ওয়াচডগ এর সকল পোস্ট

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ১১

274368

– ব্রেকফাস্ট ইন তেল আভিভ-

অনেকদিন হয়ে গেল পাখিদের ডাকে ঘুম ভাঙ্গে না। তাসমান পাড়ের সিডনির ফ্লাটটা ছিল সাগরের খুব কাছে। ওখানে কান পাতলে হরেক রকম পাখিদের গান শোনা যেত। অবশ্য বেলা গড়ানোর সাথে এনযাক প্যারেডের গাড়ির স্রোত গ্রাস করে নিতো মিহি সুরের কিচির মিচির গান। অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে আসার পর অনেকদিন মিস করেছি বীচের পাশে রোদময় ঝলমলে সকাল গুলো।

বেন ইহাহুদা স্ট্রীটের উপর সেন্ট্রাল হোটেলটার কোন শ্রী ছিলনা। সাদামাটা মোটেলের মত। প্রথম দেখায় আমাদের মগবাজারের কোন হোটেলের সাথে গুলিয়ে ফেললে অন্যায় হবেনা। তবে সব বিচারে ক্লান্ত, শ্রান্ত পরিব্রাজকদের সস্তায় রাত কাটানোর আয়োজন ছিল সন্তোষজনক। অনলাইনে হোটেল খুঁজতে গিয়ে ডাউন টাউনের কাছাকাছি এর চাইতে সস্তা কোন হোটেল খুঁজে পাইনি। তাই হোটেলটার ভালমন্দ নিয়ে অভিযোগ করার কারণ ছিলনা।

সেই হোটেলেই ঘুম ভাঙ্গল পাখিদের ডাকে। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরের দিকে তাকাতে মনটা হাল্কা হয়ে গেল। দুটো কবুতর বসে আছে রেলিংটায়। থেমে থেমে শব্দ করছে। ব্যস্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কাঁচের ওপাশে আমাকে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চুপ হয়ে গেল। হঠাৎ করেই উড়াল দিল। হয়ত ভয় পেয়েছে। কিছুক্ষণ পর নতুন দুজন অতিথি এসে ফিরে গেল পুরানো কাজে।

রাতের ঘুম খুব একটা লম্বা হয়নি। পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি এখনো অন্ধকার। হঠাৎ করেই অংকটা মাথায় এলো যা এয়ারপোর্টে নেমে কষে নিয়েছিলাম। আমার শহরের চাইতে ৯ ঘণ্টা এগিয়ে ইসরাইলের সময়। সে হিসাবে এখন ভোর প্রায় ৪টা। দুয়েকটা গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে বাইরে। রাস্তা পরিষ্কার করার ট্রাকটাকে দেখলাম বেশ সময় নিয়ে পরিষ্কার করছে।

বাইরে তাকালে মনে হবে ঢাকার কোন গলির কার্বন কপি। পাশের জরাজীর্ণ দালানের অনেক জায়গায় পলিস্তরা খসে খসে পরছে। ছাদের উপর পুরানো দিনের এন্টেনা। জানালার পর্দাগুলোও স্যাঁতস্যাঁতে। শুধু বাকি ছিল মসজিদ হতে আজানের ধ্বনি ভেসে আসার।

274343 ভোরের আলো ফুটতেই রাতের খিদাটা মোচড় দিয়ে উঠল। অপেক্ষা করার সময় ছিলনা। নিশ্চয় এতক্ষণে দোকান-পাট খুলে গেছে। হয়ত হোটেল গুলোতে ব্রেকফাস্ট গ্রাহকদের ভিড় জমতে শুরু করেছে। বেরিয়ে পড়ার এটাই ছিল উত্তম সময়। আরও একপ্রস্ত গোসল শেষে পরিষ্কার জামাকাপড় পড়ে লবির দিকে রওয়ানা দিলাম।

আবারও হতাশ হলাম। হোটেলের মুল ফটক তখনো তালা দেয়া। রেসিপশনে কেউ নেই। আনাতোলি স্তেপানভিচকে কোথায় দেখতে পেলাম না। অজান্তেই মুখ হতে অশ্রাব্য একটা গালি বেরিয়ে এলো। লবির কফি মেশিন হতে আবারও এক কাপ কফি নিয়ে ফিরে এলাম রুমে।

ভ্রমণের ক্লান্তি ও পেটে সাহারা মরুর ক্ষুধার কারণে রাতে ব্যাপারটা খেয়াল করিনি। সকালে তা বুঝতে পেরে ভয় পেয়ে গেলাম। ফোন ও ল্যাপটপের চার্জ কমে আসছে। বড়জোর ঘণ্টা-খানেক চলবে। এরপর রি-চার্জ না করলে দুটোই নিস্তেজ হয়ে পড়বে।

সমস্যাটা নতুন নয়। এর আগেও পৃথিবীর অনেক দেশে মুখোমুখি হয়েছি। তবে প্রতিবার তার প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছি। কিন্তু এ যাত্রায় ব্যপারটা একবারের জন্যেও মাথায় আসেনি।

রি-চার্জের জন্যে এডপটার দরকার। এখানকার পাওয়ার কর্ডের সাথে আমেরিকান কর্ডের মিল নেই। কানেকশনের জন্যে চাই এডপটার। দ্রুত এ সমস্যার সমাধান না করা গেলে আমার গোটা সফরটাই অন্ধকারে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল।

৮টার দিকে দ্বিতীয় চেষ্টায় বেরিয়ে পরলাম হোটেল হতে।

তেল আভিভ। যে কোন মানদণ্ডে আধুনিক একটা শহর। চারদিক চকচক করছে সবকিছু। নিয়ন্ত্রিত ট্রাফিক ব্যবস্থাও যে কোন আধুনিক শহরের মত। রুম হতে দেখা পুরানো বাড়িটা মনে হল একটা যাদুঘর। নিজের মত করে দাঁড়িয়ে আছে। অথবা হতে পারে সক্ষম-হীন কোন পরিবার শেষ অবলম্বন হিসাবে আঁকড়ে ধরে রাখছে বাড়িটা। এক কথায় পাশের কোন বাড়ির সাথেই মিল নেই।
সময় গড়ানোর সাথে বাড়ছে মানুষের কোলাহল, গাড়ির মিছিল। জেগে উঠেছে তেল আভিভ।

274444

হোটেলের ঠিক উলটো দিকে বেশকটা রেস্টুরেন্ট চোখে পড়লো। খোলার আয়োজন চলছে কেবল। দরজায় সময় পরখ করতে গিয়ে হতাশ হলাম; ৯টার আগে একটাও খুলবে না।

সময় করে ব্রেকফাস্ট করতে চাইলে আমাকে আরও ঘণ্টা-খানেক সময় ব্যয় করতে হবে কোথাও। সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম নতুন রেস্টুরেন্টের সন্ধানে।

গর্জনটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল। কিছু মানুষের পোশাকও ইঙ্গিত দিচ্ছিল সন্দেহটার। নিশ্চয় সামনে কোথাও সমুদ্র। আপাতত সবকিছু উঠিয়ে রেখে ওদিকটায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। জমে থাকা সময় কাটানোর উপযুক্ত জায়গা! কয়েক ব্লক হাঁটার পর আন্দাজ করে নিলাম কোন দিক হতে বইছে এ বাতাস।

কিছুটা এগুতেই চোখে পরল দৃশ্যটা। সমুদ্র! শহরের রাস্তা গুলো ঢালু হয়ে ওদিকেই যাচ্ছে আমার মত। দুপাশের স্কাই স্ক্র্যাপার গুলো বলে দিচ্ছে জীবন এখানে অনেক দামী। হাতে যথেষ্ট অর্থ না থাকলে এমন এলাকায় বাসকরা সম্ভব নয়। এক কথায় বিত্তবানদের এলাকা।

প্রথম দেখায় তালগোল পাকিয়ে যায় সবকিছু। মগজের সবকটা কলকব্জা একবিন্দুতে এসে স্থির হয়ে যায়। ভূমধ্য সাগরের রাশি রাশি ঢেউ! সাথে নীলাভ আভা। তীরে এসে আছড়ে পরে মিশে যাচ্ছে বালুকা বেলায়। কলোম্বিয়ার সান্তা মার্তায় দেখা ক্যারিবিয়ান সাগরেরই যেন কার্বন কপি। ঢেউ ভারত মহাসাগরের মত উত্তাল না হলেও তাতে আছে এক ধরণের মায়াবী আবহ। সহজে চোখ ফেরানো যায়না।

বীচের কাছাকাছি আসতেই দেখলাম খুব একটা ভিড় নেই। দুয়েকজন বয়স্ক মানুষ তাদের প্রাতঃকালীন জগিং করছে। বিকিনি পরা মহিলারাও জড়ো হচ্ছে। একজন ভারতীয় মহিলাকে একটু অবাক হলাম। দৃষ্টিকটু পোশাক পরে শামিল হওয়ার চেষ্টা করছে মুল কাফেলায়।

২৪ ঘণ্টারও কম সময় এ দেশে। এরই ভেতর একটা উপসংহার টানলে বোধহয় ভুল হবেনা। এ দেশের মেয়েরা বিপদজনক সুন্দরী। কেবল গায়ের রঙ আর চেহারাই নয়, শরীর সঠিক রাখার মাপকাঠিতেও ওরা এগিয়ে। ছেলেদের সৌন্দর্য বিচার করার দায়িত্ব আমার নয়। কিন্তু এদের দিকে তাকালেও মনে হবে ঈশ্বর হয়ত নিজ হাতে তৈরি করেছেন।

বীচের পাশেই দেখা মিলল মাকডোনাল্ডের। পরিচিত দোকানের গন্ধ পেয়ে ওদিকে রওয়ানা দিতে দেরী করলাম না। খোলা থাকলে নাস্তা ওখানেই সেরে নেয়া যাবে ভেবে স্বস্তি পেলাম। কিন্তু হতাশ হলাম। ভেতরে কোন আলো নেই। একেবারেই অন্ধকার। দেখে মনে হল মেরামত চলছে। খাবার যেন অধরা হয়ে গেল তেল আভিভ শহরে।

ঘণ্টা-খানেক সময় কাটিয়ে হোটেলে ফেরার রাস্তা ধরলাম। ওখানের রেস্টুরেন্ট গুলো এতক্ষণে খুলে যাওয়ার কথা। দরদাম অথবা প্রকারভেদ খুঁজে দেখার মত অবস্থা ছিলনা। ঢুকে পরলাম ছিমছাম একটা ক্যাফেতে।

মেনু হিব্রু ভাষায়, তাই বুঝতে অসুবিধা হল। তবে তালিকার পাশে ছবি থাকায় কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারলাম।

সাজগোজে পরিপক্ব সুপার আবেদনময়ী মেয়েটা ভুবন-জুড়ানো হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এদিকটায় এই প্রথম বুঝি?’

আমিও সহজ ভাবে উত্তর দিলাম। ‘একেবারে ব্রান্ড নিউ। চব্বিশ ঘণ্টারও কম।

সময় নিয়ে রান্না করলো। প্লেট যখন টেবিলে রেখে গেল আমার চোখ ছানাবড়া। বিশাল আয়োজন। ছোট একটা বাস্কেটে চার টুকরো পাউরুটি। টমেটো সসে ডুবানো দুটো ডিম ভাজি। শসা ও টমেটোর সালাদ। সাথে অলিভ ওয়েল। এবং ফ্রেশ এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস। তেল আভিভের প্রথম ব্রেকফাস্ট। এক কথায় ইসরায়েলে আমার প্রথম খাবার।

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ১০

27434

পৃথিবীর এ প্রান্তে আমার প্রথম রাত। দ্বিধা, সংশয় আর বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ইসরায়েল নামের দেশটায় সহজে পৌঁছতে পারবো এর কোন নিশ্চয়তা ছিলনা। সংশয় থাকলেও ভয় ছিলনা। সীমান্ত হতে ফিরিয়ে দিলে তেমন কিছু হারানোর ছিলনা আমার।

ইসরায়েল নামের একটা দেশ দেখার আকর্ষণ কি আমাকে এখানটায় টেনে এনেছে! বোধহয় না। তেল আভিভ, হাইফা, রিশহন যিলিওনের মত ইসরায়েলি শহরগুলোতে হয়ত আর দশটা শহরের মত জীবন আছ।, তবে সে জীবন আমার মত গোবেচারা টাইপের একজন টুরিস্টকে টানার জন্যে যথেষ্ট মনে হয়নি। আমি এসেছি আসলে প্যালেষ্টাইনিদের দেখতে। পশ্চিমা অর্থ ও পেশী শক্তির কাছে পরাজিত একটা জাতির জীবনকে কাছ হতে দেখার আগ্রহ নিয়েই এখানে আসা।

রাত গড়াচ্ছিল। টিক টক শব্দে ভ্রমণের ঘড়ি কখন মধ্যরাত পাড়ি দিয়েছে টের পাইনি। গরম পানিতে লম্বা একটা গোসল দিয়ে শরীর মন হতে ঝেড়ে ফেললাম ভ্রমণের ক্লান্তি। ধবধবে সাদা বিছানাটাকে এ মুহূর্তে দেখাচ্ছিল লাস্যময়ী নারীর তুলতুলে শরীরের মত।

না, ঘুমের কাছে নিজকে সপে দেয়ার সময় না এটা। পেটের ক্ষুধা ক্যান্সারের মত চেপে বসেছে গোটা শরীরে। মগজ প্রায় বিকল। যেকোনো মূল্যে কিছু একটা দিতে হবে পেটে। পোশাক পালটে রওয়ানা দিলাম লবির দিকে।

আনাতোলি স্তেপানভিচকে দেখে একটু অবাক হলাম। রাত অনেক হয়েছে অথচ ছোট টেবিলটায় বসে হাবিজাবি কি যেন লিখছে। আমাকে দেখে রাজ্যের বিরক্তির নিয়ে চোখ তুললেন।

কোন ভণিতা না করে জানতে চাইলাম হোটেলের ক্যান্টিন হতে খাওয়ার মত কিছু পাওয়া যাবে কিনা। রাত হয়ে গেছে, এসময় ক্যান্টিন খোলা থাকার কথা না। তাই অনুরোধের ভাষায় বিনয়ের কোন অভাব রাখলাম না।

2743

হোটেলের কোন ক্যান্টিন নেই, ভাবলেশহীন আনাতোলির চেহারায় সামান্যতম বিনয় ছিলনা। আমিও নাছোড় বান্দা। পেটে কিছু দিতেই হবে, তা না করলে সারারাত জাগতে হবে। বুঝিয়ে বলতে কিছুটা নরম হল হোস্টের চেহারা। হাতে একটা চাবি ধরিয়ে অনুরোধ করল ফেরার সময় যেন শব্দ না করি। সিঁড়ির বাতি মূল সুইচ হতে বন্ধ থাকবে, তাই এ নিয়েও যেন হৈচৈ না করি তা মনে করিয়ে দিলেন।

মধ্যরাতের তেল আভিভ! হোটেলের মূল দরজা খুলে রাস্তায় পা রাখতে ঠাণ্ডা বাতাস চোখে মুখে প্রশান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিল। বেন ইয়াহুদা স্ট্রীট একেবারেই ফাঁকা। মাঝে মধ্যে দ্রুত গতির দুয়েকটা গাড়ি মনে করিয়ে দিচ্ছিল এ শহরেও জীবন আছে। ট্রাফিক বাতিগুলো পালা করে লাল সবুজ বাতির আভা ছড়াচ্ছে।

আমি হাঁটছি আর হন্যে হয়ে সন্ধান করছি মুখে দেয়ার মত খাবারের। আগেই লক্ষ্য করেছি পুলিশের গাড়িটা আমাকে ফলো করছে। তিনবার চক্কর দেয়ার পর ব্রেক কষলো আমার পাশে। কোন সমস্যায় আছি কিনা জানতে চাইলো। সংক্ষেপে তুলে ধরলাম মধ্যরাতে তেল আভিভের রাস্তায় পদচারণার পটভূমি। দুই ব্লক দূরে একটা নাইট ক্লাবের দিকে ইঙ্গিত করে জানাল ওখনাটায় কিছু একটা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

চারদিকে পিনপতন নীরবতা। সমুদ্রের গর্জন ভেসে আসছে থেমে থেমে। নিশ্চয় ভূমধ্য সাগর খুব একটা দূরে না। বেশকিছুটা দূর হতেই বুঝা যাচ্ছে নাইট ক্লাব বন্ধ হতে চলছে। কাছাকাছি আসতে ফটকের বাউন্সার জানালো তাদের ফুড অপশন ১২টার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। কাউন্টারে হাল্কা কিছু স্ন্যাক্সের ব্যবস্থা থাকলেও এ মুহূর্তে সেটাও বন্ধ। বাড়তি কোন ঝামেলা এড়াতে আমাকে হোটেলে ফিরে যাওয়ার উপদেশ দিল।

মগবাজার মোড়ের হোটেলগুলো কি এখনো খোলা আছে? হিসাব করলে ঢাকায় নিশ্চয় এখন সকাল। হোটেলগুলোর জীবন শুরু হতে যাচ্ছে কেবল। এ মুহূর্তে গরম দুটো পারোটা আর খাসির পায়ার বিনিময়ে ইসরায়েল সফর বিকিয়ে দিতেও দ্বিধা করতাম না। বসবাসের অযোগ্য তালিকার শীর্ষে থাকা ঢাকাকেই মনে হল পৃথিবীর সবচাইতে খাদ্য-বান্ধব শহর!

আমি আসলেই ক্ষুধার্ত। তেল আভিভে এ মুহূর্তে পেটে দেয়ার মত কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই হোটেলে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। লবিতে কফি মেশিন চালু আছে। ওখান হতে বড় এক কাপ কফি নিয়ে রুমে ফিরে রাত জাগার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আনাতোলির উপদেশ মেনে বেড়ালের মত নিঃশব্দে ফিরে গেলাম নিজ রুমে।

আজ আর ঘুম আসবেনা। হঠাৎ করেই মনে হল এ শহরে করার মত কিছু নেই আমার। দেখার তেমন কিছু থাকলেও আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। সকালে আরও এক প্রস্ত গোসল দিয়ে নাস্তা শেষ করে জেরুজালেমের দিকে রওয়ানা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

– চলবে।

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৯

27392

বেন গুরিয়ন এয়ারপোর্ট হতে তেল আভিভ শহর ২০ কিলোমিটার পথ। অবেলায় ট্যাক্সি ক্যাব ছাড়া দ্বিতীয় কোন মাধ্যম নেই ওখানে যাওয়ার। টুরিস্ট ব্যুরোর বুথ হতে যাবতীয় তথ্য নিয়ে রওয়ানা দিলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে। গড়পড়তা সময় ও ভাড়া সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়ায় ক্যাবিদের হাতে হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনাটা দূর হয়ে গেল।

ট্যাক্সি ক্যাবের লাইন অনেক সময় একটা দেশের আয়না হিসাবে কাজ করে। ট্যুরিজমের প্রতি একটা দেশ অথবা জাতির কমিটমেন্টের পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া যায় লাইনের স্বচ্ছতা ও ড্রাইভারদের আচার ব্যবহারে।

ঢাকা এয়ারপোর্টের কথা মাথায় রেখেও যদি অন্য কোন এয়ারপোর্টের কথা মনে করতে চাই প্রথম আসবে সোভিয়েত কালে মস্কোর শেরমেতেয়াভা এয়ারপোর্ট। ওখানে সরকারী ট্যাক্সি লাইনের ছায়ার নীচেই বাস করতো একদল প্রতারক। যাত্রীদের সস্তা ভাড়ার লোভ দেখিয়ে অচেনা কোন গন্তব্যে নিয়ে সর্বস্ব কেড়ে নেয়া ছিল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। না জেনে ওসব ফাঁদে পা দিয়ে অনেকেই চরম মাশুল গুনতে বাধ্য হত সে সময়।

ভেতরে যাত্রীদের ভিড় থাকলেও ট্যাক্সি লাইনে তেমন ভিড় ছিলনা। মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর ডিসপাচার আমাকে খালি একটা ট্যাক্সি ধরার ইশারা দিল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষার পর ড্রাইভার বেরিয়ে এসে শুভেচ্ছা বিনিময় করল। বড় লাগেজটা নিজ হাতে ট্রাংকে উঠিয়ে আমাকে ভেতরে আসার আহবান জানাল।

প্রথম দর্শনেই বুঝে নিলাম ড্রাইভারের জাতিগত পরিচয়। রুশ!
কেবল চেহারায় না, গোটা শরীরে একধরনের ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘনের ছাপ। চোখে মুখে রুক্ষতার ছোঁয়া, মুখের ভাষাও তরবারির মত ধারালো ও কর্কশ।

আমার মুখে খাঁটি উচ্চারণের রুশ ভাষা শুনে একটু ভড়কে গেল। প্রথমে মনে করেছিল আমি তাদেরই একজন এবং এদেশেরই স্থায়ী বাসিন্দা। ভুলটা ধরিয়ে দেওয়ার সাথে সদর্পে ফিরে গেল রুশ চেহারায়। পরিচয়ের দুই মিনিটের মাথায় তুই তোকারির সাথে আলাপচারিতায় অশ্লীল রুশ শব্দ ব্যবহারের বন্যা বইয়ে দিল।

নিজের জন্যে এ ছিল মারাত্মক সাবধান বাণী। আমার জানা ছিল ইসরায়েলি নাগরিকদের একটা বিরাট অংশের আদিবাস সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য। রুশ এখানে খুবই প্রচলিত ভাষা। কথায় কথায় অপরিচিত কারও কাছে নিজের রুশ কানেকশন উন্মোচন না করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম।

আর দশটা পশ্চিমা শহরের মতই এয়ারপোর্ট হতে তেল আভিভ যাওয়ার রাস্তা। দ্রুত গতির রাস্তাটায় কোন ট্রাফিক লাইট নেই। অনেকটাই মার্কিন ফ্রীওয়ে গুলোর মত। ২০ কিলোমিটার পথ হলেও গতির সীমাবদ্ধতার কারণে সময় লেগে গেল।

ঝাঁপিয়ে রাত নেমে গেছে তেল আভিভে। ট্যাক্সি ক্যাবের ঘড়িটায় রাত প্রায় ৯টার মত। হাতের ঘড়িটায় ইসরায়েলি সময় সেট করে নতুন আরও একটা দেশে পা রাখার মানসিক প্রস্তুতি নিলাম।

রাত মাত্র ৯টা। অথচ তেল আভিভ অনেকটাই নীরব। চারদিকে এক ধরণের ভৌতিক নীরবতা। হঠাৎ দেখায় মনে হবে ব্যস্ত একটা দিনের পর ক্লান্ত অবসন্ন মানুষ সকাল সকাল বিছানায় চলে গেছে। রাস্তার দুপাশের স্কাই স্ক্রাপারগুলোতেও কোন বৈচিত্র্য নেই। মূর্তিমান আতংকের মত নিজেদের অবস্থান জানান দিলেও তাতে নেই প্রাণের স্পন্দন। পার্থক্য কেবল শহরের বিলবোর্ড গুলো। চারদিকে হিব্রু ভাষার ছড়াছড়ি। ইংরেজির দাপটও চোখে পড়ার মত। তবে আরবি একবারেই অবহেলিত। হতে পারে কল্পনায় আমি তেল আভিভে সদ্য ফেলে আসা সান ফ্রান্সিসকোর মত ঝলমলে আলো আর মধ্যরাতের বাঁধভাঙ্গা যৌবন দেখতে চেয়েছিলাম। তাই প্রথম দেখায় কিছুটা হলেও হতাশ হলাম।

27398

দশটার উপর বেজে গেল বেন ইয়াহুদা স্ট্রীটের উপর সেন্ট্রাল হোটেলটায় পৌঁছতে। রুম আগেই বুক করা ছিল। তাই চেক-ইন ঝামেলায় অতিরিক্ত সময় বায় করার তাগাদা ছিলনা।

টিপস সহ ১৮০ সেকেল (ইউএস ডলারে ৫৬ ডলার) ট্যাক্সি ভাড়া চুকিয়ে হোটেল ফটকে আসতে হতাশ হলাম। তালা ঝুলছে মূল ফটকে। সামনের সবকটা বাতি নেভানো। ভেতরটাও অন্ধকার।

আমার জন্যে দেশটা একেবারেই নতুন। রীতিনীতি দূরে থাক দেশটার সাধারণ মানুষগুলো সম্পর্কেও তেমন ধারণা নেই। ইসরায়েল বলতে এতদিন জেনে এসেছি বেনইয়ামিন নেতনিয়াহু, এরিয়াল শ্যারণ আর ইয়াহুদ বারাকের মত রাজনীতিবিদদের। তাই রাত ১০টার পর হোটেলের ঘুমন্ত মানুষগুলোকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকার কোন পথ বের করতে পারলাম না। হাতের সুটকেস মাটিতে ফেলে অনেকক্ষণ ঠায় বসে রইলাম।

রাত গড়াচ্ছিল। যেকোনো ভাবে ভেতরে যাওয়ার তাগাদাটা অজগর সাপের মত তেড়ে ফুরে উঠছিল। আমি বুকিং দিয়েই এ হোটেলে এসেছি এবং আমার আগমনের সময়ও ওদের ইমেইল করে জানিয়েছি। ইউরোপ আমেরিকার কোন হোটেল হলে ওরা দরজা খুলে আমার অপেক্ষায় থাকত। সৌজন্য বোধ বিদায় নিয়ে এবার ক্রোধ চপে বসল মগজে। আঙ্গুলের সব শক্তি এক করে কলিং বেলে টিপ দিলাম।

বেশ ক’বার টিপলাম। কারও কোন সাড়া শব্দ নেই। হোটেলের কোন লবি আছে বলেও মনে হলোনা। ভেতরে একধরণের ভয় দানা বাধতে শুরু করল। কি হবে যদি আদৌ কেউ দরজা না খোলে!
লোহার গেইট ধরে সজোরে ধাক্কা দেয়া শুরু করলাম।
খুট করে একটা আওয়াজ হল। দূরের সিঁড়িতে একটা অনুজ্জ্বল আলোর রেখা ফুটে উঠল। সাথে হালকা পায়ে সিঁড়ি ভাঙ্গার শব্দ। কেউ একজন এগিয়ে আসছে।

পরিচয় না দিলেও যা বুঝার তা আমি বুঝে নিলাম। রুশ ভাষায় অশ্লীল একটা গালি দিয়ে চেইন লাগানো তালাটা খুলতে শুরু করল। এ যাত্রায় ভাষা ব্যবহারে সতর্ক হয়ে গেলাম। আমি একজন আমেরিকান এবং সামনের লোকটা আমার ট্যাক্সের পয়সায় লালিতদের একজন, ভাবনটা সামনে আনতে সবকিছু সহজ হয়ে গেলাে।

এবার কর্কশ ভাষায় জানতে চাইলাম আমার বুকিং সম্পর্কে ধারণা থাকলে দরজা খুলতে এত দেরী হচ্ছিল কেন! রুশ অরিজিন মানুষদের ভোকাবুলারিতে ক্ষমা বলতে কোন শব্দ নেই, হোক তা ইহুদি, তাতার অথবা আজেরি। তাই আমার হোটেল গাইডের মুখ হতে এমন কোন শব্দ আশা করলাম না।

কাউন্টারে তার ভাইয়ের থাকার কথা এ সময়ে, এমন একটা তথ্য দিয়ে এড়িয়ে গেল আমার প্রশ্ন। আসলে কাউন্টার বলতে তেমন কিছু নেই হোটেলে। সিঁড়ির কোনায় একটা টেবিল, পাশে একটা কফি মেশিন ও ছোট মত একটা বক্সে কিছু ব্রসিউর, এসব নিয়েই হোটেলের রিসিপশন। সস্তা হোটেল খোঁজার মূল্যটা বোধহয় একটু বেশিই হয়ে গেল, চিন্তাটা মাথায় আসতে আরও সাবধান হওয়ার তাগাদা অনুভব করলাম।

নিজকে আনাতোলি স্তেপানভিচ হিসাবে পরিচয় দিল। এটা নাকি তাদের পারিবারিক ব্যবসা। দুই ভাই পালা করে দায়িত্ব পালন করে থাকে। সাধারণত রাত ১০টার পর এদিকটায় নাকি কেউ আসেনা, তাই চোখ কান খোলা রাখে না মূল ফটকের দিকে। হাতে একটা টর্চ-লাইট নিয়ে দুজনে দোতলার সিঁড়ি ভাঙ্গতে শুরু করলাম। বাকি বোর্ডারদের সবাই ঘুমাচ্ছে তাই করিডোরের বাতি জ্বালানো আনাতোলির কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হলোনা। তর্ক করার ইচ্ছা ছিলনা, তাই সবকিছু নীরবে হজম করতে বাধ্য হলাম।

রুমের অবস্থাও অনেকটা আনাতোলির মত। কোথাও কোন চাকচিক্য নেই। রাত কাটানোর জন্যে নূন্যতম যা দরকার তার বাইরে কিছু নেই। অনলাইনে বুকিং দেয়ার সময় এমন কিছু ঘটবে তার কিছুটা হলেও আন্দাজ ছিল। কারণ একটু ভাল হোটেলের ভাড়া ছিল এ হোটেলের চাইতে দুই তিন গুন বেশী।

হোটেলের কোয়ালিটি নিয়ে আমার তেমন কোন মাথা ব্যথা কোন কালেই ছিলনা। কোলকাতার সদর রোডের সস্তা হোটেলের খাটিয়া অথবা বলিভিয়ার রাজধানী লা পাসের শ্রীহীন হোস্টেলের লোহার বেড, কোন কিছুতে সমস্যা দেখিনি। দিনশেষে মাথা গোজার একটা ঠিকানাই যথেষ্ট ছিল।

চলবে।

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৮

27364a তেল আভিভ বেন গুরিয়ন এয়ারপোর্ট। হিব্রু এক্রোনেম ন্যাটবাগ। পৃথিবীর আর দশটা উন্নত দেশের মত গুছালো ও পরিচ্ছন্ন একটা এয়ারপোর্ট। প্রথমে দেখায় ভাল না লেগে উপায় নেই। নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টের মত ব্যস্ত না হলেও সামগ্রিক ব্যস্ততা চোখে পরার মত। পৃথিবীর সব প্রান্ত হতে বিমান নামছে। দলবেঁধে টুরিস্টরা আসছে। ধার্মিকদের সংখ্যাও কম না। গায়ের পোশাক দিয়ে অনেককে আলাদা করা যাচ্ছে।

অজানা আশংকাটা আবারও ফিরে এলো। আদৌ কি ঢুকতে পারবো দেশটায়! ধর্মীয় সমস্যায় জর্জরিত একটা দেশে ধর্মীয় পরিচয় অন্য যে কোন পরিচয়ের ঊর্ধ্বে। কাগজে কলমে আমি একজন মুসলমান। এবং ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলে একজন সন্দেহজনক ব্যক্তি। অবশ্য সন্দেহ করার মত তেমন কিছু ছিলনা আমার চেহারা সুরতে অথবা সাথে আনা তল্পিতল্পায়।

আমি একজন পরিব্রাজক। পৃথিবীর দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই, বন্দরে বন্দরে নোঙ্গর ফেলি। এ পর্যন্ত বৈধ ভিসা থাকাবস্থায় কোন দেশ আমাকে তার সীমান্ত হতে ফিরিয়ে দেয়নি। বরং একজন সুস্থ স্বাভাবিক পরিব্রাজক হিসাবে স্বাগত জানিয়েছে। বিনিময়ে আমিও এমন কোন কাজ করিনি যা আমার পরিচয়ে কালিমা আটতে পারে।

ফ্লাইট হতে বেরিয়ে লাগেজ কারুসেলে যাওয়ার পথেই সিদ্ধান্তটা নিলাম, ঢুকতে না দিলে পাশের দেশ মিশরে চলে যাব। ওখানেও অনেক কিছু দেখার আছে। হয়ত নষ্ট হবে পকেটের কিছু পয়সা। তা নিয়ে ভাবতে চাইলাম না।

273630b

একজন মার্কিন নাগরিককে ইসরায়েল তার সীমান্ত হতে বিনা-কারণে ফিরিয়ে দেবে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। ইসরায়েল নামের দেশটার অস্তিত্বের প্রতি অঙ্গে মিশে আছে আমার মত মার্কিনিদের ট্যাক্সের পয়সা। এ নিয়ে টালবাহানা করার কোন অধিকার নেই ইসরায়েলিদের। ধারণাটা মগজে স্থায়ী করার চেষ্টা করলাম। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে নিজকে এখন হতে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে ভাবার চেষ্টা করবো। কোথাও কেউ সমস্যা তৈরির চেষ্টা করলে সরাসরি যোগাযোগ করবো জেরুজালেমের মার্কিন দূতাবাসে।

ট্রলিতে সুটকেস, হাতব্যাগ আর ল্যাপটপ উঠিয়ে রওয়ানা দিলাম ইমিগ্রেশনের দিকে। পাশের সীটের যাত্রী সারাহ এসে ইসরাইল’এ সাদর অভ্যর্থনা জানালো। কোন ধরণের সাহায্যের প্রয়োজন হলে জানাতে অনুরোধ করল। আমিও ধন্যবাদ জানিয়ে উত্তর দিলাম অজানা অচেনা দেশের ভাল-মন্দ আমি নিজের মত করে উপভোগ করতে চাই। দুজন দুদিকের লাইনে দাঁড়িয়ে ইতি টানলাম পরিচয় পর্ব। মেয়েটা ইসরায়েলি নাগরিক, তাদের জন্যে আলাদা লাইন।

সিরিয়াল আসতে ছোট একটা বুথে বসা ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে ইশারা দিল। হাতে পাসপোর্ট নিয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেলাম। বিনয়ের সাথে কুশল বিনিময় করার চেষ্টা করলাম। কাজ হলোনা। ইমিগ্রেশন অফিসারদের জাতটাই এরকম। ওরা সহজে স্বাভাবিক হয়না। যখন তখন হাসেনা। কিছুক্ষণ ঠায় হয়ে তাকিয়ে থাকে চেহারার দিকে। যা বুঝার তা বুঝে পেলে খটাস করে একটা সীল মারে।

– তুমি কি কোন গ্রুপের সাথে ট্রাভেল করছ?
– না, আমি কোন গ্রুপের সাথে নেই। একা এসেছি
– এর আগে কোনদিন এসেছ ইসরায়েলে?
– না, এই প্রথম
– কতদিনের জন্যে এসেছ?
– বেশি হলে দুই সপ্তাহ

পাঁচ মিনিটের বেশী স্থায়ী হলোনা আমাদের কথাবার্তা। হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে স্মরণ করিয়ে দিল কাগজটা যেন না হারাই। কারণ ওটাই দেশটায় ঢুকার ভিসা। যে হোটেলে থাকতে চাচ্ছি ওরাও দেখতে চাইবে কাগজটা। ফেরার পথে ইমিগ্রেশনও দেখতে চাইবে ইস্যু করা ভিসা।

ইসরায়েল ঘুরে দেখার তিন মাসের ভিসা আমার হাতে। প্লান বলতে যা ছিল তা বাস্তবায়নের কোন অসুবিধা রইলো না।

কাস্টমসের গ্রিন চ্যানেল ধরে বেরিয়ে গেলাম কোন প্রশ্ন ছাড়াই। কেউ ফিরেও তাকালও না আমার দিকে। ভিতরে জমে থাকা সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিমিষে উবে গেল।

টার্মিনাল গেটের সামনে এসে আবারও দেখা পেলাম সারার। সেও বুঝে নিয়েছে আমার কোন অসুবিধা হয়নি। ফোনটা তার হাতে ধরিয়ে দু’একটা ছবি তুলে দেয়ার অনুরোধ করলাম। সমস্ত মুখ বিস্মৃত করে একটা হাসি দিল। ইসরায়েল নামের দেশটায় তোলা প্রথম ছবি সারার হাত ধরেই জন্ম নিলো।

এয়ারপোর্টের ভেতরের আলোর সাথে বাইরের আলোর কনট্রাস্টটা ছিল চোখে পরার মত। খুবই অল্প ও অনুজ্জ্বল। দেখতে অনেকটা ৭১সালে দেখা দাদাবাড়ি যাওয়ার মদনগঞ্জ লাইনে মোল্লারচর ষ্টেশনটার কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে বাস্তবে এতটা বিবর্ণ ছিলনা। ভেতরের আলোর ঝলকানিতে চোখ ঝলসে যায়, বাইরে এলে তা নিঝুম কোন দ্বীপের মত দেখায়।

2735631c
– চলবে।

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৭

27341

আকাশ পথে লম্বা জার্নির এই এক অসুবিধা। এক সময় মনে হবে এ পথ কোন দিন শেষ হওয়ার নয়। চলছি তো চলছিই। ব্রেকফাস্টের পর লাঞ্চ আসে, লাঞ্চের পর ডিনার, মাঝখানে চা-কফি পর্ব। দিন গড়িয়ে রাত নামে। সময়ের হেরফেরে সে রাত শেষ হতেও সময় লাগে না।

ফ্লাইট হোস্টেসদের এলোপাথাড়ি চলাফেরা, কিছু কিছু যাত্রীদের কারণে অকারণে হোস্টেসদের বিরক্ত করা, সর্বোপরি ফ্লাইট ফ্লোরে জমতে থাকা আবর্জনার স্তূপ একসময় মগজে স্থায়ী জায়গা করে নেয়। মনে হয় এসব দৃশ্য আমি অনন্তকাল ধরে দেখছি। সহযাত্রীদেরও মনে হয় কতকালের চেনা।

ইন-ফ্লাইট মুভি দেখায় মনোযোগ দিতে পারছিলাম না কাছের সীট হতে ভেসে আসা ম্যারাথন কান্নার কারণে। বয়স হয়ত ১ মাসও হয়নি, এমন একটা শিশুকে নিয়ে আকাশ জার্নি করার কোন জাস্টিফিকেশন খুঁজে পেলাম না। বিশেষকরে জার্নি কাফেলায় যখন অপ্রাপ্তবয়স্ক একাধিক শিশু থাকে।

কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম টের পাইনি। পাশের সীটের মেয়েটা এক মিনিটের জন্যেও বইয়ের পাতা হতে চোখ সরায়নি। মাঝখানের সীটটা খালি, শরীর আলগা করে হেলান দিয়ে বসতে ঝিমুনি এসে গেল। কখন চোখ বুজে ঘুমাতে শুরু করেছি বুঝতে পারিনি। বাইরে দিন কি রাত সেটা বুঝারও উপায় ছিলনা। জানালার উপর পর্দা এঁটে গভীর রাত মেইনটেইন করছিল ফ্লাইট হোস্টেসরা।

যাত্রীদের চঞ্চলতাই বলে দিচ্ছিল আমরা খুব একটা দূরে নেই। শেষবারের মত খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পরলো হোস্টেসরা। দুদিকের বাথরুমে লম্বা লাইন ধরে ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করছে যাত্রীরা। জানালার ঢাকনা সরিয়ে বাইরে তাকাতে নিকস কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। মনিটর ম্যাপে চোখ ফেরাতে ধারণা পেলাম আমাদের বর্তমান অবস্থান। আরও প্রায় ২ ঘণ্টার পথ।

তারিখ ও দিনের কোন হদিস ছিলনা। হাতের ঘড়িও সময় দেখাচ্ছিল আমেরিকার মাউন্টেন জোনের সময়। এবার আমি নিজেই অনুরোধ করলাম জানালার পাশের সীটটার জন্যে। সহযাত্রী সানন্দে ছেড়ে দিল তার নিজের সীট।

জানালার বাইরে রাতের আকাশ। নিকষ কালো অন্ধকার। এদিক সেদিক দুয়েকটা তারা মিটমিট করছে। নীচের দিকে তাকাতে নিশ্চিত হয়ে গেলাম ল্যান্ড করতে যাচ্ছি আমরা।

রাত নেমে এসেছে পৃথিবীর এ প্রান্তে। স্বরলিপি-হীন এক ধরণের আবেগ এসে মগজে চেপে বসল। যে দেশটার জন্যে সারা জীবন ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই লালন করিনি সেখানেই নামতে যাচ্ছি। জীবন কি জিনিস বুঝে উঠার অনেক আগ হতে বুঝতে শিখেছি একটা জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখে শোষণ করছে আরেকটা জাতি। এখানে জন্ম নিয়ে একটা শিশু উত্তরাধিকার সূত্রে পায় উদ্বাস্তুর তকমা। নিজ গৃহে ওরা পরবাসী। স্বপ্ন-হীন একটা জাতি তিল তিল করে বেড়ে উঠে প্রতিরোধ আর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে পুড়ে তামা হয়ে।

আকাশ হতে বুঝার উপায় ছিলনা কোনটা ইসরায়েল আর কোনটা তাদের দখলে থাকা পশ্চিম তীরের প্যালেস্টাইন। আলোর ঝলকানি যাচাই বাছাই করলে হয়ত আন্দাজ করা যেত প্যালেস্টাইনের সীমানা। ওখানে জীবন থাকলেও নেই জীবনের ছন্দ। তাই আলোর ঝলকানি ওখানে প্রত্যাশিত ছিলনা।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের ঠিক মাঝখান হতে।

চলবে।

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৬

27292

যাত্রীর মিছিল শেষ হতে লম্বা সময় লেগে গেল। অনেকে একাধিক হ্যান্ড লাগেজ ও শিশু নিয়ে প্রবেশ করায় তাদের বসাতে যথেষ্ট সময় ব্যায় করতে হল এয়ার হোষ্টেসদের। আমার দু লাইন সামনে ছোট দুই বাচ্চা নিয়ে এক ইসরায়েলি পরিবার বসায় রাতের ঘুম কেমন হতে পারে কিছুটা আন্দাজ করে নিলাম।

সামনে পেছনে যতদূর তাকালাম কোথাও খালি কোন সীটের দেখা পেলাম না। মনে মনে কিছুটা হতাশ হলাম। খালি কোন সীট পেলে ওখানে ঘুমের আয়োজন করতে পারতাম। অতীতে অনেক ফ্লাইটে এ সুবিধা নিয়েছি। আমার চার সীটের লাইনটা তখনও খালি। মনে মনে দোয়া করলাম অন্তত একটা সীট যেন খালি যায়।

একদম শেষমুহূর্তে একজন এসে জানান দিল জানালার পাশের সীটটা তার। ২০-২৫ বছর বয়সী অনিত্য সুন্দরী এক ইহুদি মেয়ে। চমৎকার একটা হাসি দিয়ে গুছিয়ে নিলো নিজের সীট। কোন ভণিতা না করে নিজের পরিচয় দিল। সারাহ, জন্মগত ইসরায়েলি। সান ফ্রানসিস্কোর কোন এক ইউনিভার্সিটির সোশ্যাল সায়েন্সের ছাত্রী। ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে। জন্ম হাইফা শহরে হলেও তার মা-বাবা এখন তেল আভিভের বাসিন্দা। ওখানেই যাচ্ছে।

নিজেকে একজন টেলিকম প্রকৌশলী হিসাবে পরিচয় দিতে খুশি হয়ে জানালো তার এক ভাইও এই লাইনের প্রকৌশলী। ইসরায়েল প্রথম যাচ্ছি জানতে পেরে আমাকে জানালার পাশের সীটে বসার আহবান জানালো। ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের অস্বীকৃতি জানালাম। লম্বা জার্নিতে আমি আইলসের সীটে বসতেই পছন্দ করি। তাতে মধ্যরাতে বাথরুম চাপলে আসা-যাওয়ায় অনেক সুবিধা। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম গোটা ফ্লাইটের দুটা সীটই কেবল ফাঁকা। এবং তা আমাদের সারিতে।*

ফ্লাইটের ঝামেলা শেষ করে আকাশে উঠতে উঠতে রাত প্রায় ১২টা বেজে গেল। ততক্ষণে নিকষ কালো অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে বাইরের আকাশ। ইউনাইটেডের সুপরিসর বিমান রানওয়ে ছেড়ে আকাশে ডানা মেলতে কোন ঝামেলা হয়নি।

উড্ডয়নের মুহূর্তটা যেকোনো আকাশ জার্নির উৎকণ্ঠার সময়। ফ্লাইট ইতিহাসে যতো দুর্ঘটনা তার অধিকাংশই ঘটে হয় উঠা অথবা ল্যান্ড করার সময়। তাই আশংকা উৎকণ্ঠা ক্ষণিকের জন্যে হলেও মগজ চেপে ধরে। অতিরিক্ত ধাক্কা ধাক্কি ভয় ধরিয়ে দেয়। এ সময় কেবিন ক্রুরাও নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সব সংশয় সব ভয় নিমিষে উবে যায় যখন বিমান তার প্রয়োজনীয় উচ্চতায় পৌঁছে সোজা হয়ে চলতে শুরু করে।
এ যাত্রায়ও কোন ব্যতিক্রম হলোনা।

চারদিকে যাত্রীদের কোলাহল। হিব্রু ও আরবি ভাষায় নিচু স্বরে কথা বলছে সবাই। খুব কাছে বাচ্চাদের কেউ বিরামহীনভাবে কাঁদছে। মা চেষ্টা করছে সন্তানকে সান্ত্বনা দিতে। কথা বলছে আরবি ভাষায়। ভাষা বুঝা না গেলেও মা ও সন্তানের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হলোনা। কারণ এ ভাষা চিরন্তন।

প্রচণ্ড খিদায় পেট চো চো করছিল। এয়ারপোর্ট লাউঞ্জে খাওয়া ম্যাকডোনাল্ডের বিগ ম্যাক ততক্ষণে হজম হয়ে গেছে। লম্বা জার্নি, তাই খাবার যাই হোক খেতেই হবে। অরুচি এখানে অপশন না। পরের খাবার কখন আসবে তারও কোন ঠিক নেই। কারণ বাইরে এখন রাত হলেও দূরত্ব অতিক্রম করার সাথে সময় বদলে যাবে। জীবন হতে হয়ত নীরবেই খসে যাবে একটা রাত অথবা দিন।

এক কাপ কফি দিয়ে শেষ হল ডিনার। প্রয়োজনের চাইতে একটু বেশিই খেলাম। সহযাত্রী সারাহ’র আহারে আছে অনেক রকম বিধিনিষেধ। তাই তার মেনুর বেশকিছু আইটেম জোর করে ধরিয়ে দিল আমার হাতে। ঘণ্টা দুয়েকের ভেতর গোটা কেবিন জুড়ে নেমে এলো পিনপতন নীরবতা। ফ্লাইটের মূল বাতি ততক্ষণে নিভে গেছে। কান্নারত শিশুর শেষ চীৎকারও মিহি হয়ে এসেছে। এবার ঘুমের পালা।

পার্সোনালাইড মনিটরে মুভি দেখার আয়োজন শেষ করে আমিও কম্বলের নীচে মুখ লুকালাম। এত সহজে ঘুম আসবেনা আমার। তাছাড়া এভাবে বসে ঘুমানোর সাথে আমার বৈরিতা অনেকদিনের।

হরেক রকম ভাষায় শতাধিক মুভি সেভ করা আছে ফ্লাইট নেটওয়ার্কে। রাতের জন্যে সংক্ষিপ্ত একটা তালিকা তৈরি করে নিলাম। এক চ্যানেলে ফ্লাইটের মতিগতি মনিটর করার ব্যবস্থা আছে। কানাডার নিউ ফাউন্ডল্যান্ড হয়ে নর্থ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পশ্চিম ইউরোপের স্পেনের উপর দিয়ে উড়ে যাবে আমাদের ফ্লাইট। ঘণ্টার হিসাবে প্রায় ১৬ ঘণ্টা বসে থাকতে হবে এখানটায়।

চলবে

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৫

27299

সান ফ্রানসিসকো। অদ্ভুত সুন্দর একটা শহর। ঘন কুয়াশা, মৃদু শীতের বসন্ত, গোল্ডেন গেইট ব্রিজ আর নটরিয়াস আলকাট্রাস জেলখানার এই শহরে বছর-জুড়ে লেগে থাকে টুরিস্টদের ভিড়। গোটা শহরের একটা স্ন্যাপ শট পেতে উঁচু হতে দেখার কোন বিকল্প নেই। ক্ষণিকের জন্যে হলেও থমকে যেতে হয়। প্রকৃতি ও মানুষের আজন্ম ভালবাসার এই শহরকে প্রথম দেখায় ভাল না লেগে উপায় নেই। ল্যান্ড করতে চাইলে সব ফ্লাইটকেই সানফ্রানসিসকো বে’র খুব নিচু দিয়ে উড়ে যেতে হয়।

ভাল লাগার এসব খণ্ড খণ্ড মুহূর্তগুলোর সবটা ক্যামেরায় ধরা যায়না, বরং হ্রদয় খুলে উজাড় করে নিতে হয়। এবং এ ধরে রাখা ক্ষণিকের জন্য নয়, বেঁচে থাকার বাকি দিনগুলোর জন্যে। উপরে পরিষ্কার নীল আকাশ, নীচে বে’র পানিতে মৃদু-মন্দ ঢেউ; সবমিলিয়ে উপভোগ করার মত একটা বিকেল।

272831

সূর্য পরে আসছিল। নির্ধারিত সময়ের একমিনিট হেরফের না করে ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট আলতো করে ছুঁয়ে ফেললো সান ফ্রানসিস্কোর মাটি।

তেল আভিভের কানেন্টিং ফ্লাইট রাত ১১টায়। নষ্ট করার মত হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। ভাবছিলাম এদিক ওদিক ঘুরে তারপরই কেবল চেক-ইন করবো।

27291

অতীত অভিজ্ঞতার শিক্ষা, এয়ারপোর্টের সময়কে বিশ্বাস করতে নেই। নিমিষেই বদলে যেতে পারে সবকিছু। তার উপর ইমিগ্রেশন পার হয়ে লম্বা লাইন ধরে ভেতরে ঢুকার ভেতরও ছিল অনিশ্চয়তা। কোথায় কখন সমস্যার জন্ম হয় পূর্বাভাষ করার কোন উপায় ছিলনা। তাছাড়া আমি যাচ্ছি এমন একটা দেশে, যেখানে প্রতিদিনের জীবন ডুবে থাকে সমস্যার অথৈ সাগরে। একদিকে প্যালেষ্টাইনিদের প্রতিরোধ, পাশাপাশি ইসরায়েলি সৈন্যদের নির্মমতা। সবমিলিয়ে ইসরায়েল নামের দেশটায় যাওয়া যেমন কঠিন, বেরিয়ে আসাও খুব একটা সহজ না। বিশেষকরে আমার মত জন্মগত মুসলমানের জন্যে।

বিশেষ কোন ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন ও স্ক্যানিং পার হয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে।

দেখলে মনে হবে আলোর হাঁট জমেছে টার্মিনালে। সাথে মানুষের স্রোত। হরেক রকম মানুষ। যেন সাদা, কালো, বাদামি, এশিয়ান সহ গোটা বিশ্বের খণ্ড একটা মানচিত্র এখানে। এলোমেলো হাঁটছে সবাই। কেউ হাতে টিকেট নিয়ে দৌড়চ্ছে নিজ গেটের দিকে। আমার মত যাদের হাতে অফুরন্ত সময় তারা পথভ্রষ্ট পথিকের মত এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কেউ কেউ ঢুকে পরছে ট্যাক্স ফ্রি দোকানগুলোতে। শেষ মিনিটের কেনাকাটা সেরে অনেকে তৈরি হচ্ছে লম্বা জার্নির। সে জার্নির দূরত্ব অনেকের জন্য হয়ত আফ্রিকার গহীন জঙ্গল অথবা ব্রাজিলের আমাজন নদী পর্যন্ত।

টুকটাক কেনাকটি আমিও সেরে নিলাম। যদিও ডিনারের সময় অনেকটা বাকি, তবু ম্যাকডোনাল্ড রেস্টুরেন্টে আগাম কিছু খেয়ে নিলাম। সব প্রয়োজনীয়তা শেষ করে ফ্লাইট যখন আকাশে উড়বে রাতের খাবার পরিবেশনে তখনো অনেক দেরী। অতীতে কলোম্বিয়ার বগোটা হতে নিউ ইয়র্ক ফেরার পথে তিক্ত এক অভিজ্ঞতা এড়াতেই অসময়ের এ ডিনার।

27279

ইউনাইটেডের ৯৫৪নং ফ্লাইট জি৯৬ গেইট হতে ছেড়ে যাবে। হাতে তখনো নষ্ট করার মত ২ ঘণ্টা সময় আছে। হাতের ছোট ব্যাগ আর কাঁধের ঝুলন্ত ল্যাপটপটা শেষবারের মত চেক হাঁটা দিলাম নির্দিষ্ট গেইটের দিকে। কাছাকাছি আসতেই বিস্মিত হলাম। বেইসমেন্টে মূল ফটক। পাশাপাশি অন্যান্য ফ্লাইটে ঢুকার চাইতে তেল আভিভ গামী ফ্লাইটে ঢুকার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পাসপোর্ট চেক, তার উপর নতুন করে স্ক্যানিং। গায়ের শেষ তুলাটা পর্যন্ত খুলে রাখতে হল স্ক্যানিং মেশিনের বেল্টে।

সান ফ্রানসিস্কো শহরে জানতাম চীনাদের ঘনবসতি। এই প্রথম খুব কাছ হতে অনুভব করলাম এর সত্যতা। ইমিগ্রেশন ও স্ক্যানিং মেশিন অপারেটরদের সবাই চীনা। মাঝে মধ্যে বিনা কারণে এশিয়ান ব্যাকগ্রাউন্ডের ইমগ্রেশন অফিসাররা ঝামেলা বাধায়। সামান্য ত্রুটিকে বিশাল কোন কিছুতে রান্না করতে ভালবাসে। এ দৌড়ে চীনারা সবসময় এগিয়ে। তারপর দাঁড় করানো যাবে ভারতীয়দের। এসব ব্যপারে আমার অভিজ্ঞতার ঝাঁপি অনেক ভারী। তাই কিছুটা হলেও জানা ছিল কি করলে ঝামেলা এড়ানো যায়।

ওরা কিছু বলার আগেই আমি পরনের কাপড় ছাড়া বাকিসব বেল্টে রেখে দিলাম। অফিসার অন ডিউটিকে খুব সন্তুষ্ট দেখাল। প্রয়োজনের চাইতে একমিনিটও দেরী হবোনা ঝামেলা শেষ করতে। বেল্ট হতে সবকিছু কুড়িয়ে আসল জায়গায় ফিরিয়ে নিতে বেশকিছুটা সময় পার হয়ে গেল। খুব সাবধানে গুনে গুনে সবকিছু যত্ন করে প্যাক করলাম। বিশেষ চোখ রাখলাম পাসপোর্ট ও বোর্ডিং পাসের দিকে।

এক মিনিটের জন্যেও ভুলে গেলাম না আমি কোথায় যাচ্ছি। ভাল করে জানা ছিল কথা ও কাজে সামান্য হেরফের হলেই আমাকে কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় ডিঙ্গাতে হবে। আমি আমার ইসরায়েল যাওয়ার উদ্দেশ্য ও বিধয়ের স্টোরি সোজা করে নিলাম। মনে বিশ্বাস ছিল, সত্য বললে কোথাও কোন সমস্যা হবেনা।

বোয়িং’এর বিশাল এক ফ্লাইট। শত শত যাত্রী। সবাই নিজ দেশে যাচ্ছে। তিন ধর্মের দেশ ইসরায়েল। যাত্রীদের পরনের পোশাক দেখেই বুঝা যায় কে কোন ধর্মের। ইহুদিদের মাথার টুপি জাতীয় টেফিল্লিন নামে পরিচিত বস্তুটা বলে দেয় ওদের পরিচয়। মুসলমান বলতে যে দু’চারজন ছিল তাদের সবার পরনে ট্রাডিশনাল আরবি পোশাক। দু’চারজন ভারতীয় পোশাকেও তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। সাদা আমেরিকানদের কেউ ভ্রমণ করছে বলে মনে হলনা।

চলবে

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৪

273019

কেবল বৈধ কাগজপত্র ও আর্থিক সংগতি থাকলেই ইসরায়েলের মত সমস্যাসংকুল দেশে যাওয়া যায়না। সমস্যার আগ্নেয়গিরিতে বাসকরে দেশটা। কখন সে আগ্নেয়গিরি হতে লাভা বিস্ফোরিত হবে কেউ জানেনা।
একদিকে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন, ইসলামিক জেহাদের মত পশ্চিম তীরের সংগঠন, উত্তরে লেবাননের হেজবল্লাহ, গোলান হাইটসের ওপারে সংঘাতময় সিরিয়া। সবমিলিয়ে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির সাথেই হতে পারে দেশটার তুলনা। তবে গেল ক’বছর ধরে সব ফ্রন্টেই শুনশান নীরবতা। মাঝেমধ্যে স্যাটলারদের সাথে প্যালেষ্টাইনিদের সংঘাত সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি করলেও তা অল-আউট ইন্তেফাদায় গড়ায়নি। রাজনৈতিক বাস্তবতা সহসাই পরিস্থিতি বদলে দেবে তেমন অবস্থাও ছিলনা।

মনের গভীরে কিছুটা দ্বিধা থাকলেও অজানাকে জানার, অচেনাকে দেখার পুরানো ইচ্ছাটারই জয় হল। দুদিনের অনুসন্ধানের পর মনের মত রুট ও দামে টিকেট পাওয়া গেল।
জুলাই ১৯, ২০১৯ সাল। চমৎকার রৌদ্রজ্জ্বল একটা দিন। আমেরিকার হিংস্র পশ্চিমে বছরের এ সময়টায় সূর্যের দাপাদাপিতে কেউ ভাগ বসাতে পারেনা। একটানা গরমে জীবন অনেকসময় অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। মাঠ-ঘাট, চারিদিকে পাহাড় পর্বতেও চলে সূর্যের রাজত্ব।

আজকেও এর ব্যতিক্রম হলোনা। এয়ার ট্রাভেলের নিখুঁত আবহাওয়া। বিকাল ৪টায় ফ্লাইট হলেও দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় সানপোর্ট এয়ারপোর্টে হাজির। লাগেজ বলতে মধ্য সাইজের একটা সুটকেস ও হাল্কা একটা হাতব্যাগ। জানতাম মধ্যপ্রাচ্যের যে কোন দেশে এটা গরমের সময়। অনেক জায়গায় রাতে বেশ ঠাণ্ডা পরে। তাই দু’ধরণের আবহাওয়ার জন্যেই কাপড় নিতে হল।

নিউ মেক্সিকোর আলবুকুরকে হতে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রানসিসকো তিন ঘণ্টার সরাসরি ফ্লাইট। ইউনাইটেড এয়ার লাইন্সে ক’মাস আগে একই পথে ভ্যানকুভার ঘুরে এসেছি। চরম বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার পর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এই কোম্পানির ফ্লাইটে আর উঠবো না। কিন্তু সময় ও দামের সাথে কম্প্রোমাইজ করতে হল এ যাত্রায়।

দু’ঘণ্টা সময়ের পার্থক্যের কারণে সান ফ্রানসিসকো পৌঁছানোর পর একই দিন রওয়ানা দিব তেল আভিভের পথে। অযথা এয়ারপোর্টে সময় নষ্ট করতে হবেনা, এটাই ছিল ফ্লাইট সিলেকশনের আসল কারণ। এ যাত্রায় ইউনাইটেড হতাশ করেনি। আলবুকুরকে হতে ফ্লাইট ছাড়তে একমিনিটও দেরী হয়নি।

পথে দু’একবার ঝাঁকি লাগলেও গোটা ফ্লাইট ছিল শান্ত। যাত্রীদেরও তেমন ভিড় ছিলনা। ইন-ফ্লাইট সার্ভিস বলতে এক কাপ কফি অথবা এক গ্লাস সফট ড্রিংক। তা নিয়েই ইদানীং সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

এই স্বল্পতার হেতু জানতে চাইলে ওরা বলে টিকেটের দাম কম, তাই সার্ভিসও কম। অথচ সময় ছিল যখন তিন ঘণ্টার জার্নিতেও গরম খাবারের ব্যবস্থা থাকতো। অবশ্য ফ্লাইটে উঠলেই ক্ষুধা চাপতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আমার কোন কালেই ছিলনা। জানালার সীটটায় বসে বাইরের পৃথিবী দেখতে দেখতে কখন পৌঁছে গেছি টের পাইনি।

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা… ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ৩

272299

২০০২ সালের মার্চ মাস। গোটা প্যালেস্টাইন দাউ দাউ করছে দ্বিতীয় ইন্তেফাদার আগুনে। শুরু হয়েছিল ২০০০ সালের আগস্ট মাসে। সামনে ইসরায়েলি পার্লামেন্টের নির্বাচন। লিকুদ দলীয় প্রার্থী লেবানন যুদ্ধের কসাই হিসাবে পরিচিত এরিয়েল শ্যরণ দলবল নিয়ে সহসাই জেরুজালেমস্থ মুসলমানদের পবিত্র স্থান আল-আকসা মসজিদে প্রবেশ করেন। দেশটার ইহুদিরাও এই মসজিদের মালিকানা দাবি পূর্বক নিজেদের পবিত্র স্থান হিসাবে গণ্য করে থাকে। তাদের কাছে এ মসজিদ টেম্পল মাউন্ট, এবং মুসলমানদের মতই পবিত্র স্থান। কলফ্লিক্টের শুরু ওখানেই।

প্যালেষ্টাইনিরা গর্জে উঠে। রাস্তায় রাস্তায় শুরু হয় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। সাথে বাড়তে থাকে ইসরায়েলের মূল ভূখণ্ডে প্যালেষ্টাইনিদের সুইসাইড মিশন। অনিশ্চয়তার ঘোর অমানিশায় ডুবে যায় ইসরায়েলিদের জীবন। একদিকে মূল ভূখণ্ড, পাশাপাশি প্যালেষ্টাইনি এলাকায় স্যাটেলারদের উপর চলতে থাকে মুহুর্মুহু আক্রমণ। এভাবে চলতে থাকে প্রায় ২ বছর। ততদিনে ক্ষমতায় পোক্ত হয়ে বসেছেন এরিয়াল সারণ।

মার্চের ২৭ তারিখ, ২০০২ সাল। তরুণ এক প্যালেষ্টাইনি বুকে বোমা বেধে ইসরায়েলি শহর নেতনিয়ার পার্ক হোটেলে নিজকে উড়িয়ে দেয়। সাথে নিয়ে যায় ৩০ জন ইসরায়েলি জীবন। দিনটা ছিল ইহুদিদের পবিত্র পাস-ওভার দিন। যারা মারা যায় তাদের প্রায় সবাই ছিল বয়স্ক টুরিস্ট। এরিয়েল সারণ ঘোষণা দেন চরম প্রতিশোধের। রক্তের বদলে রক্ত নেয়ার কঠিন শপথ নেন এই জেনারেল। এর আগে তিনি ১৯৮২ সালের দক্ষিণ লেবানন অভিযানের সময় রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে কসাই হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।

শ্যরণ কথা দিয়ে কথা রাখেন, তাই বিশ্বের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল কি ঘটতে যাচ্ছে প্যালেষ্টাইনের মাটিতে। পার্ক হোটেল ম্যাসাকারের দুদিন পর মার্চের ২৯ তারিখ ইসরায়েলিরা সেনারা সামরিক অভিযানে ঢুক পরে পশ্চিম তীরে। ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের পর এটাই ছিল সবচাইতে ভয়াবহ অভিযান। ইসরায়েলিরা এ অভিযানের নাম দেয় অপারেশন ডিফেন্সিভ শিল্ড।

প্যালেস্টাইন লিবারেশন আর্মির রামাল্লাস্থ সদর দফতর ও দলটার চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাতের কার্যালয় অবরোধ করে ফেলে ইসরায়েলি বাহিনী। শুরু হয় প্যালেষ্টাইনিদের উপর নির্যাতনের ষ্টীম রোলার। চেয়ারম্যান আরাফাতকে গৃহবন্দী করে চারদিক ট্যাংক কামান দিয়ে আটকে ফেলে রামাল্লায়।

নিউ ইয়র্কের বেইসমেন্টের রুমটায় বসে এসব দেখতে গিয়ে একসময় প্রতিজ্ঞা করি যুদ্ধের শেষ ও অবরোধের অবসান হলে চেয়ারম্যান আরাফাতকে দেখতে রামাল্লায় যাবো।

পুরানো ইচ্ছাটাকে ঝালাই করে সুযোগ খুঁজতে থাকি ইসরায়েল তথা প্যালেস্টাইন যাওয়ার। কিন্তু সে সুযোগ আর আসেনি। ২০০৪ সালে চেয়ারম্যান আরাফাত মারা যান। তার মৃত্যুতেও আছে অনেক বিতর্ক। বলাহয় ইসরায়েলিরা তাকে স্লো পয়জনিং করছিলো। সময় গড়িয়ে অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু আমি আমার স্বপ্ন, ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা হতে সরে আসিনি। গন্তব্য ইসরায়েল হয়ে প্যালেস্টাইন।

দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু যাওয়ার প্লান অনেকদিনের। আমার গিন্নীর জন্মস্থান। পারিবারিক-ভাবে আমাদের পরিকল্পনাটা এরকম; পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ ও পেরু সফরে যাওয়া। একবছর পেরু হলে পরের বছর বাংলাদেশ। এভাবেই চলে আসছিল। বাচ্চারাও মানসিকভাবে তৈরি হচ্ছিল জুলাই’র শেষদিকে নানার দেশে যাওয়ার। সময়টা উত্তর আমেরিকার জন্যে গ্রীষ্মকাল হলেও দক্ষিণ আমেরিকায় তখন শীতকাল।

পেরু সহ দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ ইতিমধ্যে আমি বহুবার গেছি। এ যাত্রায় নতুন করে যাওয়ার আগ্রহটা হারিয়ে ফেললাম বেশকিছু কারণে। প্রথমত; ওটা আমার দেখা দেশ। নতুন কিছু দেখার নেই। দ্বিতীয়ত; ওখানে গেলে ঘরে বসেই কাটাতে হবে ছুটির এক মাস। মা আর মেয়ে মিলে শপিংয়ে যাবে আর বাসায় বসে আমি বাচ্চাদের দেখবো। মন চাইছিল না ছুটিটা এভাবে কাটাতে। শেষমুহুর্তে এসে আমি অস্বীকার করলাম এ যাত্রায় পেরু যাওয়ার। ওরাও অবাক হলোনা। হয়ত মনে মনে ধরে নিয়েছিল আমি যাচ্ছিনা। কারণগুলো অনেক আগেই গিন্নীকে বলেছি। তাই সে অবাক হলোনা।

মার্চের মাঝামাঝি ওরা চলে গেল দক্ষিণের দিকে। আমি যথারীতি কাজে যাই। বাসায় ফিরে সময় কাটাই ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। ধারণটা হঠাৎ করেই মাথায় এলো। এখান হতে চলে যাবো আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনাস আয়ার্সে। সপ্তাহ-খানেক ওখানে কাটিয়ে ফ্লাইট ধরবো আরও দক্ষিণের। একবারে মেরুর কাছের দ্বীপ ইসলাস মালভিনাস’এ। যার ইংরেজি নাম ফকল্যান্ড আইল্যান্ডস।

দ্বীপ নিয়ে ব্রিটিশ ও আর্জেন্টাইনদের যুদ্ধের সময় কিছুটা ধারণা পেয়েছিলাম এর বিচিত্রতার উপর। অনলাইল গবেষণার ম্যারাথন চালিয়ে উপসংহারে আসতে বাধ্য হলাম শীতের সময়টা ওখানে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় নয়। তাছাড়া দ্বীপের ফ্লাইট ধরতে আমাকে যেতে হবে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে। ওখান হতে ইসলাস মালভিনাসে মাসে কেবল দুটো ফ্লাইট। হঠাৎ করে পেরুর রাজধানী লিমায় হাজির হয়ে গিন্নী ও বাচ্চাদের অবাক করে দেয়ার প্লানটা মাঠে মারা যাওয়ায় হতাশ হলাম।

টিকেট আগেই কেনা ছিল। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই ওরা চলে গেল। বাচ্চারা একটু অবাক। ইতিমধ্যে ওরা দুজনেই অনেক দেশ ভ্রমণ করেছে। অনেক পথ-ঘাট মাড়িয়েছে। কিন্তু কোনদিন বাবাকে ছাড়া কোথাও যায়নি। এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে ওদের চোখ ছল ছল করে উঠল। বুঝতে পারলো না কি ঘটতে যাচ্ছে। মন খারাপ দুজনেরই। এক পা আগায় তো দুপা পিছনে ফিরে। এবং তাকিয়ে থাকে। সবারই মন খারাপ। তবে আমি জানতাম ভোরে লিমায় পা রাখা মাত্র যে কোলাহল শুরু হবে। ততক্ষণে ভুলে যাবে বাবার কথা। নানী, নানা, খালা, খালাতো বোনদের ভিড়ে তলিয়ে যাবে বিদায়ের বিষাদ। ডালাস হতে কানেক্টিং ফ্লাইট। আট ঘণ্টার জার্নি। চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলাম বহির্গমন টার্মিনালে।

হাইওয়ে ধরে বাসায় ফিরতে একধরণের হাহাকার বয়ে গেল পা হতে মাথা পর্যন্ত। গোটা বাড়ি-জুড়ে ভৌতিক নীরবতা। ওদের খেলনাগুলো দেখে কান্না এসে গেলো। ঘন্টাখানেক পর ডালাস হতে ফোনে সবার সাথে কথা হল। ওরা উপভোগ করেছে জার্নি। মন হালকা হয়ে এলো। আগামীকাল শনিবার। অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই। অনেকদিন রাত জাগা হয়না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ফেলে আসা পথ ধরে আজ ফিরে যাবো সুখময় অতীতে। এবং রাত জেগে সন্ধান শুরু করবো ইসরায়েল যাওয়ার পথ।

চলবে।

জেরুজালেম হয় রামাল্লা … ঘুরে এলাম পশ্চিমে তীরের প্যালেস্টাইন পর্ব ২

2726

পেশায় আমি একজন প্রকৌশলী। কিন্তু ইতিমধ্যে জেনে গেছি লোকাল ডিগ্রী অথবা অভিজ্ঞতা ছাড়া প্রফেশনাল লাইনে চাকরি পাওয়া খুব সহজ না। আমি মেনে নিয়েছিলাম এ বাস্তবতা।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় প্রথম প্রজন্মের ইমিগ্রেন্টদের জন্যে এ সমস্যা নতুন কিছু না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ হতে যারা এ দেশে এসেছিল তাদের সবার ভাগ্য একই পথে গড়িয়েছিল। এ কাহিনী কেবল আমেরিকার কাহিনী নয়, অস্ট্রেলিয়ার মাইগ্রেন্টদেরও একই পথে হাটতে হয়েছে। তাই অবাক হইনি সময় গড়ানোর সাথে নিউ ইয়র্ক শহরে এমন অনেক বাংলাদেশির সাথে পরিচয় হয়েছে যারা দেশে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এমনকি সংসদ সদস্য হয়েও এ দেশে ইয়োলো ক্যাব চালানোর প্রফেশন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

সৎপথে ভাগ্য গড়া নিয়ে কোনদিন আমার কোন দ্বিধা ছিলনা। হোক তা ইয়েলো ক্যাব ড্রাইভিং অথবা হ্যান্ডিম্যান সাপোর্ট। চাকরির প্রথম বছর শেষ হতেই মনে হল সময় হয়েছে বেরিয়ে পরার। ব্যাংকে যৎ সামান্য যা জমা হয়েছে তা পৃথিবীর যে কোন দেশ ঘুরে আসার জন্যে যথেষ্ট। পকেটে অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট থাকায় আমার জন্যে গোটা পৃথিবী ছিল উন্মুক্ত। বাকি ছিল কেবল গন্তব্য স্থল পছন্দ করা।

ইউরোপে ১২ বছর কাটিয়ে এসেছি, তাই ওদিকে যাওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাইনি। এশিয়ার বহু দেশে ঘুরে বেরিয়েছি। অস্ট্রেলিয়া ছিল আমার নিজের দেশ। বাকি ছিল আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা। আফ্রিকা ঘুরতে যাওয়ার সময়টা ভাল ছিলনা। কি একটা ভাইরাস ঘুরে বেড়াচ্ছে মহাদেশের আকাশে বাতাসে। তাই দক্ষিণ আফ্রিকা অথবা কেনিয়া যাওয়ার ইচ্ছাটা উঠিয়ে রাখতে হল। বাকি ছিল দক্ষিণ আমেরিকা।

বলিভিয়া যাওয়ার ইচ্ছাটা হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি। অস্ট্রেলিয়া থাকাকালীন স্থানীয় টিভি চ্যানেলে দেখেছিলাম পেরু হয়ে এন্ডিসের অলি গলি পেরিয়ে বলিভিয়া যাওয়ার ট্রেইলটা ছিল রোমাঞ্চকর, নিরাপদ ও তুলনামূলক সস্তা। ততদিনে ঘরে বসে অনলাইনে টিকেট কাটার রাস্তাও পৌঁছে গেছে বেডরুমে। কিছু অনুসন্ধান ও সামান্য কিছু কেনাকাটা সেরে আগস্টের সুন্দর এক চেপে বসলাম পেরুর রাজধানী লিমা গামী ফ্লাইটে। ওখান হতে বাসে করে এন্ডিসের বুক চিড়ে বলিভিয়ার রাজধানী লা পাস।

আমার এ লেখা পেরু অথবা বলিভিয়া ভ্রমণ নিয়ে নয়। এই দুটো দেশ ভ্রমণের কাহিনী নিয়েই আমার প্রথম বই ‘এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে’। পাঠকদের অনেকেরই হয়ত পড়া যাছে। বিশেষকরে যারা আমার সাথে বিভিন্ন ব্লগে সময় কাটিয়েছেন। এবারের লেখা পৃথিবীর অন্য কোনা নিয়ে। এমন কোনা যেখানে সাধারণত বাংলাদেশিদের যাওয়া হয়না। চাইলেও যেতে পারেনা। কারণ যাওয়ার বৈধতা নেই।

ইসরায়েল। বাংলাদেশ সরকার তার নাগরিকদের যে দুটো দেশে পাওয়ার অনুমতি দেয়না ইসরায়েল তার একটি (ইদানিং পরিবর্তন এসেছে এ সিদ্ধান্তে)।

ইসরায়েল যাওয়ার ইচ্ছাটারও একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। তার জন্যে আমাকে ফিরে যেতে হবে আমার চাকরি জীবনে। প্যালেষ্টাইনিদের অবিসংবাদী নেতা ইয়াসির আরাফাত ১৯৮১ সালে প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমি তখন স্থানীয় একটা কনসাল্টিং ফার্মে কাজ করি। প্রতিদিন পুরানা পল্টনস্থ বাসা হতে ধানমন্ডির ২৭ নং রোডের অফিসে যাই। প্রতিদিনের মত সেদিনও যাচ্ছি। হঠাৎ করে বেইলি রোডের কাছে আসতেই দেখি রাস্তা আটকানো। বুঝতে পারলাম না কেন এ অবস্থা।

বেশকিছুটা সময় অপেক্ষা করার পর ব্যপারটা পরিষ্কার হল। কালো রংয়ের একটা গাড়িতে করে হেভি গার্ড নিয়ে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের প্রধান, চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত যাচ্ছেন। রিক্সায় বসে ভাল করে দেখা হয়নি চেয়ারম্যান আরাফাতের চেহারা। সুযোগটা নষ্ট হওয়ায় কষ্ট পেয়েছিলাম। মনের গভীরে কোথায় যেন একটা ইচ্ছা জন্ম নিয়েছিল; যদি কোনদিন সুযোগ আসে নিশ্চয় চেয়ারম্যানকে দেখতে প্যালেষ্টাইনে যাব।

চলবে।

জেরুজালেম হয়ে রামাল্লা : ঘুরে এলাম পশ্চিম তীরের প্যালেস্টাইন … ১ম পর্ব

27242

ভালই ছিল নিউ ইয়র্কের জীবন। ব্যস্ততা ও অলসতার মাঝে যে কোন একটা বেছে নিতে কোন বাধা ছিলনা। ছিলনা ঘরে ফেরার তাগাদা। না ছিল কোন পিছু টান। আমার রাজত্বে আমিই ছিলাম রাজা।
থাকি উডসাইডের একটা বাসায়। বাসার বেইসমেন্টে দুটো রুম থাকলেও বাড়িওয়ালা একটা রুম আমাকে দিয়ে বাকি রুমটা ভাড়া দেননি অন্য কারণে। মাঝেমধ্যে জুয়ার আসর জমতো ওখানে।

বাড়িওয়ালা বাংলাদেশি। নিজে ইয়োলো ক্যাব চালাতেন। আসরে যারা আসতো তারাও ছিল মেগা শহর নিউ ইয়র্কের পরিশ্রমী বাংলাদেশি ক্যাব ড্রাইভার। কাজের ফাঁকে জুয়ার আড্ডা আমার জন্যে নতুন কোন ঘটনা ছিলনা। অনেকে সপ্তাহে ছয়দিন গাড়ি চালাত। দৈনিক ১৫/১৬ ঘণ্টা কাজের পর এটাই ছিল তাদের একমাত্র বিনোদন।
এ নিয়ে আমার কোন অভিযোগ ছিলনা। কারণ আসর জমত মাসে দু’একবার। বাকি দিন আমি একা। কাজে যাই, বাসায় ফিরি, রান্না করি এবং দিনশেষে বিছানায় যাই নতুন একটা দিনের প্রত্যাশায়।

কাজ করি কুইন্স বুলোভার্ডের উপর একটা ষ্টোরে। পেশায় সেলসম্যান। আমেরিকায় প্রথম কাজ। শুরু হিসাবে মন্দ ছিলনা। যা আয়-রোজগার তা দিয়ে জীবন চলে যায়। রেগো পার্কের ঐ এলাকাটা মূলত রুশ, হিস্পানিক ও আমাদের উপমহাদেশের ইমিগ্রেন্টদের বাস।

ইংরেজির দৌড় প্রায় সবারই সীমিত। এবং চাকরিতে এটাই ছিল আমার এডভান্টেজ। আমার স্থায়ী কোন বেতন ছিলনা। আয়ের সবটাই আসত বিক্রির উপর কমিশন হতে। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দুর পাশাপাশি রুশ ভাষাতেও ছিল যথেষ্ট ভাল দখল। ইউরোপের ১২ বছরের সবটাই কাটিয়েছি রুশ দেশে।

দুর্বল ইংরেজি সহ গ্রাহকদের সবাই চাইতো নিজ ভাষায় কথা বলতে। কাজ চালানোর মত স্প্যানিশ খুব দ্রুতই শিখে নেই মোটা দাগের হিস্পানিকদের কাছে টানতে। এভাবেই চলে যাচ্ছিল জীবন। এক বছর, দু’বছর, তিন বছর, একে একে ছ’বছর।

কাজেই পরিচয় হয় ওদের সাথে। নরমা, আয়ানা, অসমার, জুলিসা, শ্যরন, লুইস সহ আরও অনেকে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে ওরা অথবা ওদের পূর্ব পুরুষেরা এসেছে। নতুন করে জীবন গড়ছে ইমিগ্রান্টদের দেশ আমেরিকায়।

জীবন নিয়ে ওদের সবারই একটা গল্প আছে। সে গল্পের পরিধি নিউ ইয়র্ক ছাড়িয়ে চলে যায় কলোম্বিয়া, পেরু, জ্যামাইকা, গায়ানা, ত্রিনিদাদ টবাগো সহ পৃথিবীর অনেক দেশে। দিনের পর দিন একসাথে কাজ করতে গিয়ে একে অন্যের গল্প শুনেছি। পরস্পরকে জেনেছি। জীবনের সাথে মিশে গেছি। বেরিয়ে পরার ইচ্ছাটার জন্ম বোধহয় ওখানেই।

পেরুর মাচুপীচু দেখার ইচ্ছাটা ছিল অনেকদিনের। সোভিয়েত দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় আমার বন্ধু ছিল পেরুর ইসাবেলা। এক সময় আমাদের জানা-শুনাটা ইন্টিমেসি পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তার কাছেই গল্প শুনেছি এন্ডিস পর্বমালার। শুনেছি ইনকাদের লুকানো শহর মাচুপিচু্র কাহিনী। ইচ্ছেটা তখনই মগজে গেঁথে গিয়েছিল।

তবে সে ইচ্ছাটা ছিল অনেকটা স্বপ্নের মত। কোনদিন আলোর মুখ দেখবে আশা করিনি। মাচুপিচুর উচ্চতা জয় করার বাধাগুলো সহজ ছিলনা। প্রথমত, বাংলাদেশি পাসপোর্টে পৃথিবীর অনেক দেশই ভিসা দেয়না। আর আর দিলেও তাতে থাকে চলাফেরায় অনেক বিধি নিষেধ। আর্থিক সীমাবদ্ধতাও ছিলই।

আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করি বাংলাদেশির পাশাপাশি আমি ছিলাম একজন অস্ট্রেলিয়ান। দেশটার পাসপোর্ট আমাকে দিয়েছিল প্রায় পৃথিবীর সব দেশে প্রবেশ করার বৈধতা। এবং সুযোগটা কাজে লাগাতে আমি লম্বা সময় অপেক্ষা করিনি।

নিউ ইয়র্কের শুরুটা জন্যে ছিল ঘটনাবহুল। পেনসেলভ্যানিয়ার ফিলাডেলফিয়া হতে এ মেগা শহরে প্রথম যেদিন পা রাখি আমেরিকার ধূসর ইতিহাস ৯/১১’র বয়স মাত্র চার দিন। শহর জুড়ে শোকের স্তব্ধতা। কেবল নিউ ইয়র্কই নয়, গোটা আমেরিকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা গ্রাস করে নিয়েছে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। জীবন শুরু করার জন্যে সময়টা ছিল খুবই কঠিন। তাই শুরুর জন্যে কমিশন ভিত্তিক চাকরিটা নিয়ে কোন অভিযোগ ছিলনা।

-চলবে।

তাসমান পাড়ের গল্প … শেষ পর্ব

27200

মাঝে মধ্যেই চিন্তাটা মাথায় আসে। মগজের গভীরে ঢুকে কিলবিল করে। কল্পনায় চমকিত হই। আবেগ আপ্লূত হই। কেমন হত যদি ঘুরে বেড়ানোর মুহূর্তগুলোতে পাশে কেউ থাকতো। খুবই আপন কেউ। ভালবাসার কেউ! এমন কিছু নিয়ে মাঝে মধ্যে যে ভাবিনি তা নয়।

মেঘে মেঘে বেলা পেরিয়ে যাচ্ছে, এক বন্দর হতে অন্য বন্দরে নাও নোঙর করছি অথচ কোথায় যেন কি একটা নেই। হিসাবের শেষে কিছু একটা গোলমাল থেকে যাচ্ছে। বন্ধু শফিউল ও তার স্ত্রী বার বার সেদিকেই ইঙ্গিত করছিল।

নিউজিল্যান্ডে প্রথম দুদিন ঘরে বসে স্মৃতি রোমন্থন করেই কাটিয়ে দিলাম। পৃথিবীর এ প্রান্তে এ সময় গ্রীষ্মকাল। মধ্য গগনে সূর্যের দাপটে কোন কার্পণ্য নেই। তবে নেই প্রখরতা, সবকিছুতে কেমন যেন কোমলতার ছোঁয়া। উপভোগ করার মত ভালোলাগা।

তিনদিনের মাথায় রওয়ানা দিলাম আরও দক্ষিণে। ২২৭ কিলোমিটার দূরে রটোরোয়া নামের এক শহরে। ড্রাইভিং সময় প্রায় ৩ ঘণ্টা। নেইমসেক লেকের পাড়ের এ শহর তার জিও-থার্মাল এক্টিভিটির জন্যে বিখ্যাত। দেখার মত অনেক কিছু আছে এখানে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে টুরিস্টদের ভিড় লেগেই থাকে।

272069

মাঝপথে হ্যামিলটন নামের বড় একটা শহর। ওখানে দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পরলাম শহর দেখতে। বেশ বড় শহর। একপাশ দিয়ে বয়ে গেছে ওয়াকাটো নদী। মানুষ আর প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এ শহরে। মাঝ নদীতে গলফ খেলার ব্যবস্থা আছে। ওখানে কিছুটা সময় ব্যায় করে আবারও নেমে পরলাম রাস্তায়।

অদ্ভুত দেশ এই নিউজিল্যান্ড। চারদিকে থমথমে চেহারার জঙ্গল। মাইলের পর মাইল জনবসতির কোন চিহ্ন নেই। ঝকঝকে রাস্তাঘাট। ভাল করে তাকালে মনে হবে কেউ দিনের পর দিন যত্ন করে আগলে রাখছে সবকিছু। এতকিছু ছাপিয়ে যে ছবি মগজে আঘাত হানে তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রক্ত। রাস্তা পারা হতে গিয়ে চলমান গাড়ির নীচে চাপা পরে মারা যাচ্ছে বনের পশু। রক্ত শুকিয়ে শক্ত হয়ে যাচ্ছে। চলমান গাড়ির চাকার নীচে চাপা পরে যাচ্ছে প্রকৃতি ও মানুষের এই বৈরী সম্পর্ক।

হোটেল আগেই বুক করা ছিল। আহামরি তেমন কিছু না। তবে আধুনিক সভ্যতায় বাস করতে যা লাগে তার কোন অভাব ছিলনা।

হোটেলের বাইরে প্রথম পা রাখতে চোখে পরল অবিস্মরণীয় এসব দৃশ্য। মাটি ফুঁড়ে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে বাষ্প। কাঠি দিয়ে মাটিতে খোঁচা দিলে সেখান হতেও বেরিয়ে আসছে।

রাতের খাবার ভারতীয় এক রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে মোকাবেলা করতে হল অন্য এক অভিজ্ঞতা। রেস্টুরেন্টের মহিলা মালিক আমার পাশের চেয়ারটায় বসে অনেকক্ষণ আলাপ করলেন। এবং সবশেষে প্রস্তাব দিলেন তার রেস্টুরেন্টে কাজ করার জন্যে। রেস্টুরেন্ট চালু রাখার মত লোকবল পাওয়া যাচ্ছেনা এদিকটায়। যে দুজন মাওরি কাজ করে করে তাদের মন-মর্জির কোন ঠিক ঠিকানা থাকেনা। একদিন আসে তো দুদিন দেখা দেয়না। অথচ ব্যবসা নাকি এখানে খারাপ না।

চমৎকার একটা হাসি দিয়ে এক কিশোরী এসে পাশে বসলো। মালিকের কন্যা প্রমা। স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করছে। লোক না থাকায় প্রায়ই এখানে আসতে বাধ্য হয় মাকে সাহায্য করার জন্যে।
আমি সিডনির বাসিন্দা এবং ক’মাস পর চলে যাচ্ছি পৃথিবীর আরেক প্রান্তে শুনে বোধহয় কষ্ট পেলেন মহিলা। সামনে আরও একদিন আছি এখানে শুনে প্রমা প্রস্তাব দিল শহর ঘুরে দেখানোর। আমার বন্ধু ও তার স্ত্রীর চোখে অন্যরকম ইঙ্গিত।

পরদিন হোটেল হতে আমাকে উঠিয়ে নীল প্রমা। বাকি কেউ ইচ্ছা করেই যেতে ছিলোনা। আমি মনে মনে হাসলাম এবং কোন কিছু জটিল না করে উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নিলাম কুড়িয়ে পাওয়া বাস্তবতা।

প্রথম দেখায় মনে হবে হলিউডের ক্যামেরায় আটকে রাখা কোন সিনেমার দৃশ্য। যতদূর চোখ যায় ধোয়া আর ধোয়া। থার্মাল স্পার্ক মাটি ফুঁড়ে রকেট গতিতে আকাশের দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রমাই নিয়ে গেল হ্যালিপ্যাডের দিকে। ওখানে চাইলেই হেলিকপ্টার ভাড়ায় পাওয়া যায়। মাস-খানেক আগে নাকি এক দুর্ঘটনায় দুজন প্রাণ হারিয়েছে। ধন্যবাদ জানিয়ে হেলিকপ্টারে আমার সহযাত্রী হতে অস্বীকার করলো প্রমা। দুর্ঘটনা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাইলাম না। পৃথিবীর এদিকটায় কোনদিন ফিরে আসবোনা, তাই যা দেখার যা ছোঁয়ার সবকিছু উপভোগ করতে চাইলাম।

১৫ মিনিটের জন্যে উড়ে গেলাম রটোরোয়ার আকাশে। পাশে পাইলট কাম ট্যুর গাইড। এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। নীচের দিকে তাকালে মনে হবে হাজার বছর আগের অন্য এক সভ্যতায় ফিরে গেছি আমি। চারদিকে ঘন বন, বাষ্পের ধোয়ায় ছেয়ে আছে সবকিছু। চোখ বুজলে মনে হবে নিশ্চয় জুরাসিক পার্কের উপর দিয়ে উড়ছি আমি। নীচে ভালকরে তাকালেই দেখা মিলবে অতিকায় সব ডায়নাসোরদের।

রাতে হোটেলের পাশে একটা খালি জায়গায় BBQ’র আয়োজন হল। আগুন জ্বালিয়ে রাত ২টা পর্যন্ত কাটিয়ে দিলাম ওখানে। পাশেই চমৎকার একটা লেক। রাত হলেও ওখানে মানুষের কমতি ছিলনা। অনেক কপোত কপোতী তাদের ভালবাসা প্রকাশ্যে আনতে কার্পণ্য করছেনা।

রাতটা ছিল খুবই শান্ত। চারদিকে জ্যোৎস্নার প্লাবন। আমরা কোন কথা বলিনি সে রাতে। চুপ হয়ে যার যার মত ফিরে যাচ্ছিল ফেলে আসা অতীতে।

ফেরার পথে হেমিলটনে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। এখানেও অনেক কিছু দেখা হয়নি। বন্ধু শফিউল ইতিমধ্যে ঘুরে গেছে এ শহর। হাতে সময় ছিল সীমিত। তাই অস্থির হয়ে ছুটতে হয়েছিল এক জায়গা হতে অন্য জায়গায়।

অকল্যান্ড ফিরে দেখতে গিয়েছিলাম গলফ অব হাওরাকিতে চলমান আমেরিকা’স কাপ ইয়ট রেস দেখতে। বন্ধু শফিউলের আরও কজন বন্ধু দাওয়াত দিতে এসেছিল। তার এক রুশ বন্ধুর দাওয়াত অস্বীকার করার উপায় ছিলনা।

এভাবেই কেটে গেল বাকি সময়। এখান হতে ওখানে, এদিক হতে ওদিকে। শেষরাতে আমাদের আড্ডায় তৃতীয় কেউ যোগ দেয়নি। হয়ত ইচ্ছা করেই। পরিবারের বাকি সবাই চাইছিল আমরা দুই বন্ধু নিজেদের জমানো কথা জমানো স্মৃতি কেবল দুজনেই রোমন্থন করি।

অকল্যান্ড এয়ারপোর্টে বন্ধুর সাথে আলাদা হতে গিয়ে নিশ্চিত ছিলাম সহসাই দেখা হচ্ছেনা আমাদের। অন্তত পৃথিবীর এ প্রান্তে।

27197

নোটঃ ভারতীয় যুবতী প্রমার সাথে পরিচয় ও তার পরবর্তী অনেক ঘটনা সামনে আনলাম না অনেক কারণে।

তাসমান পাড়ের গল্প … ২য় পর্ব

26983

১৯৯৯ সালের শেষদিকেই সব চূড়ান্ত হয়ে গেল। যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন ভিসার প্যাকেট হাতে পেয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলাম অস্ট্রেলিয়ার থাকা হচ্ছেনা আমার। এ নিয়ে তেমন কোন হায় হুতাশ ছিলনা। প্রথমত, এখানে আপনজন অথবা ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলতে তেমন কেউ ছিলনা। দ্বিতীয়ত, ভাল একটা চাকরির জন্যে তখনও ষ্ট্রাগল করছিলাম।

একদম শেষমুহুর্তে আমেরিকায় প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় গুনে দেখলাম হাতে এখনও নয়টা মাস সময় আছে। অস্ট্রেলিয়ায় ইতিমধ্যে মন উঠে গেছে। সিদ্ধান্ত নিলাম দেশে ফিরে যাব। কটা মাস মা’র সাথে কাটিয়ে ফিরে এসে পাড়ি দেব আমেরিকার দিকে।

শাফিউল আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। সেন্ট পিটার্সবার্গে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় রুম শেয়ার করেছি। বছরের পর বছর ধরে এক হাড়ি হতে ভাত খেয়েছি। বাংলাদেশে ফিরে এসে একই কোম্পানিতে চাকরি করেছি।

হঠাৎ করেই শফিউল আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ে চলে যায় চাকরি নিয়ে। এবং তারপর দেখা দূরে থাক, কোন রকম যোগাযোগও ছিলনা।
সেই শফিউল হঠাৎ করে নিউজিল্যান্ডে হাজির। সপরিবারে মাইগ্রেট করেছে। তাসমানের দুই তীরে দুজন থাকলেও দেখা হয়নি এতদিন। যাই যাই করেও আমার যাওয়া হয়নি। আমেরিকা চলে যাচ্ছি শুনে শফিউল ওর ওখানে ঘুরে যাওয়ার জন্যে শেষবারের মত অনুরোধ করল।

কোথাও বেরিয়ে পরার ওটাই ছিল আমার মোক্ষম সময়। পৃথিবীর এ প্রান্ত একবার ছেড়ে গেলে দ্বিতীয়বার আসা হবে কি-না সন্দেহ ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ঘুরে আসব নিউজিল্যান্ড। হাতে সময় নিয়ে টিকেট কাটলাম যাতে ফিরে এসে চলে যেতে পারি বাংলাদেশে।

১৯৯৯ সালের ২৫শে ডিসেম্বর। ক্যালেন্ডারের হিসাবে খ্রিষ্টানদের বড়দিন। চারদিকে উৎসবের আমেজ। বন্ধু শফিউলেরও ছুটি। আমাকে সময় দেয়ার মত যথেষ্ট সময় থাকবে হাতে।

সিডনি হতে অকল্যান্ড। তিন ঘণ্টার ফ্লাইট। সাথে দুই ঘণ্টার সময় পার্থক্য। ঘড়ির হিসাবে ওরা এগিয়ে। বড়দিন তাই আসছিলো এয়ার নিউজিল্যান্ড হয়ত বিশেষ সার্ভিসের ব্যবস্থা করবে। থাকবে হরেক রকম খাবার ও আপ্যায়ন।

তেমন কিছুই ছিলনা ফ্লাইটে। কেবল পাইলটের অভিনন্দন’এর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে বিশেষ দিনের বিশেষ আয়োজন। প্রায় ৯০% ফাঁকা সীটের ফ্লাইটে আগে কোনদিন ফ্লাই করেছি কিনা মনে করতে পারলাম না।
নির্ধারিত সময়ের দশমিনিট আগেই ল্যান্ড করল আমাদের ফ্লাইট।

অকল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চেহারা দেখে একটু অবাক ও বিমোহিত হলাম। এয়ারপোর্টের প্রায় সব দায়িত্বে দেশটার আদিবাসী মাউরিরা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ টোংগা, সামোয়া, ভানোয়াতুর নাগরিকদের মত চেহারার মাউরিদের চিনতে অসুবিধা হয়না। গায়ে গতরে খুবই শক্তিশালী মাউরিরা হাজার বছর আগে তাদের মিথিক্যাল পলিনেশিয়ান হোমল্যান্ড হাওয়াইকি হতে এখানে এসেছিল। গোটা নিউজিল্যান্ড জুড়ে এদের বাস। দেশটার জনসংখ্যার শতকরা ১৪ ভাগ হলেও এয়ারপোর্টে তাদের উপস্থিতি দেখে তা মনে হলোনা।

প্লেনের দরজা হতে বেরুতেই চোখ পরল শফিউলের উপস্থিতি। সপরিবারের অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। বন্ধুর স্ত্রী ইউক্রেইনের নাগরিক। চিনি সেই কৈশোরকাল হতে।

আমরা দুজনেই আবেগী নই। তাই ভেতরের অনুভূতি বাইরে না এনেও অনেক কথা বিনিময় হয়ে গেল। আমরা অনেকদিন অপেক্ষায় ছিলাম এমন একটা মুহূর্তের।

ডিসেম্বরের শেষদিকে নিউজিল্যান্ড যাওয়ার আরও একটা কারণ ছিল আমার জন্যে। মিলেনিয়াম অথবা Y2K বাগের জ্বরে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। কম্পিউটার সফটওয়্যার ২০০০ সালের শেষ দুটা শূন্যের জন্যে প্রোগ্রাম করা না থাকায় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে মানব সভ্যতায়, এমন আশংকা করছিল অনেকে। অনেকে অতিরিক্ত খাদ্য, পানি মজুত করে তৈরি হচ্ছিল আপদকালিন সময়ের জন্যে। এ নিয়ে মিডিয়াতেও ছিল প্রচুর হৈ চৈ। ২০০০ সাল ধরণীতে প্রথম পা রাখবে নিউজিল্যান্ড সহ পলেনেশিয়ার বাকি দ্বীপগুলোতে। বিপর্যয় যদি ঘটে তার শুরুটাও হবে ওসব দেশ হতেই। ইচ্ছা ছিল মানব সভ্যতা ভেঙ্গে পরার ঊষালগ্নের সাক্ষী হওয়ার। তাই ইচ্ছা করেই বছরের শেষদিকে পাড়ি জমাই তাসমানের ওপারে।

সে রাতে আমাদের কারও চোখে আসবেনা জানা ছিল। শেয়ার করার মত গল্পের পাহাড় জমে ছিল দুজনের ভেতর। সাথে ছিল ফেলা আসা স্মৃতি রোমন্থন। যে স্মৃতি আমাদের নিয়ে গিয়েছিল ইউক্রেইনের ছোট এক শিল্প শহর হতে রুশ জার-তন্ত্রের রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গে। সে তালিকায় আরও ছিল বাংলাদেশের নওগাঁর পত্নীতলা, বদলগাছি ও ধামুইরহাটের অনেক পথ-ঘাট।

বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে BBQ আর পানের আসরে যোগ দিয়েছিল আরও কটা পরিবার। শফিউলের বাড়িটা খোলামেলা জায়গায় হওয়ায় মাঝরাতে গলা খুলে গান ধরতেও কোন বাধা ছিলনা। বন্ধু নিশ্চিত করেছিল সম্ভাব্য শব্দ দূষণের আওতায় আসতে পারে এমন সব বাড়িওয়ালাদের সবাইকে আগাম নোটিশ দেয়া আছে। কেউ মাইন্ড করবেনা।

বড়দিন হতে নিউ ইয়ার, গুনলে এক সপ্তাহের ব্যবধান। এই এক সপ্তাহ চষে বেড়ালাম অকল্যান্ডের সব কোনায়। সফরের দ্বিতীয় রাতে বন্ধুকে নিয়ে গেলাম স্থানীয় কাসিনোতে। কাসিনোর সাথে শফিউলের পরিচয় নেই। ওখানে জুয়া খেলার ব্যাপারে তার সামান্যতম ধারণা ছিলনা।

রুলেট টেবিলে আধাঘণ্টায় ৮০০ ডলার লাভ করে নীরবে বেরিয়ে আসলাম। নিউজিল্যান্ড আসা-যাওয়া সহ সব খরচ এক নিমিষে উঠে এলো। বন্ধু ও তার স্ত্রী হতভম্ব! বুঝতেই পারলো না কি হতে কি হয়ে গেল। চিপস হাতে নিয়ে বিভিন্ন নাম্বারে বসাচ্ছি…রুলেটের চাকা ঘুরছে…আমি আরও চিপস হাতে পাচ্ছি এবং একসময় চিপসগুলো কাউন্টারে জমা দিয়ে কিইউ ডলার হাতে নিয়ে বেরিয়ে পরা, বন্ধু ও বন্ধু-পত্নী দুজনের জন্যেই ছিল দুর্বোধ্য।
এবং শেষমেশ হাজির হল সে মাহেন্দ্রক্ষণ! নতুন সহস্রাব্দির ঊষালগ্নে আমরা। টেবিলে খাবার ও পানীয় নিয়ে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছি বড় ধরণের বিপর্যয়ের। ঘড়ির কাটায় বারটা বাজার শেষ ঘণ্টাটা বাজতে দলবেঁধে রাস্তায় নেমে এলাম। রাস্তায় মানুষের ঢল। সবাই সাক্ষী হতে চাইছে ইতিহাসের।

না, কোথাও কিছু ঘটেনি সে রাতে। মানব সভ্যতার একটা চুলেও হাত দিতে পারেনি মিলেনিয়াম বাগ। পৃথিবী যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেল সে রাতে। ভয় ভীতি আর উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে শেষরাতে দিকে ঘুমাতে গেলাম সবাই।

সূর্য উঠার সাথে সাথে কলিং বেলের তীব্র আর্তনাদে ভেঙ্গে গেল কাঁচা ঘুম। আমি ড্রয়িং রুমে তাই আমাকেই খুলতে হল বাসার মুল দরজা।
একদল বাংলাদেশি। সবার মাথায় টুপি ও মুখে দাঁড়ি। বন্ধু শফিউলের সাথে দেখা করতে এসেছে। তার জন্যে তবলীগ জামাতের দাওয়াত নিয়ে এসেছে।

(বড় হয়ে যাচ্ছে, তাই আপাতত ইতি টানছি। সময়ে পেলে আরও একটা লেখায় শেষ করবো নিউজিল্যান্ড সফরের বাকি অংশ)

তাসমান পাড়ের গল্প

2719216

ইউরোপের ব্যস্ত জীবন ছেড়ে চলুন এবার তাসমান পাড়ের গতিহীন জীবনে ঘুরে আসি। জীবন সেখানে আসলেই অচল। ছবির মত সুন্দর, হিজল তমাল দিঘীর মত শান্ত ও উঁচু উঁচু পাহাড়ের মত নিশ্চুপ ও স্থবির। ইউরোপের কোলাহলময় জীবন অনেক ব্যস্ত। ওখানে গাড়ি ঘোড়া বাস ট্রেনে চড়ে একদেশ হতে অন্য দেশে যেতে অতিরিক্ত কিছুর দরকার হয়না। চাই কেবল ইচ্ছা ও সময়। কিন্তু তাসমান পাড়ের দুই দেশে আসা যাওয়ার একটাই মাধ্যম, সাগরের উপর ভাসমান মেঘমালার বুক-চিড়ে যাওয়া। চলুন সেটাই করি।

টাইম মেশিনে চড়ে চলুন ফিরে যাই ২২ বছর আগে। ২০০০ সাল। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি অলিম্পিকের জন্যে তৈরি হচ্ছে। চারদিকে সাজ সাজ রব। সবার মত আমিও কাঁপছি সে উত্তেজনায়। ১৯৮০ সালে মস্কোতে যে সুযোগ মিস করেছি এ যাত্রায় তা না করতে ছিলাম দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

কিন্তু হায়, আমি ও আমার দোতারার দুই সুরের গান আবারও অলিম্পিক মিস করা নিশ্চিত করে দিল। সেপ্টেম্বরের শুরুতে অলিম্পিক আর আমাকে আমেরিকায় ঢুকতে হবে একই মাসের ১৫ তারিখের ভেতর। তারিখের হেরফের হলে দেশটায় আমার মাইগ্রেশন প্রসেস ইনভেলিড হয়ে যাবে।

১৯৯৯ সালের নভেম্বরের শেষদিকে কাগজপত্র চূড়ান্ত করে অপেক্ষা করছি মাত্র শুরু হওয়া অস্ট্রেলিয়া জীবনের ইতি টানার। আমার জীবনের যা কিছু ঘটে সবই ঘটে এই সেপ্টেম্বর মাসে। ১৯৯৫ সালের একই মাসে জীবন যুদ্ধের শেষ অধ্যায় লেখার জন্যে হাজির হয়েছিলাম এই দ্বীপে।

অচেনা দেশ। প্রাথমিক সাহায্য পাওয়ার মত কেউ ছিলনা। লাগেজ নিয়ে কোথায় উঠবো তারও কোন ঠিক ছিলনা। অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়াতে যাচ্ছি সিডনি কিংসফোর্ড স্মিথ এয়ারপোর্টে পা রেখেই তা বুঝতে পেরেছিলাম। তবে এ নিয়ে আমি বিশেষ যে চিন্তিত ছিলাম তা নয়।

অতীতে বহুবার এমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি। অপরিচিত দেশ, অজানা ভাষার মত বাধা কাটিয়ে ইতিমধ্যে পৃথিবীর অনেক প্রান্ত ঘুরে এসেছি। অস্ট্রেলিয়ায় এসেছি সরকারী স্পন্সরে। স্কিল মাইগ্রেশনের বৈধ কাগজপত্র হাতে। তাই দ্বিধা থাকলেও ভয় ছিলনা। তাছাড়া পকেটে ছিল খরচ করার মত দুই হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড স্টালিং।

মার্টিন প্যালেসের কাছে জর্জ স্ট্রীটের উপর সস্তা এক হোটেলে উঠেছিলাম বাধ্য হয়ে। দুদিন পর ভোজবাজির মত বদলে গেল সবকিছু। আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধুর সন্ধান পাওয়ার একদিনের মাথায় দেশটার সোশ্যাল সিকিউরিটিতে নাম লিখিয়ে অন্তত প্রাথমিক খরচের কিছু অংক নিশ্চিত করতে সক্ষম হই। আরও একদিন পর মেডিকেয়ার/মেডিকেইডে তালিকাভুক্ত হয়ে নিশ্চিত করি চিকিৎসা পর্ব। শহরের পুবদিকে প্রথমে ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশে রেন্ডউইক, পরে ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলেসের পাশে কেনসিংটনে এলাকার দিনগুলো ভালই কাটছিল।

চার বছর কেটে যায় সিডনি শহরে। শহরকে নিজের শহর ও দেশকে নিজের দেশ ভাবতে শুরু করছি কেবল। দু’বছরের মাথায় নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট পাওয়ায় নিশ্চিত হয়ে যাই এই শহর এ দেশই হতে যাচ্ছে আমার শেষ ঠিকানা।

গোলমাল বাধে অন্য জায়গায়। মারুবার এনজাক পেরেডের উপর একটা ফ্লাটে থাকি। ফ্লাট-মেট হিসাবে বন্ধু পাভেল যোগ দিয়েছে কেবল। ইংল্যান্ডে এমবিএ করা পাভেল নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিতে কম্পিউটার সাইন্সে কি একটা কোর্স করতে দেশ হতে এসেছে কেবল। আমার মত অনেক ঘাটে পোড় খাওয়া পাভেলের সাথে সম্পর্কটা ফ্ল্যাট-মেট হতে বন্ধুত্বে রূপ নিতে সময় লাগেনি। দুজন দুদিকে কাজ করি। পাশাপাশি ইউনিতে দৌড়ায় পাভেল। দুজনের জীবন বয়ে চলছে অনেকটা নদীর মত।

আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে এসেছি। পাভেল এসেছে স্টুডেন্ট ভিসায়। কোর্সের শেষদিকে এসে চিন্তাটা তাকে চেপে ধরল। দেশে ফেরার ইচ্ছা ছিলনা তার।

ক্লাস হতে ফিরে খাবার টেবিলে বসে সংবাদটা দিল। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারের দেশ আমেরিকা তার দেশে প্রতিবছরের মত এবারও ডিভি লটারি অফার করছে। পাভেল ইউনির লাইব্রেরি হতে প্রিন্ট করে এনেছে দুটো ফর্ম। একটা তার ও অন্যটা আমার জন্যে। নিজে পূরণ করে কেবল আমার সই নিয়ে নিজেই পোস্টে পাঠিয়ে দেয় ডিভি দরখাস্ত। খুব দ্রুতই ভুলে যাই এমন একটা কাজ আমরা করেছিলাম।

কোর্স শেষ করে পাভেল দেশে ফিরে যায়। আমিও মন দেই আমার কাজে। ইতিমধ্যে বেশকিছু স্বদেশীর সাথে পরিচয় হওয়ায় জীবন আরও সহজ হয়ে যায়। মাছে-ভাতের একজন বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়ান হওয়ার লড়াই শুরু করি সর্বশক্তি দিয়ে।

হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস হতে একটা খাম পেয়ে অবাক হয়ে যাই। কারণ ততদিনে স্মৃতি হতে মুছে গেলে ডিভি পর্ব।
খাম খুলে হতভম্ব! আই এম আ উইনার।

আগামী পর্বে সমাপ্ত।

বিকেলে ভোরের গল্প … শেষ পর্ব

2714379

বরাবরের মতই ব্রিটেনের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। প্রথম দেখায় মনে হবে নিশ্চয় বর্ষাকাল এখন। উত্তর সাগর হতে মেঘমালা সহসাই উড়ে এসে ভিজিয়ে দেবে সবকিছু। শরীর হয়ে ধুয়ে মুছে ফেলবে লম্বা জার্নির ক্লান্তি।
এ ধরণের আবহাওয়া টিপিক্যাল ব্রিটেনের জন্যে। যতবার এ দ্বীপপুঞ্জে এসেছি ততবারই মেঘাচ্ছন্ন সকাল স্বাগত জানিয়েছে। তাই অবাক হইনি এ যাত্রায়। বিষণ্ণতায় ভরা এ সকাল যে বেশিক্ষণ স্থায়ী হবেনা সেটাও জানা ছিল। কারণ মেঘের ওপাশেই আধির আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে গ্রীষ্মের ঝলমলে রোদ।

দশটা বাজার সাথে ভোজবাজির মত বদলে যায় সকালের বিষণ্ণ চেহারা। কুয়াশার চাদরে মোড়া উত্তর সাগর জেগে উঠবে ঘুম হতে। বাস, ট্রেন আর ফেরী গুলো কানায় কানায় ভরে উঠে পর্যটকদের পদভারে।

ব্যস্ততা বাড়ছে ইমিগ্রেশন বুথ গুলোতে। কাঁধে ব্যাক-প্যাক আর হাতে ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ এগুচ্ছে ওদিকে। কমনওয়েলথভুক্ত দেশ গুলোর জন্যে আলাদা একটা লাইনের ব্যবস্থা আছে। তুলনামূলক কম ভিড় থাকে ওখানটায়। যেহেতু বাংলাদেশ কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশ তাই ওখানেই আমাদের লাইন ধরতে হয়।

পাসপোর্টের পাতাগুলো এদিক সেদিক করে কোন প্রশ্ন না করেই ৬ মাসের ভিজিটির ভিসা ইস্যু করে স্বাগত জানাল ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে। হালকা একটা হাসি দিয়ে আমিও ধন্যবাদ জানালাম।

ইমিগ্রেশন ঝামেলা বলতে যা বুঝায় তা প্রথমবার এ দেশে প্রবেশ করার সময় সেরে নিয়েছিলাম। দ্বিতীয়বার এ নিয়ে আর কোন ঝামেলা পোহাতে হয়নি।

অতিরিক্ত কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছিল সে যাত্রায়। নিজের ব্রিটেন ভ্রমণকে জাস্টিফাই করতে হয়েছিল। কেন এসেছি, কোথায় থাকবো, কতদিন থাকবো এসব প্রশ্নের উত্তর সাবলীলভাবে দেয়ার পর গুনে ২ মাস ১০ দিনের ভিসা দিয়েছিল। পকেটে ১০ ডলার নগদ নিয়ে টুরিস্ট হিসাবে এ দেশে ঢোকা নিমিষেই বানচাল হয়ে যেত যদি ইমিগ্রেশন আমার ওয়ালেট পরখ করতে চাইতো।

তেমন কিছুই করেনি। আমি সোভিয়েত দেশে সরকারী স্কলারশিপে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি এবং আমার ডিগ্রীলাভ ব্রিটেনে অবৈধ অভিবাসী হওয়ার চাইতেও অনেক জরুরি এটাই ছিল আমার ডিফেন্স আর্গুমেন্ট।

ইমিগ্রেশন হতে বেরিয়ে রেল ষ্টেশনে এসে ভাবনায় পরে গেলাম। এখনও অনেক সকাল। কাউকে ফোন করে ঘুম ভাঙ্গানোর সময় হয়নি। বন্ধু হাসানকে ফোন না করে লন্ডনের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আবারও ট্রেন ধরতে হবে। এ যাত্রায় ব্রিটেনের আন্তঃশহর ট্রেন। এসেক্সের হারউইচ হতে লন্ডনের লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশন।

দেড় ঘণ্টার ট্রেন জার্নি। জানালার পাশে বসলে ব্রিটেনের কান্ট্রি সাইড খুব কাছ হতে দেখা যায়। ছোট ছোট উপশহর, ফসলের মাঠ, কাউবয়দের ক্যাটেল নিয়ে ব্যস্ততা, সবকিছু মগজে আটকে যায় স্থায়ী স্মৃতি হিসাবে।
সকালের লোকাল ট্রেন। বলতে গেলে খালিই ছিল যাত্রার শুরুতে। কিন্তু ঘাটে ঘাটে থামার কারণ যাত্রীদের ভিড় বাড়তে শুরু করল। এ পথেই যে অনেকে চাকরি করতে লন্ডন যায় তার আলামত সবখানে। আমার উদ্দেশ্য একই। তবে পার্থক্য হচ্ছে, চাকরি করার আগে তার সন্ধান করতে হবে।

লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশনে নেমে হাতের ব্যাক-প্যাকটাকে বালিশ বানিয়ে প্লাটফর্মের এক কোনায় শুয়ে পরলাম। আমার মত আরও অনেকে একইভাবে সময় কাটাচ্ছে। দশটা বাজার আগ পর্যন্ত বন্ধু হাসানকে ফোন না করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ও অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে। সকালে বিছানা ছাড়ে অনেক দেরী করে।

শুয়ে শুয়েই ফিরে গেলাম একই ষ্টেশনের এক ঘটনায়। বেশ ক’বছর আগের ঘটনা। ব্রিটেন তখন লণ্ডভণ্ড আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির হুমকিতে। যত্রতত্র বোমা ফুটছে। আকাশে বাতাসে ভয়ের রাজত্ব। রাস্তা-ঘাট, বাজার-বন্দর, ষ্টেশনগুলোতে পুলিশদের অতিরিক্ত নজরদারি। সাথে কেডাবরা ডগ। সন্দেহ হলেই পুলিশ আটকে দিচ্ছে অনেক কিছু।

প্রতিবারের মত সেবারও লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশনে বসে অপেক্ষা করছি বেলা গড়ানোর। দশটা বাজার সাথে সাথে হাতের ব্যাক-প্যাকটা বাইরে রেখে ঢুকে গেলাম পাশের টেলিফোন বুথে। একটা পর একটা নাম্বার ডায়াল করে চালিয়ে গেলাম চাকরি সন্ধানের কাজ। মূলত সিলেটী ভাইদের রেস্টুরেন্টের কাজই ছিল আমার মূল টার্গেট। বেশকিছুটা সময় টেলিফোন বুথে কাটিয়ে বাইরে আসতে চোখ ছানাবড়া। পুলিশ!

একগাদা পুলিশ ঘিরে রেখেছে আমার ব্যাক-প্যাক। ক্যডাবরা ডগের সাহায্য নিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। আমি কাছে আসতে চীৎকার করে আদেশ দিল যেখানে আছি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার। আমি একেবারেই বোবা। কোথা দিয়ে কি শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। পুলিশই বা কেন আমার ব্যাক-প্যাক ঘিরে রেখেছে তার আগা-মাথা কিছু বুঝতে পারলাম না।

একজন এগিয়ে এসে জানতে চাইল ব্যাগটা আমার কিনা। স্বীকার করতে আমাকে ঘিরে ফেললো। জানতে চাইলো কি আছে ব্যাগে এবং কেন আমি এক ঘণ্টার উপর একে বাইরে ফেলে রেখেছি।

সোভিয়েত দেশের টুরিস্ট আমি। ব্যাগ বাইরে রেখে ফোনে বন্ধুদের সন্ধান করছিলাম এতক্ষণ। অনেক কষ্টে বুঝানো গেল। ব্যাক-প্যাকে বিস্ফোরক কিছু নেই এমনটা নিশ্চিত হওয়ার পর আমাকে খুলে বলল ঘটনা প্রবাহ। মালিকানা না থাকায় কেউ একজন পুলিশে ফোন করেছিল। পুলিশের সন্দেহ হয়ত আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি ব্যাগ ভর্তি বিস্ফোরক রেখে গেছে বড় ধরণের নাশকতার অংশ হিসাবে।
আমাকে খুবই নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সবকিছু পরিষ্কার হওয়ার পর পুলিশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। প্রস্তাব দিল আমাকে আমার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার। ধন্যবাদ দিয়ে ব্যাক-প্যাক গুটিয়ে বিদায় জানালাম লিভারপুল স্ট্রীট ষ্টেশনকে। উৎসুক জনতার অনেকে আমার দিয়ে তাকিয়ে আই এর এ’র চেহারায় দেখছিল।

ষ্টেশনের ঘড়ির কাটা ততক্ষণে ১০টায় পৌঁছে গেছে। বন্ধু হাসানকে ফোন করার সময় হয়েছে।

জানতাম ও রাগ করবে আমার হঠাৎ আগমনে। গেলবার কথা দিয়েছিলাম পশ্চিম বার্লিন নেমেই ওকে ফোন করবো এবং ও আমার জন্যে হারউইচ ষ্টেশনে অপেক্ষা করবে।

যেখানে আছি সেখান হতে এক পা না নড়ার নির্দেশ দিয়ে বন্ধু হাসান রওয়ানা দিল আমার সন্ধানে।

– শেষ।