জিল্লুর রহমান এর সকল পোস্ট

জিল্লুর রহমান সম্পর্কে

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০১৬ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৭ টি উপন্যাস এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়ল অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। সর্বশেষ প্রতিচ্ছবিটি প্রকাশিত হয় অমর একুশে বইমেলা-২০১৭।

প্রিয়ন্তী-১০ (সংস্কারের প্রাচীর ভাঙ্গা তরুণী)

ইতোমধ্যে যতীন বাবু একদিন পরোক্ষভাবে প্রিয়ন্তীর কথা দীপক বাবুকে বলেছে। দীপক বাবু মনে মনে প্রিয়ন্তীর ওপর রেগে গেলেও যতীন বাবুর কথাকে না শোনার ভান করে পাশ কাটিয়েছে।
দূর্গা পূজায় সুশান্তর সঙ্গে প্রিয়ন্তীর মেলামেশা, যতীন বাবুর কথা, বজ ঠাকুরের কান ভারী করা সবকিছু মিলিয়ে দীপক বাবু প্রিয়ন্তীর ওপর খুব রাগান্বিতছিল। তারওপর জামাইবাবুর কথা যেন ভস্মে ঘি ঢাললো। জামাইবাবু প্রিয়ন্তীর কথা আরো হাজারগুণ বাড়িয়ে যখন দীপক বাবুকে বলল, তখন প্রিয়ন্তীর ওপর তার রাগ আরো সহস্রগুণ বেড়ে গেল।
বজ ঠাকুরসহ আত্মীয়-স্বজনদেরঅনেকেই তাকে প্রিয়ন্তীর লেখাপড়া বাদ দিয়ে বিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কিন্তু শত রাগেও প্রিয়ন্তীকে উচ্চ শিক্ষিত করার স্বপ্নটাসে মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি তাই কোনভাবে প্রিয়ন্তীর বিয়ের কথাও ভাবেনি। আজ নিজের জামাই যখন বলল তখন সে কিছুক্ষণ মাথা নত করে বসে রইল।
জামাইকে সে বিশ্বাস করে, সব সময় স্নেহের সঙ্গে কথা বলে। আজ প্রিয়ন্তী সম্পর্কে সে যা বলল তাতে দীপক বাবুর অবিশ্বাস নেই। প্রিয়ন্তী লেখাপড়ায় ভালো তাতে কোন সন্দেহ নেই, হয়ত পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করবে সেটাও মোটামুটি নিশ্চিৎ কিন্তু লেখাপড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে বিয়ে করবে না এই বিশ্বাসটা দিনে দিনে ক্ষীণ হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পর দীপক বাবু যখন মাথা তুলল তখন তার চোখ দু’টো লাল, গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের আভা ষ্পষ্ট। তার মুখচ্ছবিতে যেন সমপ্রতি বয়ে যাওয়া ঝড়ের চিহ্ন। জামাই সত্যই বলেছে, তার কথার প্রতিবাদ করার ইচ্ছাও দীপক বাবুর নেই। প্রিয়ন্তীকে নিয়ে দেখা স্বপ্নটা আজ স্মৃতি থেকে মুহূর্তে মুছে গেল।
দীপক বাবু মাথা তুলে রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, তুমি আমার জামাই, অরুণ ছেলে তোমাদের দু’জনের যা ইচ্ছা হয় করো।
অরুণ বলল, বাবা আমরা আসলে প্রিয়ন্তীর লেখাপড়া বন্ধ করার কথা বলছি না, আজকাল মেয়েরা লেখাপড়া শিখে অনেক বড় অফিসার হচ্ছে, আমাদের সবার ইচ্ছা ছিল সেও একদিন অনেক বড় অফিসার হবে কিন্তু প্রিয়ন্তীর ওপর কি আর আমাদের মান-সম্মান ছেড়ে দেওয়া যায়?
কিন্তু প্রিয়ন্তী যদি রাজি না হয়?
সবাই মিলে তাকে বোঝাতে হবে।
বোঝাও।
বাবা তাহলে প্রিয়ন্তীকে আসতে বলি।
দীপক বাবু মাথা বাঁকিয়ে সায় দিল।

সেদিনের পর থেকে প্রিয়ন্তীর চিন্তার অন্ত নেই। জামাইবাবু সুশান্তকে তার জন্য অপেক্ষা করতে দেখেছে, আবার দুজনে একসঙ্গে বের হবে একথাও জেনে গেছে। প্রথমতঃ সে জটিল প্রকৃতির মানুষ, দ্বিতীয়তঃ তার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে প্রিয়ন্তীর বিয়ে দেওয়ার জন্য তার ইচ্ছাও অনেক বেশি। এতদিন প্রিয়ন্তী তার লেখাপড়ার কথা বলে বিয়ের কথা এড়িয়ে গেছে। অবশ্য তার বিয়ে করার কথা এড়িয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় ভিত্তি ছিল তার বাবা। বাবা ঠিক থাকলে তার আর কাউকে ভয় পাবার কোন কারণ নেই।
প্রিয়ন্তী একবার মোবাইলের ঘড়ির দিকে তাকাল, রাত দশটা বাজে।
তার মোবাইলের রিং বেজে উঠল।
তার দিদি মোবাইল করেছে, হ্যালো প্রিয়ন্তী।
হ্যাঁ দিদি বলো।
ভালো আছিস?
হ্যাঁ, তোমরা সবাই ভালো আছ।
না, আমরা ভালো নেই, বাবার অসুখ, আমি এসেছি তুইও কাল সকালেই চলে আয়।
দিদির কণ্ঠস্বরেতার বাবার অসুখ বলে প্রিয়ন্তীর মনে হলো না। তার কণ্ঠস্বরেকোন অস্বাভাবিকতানেই, একেবারে স্বাভাবিককণ্ঠ।
প্রিয়ন্তী জিজ্ঞেস করল, কী অসুখ দিদি?
বাবার অসুখ, আমি শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছি, তোকে আসতে বলছি, তুই বুঝছিস না। আমি কি ডাক্তার নাকি, কী অসুখ আবার তোকে বলতে হবে। আগে আয়, তারপর দেখবি।
ঠিক আছে দিদি, বলে প্রিয়ন্তী মোবাইল রেখে দিল।
বাবার অসুখ শুনে প্রিয়ন্তীর যেমন ভেঙ্গেপড়ার কথা ছিল সে রকম কিছু হলো না। আবার বাবার অসুখ শুনে চুপ করে থাকতেও চায় না। ক্ষণিকের মধ্যেই যেন তার ঘাড়ের রগ দু’টো ব্যথা শুরু করল। সে জানে যে কোন দুশ্চিন্তায় তার রক্তের চাপ বেড়ে যায় আজো তাই হয়েছে। তার মনে হচ্ছে বাবার অসুখের নাম করে বিয়ে দেওয়ার জন্য এটা একটা কৌশল মাত্র।
প্রিয়ন্তী সুশান্তকে মোবাইল করল, হ্যালো সুশান্ত।
প্রিয়ন্তী বল।
প্রিয়ন্তী রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, সুশান্ত দিদি মোবাইল করেছিল, বাবা নাকি অসুস্থ?
আমি কাল সকালে তোকে তুলে দিয়ে আসছি, তুই বাড়ি যা।
কিন্তু আমার মনে হচ্ছে বাবা অসুস্থ না।
তবে?
সুশান্ত আগেও আমাকে একবার বিয়ে দিতে চেয়েছে কিন্তু আমি বিয়ে করিনি। অবশ্য তখন আমার মনোবল ছিল। কিন্তু এবার আমরা দূর্গা পূজায় একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতে বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেছে। তারওপর সেদিন জামাইবাবু তোকে আমার মেসে অপেক্ষা করতে দেখেছে। হয়ত সে রকম কোন চেষ্টা আবারো হচ্ছে।
তাহলে কী করবি? বাড়ি যাবি না?
বাবার অসুখ শুনেও বাড়ি না গেলে হয়?
তাহলে সবাই যদি তোকে বিয়ে দিতে চায়?
চাইলেই বিয়ে দিতে পারবে? তুই আমার ওপর বিশ্বাস রাখ, আমি সোজা তোর কাছে চলে আসবো।
হ্যাঁ, অবশ্যই আসবি।
তারচেয়ে আমি বলি তুই সিঁদুর পরে যা, তাহলে কেউ আর বিয়ের কথা বলতে পারবে না।
না সুশান্ত তুই আমার ওপর বিশ্বাস রাখ, প্রিয়ন্তীর শেষের কথাগুলোতে তার দৃঢ় মনোবল ফুটে উঠল।
প্রিয়ন্তীর চোখে ঘুম নেই। অনেক আজে-বাজে স্বপ্নেরমাঝে বার বার করে তার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। সে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করছে। প্রিয়ন্তীর মোবাইলের রিং বেজে উঠল।
একটা অপরিচিত নাম্বারথেকে কল এসেছে, সে রিসিভ করল, হ্যালো নমস্কার।
নমস্কার, আপনি কি প্রিয়ন্তী চক্রবর্তী বলছেন? নারী কণ্ঠের আওয়াজ, কণ্ঠস্বরেবেশ বিনয় আছে।
হ্যাঁ বলুন।
আমার নাম বর্ণালী। আমি অনেক কষ্টে আপনার মোবাইল নাম্বারযোগাড় করেছি।
বলুন আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?
বিদ্যুতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। আমি ওকে খুব ভালোবাসি, এক সময় ও আমাকে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু এখন শুনছি আপনার সঙ্গে নাকি ওর বিয়ে।
আমার বিয়ে, আমি তো কিছু জানি না।
শুনলাম বিয়ের কথাবার্তা নাকি এক রকম পাকাপাকি হয়েছে, শুভ দিনক্ষণ দেখে একটা তারিখও নির্ধারিত হয়েছে।
বর্ণালী আমি আসলে কিছু জানি না, আপনার মুখ থেকে বিদ্যুতের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা শুনলাম। যাক আপনি আমাকে জানিয়ে খুব ভালো করেছেন, না হলে হয়ত আমাকে অনেক ঝামেলায় পড়তে হতো।
বর্ণালী মিনতির সুরে বলল, দিদি আমাকে কথা দিন আমার বিদুৎকে আপনি কেড়ে নিবেন না?
আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি আপনার বিদ্যুৎকে বিয়ে করব না। আপনি আমারো উপকার করলেন। আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।
রাখি দিদি, ভগবান আপনার মঙ্গল করুন।
মোবাইল রেখে দিয়ে যেন প্রিয়ন্তী হাফ ছেড়ে বাঁচলো। তার হৃৎপিণ্ড দ্রুত চলতে লাগল। কয়েকমিনিট পর সে সুশান্তকে মোবাইল করল।
সুশান্ত রিসিভ করল, হ্যালো প্রিয়ন্তী ঘুমাসনি?
না।
কেন?
সুশান্ত একটা ঘটনা ঘটে গেছে।
কী ঘটনা?
প্রিয়ন্তী বর্ণালীর মোবাইল করার কথা বলে বলল, সুশান্ত তোকে আমার জন্য অনেক ঝড় সামাল দিতে হবে।
দিব।
চল আমরা কালকে এ্যাফিডেভিট করে বিয়ে করি।
কিন্তু আমি তো এত সব বিষয় জানি না।
জানিস না এখন জানতে হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে, আমি দেখছি, তুই কিচ্ছু ভাবিস না।
তুই সব ম্যানেজ করতে পারবি?
পারতে হবে, যে কোন মূল্যে আমাকে পারতে হবে। আমি তোকে হারাতে পারবো না প্রিয়ন্তী।
আমিও।
চলবে…
আমার এই উপন্যাসটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:প্রিয়ন্তী-০১ (সংস্কারের প্রাচীর ভাঙ্গা তরুণী)

প্রিয়ন্তী-০৯ (সংস্কারের প্রাচীর ভাঙ্গা তরুণী)

Prionti
দীপক চক্রবর্তীর সঙ্গে তার প্রতিবেশী যতীন বাবুর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। যার বহিঃপ্রকাশ নেই, দুই পরিবারের মধ্যে এই দ্বন্দ্বের কারণ সকলের জানাও নয়। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। দুজনের লোক দেখানো সখ্যতাও আছে কিন্তু দ্বন্দ্বটা কীসের তা কেউ কোনদিন কাউকে মুখ ফুটে বলে না। দারিদ্রের দ্বন্দ্বকে ঝগড়া বলে যা মানুষের মুখে মুখে মুখরোচক কথার খই ফোটায় কিন্তু ধনীর দ্বন্দ্বের কথা সংকোচের সঙ্গে উচ্চারণ করতে মানুষ ইতস্তত করে।
এই মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের কথা বজ ঠাকুর জানতো কী না তা দুজনের কেউ-ই জানে না। পুরোহিত হিসেবে, ধর্মগুরু হিসেবে বজ ঠাকুরের প্রতি দীপক বাবুর শ্রদ্ধার কমতি নেই কিন্তু বার বার করে তার পারিবারিক সম্মান নিয়ে বজ ঠাকুরের আচরণ দীপক বাবুর মনে তার প্রতি একটা ঘৃণা সৃষ্টি করেছে।
সেদিন পথিমধ্যে বজ ঠাকুরের সঙ্গে যতীন বাবুর সাক্ষাৎ হলো। সাক্ষাৎটা ঘটনাক্রমে নয়, বজ ঠাকুর এক রকম ইচ্ছা করে যতীনের সঙ্গে দেখা করল, যতীন তোমাকে মনে মনে খুঁজিতেছিলাম।
কেন ঠাকুর মশাই?
রাম, রাম কী যে কলিযুগ আসিলো। আমি বাপু তোমাকে কথাটা বলিতে চাহি নাই কিন্তু কী করিব সমাজে একটা কলংক রটিয়া যাইলে তো আর জাত বলিতে কিছু থাকিবে না। তুমি কিছু মনে করিও না, আমি গোটা সমাজের মঙ্গল চাই বলিয়াই শুধু তোমাকে বলিতেছি।
আজ্ঞে ঠাকুর মশাই, বলুন।
ব্যাপারটা তোমার না, তবু তোমাকেই বলিতেছি।
আজ্ঞে বলুন।
বজ ঠাকুর একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে চাপাস্বরেবলল, দীপকের মেয়ে প্রিয়ন্তী একটা নিচু জাতের ছেলের সহিত যেইভাবে ঢলাঢলি করিতেছে, ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ। এইভাবে অনাচার করিলে সমাজ রসাতলে যাইবে। তোমার সঙ্গে বাপু দীপকের ভালো সম্পর্ক তুমি ইশারা ইঙ্গিতে একটু বুঝাইয়া বলিও। বিষয়টা এখনো তেমন কেউ জানে না, জানিলে সমাজের কাছে আমি যে কী জবাব দিব ভগবানই জানেন।
আচ্ছা ঠাকুর মশাই দীপকের সঙ্গে দেখা হলে আমি বলব।
যতীন বাবুর সঙ্গে বজ ঠাকুরের একথার কয়েকদিন গত হলো সে মনে করেছিল যতীন বাবু বিষয়টা দীপক বাবুর সঙ্গে আলোচনা করে ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলবে কিন্তু তার কোনটাই ঘটতে না দেখে একদিন বজ ঠাকুর নিজেই দীপক বাবুর সঙ্গে কথা বলল।
দীপক হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিল। ঠাকুর হাতের ইশারায় ডাকল, এই যে দীপক কোথাও যাইতেছ নাকি?
আজ্ঞে ঠাকুর মশাই।
কয়েকদিন ধরিয়া একটা কথা তোমাকে বলিব বলিব ভাবিতেছিলাম কিন্তু তোমাকে সেইভাবে দেখাও পাইনা আর কথাটা বলাও হয় না।
কী কথা বলে ফেলুন?
দীপক বাবু বজ ঠাকুরকে কৈশোর থেকে চিনে সে যখন কিছু বলবে বলে ভাবছে তখন নিশ্চয়ই সেটা ভালো কিছু না। হয়ত আবার কোন সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ করার কথা বলবে। তার তো মন্দিরে পূজা দেওয়া আর সমাজকে অনাচার থেকে বিরত রাখা ছাড়া কোন কাজ নেই।
তোমার মনে হয় তাড়া আছে, তাহা হইলে থাকুক আরেকদিন বলিব।
না, বলার সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছেন তখন বলে ফেলাই ভালো।
আমি তোমাদের ভালো চাই বলিয়া বলিতেছি।
দীপক বাবু রাগান্বিত স্বরেবলল, হ্যাঁ আপনি আমার ভালো চান বলেই তো বলবেন। তবে তাড়াতাড়ি বলুন আমার আবার কাজের তাড়া আছে।
বিষয়টা না বলিলেই নয় বলিয়া বলিতেছি, কথাটা ধীরে ধীরে সবার কানে চলিয়া যাইলে তো ভীষণ একটা খারাপ কাজ হইবে।
ঠাকুর মশাই কী কথা বলে ফেলুন?
আমি বলিতেছলাম তোমার মেয়ে প্রিয়ন্তীর কথা।
কী হয়েছে প্রিয়ন্তীর?
দীপক বাবু বজ ঠাকুরের কাছ থেকে কোন পরামর্শ চায়নি তবুও ঠাকুর তার সংসারের বিভিন্ন বিষয়ে উপযাচক হয়ে পরামর্শ দেয়। দীপক তার পরামর্শ শ্রবণ করে কিন্তু যা করে তা নিজের বুদ্ধিতেই, তুমি বাপু এক কাজ করো?
কী কাজ?
ভালো সম্বন্ধ পাইলে প্রিয়ন্তীর বিবাহ দিয়ে দাও।
ঠাকুরের অযাচিত পরামর্শে দীপক বাবুর সমস্ত গা জ্বলে উঠল, ঠাকুর মশাই আমি আমার মেয়েকে বিয়ে দিব কী না সেটা আমি বুঝব, আপনার এতটা চিন্তা না করলেও চলবে। সমাজের যেন কোন অনাচার না হয় সেটাও আমি দেখব।
তুমি দেখিলে তো হইবে না বাপু, সমাজের অনাচার দেখার দায়িত্ব সবার। তবে এই যাত্রায় কথাটা যেন কেউ না জানে বা কেউ কেউ জানিলেও আমি সেটা মানাইয়া লইব।
দীপক বাবু কোন কথা বলল না। তার বুকের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে গেল। মনে মনে সে প্রিয়ন্তীর ওপর প্রচণ্ড রেগে গেল। কিছুক্ষণ পর তার ছেলে অরুণ দোকানে এলে সে বাড়িতে চলে গেল, যাওয়ার সময় বলে গেল সে আজ আর দোকানে আসবে না।
দীপক বাবু কোনদিন বিকেলবেলা বাড়িতে আসে না। সাধারণত অনেক রাতে বাড়িতে আসে, বাড়িতে ঢোকার সময় অরুণের মা, অরুণের মা বলে ডাকতে ডাকতে ভিতরে ঢুকে, আজ সন্ধ্যা বাতি জ্বালানোর আগেই অরুণের নাম ধরে না ডেকে গম্ভীর কালো মুখ নিয়ে সোজা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করল।
বাসন্তী অনেক বছর যাবৎ সংসার করছে, সে খুব সহজে দীপক বাবুকে রাগ করতে কিংবা ভেঙ্গে পড়তে কিংবা মুখ ভার করতে দেখেনি আজ তার চোখে মুখে এক অস্বাভাবিকতাদেখে সে জিজ্ঞেস করল, তোমার কী হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
বাসন্তী একবার মোবাইলটা দাও তো।
বাসন্তী দীপক বাবুকে মোবাইলটা দিল।
দীপক মোবাইলটা হাতে নিয়ে প্রিয়ন্তীকে মোবাইল করল। কিন্তু প্রিয়ন্তীর মোবাইল ব্যস্ত আর ব্যস্ত। দীপক বাবু প্রচণ্ড রেগে গেল।
অনেকক্ষণ পর প্রিয়ন্তীর মোবাইলের ব্যস্ততা শেষ হলো।
প্রিয়ন্তী মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো বাবা।
কার সঙ্গে কথা বলছিলি এতক্ষণ?
বাবার কণ্ঠস্বরগম্ভীর, ভয়ংকর, তার বাবার রক্তাক্ত চোখ দু’টো যেন প্রিয়ন্তীর চোখের সামনে ভেসে উঠল, বাবা।
আমি জানতে চাচ্ছি তুই এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
আমার এক ফ্রেণ্ডের সঙ্গে।
ফ্রেণ্ড, ফ্রেণ্ড করেই তুই আমাকে ডুবাবি। তোকে আমি লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছি, বন্ধুত্ব করতে নয়। তোর নামে আজ এক অভিযোগ, কাল এক অভিযোগ, এসব শুনতে শুনতে আমার কখনো কখনো মনে হচ্ছে তোর লেখাপড়া বাদ দিয়ে তোকে বিয়ে দিয়ে দিই।
প্রিয়ন্তীর কণ্ঠ শুকিয়ে গেল। সে ভীত কণ্ঠে বলল, বাবা কী হয়েছে?
বাসন্তী কাছেই দাঁড়িয়েছিল, সে চাপাস্বরেবলল, চুপ করো, মেয়েকে মানুষ এভাবে কথা বলে? তারওপর আবার মোবাইলে।
বাসন্তী কথা শুনে দীপক বাবু একটু ক্ষান্ত হলো, থাক মোবাইলে সব বলছি না, তবে তুই যদি লেখাপড়া করতে চাস তবে তোকে ঐ ছোট জাতের ছেলেটার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে।
বাবা।
হ্যাঁ, কথাটা মনে রাখবি আর যদি কোনদিন কথাটা আমার কানে আসে তবে কোনদিন আর আমার বাড়ির দিকে মুখ করে তাকাবি না। সোজা ঐ দত্তের বেটার সঙ্গেই চলে যাবি। আর হ্যাঁ মোবাইল প্রয়োজনীয় কথা বলার জন্য, বলে দীপক বাবু প্রিয়ন্তীকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই রেখে দিল।

সেদিন বাবার সঙ্গে কথা বলার পর প্রিয়ন্তী অনেকটা সাবধান হয়ে গিয়েছিল। সুশান্তর সঙ্গে খুব সহজে দেখা করতো না। তার এক বান্ধবীর মোবাইলে সুশান্ত মোবাইল করতো, প্রিয়ন্তী নিজের মোবাইলকে সব সময় ফ্রি রাখতো। কিন্তু তাতেও রক্ষা হলো না একদিন প্রিয়ন্তীর জামাই বাবু রাজশাহী এলো। শহরে কাজ সেরে সে এলো প্রিয়ন্তীর মেসে।
গার্ডের মাধ্যমে প্রিয়ন্তীকে খবর দিতেই সুশান্ত এসে দাঁড়ালো। তার সঙ্গে জামাইবাবুর পরিচয় নেই, খুব সম্ভব তার সঙ্গে প্রিয়ন্তীর কথা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে, আর গার্ড প্রিয়ন্তীকে খবর দিতে গেল এইমাত্র।
কিছুক্ষণ পর প্রিয়ন্তী এলো।
প্রিয়ন্তীকে দেখে সুশান্ত বলল, প্রিয়ন্তী তাড়াতাড়ি চল দেরি হয়ে গেল।
প্রিয়ন্তী ইশারা করল কিন্তু সুশান্ত বুঝতে পারল না।
স্বাভাবিকভাবেপ্রিয়ন্তী জামাইবাবুকে কখনো প্রণাম করে না, নমস্কারদেয় কিন্তু আজ সুশান্তকে জামাইবাবুর গুরুত্ব বোঝাবার জন্য প্রণাম করল।
জামাইবাবু প্রিয়ন্তীর চালাকি বুঝতে পেরেছে সে দেখেও কিছু বলল না। তার মনে সন্দেহ হলো এই ছেলেই নিশ্চয়ই প্রিয়ন্তীর সেই ফ্রেণ্ড।
সুশান্ত আর জামাইবাবুকে এক সঙ্গে দেখে তার বুক শুকিয়ে গেল।
প্রিয়ন্তী এই ছেলেটির নাম সুশান্ত?
প্রিয়ন্তী সুশান্তকে আবার ইশারা করল কিন্তু সুশান্ত তার দিকে না তাকিয়েই সে বলল, হ্যাঁ।
তুমি সুশান্তর সঙ্গে কোথাও যাবে নাকি?
প্রিয়ন্তী থতমত খেলো, হ্যাঁ স্যারের কাছে কোচিং আছে।
সুশান্ত কিছু বলল না।
প্রিয়ন্তী জামাইবাবুর কাছ থেকে বাড়ির খোঁজখবর নিয়ে চলে গেল।
জামাইবাবু চলে যাবার পর প্রিয়ন্তী সুশান্তকে বলল, সুশান্ত তোর এতটুকু বোঝা উচিত ছিল। এখন বুঝতে পারলি কে এসেছিল?
সরি প্রিয়ন্তী।
সরি বললেই যদি সব হয়ে যেত তবে তো ভালোই হতো। এখন কী যে হবে ভগবানই জানেন।
চলবে…
এই উপন্যাসটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:প্রিয়ন্তী-০১

প্রিয়ন্তী-০৮ (সংস্কারের প্রাচীর ভাঙ্গা তরুণী)

Prionti
দূর্গা পূজা শেষ হয়েছে। এবার দুজনেরই রাজশাহী ফেরার পালা। আগামীকাল বরেন্দ্র এক্সপ্রেসে সুশান্ত উঠবে ফুলবাড়ি আর প্রিয়ন্তী বিরামপুর একই স্টেশনে উঠলে আবার কথাটা দুজনেরই গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে যেতে পারে। তারপর দুজনে এক সঙ্গে গল্প করতে করতে রাজশাহী পৌঁছাবে। প্রিয়ন্তীদের বাড়ির অদূরে একটা সুপারি বাগান আছে, সেই বাগানের এক কোণায় একটা সিমেন্ট কংক্রিটের বেঞ্চ বানানো হয়েছে অনেক আগে, যখন এলাকায় বিদুৎ পৌঁছায়নি তখন গরমের দিনে অনেকেই বসে আড্ডা দিত। আজকাল আর কেউ তেমন একটা বসে না। গতকাল প্রিয়ন্তী সেই বেঞ্চের ওপর বসে সুশান্তর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলল। যেন কথার শেষ নেই।
বিজয়া দশমীর দিন বজ ঠাকুর সুশান্তর সঙ্গে কথা বলেছিল, তুমি কে বাবা?
আমার নাম সুশান্ত।
সুশান্ত কি? নামের শেষে একটা পদবি আছে না?
সুশান্ত দত্ত।
বজ ঠাকুর মুখ আংশিক বিকৃত করল, ও তাহাই বলো, তোমার বাড়ি কোন গ্রামে?
সুশান্ত তার গ্রামের নাম বলল।
প্রিয়ন্তী তোমার কে হয়?
আমার ফ্রেণ্ড, আমরা একসঙ্গে পড়ি।
ও তাহাই বলো, বলে বজ ঠাকুর ফিসফিস করে চাপা স্বরেকি যেন বলতে বলতে চলে গিয়েছিল।
প্রিয়ন্তী সুশান্তর সঙ্গে কথা বলে বাড়িতে ঢুকবে এমন সময় ঠাকুর ঘরের কাছে বজ ঠাকুরের দেখা। হয়ত বজ ঠাকুর প্রিয়ন্তীর সঙ্গে কথা বলার জন্যই দূর থেকে দেখছিল। প্রিয়ন্তী কাছে যেতেই তাকে ডাক দিল, প্রিয়ন্তী।
প্রিয়ন্তী দাঁড়ালো, বলুন ঠাকুর মশাই।
তুমি এখন বড় হইয়াছ, অনেক বেশি লেখাপড়া শিখিয়াছ তোমাকে নতুন করিয়া কিছু বলিতে হইবে এমন জ্ঞান আমার নাই। তবুও একটা কথা না বলিলেই নয়।
কী ঠাকুর মশাই?
এতক্ষণ কাহার সহিত কথা বলিলে মা?
প্রিয়ন্তীর সমস্ত শরীর রাগে রি রি করে উঠল, সে অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে বলল, আমার এক ফ্রেণ্ডের সঙ্গে।
তা বেশ, তা বেশ। আজকাল এই মোবাইল নামক যন্ত্রটা আসিয়া পৃথিবীতে অনাচার আরো বাড়িয়া গিয়াছে, সেইদিন তোমার সহিত একটা ছেলে আসিয়াছিল, নামটা কি যেন, সুশান্ত দত্ত।
আমার ফ্রেণ্ড।
রাজশাহীতে থাকে, না?
হ্যাঁ আমরা একসঙ্গে পড়ি।
আমি ছেলেটিকে চিনি, তাহার বাবা-মা’সহ গুষ্ঠিসুদ্ধ চিনি। তাহাদের বংশে তেমন খারাপ কেউ নেই। আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে যতটুকু জানি মন্দ না। কিন্তু হিন্দু ধর্মে গোত্র-বর্ণ বলিয়া একটা কথা আছে, তোমরা হইলে চক্রবর্তী, জাতে বামুন আর সুশান্ত দত্ত কী তাহা তো তুমি বুঝিতেই পাইতেছ।
প্রিয়ন্তীর বুক ধক্ করে উঠল, সে প্রচণ্ড রেগেও গেল, ঠাকুর মশাই দয়া করে আপনি আর এ বিষয়ে আমাকে কিছু বলবেন না।
বজ ঠাকুর রাম, রাম বলতে বলতে মন্দিরের দিকে গেল।
বজ ঠাকুরের প্রশ্নবাণ এ পর্যন্ত শেষ হলেই ভালো হতো কিন্তু না, কথাটা এ পর্যন্তই থেমে থাকলো না। তার প্রশ্নবাণের প্রতিফলন ঘটল তার বাবা-মা’র গম্ভীর কালো মুখের প্রতিচ্ছবিতে। প্রিয়ন্তী রওয়ানা দেওয়ার জন্য কাপড়-চোপড় পরে যখন তার বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেল তখন বাবা তার হাতে টাকা দিল একটা কথাও বলল না। অন্যান্য বার বাবা তাকে সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে নানান কথা বলতো।
প্রিয়ন্তী বলল, বাবা তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ?
না।
তার না বলার ভঙ্গীতে বোঝা গেল তার মনের মধ্যে প্রচণ্ড রাগ আর ক্ষোভের মেঘ জমাট বেঁধেছে। এই গাঢ়, কালো জমাট মেঘ দূরীভূত না করে তার চলে যাওয়া ঠিক হবে না। সে তার বাবার পাশে বসল, বাবা কী হয়েছে? আমাকে বলোতো?
দীপক বাবু বলল, আমি তোকে রাজশাহীতে লেখাপড়া করতে পাঠিয়েছি কিন্তু এখন আমার আশংকা হচ্ছে তুই লেখাপড়া শেষ করতে পারবি কি না।
বাবা বজ ঠাকুর তোমাকে কিছু বলেছে?
শুধু বজ ঠাকুর বলবে কেন? আমি নিজে কি কিছু বুঝি না? সেজন্য একবার তোর বিয়ে দিতে চাইলাম, না তুই বিয়ে করবি না। ভালো কথা বিয়ে করবি না লেখাপড়া করবি কিন্তু এখন যা দেখছি তোর বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণটা অন্য।
প্রিয়ন্তীর বড় মুখ করে কথা বলার কিছু নেই। সে মাথা নত করে বসে রইল।
দীপক বাবু বলল, তোর ইচ্ছা তুই লেখাপড়া শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হবি, আমারো ইচ্ছা তাই কিন্তু কোনদিন যদি এর ব্যতিক্রম ঘটে তবে আর আমার সামনে এসে দাঁড়াবি না।
প্রিয়ন্তী জানে তার বাবার ইচ্ছার ব্যতিক্রমটা কী? সে তার বাবাকে চিনে, খুব সহজ-সরল কিন্তু কোন বিষয়ে একবার বাঁকা হলে তাকে আর সোজা করার মতো কেউ নেই। প্রিয়ন্তী বুঝতে পারল সুশান্ত আর তার সম্পর্ককে বাবা কোনভাবেই মেনে নিবে না। এমনকি কোনদিন বাবার সামনে এসে সেকথা বলাও যাবে না। আবার সুশান্তকে সে ঠাকুর সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছে, সিঁথিতে সিঁদুর নেই মনের সিঁদুরটা যেন তাকে বাবা-মা’র স্নেহ ভালোবাসা, পুরোহিতের নীতিবাক্য, সমাজের অনাচার জ্ঞান সমস্ত কিছু থেকে আলাদা করেছে।
প্রিয়ন্তী আর কথা বাড়ালো না। সে বাবার পা ছুঁয়ে বলল, আমার জন্য আশীর্বাদ করো বাবা।
সবাই তখন বাইরে রিক্সা ভ্যানের ওপর তার ব্যাগ চাপিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। মা’র চোখের পানি গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। দীপক বাবুর একটা চাপা অশ্রুনিরুদ্ধ কণ্ঠেবুক চিরে বেরিয়ে এলো, ভালো থাকিস মা।
স্টেশনে এসে বেশিক্ষণ দেরি করতে হলো না। কয়েকমিনিটের মধ্যে ট্রেন এলো। ট্রেন পুরোদমে না থামতেই প্রিয়ন্তীর চোখে পড়ল একটা লাল শার্ট পরা হাত কাকে যেন ইশারায় ডাকছে। ট্রেন আরো কাছাকাছি আসতেই প্রিয়ন্তী সুশান্তকে না দেখেই অনুমান করল, এ যেন সুশান্তরই হাত, তাকেই ডাকছে। হ্যাঁ সুশান্তই তাকে ডাকছে। ট্রেন থামতেই প্রিয়ন্তী ট্রেনে উঠে সুশান্তর পাশে বসল।
প্রিয়ন্তী কেমন আছিস?
প্রিয়ন্তী একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, ভালো।
কিন্তু সুশান্ত খেয়াল করল প্রিয়ন্তীর গণ্ডদেশ দিয়ে বেয়ে পড়া পানির আভা তখনো শুকায়নি। দু’চোখ তখনো ছলছল করছে।
সুশান্ত জিজ্ঞেস করল, প্রিয়ন্তী কী হয়েছে?
প্রিয়ন্তী রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, এখন আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করিস না সুশান্ত, আমার মনটা ভালো নেই। আগে রাজশাহী যাই, কাল তোকে সবকিছু বলব।
সুশান্ত আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।
চলবে…
আমার এই উপন্যাসটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:প্রিয়ন্তী-০১

প্রিয়ন্তী-০৭ (সংস্কারের প্রাচীর ভাঙ্গা তরুণী)

Prionti
আজ বিজয়া দশমী। সকাল থেকে সুশান্ত প্রিয়ন্তীকে কয়েকবার মোবাইল করেছে, কি রে কখন আসছিস্? নাকি আমি গিয়ে নিয়ে আসবো?
না রে আমাকে নিতে আসতে হবে না। আমি নিজেই যেতে পারবো।
বিকেলবেলা প্রিয়ন্তী বাবাকে পূজা দেখার কথা বলে বের হলো। প্রিয়ন্তীদের বাড়ি থেকে সুশান্তদের বাড়ি আলাদা আলাদা উপজেলায় দূরত্ব বেশ কয়েক কিলোমিটার। বাড়ির অদুরে রাস্তায় যেতেই একটা রিক্সা ভ্যান পেয়ে প্রিয়ন্তী উঠে বসল। কয়েকমিনিটের মধ্যে প্রিয়ন্তী সুশান্তদের বাড়ির সামনে গিয়ে পৌঁছে গেল।
সুশান্ত প্রিয়ন্তীর সামনে এসে দাঁড়ালো, প্রিয়ন্তী ভিতরে আয় বউদি তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
তারমানে তুই আমার সম্পর্কে বউদিকে কিছু বলেছিস?
হ্যাঁ বউদিকে বলেছি প্রিয়ন্তী নামে আমার এক বন্ধু আছে।
বউদি কী বলেছে?
তোকে দেখতে চেয়েছে, আমাকে কয়েকবার করে বলল, ঠাকুরপো মেয়েটার হেঁটে আসতে কষ্ট হবে তো, যাও না মোটর সাইকেলটা নিয়ে।
তুই কী বললি?
আমি বললাম, মেয়েটা একটু গোঁড়া টাইপের সে আমার মোটর সাইকেলে উঠবে না।
প্রিয়ন্তী মনে মনে বলল, যে মেয়ে একাই বরের সঙ্গে গিয়ে মন্দিরে বিয়ের মন্ত্র পড়তে পারে সে আর গোঁড়া!
কথা বলতে বলতে প্রিয়ন্তী সুশান্তর সঙ্গে তাদের বাড়ির ভিতরে গেল।
বউদি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। সুশান্তর সঙ্গে প্রিয়ন্তীকে ঢুকতে দেখে সামনে এগিয়ে এলো।
সুশান্ত প্রিয়ন্তীকে পরিচয় করে দিল, বউদি এ হচ্ছে প্রিয়ন্তী আমরা এক সঙ্গে পড়ি আর প্রিয়ন্তী আমার বউদি, বাসন্তী।
প্রিয়ন্তী বাসন্তীকে প্রণাম করল।
বাসন্তী প্রিয়ন্তীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ঠাকুরপো তোমার পছন্দ আছে, আগে থেকেই তুমি প্রিয়ন্তীর খুব প্রশংসা করতে, কাল যখন দূর্গা দেখতে যাওয়ার জন্য মোটর সাইকেল চাইলে তখন মনে হলো তুমি বুঝি দূর্গা দেখতে যাচ্ছ কিন্তু আজ দেখি তুমি শুধু দূর্গা দেখে আসোনি একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ। মা এদিকে এসে একবার দেখে যান ঠাকুরপো একেবারে সাক্ষাৎ দূর্গা নিয়ে এসেছে।
প্রিয়ন্তী লজ্জায় সংকুচিত হয়ে গেল।
প্রিয়ন্তী বসো, ঠাকুরপো তুমি বসো, গল্প করো আমি খাবার নিয়ে আসছি, বলে বাসন্তী চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর সুশান্তর মা এলো। সেও প্রিয়ন্তীর খুব প্রশংসা করল। কথায় কথায় বলল, তুমি বুঝি লেখাপড়ায় খুব ভালো মা, আমার গাধাটাকে তো কোনদিন লেখাপড়া করতে দেখি না।
প্রিয়ন্তী কিছু বলল না, সুশান্ত বলল, প্রিয়ন্তী তুই বল আমি কি লেখাপড়া করি না?
প্রিয়ন্তী বলল, না মাসী ও তো কলেজে ভালো লেখাপড়া করে।

সুশান্তর এক প্রতিবেশী বউদি আছে, সে তাকে খুব স্নেহ করে কিন্তু তার স্নেহের মাঝে যেন এক ধরণের মাধুর্য আছে। সবকথা উল্টা করে বলে সুশান্তকে ক্ষেপানোর জন্য কথা বলে। সে কাছে এলো, আপনাদের মুখে এতক্ষণ যা শুনলাম তাতে তো মনে হচ্ছিল এ বাড়িতে স্বয়ংদূর্গা এসেছে, এখন যা দেখছি তাতে মনে হচ্ছে দূর্গার রুপ সম্পর্কে ঠাকুরপোর কোন ধারণাই নেই।
সুশান্ত বলল, দূর্গা না হোক তোমার চেয়ে তো ভালো। তোমাকে দেখলে তো বউদি পরিচয় দিতে-
কী এত বড় কথা? আজ তোমার দাদা আসুক তারপর বলব, বলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল।
সুশান্ত মুখ কালো করে বসে রইল। সুশান্তর মা রাগান্বিতচোখে তার সেই প্রতিবেশী বউদির দিকে তাকিয়েই বিষয়টা হালকা করার জন্য একরকম হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলল, বউমা তোমরা বউদি আর ঠাকুরপো মিলে বাড়িতে যত ইয়ার্কিই করো না তাতে কিছু যায় আসে না কিন্তুপ্রিয়ন্তী আজই প্রথম এ বাড়িতে এলো ওর সামনে কি সব কথা বলা দরকার আছে?
প্রিয়ন্তী একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, না মাসীমা আমি কিছু মনে করিনি। আসলে বউদির সঙ্গে সুশান্তর সম্পর্কটা খুব ভালো তাই ইয়ার্কি-ফাজলামিটা একটু বেশি হয়।
ও প্রিয়ন্তী, তুমি ছোট মানুষ-
বউদির কথা শেষ হওয়ার আগেই সুশান্তর মা রাগান্বিতচোখে তাকাল।
বউদি বলল, আপনি কিছু মনে করবেন না, মেয়েটা একদিন এ বাড়ির বউ হবে ওকে তো সবকিছু বলতে হবে আমরা সবাই মিলে এবাড়িতে এবং পাশের বাড়িতে কেমন একটা আনন্দময় সময় উপভোগ করি তাও তো জানতে হবে।
সুশান্তর মা চেয়ার থেকে উঠল, বউমা তুমি আমার সঙ্গে এসো তো, মেয়েটা অনেকদুর থেকে এসেছে আগে কিছু খেতে দিই, শুকনা মুখে চিড়া ভিজালে তো চলবে না। না হলে সেও আবার তোমাকে ছেড়ে কথা বলবে না।
না মা তা বলবে না প্রিয়ন্তী খুব শান্ত-শিষ্ট মেয়ে, দেখেন না তার মুখের ওপর একটা কেমন সাদাসিধে প্রকৃতির ছাপ আছে। তা সুশান্ত তোমাকে পটিয়েছে ভালোই, না হলে তোমার মতো একটা সুন্দর, শান্ত-শিষ্ট, বুদ্ধিমতী মেয়ে সুশান্তর মতো একটা ছেলের প্রেমে পড়বে কেন? ভগবানের এই এক নিষ্ঠুরতা, সুন্দর ছেলেরা পাবে অসুন্দর মেয়ে আর খুব ভালো মেয়েরা পাবে খারাপ স্বামী।
সুশান্তর মা আবার বলল, এসো তো বউমা।
সুশান্তর মা আর তার প্রতিবেশী বউদি চলে গেল।
প্রিয়ন্তী সুশান্তকে বলল, তোর এই বউদি বুঝি তোর সঙ্গে খুব ইযার্কি করে।
সুশান্ত একটা ঢোক গিলে বলল, হ্যাঁ, একটু বেশি কথাও বলে।
তবে বউদি কিন্তু অনেক ইয়ার্কি-ফাজলামির মধ্যে একটা সত্য কথা বলে ফেলেছে।
সুশান্তর বুক কেঁপে উঠল। সে চুপ করে রইল।
প্রিয়ন্তী জিজ্ঞেস করল, এই সুশান্ত কী ভাবছিস?
না ভাবছি বউদির কোন কথাটা তুই সত্য বলে মনে করছিস?
আরেকদিন বলব।
বউদি খাবার নিয়ে এসে টেবিলে খাবারের ট্রে রাখতে রাখতে বলল, সুশান্ত আমাকে বলে ওর দাদার কাছ থেকে মোটর সাইকেল নিয়ে গেল, আমি মনে করেছিলাম তুমি ওর সঙ্গে মোটর সাইকেলে চলে আসবে।
না বাবাকে বলা হয়নি তো, তাই কাল আসতে পারিনি।

হ্যাঁ মেয়েদের আবার অনেক কিছু মেনে চলতে হয়, এখন বাবার অনুমতি নিতে হচ্ছে, এরপর ঠাকুরপো’র অনুমতি নিতে হবে, তারপর ছেলে বড় হলে ছেলেদের অনুমতি নিতে হবে। সারাজীবনই যেন শিকলে বাঁধা।
বাঁধা বলছেন কেন বউদি এটাই তো সমাজের নিয়ম, তাছাড়া মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যাপার তো আছেই।
সেই প্রতিবেশী বউদি আবার এলো, তবে তোমার নিরাপত্তার ব্যাপারে তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো, এই গ্রামে এমন কেউ নেই যে আমাদের ঠাকুরপো’র বিরুদ্ধে কথা বলতে পারে, ওর হাড় গুঁড়া করে দিবে।
প্রিয়ন্তী অভিমানের সুরে বলল, কারো হাড় কোনদিন গুড়া করেছে নাকি বউদি?
না করেনি তবে ও কারো হাড় গুড়া করতে পারে এই ভীতিটা সবার মনে আছে। তুমি বোধ হয় জানো না বোকারা একবার ক্ষেপলে তাকে আর থামানো যায় না।
বউদি এটা কিন্তু আপনি অন্যায় বললেন, সুশান্ত বোকা না, শান্তশিষ্ট।
বাঃ, বাঃ এত তাড়াতাড়ি তো বেশ ভালোবাসা জম্মেছে।
বউদি বলল, সে চিন্তা তোমার নেই প্রিয়ন্তী কারণ সে কোনদিন তোমার হাড় গুঁড়া করবে না তবে কারো কারো হাড় গুঁড়া করার মতো তো কাউকে চাই।
তোমরা বসো আমার একটু কাজ আছে, বলে প্রতিবেশী বউদি চলে গেল।
বউদি পাশে থেকে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল, তুমি কিছু মনে করো না প্রিয়ন্তী ও সব সময় সুশান্তর সঙ্গে একটু খোঁচা মেরে কথা বলে তো। অভ্যাসটাই এরকম।
প্রিয়ন্তী মৃদু হেসে বলল, না আমি কিছু মনে করিনি বউদি।
তোমরা বসো, গল্প করো, আমি চা নিয়ে আসছি, বলে বউদি চলে গেল।
সুশান্ত বলতে শুরু করল, বউদির বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভালো তো তাই একটু অহংকারী। আসলে বউদি আমাকে খুব একটা পছন্দ করে না কারণ আমি কোন দোষ পেলে মুখের ওপর ষ্পষ্ট করে বলি।
সুশান্ত ষ্পষ্ট কথা বলা ভালো কিন্তু অনেক সময় ষ্পষ্ট কথা বিপদ ডেকে আনে।
বউদি চা নিয়ে এলো।
তুমি কীভাবে এসেছ প্রিয়ন্তী?
ভ্যানে।
কেন তুমি ঠাকুরপো’কে মোবাইল করলে তো পারতে?
প্রিয়ন্তী কিছু বলল না।
সুশান্তর মুখে যেন একটা আনন্দের আভা ফুটে উঠল।
বউদি বলল, সুশান্ত তুমি কিন্তু প্রিয়ন্তীকে নামিয়ে দিয়ে এসো।
সুশান্ত বলল, ঠিক আছে।

প্রিয়ন্তী সুশান্তর মোটর সাইকেলে উঠল। সে মাত্রক’দিন আগে মোটর সাইকেল চালাতে শিখেছে, কখনো মোটর সাইকেল যাচ্ছে দ্রুত গতিতে আবার কখনো হঠাৎ ব্রেক কষছে। তারওপর প্রিয়ন্তীর মতো সুন্দর মেয়েকে মোটর সাইকেলে চড়াতে পেরে সে যেন নিজেকে নায়ক ভাবতে শুরু করেছে। কিছুদুর যাওয়ার পর সুশান্ত বলল, প্রিয়ন্তী চল না কয়েকটা পূজা মণ্ডপ ঘুরে দেখি?
রাত হয়ে যাবে না তো?
না রাত হবে কেন? আমি তোকে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বাড়িতে রেখে আসবো।
প্রিয়ন্তী আর কিছু বলল না।
সুশান্ত আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। দ্রুত গতিতে মোটর সাইকেল চালাতে লাগল। প্রিয়ন্তী একবার বলল, সুশান্ত একটু আস্তে চালা।
তুই আমার ওপর ভরসা রাখ, কিছু হবে না।
দু’জনে কয়েকটা পূজা মণ্ডপ দেখার পর সুশান্ত যখন মোটর সাইকেল নিয়ে প্রিয়ন্তীর বাড়ির কাছে পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। রাস্তার মোড়ে এসে প্রিয়ন্তী বলল, তুই যা সুশান্ত আমি এটুকু রাস্তা একাই যেতে পারবো।
আমি তোকে বাড়িতে দিয়ে আসি?
প্রিয়ন্তী কিছুটা রাগান্বিত স্বরেবলল, সুশান্ত আমি গতকাল তোকে কী বলেছিলাম?
ঠিক আছে প্রিয়ন্তী তুই বাড়িতে পৌঁছে আমাকে রিং দিস।
তুই মোটর সাইকেলে থাকতে আমি তোকে রিং দিব না সুশান্ত, তুই বাড়িতে গিয়ে আমাকে রিং দিস, তুই কিন্তু ভালো মোটর সাইকেল চালাতে পারিস না, সাবধানে যাবি।
আচ্ছা।
চলবে…
এই উপন্যাসটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:প্রিয়ন্তী-০১

প্রিয়ন্তী-০৬ (সংস্কারের প্রাচীর ভাঙ্গা তরুণী)

Priontiতিন ভাই বোনের মধ্যে প্রিয়ন্তী সবার ছোট। প্রিয়ন্তীর একমাত্র ভাই অরুণ চক্রবর্তী লেখাপড়ায় তেমন ভালো ছিল না। তাই বাবা দীপক চক্রবর্তী তাকে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ার পর নিজের ব্যবসার কাছে লাগিয়ে দিয়েছে। অরুণ লেখাপড়ায় ভালো না হলেও ব্যবসায় অতি অল্প বয়সে বেশ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। অরুণের সহযোগিতায় দীপকের ব্যবসায় উত্তরোত্তর উন্নতি হতে শুরু হয়েছে।
দীপকের একান্ত ইচ্ছাছিল ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে শিক্ষিত করে তুলবে কিন্তু অঞ্জনার বিয়ে আর অরুণ পড়াশোনায় মনোযোগী না হওয়ায় দু’জনের লেখাপাড়ায় দ্রুত সমাপ্তি ঘটেছে। তাই দীপকের একান্ত ইচ্ছা প্রিয়ন্তীকে লেখাপড়া শিখিয়ে অনেক বড় করে তুলবে।

প্রিয়ন্তীর গায়ের রং ফর্সা যেন দুধে আল্তা, মুখের গড়ন সুন্দর, চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত ঝুলানো, যেন বাতাসে দোল খায়, ভদ্র, কথাবার্তায় কোন জড়তা নেই, সর্বদাই হাস্য মুখ। তার সৌন্দর্য আর গুণাবলী যেন শত মেয়ের মধ্যেও দৃষ্টি কাড়ে, তার এই সৌন্দ্যের্যের জন্য দীপক বাবুকে মাঝে মাঝে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। কলেজ যাওয়া আসার পথে যে কেউ প্রিয়ন্তীকে দেখলেই দীপক বাবুর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়, কেউ কেউ বলে মেয়ে মানুষ বয়স কম থাকতেই বিয়ে দেয়া ভালো পরে বয়স বেশি হলে সবাই ধাড়ী মেয়ে বলে, বিয়ে দেয়া কঠিন হবে। দীপক বাবু প্রিয়ন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে অনেক বড় অফিসার বানাবার স্বপ্নদেখে। দেখতে সুন্দর বলে প্রিয়ন্তীকেও অনেক বিড়ম্বনারশিকার হতে হয়। প্রিয়ন্তী তার মোবাইল নাম্বারখুব সহজে কাউকে দেয় না তারপরও মোবাইল রিচার্জ করার সময় বা যে কোনভাবে কেউ তার নাম্বারপেলে ঘন ঘন মোবাইল করে, কেউ বা প্রেম করার প্রস্তাব দেয় আবার কেউ কেউ সরাসরি বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়। প্রিয়ন্তী এসব প্রস্তাব খুব মার্জিতভাবে এড়িয়ে যায়।

অন্য সবার মতো প্রিয়ন্তী সুশান্তর ভালোবাসার প্রস্তাব এড়িয়ে যেতে পারেনি। প্রথম দেখায় সুশান্ত যেন তার মনের মধ্যে একটা অন্য ধরণের রোমাঞ্চকর অনুভুতি সৃষ্টি করেছিল তখন সে তাকে না করতে পারেনি। তারপর দুজনের মধ্যে অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠে, যা শেষ পর্যন্ত বিয়ের পিঁড়ি পর্যন্ত গড়ায়। রাষ্ট্রীয় কিংবা সমাজ ব্যবস্থায় তাদের বিয়ে স্বীকৃত হোক বা না হোক তারা দুজনে পরষ্পরকে স্বামী-স্ত্রীরআসনে স্থান করে দিয়েছে। প্রিয়ন্তীর কোন কিছু খেতে গেলেই সুশান্তর কথা মনে পড়ে কিন্তু এ বাড়িতে তাদের লুকিয়ে বিয়ের কথা বলার সুযোগ নেই। বাবা-মা প্রিয়ন্তীর লেখাপড়া বন্ধ করে দিবে, ঘরে বন্ধ রেখে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের পছন্দ করা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবে।

আজ যেন বিকেলটা হচ্ছেই না। দুপুরের সুর্যটা কেমন যেন মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
প্রিয়ন্তী সকালবেলা তার পছন্দের কয়েকটা খাবারের কথা তার মাকে বলেছে। সে নিজেও রান্নার কাজে তার মাকে সহযোগিতা করছে।
তার মা একবার জিজ্ঞেস করল, তোর আবার হঠাৎ করে কী হলো? তুই তো কোনদিন খাবার-দাবারের ব্যাপারে কিছু বলতিস না, এবার পূজায় আবার এতকিছু বলছিস কেন?
প্রিয়ন্তী বলল, মা আমি এখন কলেজে পড়ছি আমার বন্ধু-বান্ধব অনেককেই ইনভাইট করেছি, কেউ কেউ আসতেও তো পারে?
ঠিক আছে মা, তোর যা যা ইচ্ছা তৈরি কর।
প্রিয়ন্তী মনে মনে বলল, আমার বন্ধু-বান্ধব বলতে তো একজনই মা, ঐ একজনকে ভালোভাবে আপ্যায়ন করলে আমার আর কিছু লাগবে না।

সুশান্ত মোটর সাইকেল নিয়ে পূজা মণ্ডপে এলো বিকেল তিনটায়। পূজা মণ্ডপের কাছে স্ট্যান্ড করেই প্রিয়ন্তীকে মোবাইল করল।
প্রিয়ন্তী মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো সুশান্ত তুই কোথায়?
আমি তো তোদের পূজা মণ্ডপের কাছে।
দাঁড়া আমি আসছি।
প্রিয়ন্তী এক রকম দৌড়ে মণ্ডপের কাছে এলো, সুশান্ত।
প্রিয়ন্তী কেমন আছিস্?
ভালো, তুই?
ভালো।
আয় ভিতরে আয়, বলে প্রিয়ন্তী এগিয়ে চলল।
সুশান্ত প্রিয়ন্তীর পিছনে পিছনে বাড়ির ভিতরে গেল।
প্রিয়ন্তী তার মা’র সঙ্গে সুশান্তর পরিচয় করে দিল।
সুশান্ত প্রিয়ন্তীর মাকে প্রণাম করল।
প্রিয়ন্তীর মা সুশান্তর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করল, দীর্ঘজীবী হও বাবা।
সুশান্ত মাথা নত করে সুবোধ বালকের মতো দাঁড়িয়ে রইল।
প্রিয়ন্তীর মা বলল, দাঁড়িয়ে থাকলে কেন বাবা? বসো।
সুশান্ত চেয়ারে বসল।
প্রিয়ন্তীর মা জিজ্ঞেস করল, তোমার বাড়ি কোথায় বাবা?
সুশান্ত তার গ্রামের নাম বলল।
ঐ গ্রামের শংকর ঠাকুর মশাইকে তুমি চেনো?
হ্যাঁ, আমাদের বাড়ি একই পাড়ায়।
তোমার বাবার নাম কী?
মহেশ দত্ত।
প্রিয়ন্তীর মা হঠাৎ করেই মুখ কালো করল, তোমরা বসো বাবা, আমি জলখাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি, বলে সে চলে গেল।
সুশান্ত কয়েকমুহূর্ত প্রিয়ন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
প্রিয়ন্তী জিজ্ঞেস করল, কী রে কতগুলো মণ্ডপ ঘুরলি?
কই আর ঘুরলাম?
কই ঘুরলাম মানে? তুই কি ঘরে বসে থাকার মতো ছেলে?
হ্যাঁ আমি ঘরে বসে থাকার মতো ছেলে না, গ্রামের বাড়ি এলে দাদার মোটর সাইকেল নিয়ে ঘোরাফেরা করি, তবে এবারে ঘুরিনি।
কেন?
সুশান্ত প্রিয়ন্তী বলে থেমে গেল তার মুখ আড়ষ্ট হয়ে গেল।
প্রিয়ন্তী বলল, কী রে বল, থামলি কেন?
সুশান্ত মৃদু কন্ঠে বলল, প্রিয়ন্তী চল না কাল এক সঙ্গে পূজা দেখি, আমি সেজন্য বউদিকে বলে দাদার কাছ থেকে মোটর সাইকেলটা নিয়েছি।
প্রিয়ন্তী বলল, সুশান্ত তোর মাথা খারাপ হয়েছে, বাবা আমাকে তোর সঙ্গে মোটর সাইকেলে যেতে দিবে?
তুই কি বলে যাবি নাকি?
সরি সুশান্ত বাবার কাছে আমি কিছু লুকাই না।
সুশান্ত আর কিছু বলল না। কোন কিছু বলতে গিয়ে সে যেন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ল। সে কয়েকমুহূর্ত চুপ করে রইল।
সুশান্ত তুই বস আমি খাবার নিয়ে আসছি, বলে প্রিয়ন্তী চলে যাচ্ছিল সুশান্ত বলল, প্রিয়ন্তী তুই একটু বস না, তাড়াতাড়ি বিদায় করতে চাচ্ছিস কেন?
না বিদায় করতে চাইব কেন? খেতে খেতে গল্প করব, খাওয়ার পরও গল্প করব।
প্রিয়ন্তীকে আর উঠতে হলো না। কিছুক্ষণ পর প্রিয়ন্তীর মা কাজের মেয়েকে দিয়ে জলখাবার পাঠিয়ে দিল।
খেতে খেতে দু’জনে অনেকক্ষণ গল্প করল। তারপর একবার সুশান্ত একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, প্রিয়ন্তী তুই তাহলে কাল কখন আসছিস?
তোকে মোবাইলে জানিয়ে দিব। বাবাকে বলতে হবে তো।
যেতে দিবে তো আবার?
এমনিতেই দিত না, পূজা বলে যেতে দিবে।
আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে উঠি।
চলবে…
এই উপন্যাসটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:প্রিয়ন্তী-০১

প্রিয়ন্তী-০৫ (সংস্কারের প্রাচীর ভাঙ্গা তরুণী )

Priontiরাজশাহী রেল স্টেশন থেকে রিক্সায় দুজনে প্রিয়ন্তীর মেস পর্যন্ত এলো কিন্তু প্রিয়ন্তীর মুখে কোন কথা নেই। গম্ভীর মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেছে। চোখ দু’টো টলমল করছে, বার বার করে সুশান্তর মুখের দিকে তাকাচ্ছে, তার মন বলছে সুশান্তকে এখনি সবকিছু বলবে কিন্তু মুখ আড়ষ্ঠ হয়ে আসছে।
সুশান্ত প্রিয়ন্তীর মনের অবস্থা বুঝে জিজ্ঞেস করল, প্রিয়ন্তী কী হয়েছে?
সুশান্ত তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।
বল।
এখন না, বিকেলে নিরিবিলি কোথাও বসে বলব।
সুশান্তর মুখ শুকিয়ে গেল, খারাপ কিছু নয় তো।
খারাপ তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মনটা শক্ত করতে হবে।
প্রিয়ন্তী এখনি বল না, আমার খুব ভয় করছে।
প্রিয়ন্তী গম্ভীর গলায় বলল, ছেলেমানুষ এত ভয় পেলে কি চলে?
ততক্ষণে রিক্সা প্রিয়ন্তীর মেসের গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রিয়ন্তী রিক্সা থামতে বলল, আমি নেমে যাচ্ছি তুই বিকেল পাঁচটায় গেটে এসে আমাকে মিস্ কল দিস।
আচ্ছা ঠিক আছে।

বিকেলে দুজনে বের হলো। কিছুদূর যাওয়ার পর সুশান্ত জিজ্ঞেস করল, প্রিয়ন্তী কোথায় যাবি?
তোকে বলেছি না, নিরিবিলি কোন জায়গায়।
এত কী কথা যে নিরিবিলি জায়গা দরকার?
খুব জরুরী না হলে তো তোকে এভাবে বলতাম না সুশান্ত।
তাহলে ভদ্রা পার্কে চল।
তাই চল।
সুশান্ত বলল, এই রিক্সা ভদ্রা পার্কে যাও।
অন্যদিন হলে রিক্সায় বসে প্রিয়ন্তী অনেক কথা বলতো, তার যেন কথার শেষ নেই। কথার মাঝে মাঝে একটু করে হাসতো। তার মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকে, যাকে বলে সদা হাস্য মুখ ইংরেজীতে স্মাইলিং ফেস কিন্তু আজ সেই হাস্যজ্জ্বল মুখের ওপর একটা গাঢ় কালো মেঘ ঢেকে দিয়েছে। সুশান্ত যতদিন থেকে প্রিয়ন্তীর সঙ্গে মেলামেশা করছে ততদিনে সে একবারও প্রিয়ন্তীকে আজকের মতো চিন্তিত দেখেনি তাই আজ প্রিয়ন্তীর এই অস্বাভাবিকআচরণ তাকে চিন্তিত করে তুলল। সে বার বার প্রিয়ন্তীর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল কিন্তু প্রিয়ন্তী অনঢ়।
রিক্সা ভদ্রা পার্কের গেটে এসে দাঁড়ালো।
দুজনে রিক্সা থেকে নেমে ভিতরে ঢুকলো। পার্কে উত্তর দিকটায় গাছপালা একটু ঘন, সবাই নিরিবিলি কথা বলার জন্য পার্কের এই উত্তর দিকটাকেই বেছে নেয়। সুশান্ত আর প্রিয়ন্তী দুজনে পার্কের গেট দিয়ে ঢুকে উত্তর দিকে গিয়ে ঘাসের ওপর বসল।
কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। প্রিয়ন্তী কথাটা সুশান্তর কাছে কিভাবে উপস্থাপন করবে ভাবছিল।
সুশান্ত জিজ্ঞেস করল, প্রিয়ন্তী কী হয়েছে?
প্রিয়ন্তী শুষ্ক হাসি হেসে বলল, না, তেমন কিছু না।
তাহলে তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আমাকে বল?
আসলে তোকে বললে তুই কি মনে করবি বুঝতে পাচ্ছি না।
প্রিয়ন্তী মনে হয় তোর সঙ্গে আমার কেবল আজকেই পরিচয় হলো যে কিছু বলতে গিয়ে সংকোচ করছিস। কোন সংকোচ না করে বলে ফেল, যদি কোন সমস্যা হয় দুজনে সমাধান করতে হবে।
থ্যাংক ইউ সুশান্ত, আমি তোর কাছে এমন একটা কথাই আশা করছিলাম।
কী হয়েছে এখন বল তো?
প্রিয়ন্তী পার্বতীপুর তার দিদির ঠাকুরপো বিদ্যুতের কথা সুশান্তকে বলল।
সুশান্ত সবকিছু শুনে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইল। তার মুখে কোন কথা নেই, তার হৃৎপিণ্ড যেন দ্রুত গতিতে চলছে, তার হৃৎপিণ্ডের ধড়াস ধড়াস শব্দ প্রিয়ন্তীকে আতংকিত করে তুলল।
সুশান্ত বলল, তুই কি বিদুৎকে বিয়ে করবি?
প্রিয়ন্তী রেগে গেল, তার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল, তুই এমন কথা বলতে পারলি? তুই জানিস না তোকে ছাড়া আমি কাউকে বিয়ে করব না।
সরি প্রিয়ন্তী, তাহলে এখন কী করবি?
প্রিয়ন্তী আরো রেগে গেল, এখন কী করতে হবে তাও আমাকে বলে দিতে হবে, এজন্য অনেকদিন আগেই আমি তোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যদি কোনদিন কোন সাহসী ভুমিকা নিতে হয় তবে নিতে পারবি কি না?
পারবো, আমাকে কী করতে হবে তুই বল?
আমাকে বিয়ে করতে হবে।
করব।
তাহলে আয়োজন কর।
আমাদের বাড়িতে বলব।
না, বাড়িতে বললে কোন পক্ষই বিয়েতে রাজি হবে না।
কেন? আমি বিয়ে করতে চাইলে তারা রাজি হবে না কেন?
সুশান্ত এত সরল হলে চলে না, তুই বাড়িতে বললে পণের কথা জিজ্ঞেস করবে আর পণ পাবি না বলে তোকে আমাকে বিয়ে করতে দিবে না।
তাহলে এক কাজ করি, আমি আজকের রাতটা ভেবে দেখি, আমার বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করি তারপর যা হয় কাল করব।
সব বন্ধুদের সঙ্গে ঢাক ঢোল পিটিয়ে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই, তোর খুব ঘনিষ্ঠ দু’য়েকজন বন্ধুকে বললেই হবে।
আচ্ছা।
কী করলি আমাকে রাতেই জানাবি?
ঠিক আছে।

রাতেই মোবাইলে সব কথা হলো। সবকিছু শুনে প্রিয়ন্তী খুশি হলো, সুশান্ত এতদিনে তোর বুদ্ধি খুলেছে। সিদ্ধান্ত হলো পরদিন প্রিয়ন্তী তার দু’বান্ধবী আর সুশান্ত তার দু’বন্ধুকে নিয়ে মন্দিরে যাবে, সেখানে তাদের বিয়ে হবে। তাদের বিয়ের ব্যাপারটা আপাততঃ গোপন থাকবে কিন্তু একটা ব্যাপার প্রিয়ন্তীর মাথায় ঢুকল না। মাথায় সিঁদুর পরলে বিয়ের ব্যাপারটা গোপন থাকবে কী করে?
মন্দির থেকে ফেরার পর সিঁদুর মুছে ফেলবি।
প্রিয়ন্তী বুকে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খেল, সিঁদুর মুছে ফেলবো, হিন্দু মেয়েদের সিঁদুরই সব। আমরা দুজনে যে পুরো সমাজব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করছি তা তো শুধু সিঁদুরের জন্যই, আর সিঁদুরটাই মুছে ফেলবো!
আচ্ছা ঠিক আছে তুই যখন চাচ্ছিস না তখন না হয় সিঁদুর পরবি না।
তা কি করে হয় তুই আমাকে বিয়ে করবি আর সিঁদুর পরাবি না।
সুশান্ত বলল, প্রিয়ন্তী আগে মন্দিরে যাই, বিষয়টা ঠাকুরের সঙ্গে আলাপ করি তারপর না হয় সিদ্ধান্ত হবে।
তবে খেয়াল রাখিস সুশান্ত তোর পরিয়ে দেয়া সিঁদুর আমি মুছতে পারবো না।
সিঁদুর পরানো নিয়ে সুশান্ত আর প্রিয়ন্তীর মধ্যে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল তা কেটে গেল। সুশান্তর এক বন্ধু ঠাকুরকে আলাদাভাবে ডেকে নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে কি যেন বলল, কিন্তু ঠাকুর তার কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করলেন। এখন তো কার্তিক মাস হিন্দু ধর্মে সংস্কার বলে অনেক কিছু আছে, সবকিছুকে অবহেলা করলে সমাজের অমঙ্গল হবে।
পরে অবশ্য ঠাকুর বিয়ে পড়ালেন ঠিকই কিন্তু বললেন, আগামী মাসে আরেকবার এসো আমি বিয়ে পড়িয়ে দিব।
এই বিয়ের না থাকলো কোন সামাজিক স্বীকৃতি, না থাকলো কোন রাস্ট্রীয় স্বীকৃতিউভয়ে পরষ্পরকে স্বামী-স্ত্রীরমর্যাদায় আসন দিলেও প্রিয়ন্তীর চলাফেরা থাকলো ঠিক আগের মতোই শাঁখা সিঁদুর ছাড়া অবিবাহিত মেয়ের মতোই। দুজনে বসবাস করতে লাগল ঠিক আগের মতোই, সুশান্ত তার মেসে আর প্রিয়ন্তী তার মেসে।
সুশান্তর সঙ্গে প্রিয়ন্তীর দ্বিতীয়বার বিয়ের ঘটনাটা অন্যরকম আইন সম্মত কিন্তু তাতেও সমাজের স্বীকৃতি নেই। সমাজের স্বীকৃতিযেন একেবারে সংস্কারে বাঁধা। সমাজে মানুষের অধিকারের চেয়ে সংস্কারের মূল্য অনেক বেশি।
চলবে..
এই উপন্যাসটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:প্রিয়ন্তী-০১
আমার সব লেখা একসাথে পড়তে ভিজিট করুন:আমার ঠিকানা

আমারও পরাণও যাহা চায়-শেষ পর্ব

10722-lost-love-poems
অনেক দিন আগে থেকেই গভীর রাতে ইরার ঘুম ভেঙ্গে যায়, বিছানায় ছটফট করে। পাশে শুয়ে মোশা ঘুমায়, নাক ডেকে ঘুমায়। ইরা ভেবেছিলো ফিরে আসার পর হয়তো মোশা তাকে ভালোবাসবে, তার কষ্ট বুঝবে, তার সাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করবে কিন’ ইরার সে আশা অপূর্ণই রয়ে গেলো অথচ নিয়ে আসার আগে মোশা তাকে কত না স্বপ্নই না দেখিয়েছিলো, আমাদের পঁচিশ বছরের সংসার, কত স্মৃতি, কত আনন্দ-বেদনা মিশিয়ে আছে। হতে পারে কখনো কখনো একটু মনোমালিন্য হয়েছে তাই বলে আমাদের কি সুখের কোনো স্মৃতি নেই? এসো ইরা, আমার সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে মিলে মিশে চলবো।
এই মোশার সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে চলার নমুনা, আমার চোখে ঘুম নেই, দুশ্চিন্তায় ছটফট করছি আর মোশা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।

জয় যেনো ইরাকে ঘুমের মাঝেও লক্ষ্য রাখতো, হয়তো ইরার প্রতিটি নি:শ্বাসও খেয়াল করতো, ইরার সুখ-দুঃখ অনুভব করতো। একদিন গভীর রাতে ইরার ঘুম ভেঙ্গে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে জয় চমকে উঠলো, ইরা।
ইরাও চমকে উঠলো, কী হলো তোমার?
না, আমার কিছু হয়নি। তোমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো কেনো? কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছো?
না, এমনিতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো। একটু পানি খাও, বলে জয় নিজেই এক গ্লাস পানি এনে দিলো।
সেদিন ইরার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া আর জয় তাকে নিজে পানি এনে দেয়াকে ইরার খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছিলো কিন্তু আজ গভীর রাতে তার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া আর মোশার নাক ডেকে ঘুমানো দেখে মনে হলো, জয় তার কত আপন ছিলো।

ইরা কয়েকমুহূর্ত মোশার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, মৃদু কণ্ঠে ডাক দিলো, এই, এই, ওঠো না। আমার ঘুম আসছে না, চলো তো একটু ছাদে যাই।
না, মোশার কোনো সাড়া শব্দ নেই। এবার ইরা মোশাকে মৃদু ধাক্কা দিলো, এই, ওঠো না…
মোশা এবার জোরে একটা ধমক দিলো, ইরা, শোওতো, ঘুমানোর চেষ্টা করো। এতো রাতে কেউ ছাদে যায়। তোমার মাথাটা সত্যিই গেছে। ঘুমাও, বলে মোশা আবার চোখ বন্ধ করলো। কয়েকমুহূর্ত পর আবার সেই নাক ডাকা ঘুম।
ইরার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, হায় আল্লাহ আমি, আমি কি হীরা ফেলে কাঁচ তুলে নিলাম?

স্কুলে এসে চেয়ারে বসে ইরা ঝিমোচ্ছে। পাশের চেয়ারে বসেছে তার কলিগ সাহেদা, সে বার বার তাকে টোকা মারছে, এই আপা, এই।
ইরার মুখোমুখি বসেছে শরীফ সাহেব। ভদ্রলোক ইরাকে সবসময় খোঁচা মেরে কথা বলে। ইরার ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সবার সামনে তুলে ইরাকে বিব্রতকর অবস’ায় ফেলে, ইরা মার্জিতভাবে অনেকবার ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা না বলার জন্য অনুরোধ করেছে কিন’ তারপরও একটু সুযোগ পেলেই কেউ কথা না বললেও শরীফ সাহেব বলবেনই।
আজ ইরাকে ঝিমাতে দেখে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে সাহেদাকে লক্ষ্য করে বললেন, ঘুমাতে দেন আপা, ঘুমাতে দেন। আপাকে আজ খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
শরীফ সাহেবের কথা শুনে ইরার মাথায় যেনো রক্ত চেপে গেলো। সে কিছু বলবার জন্য মুখ তুলে তাকাতেই ক্লাসের ঘণ্টা বেজে গেলো।

ইরা হাজিরা খাতা নিয়ে ক্লাসে রোল কল করছে। ইরা ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে খুব প্রিয়। ইরা নিজে যেমন মনোযোগ দিয়ে পড়ায়, ছাত্র-ছাত্রীরাও তেমনি মনোযোগ দিয়ে তার কথা শোনে কিন্তু আজ ইরা ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারছে না। ছাত্র-ছাত্রীরাও ক্লাসে অমনোযোগী হয়ে পড়েছে। পরস্পরের সাথে কথা বলছে, হৈ চৈ করছে।
সাধারণত ইরার এমন হয় না, ইরা লক্ষ্য করেছে যেদিনই এমন হয়েছে, তার মন ছটফট করেছে, অমনোযোগী হয়ে পড়েছে, সেদিনই জয়ের কোনো না কোনো দু:সংবাদ এসেছে। ক’দিন থেকে জয়ের কোনো খবর নেয়া হয়নি আর জরিফুলকে তো সে ফোন করতে নিষেধই করেছে, ইসস কেনো যে জরিফুলকে ফোন করতে নিষেধ করলাম, জয়ের কোনোকিছু হলে আমি কীভাবে জানবো? ক্লাস শেষ হলে একবার জরিফুলকে ফোন দিতে হবে, আল্লাহ আমার জয়কে তুমি ভালো রেখো।

ইরার ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের গুঞ্জন শুনে পাশের রুম থেকে সেই শরীফ সাহেব এলেন, আপা, স্টুডেন্টরা এতো কথা বলছে আপনি কিছু বলছেন না?
ইরা চমকে উঠলো, ও হ্যাঁ।
শরীফ সাহেব নিজে টেবিলে জোরে শব্দ করে বললেন, এই যে ছেলেমেয়েরা ক্লাসে এতো কথা বলছো কেনো?
ছাত্র-ছাত্রীরা চুপ করলো।
শরীফ সাহেব বললেন, ছেলেমেয়েদের শাসন করবেন আপা আর ক্লাসে মনোযোগী হবেন। টিচার এ্যাফসেন্ট মাইন্ড হলে স্টুডেন্টরা তো গোলমাল করবেই।
ইরা আবার ক্লাসে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করলো কিন’ কিছুতেই মন ফেরাতে পারলো না।
ইরার মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।
জরিফুল ফোন করেছে, ইরা তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো।
হ্যালো ম্যাডাম।
ইরা কয়েকমুহূর্ত কানের কাছে ফোন ধরে রাখলো। চোখের সামনে পৃথিবীটা ওলট-পালট হয়ে গেলো, দু’ঠোট মৃদু ফাঁক হয়ে বুক চিরে হয়ে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো, জয়।
তারপর মোবাইল ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেলো।

সমাপ্ত।
এই ছোটগল্পটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:আমারও পরাণও যাহা চায়-০১
আমার সব লেখা একসাথে পড়তে ক্লিক করুন:আমার ঠিকানা

প্রিয়ন্তী-০৪ (সংস্কারের প্রাচীর ভাঙ্গা তরুণী)

Prionti
অঞ্জনার মেয়েটি খুব সুন্দর হয়েছে, যেন স্রষ্টার নিজ হাতে তৈরি। দীপক বাবু, বাসন্তী মেয়েটিকে কোলে নেবারও অনেকক্ষণ পর প্রিয়ন্তী যখন কোলে নিল ততক্ষণে জামাই বাবু কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
জামাই বাবুকে শুনিয়ে প্রিয়ন্তী বলল, বাচ্চা তো খুব সুন্দর হয়েছে জামাই বাবু।
হবে না, আমার বাচ্চা, আমাদের রক্তের মধ্যে আভিজাত্য আছে। তুই দেখিস আমার মেয়েও একদিন অনেক বড় হবে।
আমিও তাই আশীর্বাদ করি।
ততক্ষণে দীপক বাবু আর বাসন্তী চলে গেছে। প্রিয়ন্তী আর জামাই বাবুর কাছে বিদ্যুৎ এসে দাঁড়ালো, আমাকে দাও।
জামাই বাবুর ছোট ভাই বিদুৎ চক্রবর্তী এ বছর বি.এ পাস করেছে। আপাততঃ কৃষিকাজ দেখাশোনা করছে, ভবিষ্যতে চাকরির প্রত্যাশায় বই-পুস্তক এখনো ছেড়ে দেয়নি। বিভিন্ন দপ্তরে চাকরির দরখাস্ত করছে। তার আশা বি.এ পাস করেই একদিন সে বড় অফিসার হবে। তবে চেহারায় জামাই বাবুর মতোই রাজকীয়।
প্রিয়ন্তী খেয়াল করেছে বিদ্যুৎকে বাচ্চাটাকে দেওয়ার সময় ইচ্ছা করেই প্রিয়ন্তীর হাত ষ্পর্শ করেছে, সঙ্গে সঙ্গে বলেছে, সরি।
প্রিয়ন্তী রেগে গেল। সে চোখ মুখ লাল করে নিতান্ত ভদ্রতা বশতঃ বলল, না, ঠিক আছে। কিন্তু সে বুঝতে পারল বিদ্যুৎ অনিচ্ছাকৃত নয় ইচ্ছাকৃতই তার হাত ষ্পর্শ করেছে। সে মনে মনে বলল, মিঃ বিদ্যুৎ আপনি হয়ত জানেন না, মেয়েরা গায়ে জড়ালেই বুঝতে পারে সাপ না লতা।
জামাই বাবু তাদের কথা বলতে দেখে চলে গেছে।
তুমি যেন এবার কোন ইয়ারে?
অনার্স সেকেণ্ড ইয়ারে।
তাহলে তো আর বেশিদিন নেই।
তারমানে?
পরে শুনবে?
আপনি বলুন এখনই শুনি।
বিদ্যুৎ ইতস্ততঃ করল, প্রিয়ন্তী আর কোন আগ্রহ দেখাল না।
কয়েকদিন কেটে গেল। প্রিয়ন্তী খেয়াল করেছে বিদ্যুৎ প্রায় সব সময় কাছাকাছি থেকে তাকে অনুসরণ করে। বেশিরভাগ সময় তার সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা করে, ইতোমধ্যে মোটর সাইকেলে করে দিনাজপুর কিংবা স্বপ্নপুরী বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছে। বিষয়টি সবাই দেখলেও সবাই যেন বিদ্যুৎকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু প্রিয়ন্তী কাউকে কিছু বলেনি সে এই অবস্থার শেষ দেখতে চায়।
অবশেষে প্রিয়ন্তী যেদিন পার্বতীপুর থেকে তাদের গ্রামের বাড়ি ফিরবে সেদিন প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ পেল। অঞ্জনা আর জামাই বাবু প্রিয়ন্তীকে তাদের ঘরে ডাকল। প্রিয়ন্তী প্রথমে কিছু বুঝতে পারল না।
জামাই বাবুই প্রথমে কথা তুলল, প্রিয়ন্তী কথাটা তোকে আরো আগে বলা উচিত ছিল কিন্তু আজকাল, আজকাল করে বলা হয়নি।
কী কথা জামাই বাবু?
আমাদের বিদ্যুৎ আছে না, ওর সঙ্গে তোমার বিয়ের ব্যাপারে আমরা একটা চিন্তা-ভাবনা করেছি। বাবা-মা সবার সঙ্গে আলাপ হয়েছে, তাঁরাও এ বিয়েতে রাজি আছে।
প্রিয়ন্তী যেন আকাশ থেকে পড়ল, বিদ্যুৎদা’র সঙ্গে বিয়ে আমার!
অঞ্জনা বলল, হ্যাঁ, তোর সঙ্গে ঠাকুরপোর বিয়ে হলে খুব ভালো হবে, চেহারা দেখিস না একেবারে রাজপুত্রের মতো। আমরা দু’বোন এক সঙ্গে থাকবো।
প্রিয়ন্তী এক মুহূর্ত ভেবে নিল তারপর বলল, দিদি আমার তো এখনো লেখাপড়াই শেষ হয়নি। আগে লেখাপড়া শেষ করি তারপর না হয় বিয়ের কথা হবে।
জামাই বাবু বলল, ওর বিয়ের জন্য কনে দেখা হচ্ছে তো, অনেক পণের প্রস্তাব আসছে কখন আবার বিয়ে হয়ে যায়, তাই আমি বলছিলাম আগে তোর সঙ্গে বিয়েটা হয়ে যেত তারপর তুই আবার পড়াশোনা করতিস?
হ্যাঁ তোর জামাই বাবু তো ঠিকই বলেছে, অঞ্জনা জামাই বাবুর কথাকে সমর্থন করল।
প্রিয়ন্তী মৃদু কণ্ঠে বলল, না দিদি আমি আগে লেখাপড়া শেষ করব, তারপর বিয়ে।
অঞ্জনা বলল, সবার সঙ্গে কথাবার্তা এক রকম পাকাপাকিই ছিল, ভেবেছিলাম তুই রাজি হবি। না তুই রাজি হলি না, এরকম ধনী পরিবারের রাজপুত্রের মতো ছেলের জন্য কি মেয়ের অভাব হবে?
প্রিয়ন্তী একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, আমিও তো তাই মনে করি দিদি, দাদার জন্য ভালো মেয়ের অভাব হবে না। আর তুমিও একজন নতুন জা পাবে।
থাক, থাক তোকে আর বলতে হবে না। দেখি কত বড় ঘরে তোর বিয়ে হয়?
প্রিয়ন্তী অঞ্জনার কথার কোন প্রতিবাদ করেনি, ধীর পদে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

পার্বতীপুর থেকে ফিরে রাতেই প্রিয়ন্তী সুশান্তকে ফোন করল, হ্যালো সুশান্ত।
প্রিয়ন্তী তুই কেমন আছিস? সুশান্তর কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।
ভালো নেই রে।
কেন? কোন অসুখ করেছে?
আরে মরলে তো বেঁচেই যেতাম, তারচেয়ে অনেক বড় সমস্যা।
আমাকে বল।
অনেক বড় সমস্যা ফোন বলা যাবে না, কাল এসে আমি তোকে বলব, তুই ভালো আছিস?
ভালো নেই, তুই নেই সব সময় আমার শুধু তোর কথা মনে পড়ছিল, আমি এ ক’দিন নানান আজেবাজে স্বপ্ন দেখছি।
আজে-বাজে না, তুই সব ঠিক স্বপ্নদেখেছিস?
প্রিয়ন্তী তুই কবে আসছিস?
আগামীকাল সকালের ট্রেনে।
আমি তোকে নিতে স্টেশনে আসবো?
আসিস।
পরদিন সকালের ট্রেনে প্রিয়ন্তী রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। ট্রেন যখন বিরামপুর ছেড়েছে তখন সুশান্ত ফোন করেছে, হ্যালো প্রিয়ন্তী।
হ্যাঁ সুশান্ত বল।
সুশান্ত মোবাইলে ট্রেনের শব্দ পেল তারপরও জিজ্ঞেস করল, ট্রেনে উঠেছিস তো, না?
হ্যাঁ।
এখন কোথায়?
বিরামপুর, কেবল ট্রেন ছাড়লো।
প্রিয়ন্তীর চোখের সামনে বার বার করে সুশান্তর ছবিটা ভেসে উঠছে। সুশান্ত গ্রাম্য উচ্চ বিত্ত পরিবারের ছেলে, দুই ভাই’র মধ্যে সে ছোট। বাড়িতে অনেক জমি-জমা আছে। প্রতিমাসে বাড়ি থেকে অনেক টাকা আসে কিন্তু তারপরও সুশান্ত টিউশনি করে। জিজ্ঞেস করলে বলে, টিউশনি করলে বিদ্যাচর্চা থাকে। লেখাপড়া শেষ করে যেভাবেই হোক তাকে একটা চাকরি জোগাড় করতে হবে আর চাকরি জোগাড় করতে চাইলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তো পড়তেই হবে সঙ্গে দু’য়েকটা টিউশনি করলে পড়ানোরপ্রয়োজন নিজেকেও লেখাপড়া করতে হয়।
সুশান্ত সহজ-সরল, প্রিয়ন্তীর প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস, প্রিয়ন্তী যদি কোন মিথ্যা কথাও বলে তবুও সে কোন প্রতিবাদ ছাড়াই বিশ্বাস করে। কোন কারণে প্রিয়ন্তী রাগ করলে সে অবোধ ছেলের মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
সুশান্তর সামর্থ্যও আছে, সাধও আছে। প্রায়ই প্রিয়ন্তীসহ বেড়াতে যায়। যেদিন বাড়ি থেকে টাকা আসে বা টিউশনির টাকা পায় সেদিন দুজনে কোন ভালো একটা রেস্টুরেণ্টে বসে খাবার খায়, আড্ডা দেয়। প্রিয়ন্তীকে কসমেটিক্সের দোকানে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন ধরণের কসমেটিক্স কিনে দেয়। অনেক সময় প্রিয়ন্তী রেগে যায়, তখন সুশান্ত বলে, তুই রেগে গেলে আমার খুব ভালো লাগে, বুঝলি?
সুশান্তর মনটা উদার, মনের মধ্যে অহংকার বলে কিছু নেই, খুব সহজে মানুষকে আপন করে নিতে পারে। যে কারো বিপদে নিজের বিপদ বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে প্রিয়ন্তীর মোবাইলের রিং বেজে উঠল।
সুশান্ত মোবাইল করেছে, প্রিয়ন্তী রিসিভ করল, হ্যালো সুশান্ত।
প্রিয়ন্তী তুই কোথায়?
নাটোর পার হলাম, আর বেশি সময় লাগবে না।
আমি স্টেশনে এসেছি, তুই ট্রেন থেকে নেমে আমাকে দেখতে পাবি।
এত আগে এসেছিস কেন?
ভাবলাম ট্রেন যদি আগে আসে।
প্রিয়ন্তী মনে মনে হাসলো, সুশান্ত জীবনে কোনদিনদেখেছিস, ট্রেন কখনো আগে আসে?
তাছাড়া সময় কাটছিল না, তোকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে, তাই আগে এলাম।
তাহলে আর কী করবি? বসে বসে ভগবানের নাম জপ কর।
চলবে…
আমার এই উপন্যাসটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:প্রিয়ন্তী-০১

আমারও পরাণও যাহা চায়-০৪

10722-lost-love-poemsপাশের ঘরে জরিফুল থাকে। অনেক রাত জেগে কাজ করে, ফেসবুকে আড্ডা দেয়, রাতে শোয়ার সময় সে কয়েকবার লক্ষ্য করেছে একই গান বাজছে, হতে পারে জয়ও অনেক রাত জাগে, বই পড়ে, লেখালেখি করে। এইতো প্রায় দু’মাস আগের কথা। জয় প্রথম জয়েন করলো।
কয়েকদিন পর একদিন জরিফুল জয়ের রুমে ঢুকে একটা বই হাতে নিলো, পাতা উল্টিয়ে লেখক পরিচিতি পড়ে কিছুটা আবেগ আল্পুত হয়ে পড়লো, আপনি বই লিখেন স্যার? আমি জানতাম আমাদের ডিপার্টমেন্টের একজন স্যার বই লিখেন, আপনি সেই স্যার! আমি খুব খুশি হয়েছি স্যার, আমি একজন স্যার পেলাম যিনি একজন লেখকও, বলে জরিফুল বইটা নিয়ে বললো, আমি এটা নিই স্যার, পড়ে আবার দিয়ে দিবো।
পরের দিন এক ভদ্রমহিলা জরিফুলকে ফোন করলো, হ্যালো আসসালামুয়ালায়কুম।
ওয়ালেকুম আসসালাম, কে বলছেন প্লিজ!, অপরিচিত মহিলার কণ্ঠস্বর শুনে জরিফুল কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লো।
জয় আপনাদের ওখানে জয়েন করেছে না?
স্যারের কথা বলছেন? হ্যাঁ, ও আপনি ম্যাডাম বলছেন? আসসালামুয়ালায়কুম ম্যাডাম, জরিফুল কথাগুলো না বুঝেই বলে ফেললো।
ওয়ালেকুম আসসালাম। আপনি কি রাতে রেস্ট হাউজেই থাকেন?
জি ম্যাডাম।
আপনার স্যারের দিকে একটু খেয়াল রাখবেন।
জি ম্যাডাম, অবশ্যই।
আর একটা কথা, বলে ভদ্রমহিলা যেনো থমকে গেলো।
জি ম্যাডাম বলুন।
আর আমি যে আপনার কাছ থেকে আপনার স্যারের খোঁজখবর নিই এটা যেনো কেউ না জানে, এমনকি আপনার স্যারও না।
কথাটা শুনে জরিফুল কেমন একটা হোঁচট খেলো, জি ম্যাডাম কাউকে বলবো না।

সেদিনের পর থেকে সেই ভদ্রমহিলা প্রতিদিন রাতে জয়ের খোঁজখবর নেয়, আপনার স্যার সকালে কোথায় নাস্তা খায়, দুপুরে কোথায়, রাতে কোথায়? কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়?
ক’দিন আগে জিজ্ঞেস করলো, আপনার স্যার আরেকটা মোবাইল ফোন কিনেছে নাকি? রাত জেগে মোবাইল ফোনে কথা বলে নাকি? ফেসবুকে আরো এ্যাকাউন্ট খুলেছে নাকি?
জরিফুল অবশ্য সত্যি কথাই বললো, না, স্যার তো কাজ আর কাজ নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকে। তবে ফেসবুকে বসে…
বসে মানে?
ঠিক রাত ন’টায়। অল্প কিছুক্ষণ, এই প্রায় আধ ঘণ্টা।
অ।
সেদিনের পর থেকে ভদ্রমহিলা আগের মতোই খোঁজখবর নিতো। গতকাল রাতেও খবর নিয়েছে, এটা যেনো জরিফুলেরও রুটিন ওয়ার্ক হয়ে গেছে। রাতে স্যারের খবর ম্যাডামকে না দেয়া পর্যন্ত জরিফুলের যেনো দিনটা অসম্পুর্ণই থেকে যায়। কিন্তু আজ প্রায় তিন চার দিন হলো সেই ভদ্রমহিলার কোনো খোঁজখবর নেই, স্যারের সঙ্গে ম্যাডামের ঝগড়া-বিবাদ হলো নাকি?

জয়ের রুমে সেই একই গান বেজেই চলেছে, আমারও পরাণও যাহা চায়।
জরিফুল একবার ঘড়ির দিকে তাকালো, সকাল সাড়ে আটটা বাজে এখনো স্যার ঘুম থেকে উঠলেন না। স্যার তো প্রতিদিন সাতটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠেন, কিছুক্ষণ লেখালেখি করেন তারপর অফিসে এসে বসেন ঠিক সকাল ন’টায়। অথচ আজ সাড়ে আটটা বাজলো স্যার এখনো ঘুম থেকে উঠলেন না।
জরিফুল একবার জয়ের রুমের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রুমে সেই গানটা বেজেই চলেছে, জরিফুল মৃদু কণ্ঠে কয়েকবার ডাক দিলো, স্যার, স্যার
জয়ের কোনো সাড়া নেই।
জরিফুল জয়ের মোবাইল ফোনে রিং করলো কিন’ জয় ফোন রিসিভ করলো না।
জরিফুল পর পর কয়েকবার রিং করলো কিন্তু জয়ের কোনো সাড়া মিললো না।
ততক্ষণে সকাল ন’টা বেজে গেছে। অফিসের সবাই আসতে শুরু করেছে। জরিফুল প্রথমে খবরটা অফিসের বড় বাবুকে বললো। বড়বাবু বসকে জানালো।
বস আগে কয়েকবার ফোন করলেন, নিজে জয়ের নাম ধরে ডাকলেন কিন’ কোনোভাবেই জয়ের সাড়া মিললো না। অবেশেষে তিনি থানায় ফোন করলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে থানা থেকে পুলিশ এলো। পুলিশ অফিসার সবার উদ্দেশ্যে কিছুটা আদেশের সুরে বললেন, আপনারা কেউ অফিস ত্যাগ করবেন না। রুমের ভেতরেও আসবেন না। তারপর দরজা খোলার ব্যবস্থা করলেন।
পুলিশ অফিসার এবার জয়ের পালস পরীক্ষা করতে শুরু করলেন।
জরিফুলের হঠাৎ করে মনে হলো খবরটা একবার ম্যাডামকে দেয়া দরকার। সে তখনই ভদ্রমহিলাকে ফোন করলো।
চলবে…
আমার এই লেখাটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:আমারও পরাণও যাহা চায়-০১

প্রিয়ন্তী-০৩ (সংস্কারের প্রাচীর ভাঙ্গা তরুণী )

Priontiঅঞ্জনার মেয়ে হয়েছে, খবরটা শোনার পর থেকে দীপক বাবুর বাড়িতে আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করেছে, দীপক বাবু আত্মীয়-স্বজনদেরসবাইকে মোবাইল করে আনন্দের খবর জানাতে শুরু করল। অঞ্জনার মেয়ে হওয়ার খবর শুনে প্রিয়ন্তীও খুব আনন্দ পেল। সে মনে মনে নানান কিছু ভাবতে শুরু করল। তার চোখের সামনে একটা অষ্পষ্ট শিশুর ছবি ভেসে উঠল। তার আর অপেক্ষা সইছে না। প্রিয়ন্তীকে যখন তার বাবা মোবাইল করে তখন রাত প্রায় দশটা বাজে, সে তার বাবাকে জানিয়ে দিল, বাবা আমি কাল সকালের তিতুমীর এক্সপ্রেস ট্রেনে আসছি, তোমরা আমাকে ছেড়ে দিদির বাড়িতে যেও না কিন্তু।
সে কি মা তুই কিভাবে ভাবলি যে আমরা তোকে ছাড়া অঞ্জনার বাড়িতে যাবো, তুই চলে আয়, তারপর এখান থেকে কাল সন্ধ্যার ট্রেনে অঞ্জনার বাড়িতে যাবো।
প্রিয়ন্তী আগামীকাল বিরামপুর যাবার খবরটা সঙ্গে সঙ্গে সুশান্তকে জানালো, সুশান্ত আমি কাল সকালের তিতুমীর এক্সপ্রেসে বিরামপুর যাচ্ছি। মনে হয় কয়েকদিন থাকবো।
হঠাৎ করে বিরামপুর কেন?
বাবা মোবাইল করেছে, দিদির মেয়ে হয়েছে, কাল সন্ধ্যার ট্রেনে আমরা দিদির বাড়িতে যাবো।
তুই দু’য়েকদিন থেকে চলে আসিস।
সুশান্ত তুই বুঝতেই পাচ্ছিস, দিদির মেয়ে হয়েছে, মেয়ে দেখতে বাবা-মা যাবে, ঠাকুরগাঁও থেকে আমার মাসী পার্বতীপুর আসবে। আসতে তো দেরি হতেই পারে।
সুশান্তর ধীর, শান্ত কণ্ঠস্বরভেসে এলো, প্রিয়ন্তী তুই না থাকলে আমার খুব খারাপ লাগে, এমনিতেই দিনে কয়েকবার মোবাইলে কথা না বললে আমার মুড অফ হয়ে যায়। পর পর দু’দিন দেখা না হলে যেন মনের মধ্যে একটা অপরিপূর্ণতা থেকে যায়। আর তুই বিরামপুর অনেক দিন থাকলে-
সুশান্ত শুধু তোর না, তোকে ছেড়ে থাকতে আমারো খুব খারাপ লাগবে। আমি সুযোগ পেলেই তোকে ফোন করব, আমি তোকে বুঝতে দিব না যে আমি রাজশাহী নেই।
আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিস ভালো কথা কিন্তু হঠাৎ করে যেন ভুলে যাস না, আর আমি কাল সকালে তোকে ট্রেনে তুলে দিতে যাবো।
থ্যাংক ইউ সুশান্ত, আমিও তোকে একথা বলতে চাচ্ছিলাম, তুই একেবারে আমার মনের কথা বলেছিস।

পরদিন সকালবেলা সুশান্ত প্রিয়ন্তীকে ট্রেনে তুলে দিতে এলো। ট্রেন ছাড়তে কিছুক্ষণ দেরি। রাজশাহী স্টেশনের প্লাটফরমের একটা বেঞ্চে বসে দু’জনে কিছুক্ষণ গল্প করল। সুশান্তর বার বার একটাই কথা, প্রিয়ন্তী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসিস।
এ কথার উত্তরে প্রিয়ন্তী সুশান্তর চোখের দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে রইল, শুধু তোর কষ্ট হবে? আমার কষ্ট হবে না, না? একটা কথা তোকে বার বার বলতে হবে, বলে প্রিয়ন্তী হেসে ফেলল।
সুশান্তও হাসল, তবে চিরাচরিত সহজ সরল হাসি না, একটা কষ্ট মিশানো শুষ্ক হাসি।
কিছুক্ষণ পর ট্রেন প্লাটফরমে দাঁড়ালো। প্রিয়ন্তীর ব্যাগ ট্রেনে তুলে দিতে দিতে দু’জনের চোখ ছল্ছল করে উঠল। ট্রেন দৃষ্টিসীমা অতিক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত প্রিয়ন্তী বার বার করে সুশান্তর দিকে তাকাতে লাগল কিন্তু সুশান্ত হাত নেড়ে বিদায় জানালো না, সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

অঞ্জনার মেয়ে হওয়ার খবর শুনে বজ ঠাকুর খুশি হয়েছে তবে কথা বার্তায় মনে হলো ছেলে হলে সে আরো বেশি খুশি হতো। দীপক বাবুর কাছ থেকে কথাটা শোনার পর বজ ঠাকুর বলল, প্রথম বাচ্চা মেয়ে হইল!
দীপক বাবু বজ ঠাকুরের কথায় কিছুটা রাগ করল, ঠাকুর মশাই কিছু মনে করবেন না, অঞ্জনার মেয়ে হবে নাকি ছেলে হবে এটা নির্ধারণ করবে ভগবান, এখানে কারো হাত নেই। অঞ্জনার মেয়েই হোক আর ছেলেই হোক আমরা সবাই খুশি হয়েছি।
বজ ঠাকুর তার কথা ফিরিয়ে নিল, তা তুমি ঠিকই বলিয়াছ দীপক। তোমরা যাইবে কবে?
সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজকেই যাবো।
তা বেশ ভালো, বেশ ভালো, যাইবার আগে একবার ঠাকুর ঘরে আসিও।
হ্যাঁ আসবো।
প্রিয়ন্তী ট্রেনে ওঠার পর বাসন্তী একবার মোবাইল করে প্রিয়ন্তী ট্রেনে উঠেছে কি না জেনে নিয়েছে তারপর থেকে দীপক বাবু বার বার করে মোবাইল করে প্রিয়ন্তীর অবস্থানের খোঁজখবর নিচ্ছে। প্রিয়ন্তীর মোবাইলের রিং বেজে উঠল, হ্যালো বাবা।
মা তুই এখন কোথায়?
বাবা আমি এখন শান্তাহার, এত তাড়া কেন বাবা? আমি তো আসছিই।
একটু আগে অঞ্জনা মোবাইলে জিজ্ঞেস করল, আমরা রওয়ানা দিয়েছি কি না?
বাবা তুমি না বলেছ সন্ধ্যার ট্রেনে যাবে।
হ্যাঁ তা বলেছিলাম কিন্তু তোর মা আর ধৈর্য ধরছে না, খালি তাড়াহুড়া করছে।
প্রিয়ন্তী জানে আসলে তার মা ধৈর্য হারায়নি তার বাবাই অসহিঞ্চু হয়ে পড়েছে।
প্রিয়ন্তী বলল, একটু ধৈর্য ধরো বাবা, আমি তো আসছিই, প্রিয়ন্তীর কথায় বিরক্তি ফুটে ওঠার মতো হলেও আসলে সে মনে মনে খুশি হলো, সে আপন মনে বলল, আমার বাবা যেমন আমাকে ভালোবাসে সবার বাবা কি তাদের মেয়েদের এত বেশি ভালোবাসে?
মা তাহলে একটা কাজ করি, আমরা বিরামপুর রেলস্টেশনে অপেক্ষা করি, তোর আর ট্রেন থেকে নামার প্রয়োজন নেই আমরা ট্রেনে তোকে খুঁজে নিবো।
ঠিক আছে বাবা।

সুশান্তর একটা মানসিক রোগ আছে যে কোন কাজ পরদিন সকালে করার জন্য সময় নির্ধারণ করা থাকলে সারারাত তার মাথায় একটাই চিন্তা কাজ করে কখন রাত শেষ হবে আর কখন সে তার কাজ শেষ করবে। গতকাল প্রিয়ন্তী কথার সময় তাকে ট্রেনে উঠিয়ে দেওয়ার কথা বলেছে তাই তার রাতে ভালো ঘুম হয়নি। আজ কলেজে ক্লাস নেই, সকালবেলা প্রিয়ন্তীকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে এসে সুশান্ত বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিন্তু চোখে ঘুম নেই, একটু করে ঘুমের ভাব আসতেই প্রিয়ন্তীর কথা মনে পড়ছে আর তার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে।
ট্রেন রাজশাহী থেকে বিরামপুর পৌঁছাতে সুশান্ত তিন বার ফোন করেছে। পার্বতীপুর সবার সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে প্রিয়ন্তী একটু আড়ালে গিয়ে সুশান্তকে মোবাইল করে তার পৌঁছার খবর দিল, সেই সঙ্গে বলল, সুশান্ত আমি তো কখনো গ্রামের বাড়ি, কখনো দিদির বাড়িতে থাকবো। আমিই মাঝে মাঝে তোকে মোবাইল করব।
মোবাইলে সুশান্তর একটা বাষ্পনিরুদ্ধকণ্ঠস্বরভেসে এলো, ঠিক আছে তুই যখন আমাকে-
প্রিয়ন্তী সুশান্তর কথা শেষ হওয়ার আগেই বলল, সুশান্ত তুই বুঝতে চেষ্টা কর, আমি যদি বাবা-মা বা দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে থাকি আর তুই বার বার করে মোবাইল করিস তবে কি কাজটা ঠিক হবে?
সুশান্ত কোন কথা বলল না।
সুশান্ত আমি সুযোগ পেলেই তোকে মোবাইল করব, তুই দেখিস আমার ভুল হবে না। তুই বুঝছিস না কেন আমারো তো সব সময় তোর কথা মনে পড়ে?
ঠিক আছে, আমি আর তোকে মোবাইল করব না, সুশান্তর কণ্ঠে অভিমানের সুর ভেসে এলো।
প্লিজ সুশান্ত ডণ্ট মাইণ্ড।
চলবে…
আমার এই লেখাটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:প্রিয়ন্তী-০১

আমারও পরাণও যাহা চায়-০৩

10722-lost-love-poems
ফোনটা ভেঙ্গে দিয়ে ভালোই তো করেছিলে, কিন্তু না তাও তোমার সইবে না। আবার আরেকটা ফোন কিনে দিলে, ইসস আজ যদি আমার ফোন না থাকতো তবে ঘন ঘন হেল্প লাইনের ম্যাসেজ আসতো না, আমি ঘুমে, জাগরণে চমকেও উঠতাম না।
তোমার মনে আছে? যখন আমাদের ছোট্ট ডিঙি নৌকার মতো সংসারটা প্রতিদিন ঝড় আর ঢেউয়ের তাণ্ডবে ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছিলো তখন আমি একবার তোমাকে বলেছিলাম যদি শেষ পর্যন্ত হেরে যাই তবে দু’জনে একসঙ্গে এই পৃথিবী থেকে চলে যাবো।
তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে কীভাবে?
আমি বলেছিলাম আমার কাছে একপাতা, মানে দশটা হাই পাওয়ার ঘুমের ঔষধ আছে, খেলে…শেষ।
তুমি বলেছিলে, তাহলে একপাতা কেনো? তুমি চলে গেলে আমাকে কার কাছে রেখে যাবে। দু’পাতা আনো, একসঙ্গে মরবো, খুব ভালো হবে, ভালোবাসার একটা দৃষ্টান্ত হবে।
তারপর কেমন করে সব কী হলো? ঢেউয়ের তোড়ে আর ঝড়ের তাণ্ডবে আমাদের সংসার নামক বৈতরণী টাইটানিকের মতো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে সমুদ্রের অতলে ডুবে গেলো। কোথায় চলে গেলে তুমি আর কোথায় আমি। আমি কিন্তু সেই ঘুমের ঔষধগুলো নষ্ট করিনি। তুমি অনেকবার সেই ঔষধের নাম জানতে চেয়েছিলে, আমি বলিনি। এবার আমি একাই মরবো, তুমি তো চলে গেছো তোমার সুখের সন্ধানে, আর আমি তোমাকে পেয়েছে হৃদয়ের মাঝে, আর কিচ্ছু চাই না আমার, বলে জয় পাতা থেকে একে একে ঘুমের ঔষধগুলো খুলতে শুরু করলো। তার মোবাইল ফোনে তখনো গান চলছেই…
আমি তোমারো বিরহে রহিবও বিলীন,
তোমাতে করিবও বাস,
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী
দীর্ঘ বরসও মাস
যদি আরও কারও ভালোবাসো,
যদি আরও ফিরে নাহি আস
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও
আমি যত দূ:খ পাই গো।

জয় পুরো ঘর একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। ক’দিন আগে দু’জনের কিছু ছবি প্রিন্ট করে এনেছিলো। একটা ছবিতে দু’জন আধশোয়া হয়ে আছে, ইরা জয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে আর জয়ইও ইরার চোখের দিকে, দু’জনে একসাথে থেকে কী তৃপ্তি ফুটে উঠেছিলো ওদের দু’জনের চোখে। সেই-ই বিছানার চাদর, যেটা ইরা জোর করে জয়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। যখন ওদের দু’টো পথ দু’দিকে বাঁকা হয়ে যাচ্ছিলো, ইরা চলে যাচ্ছিলো তার ম্যাসে আর জয় তার অফিসে। ইরা জয়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো, এটাতে ঘুমাবে, আমাকে পাবে, আমার ছোঁয়া পাবে।
দু’জনের গণ্ডদেশ বেয়ে তখন অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছিলো।

আমি আজো সেই বিছানার চাদরেই শুয়ে আছি ইরা, পরণের সেই গেঞ্জি, সেই প্যান্ট-শার্ট, রুমের দেয়ালে দেয়ালে আমাদের পোস্টার সাইজের ছবি, হৃদয়ে তোমারই ছবি। এতো স্মৃতি নিয়ে আমি কীভাবে বেঁচে থাকি বলো তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি চলেই যাবো, তুমি নিশ্চয়ই জানো রবী ঠাকুরের মতো দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী অপেক্ষা করার মতো মানুষ আমি নই কিন’ আজ আমি এতো সি’র, শান্ত কেনো? হাতে আমার মৃত্যু পরোয়ানা, কিছুক্ষণ পরেই হয়তো আমি চলে যাবো এই পৃথিবী ছেড়ে কিন’ আমার মধ্যে কোনো দুশ্চিন্তা নেই, অস্থিরতা নেই, যেনো আমি হাসতে হাসতে মরতে যাচ্ছি সেই কবিতার মতো…
যখন তুমি এসেছিলে ভবে,
কেঁদেছিলে তুমি হেসেছিলো সবে,
এমন জীবন তুমি করিবে গঠন,
হাসিতে হাসিতে মরিবে তুমি সবাই কাঁদিবে তখন।

জয় একে একে কয়েকটা ঔষধ আমি খেয়ে নিলো, আমি কি তোমার জন্য কয়েকটা রেখে যাবো? তুমি যদি আমাকে বেঈমান বলো, যদি বলো আমার জন্য কয়েকটা রেখে গেলে না কেনো? এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে জয়ের দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসছে, শরীর অবশ হয়ে আসছে, আর কয়েকটা, আরো কয়েকটা কি আমি খেয়ে নিবো ইরা, যদি তাড়াতাড়ি, আরো তাড়াতাড়ি যেতে পারতাম, নাকি তোমার জন্য….
চলবে…
এই গল্পটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:আমারও পরাণও যাহা চায়-০১
আমার সব লেখা একসাথে পড়তে ক্লিক করুণ:আমার ঠিকানা
ফেসবুকে আমার লেখা উপন্যাস গডফাদার পড়তে লাইক দিন:গডফাদার

প্রিয়ন্তী-০২ (সংস্কারের প্রাচীর ভাঙ্গা তরুণী )

Prionti ব্রজেন্দ্র নাথ ঠাকুর, নামটা বেশ বড় আর উচ্চারণটা আরো কঠিন, তাই সবাই সংক্ষেপে তাকে বজ ঠাকুর বলে ডাকে। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই করছে কিন্তু শরীরের গড়ন ভালো হওয়ায় বয়স বোঝা যায় না। শৈশবে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে এটা তার জন্য যেন একটা গর্বের বিষয়। বজ ঠাকুর সব সময় সাধু ভাষায় কথা বলে এটাও যেন তার একটা অহংকার। কথায় কথায় সে নিজে নিজে বলে, আমি হইলাম গিয়া সেই আমলের পঞ্চম শ্রেণী পাস। আগে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কেউ আমার সহিত কথা বলিতে পারিতো না, ইদানিং কেউ কেউ চলিত ভাষায় কথা বলে তবুও কথা বলার মধ্যে হাজার গণ্ডা ভুল। আরে নিজের মায়ের ভাষাটাই যদি ঠিক মতো বলিতে না পারিলে তবে আর শিখিলে কী? আর গীতা পাঠ? গীতা পাঠ, পূজা অর্চনা পালন করিবার মতো ঠাকুর তো এই অঞ্চলে দ্বিতীয়টি নেই।

বজ ঠাকুর চল্লিশ বছর যাবত পূজা মণ্ডপে পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করে আসছে। আগের দিনে কেউ কোন সুপরামর্শের জন্য বজ ঠাকুরের স্মরণাপন্ন হতো, এখন শিক্ষার হার বেড়েছে, উচ্চ শিক্ষাও বেড়েছে তাই বজ ঠাকুরের কদর কিছুটা কমেছে তবে সনাতন রীতি-নীতির বিষয়ের এখনো বজ ঠাকুরই শ্রেষ্ঠ।

বাসন্তীর বয়স যখন পনেরো কিংবা ষোল তখন দীপক চক্রবর্তীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের সমস্ত সনাতন আনুষ্ঠানিকতা পালন করে বজ ঠাকুর। সেসূত্রে বজ ঠাকুর শেফালি আর দীপকের সংসারে অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করে। দীপক সেটা বুঝতে পেরেও মেনে নেয়।
দীপক চক্রবর্তীর দু’মেয়ে। বড় মেয়ে অঞ্জনা চক্রবর্তী পড়াশোনায় ভালো, দেখতেও অপূর্ব সুন্দরী। নবম শ্রেণীতে লেখাপড়া করার সময় থেকে বিয়ের জন্যসম্বন্ধআসতে থাকে, প্রথম থেকেই দীপক বাবুর ইচ্ছা দু’মেয়েকেই লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে। অঞ্জনার এস.এস.সি পরীক্ষার ফলাফলও ভালো আর সে কারণেই বিয়ের সম্বন্ধ আরো বেশি করে আসতে শুরু করল।

একবার সম্বন্ধএলো পার্বতীপুর থেকে। পাত্র এম.এস.সি পাস করে একটা বেসরকারী কলেজে অধ্যাপনা করে। দেখতে শুনতে ভালো, ধনাঢ্য পরিবারের ছেলে। পাত্রের বাবার প্রায় এক’শ বিঘা আবাদি জমি আছে, যা তার দু’ছেলের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ হলে পাত্রের ভাগে পরবে পঞ্চাশ বিঘা জমি। এমন পাত্র পাওয়া দুষ্কর ব্যাপার তারওপর বর্ণ অনুযায়ী পাত্র পাওয়া তো আরো কঠিন।

সবকিছু শুনে দীপক বাবু কিছুটা নমনীয় হলো। বাসন্তী সামান্য আপত্তি থাকলেও পাত্রের যোগ্যতা, বিষয় সম্পত্তি আর পারিবারিক ঐতিহ্যের কাছে সেও নীরব সমর্থন দিল। অঞ্জনা একবার আপত্তি তুলতেই বজ ঠাকুর রাম, রাম বলে তাকে তিরস্কার করল।
বজ ঠাকুর আরো বলল, কলি যুগ দীপক বুঝিলে, আগের দিনে মেয়েদের বিবাহ হইয়াছে কোনদিন জানিতেও চাহে নাই পাত্র কী করে? কোথায় বাড়ি? পাত্রের গায়ের রং কী রকম? আর আজকাল কী না বিয়েতে মেয়ের সম্মতি লইতে হইবে রাম, রাম, রাম।
দীপক বলল, না ঠাকুর মশাই অঞ্জনা বলছিল ও আরো লেখাপড়া করবে।
লেখাপড়া করিবে তো ভালো কথা, শিক্ষিত পরিবার, জামাই বাবু নিজেও কলেজের অধ্যাপক, অঞ্জনার লেখাপড়ার কোন অসুবিধা হইবে না। জামাই বাবু নিজের আগ্রহে অঞ্জনাকে লেখাপড়া শিখাইবে।
দীপক বাবু অঞ্জনার বিয়ে দিল অনেক টাকা পণ দিয়ে এবং খুব ধুমধাম করে।
দীপক চক্রবর্তীর ছোট মেয়ে প্রিয়ন্তী চক্রবর্তী। রাজশাহী কলেজে লেখাপড়া করে। অঞ্জনার মতো প্রিয়ন্তীও এস.এস.সি পাস করার আগে থেকেই তার বিয়ের সম্বন্ধআসতে থাকে কিন্তু দীপক বাবুর একই কথা, অঞ্জনার বিয়ে দিয়েছি, আশা করেছিলাম বিয়ের পর জামাই তাকে লেখাপড়া শেখাবে কিন্তু তা আর হলো না। আসলে বিয়ের পর মেয়েদের আর লেখাপড়া হয় না।

প্রিয়ন্তীও তার সিদ্ধান্তে অনড়, আগে লেখাপড়া শেষ করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, তারপর বিয়ে।

সেদিন লাইব্রেরীতে কথা বলার পর থেকে সুশান্ত একটু সুযোগ পেলেই প্রিয়ন্তীর সঙ্গে কথা বলতো, সুশান্ত যেমন প্রিয়ন্তীকে ভালোবেসেছে প্রিয়ন্তীও তেমনি মনে মনে সুশান্তকে ভালোবেসেছে। তারপর থেকে কলেজ ছুটি হলেই দু’জনে বেরিয়ে পড়ে যেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো।
আজ কলেজ বন্ধ, গতকাল প্রিয়ন্তীর সঙ্গে সুশান্তর কথা হয়েছে। আজ সকালবেলা দু’জনে একসঙ্গে বের হবে। সুশান্ত সকাল থেকে প্রিয়ন্তীর মোবাইলে রিং দিচ্ছে কিন্তু প্রিয়ন্তীর মোবাইল বন্ধ। প্রিয়ন্তীকে না পেয়ে সুশান্ত প্রিয়ন্তীর রুমমেট-এর মোবাইলে রিং করল কিন্তু না তার মোবাইলও বন্ধ। সুশান্ত কিছুটা বিরক্ত বোধ করল। তারপর সে প্রিয়ন্তীর মেসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
সুশান্তর মেস থেকে প্রিয়ন্তীর মেসে যেতে সাহেব বাজার মোড় অতিক্রম করতে হয়। প্রিয়ন্তীর ওপর রাগ থাকা সত্ত্বেও সে সাহেব বাজার মোড়ের একটা দোকান থেকে ফুল কিনলো। তারপর প্রিয়ন্তীর মেসের গেট-এ গিয়ে দাঁড়ালো।
মেসে একজন সার্বক্ষণিক গার্ড নিয়োজিত থাকে। সে গম্ভীর কণ্ঠে সুশান্তকে জিজ্ঞেস করল, কাকে চাই?
প্রিয়ন্তীকে।
মোবাইল করো।
মোবাইল বন্ধ, একটু ডেকে দিন না প্লিজ!
কী বলতে হবে?
বলবেন সুশান্ত এসেছে।
ঠিক তো?
মানে!
মানে এখানে তো সুশান্ত অশান্ত সবাই আসে, তুমি সুশান্ত ঠিক তো?
সুশান্ত হেসে উঠল, একেবারে ঠিক।
গার্ড ভিতরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর প্রিয়ন্তী বেরিয়ে এলো। প্রিয়ন্তী আজ লাল জর্জেটের কামিজ পরেছে। এমনিতেই প্রিয়ন্তীর গায়ের রং ধব্ধবে ফর্সা তারওপর লাল রংয়ের কামিজ যেন ফর্সা গালের ওপর আলতার প্রলেপ দিয়েছে। প্রিয়ন্তী কামিজের সঙ্গে ম্যাচিং করে কপালে একটা বড় আকারের টিপ দিয়েছে, সবকিছু মিলিয়ে প্রিয়ন্তী যেন আজ অপূর্ব সাজে সেজেছে।
সুশান্ত প্রিয়ন্তীর দিকে কয়েকমুহূর্ত তাকিয়ে রইল।
আজ প্রিয়ন্তী চোখ সরিয়ে নিল, কখন এলি সুশান্ত।
এই তো কয়েকমিনিট হলো, তোর মোবাইলে-
প্রিয়ন্তী সুশান্তকে ইশারা করে থামতে বলে হাত এগিয়ে দেখিয়ে বলল, চল।
দু’জনে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় এসে একটা রিক্সায় উঠল।
প্রিয়ন্তী জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবি?
চল পার্কে যাই।
চল।
কয়েকমিনিটের মধ্যে দু’জনে পার্কের গেটে এসে নামল। গেট পেরিয়ে অনেকদূর ভিতরে ঢুকে গেল।
দু’জনে একটা গাছের নিচে বসল।
প্রিয়ন্তী জিজ্ঞেস করল, এখন বল, মেসের সামনে কী বলতে চাচ্ছিলি?
আমি সকাল থেকে তোর মোবাইলে রিং দিচ্ছিলাম কিন্তু মোবাইল বন্ধ।
আমার মোবাইলে বেশিক্ষণ চার্জ থাকে না, কম দামি মোবাইল তো।
একটা বেশি দামি মোবাইল কিনে ফেল।
টাকা পাবো কোথায়?
আমি দিব।
তুই দিলেই আমি নিবো?
কেন? অসুবিধা কী?
সুশান্তর অতি আগ্রহের জবাবে প্রিয়ন্তী একবার রাগান্বিতচোখে সুশান্তর দিকে তাকাল। সুশান্ত আর কিছু বলল না একরকম অপরাধীর মতো সংকুচিত হলো।
কিছুক্ষণ দু’জনে নীরব তারপর সুশান্ত আবার বলতে শুরু করল, তোর মোবাইল বন্ধ পেয়ে তোর রুমমেট-এর মোবাইলে রিং দিলাম কিন্তু ওর মোবাইলও বন্ধ।
ও সিমকার্ড পাল্টিয়েছে।
মেয়েদের এই একটা দোষ, ক’দিন পর পর সিমকার্ড পাল্টায়।
পাল্টায় কি আর সাধে? ক’দিন যেতে না যেতেই নাম্বারসব ছেলেদের হাতে হাতে চলে যায়। দিন রাত বিরক্ত করে, মিস্ কল দেয়, আজে বাজে কথা বলে, এ্যডাল্ট এম.এম.এস পাঠায়।
তোরা সে সুযোগ দিস কেন?
সুযোগ দিই মানে? মোবাইল রিচার্জ করতে গেলে সেখান থেকেই নাম্বারনিয়ে শুরু হয় বিরক্ত করা।
ছেলেরা আসলে তোদের বিরক্ত করে নাকি তোরা বিরক্ত হতে আনন্দ পাস।
মানে?
না কোন কোন মেয়ে তো চায় দিন রাত তার মোবাইলে কল আসুক, তা না হলে কোন মেয়ে যদি একবার কোন ছেলেকে তাকে মোবাইল করতে নিষেধ করে বা আগ্রহ পাওয়ার মতো কোন সাড়া না দেয় তবে মোবাইল করবে কেন?
প্রিয়ন্তী সুশান্তর কথার কোন জবাব দিল না। সে দূরে তাকিয়ে রইল। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে খুব ঘনিষ্ঠভাবে বসে আছে, ছেলেটা মেয়েটার কাঁধে হাত দিয়েছে আর মেয়েটা ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সুশান্ত অনেকক্ষণ যাবত প্রিয়ন্তীর দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, প্রিয়ন্তী কী দেখছিস?
প্রিয়ন্তী কিছুটা লজ্জা পেল, না কিছু না।
সুশান্ত প্রিয়ন্তীর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিল।
প্রিয়ন্তী জিজ্ঞেস করল, সুশান্ত তুই আমাকে খুব ভালোবাসিস, না?
হ্যাঁ।
আচ্ছা তুই আমাকে একটা সত্য কথা বলতো, সেদিন হঠাৎ করে তুই লাইব্রেরীতে গিয়েছিলি নাকি আগে থেকেই আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করছিলি?
সুশান্ত লজ্জা পেল, প্রিয়ন্তী।
আচ্ছা থাক আর বলব না।
না তা তো হয় না, কারণ তুই আমার অনেকক্ষণ থেকে ইন্টারভিউ নিচ্ছিস আমাকে অন্ততঃ একটা প্রশ্নের উত্তর দে।
বল?
তুই কি আমাকে ভালোবাসিস?
প্রিয়ন্তী এ কথার উত্তরে কিছু বলল না। সুশান্তর চোখে চোখ রাখল। আজ সুশান্ত চোখ নামালো না, কয়েক সেকেণ্ড পর প্রিয়ন্তী একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, আমার উত্তর পেয়েছিস?
সুশান্ত না বোঝার ভান করে বলল, না।
সব প্রশ্নের উত্তর মুখে দিতে হয় না, অনেক প্রশ্নের উত্তর অনুভব করতে হয়।
আমি চোখের ভাষা বুঝি না, হৃদয়ের ভাষা বুঝি না, অনুভব করতেও পারি না।
সুশান্ত আমি তোর সরলতায় গর্ব বোধ করি আর তুই আমার সঙ্গে চালাকি করছিস?
সুশান্তর সেই সরল হাসি, আমি সরল না বোকা, তাই কিছু বুঝিনা।
বুঝিস না, না? বলে প্রিয়ন্তী সুশান্তর কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, আমি তোকে ভালোবাসি সুশান্ত, তোকে ছাড়া আমি কাউকে কোনদিন কল্পনাও করতে পারি না। যেকথা তোর আগে বলা উচিত ছিল সেকথা আমি বললাম, তুই তো একটা ভীতু।
সুশান্ত যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল, সে প্রিয়ন্তীর চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে দিয়ে তার কপালে চুমু দিল, প্রিয়ন্তী আমিও তোকে ছাড়া কোনদিন কাউকে কল্পনা করতে পারি না।
দু’জনে আরো কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর সুশান্ত বলল, প্রিয়ন্তী চল নদীর ধারে একটু বেড়িয়ে আসি?
চল।
দু’জনে পার্কের পাশেই পদ্মার ধারে গেল। তখন একটু একটু বাতাস বইছে। নদীতে ছোট ছোট নৌকাগুলো যেন মাঝে মাঝে ঢেউয়ের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। পদ্মার পাড়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ঢেউ আছড়ে পড়ছে। আর সেই সুমধুর ছন্দময় শব্দ সুশান্তকে যেন শিহরিত করছে।
দু’জনে একটা বেঞ্চে বসল।
পদ্মার পাড় থেকে দু’জন ফিরছে তখন সন্ধ্যা হতে আর বেশি দেরি নেই। সুশান্ত প্রিয়ন্তীকে নিয়ে একটা হোটেলে ঢুকল।
প্রিয়ন্তী কিছু বলল না।
সুশান্ত নাস্তার অর্ডার দিল।
প্রিয়ন্তী তো দেখে অবাক, এত নাস্তা খাবো কী করে?
আজকের দিনটা আমার জন্য একটু কষ্ট কর।
কিন্তু বিকেলবেলা এত বেশি নাস্তা খেলে তো রাত্রে ভাত খেতে পারবো না।
খাবি না।
আচ্ছা সুশান্ত একটা কথা তো জানাই হলো না, তোদের গ্রামের বাড়ি যেন কোথায়?
দিনাজপুর, ফুলবাড়ী উপজেলায়।
আমার বাড়ি তো তুই জানিস?
হ্যাঁ, দিনাজপুর, বিরামপুর উপজেলায়।
একেবারে প্রতিবেশী উপজেলায়, তাই তো আমার মনে হয় তোকে কোথায় যেন দেখেছি।
হবে হয়ত কোনদিন ট্রেনে বা রাস্তায়।
আগে বলিসনি কেন?
বলার সুযোগ পাইনি, মনে করেছিলাম তুই আবার কখন কি মনে করিস?
না, কিচ্ছু মনে করতাম না।
প্রিয়ন্তী আর কিছু বলল না, সে খেতে শুরু করল। নাস্তা শেষে কোল্ড ড্রিংক্স এর পাইপে মুখ লাগিয়ে প্রিয়ন্তী জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা সুশান্ত তোরা ক’ভাই বোন?
আমরা দুই ভাই।
তুই?
আমি ছোট।
তোর বড় ভাই বিয়ে করেছে?
হ্যাঁ।
তোর বউদি কি দেখতে খুব সুন্দর?
সুশান্ত একটা হাসি হাসল, প্রিয়ন্তী সে হাসির কোন অর্থ বুঝল না। সে না বুঝেই বলল, আমি তাদের সঙ্গে মানাবো তো?
আমি তোকে ভালোবাসি, তুই কার চেয়ে কম সুন্দরী সেটা আমার কাছে কোন বিষয় না, তুই আমার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী, সবচেয়ে আপন। তোকে যদি কেউ পছন্দ না করে তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না, আমি তোকে ভালোবেসেছি, আমি তোকে বিয়ে করব, তোকে পাওয়ার জন্য আমি সবকিছু ছাড়তে রাজি আছি।
প্রিয়ন্তী সুশান্তর দিকে তাকিয়ে রইল তার কথায় কোন জড়তা নেই, কোন কৃত্রিমতানেই। একেবারে স্বাভাবিক, যেন খাঁটি অন্তরের কথা। সুশান্তর কথা শেষ হলেও প্রিয়ন্তী স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
সুশান্ত জিজ্ঞেস করল, কী দেখছিস?
প্রিয়ন্তী সুশান্তকে একটু ধাক্কা দিয়ে মুচকি হাসি হাসলো, আমি তোকে ভালোবাসি এবং বিশ্বাস করি কিন্তু সুশান্ত তোকে যদি কোন দিন কোন সাহসী কাজ করতে হয় তবে তুই সাহস করতে পারবি কি না সে নিয়ে আমার সন্দেহ আছে।
সুশান্ত প্রিয়ন্তীর হাতে একটা চাপ মেরে তার থুতনি উঁচু করে ধরে বলল, আমাকে তোর সন্দেহ হয়, না? আমি কোন সাহসী কাজ করতে পারবো না। যখন সময় হবে তখন দেখিস, আমি সাহসী কি না?
প্রিয়ন্তী সুশান্তর চোখে চোখ রাখল। তার চোখে কোন লজ্জা নেই, কোন চাতুরতা নেই। তার চিরাচরিত সরলতায় প্রিয়ন্তীর বুক গর্বে ভরে গেল।
চলবে…
আমার এই উপন্যাসটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:https://www.shobdonir.com/writerzillur/106712
আমার সব লেখা একসাথে পড়তে ক্লিক করুন:writerzillur.com

আমারও পরাণও যাহা চায়-০২

10722-lost-love-poems

অফিসের রেস্ট হাউজে শুয়ে শুয়ে জয় চোখ বন্ধ করে সেই গান শুনছে আমারও পরাণও যাহা চায়… আর তার মন চলে গেছে জয়পুরহাটের তাদের সেই ছোট্ট বাসায়। যেখানে জয় আর ইরা ঘর বেঁধেছিলো। তাদেও সেই ঘরে দু’জনে সুখেই ছিলো। প্রতিদিন কোনো না কোনো বিষয়ে দু’জনে ঝগড়া করতো, হাসতো, কাঁদতো। আবার এক হয়ে যেতো। ইরার অভিমানটা ছিলো একটু বেশি। শুধু অভিমানই নয়, রাগ, ক্ষোভ, জিদ আর সন্দেহপ্রবণতা সবকিছু যেনো একটু বেশিই ছিলো। আর জয় ছিলো বরাবরই শান্ত, তাতেও ইরার সন্দেহ ছিলো, আচ্ছা তুমি আমার রাগ করো না কেনো বলোতো?
জয় বলতো, ইরা দু’জনে রেগে গেলে কি চলে? একজন রেগে গেলে আরেকজনকে তো শান্ত হতে হবে।
ইরার সেই রাগান্বিত কণ্ঠ স্বরটাও যদি জয় একবার শুনতে পেতো। মোবাইল ফোনে কতদিন থেকে ইরার কোনো ম্যাসেজ আসে না। অথচ আগে সবসময় জয়ের ফোনে ইরার ম্যাসেজ আসতো, কী করছো?
এই তো লিখছি।
নাস্তা খেয়েছো?
না, খাবো এখন।
কেনো তোমাকে না বলেছি সকাল সকাল নাস্তা খাবে। তুমি তো লিখতে বসলে আর সময়জ্ঞান থাকে না। তারপর হঠাৎ করে দেখো অফিসের সময় হয়ে গেছে। তখন তাড়াহুড়ো করে সব ফেলেটেলে অফিসের কাজে লেগে যাও। সেদিন আর নাস্তা করাই হয় না। সারাজীবন নিজের দিকে খেয়াল রাখলে না। অন্যের জন্য নিজেকে বিসর্জন দিলে।
আামি নিজেকে বিসর্জন দিলাম, একথা তুমি বললে, তুমি না আমাকে সবসময় স্বার্থপর বলো, আজ আবার নতুন সুর শুনছি।
আরে ওগুলো তো আমার রাগের কথা। আমি তো তোমাকে চিনি। তুমি জীবনে কোনোদিন নিজের কথা ভাবোনি।
জয়ের মোবাইল ফোনে তখনো বেজেই চলেছে,
আমারও পরাণও যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমারও পরাণও যাহা চায়।
তোমা ছাড়া আর এজগতে মোর কেহ নাই কিছু নাই গো
আমারও পরাণও যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমারও পরাণও যাহা চায়।

তুমি সুখ যদি নাহি পাও,
যাও সুখেরও সন্ধানে যাও,
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ও মাঝে
আর কিছু নাহি চাই গো।
আমারও পরাণও যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমারও পরাণও যাহা চায়।

জয় তন্ময় হয়ে গানটা শুনছিলো আর গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। সেদিন ইরা জয়কে গানটা শুনতে বলছিলো আর জয় না শুনেই বলেছিলো, আমি তোমাকে পেয়েছি, তুমি আমার ছন্দ, কবিতা, গান, তুমিই আমার সব। আমার আর নতুন করে আমারও পরাণও যাহা চায় শুনতে হবে না। ওসব তুমি শোনো।
অথচ আজ ইরা চলে যাবার পর জয় গানটা শুনছে আর আমার দু’চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে, হায় অভিমানী, কেনো, গানে গানে তোমার চলে যাবার কথা জানিয়েছিলে। আমি সেদিন যদি পুরো গানটা মনোযোগ দিয়ে শুনতাম আর তোমার চলে যাওয়ার কথা জানতাম তবে সবকিছু অন্যরকম হতো ইরা। আমি তোমাকে কোনোভাবে যেতে দিতাম না।

জয়ের মোবাইল ফোনে একটা ম্যাসেজ আসার রিংটোন বেজে উঠলো, জয় মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে দেখলো, না ইরার ম্যাসেজ না, হেল্প লাইনের কমার্সিয়াল ম্যাসেজ।

ফোনটা এভাবেই জয়কে যন্ত্রণা দিচ্ছে। জয় আপনমনে বিলোপ করে আবার বলতে শুরু করলো, কেনো দিয়েছিলে তুমি মোবাইল ফোনটা? প্রথমে একবার কিনে দিলে সখের বশে, জিদের বশে, ফোনটা হাতে দিয়ে বললে, আজ থেকে এই ফোন দিয়ে শুধু আমার সঙ্গে কথা বলবে, না, সরি, শুধু আমার সাথে না, আমার সাথে ফ্যামিলির সবার সাথে আর অফিসের কাজে।

আমি জানতাম এর পরের কথাটা তুমি কী বলবে, তবু জিজ্ঞেস করছিলাম তাহলে কার সাথে কথা বলতে পারবো না?
তুমি বললে, তোমার ভক্তদের সাথে।
আমি একটা দুষ্টুমীর হাসি হেসে বললাম, যদি কোনো ছেলে ভক্ত হয়?
তুমি রেগে বললে, তুমি বোঝোনি কার সাথে কথা বলতে নিষেধ করছি, তোমার মেয়ে ভক্ত, মেয়ে বন্ধু, মেয়ে কলিগদের সাথে। বুঝেছো বৎস।
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।
আমি তো তোমার কথামতো কোনো মেয়ের সাথে সাথে কথা বলছিলাম না। সেদিন রাতে তোমার সাথে ঝগড়া হলো, তুমি রাগ করে পাশের ঘরে গিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়লে, আমি তোমাকে তুলে আনার চেষ্টা করলাম, তুমি এলে না। তোমাকে ছাড়া কি আমার ঘুম আসে….
আমি বিছানায় ছটফট করছিলাম, তাই ফেসবুকে বসেছিলাম। তুমি দৌড়ে এলে পাশের ঘর থেকে, ছোঁ মেরে আমার কাছ থেকে মোবাইল ফোনটা নিয়ে মেঝেতে আছাড় মারলে, ফোনের স্ক্রিনটা ফেটে গেলো কিন’ তোমার রাগ কমলো না, মাটি কাটার সময় লোকেরা যেমন কোদাল দিয়ে মাটিতে কোপ মারে সেভাবে মোবাইল ফোনটা সজোরে আঘাত করলে মেঝেতে। ফোনটা ভেঙ্গে গেলো, আমি অসহায়ের মতো তোমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। আমার মুখ থেকে অষ্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো, ফোনটা ভেঙ্গে দিলে!

তারপর তুমি আমার বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে, তুমি আমার কাছ থেকে ফোনটা কেড়ে নিলে না কেনো? আমাকে মারলে না কেনো? অন্য কেউ হলে, মোশা হলে মেরে আমার হাড় ভেঙ্গে দিতো। আর তুমি কী না ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলে, তুমি ভালো, খুব ভালো জয়।

চলবে…

(বন্ধুগণ, জয়-ইরার জীবনের আনন্দ-বেদনা নিয়ে ৫৩ টি ছোটগল্প নিয়ে লেখা আমার একটি বই প্রকাশিত হবে আমার ৫৩ বছর বয়সে অর্থাৎ অমর একুশে বইমেলা-২০২১/২০২২ এ। আশা করি সঙ্গে থাকবেন)

এই লেখাটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:
https://www.shobdonir.com/writerzillur/106638
আমার সব লেখা এক সাথে পড়তে ভিজিট করুন:
http://www.writerzillur.com
ফেসবুকে আমার সাথে সার্বক্ষণিক থাকতে আমাকে এ্যাড করুন:
Zillur Rahman.

প্রিয়ন্তী-০১ (সংস্কারের প্রাচীর ভাঙ্গা তরুণী )

Prionti
প্রিয়ন্তীর সঙ্গে সুশান্তর বিয়ে হয়েছে তিনবার। একই বর-কনে তিনবার বিয়ের বিষয়টি অনেকের মনে কৌতুহলের সৃষ্টি করল, কারো অবিশ্বাস্য মনে হলো, কারো কারো মনে হাস্য রসের সৃষ্টি করল, কারো কারো হৃদয়কে আহত করল। কিন্তু একই বর-কনের মধ্যে তিনবার বিয়ে হবে কেন? এই কেন-এর উত্তর দিতে গেলে সমাজের যে অসঙ্গতি ফুটে উঠবে তা অনেকের বিবেককে দংশন করবে আর পরের ঘটনাগুলো মানুষের হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করবে।
প্রিয়ন্তী, প্রিয়ন্তী চক্রবর্তী তখন রাজশাহী কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। এ-প্লাস পেয়ে এস.এস.সি এবং এইচ.এস.সি পাস করেছে। ক্লাসের লেখাপড়ার বাইরে সে প্রচুর বই পড়ে। ইংরেজি সাহিত্য, বাংলা উপন্যাস, কবিতা, ছোটগল্প এমনকি যে কোন একটা বই হাতের কাছে পেলেই সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে। বলা যায় প্রিয়ন্তী একজন জ্ঞান পিপাসু মেয়ে। ক্লাসের মাঝে একটু অবসর পেলে অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা যখন কলেজের মাঠে গোল হয়ে বসে চিনাবাদাম খায়, কেউ কেউ তাদের ভালোবাসার মানুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলে, প্রিয়ন্তী তখন লাইব্রেরীতে বসে বই পড়ে। তার চালচলন সবকিছুই একেবারে ব্যতিক্রম।
প্রথম বর্ষে প্রিয়ন্তী ভালো রেজাল্ট করেছে। প্রিয়ন্তীএত ভালো রেজাল্ট করবে আশা করেনি, তাই তার আত্মবিশ্বাস আরো বেড়ে গেছে, সে আরো ভালো রেজাল্ট করার জন্য আরো বেশি করে লেখাপড়া শুরু করেছে। আজকাল সে কলেজের ক্লাস শেষ করেই মেসে ফিরে না, লাইব্রেরীতেই সময় কাটায়। কলেজ চালু থাকলে তার দু’টো ঠিকানা, ক্লাস আর লাইব্রেরী, কলেজ বন্ধ থাকলে মেস।
একদিন প্রিয়ন্তী ক্লাসের ফাঁকে লাইব্রেরীতে বসে একটা বই পড়ছিল। বই পড়া তো নয় যেন ধ্যানে মগ্ন থাকা। প্রিয়ন্তীর ক্লাসফ্রেণ্ড সুশান্ত, সেও ভালো ছাত্র তবে প্রিয়ন্তীর মতো নয়। প্রথম কয়েকদিন ক্লাস করার পর একদিন প্রিয়ন্তীর সঙ্গে সুশান্তর দৃষ্টি বিনিময় হলো। প্রিয়ন্তী লক্ষ্য করেছে সুশান্ত তার সঙ্গে কথা বলার অজুহাত খুঁজে। প্রিয়ন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন কিছু বলতে চায় কিন্তু বলতে গিয়েও যেন থেমে যায়। প্রিয়ন্তীরও প্রায় মনে হয় সুশান্ত যেন তার চেনা, কোথায় যেন দেখেছে কিন্তু মনে পড়ে না।
সেদিন প্রিয়ন্তী ক্লাসের ফাঁকে লাইব্রেরীতে একটা বই পড়ছিল। সুশান্ত একটা বই খোঁজার অজুহাতে প্রিয়ন্তী যেখানে বসে বই পড়ছিল ঠিক তার কাছের একটা বই ইচ্ছা করে র্যাক থেকে ফেলে দিল।
প্রিয়ন্তী বই থেকে মুখ তুলে তাকাল। সুশান্তর গায়ের রং শ্যামলা, লম্বা, নামের সঙ্গে আচরণের একটা অদ্ভুত মিল আছে। তার চেহারায় সরলতার ছাপ আছে যা সহজে কারো মধ্যে পাওয়া যা না। কখনো সুযোগ পেলে প্রিয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে থাকে, কখনো প্রিয়ন্তীর চোখে চোখ পড়লে সুশান্ত আগে চোখ নামায়।
প্রিয়ন্তীর চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল কিন্তু সে কিছু বলল না।
সুশান্ত সরি প্রিয়ন্তী বলে বইটা তুলে রাখল। তার ধারণা ছিল প্রিয়ন্তী হয়ত কিছু বলবে আর সে অজুহাতে সুশান্ত তার সঙ্গে কথা বলবে কিন্তু প্রিয়ন্তী কিছু না বলায় সুশান্ত কিছুটা নিরাশ হলো।
আজ সুশান্ত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে করেই হোক আজ সে প্রিয়ন্তীর সঙ্গে কথা বলবেই। সে বইটা তুলে রেখে প্রিয়ন্তীর মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল, প্রিয়ন্তী।
প্রিয়ন্তী কিছু বলল না।
সুশান্ত মনে মনে বলল, কী আনকালচার্ড মেয়ে রে বাবা, আমি কথা বললাম আর সে কোন কথাই বলল না। সে যেমন ছিল তেমন করেই বইয়ে মনোযোগ দিল।
সুশান্ত একটু নড়েচড়ে বসল।
না, প্রিয়ন্তীর কোন কথা নেই।
সুশান্ত প্রিয়ন্তী, প্রিয়ন্তী বলে দু’বার ডাক দিল।
তারপরও কোন কথা নেই।
সুশান্ত আপন মনে আস্তে আস্তে বলল, প্রিয়ন্তী কি কানে শোনে না নাকি? ক্লাসে তো কোনদিন এমন মনে হয়নি?
প্রিয়ন্তী বইটা বন্ধ করে রেখে বলল, একটা বই পড়ছিলাম, খুব ইন্টারেস্টিং তো।
আমি তিনবার ডাক দিয়েছি।
শুনেছি।
কথা বললি না যে! খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলি বুঝি?
হ্যাঁ, আমি কোন কাজ করলে খুব মনোযোগ দিয়ে করি আর কোন কাজ না করলে তার ধারের কাছেও যাই না।
সুশান্ত কিছু বলল না।
সুশান্ত কেমন আছিস?
ভালো, তুই?
ভালো আছি।
প্রিয়ন্তী একটা খবর শুনেছিস?
কী খবর?
আজ আর ক্লাস হবে না।
কেন?
স্যার অসুস্থ।
ও আমি পরের ক্লাসটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তাহলে তো আজ আর থেকে লাভ নেই, বলে প্রিয়ন্তী চেয়ার থেকে উঠল।
সুশান্ত মিষ্টি হাসি হেসে বলল, আমি বুঝি তোকে বলে ভুল করলাম।
কেন?
এই যে তুই উঠছিস, আমি যদি কিছু না বলতাম তবে তুই আরো কিছুক্ষণ লাইব্রেরীতে বসতিস।
হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক, প্রিয়ন্তী একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার বসল।
প্রিয়ন্তী সুশান্তর দিকে তাকাতেই সুশান্ত হাসল।
সুশান্তর হাসিটা অদ্ভুত। একেবারে সহজ-সরল, নিষ্পাপ একটা হাসি। আজ প্রিয়ন্তীর মনের মধ্যে যেন সুশান্তর ছবিটা গেঁথে গেল, সুশান্ত তুই কি হোস্টেলে থাকিস?
না একটা মেসে।
হোস্টেলে সিট পাসনি?
না, অবশ্য কোন রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে পেতাম।
দিলে ভালো করতিস।
রাজনীতিতে যোগ দিলে মিছিলে যেতে হবে।
যাবি।
তুই যেতে বলছিস?
বাঃ আমি যেতে বললে তুই যাবি?
সুশান্ত খুব সরলভাবে বলল, হ্যাঁ।
সুশান্ত এটা কিন্তু ঠিক না, আমি যেতে বললেই তুই যাবি?
সুশান্ত কিছু বলতে গিয়ে যেন আটকে গেল। হয়ত বলতে চেয়েছিল, তোকে আমার ভালো লাগে তাই কিন্তু প্রিয়ন্তীর গম্ভীর শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারলো না।
চলবে…

আমারও পরাণও যাহা চায়

10722-lost-love-poems

ক’দিন থেকে জয় একটা গানই শুনছে, আমারও পরাণও যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো… কিন্তু এই একটা গানের মধ্যে কী আছে যে যে দিনরাত জয় একটা গানই শুনছে। কোনো কোনো দিন গভীর রাতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, শিশুর মতো, কখনো কখনো কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলতেই থাকে, কেনো চলে গেলে অভিমানী, কেনো এভাবে চলে গেলে। তুমি জানো না, আমি তোমাকে কত ভালোবাসি, আমি বলতাম আমি তোমাকে ভালোবাসি, খুব সহজভাবে, হাসতে হাসতে, আর তুমি ভাবতে আমি বুঝি কথার কথা, বলতে হয় তাই বলছি।

তুমি বলতে এভাবে বলতে হয় না, তুমি ভালোবাসি কথাটা এমনভাবে বলো যে মনে হয় হাল্কাভাবে, কৃত্রিমভাবে, আমাকে খুশি করার জন্য বলছো, যার মধ্যে কোনো গভীরতা নেই।
আমি তখন সত্যিই কৃত্রিমভাবে কণ্ঠস্বর গম্ভীর করার চেষ্টা করতাম, বলতাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি ইরা।
তুমি বলতে তবুও হয়নি।
তখন আমি তোমাকে বুকে জড়িয়ে বলতাম, একবার আমার হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করো, বুঝতে পারবে আমি তোমাকে কত ভালোবাসি।
তুমি নিবীড়ভাবে আমার হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে মিশে যেতে, দু’জন অনেকক্ষণ পরস্পরের হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করতাম, আমি বিশ্বাস করতাম তুমি আমাকে ভালোবাসো কিন’ তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে না।
আমি আবারো জিজ্ঞেস করতাম, কী বুঝতে পেরেছো?
তুমি বলতে, পেয়েছি, তুমি আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসো, তবে শুধু আমাকে না। আরো অনেককে।
ইরা মার খাবে কিন’…
তুমি হেসে বলতে, পারবে, তুমি আমাকে মারতে পারবে, মারো না গো, একটু মার দাও, বলে রান্নাঘরে একরকম দৌড়ে যেতে, তরকারি কাটার চাকু এনে হাতে দিতে, এই নাও, এই নাও চাকু, আমাকে মারো, কাটো, আমার শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে দাও, যেনো সারাজীবন হৃদয়ে তোমার স্মৃতি, আমার সমস্ত শরীরে তোমার স্মৃতি বয়ে বেড়াতে পারি, সেটাই হবে আমার জন্য সবচেয়ে সুখের জীবন।
আমিও হেসে ফেলতাম আবার তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতাম, আমি তোমাকে মারতে পারবো না ইরা, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে পারবো না।
মুহূর্তে তুমি গম্ভীর হয়ে যেতে, তুমি কষ্ট দিতে পারবে না কিন’ আমি তো কষ্ট পাচ্ছিই জয়।
কেনো? তুমি কষ্ট পাচ্ছো কেনো? আমি তো এমনকিছু করছি না যাতে তুমি কষ্ট পাও?
এই যে তুমি ফোনে হাজার জনের সাথে কথা বলো, তোমার কত ফ্যান, ফ্রেন্ড। তোমার হৃদয়ে এতো মানুষের ভিড়ে জায়গা করে নেয়া আমার জন্য কঠিন। আমি পারবো না।
পারবো না মানে? পেরেছো, আমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে তো এখন তুমিই ইরা।
এটা তুমি বলতে পারো কিন’ আমি তো তোমার মাঝে আমাকে খুঁজে পাই না জয়। একসাথে সারাজীবন থাকার মানে এই না যে একজন আরেকজনকে পেয়েছে। স্বামী-স্ত্রী একসাথে থাকার পরও কেউ কাউকে নাও পেতে পারে কিন’ আশ্চর্যের বিষয় কি জানো?
কী?

কোনোদিন কোনো স্বামী বা স্ত্রী বোঝার চেষ্টাও করেনা যার সঙ্গে সে সারাজীবন সংসার করছে, একঘরে থাকছে, এক বিছানায় রাত্রি যাপন করছে সে আদৌ তাকে পেয়েছে কী না। কোনোদিন জানার চেষ্টাও করে না। তুমি একবার চোখ বন্ধ করো আমাকে ফিল করো, দেখবে আমাকে তুমি ষোলো আনা পেয়েছো, আমার ভালোবাসায় কোনো খাত নেই।
আমি চোখ বন্ধ করলাম, হ্যাঁ সত্যি সত্যি আমি তোমাকে পেয়েছি ইরা।
কিন’ আমি তো তোমাকে পাইনি জয়। আমি দু’চোখ বন্ধ করে যখন তোমাকে খুঁজি…
আমি ইরার দু’বাহুতে ঝাঁকি মেরে বললাম, থামলে কেনো ইরা? থামলে কেনো বলো?
মিথ্যা কথা বলবো না, পেয়েছি, আমিও তোমকে পেয়েছি, খণ্ডিত, আমি তোমার কাছে পেয়েছি খণ্ডিত প্রেম। আর দিয়েছি নিখুঁত ভালোবাসা।
আমি ইরাকে জড়িয়ে ধরতে গেলাম, ইরা রান্নাঘরে চলে গেলো। যেতে যেতে বললো, আমি নাস্তা তৈরি করি, তুমি রেডি হও। তোমার অফিসের সময় হয়নি?
আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জোরে বললাম, না, এখনো আমার অফিসের সময় হয়নি।
তাহলে শুয়ে শুয়ে এই গানটা শোনো বলে তুমি গানটা চালু করে দিয়ে চলে গেলে, আমারও পরাণও যাহা চায়…

চলবে…
পরবর্তী পর্ব আগামীকাল।

(বন্ধুগণ, জয়-ইরার জীবনের আনন্দ-বেদনা নিয়ে ৫৩ টি ছোটগল্প নিয়ে লেখা আমার একটি বই প্রকাশিত হবে আমার ৫৩ বছর বয়সে অর্থাৎ অমর একুশে বইমেলা-২০২১/২০২২ এ। আশা করি সঙ্গে থাকবেন)

আমার সব লেখা এক সাথে পড়তে ভিজিট করুন: www.writerzillur.com
ফেসবুকে আমার সাথে সার্বক্ষণিক থাকতে আমাকে এ্যাড করুন: https://www.facebook.com/profile.php?id=100000449437795
যাত্রার একঘেঁয়েমি কাটাতে আমার বই পড়ুন: https://sheiboi.com/Pages/BookDetails.html?/Dag/285