ট্রানজিট ভিসা নিয়ে ভ্রমণের এই এক সুবিধা; ঝামেলা যত তা ইমিগ্রেশন পুলিশেই সীমাবদ্ধ থাকে। কাস্টম পুলিশদের বিশেষ কোন মাথাব্যথা দেখা যায়না। কারণ তারা জানে সাথে যাই থাকুক তা নিয়ে বেশিদূর যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। ট্রেন জার্নির ট্রানজিট অবশ্য আকাশ পথের চাইতে একটু ভিন্ন। এমন ভিসায় ট্রেন হতে নেমে যতদূর চোখ যায় ততদূরই যাওয়া যায়। আকাশ পথের মত বিশেষ একটা জায়গায় আটকে রাখেনা। রেলপথের ট্রানজিট টাইম সেনসিটিভ। আমার বেলায় তা ছিল ২৪ ঘণ্টা।
পশ্চিম জার্মান-নেদারল্যান্ড সীমান্ত পারাপারে কোনদিনও কোন ঝামেলা হয়নি। ইমিগ্রেশন পুলিশ পাসপোর্ট হাতে নিয়ে খুব দ্রুত ভিসার পৃষ্ঠায় একটা সিল মেরে স্বাগত জানায় দেশটায়। ট্রেনের স্টপেজ টাইমও থাকে খুব সীমিত। কারও ইমিগ্রেশনে সমস্যা দেখা দিলে ট্রেন আটকে রাখেনা। বরং কাছের কোন ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আসলে ট্রেনে পুলিশ না উঠলে বুঝারই উপায় থাকেনা আমরা এক দেশ হতে অন্য দেশে প্রবেশ করছি।
সীমান্ত ঝামেলা শেষ হতে বাকি রাস্তা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়ার প্লান মরলাম। ক্ষুধায় পেট চো চো করেছে। এ পথে হকারদের আনাগোনা নেই যে কিছু কিনব। দিনের আলোতে মাঝে মধ্যে দেখা মিললেও রাতে ওরা আসেনা। সাথে খাবার, পানি সহ যা ছিল তা আগেই শেষ। পকেটে টাকা থাকলেও খাবার যোগার করার উপায় নেই। ফেরীতে উঠার আগে পেটে কিছু পরছে না এ ব্যপারে নিশ্চিত হয়ে গেলাম।
Rotterdam পার হয়ে Hook Van Holland’এ পৌঁছতে রাত ১০টা বেজে গেল। ফেরী ছাড়তে তখনও এক ঘণ্টা দেরী। ব্যস্ত এ বন্দরে যাত্রীদের ভিড় লেগেই থাকে। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার এ পথটা বাকি পথ গুলোর চাইতে একটু লম্বা। বেলজিয়াম হয়ে গেলে ৬ ঘণ্টার কম সময়ে অতিক্রম করা যায় ইংলিশ চ্যানেল। কিন্তু আমার মত অনেকেই এ পথ বেছে নেয় উন্নত ফেরী সার্ভিসের কারণে।
যাত্রী ও যাত্রীদের গাড়ি পাশাপাশি দুটো লাইনে উঠছে ফেরীতে। লম্বা লাইন, কিন্তু খুব দ্রুতই এগুচ্ছে। আমার সামনে একজন ভারতীয়। বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। চোখে চোখ পড়তে মৃদু একটা হাসি দিয়ে ফিরিয়ে দিলাম তার চাউনি। এখন কথা বলার সময় না। ফেরীতে উঠে রাতের ঘুমের জন্যে ভাল একটা জায়গা খুঁজতে হবে। পেটে দিতে হবে কিছু। তারপর না হয় কথা বলা।
ফেরীতে ঘুমের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা আছে। তার জন্যে পে করতে হয়। আমার মত পকেটে ২০০/৩০০ ডলার নিয়ে যারা ভ্রমণ করে তাদের জন্যে এ লাক্সারি সাজে না। তাই ডেকেই খুঁজতে হয় রাতের আশ্রয়।
এ পথে প্রথম যাত্রায় বুঝতে পারিনি এতকিছু। রাতের খাবার আর ফেরীর উপর নীচ সব তলা আবিষ্কারের পর রাত বেশ গড়িয়ে যায়। ঘুমের আয়োজন করতে গিয়ে হতাশ হলাম। কোথাও এক ফোঁটা জায়গা নেই। এমনকি করিডোরেও ঘুমন্ত মানুষের মিছিল। শেষপর্যন্ত লাইভ ব্যান্ড শো আর কাসিনোর রুলেটের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁটাতে হয়েছিল বাকি রাত।
হঠাৎ মনে হল সবকিছুর আগে ভারতীয় যাত্রীর সাথে আলাপটা সেরে নিলে আমারই সুবিধা। অন্তত সাথে আনা লাগেজটা তার জিম্মায় রেখে খাবারের সন্ধানে যাওয়া যাবে। সাথে বোঝাটা টানতে ক্লান্তি লাগছিল। দুনিয়ার বাকি সব অর্থহীন মনে হল ক্ষুধার কাছে।
আকবর আলী। জন্ম ভারতে হলেও এসেছে পর্তুগাল হতে। ওখানকার কোন এক সমুদ্র সৈকতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। সেও একা। কারও সাথে পরিচয় হওয়াটা তার জন্যেও ছিল জরুরি।
উপর তলার ডেকে খালি কিছু স্পট পাওয়া গেল। বিছানা হিসাবে ব্যবহারের জন্যে আমার কাছে হাল্কা একটা কম্বল ও এয়ার বালিশ ছিল। আকবর আলীও আমার পাশে বিছানা পাতলো। সবকিছু তার জিম্মায় রেখে কেবল পাসপোর্ট ও মানিব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পরলাম খাবারের সন্ধানে।
রাত যত গভীর হয় ফেরীর জীবন ততই রহস্যময় হয়ে উঠে। হাই ভলিউমের লাইভ মিউজিক, রুলেট ও ব্ল্যাক জ্যাক টেবিলে সুন্দরীদের অর্ধ-নগ্ন দেহ, বারে বোতল আর গ্লাসের টুং টাং আওয়াজ বৈচিত্র্য এনে দেয় রাতের জার্নিতে।
পতিতাদের আনাগোনাও চোখ পরার মত। ওরা কেবিন ভাড়া নিয়ে খদ্দের টানে। ফাঁদ পাতে বার ও কাসিনোতে। স্পেন ও ইতালি হতে আসা অনেক কিশোরীও অতিরিক্ত কিছু আয়ের জন্যে শরীর বিক্রি করে। ওদের কেবিন থাকেনা। নির্জন কোন জায়গা পেয়ে ওখানেই মিলিত হয়।
এ এক বিস্ময়কর অনুভূতি। প্রথম প্রথম খুব অবাক হতাম। কিন্তু অনেকের সাথে মেশা ও আলাপের পর উপসংহারে আসতে বাধ্য হয়েছি, মেয়েদের অনেকের কাছে শরীর আসলে জাস্ট একটা অঙ্গ। হাত পা, চোখ মুখ ব্যবহারের মত শরীরে সে সব অঙ্গও ব্যবহার করে শারীরিক অথবা পকেটের চাহিদা মেটাতে। এ নিয়ে কারও কোন আক্ষেপ নেই। ওদের অনেকের ভাষ্য, শরীর থাকলে তার চাহিদাও থাকবে। সে চাহিদা মেটাতে পুরুষের মত অনেক মেয়েও সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়।
ফেরীতে কেবল পতিতারাই আয়ের জন্যে শরীর বিক্রি করে তা নয়। অনেক মহিলাও one night stand’এর বৈচিত্র্য কাছ হতে উপভোগের জন্যে পুরুষদের বিছানায় নেয়। কাসিনো অথবা বারে বসলে এসবের আলামত অনুধাবন করতে সময় লাগেনা।
অনেক রাত পর্যন্ত সহযাত্রী আকবর আলীর সাথে আলাপ হল। ভারতের গুজরাটে জন্ম হলেও জীবনের অনেকটা সময় ইউরোপে কাটিয়েছেন। চাকরি পর্ব সেরে এখন নিজে ব্যবসা করছেন। বিয়ে করেছেন পর্তুগীজ এক মহিলাকে। ব্যবসা বাড়াতে চাইছেন, কিন্তু লোকবল পাচ্ছেন না। লন্ডন যাত্রার এটাই অন্যতম কারণ। পরিচিত অনেকে আছে ওখানে। এবং তাদের মাধ্যমে সন্ধান করবেন নতুন রেস্টুরেন্টের জন্যে সেফ, ওয়েটার সহ আরও অনেককে।
লন্ডন যাত্রার আমার হেতু জানতে চাইলেন আগ্রহ নিয়ে। খুলে বললাম আমার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। ওখানে কাজ করতে পর্তুগাল যাওয়ার কোন উইন্ডো ছিলনা। ভদ্রলোক খুব করে অনুরোধ করলেন ছুটি কাটাতেও যেন ওনার কাছে যাই। হাতে একটা বিজনেস কার্ড ধরিয়ে নিজের ঠিকানা ও ফোন নাম্বার দিলেন।
সে রাতে আর ঘুম আসেনি। জীবনের অনেক হিসাব সেলুলয়েডের ফিতার মত মগজে কড়া নাড়ছিল। পকেটে ১০ ডলার নিয়ে এ পথে প্রথম জার্নি। কোন এক জার্নিতে নর্থ সী’র উত্তাল ঢেউ, সাথে ফেরীর নিয়ন্ত্রনহীন উদ্দামতা, মানিব্যাগ হারিয়ে খুঁজে পাওয়া, গায়ানীজ ভারতীয় এক যুবতীর সাথে কিছু অন্তরঙ্গ সময়… মনে করার মত অনেক কিছুই ছিল।
সবকিছু ছাপিয়ে কিছু কষ্ট বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল, এটাই আমার শেষ যাওয়া। আর কোনদিন আসা হবেনা। লাইভ ব্যান্ডের পর্দা ফাটানো মিউজিক, কাসিনোর রুলেট টেবিলে হঠাৎ জেতা জুয়ারির বাঁধভাঙ্গা উল্লাস, ডেকের চোরাগলিতে পতিতাদের ইশারা…অনেক কিছুই মিস করবো। মিস করবো এসব বাধাহীন সহজ জীবন।
শেষরাতের দিকে কখন ঘুমিয়ে পরেছি টের পাইনি।
আগামী পর্বে সমাপ্য…