চর্য হয়ে যাই। আমার খালার কথা মনে হলে এখন বুঝি এদেশের কত মা বোন এমনি করে নিজের জীবনের ঝুঁকির কথা না ভেবে কত কি দিয়ে গেছেন যা আমরা কেও কোনদিন জানতেও পারব না, তাদের সবাইকে জানাই শ্রদ্ধা ও সম্মান।

আমাদের স্বাধীনতার জন্য এ দেশের হাজার হাজার মা বোনের কত যে অবদান আছে, সে খবর কি কেউ রাখে? বা জানতে পেরেছে কোনদিন? এর প্রেক্ষিতেই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম অনেক আগেই লিখে গেছেন, “কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে, কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে”, কত মাতা দিল হৃদয় উপাড়ি, কত বোন দিল সেবা, বীরের স্মৃতি-স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা? আমরা বাঙালি, আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা, পতাকা, জাতীয় সংগীত! তাই জাতীয় পরিচয় নিয়ে যখন বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখন মনে হয় একাত্তর সালের চলে যাওয়া সেই ভূতের ছায়া এখনও বাংলার মাটিতে রয়ে গেছে, এই ভূতের ছায়া কবেই যে এই মাটি থেকে বিদায় নিবে সেই সুদিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

একাত্তরের দিনগুলি

flag

তখন ছিল ১৯৭০ সালের অগ্রহায়ণ মাস। আমাদের এলাকার বিস্তীর্ণ জমিতে চলছে আমন ধান কাটার পালা। ধান কাটার সময় চাষিদের ভাটিয়ালি গানের সুরে সুরে বাংলার আকাশ বাতাসে এক শান্তির পরিবেশ, আনন্দের পরিবেশ বিরাজ করছিল, মানুষের মনে সুখ ছিল, আনন্দ ছিল। ধান কাটার পরে নাড়ার মধ্যে কিছু কিছু ধানের শীষ থেকে যায় সেগুলো একটা একটা করে কেটে ছোট টুকরি ভরাকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় লুড়া বলে। তবে অন্য জাগায় কি বলে সে আমার জানা নেই। অগ্রহায়ণ মাসে আমার বয়সের গ্রামের অনেক ছেলেরা লুড়তে যেত আমিও শখেরবসে প্রলুব্ধ হয়ে মাঝে মধ্যে নিজের জমিতেই অন্যান্য সমবয়সীদের সাথে লুড়তে যেতাম। কিন্তু টুকরি ভরা আমার পক্ষে কখনও সম্ভব হয়নি। যারা ধান কাটত তাদের দিয়ে কিছু ধান নিজের জমি থেকে খাটো করে কাটিয়ে টুকরিটা ভরে নিতাম।

তজই উল্লা ছিলেন আমাদের বাৎসরিক স্থায়ী কাজের লোক। তার নেতৃত্বে ধান কাটার অস্থায়ী দশ বার জন লোক পরিচালিত হতো। আমার বয়সী তার এক ভাগিনা ছিল নাম খুরশিদ। আমি এবং খুরশিদ একদিন লুড়তে গেলাম। যে জমিতে লুড়ব হাওরের মধ্যে ঐ এলাকার নাম ছিল মুলমাল। ওই দিন কাজের লোকদের দুই ভার করে ধান কাটা শেষ, তাই তারা প্রথম ভার নিয়ে বাড়ীতে আসল, আমি এবং খুরশিদ রয়ে গেলাম পরে আসব বলে। হঠাৎ আমাদের চোখে পরল একটা দিয়াশলাই পরে আছে নাড়ার উপরে যা কাজের লোকেরা তামাক বিড়ি খাওয়ার জন্য নিয়েছিল। আমাদের দুজনের মাথায় হঠাৎ শিশুসুলভ দুষ্টু বুদ্ধি এলো। তামাসা করে নাড়ার মধ্যে আগুন লাগিয়ে দিলাম কিন্তু ফলাফল কি হবে সেটা দুজনের আক্কেলের মধ্যে বিন্দু মাত্রও আসেনি। যেহেতু সারা জমি ছিল একদম শুকনো তাই অতি তাড়াতাড়ি আগুন চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেল। আমরা আগুন নিভানোর চেষ্টা করার পাশা পাশী আশপাশ থেকে আরও লোকজন এসে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। শুধু কাটা ধান গুলা কোনরকম সরিয়ে রক্ষা করা গেল।

ভাগ্য ভাল ছিল কারণ এই সময় ঐ এলাকায় অন্য সব লোকের জমিতে ধান কাটা শেষ। শুধু মাত্র আমাদের জমিতেই পোয়া দেড় পরিমাণ জায়গা ধান কাটার বাকি ছিল নতুবা অগ্রহায়ণ মাসে যে পরিমাণ ধান আমাদের পাওয়া হয়েছিল এর বিশ গুণ বেশী পেলেও মানুষের ক্ষতি পূরণ করা যেত না। আগুনের ঘটনার খবর ইতিমধ্যে বাড়িতে পৌঁছে গেছে। বাড়িতে ঢুকব এই সাহস মোটেই নেই। বাড়ির উত্তর দিকের রাস্তার পাশে বসে আছি সাথে ছোট বড় মিলিয়ে আরও কয়েক জন। বিভিন্ন কথা বার্তা চলছে কেউ আবার বলছে ঘটনার সূত্রপাত কিভাবে হলো আরও কত কিছু । আমাদের গ্রামের সম্পর্কে আমার এক চাচাও উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ আমাকে বলে উঠলেন ভাতিজা তোর বাপ আসছে। শুনে মেজাজটা গরম হয়ে গেল, এমনিই মনে দুঃচিন্তায় অস্থির তার উপর মশকারা । সত্যই পূর্ব দিকে চেয়ে দেখি সুট টাই পরা একজন লোক হেটে আসছেন সাথে একজন কুলি মাথায় করে সুটকেস নিয়ে আসছে। আরও একটু কাছে আসতেই চিনে ফেললাম, সত্যিই আমার বাবা! তবে তিনি হঠাৎ আসেননি। আসার আগে বাবা চিঠি দিয়েছিলেন তারিখ জানিয়ে কিন্তু সে চিঠি তিনি আসার এক সপ্তাহ পরে বাড়িতে পৌঁছেছে। বাবা সোজা বাড়িতে ঢুকে গেলেন। আমিও আস্তে ধীরে এই সুযোগে বাড়ির ভিতর চলে আসলাম। সবার সাথে বাবার কুশল বিনিময় চলছে আর আমি দূরে দাঁড়িয়ে তাই দেখছি। এমন সময় আমার দাদি বাবাকে সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণী মুখস্থ বলা শুরু করলেন, তোমার ছেলে এই কামাই করেছে, সাড়া জমি জ্বালিয়ে দিয়েছে ইত্যাদি। অনেক দিন পর বাবা লন্ডন থেকে এসেছেন এই সুবাদে প্রচলিত আইন অনুযায়ী আমার অপরাধের যে দণ্ডাদেশ হওয়ার কথা ছিল সেই মামলা বাবার স্নেহের কাছে ডিসমিস হয়ে গেল। অনেকদিন পরে বাবা তার ছেলেকে কাছে পেয়ে তার আনন্দের আতিশয্যে আমি খালাস পেয়ে গেলাম।

অগ্রহায়ণ মাস প্রায় শেষ পর্যায়ে। সাড়া দেশে চলছে নির্বাচনী প্রচারণা। সপ্তাহ খানেক পরেই নির্বাচন। এইবারের ভোট কেন্দ্র ছিল দক্ষিণ বাড়ন্তী প্রাইমারী স্কুলে। প্রবাসী হিসাবে যদিও বাবার ভোটাধিকার ছিলনা কিন্তু ভোটের দিন সেন্টারে এমনিই বেড়াতে গেছেন, সাথে আমিও ছিলাম। ভোট কেন্দ্রে বেশ কিছু চা মিষ্টির দোকান বসেছিল। বাবা এক হিন্দু মিষ্টির দোকানে বসে অন্যান্য লোকদের সাথে গল্পগুজব করছেন । বাবা দোকানদারকে বললেন আমার ছেলে যত মিষ্টি খেতে পারে তাকে দিতে থাক। দোকানদার একটা প্লেট ভরে মিষ্টি দিল, দুটি মিষ্টি অনায়াসে খেয়ে ফেললাম কিন্তু তৃতীয় মিষ্টির অর্ধেক খেয়েই আর পারছিলাম না, বাকি টুকু খেলে হয়ত পেটের ভিতরে না গিয়ে বাইরে রেরিয়ে আসত।

নির্বাচন শেষ হলো, আওয়ামীলীগ বিপুল ভোটে পাশ করল। তারপর বঙ্গবন্ধুর সাথে শুরু হল ইয়াহিয়া-ভুট্টোর আলাপ আলোচনা। আলোচনা চলছে কিন্তু কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। দিনে দিনে এ ভাবে ব্যর্থ আলাপ আলোচনার জের ধরে চলে আসে সেই উত্তাল মার্চ মাস। হানাদার বাহিনী বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। এক দিন বাবা কাজের লোক নিয়ে দিঘিরপার বাজারে গিয়েছেন হালের গরু কেনার জন্য, যথাসময়ের আগেই খালি হাতে বাবা বাড়ি ফিরে এসে বললেন যে পাঞ্জাবিরা হঠাৎ বাজারে আক্রমণ করেছে বলে বাজার ভেঙ্গে গেছে তাই গরু কেনা হয়নি। যে যে দিকে পারে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছে। ঠিক ওই দিন আমাদের থানার বাজারেও পাঞ্জাবী এসেছিল তখন লোকজন লাঠি ঝাঁটা নিয়ে পাঞ্জাবিদের দিকে এগুতেই তারা গুলি চালায়। রাধানগর গ্রামের এক জন লোক (নাম জানা নেই) গুলিতে নিহত হয়। এর কয়েক দিন পরেই শেরপুরে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ।

আমাদের বাড়ি বাড়ন্তী গ্রামের একদম পশ্চিমে অবস্থিত। এর পরে কাশির বাড়ি, সেখান থেকেই হাওরের শুরু। আমরা গ্রামের ছোট বড় সবাই কাশির বাড়ির কাছে দাড়িয়ে যুদ্ধের গোলাগুলির আওয়াজ শুনতাম। পাকিস্তানি বোমারু বিমান অনবরত মুক্তি বাহিনীর উপর বোমা বর্ষণ করছে সেই দৃশ্য আমরা সবাই দেখতাম। কেউ কেউ আফসোস করে বলতেন হায়রে যদি আমাদের ঐ রকম একটি বিমান থাকত! যুদ্ধ চলছে, উত্তর থেকে লোকজন প্রাণের ভয়ে বাড়ি ঘর ছেড়ে সপরিবারে দল বেধে হাওর দিয়ে দক্ষিণ দিকে আসছে। কোথায় যাবে সেই ঠিকানা তাদের জানা নেই। এক লোক তার বৃদ্ধ পিতাকে কাঁধে করে নিয়ে আসছিল এই হৃদয় বিদারক দৃশ্যটা এখনও বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠে। মনটা অস্থির হয়ে পরে। ভীষণ বেদনাদায়ক দৃশ্য।

সন্ধ্যার পরে তিন জন মুক্তি সেনা সোজা হাওর দিয়ে আমাদের বাড়িতে উঠে রেডিওতে খবর শুনে রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে চলে গেলেন। এক তরফা বোমা নিক্ষেপের ফলে মুক্তি বাহিনীর পক্ষে শেরপুরের যুদ্ধ বেশি দিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তখন তারা সেখান থেকে চলে এসে কামালপুরে মনু নদীর পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধের পুন: প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কামালপুর বাজার সপ্তাহে দুই দিন, শনি এবং মঙ্গল বার। আমাদের ইউনিয়নের প্রত্যেকের পারিবারিক রসদ যোগান হয় ঐ বাজার থেকেই। সে দিন ছিল বাজার বার, গ্রামবাসী অনেকেই সকাল সকাল বাজার খরচ সেরে বাড়িতে এসে বলাবলি শুরু করেন যে, তারা দেখে এসেছেন মুক্তি বাহিনী গর্ত খুরে বিভিন্ন মারণাস্ত্র ফিট করছে, হয়তো কাল কিছু একটা ঘটতে পারে। পরের দিন ভোর বেলা হানাদার বাহিনী শেরপুরের নদী পার হয়ে কাজীর বাজার এসে গুপ্তচরের মাধ্যমে জানতে পারে সামনে মুক্তি বাহিনী ওত পেতে আক্রমণের জন্য অপেক্ষায় আছে, তারা তখন পায়ে হেটে সেখান থেকে রওয়ানা দেয়। সকাল সাত বা আটটার মত হবে হঠাৎ ভটভট করে মেশিনগানের আওয়াজ শুনে বুঝলাম যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।

আমাদের প্রয়োজনীয় মূল্যবান জিনিসপত্র আগের দিন গুছিয়ে রাখা ছিল, যদি বাড়ি ছেড়ে যেতে হয় সেই জন্য। কাজের লোক ভার নিয়ে প্রস্তুত, বাড়ি ছেড়ে চলে যাব এমন সময় ঘটে গেল এক এলাহি কাণ্ড । আমাদের পাঁচ মৌজার কয়েক গ্রামের লোক বাড়ি ঘর ছেড়ে সপরিবারে আমাদের বাড়িতে নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় নিচ্ছে। মহিলারা ঘরের ভিতর, কিছু লোক গাছের নিচে, বাঁশ ঝাড়ের নিচে, উঠানে অর্থাৎ যে যেখানে পারছে অবস্থান নিয়েছে। বেশীর ভাগ পুরুষ মানুষ রাস্তার উপর দাড়িয়ে নানা রকম আলাপ আলোচনা করছে, সবাই একটা অনিশ্চিতের মধ্যে রয়েছে, কেও শান্তি পাচ্ছে না। সবার মনেই আতংক। বাবা তখন ভাবলেন এত লোক আমার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তাহলে এদেরকে রেখে আমরা বাড়ি ছেড়ে যাই কেমন করে? সবার যা হবে আমাদের ও তাই হবে। আমাদের আর কোথাও যাওয়া হলো না।

কামালপুরেও মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানি হানাদারদের যুদ্ধ চলছে আর আমরা গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ভয়ে সবার মুখ শুকিয়ে গেছে কিন্তু কেও কোন কথা বলতে পারছে না। সবার মনেই অজানা ভয়, মুখ শুকনো। বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনীর সামনে সামান্য অস্ত্র নিয়ে মাত্র কয়েক জন মুক্তি বাহিনীর বেশী সময় যুদ্ধে টিকে থাকা সম্ভব নয়, প্রায় বিশ মিনিট পরেই গোলাগুলি থেমে যায়। তিন জন মুক্তি বাহিনী ঐ দিন শহীদ হন এবং হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন নিহত হয় (সংখ্যা জানা নেই)। মনের আক্রোশ মিটাতে গিয়ে ঐ দিন কামালপুর বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট হানাদার বাহিনী জ্বালিয়ে দেয়। হঠাৎ দেখি এক জন মুক্তি সেনা রাস্তা দিয়ে পূর্ব দিক থেকে দৌড়ে আসছে, যেই মাত্র বেচারা ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পরে অমনি মুসলিম লিগের দোসররা তাকে ধরে শুরু করল টানাহেঁচড়া, লাথি, তারপর, অকথ্য ভাষায় গালাগালি, শালার বেটারা তোদের কারণে আমাদের দেশ ভাগ হতে যাচ্ছে, ইত্যাদি। এক পর্যায়ে ওর পেন্ট এবং গায়ের জামা খুলে যায়, শুধু একটা কালো আন্ডার প্যান্ট ব্যতীত পরনে আর কিছুই ছিলনা। আত্মরক্ষার জন্য দৌড়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পরে। আমার বাবা লোকটাকে একটা লুঙ্গি দিয়ে হাওরের পশ্চিম দিকে যেতে বললেন। এখনও মনে আছে ঐ মুক্তি সেনার বাড়ি ছিল দিনাজপুর কিন্তু নামটা জানতে পারিনি। নাম না জানলে কি হবে তার মুখের ওই ছবি কোনদিনও ভুলব না। যতদিন বেচে থাকব ওই মুখের ছবি আমার অন্তরে গেঁথে থাকবে। থাকবে না কেন? সে যে মুক্তি যোদ্ধা! এই প্রথম আমি কোন মুক্তিযোদ্ধা দেখলাম নিজের চোখে। আমার খুব আনন্দ হলো আমি মুক্তি যোদ্ধা দেখেছি। সে দেশের জন্য ওই মুখ ওই প্রাণ বলি দিতে এসেছে। সে বেচে আছে কিনা তাও জানি না। তবে সে যেখানেই থাকুক আল্লাহতাআলা যেন তাকে শান্তিতে রাখেন এবং বেহেস্ত নসিব করেন।

যে উঠতি বয়সের তাজা মানুষগুলি নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করছে তাদের প্রতি এ ধরনের অমানুষিক, হিংস্র আক্রমণ কতটা দুঃখ জনক তা যে দেখেনি তাকে বোঝান সম্ভব নয়। গ্রামের অধিকাংশ লোকের সকালের খাওয়া দাওয়া হয়নি পেটের ক্ষুধায় ছোট বাচ্চারা কান্নাকাটি করছে। এই দৃশ্য দেখে বাবা খুবই চিন্তিত হলেন, মর্মাহত হলেন। শুধু বাড়ির উঠানে এপাশ থেকে ওপাশে পায়চারী করছেন আর ভাবছেন কি করা যায়? ভাবছেন এই লোকগুলি বিপদে পরে আজ আমার বাড়িতে এসেছে, হঠাৎ করে এত লোককে খাওয়ানো ও সম্ভব নয় অথচ খেতে না পেলে এরা করবেই বা কী? এমত অবস্থায় ওদের জন্য সামান্য কিছু ও যদি করতে না পারি তাহলে সাড়া জীবন অনুশোচনার মধ্যে থাকব, অমনি হঠাৎ তার মনে পড়ে যে আমাদের ঘরে একটা বড় ডেকচি ছিল যেটা শুধু ব্যবহার হত বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য। আমার বাবার তাৎক্ষণিক উদ্যোগে লোক দ্বারা ঐ ডেকচি উঠানে বের করে ওতে করে খিচুরি রান্না করা হয় এবং যথাসাধ্য উপস্থিত সবাইকে কোনভাবে কিছু কিছু দিয়ে চালিয়ে নেয়া হয়। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার কিছুক্ষণ পরে সবাই যার যার বাড়িতে চলে গেলেন।

মানুষের বিপদের সময় সামান্য একটু উপকার করতে পারলে সেটা সাড়া জীবন মনে থাকে। এই প্রেক্ষিতে ছোট একটা কথা মনে এলো যা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও না বলে পারছি না। আমার বাবা মরহুম আব্দুল গণি ২০০৪ সালে মারা যান। কামালপুর ইউনিয়নের ছোট বড় সকলের কাছেই উনি বেশ পরিচিত এবং প্রিয় ছিলেন। বাবার জন্য শিরনী করব এই পরিকল্পনা নিয়ে আমরা চার ভাই ২০০৭ সালে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে যাই। আমাদের এলাকার স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী যে কোন শিরনীর পূর্বে মুছলত করতে হয় যার মানে হল পূর্ব প্রস্তুতির জন্য আলোচনাসভা। যেহেতু ঐ শিরনীটা ছিল বড় আকারের, সাড়া ইউনিয়ন নিয়ে। কাজেই কয়েকটা মুছলত করতে হয়। কে কি ভাবে নিবে বা কার কি মতামত বা পরামর্শ সবই জানতে হবে। এক দম শেষের মুছলতের দিন বিভিন্ন গ্রামের কয়েক জন প্রবীণ মুরব্বিয়ান উপস্থিত ছিলেন। তারা তখন আমার চাচা তালেব উদ্দিন মালদারকে উদ্দেশ্য করে বললেন যার জন্য আপনারা শিরনী করতে যাচ্ছেন ঐ ব্যক্তির শিরনীতে মুছলত করার প্রয়োজন নাই, আমাদেরকে শুধু বললেই হত, যত প্রকার সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন সব কিছু আমাদের কাছ থেকে পাবেন। আপনারা আপনাদের সুবিধা অনুযায়ী যা ভাল হয় তাই করেন, আমরা আপনাদের সাথেই আছি। তিনি এই এলাকার একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন এবং আমাদের জন্য যা করেছেন তা আমরা কেও ভুলে যাইনি, আমাদের সবই মনে আছে। কামালপুরের যুদ্ধের দিন উনি আমাদের জন্য যা করেছিলেন এখনও সেটা আমাদের হৃদয়ে চীর স্মরণীয় হয়ে আছে। আলহামদুলিল্লাহ ঐ শিরনী খুব সুন্দর ও সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।

এবার যুদ্ধের কথায় আসি। সাড়া দেশেই যুদ্ধ চলছে। ছয় সাত দিন পরে বিকাল বেলা আমরা গ্রামবাসীরা দেখতে পেলাম হাওরের পশ্চিম দিকে বেশ দুরে নড়িয়া গ্রামে কালো ধোয়া উড়ছে, অনেকেই ভাবলেন হয়ত কারো বাড়িতে আগুন লেগেছে, কিন্তু পরে জানা গেল যে হানাদার বাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় মাড়া গোষ্ঠীর বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে সপরিবারে হত্যা করেছে। এত দুরে বড় হাওরের পাশে অবস্থিত ঐ গ্রামে পাঞ্জাবী যেতে পারে এই খবরটা প্রথমে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেন নাই। কিন্তু পাকিস্তানিদের দোসর তাদের চেলা শয়তান রাজাকারদের সাহায্যে তারা ঠিকই পৌছে গেছে।

লন্ডন থেকে দেশে আসার সময় বাবা একটা বড় রেডিও এনেছিলেন, প্রতি দিন সন্ধ্যার পরে গ্রামের ছোট বড় অনেকই আমাদের বাড়িতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে খবর শোনার জন্য এসে জড়ো হতেন। আমি নিজেও উপস্থিত থাকতাম এবং অনেক কিছুই মোটামুটি বুঝতেও পারতাম। প্রতি দিন বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্র কণ্ঠের আওয়াজ, “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা”। শুনতে খুবই ভাল লাগত। আমি তখন প্রাইমারী স্কুলে পড়ি তবুও মনে হতো আহা আমিও যদি ওই মুক্তি সেনাদের সাথে যুদ্ধ করতে পারতাম! শরীরের রক্তে কেমন যেন একটা উন্মাদনা অনুভব করতে পারতাম। বুঝতাম বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্র কণ্ঠের আওয়াজ আমাকে কেমন উন্মাদ করে দেয়। তখন আমার যে বয়স ছিল আজকাল সেই বয়সের ছেলেরা হাই স্কুলে পড়ছে। পড়া লেখার জন্য যদিও কড়া শাসনের মধ্যে ছিলাম কিন্তু যুদ্ধ কালীন সময়ে স্কুলে যেতে হতনা, পারিবারিক দিক থেকেও বাড়িতে পড়াশোনার জন্য বকুনি শুনতে হতনা। খাওয়া, ঘুম এবং খেলাধুলা ঐ তিন কাজ নিয়েই সময় কাটত। আর যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতাম তখন মনে অন্যরকম জোয়ার আসত বেশ বুঝতাম। দেশাত্মবোধক গানগুলি মনে ভিন্ন অনুভূতির সঞ্চার করত রাতে শুয়ে শুয়ে ঘুমাবার আগে কত কি ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরতাম।

মাস দু এক পরের ঘটনা, তখন সম্ভবত আষাঢ় মাস, ঐ দিন কামালপুরে বাজার বার ছিল। শোনা গেল হানাদার বাহিনী কামালপুরের মাহিনদের বাড়িতে আক্রমণ করেছে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য পরিবারের সবাই দেবতার ঘরে ঢুকেছিল কিন্তু শয়তান পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের চেলারা ঘর থেকে ওদের সবাইকে এক এক করে বাহির করে, লাইনে দাড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে ওদের উঠানেই আনন্দ করে নৃত্য করেছিল। ঐ সময় মাঠে গরু আনতে গিয়েছিল বলে ভাগ্যক্রমে শুধু চৌদ্দ বা পনের বয়সের একটা ছেলে বেঁচে যায়। পরে জানা গেল পাকিস্তানের পোষা সেই কালো হায়েনা এবং তাদের সহচরদের প্ররোচনায় নড়িয়া এবং কামালপুর গ্রামে হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালায়। কি অপরাধ করেছিল ওরা, কার পাকা ধানে মই দিয়েছিল, তাদের কি এই পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার ছিলনা, কেন তাদেরকে হত্যা করানো হল, এসব প্রশ্নের উত্তর আজ পর্যন্ত পেলামনা। এই দেশের মাটি, বাতাসে বেড়ে উঠে অন্যের উৎসাহে, অন্যের স্বার্থে কেন নিজের ভাইকে হত্যা করল? আবার তারাই দেখি এখন টেবিলে এই দেশের মানুষের রক্তে রাঙ্গা পতাকা উড়িয়ে অফিস করছে! হায়রে মানুষ!

আমাদের গ্রামের লোকজন সব সময় একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকতেন। কে জানে কখন পাঞ্জাবী এসে যায়। হঠাৎ একদিন উদ্দেশ্যমূলক ভাবে রঞ্জন পালের বাড়ির নিকটে কে যেন বাঁশ দিয়ে বন্দুকের মত আওয়াজ করে, সাথে সাথে গুজব ছড়িয়ে যায় পাঞ্জাবী আসছে, আর এই সুযোগে গ্রামের কিছু লোভী ব্যক্তি তাদের বাড়ি আংশিক লুট করে নেয়। আমার নিজেরও কৌতূহল হত পাঞ্জাবী দেখতে কেমন? একদিন যদি এসে যেত তাহলে দেখতে পারতাম। সেই আশাটাও পূরণ হয়ে গেল। বাবার সাথে একদিন কামালপুর বাজারে গিয়েছিলাম সেখানে দেখি সিলেট থেকে তিনটি ট্রাক ভরে পাঞ্জাবী শ্রীমঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। দেখেই একটা ঘৃণার ভাবের উদয় হলো।

এভাবেই দেখতে দেখতে এসে গেল ১৬ই ডিসেম্বর, দেশ স্বাধীন হলো। এতদিন ধরে যারা নির্বিবাদে মানুষ হত্যা করেছে সেই পিশাচেরা বিড়ালের মত শক্তিহীন মেরুদণ্ডহীন হয়ে ভাঙ্গা কোমর নিয়ে আমাদের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করল। পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন একটি দেশের জন্ম হলো। আজকে এই দেশের নামই বাংলাদেশ। আমরা বাঙালি হয়ে নতুন করে আবার জন্ম নিলাম। নতুন সূর্যের উদয় হলো, শুরু হোল আমাদের নতুন যাত্রা। ৭২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত রীতিমত খুলে গেল। আমাকেও এখন আগের মত নিয়মিত স্কুলে যেতে হয়, পাশাপাশি বাড়িতেও ঠিক মত পড়াশোনা করতে হয়। আমরা সবাই আবার নতুন করে শুরু করলাম এই দেশ গড়ার জন্য নতুন অভিযান।

সংগ্রামের বৎসর আমার যতখানি বয়স ছিল বিবেক বুদ্ধিটাও সেই পরিমাণেরই ছিল। তখনকার সময় মানুষ কত ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করছিল সেটি এখন যে ভাবে অনুধাবন করতে পারি তখন কিন্তু তা পারিনি। সে সময় স্কুলে যেতে হয়নি , বাড়িতেও পড়তে হতনা কত আরামের জীবন ছিল তাই মনে মনে ভাবতাম যদি গত বৎসরের মত আরেকটি যুদ্ধ লেগে যেত তাহলে স্কুলে যাওয়া আসার কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে যেতাম! কতটা অবুঝ ছিলাম!! এ কথা মনে হলে অবাক হই, তখন আমি এত বোকা কেন ছিলাম?

আজকে আমার পরিচিত অনেক বন্ধু বান্ধব আছেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই আমার চেয়ে বয়ঃকনিষ্ঠ। ওদের মধ্যে অনেকেই আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে গভীর ভাবে সক্রিয়। প্রায় সময় সবাই একত্রে জড়ো হলে আড্ডা বসে। বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ আলোচনা জমে উঠে। যখন স্বাধীনতা বা পাকিস্তান আমলের ইতিহাস নিয়ে কথা হয়, তখন তারা বিস্মিত হন। তাদের মধ্যে কিছু লোক আবার এসব কথা আষাঢ়ে গল্পের মত মনে করেন। অবশ্য আমরা বয়োজ্যেষ্ঠরা তাদেরকে দোষারোপ করিনা, হয়ত তারা সঠিক ইতিহাস জানার বা বোঝার তেমন সুযোগ পায়নি। আমাদের স্বাধীনতার ৪৪ বৎসর পার হয়ে গেছে আর এখনও আমাদের সিনিয়র রাজনীতিবিদরা ক্যালকুলেটর নিয়ে হিসাব মিলাচ্ছেন কত লোক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রাণ দিয়েছেন অথচ তারা নিজেই সেই রক্তাক্ত নয় মাসের চিত্র স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। ওদের মুখ থেকে এ ধরনের শিশুসুলভ কথা বার্তা শুনে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। রাজনীতি করবেন, ভাল কথা তাই বলে নিজের দলের স্বার্থ রক্ষার্থে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করে বিতর্ক সৃষ্টি করা কখনও সমীচীন নয়। নিজের স্বার্থের উদ্দেশ্য ভুলে আসুন আমরা সবাই দেশের স্বার্থের কথা ভাবি, দেশকে ভালবাসি। আমাদের জাতিকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাবার পথ খুঁজি। নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিয়ে গর্ব বোধ করি। এতেই শান্তি, এতেই সুখ যে সুখ আর কিছুতে নেই।

টলু চাচার গুঁজবি কথা

এক-
তখন সবে মাত্র নবম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছি বলে একটা সাইকেল পাওয়ার সখ যেন ভীষণ ভাবে মনের মধ্যে জেগে উঠেছে। সখ বলে কথা! সঙ্গে সঙ্গে আর কিছু না ভেবে লন্ডনে বাবার কাছে চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলাম। লিখার কয়েক সপ্তাহ পরেই টাকা পেয়ে মনের আনন্দে খালাত ভাই এবং মালদার চাচাকে সাথে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে নূতন একটি চায়নিজ ফিনিক্স সাইকেল কিনে বাড়িতে নিয়ে আসলাম। অনেক দূর থেকে এসেছি বলে বেশ ক্লান্ত হয়ে একটু ঘুম-ঘুম ভাব আসছে, তাই উঠানের মধ্যে কোন ভাবে সাইকেলটা রেখে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে কখন যেন ঘুমিয়ে পরেছি । আমাদের ক্ষেত গৃহস্থীর কাজের জন্য যে তিন জন লোক ছিলেন, তাদের মধ্যে এক জনের নাম ছিল টলু মিয়া। তিনি ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির, মধ্যবয়সের, অতি সহজ সরল মানুষ। আমরা তাকে টলু চাচা বলে ডাকতাম। তার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, কোথাও কোন আজগুবি খবর শুনলে তা গভীর ভাবে বিশ্বাস করতেন এবং অতি দ্রুত সর্বসমক্ষে পৌঁছে দিতে যথেষ্ট সুদক্ষ ছিলেন। হঠাৎ উচ্চ সুরে কথা বার্তার আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাইরে এসে দেখলাম টলু চাচা কি একটা ভয়ানক অদ্ভুত জন্তুর খবর নিয়ে বাড়ির সবাইকে উঠানে জড়ো করে এক ভীতিজনক চেহারা নিয়ে অনর্গল তার বিবরণ বলে যাচ্ছেন, আর উপস্থিতি সবাই অবাক হয়ে তা শুনছেন। আমি নিজেও কৌতূহল বশত অদ্ভুত এই খবরটি শুনে কিছুটা চমকে গেলাম। টলু চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, এ খবর কোথা থেকে শুনলেন এবং জন্তুটি দেখতে কি রকম বা নাম কি? চাচা একটু দীর্ঘশ্বাস ছেরে বিস্তৃতভাবে বললেন মছদ্দরের চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে শুনছিলাম, কিছু লোক কি যেন বলাবলি করছে, তাদের মুখ থেকে এই অদ্ভুত জন্তুর খবরটি শুনেছি এর মধ্যে গ্রামবাসী সবার কাছে খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তুমিও শুনবে ।

দুই-

ভাটি অঞ্চলে কয়েক মাস আগে এই অদ্ভুত জন্তুর আবির্ভাব হয়েছিল। আমাদের এলাকায় ঐ জন্তুটির দুই দিন যাবত আগমন ঘটেছে। শুনেছি জন্তুটি নাকি বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন, এটি মানুষ, গরু, হাঁস, মোরগ অর্থাৎ যে কোন প্রজাতির জীব কয়েক মিনিটের মধ্যে জিহ্বা দিয়ে চেটে খেয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখে। এরই মধ্যে অত্র এলাকার কিছু গবাদি পশু খেয়ে ফেলেছে, তবে ভাটি অঞ্চলে অনেক গৃহপালিত পশু খাওয়ার পাশা পাশী কিছু মানুষও খেয়েছে। যদিও আমাদের চুয়াল্লিশ পরগনায় কোন মানুষ খেয়েছে এখনও এই রকম খবর শোনা যায়নি। ঐ জন্তুর বিশেষ কোন আকৃতি বর্ণনা করতে না পারলেও, ধারণা করা হচ্ছে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পশুর রূপ ধারণ করে মানুষের সামনে আসে। যাকে আঞ্চলিক ভাষায় নাম দেওয়া হয়েছে “লেহিয়া খাওরী” ( চাটিয়া খায়)। বিশেষ করে যখন সন্ধ্যা নামে তখন জন্তুটি খাবার অন্বেষণে বের হয়। তাই এলাকাবাসী এই ভয়ংকর জন্তুর আগমনে আতঙ্কিত হয়ে রাত্রে খুব ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করে। প্রতিদিন আমাদের গরুগুলি যথারীতি গোয়াল ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে বেধে রেখে তাদের রাতের খাবারের যাবতীয় ব্যবস্থার দায়িত্ব ছিল টলু চাচার। ওই দিন তিনি এই অধ্যায়টি যথাসময়ের অনেক আগেই শেষ করে দরজায় তালা মেরে দেন। তাই দেখে আমার মেঝচাচা কিছুটা আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, কি হলো টলু “সন্ধ্যা হওয়ার এখনও অনেক বাকি আজ এত সকাল সকালে গরু ঘরে ঢোকানোর কারণ কি?
উত্তরে টলু চাচা একটু ভীতিপূর্ণ কণ্ঠস্বরে বললেন
ভাইজান, আজকাল যে একটা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে দিন কাটাচ্ছি সেটি আপনিও জানেন, তাছাড়া গরুর প্রতি লেহিয়া খাওরী জন্তুর যে লোভ খুব বেশি এ কথা আমরা সবাই শুনেছি। সুতরাং সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদেরকে বাহিরে এমন একটা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রাখা কোনক্রমেই উচিত নয় তাই গরুর নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে সন্ধ্যার আগেভাগেই কাজটা সেরে ফেললাম।
কথাগুলি বলেই টলুচাচা মেঝ চাচার দিকে একটু গর্বের সাথে তাকালেন, ভাবছিল মেঝচাচা তার খুব তারিফ করবে। কিন্তু তার কথা শুনে মেঝচাচা কিছু না বলে বাইরে চলে গেলেন। এতে একটু হতাশ হয়ে টলু চাচা আমাকে বললেন
ভাতিজা তোমার সাইকেলটা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখ।
আমি বললাম কেন! এখনও রাত হয় নাই যে কেও চুরি করে নিয়ে যাবে! চাচা কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন,
চুরি হওয়ার জন্য বলি নাই, বলেছি যদি কোন না কোন ভাবে ঐ জন্তুর নাগালে আসে!
এ কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়ে অবাক দৃষ্টিতে চাচাকে বলি! কেন সাইকেল কি প্রাণী? এতে রক্ত মাংস কিছুই নাই, সম্পূর্ণ লোহার তৈরি একটি বস্তু । তাহলে আপনার এত ভয় কিসের?
আমার কথা শুনে টলুচাচা একটু চিন্তা করে বললেন! তুমি বুঝবেনা ভাতিজা, এত দামী নূতন জিনিস বাহিরে রাখা মোটেই ঠিক হবেনা, কারণ নূতন কোন কিছুর প্রতিই ঐ অস্বাভাবিক অদ্ভুত জন্তুর বিশেষ আকর্ষণ!
ঠিক ওই সময়ে কোথা থেকে আমার দাদি এসে হাজির, তিনি টলু চাচার পক্ষ সমর্থন করে বললেন
টলু ঠিক কথাই বলছিস। দাদি আবেগপূর্ণ হয়ে বললেন! আখেরি জমানা এসে গেছেরে টলু, কত রকমের কত কিছু বাহির হবে, এটাই তো কিয়ামতের লক্ষণ।
তাদের সাথে কথা না বাড়িয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে সাইকেলটি ঘরে রেখেই যেন বাচলাম। বাড়িতে কোন অপরিচিত কুকুর, বিড়াল দেখলে টলু চাচা ঘাবড়ে যান। এমনকি তার গায়ে কোন মাছি বসলেও তিনি চমকে উঠেন এবং মনে মনে ভাবেন, এটাই কি সেই লেহিয়া খাওরী জন্তু! মাছির রূপে এসে কি আমার রক্ত চুষে খেয়ে ফেলবে! যথানিয়মে টলু চাচা সে দিনের সকল করণীয় কাজ সন্ধ্যার অনেক আগেই শেষ করে হাত পা ধুয়ে পূর্ব ঘরের নিজের কামরায় ঢুকে পরেন। রাতের খাবারের ডাক শুনে তিনি পরে যান মহা মুশকিলে। কি ভাবে উঠান অতিক্রম করে পশ্চিম ঘরে যাবেন, তাই নিয়ে বিষম চিন্তিত। হাতে ল্যাম্প নিয়ে সহকর্মী হাবিবকে সাথে নিয়ে ভয়ে ভয়ে কোন ভাবে উঠান পাড়ি দিয়ে পশ্চিম ঘরে পৌঁছেন।

তিন-

এভাবেই টলু চাচার প্রতিটি দিন যেন উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটে। প্রতি বৎসরের মত টলু চাচা এইবারে ও পৌষ সংক্রান্তির অকুরের রথ যাত্রায় গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে এসে তাকে অনেক স্বস্তি বোধ করছে বলে মনে হচ্ছিল। টলু চাচার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখে জিজ্ঞেস করলাম,
কি হয়েছে চাচা, আজকে এত খুশিখুশি লাগছে কেন? তখন তিনি কিছুটা মৃদু হাসির ভঙ্গিতে বললেন,
একটা সুখবর শুনে আসলাম! লেহিয়া খাওরী জন্তুটি মারা গেছে।
এতে আমি বিস্মিত হয়ে চাচাকে বললাম! কোথায় কি ভাবে!
চাচা বললেন! অকুরের রথ দেখে বাড়িতে ফেরার পথে শুনলাম কিছু লোক কি যেন বলাবলি করছে, তাদের মুখ থেকেই ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণী জানতে পেরেছি। পূর্ব দিকে ইটা পরগনার কোন এক গ্রামে, কারো বাড়িতে লেহিয়া খাওরী জন্তুটি কুকুরের রূপ ধারণ করে উঠানে একটা বালতির মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে কি যেন চেটে খাচ্ছিল, এমন সময় এক সাহসী যুবক বুঝতে পেরে ঝাঁটা দিয়ে ঘা বসিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই লেহিয়া খাওরী জন্তুটি জিহ্বা বের করে চির নিদ্রায় চলে গেল। তারপরে মৃত জন্তুটি যেন আবার জীবিত হয়ে না উঠে,তাই সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য এলাকার উৎসুক জনতা তৎক্ষণাৎ আগুনে পুরিয়ে লেহিয়া খাওরীর দেহাবশেষ (ছাই) নদীতে ফেলে নিজেদেরকে যেন এক বিশাল পাপ থেকে মুক্ত করল। অবশেষে চাচা যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।

চার-

বাড়ির দক্ষিণের সেই পুরানো কড়ই গাছের ডালে বসে কয়েক দিন যাবত রাতে হুতোম প্যাঁচা কর্কশ সুরে ডাকছে, তা শুনে টলু চাচা বিচলিত হয়ে আমার দাদিকে বললেন!
চাচী ঐ হুতোম প্যাঁচার ডাকে মনে হচ্ছে শীঘ্রই অমঙ্গলজনক কিছু একটা ঘটতে পারে।
দাদি বললেন! “তা অবশ্যই ঠিক, রাতে হুতোম প্যাঁচার ডাক অশুভ লক্ষণ। তবে আগামী কাল যখন ডাক শুনবে তখন ইট মেরে ঐ আপদকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিও।

দুই দিন পরে সিলেটে মৃদু ভূমিকম্প হয়। তখন ফাল্গুন মাস। বসন্তের প্রাণজুড়ানো দক্ষিণা বাতাসের মধ্যে উঠানে মাদুর বিছিয়ে বাড়ির মুরুব্বিয়ানগণ মাগরিবের নামাজ আদায় করে ওই বিছানায় বসে কিছু সময়ের জন্য বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে গল্পগুজবের আসর জমে উঠে। ওই দিনের উঠান সভার প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল ভূমিকম্প সমাচার, এবং বিশেষ বক্তা ছিলেন টলু চাচা। শুরুতেই চাচা বললেন
আজকের ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের আভাস সেই হুতোম প্যাঁচার ডাক থেকে অনুমান করতে পেরেছিলাম যে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
চাচাকে বললাম! হুতোম প্যাঁচার ডাক থেকে ভূমিকম্পের কি কোন লক্ষণ বুঝা যায়?
চাচা বললেন তা অবশ্য নয়। হুতোম প্যাঁচার ডাক অমঙ্গল বার্তা বয়ে আনতে পারে। সেটা হতে পারে যেমন ভূমিকম্প, মৃত্যু সংবাদ, চুরি অথবা কারো বাড়িতে আগুন। বলা হয়ে থাকে যে, পৃথিবী সৃষ্টির সূচনা লগ্নে মহান আল্লাহতালা একটি ষাঁড় এবং একটি মশা সৃষ্টি করেন। ঐ ষাঁড়ের দুটি শিঙের উপর পৃথিবী সম্পূর্ণ ভাবে ভর করে আছে, আর মশা অতন্দ্র প্রহরীর মত তার দায়িত্ব পালন করছে। যখনি ষাঁড় একটু শিং নাড়ানোর চেষ্টা করে তখনি ভূমিকম্প হয়, আর মশাটি তাৎক্ষণিক ষাঁড়ের মুখমণ্ডলে কামড় বসিয়ে দেওয়ার সাথে সাথেই শিং নাড়ানো বন্ধ করে, এতে ভূমিকম্প থেমে যায়। অতঃপর ষাঁড় মশার কামড়ের ভয়ে শিং নাড়ানো থেকে বিরত থাকে নতুবা শিং নাড়াতে থাকলে এই পৃথিবীর অস্তিত্ব কবেই না লণ্ডভণ্ড হয়ে যেত!

পাঁচ-

জ্যৈষ্ঠ মাসের কোন এক রাতে শু-ভু এমন একটি অদ্ভুত আওয়াজ শুনে সবাই অনুমান করে যে বাড়িতে খাটাশের (বনবিড়াল) আগমন ঘটেছে, ঠিক ঐ সময়ে টলু চাচা উচ্চ সুরে কাকে কি যেন বলছিলেন, তাও কিছু লোক শুনতে পেরেছিল।
পরের দিন টলু চাচাকে রাতে এত জোরে কার সাথে কথা বললেন, জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি উল্লাসিত হয়ে বললেন, গত রাত্রে খাটাসের শু-ভু আওয়াজ শুনে ঘর থেকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এ বছর শু হবে-না ভু হবেরে? উত্তরে তার কাছ থেকে ‘শু’ কথাটি শুনে আন্দাজ করতে পারলাম যে এই বৎসর খেত কৃষি ভাল হবে, মোটামুটি সব কিছু মিলে সারা বছরটি ভালই যাবে ।
তখন আমি চাচাকে বললাম! খাটাশের কথা থেকে কি ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা যায়।
চাচা বললেন! তখনকার মুরব্বিরা এ কথাটি বিশ্বাস করতেন।
বেশ কিছু দিন পর একাধারে চার পাঁচ দিন বৃষ্টি হওয়াতে মনু নদীর পানি বিপদ সীমার উপরে চলে যায়। হঠাৎ এক দিন বাধ ভেঙ্গে বন্যার পানিতে হাওরের সম্পূর্ণ ফসলাদি পানির নিচে তলিয়ে যায়। বিস্তীর্ণ এলাকা জুরে তাকালে যেন মনে হয় হাওর আর হাওর নেই মহাসাগর হয়ে গেছে। এই দৃশ্য দেখে আমি হতাশাগ্রস্ত হয়ে টলু চাচার কাছে জিজ্ঞেস করলাম কি চাচা! আপনার খাটাশের ভবিষ্যৎ বাণী তো মিথ্যে হলো! চাচা এবার আমতা-আমতা করে একটু ভারী কণ্ঠে বললেন সেদিন বাহিরে বৃষ্টি এবং বাতাসের সো সো শব্দের কারণে ভু এর বদলে শু শুনেছিলাম। একথা বলতে বলতে কথা ঘুরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন।
এভাবেই সহজ সরল টলু চাচার অনেক গুঁজবি কথা আমাদেরকে শুনতে হত। আমাদের সমাজে এখনও অনেক গুঁজবি কথার প্রচলন আছে, যা আমরা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি, যে গুলো শুধু মাত্রই কল্পনা, যার সাথে বাস্তব জীবনের কোন সঙ্গতি নেই। সময় এখন পেরিয়েছে, আমরা অনেক দুর হেঁটে এসেছি। এই একবিংশ শতাব্দীর যুগে যেখানে তথ্য প্রযুক্তির সাথে হাঁটছি, সেখানে কল্পকাহিনী বা রূপকথার কোন মূল্য নেই। সব মিছে হয়ে গেছে।

শুভেচ্ছা

শব্দনীড়ের সবাইকে সালাম এবং শুভেচ্ছা!
শব্দনীড়ে এবং কোন ব্লগে এই আমার প্রথম পদার্পন। আশা করি আপনাদের সাথে অবসরের সময়গুলি ভালই কাটবে।