অয়েজুল হক এর সকল পোস্ট

আজ আকাশে চাঁদ নেই ( উপন্যাস)

হাসি – কান্না, প্রেম – বিরহ নিয়ে নতুন উপন্যাস –
আজ আকাশে চাঁদ নেই।
প্রি অর্ডার চলছে –
https://www.rokomari.com/book/193411/aj-akashe-chand-nei

আজ আকাশে চাঁদ নেই
Author: মোহাম্মদ অয়েজুল হক
Publisher: সাহিত্যদেশ
Category: সমকালীন উপন্যাস
Language: বাংলা
ISBN: 9789848069196
Quality: হার্ডকভার
মূল্য – ১৫০ টাকা ( প্রি অর্ডার করলে ১১৩ টাকা )

স্বপ্নের মতো ভালো থাকিস ( চিঠি)

শ্রাবণী,
খুব ভালো আর ব্যস্ত সময় কাটছে তোর। সামনের দিনগুলো আরও সুন্দর হবে, স্বপ্নের মতো। দুঃস্বপ্নে ঘুমভাঙা কষ্ট দারুণ পীড়াদায়ক। সারাটা দিন মাটি করে দেয়। মানুষ কেন দুঃস্বপ্ন দেখে, কেঁপে কেঁপে ওঠে ঘুমের ঘোরে? প্রশ্নটা আজ আড়ালেই থাক। হারিয়ে যাক প্রভাত বেলার কুয়াশার ভেতর, ভেসে যাক আগত বসন্তের কোকিলের সুরে। শুধু এটুকু জানা থাক, বুকের জমিনে বুকের স্বপ্নগুলো মাটিচাপা দিতে দিতে ক্লান্ত, নিঃস্ব, মানুষগুলোই স্বপ্নে কাঁপে, স্বপ্নে তাদের ভয়। হোক রাতে বা দিনে, ঘুমে বা জেগে। তোর বিশ্বাস-অবিশ্বাসে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। তবু বিশ্বাস করিস তোর আজকের সুখগুলো আমার প্রত্যাশিত ছিল। তোর-আমার সবটা দিন আমি তোর সুখের কথাই ভেবেছি। ভালো থাকার কথা ভেবেছি। অনেক কিছু বদলে গেলেও আমি সুখী। আজকাল অনেক রকম হাসতে শিখেছি, অনেক রকম চলতে শিখেছি। তুই বলেছিস সময়ের সঙ্গে মানুষের স্বপ্ন, ইচ্ছা, চলার পথ যদি বদলে না যেত, তাহলে মানুষ বাঁচত না, পাথর হয়ে যেত। ঠিক রে… যাদের স্বপ্ন, ইচ্ছা, চলার পথ বদলায় না তারা বাঁচে কই! প্রাণ থাকলেই তাকে বেঁচে থাকা বলে মানুষ! অথচ আমি হাজারো জিন্দা লাশ ঘুরে বেড়াতে দেখি শহরের অলিগলিতে। ভুতুড়ে আঁধারে রাস্তার কোনে ঘাপটি মেরে বসে থাকা জিন্দা লাশ!

শ্রাবণী, আজকাল আমার কথা শোনা বা লেখাপড়ার মতো অবসরটুকু পর্যন্ত তোর নেই। তোর ইচ্ছা, স্বপ্নের ওপর আমার পাওয়া না পাওয়ার হিসাব কষতে বসেছি কেন? কেনই বা আমার একান্ত বিরহ ব্যথার আবর্জনার স্তূপ চাপিয়ে দিচ্ছি তোর ঘাড়ে?

শ্রাবণী, বুকের আকাশ ঘনকালো মেঘে ভরা। মনে পড়ে, একদিন বলেছিলাম আকাশ কেন কাঁদেরে? তুই জবাব দিয়েছিলি, আকাশের কাছে শুনে বলতে হবে। আকাশের কাছে শুনে আমাকে বলার মতো সময় তোর যে আর হয়ে ওঠেনি। স্বপ্নগুলো বড় বেশি ব্যস্ত করে দেয়। এতটাই ব্যস্ত করে তোলে তার আর পেছনে ফেরার অবকাশ থাকে না। স্বপ্নের দিকে ছোটাই যে মানুষের স্বভাব সেটা তুই নিজেই চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে দিলি।
বৃষ্টি হচ্ছে। বাইরের বৃষ্টিটাই মানুষ দেখে, বাইরের গর্জনটাই শোনে। ভেতরটা দেখে কে! ভোরের পাখিরা জেগেছে, গান করছে। একছু পরেই সকাল, সূর্যালোকে আলোকিত হবে সব। ভালো থাকার চেষ্টা করিস, তোর দেখা স্বপ্নের মতো।
১৬.০২.১৯ – দৈনিক সমকালে প্রকাশিত

মেলায় খাইরে ( রম্য)

বাবার কাছে বড় বায়না- মেলায় যাব টাকা দাও। আবিদ সাহেব কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন, কিসের মেলা?

– কেন? জানো না, বইমেলা?

– জানি। কিন্তু তোমার আবার কিসের বইমেলা।

– বইমেলায় কি আমার তোমার বলে কিছু আছে নাকি!

– আছে। বইমেলা চক্ষু ওয়ালা মানুষের, অন্ধদের না।

শান্ত চোখ দুটো বড় করে বাবার চোখের সামনে মেলে ধরে। এই দেখ চোখ। চোখ। আমি তোমাকে খুব দেখতে পাচ্ছি বাবা।

আবিদ সাহেব পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে শান্তর মুখের উপর ছুড়ে মেরে বলেন, মানুষ হও।

টাকা পেয়েছে। মনে মনে ভাবে, আপাতত মানুষ না হলেও চলবে। শান্তর ক্ষুদ্র জীবনে সম্ভবত এই মানুষ হও শব্দটা সবচেয়ে বেশি শুনেছে। মানুষ কী!

কিশোর স্যার বই লিখেছেন। আসুন মানুষ হই। স্যারের নাম কিশোর হলেও তিনি মোটেও কিশোর নন। তেলতেলে বিরাট টাক মাথার ষাটোর্ধ্ব মানুষ। খোঁচাখোঁচা সাদা গোঁফ, দাড়ি জানান দেয়, তিনি বেশ কয়েক যুগ পেরিয়ে আসা সময়ের সাক্ষী। মানুষ নিয়ে স্যারের কৌতূহল আর গবেষণার শেষ নেই। একবার শান্তর ওপর রেগে গিয়ে বলেন, তুই কবে মানুষ হবি?

– মানুষ হব না স্যার।

অদ্ভুত জবাব শুনে স্যার চিন্তিত মুখে বলেন, কেন মানুষ হবি না রে?

– মানুষ বড় নির্মম প্রাণী স্যার।

– যারা নির্মম তারা মানুষ না।

শান্ চোখ বড় করে বলে, স্যার তাহলে তো আপনিও মানুষ না। স্যার মানুষটা সহ্য করতে পারেন না। বেত দিয়ে চটাচট কটা ঘা কষে দেন। ‘বেয়াদব।’

শান্ত পিঠ ডলতে ডলতে বলে, ‘বাস্তবেই দেখালেন স্যার!’ কিশোর স্যার শান্তকে আর দু’ঘা দিতে এসে কী মনে করে হেসে ওঠেন। বলেন, মানুষ হ। এতদিন সবক দিয়ে ক্লান্ত, ক্ষ্যন্ত বয়োবৃদ্ধ স্যার এবার বই আকারে মানুষ হওয়ার কলাকৌশল বিলি করবেন।

রাতে আফরোজকে নক করে, বইমেলায় যাবে?

– হ্যাঁ, আমি প্রতিবছর যাই।

– গুড। তাহলে এবার চলো, একসঙ্গে যাই।

– কী খাওয়াবে?

– মানে!

– মানে আবার কী? বললাম না, প্রতিবছর যাই, প্রতিবছর খাই।

– এটা তো ফুড আইটেমের কোনো মেলা নয়।

আফরোজ খিলখিল করে হেসে ওঠে। ‘খাওয়ালে আছি না হলে নাই। বাই।’

পরদিন বিকেল হতেই বইমেলায় হাজির হয় শান্ত। ঝাঁকবেঁধে দলে দলে হেঁটে চলা মানুষের ভীড়। ঘুরতে ঘুরতে দেখে মেলা প্রাঙ্গণের একপাশে ঘুপমেরে বসে বাদাম খাচ্ছে আফরোজ। মন-মেজাজ খুব একটা ভালো বলে মনে হয় না।

– কী অবস্থা?

– চলছে।

– কী চলছে! আফরোজের মেজাজ খারাপ হয়। কী আবার বাস। বাস চলছে।

হে হে করে গালভরা হাসি নিয়ে শান্ত বলে ওঠে, জীবনে এই প্রথম কোনো বাস গাড়ির সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হলো। আফরোজ বাদামগুলো শান্তর মুখের ওপর ছুড়ে মেরে হনহন করে হেঁটে যায়। ওর অবশ্য ঝনঝন করে হেঁটে যাওয়া উচিত। বাস মানুষ। হাসান চিৎকার করে, এই যে বাস আস্তে চলো। কারও ঘাড়ের ওপর উঠে যেও না। মেলায় যে ভিড়। আফরোজ চলে যাওয়ার অল্পক্ষণ পরেই দেখা হয় একঝাঁক বন্ধুর সঙ্গে। একই কলেজের, একই ক্লাসের জুলয়াস, বিপ্লব, নাঈম, হাসান …। শান্তকে দেখেই বেদম খুশি সবাই। একজন হাত, একজন মাথা, একজন জামা, একজন প্যান্ট ধরে টানাটানি। এক কথায় কচলাকচলি। এ বলে দোস্ত, ও বলে ফ্রেন্ড আরেকজন ডিয়ার, পেয়ার … গিয়ার পর্যন্ত যাওয়ার আগেই শান্ত চিৎকার করে, ছাড়। এটা কী বিগ ফাইটের স্টেজ নাকি। সর।

আড্ডা চলে। রাতের খাওয়াটা এখানেই হোক। বিপ্লবের প্রস্তাব সাদরে গৃহীত হয়। একসঙ্গে তো আর এমন সুন্দর পরিবেশে খাওয়া দাওয়ার সুযোগ মেলেনা! মেলায় বসেই চূড়ান্ত হয় খাওয়ার মেনু। নামকরা রেস্টুরেন্টের বিরানি, কোমল পানীয়, কফি …। বিপল্গব গান ধরে, মেলায় খাইরে। গাইতে গাইতে খাবার আনতে বেরিয়ে পড়ে। ঘণ্টাখানেক পর ভোজন পর্ব শুরু হয়। খেতে খেতে জুলয়াস বলে, বনে গিয়ে যে ভোজন তাকে বলে বনভোজন। শহরে ভোজনের কী কোনো নাম আছে। নাঈম জবাব দেয়, শহর ভোজন। এই যে আমরা শহর ভোজন করছি। হাসান বলে হয়নি, মেলায় বসে যে ভোজন তাকে মেলা ভোজন বলাই উত্তম। ওদের পাশকাটিয়ে যারা যায় তারা চোখ বড় করে তাকায়। যেন বেশ বড় অপরাধ করছে। তাদের হতেও বইয়ের বদলে চিপস, বিস্কিট বা অন্য কোনো খাবার! কেউ জুটিবেঁধে গল্পে গল্পে সময় কাটাচ্ছে।

আবিদ সাহেব অফিস শেষে মেলায় আসেন। স্টলে স্টলে নতুন বই। প্রাঙ্গণজুড়েই নতুন বইয়ের ঘ্রাণ। যত মানুষ, যত কথা, যত বই- পড়ার প্রতি উঠতি প্রজন্মের আগ্রহ তার চেয়ে কিছুটা কম। মেলা ঘুরে বাড়ি এসে ছেলের জন্য অপেক্ষা। রাত ১০টার দিকে শান্ত আসে।

– মেলায় গিয়েছিলে?

– হু।

– বই কিনেছ।

– না।

মুহূর্তে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন আবিদ সাহেব, আমার টাকা ফেরত দে।

তুমি থেকে তুই। শান্ত জানে সদুত্তর না দিতে পারলে দু’চারটা চড় থেকে নিস্তার নেই। ভদ্র ছেলের মতো জবাব দেয়, খেয়ে ফেলেছি।

– বই খেতে পারলে না?

– বই কি খাওয়া যায়! খাওয়া গেলে খেতাম।

– যায়। বইয়ের স্বাদ যারা বোঝে তারা বই খায়। তাদের জন্যই বইমেলা।

– তাহলে কিছু টাকা দাও। কাল মেলায় গিয়ে বই খাব। কষ্ট হলেও দু’একটা বই খেয়ে আসব।

১১.০২.২০১৯ দৈনিক সমকালে প্রকাশিত

সিরিয়াল সিরিয়াস

নাসিমের ছোট খালা মাজেদা বেগম মাজা ব্যথায় মুষড়ে পড়েছেন। ডাক্তার দেখিয়ে, পাল্টিয়ে যা তাই। দিন-রাত মিলে এক পোয়া ওষুধ। ওজন দিলে দুই তিন কেজি পয়সা এক মাসে ওষুধের পেছনে খরচ। সবকিছুর পর ব্যথা যাওয়া দূরে থাক, দিন দিন সিরিয়াস হচ্ছে। ভাগ্নে নাসিম ঘটনা শুনেই বলে, সিরিয়াল দেন। মাজেদা বেগম কাতর কণ্ঠে বলেন, ব্যথা সিরিয়াস। কোথায় সিরিয়াল দেব?

-ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বড় বড় রুই কাতলা কোয়ালিটির ডাক্তার দেখাতে হলে সেখানে যাওয়ার বিকল্প নেই। পরামর্শ মতো দিন কয়েক পর সিরিয়াস ব্যথা নিয়ে সশরীরে উপস্থিত হয়ে সিরিয়াল দিন। লম্বা লাইন। ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। সিরিয়াল আস্তে আস্তে পেছনের দিকে যায়। অসুস্থ মাজেদা বেগম ভাগ্নে নাসিমকে বলেন, কিরে ডাক্তার কি পেছনে!

-না, সামনে।

-তা আমরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পেছনের দিকে যাচ্ছি কেন?

নাসিম ফেসবুক সিরিয়ালে। লম্বা সিরিয়ালের চ্যাটিং। চ্যাটিংয়ের সময় কী হচ্ছে, কে আছে না আছে, সে এখন কোথায়! ইহ জগৎ, পরজগৎ- সবকিছু মাথা থেকে হারিয়ে যায়। বেরিয়ে যায়। সিরিয়াল ব্রেক করে খালার কথার জবাব দেয়, বড় সিরিয়াল, অনেক মানুষ।

-সেজন্য কি সামনে না গিয়ে আস্তে আস্তে পেছনে যাব!

-সময় লাগবে। দেখেন না পৃথিবী পর্যন্ত ঘোরে। সব সময় কী এক জায়গায় থাকে।

সঙ্গে সঙ্গে নীলুর ফোন। খালার সামনে আপাতত রিসিভ করা যাবে না। কেটে দেয়। আবার ফোন। আবার…. খালা মাজেদা বেগম ক্লান্ত সুরে বলেন, কে ফোন দেয়?

নাসিম মিনমিন করে বলে, বাথরুমে সিরিয়াল দেওয়া ছিল। আমার ডাক পড়েছে। খালা জাস্ট মিনিট, আমি আসছি।

বাথরুমে সিরিয়াল, সেখান থেকে ফোন! সিরিয়াস ব্যাপার। মাজেদা বেগম বুঝে উঠতে পারেন না।

মোবাইল টিপতে টিপতে নাসিম সামনে এগিয়ে যায়। আবার নীলুর ফোন। রিসিভ করে বলে, হ্যাঁ, বলো। নীলুর ঝাঁজালো কণ্ঠ, কী আর বলব। আমি কত নম্বর সিরিয়াল? আমার আগে পরে কতজন আছে?

-মানে!

-আমি বাথরুমের লোক! বাথরুমে সিরিয়াল দেওয়া ছিল? সাফ বলে দিচ্ছি জীবনে আর কোনোদিন আমার সঙ্গে কথা বলবে না।

নাসিম চমকে ওঠে। সিরিয়ালে গণ্ডগোল বেধে গেছে। নীলু ফোন কেটেই ক্ষান্ত হয় না, বন্ধ করে দেয়। খালার কাছে আসতেই দেখে সিরিয়ালের অবস্থা সিরিয়াস। সামনের দিকে মারপিট শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে মারপিট ছুটে আসছে পেছনের দিকে। মাজেদা বেগম চোখ ছানাবড়া করে দাঁড়িয়ে আছেন।

-ও খালা চলো। দৌড় দিতে হবে। সিরিয়ালে আগুন লেগেছে।

-কী বলিস! সিরিয়ালেও আগুন লাগে!

-খালা বেঁচে থাকলে অনেক কথা বলা যাবে, আগে পালাই।

মাজা ব্যথা নিয়ে মাজেদা বেগম পড়িমরি করে ছোটেন। সামনে নাসিম। কোনোরকম হাসপাতালের গণ্ডিটা পেরিয়ে নাসিমকে বলেন, আর পারছি না। আমি মরে গেলাম।

-এই তো। চলে এসেছি। গাড়িতে উঠে পড়লেই হয়। রাস্তায় অটোরিকশা, রিকশা সিরিয়ালি দাঁড়িয়ে আছে। প্রতি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে চালক। হাঁক ছাড়ে নাসিম, এই যাবেন?

-যাব বলেই তো দাঁড়িয়ে আছি।

-চলুন।

-কিসে যাবেন?

নাসিমের মন ভালো না। মন ভালো না থাকলে ভালো কথাও ভালো লাগে না। এ বেচারা বলছে ফালতু কথা। অটোরিকশা নিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, কিসে যাবেন!

-তোমার এইটা কি বাস, ট্রেন, প্লেন, রকেট, হেলিকপ্টার? রূপ বদলায়?

-মানে!

-ওই যে বললে, কিসে যাবেন। বিমানে যাব। চলো। তোমার এই ভড়ভড়ি মার্কা গাড়ি নিয়ে আধা কিলোমিটার যাওয়ার পর সাঁই করে ফ্লাই করবে। সব মানুষ অবাক হবে। চলো।

চালক আবার সে একই কথা বলে, কিসে যাবেন?

নাসিমের মেজাজ পুরোপুরিই গরম হয়ে যায়, এই ব্যাটা আমি কী তোর সঙ্গে ফাজলামি করছি? চালায় অটোরিকশা, বলে কিসে যাবেন, কিসে যাবেন। ইস, ভাবসাবে মনে হয় যেন বিমানের পাইলট।

চালকের উত্তেজিত হওয়ার কথা। বেচারা উল্টো ফিক করে হেসে দেয়। ভুল বোঝেন ক্যান স্যার। আমি তো বলছি আপনি গ্যাসে যাবেন, না তেলে যাবেন, মিটারে যাবেন না ভাড়ায় যাবেন, সাধারণ যাবেন না রিজার্ভ যাবেন। দ্রুত যাবেন, না আস্তে যাবেন। দেখেশুনে যাবেন, না ঝাকি খেয়ে খেয়ে যাবেন…..

-এই ব্যাটা থাম। তোর লম্বা ফর্দ শোনার সময় নেই। খালাকে নিয়ে সামনে পা বাড়ায়। পেছন থেকে চালক চিৎকার দেয়, যাবেন না স্যার।

-তোর যাওয়ার নিকুচি করি। আরও লম্বা সিরিয়াল বানিয়ে ক্যানভাসারদের মতো লেকচার দে। মাজেদা বেগম অসহায়ের মতো বলেন, সবখানে কী সিরিয়াল শুরু হলো রে নাসিম! কিছুটা পথ হেঁটে তারপর রিকশা ঠিক করে খালাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে একটা বোঝা নামায়। মাথার ভেতর নীলু ঘুরপাক খাচ্ছে। বুকের ভেতর অশান্তি। নীলু, চিন্তা, অশান্তি। এসব নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকে। সকালে শীত দুপুরে গরম। সকালের পোশাক দুপুরে যন্ত্রণার বস্তু হয়ে উঠছে। একটা দশতলা বিল্ডিং দেখে থমকে দাঁড়ায়। নয়তলায় মাসুম ভাই থাকেন। মাসুম ভাই বয়সে অনেক বড় হলেও বন্ধুর মতো আচরণ করেন। মাসুম ভাইয়ের বাসায় গিয়ে প্রথমেই মোবাইলটা বের করে। নীলু ব্লক করেছে। সিরিয়ালি ম্যাসেজগুলোর দিকে চোখ বুলায় নাসিম। তোমার কী মনে পড়ে প্রথম দিনের কথা।

কীভাবে ভুলি।

আচ্ছা, তুমি আমাকে কত ভালোবাসো?

বড় সিরিয়াল, অনেক মানুষ।

মানে! তুমি কী আরও কারও সঙ্গে…..? উত্তর দাও। অন্য কার সঙ্গে চ্যাট করছ?

সময় লাগবে। দেখেন না পৃথিবী পর্যন্ত ঘোরে। সব সময় কি এক জায়গায় থাকে।

-দেখেন না মানে! তারপর ম্যাসেঞ্জারে কল। রিসিভ কল! খালার সঙ্গে মোবাইল টিপতে টিপতে যে কথা হয়েছে ভুল করে সে কথাগুলোই লেখা হয়ে গেছে। কল কাটতে গিয়ে কখন যে একটা রিসিভ হয়েছে সেটাও অজান্তেই। নীলুকে কীভাবে বোঝাবে এসব। মাসুম ভাই হাত ধরে বলেন, যখনি আসিস মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকিস। নাসিম বোকার মতো মাসুম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। শামীমা ভাবি যেমন টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছেন, ঠিক তেমন। মাসুম ভাইয়ের আড়াই বছরের সন্তান, ন্যাংটো অবস্থায় পাশের রুম থেকে দৌড়ে আসে। দেড় হাত মতো পা ফাঁক করে রিমোট হাতে নিয়ে কিছুটা বীরের মতো টিভিটা অফ করে দেয়। কী হচ্ছে না হচ্ছে সেটা না বুঝে, মুহূর্তেই। চটাস করে আছড়ে পড়ে পেছনে বসে থাকা মা নামক ভদ্র মহিলার পাঁচ আঙুলের বিরাট থাপ্পড়। ছোট শিশুটা হুড়মুড় করে মুখ থুবড়ে সামনে পড়ে। ভদ্র মহিলার সেদিকে লক্ষ্য নেই। হাত থেকে ছিটকে পড়া রিমোটটি হাতে নিয়ে গদগদ করতে করতে বলেন- ইসসস্‌ ! মায়ের মমত্ব সিরিয়ালটার কতখানি বাদ পড়ে গেল রে…।

নাসিম বিড়বিড় করে বলে, সিরিয়াল সিরিয়াস।
৪ ফেব্রুয়ারী- ২০১৯, দৈনিক সমকালে প্রকাশিত।

হ্যাপির ঘাড়ে আনহ্যাপি

হারুন সাহেব রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন। গোলগাল ফর্সা চেহারার পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষটার চেহারায় চিন্তার রেখা। চোখ দুটো বন্ধ করে দোল খাচ্ছেন।

-স্যার, আসি। দবির। পুরোনাম দবির উদ্দিন। হারুন সাহেবের ধার না, প্রতিষ্ঠানের সব চেয়ে বাজে লোকটাকেই তাকে দেওয়া হয়েছে। এক সপ্তাহ উইদাউট পারমিশনে ছুটি ভোগ করে অফিসে এসেছে। এ লোকটা অফিসে না এলেই ভালো হয়।

-হ্যাপি নিউইয়র্ক স্যার।

-হোয়াট!

-সরি স্যার, হ্যাপি নিউ ইয়ার।

-কিসের হ্যাপি? হ্যাপি কী! নিউ ইয়ারের সাত দিন পরে হ্যাপি থাকে?

-স্যার আমি আইসিটি ডিভিশনের হ্যাপি মেয়েটার কথা বলছি না।

-ননসেন্স।

-পুরা না স্যার, কিছু সেন্স আছে।

-দবির।

-জি স্যার।

-আমি চিন্তিত, আজকের দিন যদি আমার জন্য হ্যাপি হয়, তবে আনহ্যাপি কবে হবে আর কাকে বলে! তার বিরাট একটা ব্যাখ্যা দরকার হবে।

-চিন্তা করেন কেন স্যার? কী ব্যাখ্যা বলেন।

-আমার মেয়েটাকে খুঁজে পাচ্ছি না, ব্যাখ্যা কর-

দবির তো তো করে, কোন ক্লাসে যেন ব্যাখ্যা পড়েছিলাম!

হারুন সাহেব রেগে ওঠেন, তুমি কেন এসেছ তাই বল।

-স্যার নতুন বছরের সপ্তম দিন। হ্যাপি নিউ ইয়ার দিতে এলাম।

-আচ্ছা যাও। দবির মুখে একরাশ হাসি নিয়ে বেরিয়ে যায়। লজ্জা বলতে কোনো জিনিস লোকটার ভেতর নেই। দবির বেরিয়ে যেতেই হ্যাপি মেয়েটা হাজির।

স্যার আমাকে ডেকেছেন?

-না তো। কে বলল?

-আমার নাম বলাবলি হচ্ছে শুনে ছুটে এলাম।

হারুন সাহেব কাঁদবেন না হাসবেন বুঝে উঠতে পারেন না। খুশির দিনও কেন যেন সব মানুষ সব সময় খুশি হতে পারে না। খুশির দিনেও কেউ কেউ মুখ ভার করে বসে থাকে। কেউ আনমনা হয়ে বসে বসে দূর আকাশে উড়ে যাওয়া চিল কিংবা শকুন দেখে। শকুনের কাজ কী! হারুন সাহেব শকুন বিশেষজ্ঞ নন। তবে শকুনকে পানিতে ভাসা মরা মড়ি খেতে দেখেছে। দুঃখ নিয়ে খুশির দিনে মানুষ শকুন দেখে কেন! শকুনই-বা আকাশে ওড়ে কেন! অনেক কথা। কিছু শকুন আকাশে, কিছু শকুন মাটিতে! কিছু শকুন ওড়ে, কিছু শকুন হাঁটে। কিছু শকুন শকুনের মতো আর কিছু শকুন দেখতে মানুষের মতো! মোবাইল বেজে ওঠে। শব্দগুলো কান্নার মতো মনে হয়। হ্যালো বলতেই ওপাশে হাসির কণ্ঠ। নাম হাসি। হারুন সাহেবের সাতাশ বছরের স্ত্রী। বয়স সাতাশ নয়। তার সাথে সংসার জীবনের বয়স সাতাশ। নাম হাসি হলেও জীবনে কবে যে হাসিমুখ দেখা গেছে মনে করতে পারেন না হারুন সাহেব। নিতুর কোনো খোঁজ পেলে?

-কিসের নিতু?

-নিতু। আমাদের একমাত্র মেয়ে…

-নিতু নামে আমার কোনো মেয়ে নেই।

-কী যা তা বলছো।

-যে মেয়ে বছরের প্রথম দিন বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়, সে আমার মেয়ে হতে পারে না।

টিপ দিয়ে কল কেটে দেন। মোবাইলের গলা থাকলে টিপে ধরতেন। চিন্তায়-দুশ্চিন্তায় অফিস টাইম পেরিয়ে যায়। সন্ধ্যা নামে। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। একসময় শীত মজার ছিল। বয়সের সাথে সাথে শীত এখন এক আতঙ্ক। নিজে তিন-চারটা মোটা সোয়েটার গায়ে দিলেও খোলা আকাশের নিচে বহু শীতার্ত মানুষ। একটাও গরম কাপড় নেই। নিচে নেমে অফিসের সামনেই দেখেন দবির উদ্দিন উচ্চকণ্ঠে বুলি আওড়াচ্ছে। সাথে বিপল্গব বাবু। জানতে চান- এক সপ্তাহ অফিসে আসেনি কেন। কী অবস্থা? দবির খেপে ওঠে, রাখেন তো ভাই অবস্থা। অবস্থা অবস্থায় বন্দি।

-মানে!

-মানে আর কী! অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ছে। তিনটা জ্যাকেটে বিভিন্ন রকম অবস্থা চেইন দিয়ে আটকায় রাখছি কিন্তু…

-কী?

-দুর ভাই, আপনি কথা বোঝেন না। শীতে অবস্থা কাহিল। হারুন সাহেব পাশ কাটিয়ে রাস্তায় নামেন। ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস কান-মুখ ছুঁয়ে যায়। মোবাইলটা বেজে ওঠে। হাসি। রিসিভ করতেই প্রশ্ন করে, কোনো খবর পেলে? এক সপ্তাহ ধরে মহিলাটা কান ঝালাপালা করে ফেলছে।

-কীসের খবর?

-তুমি তো পিতা না, পিতা নামের কলঙ্ক। খেঁকিয়ে ওঠে হাসি। হারুন সাহেব কেন যেন ফিক করে হেসে ওঠেন।

‘চিন্তা কোরো না হাসি বেগম। তোমার মেয়ে খুব সম্ভব কারও হাত ধরে ভেগেছে। ভাগার জন্য হয়তো নতুন বছরটা বেছে নিয়েছে। হ্যাপি ইয়ার, হ্যাপি পেয়ার, হ্যাপি লাইফ, হ্যাপি…’

-ছিঃ, তোমার কথা শুনে আমার ঘেন্না লাগছে।

-কবেই বা মধুর লাগল! ওপাশ থেকে লাইন কেটে দেয় হাসি বেগম। শীতের রাতে চা খেলে মন্দ হয় না। রাস্তার পাশে চায়ের স্টলে গিয়ে বসে। সাধারণত রাস্তার পাশের চা দোকানগুলোতে গবেষক, রাজনীতিবিদ, জ্ঞানী, দেশপ্রেমিক, বুদ্ধিজীবীদের ভিড় থাকে। হারুন সাহেবের মন্দ লাগে না। ঢুকতেই শোনেন একজন বলছে, নিউ ইয়ারের রাতে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে এক মেয়ে। এগুলো মানুষ না। হারুন সাহেবের বুকের ভেতর খাঁ খাঁ করে ওঠে। তার নিতুর এমন কোনো বিপদ…! বিড়বিড় করে বলেন, হ্যাপির ঘাড়ে আনহ্যাপি চেপে বসল না তো!

( ০৭ই জানুয়ারী দৈনিক সমকালে প্রকাশিত )

টাটকা রস টাটকা ঠাণ্ডা

বহুদিন পর গ্রামে এসেছে মনির। ঢাকা থেকে আট ঘণ্টার যাত্রাপথে কিছুটা ক্লান্ত। বাস ভ্রমণে পাশের সিটের যাত্রী প্রথম দিকে বেশ প্রফুল্লচিত্তে গল্প শুরু করে। মোটাসোটা চল্লিশোর্ধ্ব মানুষ। গায়ে পোশাক জড়িয়ে নিজেকে ছোটখাটো একটা টিলা বানিয়ে বসে।

– খুব শীত পড়েছে।

– হুঁ, খুব শীত।

– কুয়াশা কাটলে শীত কমবে।

মনির চুপ। লোকটা আবার বলে, গাড়ি-ঘোড়া বেড়ে গেছে। শুধু জ্যাম আর দুর্ঘটনা।

– ঘোড়াও বেড়েছে নাকি!

লোকটা খিলবিল করে হেসে ওঠে। এ যুগের ঘোড়া হলো বাইক, বুঝলে। দেখ না বাইকে সাওয়ার হয়ে কীভাবে ঘোড়ার মতো ছুটে চলা…

যখন কুয়াশা কেটে শীতের সকালের মিষ্টি রোদ বাসের জানালা ভেদ করে গায়ে পড়ে তখন সহযাত্রী ঘুমে বিভোর। একেকবার মনিরের গায়ের ওপর ঢলে পড়া। একেকটা চাপ। মনির তার দৈহিক চাপে কোণঠাসা। এই বুঝি বাসের লোহালক্কড় ভেঙে বাইরে ছিটকে পড়ে। শেষমেশ একেবারে অসহ্য হয়ে বলে, আরে ভাই কী শুরু করেছেন?

লোকটা বিড়বিড় করে তাকায়। মৃদু শব্দে বলে, ঘুম।

– রাতে ঘুমাননি!

– না। সে সময় একজন হকার পেপার নিয়ে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসে- গরম খবর। এই পেপার। পেপার নিন। গরম খবর। কাছাকাছি আসতেই লোকটা ঘুম ভাঙা লাল চোখে খেঁকিয়ে ওঠে, এই ব্যাটা, ভাগ। শীতে বাঁচিনা উনি এসেছে গরম খবর নিয়ে। শীতকালে সব শীতল খবর। তোর পেপারও দেখ ঠাণ্ডা। হকার পেপারগুলো এক হাতে শক্ত করে চেপে ধরে লোকটার কানের কাছে এসে বলে, ভাগ মানে!

– কানের কাছে ঘ্যা ঘ্যা করিস না, যা।

– গাড়ি কি আপনি কিন্যা লইছেন?

– আবার মুখের ওপর কথা বলিস?

– ক্যান, আপনে কি মন্ত্রী! শপথ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন?

– আমি মন্ত্রী হলে তোর কি বেঁচে থাকা হতো?

– হেইডার জন্যই তো আপনে মন্ত্রী না। ছাগল।

– কী বললি!

– হাত চালাইনি। নাকের ওপর বইলা দিমু কইলাম।

অবস্থা ক্রমান্বয়ে সাংঘর্ষিক হতে চলে। মনির থামায়। কিছু মনে করো না, যাও ভাই। ছেলেটা কথা শোনে। ও যাওয়ার আগে একটা পেপার নেয়। প্রথম পাতার খবর- শিশু ধর্ষণের চেষ্টা, না পেরে হত্যা। বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। পৃথিবীর পশুগুলো কি এতটা নিকৃষ্ট? পাষাণ! ভাবনাগুলো সঙ্গে নিয়েই গন্তব্যে পৌঁছানো। বাড়িতে উপস্থিত হতেই একঝাঁক স্বজন ঘিরে ধরে। বেশ রাত পর্যন্ত চলে খোশগল্প। বাড়িতে এলে জুলয়াসের সঙ্গেই থাকা হয়। চাচাতো ভাই। সমবয়সী হওয়ায় বন্ধুর মতো। সবাই চলে যেতেই জুলয়াস ফিসফিসিয়ে বলে, চল রস খেয়ে আসি। একেবারে টাটকা।

– চুরি?

– কাল না হয় পয়সা দিয়ে দেব।

টাটকা রস খাওয়ার লোভ সামলাতে পারে না। আচ্ছা চঞ্চল আর ঝিলটনকে খবর দে। এত রাতে দু’জন যাওয়া রিস্কি। ওদের মোবাইল করতেই রাজি হয়ে যায়। বহুদিন পর চার বন্ধু টাটকা রস খাবে। মজাই আলাদা। কনকনে শীত উপেক্ষা করে ওরা রাস্তা ধরে সামনে এগিয়ে যায়। শহরে শীত খুব একটা অনুভব করা না গেলেও গ্রামে এখনও শীতের প্রকোপ, দাপট বোঝা যায়। বেশ খানিকটা ঘুরে খেজুর বাগানে পৌঁছে। বিলের ধারে সারি সারি খেজুর গাছ। হীম শীতল ঠাণ্ডা বাতাস। সিদ্ধান্ত হয়, চঞ্চল গাছে উঠবে। নিচে হেল্প করার জন্য থাকবে মনির। রস নামানো হলে সেটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জুলয়াসের কাছে পৌঁছে দেবে মনির। জুলয়াস পৌঁছে দেবে নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা ঝিলটনের কাছে। ব্যস। এভাবে জমা হবে টাটকা রস। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হয়। সবার আগে ঝিলটন অন্ধকার ভেদ করে এক আগন্তুককে এগিয়ে আসতে দেখে। পাশেই গাছের আড়ালে নিজেকে লুকায়। মতি কাকা! খবরটা ওদের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ হয় না। জুলয়াস মতি কাকার দিকে এগিয়ে আসে। ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ঝিলটন।

মতি মিয়া অন্ধকারে বসে ছিল। বিলের মতো ফাঁকা অল্প পানির জলধারার পাড়ে বসে থাকা তার প্রতিদিনের কাজ। রাতের প্রহরী। অন্ধকারে মানুষের মতো কিছু একটা দেখে এগিয়ে যান। সেও তাকে দেখে এগিয়ে আসে। মতির গায়ের ভেতর কাঁটা দিয়ে ওঠে। কাছাকাছি এসে মতির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে, ওকে? মাথায় উঠে গেছে।

– কী! ওরে বাবা। এত রাতে কী মাথায় উঠে গেল রে বাবা। কে আছিস বাঁচা…

না, ঝিলটন নয়। ঠিক সে সময় বিলের ভেতর ঝপাৎ করে শব্দ হয়। জুলয়াস এক মুহূর্ত দেরি করে না। আড়াআড়ি বিল পেরুলেই বাড়ি। সোজা সেও বিলের মাজা পানিতে নিজেকে আছড়ে ফেলে। চিৎকার, বিলের ভেতর ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দে কেঁপে ওঠে মনির। একই সঙ্গে সুনসান নীরব রাতে বিকট শব্দে রসের ঠিলে পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে। গুঁড়িয়ে যায়। তারপরই পড়ে আস্ত চঞ্চল। মনিরও একই গন্তব্য ঠিক করে। সোজা পথে যত দ্রুত বাড়ি পৌঁছানো যায়। মাজা পানি মাড়িয়ে সমানে দ্রুত এগিয়ে যায় মনির। কিছুটা সামনে ঝিলটন ও জুলয়াস। একটু পরেই পেছনে শোনা যায় পানিতে আছড়ে পড়া ঝপাৎ শব্দ। মিনিট দশেকের ভেতর বিল পেরিয়ে একে একে চরজন জড়ো হয়। মনির কাঁপতে কাঁপতে বলে, রস খাবি না, টাটকা রস? জুলয়াস আড়ষ্ট গলায় বলে, টাটকা ঠাণ্ডায় মরে গেলাম। সব নিথর হয়ে যাচ্ছে। আর কোনো দিন রস খাব না। ওপারে টর্চলাইটের আলোর সঙ্গে ভেসে আসে অনেক মানুষের চিৎকার- ধর ধর। ডাকাত। মুহূর্তে সব কষ্ট উবে যায়। শেষে টাটকা পিটুনিতে প্রাণটাই না চলে যায়।
প্রকাশিত – দৈনিক সমকাল, ১৪.০১.১৯