জিল্লুর রহমান এর সকল পোস্ট

জিল্লুর রহমান সম্পর্কে

চোখের সামনে যেকোন অসঙ্গতি মনের মধ্যে দাগ কাটতো, কিশোর মন প্রতিবাদী হয়ে উঠতো। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটতো কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে। ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে, নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবিতা। কবিতার পাশাপাশি সামাজিক অসঙ্গতি নিয়ে শুরু হলো ছোটগল্প, উপন্যাস লেখা। একে একে প্রকাশিত হতে থাকলো কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস। প্রকাশিত হলো অমর একুশে বইমেলা-২০১৬ পর্যন্ত ০১টি কাব্যগ্রন্থ, ১৭ টি উপন্যাস এবং ০১ টি ধারাবাহিক উপন্যাসের ০৩ খণ্ড। গ্রন্থ আকারে প্রকাশের পাশাপাশি লেখা ছড়িয়ে পড়ল অনলাইনেও। লেখার শ্লোগানের মতো প্রতিটি উপন্যাসই যেন সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। সর্বশেষ প্রতিচ্ছবিটি প্রকাশিত হয় অমর একুশে বইমেলা-২০১৭।

বিদায় বেলা-শেষ পর্ব

Joypurhat Rail Station
বদলির আদেশ পাবার পর জয়ের যাবার প্রস’তিও সম্পন্ন হলো। জয় এই দীর্ঘ কর্মজীবনে অনেক জায়গায় চাকুরি করেছে, অনেক ঘাটে তরী ভিড়িয়েছে কিন’ কোথাও নোঙ্গর ফেলেনি। কোথাও তার হৃদয় গেঁথে যায়নি। অথচ জয়পুরহাটে শুধু তার হৃদয় গেঁথেই গেলো না, হৃদয় খণ্ডিত হলো, রক্তাক্ত হলো। তার এই রক্তাক্ত হৃদয় থেকে এখনো সবসময় রক্ত ঝরছে, দু’চোখ বেয়ে অবিরত অশ্রু ঝরছে।
জয়পুরহাটে জয়ের চার বছরের চাকুরি জীবন, তিন বছরের প্রেম, তিপ্পান্ন দিনের দাম্পত্য জীবনের অবসান হলো। সে দিনাজপুর যাওয়ার জন্য ফার্স্ট ক্লাসের টিকেট কিনে স্টেশনের প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে আছে। ইরা অনেকদিন তাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কষ্ট পাবে ভেবে সে তার আগেই ইরাকে ওর বাসে তুলে দিয়েছে। আজ যদি ইরার সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকতো তবে হয়তো ইরা এই প্লাটফরমে তাকে বিদায় জানাতো।
জয় সেই তালগাছের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে তার সেই কল্পনার জানালার দিকে। হয়তো ইরাও তাকিয়ে আছে। ইরার সঙ্গে তখন সেপারেশন হয়েছে কিন’ ডিভোর্স হয়নি। তখন একদিন ইরা বলেছিলো, ট্রেনের হর্ন শুনলেই তার বুকটা কেঁপে ওঠে, মনে হয় এই বুঝি ট্রেন এলো আর তুমি বুঝি ট্রেনে চড়ে দিনাজপুর চলে গেলে। আবার কখনো মনে হয় বিকেল হলেই প্লাটফরমের দিকে তাকিয়ে থাকি, যদি তোমাকে এক পলক দেখতে পাই। যে ইরা প্রতিদিন ট্রেনের শব্দ শুনলেই জানালায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতো সে যখন জানবে তার হৃদয় রক্তাক্ত করে, হৃদয় টুকরো টুকরো করে জীবনের শেষ ট্রেনটি চলে গেছে তখন এতো বড় কষ্ট ইরা সইবে কী করে?
ইরা, ইরা বুঝি এখনো জানালার কাছে বসে প্লাটফরমের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই জানালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার দু’চোখ সজল হলো। আজ ট্রেন এক ঘণ্টা দেরিতে আসবে। প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। প্লাটফরমে আবছা আবছা অন্ধকারে তার মনে হলো একটা অস্পষ্ট ছায়া তার পাশে এসে দাঁড়ালো। নিজের অজান্তে তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ইরা, আমার ইরা।
সেই অস্পষ্ট ছায়াটি জয়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। তার কানে একটা করুণ আর্তনাদ ভেসে এলো, চলে যাবে!
কথাটা জয়ের বুকে প্রচণ্ড আঘাত করলো।
ইরা অভিমানের সুরে বললো, তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না।
ভালোবাসি না মানে?
ভালোবাসলে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারতে না।
আমি তো তোমাকে ছেড়ে যাইনি ইরা তুমি তো আমাকে ডিভোর্স দিয়েছো। এখন আর থাকা না থাকার মধ্যে তফাৎ কী।
তাই বলে তুমি আমাকে রেখে চলে যাবে! ডিভোর্স হয়েছে কিন’ হৃদয়ের সব স্মৃতি তো মুছে যায়নি, হৃদয়ের সম্পর্ক তো আর ছিন্ন হয়নি। একটা কথা মনে রেখো হৃদয় কখনো বিচ্ছিন্ন করা যায় না।
দূর থেকে ট্রেনের আলো জয়ের চোখে পড়তেই সে চমকে উঠলো। না তার আশে পাশে তো কেউ নেই।
ট্রেন আসতে দেখে স্টেশনে চাঞ্চল্য দেখা দিলো। যাত্রীরা ছুটোছুটি শুরু করলো। জয় ট্রেনে উঠলো। এই জয়পুরহাট রেল স্টেশন, বারোঘাটি পুকুর, বৈরাগীর মোড়, এই সব অতি চেনা জায়গায় তার আর কোনোদিন আসা হবে না। ভাবতেই বুকে একটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
জয়ের সিট পড়েছে পূর্বদিকের ঠিক জানালায়। এই জানালা থেকে ইরার জানালা চোখে পড়ছে। একটা অস্পষ্ট নারী মূর্তি যেনো জানালায় দাঁড়িয়ে আছে, এটাই কী আমার ইরা? নিশ্চয়ই ইরা জানালায় দাঁড়িয়ে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরা বলেছিলো ট্রেনের শব্দ শুনলেই সে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে।
জয়ের গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো, ইরা, আমার হৃদয় জুড়ে আছে ইরা, তোমাকে রেখে আমি চলে যাচ্ছি, হয়তো চিরদিনের জন্য, তোমার সঙ্গে হয়তো আর কোনোদিন দেখা হবে না। যাকে কয়েকদিন না দেখলে আমি অসি’র হয়ে যেতাম, দু’য়েক ঘণ্টা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ না হলে আমার কানের কাছে মোবাইল ফোনের শব্দ বেজে উঠতো, তার সঙ্গে আমার আর কোনোদিন দেখা হবে না, তার কণ্ঠস্বর আর কোনোদিন আমার কানে ভেসে আসবে না।
ট্রেন ছাড়ার করুণ বাঁশি বেজে উঠলো। ধীরে ধীরে ট্রেন এগিয়ে চললো জয়ের হৃদয়হীন দেহ নিয়ে গন্তব্য দিনাজপুরের দিকে, পিছনে পড়ে রইলো তার প্রেম, তার হৃদয়, তার বুক ভেঙ্গে যেনো হু হু করে কান্না বেরিয়ে এলো। নিজের অজান্তে হৃদয় চিরে বেরিয়ে এলো, ইরা, আমার ইরা, বিদায়,। চিরবিদায়।
সমাপ্ত

(বন্ধুগণ, জয়-ইরার জীবনের আনন্দ-বেদনা নিয়ে ৫৩ টি ছোটগল্প নিয়ে লেখা আমার একটি বই প্রকাশিত হবে আমার ৫৩ বছর বয়সে অর্থাৎ অমর একুশে বইমেলা-২০২১/২০২২ এ। সেই ৫৩ টি ছোটগল্পের মধ্যে এটি ৩য়, অর্থাৎ ০৩/৫৩। আশা করি সঙ্গে থাকবেন)
আমার সব লেখা এক সাথে পড়তে ভিজিট করুন: www.writerzillur.com
ফেসবুকে আমার সাথে সার্বক্ষণিক থাকতে আমাকে এ্যাড করুন: https://www.facebook.com/profile.php?id=100000449437795
যাত্রার একঘেঁয়েমি কাটাতে আমার বই পড়ুন: https://sheiboi.com/Pages/BookDetails.html?/Dag/285

বিদায় বেলা-০২

কয়েকমাস আগের কথা। ইরার সঙ্গে তখনো জয়ের বিয়ে হয়নি। ইরা তার সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রায়ই কোনো না কোনো কাজের অজুহাতে জয়পুরহাট আসতো। দু’জনে সারাদিন ঘুরে বেড়াতো, সাথী নার্সারি, উর্বী নার্সারী, শিশু উদ্যান, বারো শিবালয় মন্দির, ছোট যমুনার পাড়। কেনাকাটা করতো নিউ মার্কেট, মৌসুমী মার্কেট, মাড়োয়ারী পট্টি, ক্যাটস পো। ক্যাটস পোতে ইরা জয়ের জন্য শার্ট পছন্দ করে তার গায়ে এলিয়ে দিয়ে জয়কে আয়নার কাছে নিয়ে যেতো, তার পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলতো, তোমাকে সুন্দর মানিয়েছে না?
জয় বলতো, শার্টটা সুন্দর মানিয়েছে, তবে তারচেয়ে সুন্দর সুন্দর মানিয়েছে আমাদের দু’জনকে।
ইরা লজ্জায় সংকুচিত হতো।
জয় বলতো যেমন ঝলমলে শার্ট তেমনি রাঙ্গা তরুণী।
ইরা মুখ বিকৃত করে বলতো, তরুণী? ছত্রিশ বছর বয়সেও তরুণী, তাহলে বুড়ি হবো কবে?
যারা প্রেম করে তারা নব্বই বছর বয়সেও তরুণী।
জয় কয়েকমিনিট আগেই গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের পানি মুছলো। আবার তাদের আনন্দময় স্মৃতির কথা মনে করে হাসছে তাকে কেউ পাগল বলছে না তো? ডানে-বাঁয়ে একবার তাকালো, না কেউ তার দিকে তাকায়নি। পৃথিবীতে কারো দিকে তাকানোর মতো সময় কারো নেই। যে যার সে তার।
সেদিন জয় দিনাজপুর যাবে এদিকে ট্রেনের সময়ও হয়ে গেছে আবার ইরাকেও বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেয়ার সময় হয়েছে। ইরা জয়কে বললো, প্রতিদিন তো তুমি আমাকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসো আজ আমি তোমাকে ট্রেনে তুলে দিবো।
তোমার দেরি হয়ে যাবে যে।
হোক, প্রতিদিন তুমি আমাকে হ্যাজবেন্ডের কাছে যাবার জন্য তুলে দিয়ে আসো হাসিমুখে। আমি বুঝতে পারি কষ্টে তোমার বুক ফেটে যায় কিন’ হাসিটা মুখে লেগেই থাকে। তুমি আমার জন্য খুব চিন্তা করে করে এমন সিচুয়েশন তৈরি করো যেনো আমি কোনোভাবে কষ্ট না পাই। আজ আমি তোমাকে ট্রেনে তুলে দিবো। দেখি তোমাকে তোমার বউয়ের কাছে পাঠাতে আমার কষ্ট লাগে কী না।
ইরার কথাটা যেনো জয়ের বুকে একটা ধাক্কা দিলো, ইরা তাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিবে? অনেক কষ্ট পাবে ইরা। ওর বুক ফেটে যাবে। জয় নিজেকে সংবরণ করে নিয়ে বললো, না ইরা, ট্রেনের এখনো দেরি আছে, চলো তোমাকে আমি রেখে আসি।
না। ট্রেন যত দেরিই হোক আজ আমি তোমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে তারপর যাবো।
জয়ের দু’চোখ পানিতে ছলছল করে উঠলো। কারণ ইরা সত্যি বলেছে ওকে ওর স্বামীর কাছে যাওয়ার জন্য যখন সে বাসে তুলে দিতে যায় তখন তার বুকটা ফেটে যায়। তার সবসময় মনে হয় ইরা আমার, শুধুই আমার। আমার ইরা কেনো আরেকজনের কাছে যাবে। ইরা এই কষ্ট সইতে পারবে না বলে জয় আবার ইরাকে বললো, না তোমাকে দেরি করতে হবে না। আমি তোমাকে রিক্সায় তুলে দিই, তুমি যাও।
জয়ের চোখে পানি দেখে ইরার দু’চোখ ছলছল করে উঠলো, তুমি আমাকে এতো ভালোবাসো? আমি কষ্ট পাবো বলে তুমি… বলতে বলতে ইরার কণ্ঠস্বর বুজে এলো।
জয় ইরাকে একটা রিক্সায় তুলে দিলো। ইরা চলে গেলো।

চলবে…
পরবর্তী পর্ব আগামীকাল।

(বন্ধুগণ, জয়-ইরার জীবনের আনন্দ-বেদনা নিয়ে ৫৩ টি ছোটগল্প নিয়ে লেখা আমার একটি বই প্রকাশিত হবে আমার ৫৩ বছর বয়সে অর্থাৎ অমর একুশে বইমেলা-২০২১/২০২২ এ। সেই ৫৩ টি ছোটগল্পের মধ্যে এটি ৩য়, অর্থাৎ ০৩/৫৩। আশা করি সঙ্গে থাকবেন)
আমার সব লেখা এক সাথে পড়তে ভিজিট করুন: www.writerzillur.com
ফেসবুকে আমার সাথে সার্বক্ষণিক থাকতে আমাকে এ্যাড করুন: https://www.facebook.com/profile.php?id=100000449437795
যাত্রার একঘেঁয়েমি কাটাতে আমার বই পড়ুন: https://sheiboi.com/Pages/BookDetails.html?/Dag/285

বিদায় বেলা-০১

Joypurhat Rail Station

ক’দিন হলো ইরার সাথে জয়ের বিচ্ছেদ হয়েছে। ওদের প্রায় তিন বছরের প্রেম, জয়পুরহাটের পথ-ঘাট, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, পার্ক-নার্সারিতে মুক্ত পাখির মতো ছুটে বেড়ানো, তিপ্পান্ন দিনের দাম্পত্য জীবনের অবসান হয়েছে। শরীরের কোনো অঙ্গ বিচ্ছেদ হলে মানুষ দেখতে পায়, অঙ্গ বিচ্ছেদের কারণে শরীর থেকে রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে, সবাই সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। কেউ এন্টিসেপটিক নিয়ে, কেউ এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে। ডাক্তার আসে অপারেশনের যন্ত্রপাতি নিয়ে। কেউ চুক চুক করে হলেও আফসোস করে কিন’ ওদের প্রেম, পবিত্র দাম্পত্য সম্পর্কের অবসান হলো, চোখের জলে গণ্ডদেশ প্লাবিত হলো, হৃদয় রক্তাক্ত হলো কেউ একবারো বিন্দুমাত্র সহানুভূতিও দেখালো না। যারা জানলো তাদের দু’য়েকজন জয়কে বললো, তোমার জয়পুরহাটের ঝামেলাটা মিটেছে?

জয়পুরহাটের ঝামেলা? কথা শুনলেই জয়ের মাথায় রক্ত উঠে যায়। ওদের হৃদয় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়েছে, ওদের প্রেম, ওদের স্বপ্ন, ওদের সংসার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো আর সবাই বলে, ঝামেলাটা মিটেছে?

টুকরো টুকরো হয়ে হৃদয়ের বিচ্ছেদ হলে কেউ দেখে না। এ যেনো খুব সামান্য ব্যাপার, প্রেম প্রেম খেলা চলছিলো, আবেগের বশে বিয়েও হয়েছিলো, তালাক হয়েছে। বাহ কাজির সবুজ রেজিস্টারে দু’টো স্বাক্ষর করেই সব বন্ধন, সব সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়, আইনের দৃষ্টিতে হয়তো সব মিটে যায় কিন’ হৃদয়ের কাছে, দু’টো স্বাক্ষর করলেই কি অতীতের সব স্মৃতি, আনন্দ, বেদনা, সব হৃদয় থেকে মুছে যায়? না, হৃদয়ের সম্পর্ক কখনো বিচ্ছিন্ন করা যায় না।
কথাটা প্রথম ইরাই বলেছিলো। ইরা বলেছিলো, আমি তোমাকে ডিভোর্স করেছি শুধু একটা রেজিস্টারের দু’টো পাতায় সই করে। কাগজে সই করলেই ডিভোর্স হয় কিন’ মনে রেখো হৃদয়ের সম্পর্ক ছিন্ন হয় না।

ইরা মানুক আর না মানুক ওদের বিচ্ছেদ হয়েছে। বিচ্ছেদের ঘা এখনো দগদগ করছে, দাম্পত্য জীবনের স্মৃতিময় মুহূর্তগুলোর কথা মনে করে যখন তখন দু’চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। জয়ের যখন মনে হয় ইরা আর তার কেউ না তখন কোনোভাবেই সে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারে না।

সেদিন জয় নওগাঁ যাওয়ার জন্য জয়পুরহাট স্টেশনের প্লাটফরমে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলো। একদিন ফোনে কথা বলার সময় ইরা বলেছিলো সে ট্রেনের শব্দ শুনলেই জানালা দিয়ে স্টেশনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার সিঁড়িঘরের স্কাই লাইট দিয়ে স্টেশনের দিকে তাকালে স্টেশনের পূর্ব দিকে যে দু’টো তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে, সেই তালগাছের ফাঁক দিয়ে প্লাটফরম দেখা যায়। জয় একথা মনে করে সেই তালগাছের ফাঁক দেখে দাঁড়ালো। যদিও কয়েকদিন থেকে ইরার সাথে তার কথা হয়নি, হয়তো হবেও না কোনোদিন। তবু ইরা যদি একবার জানালার দিকে তাকায় আর তাকে দেখতে পায়, যদি দেখতে পেয়ে ফোন দেয়। ভালোবাসার মানুষকে এক পলক দেখতে পাওয়া, কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়ার জন্য যে কত ব্যাকুলতা থাকে তা যারা ভালোবাসে শুধু তারাই জানে। ভালোবাসার মানুষকে কাছে পাবার সাধ মানুষের কোনোদিন হারায় না। জয় ইরার স্কাই লাইটের কথা মনে করে দূরে একটা উঁচু বিল্ডিংয়ের স্কাই লাইটের দিকে তাকিয়েছিলো। কতক্ষণ মনে নেই, সিঁড়িঘরে হয়তো ইরা নেই কিন’ সেই স্কাই লাইটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জয়ের দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিলো। সে চোখ মুছলো, তার হাতের ডান দিকে বারোঘাটি পুকুর। এই পুকুরের পাড়ে একটা চায়ের দোকান আছে, ইরার বি.এড পরীক্ষার সময় ওরা এই চায়ের দোকানে কিছুক্ষণ বসতো, চা খেতে খেতে গল্প করতো। ইরা এই দোকানের একটা নামও দিয়েছিলো, মধুর ক্যান্টিন। জয় দু’য়েক পা করে হাঁটতে হাঁটতে মধুর ক্যান্টিনের দিকে গেলো। তার দু’চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে।

এই জয়পুরহাট প্লাটফরমে ইরার সাথে তার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ইরাসহ একবার রাজশাহী যাচ্ছিলো। ট্রেন অনেক দেরিতে ছিলো, ওরা অনেকক্ষণ এই প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে দু’জনে গল্প করেছিলো। রেললাইন পার হয়ে ওপারে গিয়ে পিঁয়াজি-বেগুনি খেলো। তখন সন্ধ্যা, প্লাটফরমের লাইটপোস্টে বাতি নেই, আবছা আবছা অন্ধকার। রেল লাইন থেকে প্লাটফরম বেশ উঁচুতে, প্লাটফরমে উঠতে গিয়ে জয় ইরাকে হাত ধরে টেনে তুললো, তারপর প্লাটফরম দিয়ে দু’জনে হাঁটছিলো, ইরা জয়ের কাঁধে ভর করে গা ঘেঁষে হাঁটছে। হঠাৎ করে ইরা জয়কে টেনে ধরলো, তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, আমাকে সারাজীবন এভাবে ধরে রাখবে তো?

জয় ঘুরে দাঁড়ালো। অন্ধকারে দু’জনে মুখোমুখি, পাশ দিয়ে যাত্রীরা যাচ্ছে সেদিকে ওদের খেয়াল নেই। জয় ইরার থুঁতনি উঁচু করে ধরে চোখে চোখ রাখলো, ইরার দীপ্তিময় দু’চোখ পানিতে ছলছল করছে। জয় আবেগজড়িত কণ্ঠে বললো, সারাজীবন রাখবো।
এমনি হাজারো চিন্তা করতে করতে জয়ের মোবাইল ফোন বেজে উঠলো।
সিরাজ ফোন করেছে, জয়ের কলিগ। তার দু:সময়ের সবচেয়ে আপনজন।
জয় রিসিভ করলো, হ্যালো আস্‌সালামুয়ালায়কুম।
ওয়ালেকুম আস্‌সালাম, কেমন আছো জয়?
ভালো, তুমি?
ভালো আছি, তোমার তো বদলি হয়েছে।
ক’দিন আগেও জয় বদলি হওয়ার জন্য চেষ্টা করছিলো, যেদিন ইরা বাসা থেকে চলে গেলো, তার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে শুরু করলো, জয় আমি সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে এসেছিলাম, তুমি আমার সাথে প্রতারণা করেছো, আমি তোমার বিরুদ্ধে মামলা করবো, তোমার চাকরি খাবো, তোমাকে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।

তখন ইরার কথা শুনে জয়ের মনে হচ্ছিলো সে আর তার নেই, এক সময়ের বন্ধুই এখন তার দিকে বন্দুক তাক করে সুট করার অপেক্ষায় আছে। সামনে পেলে গুলি করে তার মাথার খুলি উড়িয়ে দিবে। তাই সেও বদলির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলো কিন’ ইরার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর পরিসি’তি এখন অনেকটাই শান্ত, জয় মাথা থেকে বদলির সিদ্ধান্তটা মুছে ফেলেছিলো। ঠিক এমন সময় সিরাজের কথা শুনে জয়ের বুকটা যেনো ভেঙ্গে গেলো। সে কিছুটা আর্তচিৎকারের মতোই বললো, বদলি!
হ্যাঁ, তুমি না এতোদিন বদলির চেষ্টা করছিলে এখন আবার এমন করে বলছো কেনো?
জয় মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলো, কোথায়?
রাণীশংকৈল।
ততক্ষণে ট্রেন প্লাটফরমে ঢুকে পড়েছে, ইঞ্জিন ইরার দিকে তাকানোর জানালাটা ঢেকে দিয়েছে।
জয় ট্রেনে উঠলো।

চলবে…
পরবর্তী পর্ব আগামীকাল।

(বন্ধুগণ, জয়-ইরার জীবনের আনন্দ-বেদনা নিয়ে ৫৩ টি ছোটগল্প নিয়ে লেখা আমার একটি বই প্রকাশিত হবে আমার ৫৩ বছর বয়সে অর্থাৎ অমর একুশে বইমেলা-২০২১/২০২২ এ। সেই ৫৩ টি ছোটগল্পের মধ্যে এটি ৩য়, অর্থাৎ ০৩/৫৩। আশা করি সঙ্গে থাকবেন)
আমার সব লেখা এক সাথে পড়তে ভিজিট করুন: www.writerzillur.com
ফেসবুকে আমার সাথে সার্বক্ষণিক থাকতে আমাকে এ্যাড করুন: https://www.facebook.com/profile.php?id=100000449437795
যাত্রার একঘেঁয়েমি কাটাতে আমার বই পড়ুন: https://sheiboi.com/Pages/BookDetails.html?/Dag/285

জীবনের শেষ গোধূলী-শেষ পর্ব

Shes Godhuli

ইরা গতকাল গ্রামের বাড়ি এসেছে। আসার পর থেকে সুযোগ খুঁজেছে বাসা থেকে বেরিয়ে জয়পুরহাট আসার। তারপর স্মৃতিময় বারো শিবালয় মন্দির, ছোট যমুনা নদী। জয় ইরাকে কথা দিয়েছিলো প্রতি বছর বছরের শেষ গোধূলীটা দু’জনে একসঙ্গে দেখবে। আজ সেই সুযোগ পেয়েছে ইরা, এমন একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো ইরা দুই যুগ থেকে। ইরা বাসা থেকে বেরিয়ে একটা অটোতে উঠে সোজা কালাই এসেছে, ভাগ্যক্রমে পাঁচশিরা এসে একটা সি.এন.জি পেলো। ইরা কোনোকিছু না বলেই সি.এন.জি’তে উঠলো।
সি.এন.জি’র ড্রাইভার তো অবাক, কোথায় যাবেন আপনি? না বলে উঠলেন কেনো?
ইরা বললো, জয়পুরহাট যাবো, তুমি যাবে না?
না।
যাবে না কেনো? চলো তোমাকে আমি অনেক টাকা দিবো।
অনেক টাকা মানে? ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো।
ইরা চোখ বড় বড় করে বললো, তোমাকে আমি পাঁচশো টাকা দিবো, যাবে না?
টাকার লোভে ড্রাইভার যেতে রাজি হলো। সেই সি.এন.জি নিয়ে ইরা সোজা চলে এলো বারো শিবালয়। তখন বিকেল চারটা বাজে। তখন থেকে ইরা জয়কে খুঁজছে কখনো বটগাছের চারপাশে লুকোচুরি করার মতো, কখনো নদীর ধার বরাবর একবার উজানে, একবার ভাটিতে।

বিকেল থেকে ইরাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মোশা প্রথমে পাশের বাড়ি, স্কুলের আশ-পাশ, দেবর-ননদের বাড়ি এবং জয়পুরহাট ইরার বাবার বাড়িসহ অনেক খোঁজাখুঁজি করলো। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। ইভা জুঁইকে বকাবকি করলো, একসাথে তো ছিলি তুই আবার কোথায় গিয়েছিলি যে তোর দাদিকে দেখে রাখতে পারলি না। খবর শুনে আত্মীয়-স্বজনরা বাড়িতে এলো, একেকজন একেকরকম পরামর্শ দিতে লাগলো।
অবশেষে মাইকিং শুরু হলো, কিছুক্ষণের মধ্যে খবরটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো। কেউ কেউ বললো, বয়স্ক মহিলা কোথায় আর যাবে, মাথায় একটু গণ্ডগোল ছিলো, পথ ভুলে কোথাও গেছে। পথ খুঁজে পেলে ঠিকই চলে আসবে।
কিন্তু গভীর রাত পর্যন্ত মাইকিং, বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজির পরও ইরাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। বাড়িতে একটা শোকের ছায়া নামলো।

ততক্ষণে রাত গভীর হয়েছে, ইরা শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে, সেদিকে তার খেয়াল নেই, তার কাছে এখনো সূর্য অস্ত যায়নি। সে বিড়বিড় করে কথা বলেই চলেছে, তুমি ভেবেছো আমি রাগ করে চলে যাবো? আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো, তুমি কথা দিয়েছো আসবে, আমি সেই অপেক্ষায় থাকবো। বলে কথা বলতে বলতে ইরা নদীতে নামলো, তারপর আবার বলতে শুরু করলো, একবার আমরা এখানে এসেছিলাম বর্ষায়, এখানে একটা নৌকা বাঁধা ছিলো। আমরা নৌকায় উঠলাম। আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম, বলছিলাম আমি সাঁতাড় কাটতে জানি না। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে, বলেছিলে তোমার সাঁতাড় কাটতে হবে না। আমি তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখবো, ডুবে যেতে দিবো না।
আমি বলেছিলাম, তোমাকে তুলতে হবে না, জানো না প্রেমের মরা জলে ডুবে না।
কথা বলতে বলতে ইরা নদীতে নামলো, স্রোতস্বীনির কাছে দাঁড়ালো, পানিতে ইরার অস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো। ইরা পানিতে তার নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলে উঠলো, পেয়েছি, এই তো তুমি তোমার ছায়া রেখে গেছো। আমি জানতাম তুমি আমাকে ফাঁকি দিয়ে যাবে না, তুমি ফাঁকি দিতেই জানো না। আমি তোমাকে না পাই তোমার ছায়া তো পেয়েছি। আমি তোমার ছায়াকেই বুকে জড়িয়ে ধরে রাখবো সারাজীবন। তোমার ছায়া বুকে জড়িয়ে আমি সারাজীবন কাটিয়ে দিবো। বলে ইরা জয়ের ছবি মনে করে তার নিজের প্রতিচ্ছবিকে জড়িয়ে ধরার জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
নদীতে তেমন পানি ছিলো না। সোজা হয়ে দাঁড়ালে ইরা হয়তো দাঁড়িায়ে থাকতে পারতো কিন্তু ঝাঁপ দেয়াতে তার মুখ ডুবে গেলো পানিতে। সে বাঁচার চেষ্টা করলো হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করতে লাগলো।

বারো শিবালয় মন্দিরের সামনে গতন শহর-খঞ্জণপুর রাস্তার ওপর মানুষের ভিড় জমেছে। কৌতূহলী মানুষের প্রশ্ন কী হয়েছে? কী হয়েছে ভাই?
একজন বললো, নদীতে একটা লাশ পাওয়া গেছে।
লাশ, কার লাশ?
একজন বিরক্ত হয়ে বললো, আরে ভাই কার লাশ কে জানে? হয়তো ভেসে এসেছে দূর থেকে।
আরেকজন বললো, না, দূর থেকে না। কাল বিকেলে আখ কাটার সময় কামলারা দেখেছে এই বুড়িকে বটগাছের নিচে বিড় বিড় করতে, সেই মহিলারই লাশ।
একটা পুলিশের ভ্যান এলো। কয়েকজন পুলিশ সদস্য বাঁশি বাজিয়ে ভিড় ফাঁকা করে বটগাছের শেকড়ের সঙ্গে আটকে থাকা লাশ টেনে উপরে তুললো।
পুলিশের একজন অফিসার ওয়্যারলেসে বিড়বিড় করে ম্যাসেজ পাঠালো। মিডিয়া কর্মীরা ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যে খবরটা জয়পুরহাট শহর, পুরা জেলাসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়লো।
জুঁই প্রথম ছবিটা দেখলো, তার এক ফ্রেন্ড ছবিটা ফেসবুকে শেয়ার করেছে। দেখে সে চিৎকার করে উঠলো, দাদি।
পাশের রুম থেকে ইভা দৌড়ে এলো। মোশা বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো সে ফিরে এলো। ইভা জিজ্ঞেস করলো, কী হলো মা?
জুঁই তার ল্যাপটপের স্ক্রিন দেখিয়ে বললো, মা দাদি নেই, বলে সে বিলোপ করে বলতে শুরু করলো, দাদি কাল আমাকে বললো গোধূলী দেখতে যাবে। জয় না কার সাথে নাকি দাদির এক সাথে গোধূলী দেখার কথা আছে। আমি যদি জানতাম সুযোগ পেলে সত্যি সত্যি দাদি একাই গোধূলী দেখতে যাবে আর সেটাই হবে দাদির জীবনের শেষ গোধূলী তবে… বলে জুঁই আবার বিলোপ করে কাঁদতে শুরু করলো।

সমাপ্ত
এই ছোটগল্পটি প্রথম থেকে পড়তে ক্লিক করুন:https://www.shobdonir.com/writerzillur/105715

(বন্ধুগণ, জয়-ইরার জীবনের আনন্দ-বেদনা নিয়ে ৫৩ টি ছোটগল্প নিয়ে লেখা আমার একটি বই প্রকাশিত হবে আমার ৫৩ বছর বয়সে অর্থাৎ অমর একুশে বইমেলা-২০২১/২০২২ এ। সেই ৫৩ টি ছোটগল্পের মধ্যে এটি ২য়, অর্থাৎ ০২/৫৩। আশা করি সঙ্গে থাকবেন)

জীবনের শেষ গোধূলী-দ্বিতীয় পর্ব

Shes Godhuli
হাঁটতে হাঁটতে ইরা ঠিক সেই জায়গায় গেলো আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে যেখানে সে আর জয় বছরের শেষ বিকেলটা কাটিয়েছিলো। তারপর ইরাকে মোশা নিয়ে গেলো তার বাসায়, তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে প্রথম কয়েকদিন ঘরে বন্দি করে রাখলো, তারপর স্কুল যাওয়ার সময় কাউকে না কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতো, স্কুলের সবাই জানতো তার জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো এবং তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, তার চাকরিকে জিম্মি করে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসার কথা। তাই সবাই একরকম পাহারা দিয়ে রাখতো ইরাকে, সে যেনো কারো সাথে কথা বলতে না পারে। তার সবসময় নিজেকে কয়েদি মনে হতো, কয়েদি বললে ভুল হবে, চিড়িয়াখানার প্রাণি মনে হতো নিজেকে। হ্যাঁ চিড়িয়াখানার প্রাণিই তো সে, তা না হলে সবাই তাকে দেখতে আসবে কেনো, সবাই তাকে দেখতে আসতো, আর ঘৃণা করতো, আড়ালে ফিসফিস করে বলতো, ছি: এই বয়সে স্বামী-সংসার ছেড়ে মহিলাটা পালিয়ে গিয়েছিলো অন্য পুরুষের সঙ্গে।

পাশে থাকা আরেকজন বললো, শুধু পালিয়ে গিয়েছিলো, বিয়েও করেছিলো কিছুদিন সংসারও করেছে তারপর আবার ফিরে এসেছে। কেউ কেউ বলতো, যখন পালিয়ে গিয়েছিলো তখনো একটা দিক ছিলো তার। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হলে বিচ্ছেদ হয়, সেই বিচ্ছেদ ঘটিয়েই তো চলে গিয়েছিলো তো আবার ফিরে এলো কেনো?

একদিন তার এক কলিগ বললো, চলে এলেন কেনো আপা? গেছেন যখন তখন আবার ফিরে এলেন কেনো? সবাই খুব ছি: ছি: করছে। ইরা কারো কথার কোনো জবাব দেয় না। চিড়িয়াখানার প্রাণিগুলোকে কেউ কিছু ছুঁড়লে যেমন তারা আশ্রয় খুঁজে এক কোণ থেকে আরেক কোণে যায়, খাঁচার মধ্যেই নিজের আশ্রয় খুঁজে, ইরাও তেমনি মুখ বুজে চুপ করে নিজের কাছেই নিজের আশ্রয় খুঁজে। কিন্তু এতো বড় পৃথিবীতে তার আশ্রয় কোথায়! গোটা পৃথিবী যেনো আঙ্গুল তুলে তাকে ঘৃণা করছে, তিরস্কার করছে। পৃথিবীতে একটি মানুষও কি নেই তার মনের ভাষা বোঝার। আছে একমাত্র জয়ই ছিলো যে তার মনের ভাষা বুঝতো, সেই মানিক-রতন সে নিজেই ছেড়ে এসেছে। তার সেই স্মৃতি, মানুষের অপমান সইতে না পেরে সে একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে।

মোশা তাকে ঢাকায় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখালো। ডাক্তার ঔষধের সঙ্গে কিছু পরামর্শও দিলো। তাকে একা থাকতে নিষেধ করলো, তার স্মৃতিময় জায়গাগুলো থেকে দূরে কোথাও বেড়িয়ে আসার পরামর্শ দিলো। ডাক্তারের পরামর্শ শুনে ইরা হিহি করে হেসে উঠলো, ডাক্তার সাহেব আপনার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে, আমার বায়ুবদল দরকার, আগের দিনের উপন্যাসগুলোতে পড়তাম, ডাক্তাররা এমন পরামর্শই দিতেন। এখনকার দিনে এমন হয় না কিন্তু আপনি সেই সেকেলেই রয়ে গেছেন।

মোশা ইরার দিকে একবার রাগান্বিত চোখে তাকাতেই ইরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, তাকাবে না, আমার দিকে এভাবে তাকাবে না। তুমি, তুমি তো আমার সর্বনাশ করেছো, তুমি যদি আমাকে জোর করে নিয়ে না আসতে, জোর করে আবার বিয়ে না করতে তবে আমার কিচ্ছু হতো না। আমার এ অবস্থার জন্য তুমি দায়ি, তুমিই।
যে চাকরিকে জিম্মি করে মোশা জোর করে, কৌশলে, কুটচাল দিয়ে ইরাকে তার কাছে ফিরিয়ে এনেছিলো ইরার মানসিক ভারসাম্যহীনতার জন্য সেই চাকরিটা আর থাকলো না।

ততদিনে শুভ’র লেখাপড়া শেষ করে চাকরিও হয়েছে। শুভ’র পোস্টিং হলো পাবনায়। শুভ ইরাকে পাবনায় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখালো কিন্তু পরামর্শ সেই একই। স্মৃতিময় জায়গাগুলো আর মোশা কাছ থেকে দূরে রাখা। ডাক্তারের পরামর্শে শুভ ইরাকে নিয়ে গেলো তার বাসায় আর মোশা পড়ে রইলো তার গ্রামের বাড়িতে। ইরার ইচ্ছাও তা-ই ছিলো। জয়ের কাছ থেকে তোমরা যদি আমাকে নিয়েই যাও তবে আমি আমার ছেলের কাছেই যাবো। ইরা, তার বউমা ইভা আর শুভ এই তিনজনের সংসার ভালোই কেটে যাচ্ছিলো। প্রায় বছর দু’য়েক পর ইভার একটা ফুটফুটে মেয়ে হলো। মেয়েটি দেখতে খুব সুন্দর হয়েছে, ইরার মতোই হয়েছে। ইরা তার নাতনির নাম রাখলো জুঁই।

সেই জুঁই’র বয়স এখন বিশ বছর। এই বিশ বছরে ঈদে কোরবানীতে ইরা গ্রামের বাড়ি এসেছে কিন্তু বাড়ি এলেই ইরার মাথাটা গোলমেলে হয়ে যায়। ইরা উত্তরের জানালায় বসে স্কুলের সেই বিল্ডিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার গণ্ডদেশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে, এই বিল্ডিংয়ের কাজ দেখতে জয় আসতো আর তখনই ইরার সঙ্গে জয়ের পরিচয় হয়েছিলো। ইরা সুযোগ পেলেই বিল্ডিংয়ে চলে যায়, দেয়ালে মাথা ঠুকে বলে, কেনো? কেনো তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। তুমি না আমাকে কথা দিয়েছিলে আবার বিল্ডিংয়ের কাজ দেখতে আসবে। কেনো? আসো না কেনো?

রাতের আঁধারে বাড়ির সামনের ছোট্ট বাগানের ক্রিস্টমাস ট্রিতে ওড়না পেঁচিয়ে ইরা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছে। ইরার সঙ্গে জয়ের কথা ছিলো প্রতি বছর বড়দিনে ইরা এই ক্রিস্টমাস ট্রিকে আলোক সজ্জায় সজ্জিত করবে, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিবে। জয়ের সাথে বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে, স্মৃতিময় দিনগুলোতে ইরার মাথাটা গরম হয়ে উঠে।

জয়পুরহাট এলে ইরা পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এক দোকান থেকে আরেক দোকানে যায়। জোরে চিৎকার করে বলে, ঐ যে ক্যাটস পো, আমি আমার জয়কে এই ক্যাটস পো’তে শার্ট কিনে দিতাম, জয় নতুন শার্ট পরে ট্রায়াল রুম থেকে বের হতো, কী স্মার্ট আমার জয়।
জুঁই এসব কথা শুনছে ছোটবেলা থেকে, এখন সে বড় হয়েছে, দাদির কষ্ট সে এখন বোঝে। একদিন জুঁই ইরাকে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা দাদি তুমি যে সবসময় জয়, জয় করো, কই তোমার জয় তো একবারো তোমার কাছে এলো না। আজকাল তো মোবাইল ফোন আছে, ইন্টারনেট আছে, তোমার জয় তো একবারো তোমার খোঁজ নিলো না।

ইরার মুখ কালো হয়ে গেলো। সে যেনো বুকে একটা ধাক্কা খেলো, আসতো, আসতো কিন্তু আমার মনে হয় তোর দাদু ওকে নিষেধ করে দিয়েছে, হয়তো অনেক বকা দিয়েছে। তোর দাদু যে জটিল, যে পেঁচুক মানুষ, ওর সঙ্গে আমার জয় পারবে না। তুই দেখিস্‌ এবার বাড়ি গেলে আমি ঠিকই জয়কে ডেকে নিয়ে আসবো তোর কাছে, দেখিস্‌ আমার জয় কত সুন্দর আর স্মার্ট।
জুঁই মুখ বিকৃত করে বললো, আছে তোমার জয় এখনো স্মার্ট আছে, সুন্দর আছে, সত্তর বছরের বুড়োর আবার স্মার্টনেস।
ওর শরীরের গড়নটা খুব ভালো। বয়স বোঝা যায় না। দেখিস্‌, ওকে দেখলে তুই আবার বলে ইরা হি হি করে হেসে উঠলো।
জুঁই মুচকি হাসি হেসে বললো, কি ভাবছো আমি তোমার জয়ের প্রেমে পড়ে যাবো?
হ্যাঁ যাবিই তো। তুই দেখিস্‌ কালই আমি ওকে নিয়ে আসবো। কাল একত্রিশ ডিসেম্বর না?
হ্যাঁ, তাতে কী?
একত্রিশ ডিসেম্বর জয় আসবে, আমার সাথে দেখা হবে। আমাকে ও কথা দিয়েছে প্রতিবছর আমরা একত্রিশ ডিসেম্বর একসাথে সূর্যাস্ত দেখবো। কাল আমরা যখন সূর্যাস্ত দেখবো তখন ওকে আমি তোর কাছে নিয়ে আসবো।
জুঁই হি হি করে হেসে উঠলো, দাদু তোমাকে কিছু বলবে না?
ইরা চটে গেলো, কেনো বলবে? কেনো? আমি তো ওরই বউ, মোশা তো আমাকে জোর করে, আমার চাকরিকে জিম্মি করে নিয়ে এসেছে। আমার মনের স্বামী তো জয়-ই।
জুঁই বুঝতে পেরেছে ইরার মাথাটা আবার ডিসটার্ব শুরু করেছে। সে আর কথা বাড়ালো না।

চলবে…

(বন্ধুগণ, জয়-ইরার জীবনের আনন্দ-বেদনা নিয়ে ৫৩ টি ছোটগল্প নিয়ে লেখা আমার একটি বই প্রকাশিত হবে আমার ৫৩ বছর বয়সে অর্থাৎ অমর একুশে বইমেলা-২০২১/২০২২ এ। সেই ৫৩ টি ছোটগল্পের মধ্যে এটি ২য়, অর্থাৎ ০২/৫৩। আশা করি সঙ্গে থাকবেন)

জীবনের শেষ গোধূলী-১ম পর্ব

Shes Godhuli ষাট/পঁয়ষট্টি বছর বয়সের এক বুড়ি, সমস্ত চুল পাকা সাদা ধবধবে, পাটের মতো সাদা। কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে, চিবুক, গালের চামড়ায়ও অসংখ্য ভাঁজ পড়েছে। সেই বুড়ি বারো শিবালয় মন্দিরের গা ঘেঁষে প্রাচীন বটগাছটার আশেপাশে, ছোট যমুনা নদীর তীরে সেই বিকেল থেকে কী যেনো খুঁজছে, কোনো মূল্যবান জিনিস হারিয়ে গেলে মানুষ যেমন হন্য হয়ে খুঁজে তেমনি হন্য হয়ে খুঁজছে আর বিড় বিড় করে বুলি আওড়াচ্ছে, আরে বাবা যাবে তো যাবে, নিজের ছায়াটা তো রেখে যাবে আমার জন্য। তোমাকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছায়া দর্শন বইটা দিয়েছিলাম না, পড়েছো? পড়লে তো ছায়াটা রেখে যেতে ভুল করতে না। এরকম তুমি বরাবরই করতে, আমি তোমাকে ইমদাদুল হক মিলনের বিখ্যাত উপন্যাস নূরজাহান দিয়েছিলাম, পড়োনি। সেই উপন্যাসটা আমি কিনেছিলাম কত লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ইমদাদুল হক মিলনের অটোগ্রাফসহ। ইমদাদুল হক মিলন লিখেছিলেন, ’’ভালোবাসা থাকলে সব হয়’’। আর সেই অটোগ্রাফ পড়েই তো আমি তোমার কাছে চলে এলাম সবকিছু ছেড়ে। অথচ তুমি সেই উপন্যাসটা পড়লেই না।

ঠিক একই কাজ করেছো হয়তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছায়া দর্শন বইটাও। যদি পড়তে তবে ছায়াটা রেখে যেতে ভুল করতে না। আজ এসে তোমার ছায়াটা দেখতাম। তুমি জানো তোমার ছায়াটা দেখার জন্য আমি সেই কতদূর থেকে এসেছি, লুকিয়ে, সবার চোখে ফাঁকি দিয়ে। ওরা আমাকে তোমার সাথে কথা বলতে দিবে না বলে আমার মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়েছিলো, আমাকে পাহারা দিয়ে স্কুলে পাঠাতো, স্কুলের সব কলিগদের বলে দিয়েছিলো আমি যেনো তোমার সাথে কথা বলতে না পারি। আমাকে কোরআন ছুঁয়ে শপথ করিয়েছিলো আমি যেনো তোমার সাথে না বলি। তবুও আমি লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার সাথে কথা বলার জন্য ফোন করেছি কিন্তু সেই বেয়াদব মহিলাটা বার বার করে বলেছে, দু:খিত এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। যদি সেই মহিলাটাকে কাছে পেতাম তবে আমি ওকে জুতোপেটা করতাম।

একদিন তোমার সাথে কথা বলার জন্য আমি ফোন করছিলাম আর সেই বেয়াদব মহিলাটা বার বার দু:খিত বলছিলো। সেটা দেখে ওরা আমার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো, আমাকে প্রচণ্ড মার দিলো, দেখো আমার সামনের দাঁতটা ভাঙ্গা কী না। বলে বুড়ি বট গাছের সেই যুগলবন্দি লতার কাছে দাঁড়ালো। তারপর আবার বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলো, যেদিন আমরা প্রথম এখানে এলাম সেদিনই জায়গাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিলো। তারপর তোমার জন্মদিন পালন করলাম এখানে। তোমার জন্মদিনের ক’দিন আগে থেকেই সে কী প্রস্তুতি আমার, তোমার জন্মদিনে কী দেবো আমি এই নিয়ে আমার চিন্তার অন্ত ছিলো না। সেদিন সকাল থেকে উত্তেজনায় আমি যেনো কাঁপছিলাম। কখন মোশা স্কুল যাবে, কখন আমি স্কুলে গিয়ে হেড স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে তোমার কাছে আসবো। তুমি বার বার ফোন করছিলে, ইরা দেরি করছো কেনো? তোমার কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি তো?
আমি বললাম, না।
তাহলে দেরি করছো কেনো?
আমি তখন বেকারিতে তোমার জন্মদিনের কেক-এ নাম লিখতে দিয়ে ক্যাটস পো’তে তোমার জন্য শার্ট কিনছি, আমি তখন কৃত্রিম রাগান্বিত স্বরে বললাম, এতো ব্যস্ত হয়োনা তো। একটু ধৈর্য ধরো। আমি আসছি।
আমি যতই রেগে যাই তুমি আমার ওপর কোনোদিন রাগ করতে না, এটা তোমার একটা বড় গুণ। তুমি হেসে বললে, একটু তাড়াতাড়ি এসো সোনা।
আমার সব কেনাকাটা ব্যাগে নিয়ে একটা অটো রিক্সায় উঠলাম। তুমি ততক্ষণ দাঁড়িয়েছিলে। আমি দেরিতে এলাম অথচ তুমি একটুও রাগ করলে না। একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললে, অনেক দেরি করে ফেললে, কখন যাবে আর কখন আসবে একবার ভেবে দেখেছো। তারপর রিক্সায় উঠলে।
বটগাছের নিচে এসে আমি তোমার হাতে একটা গোলাপ ফুল দিয়ে বললাম, হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।
তুমি বললে, থ্যাঙ্কস।
তারপর আমি ব্যাগ থেকে জন্মদিনের কেক বের করে কেক, মোমবাতি সাজালাম। তোমার জন্য আনা শার্ট-প্যান্ট, পারফিউম আরো যত গিফট এনেছিলাম তোমার হাতে দিলাম। তোমার চোখে-মুখে সে কি আনন্দ দেখেছি আমি। তোমার চোখ দু’টো পানিতে ছলছল করছিলো। তুমি আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেছিলে, ইরা কেনো এতোকিছু করতে গেলে, কতকগুলো টাকা খরচ করে ফেললে আননেসেসারি।
তোমার চোখের পানি দেখে আমার চোখেও পানি এসে গেলো, আনন্দে, গর্বে। গর্ব এজন্য যে, যে লেখকের শত শত ভক্ত যখন ফেসবুক, টুইটার, গুগল প্লাসসহ বিভিন্ন ব্লগ এবং মোবাইল ফোনে জন্মদিন উইশ করছে সে লেখকের জন্মদিন পালন করছি শুধু আমরা দু’জন। আমার সেদিন নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হয়েছিলো। তোমার সেই জন্মদিনটা আমার কাছে জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলির একটি।

এই বটগাছের নিচে সেদিন তুমিই আবিস্কার করেছিলে এই যুগলবন্দি লতাগুল্ম, কেমন বুকের মধ্যে জড়িয়ে আছে একটা লতা আরেকটা লতাকে। এমনি তুমিও আমাকে বুকে জড়িয়ে রাখতে। তোমার বুকের সাদা লোমগুলো আমি কাশফুল বলতাম, আমি কাশফুলে মাথা রাখতাম আর তুমি বুকে জড়িয়ে রাখতে আমাকে, আহ কী সুখ! কী অনাবিল শান্তি তোমার কাশফুলে মাথা রেখে। অথচ দেখো তোমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতাম বলে মোশা আমাকে মেরে দাঁত ভেঙ্গে দিলো। ও তুমি ভেবেছো বয়সের কারণে আমার দাঁত উঠে গেছে। বলে সে আবার হি হি করে হেসে উঠলো, পাগল, আমার আর কত বয়সই হয়েছে। এই তো, এই তো সেদিনই তুমি আমার সাথে ছিলে তখন আমার বয়স ছিলো সাইত্রিশ বছর। এখন কত আর হবে আটত্রিশ উনচল্লিশ। তুমি না বলতে, ইরা তুমি কোনোদিন বুড়ি হবে না, তুমি চিরসবুজ, চিরতরুণীই থাকবে, আমি তাই আছি। তুমি একবার এসো এই বারো শিবালয়ে, এই ছোটযমুনার তীরে।

বারো শিবালয় আমাদের ভালোবাসার, আমাদের পছন্দের জায়গা, তোমার ব্যস্ততম চাকরি, আমার শিক্ষকতার ফাঁকে, আমরা ছুটে আসতাম বারো শিবালয়। এই বটগাছের নিচে, গোল করে বাঁধানো গোড়ায় আমরা বসে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা, তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে, তুমি আমার চোখের ভাষা, মনের ভাষা সব বুঝতে। আমি যখন বাসায় মন খারাপ করে বসে থাকতাম, মনে মনে তোমাকে খুব মিস করতাম ঠিক তখনই তোমার ফোন যেতো। উ: কী যে ভালো লাগতো আমার। তুমি বিশ্বাস করো তোমার মতো করে আমাকে কেউ কোনোদিন ভালোবাসেনি আর বাসবেও না। তুমি এসো সোনা আমার, এসো। বলে ইরা যুগলবন্দি লতার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলো।

আসবে না, তুমি না বলতে ইরা যখন আমাকে খুব মনে পড়বে তখনই এখানে এসো, আমাকে পাবে, কই তুমি তো তোমার কথা রাখোনি। আমাকে দেখো, আমি ঠিকই তোমার কথা রেখেছি। ও, তুমিও এসেছো, বলে ইরা ছোট যমুনার তীর দিয়ে ভাটির দিকে যেতে লাগলো বিড়বিড় করে স্মৃতি আওড়াতে আওড়াতে, এইতো, এইতো আমরা এ-ইখানে দাঁড়িয়ে অনেক সেলফি তুলেছিলাম। আমি তোমার বুকে মাথা রেখেছিলাম, তুমি আমার থুতনি উঁচু করে ধরে আমার চোখে চোখ রেখেছিলে, কী আছে তোমার চোখে বলোতো, তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি কোনোদিন রেগে থাকতে পারতাম না, আর তোমার হাসি, বলে ইরা পাগলের মতো হো হো করে হেসে উঠলো, তোমার হাসি নিয়ে তুমি একটা গল্প করেছিলে, তোমার বাবা, মানে আমার শ্বশুর মশাই’র হাসিও নাকি খুব সুন্দর ছিলো, আমার শাশুড়ি নাকি সেই হাসির নাম দিয়েছিলো ভূবন মোহিনী হাসি। তুমিও উত্তরাধিকার সুত্রে বাবা’র সেই হাসিই পেয়েছিলে। তোমার হাসি দেখে প্রেমে পড়বে না এমন বেরসিক মেয়ে দুনিয়াতে আর একটাও নেই। তাই তোমার হাসিটাকে আমি খুব ভয় পেতাম, তোমাকে হারানোর ভয়, তোমাকে আমি বলতাম, এই তুমি কিন্তু কোনো মেয়ের সামনে হাসবে না।
তুমি জিজ্ঞেস করতে, কেনো?
তুমি হাসলে আমার ভয় লাগে, তোমার হাসি দেখে কেউ বুঝি তোমাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেলো।
তুমি বলতে, ছি: তুমি এমন কথা ভাবছো কী করে বলোতো, আমি তো তোমাকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে কখনো কল্পনাই করতে পারি না।

এবার হঠাৎ করেই ইরা গম্ভীর হয়ে গেলো, তারপর একটা লাজুক হাসি হেসে বললো, এই তুমি আবার কারো প্রেমে পড়োনি তো? ছি: এসব আমি কী ভাবছি, তুমি না আমাকে কথা দিয়েছো আর কারো সাথে তুমি জড়াবে না, এটাই তোমার শেষ প্রেম। তুমি খুব প্রতিশ্রুতিবান, তুমি যেদিন আমাকে যেটা বলেছো ঠিক সেটাই করেছো, তুমি আমাকে কথা দিয়েছো আমি মন থেকে ডাকলে তুমি আসবে, তুমি দেখো, তুমি না আসা পর্যন্ত আমি এখানেই থাকবো। কথা ছিলো আমরা বছরের শেষ দিনটা, শেষ গোধূলীটা এখানে কাটাবো…

চলবে …

(বন্ধুগণ, জয়-ইরার জীবনের আনন্দ-বেদনা নিয়ে ৫৩ টি ছোটগল্প নিয়ে লেখা আমার একটি বই প্রকাশিত হবে আমার ৫৩ বছর বয়সে অর্থাৎ অমর একুশে বইমেলা-২০২১/২০২২ এ। সেই ৫৩ টি ছোটগল্পের মধ্যে এটি ২য়, অর্থাৎ ০২/৫৩। আশা করি সঙ্গে থাকবেন)

কাশফুল

কাশফুল

তুমি কাশফুল চেয়েছিলে
চেয়েছিলে একটা নদী
নদীর ধারে আমার বুকের মতন সাদা কাশফুল
একাকার হয়ে মিশে যাবে তুমি
কাশফুলে লুকাবে মুখ
ভুলে যাবে পৃথিবীর যত জ্বালা-যন্ত্রণা।

তুমি এলে গোধূলী লগ্নে,
ছোট যমুনার তীরে লুটিয়ে পড়লো গোধূলীর লাল আভা
আমি তন্ময় হয়ে চেয়ে রইলাম,
তুমি আমার কাশফুলে মাথা রাখলে
আমি বুকে জড়িয়ে ধরলাম তোমায়
কতক্ষণ, কতক্ষণ মনে নেই,
আবেগের সময়জ্ঞান নেই, লাজ-লজ্জা নেই
আছে শুধু কাছে পাবার,
শুধু নিবীড়ভাবে আরো কাছে পাবার কামনা।
গোধূলী বিদায় হলো,
আকাশের চাঁদ নেমে এলো
তোমার চাঁদ মুখে, কাশফুলে, ছোট যমুনার স্রোতস্বীনিতে।
একটা ঢেউ খেলে গেলো ছলাৎ করে,
আমাদের নিবীড়ভাবে একাকার হয়ে মিশে যাওয়া শরীর
আবেগে শীৎকার দিলো।
তুমি লজ্জায় কাশফুল থেকে মাথা তুলে তাকালে চাঁদের আলোয়,
এক পা, দু’পা করে দূরে সরে গেলে,
আমি তাকিয়ে রইলাম,
আমার চিরচেনা তুমি,
গাঢ় অন্ধকারে বাতাসের ঘ্রাণ থেকে,
খুঁজে পেয়েছি আমি তোমায়,
তাই হারানো ভয় কোনোদিন পাইনি আমি।
অথচ আজ চাঁদের আলোয় হারালে তুমি
আজো খুঁজি তাই তোমায়
কাশফুলে, ছোট যমুনায়, চাঁদের আলোয়।

সাইক্রিয়াটিস্ট

ছবি.০২
আজ সকাল থেকে ইরার মনটা খারাপ। প্রতিদিনের মতো সকালবেলা উঠে নাস্তা তৈরি করেনি। ড্রয়িং রুমের ছোট্ট চৌকিটায় শুয়ে শুয়ে টি.ভি দেখছে ঠিক সেভাবে বসে সেভাবে জয় যেভাবে জয় এই চৌকিটায় এসে বসতো সেভাবে। সেদিন ইরার সকালবেলা উঠেই ব্যস্ততা শুরু হয়েছিলো। তার জয় আসবে, দুপুরে লাঞ্চ করবে, ইরা আগেই ফোন করে বলেছিলো কাল কিন্তু তুমি সময় নিয়ে আসবে, ঘোড়া বেঁধে রেখে আসবে না।
জয় হাসতে হাসতে বললো, না, না। সময় নিয়েই আসবো।
ইরা তামাশা করে বললো, ক’টায় পৌঁছাবেন মহাশয় আপনি?
একটায়।
তার আগে এলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?
না। মহাভারত লেখা হয়ে গেছে, অশুদ্ধ হওয়ার আর কোনো আশঙ্কা নেই।
কিন্তু আগে এলে সমস্যাটি কী? তুমি বারোটার মধ্যে চলে এসো।
তোমার স্কুল টিফিন ক’টায়?
সারাদিন।
জয় চমকে উঠলো, সারাদিন মানে? ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে তে স্কুল ছুটি থাকে নাকি?
না, থাকে না কিন্তু আমি ছুটি নিয়েছি।
কেনো? শরীরটা অসুস’ নাকি? তোমার গলার স্বরটা যেনো কেমন করছে।
আরে না, তুমি তো সবসময় একলাইন বেশি বোঝো। কাল ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে। তুমি আসছো। আমি ভালো, ভালো রান্না করবো, স্কুলে গেলে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাবে না। এই বলো না, তোমার পছন্দের খাবার কী কী?
জয় বললো, এটাই তো তোমাকে আবিস্কার করতে হবে ইরা, আমার পছন্দ-অপছন্দ তোমাকে আবিস্কার করতে হবে। ভালোবাসার মানুষের পছন্দ-অপছন্দটাই যদি না বুঝলে তবে আর ভালোবাসলে কীভাবে।
ঠিক বলেছো, তোমাকে আর বলতে হবে না। দেখো আমি ঠিক ঠিক তোমার পছন্দের খাবারগুলোই রান্না করবো।
সেদিন খাসির মাংস, মুরগির মাংস, রুই মাছের সঙ্গে ইরা রান্না করলো ইলিশ মাছ দিয়ে কচু পাতা, ঢেঁকিশাক, আর শুঁটকি মাছের ভর্তা। খেয়ে জয় খুব খুশি হলো। জয়ের সেই তৃপ্ত মুখখানা আজো ইরার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। খাওয়া শেষে জয় যখন বেসিনে হাত ধুতে গেলো তখন একবার মোশারফের দিকে লক্ষ্য করলো, মোশারফ ততক্ষণে ছাদে গিয়ে সিগারেট টানছে।
জয় ফিসফিস করে বললো, রান্না খুব ভালো হয়েছে, অপূর্ব। তুমি আমার পছন্দ-অপছন্দ বোঝো।
ইরা ডাইনিং থেকে কিচেনে যাবার অজুহাতে বেসিনের কাছে গিয়ে জয়ের গালে একটা টোকা মেরে বললো, তুমিও।
জয় একরকম চমকে উঠলো, মানে? আমি আবার কী করলাম?
কিছু করোনি, না? ওপর থেকে সিঁড়ি বেয়ে মোশারফের পায়ের শব্দ পেয়ে ইরা আবার কিচেনে ঢুকলো।
সেই ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে’র একবছর হলো কিন’ ইরার ভালোবাসার মানুষটা আর ফিরে এলো না। এমনি নানান কথা ভাবতে ভাবতে ইরা গণ্ডদেশ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো।
মোশারফ জোরে ডাক দিলো, ইরা।
ইরা কিছু বললো না।
মোশারফ আবার ডাক দিলো, ইরা নাস্তা দাও।
ইরা তবুও কিছু বললো না।
মোশারফ তার রুম থেকে ড্রয়িং রুমে এলো, তুমি না কোনোদিন টি.ভি দেখো না আজ প্রায় বারো বছর থেকে। আজ আবার টি.ভি দেখতে দেখতে নাস্তা তৈরি করার কথাও ভুলে গেলে?
মোশারফের পাঁয়ের শব্দ পেয়ে ইরা চোখের জল সংবরণ করেলো। সে বললো, দেখি না কিন’ দেখতে তো নিষেধ নেই।
টি.ভি দেখতে দেখতে নাস্তা তৈরি করার কথা ভুলে গেছো?
ইরা মনে মনে বললো, ভুলিনি। আজ আরো বেশি করে মনে পড়েছে কিন’ নাস্তা তৈরি করবো কার জন্য।
মোশারফ ইরার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে বললো, ঠিক আছে, আমি বাইরে নাস্তা খেয়ে নিচ্ছি। তুমি ওঠো, নাস্তা খেয়ে স্কুল যেও।
ইরা তবু বিছানা থেকে উঠলো না। আজ তার যেনো প্রাণশক্তি বলে কিছু নেই। জয়ের সঙ্গে ইরার পরিচয় হওয়ার আগে ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে বলতে ইরার জীবনে তেমন কিছু ছিলো না। ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েই শেষ করতো। কিন্তু জয়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে সে যেনো তার ভ্যালেন্টাইনস্‌ খুঁজে পেয়েছে। পঁচিশ বছরের এই প্রেম-ভালোবাসাহীন ঘরও একসময় তার কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়েছিলো। ভাবতে ভাবতে ইরার দু’চোখের কোণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো, ইরার সমস্ত শরীর শিথিল হয়ে এলো।
জয়! ইরা ঠোঁট দু’টো একটু ফাঁকা হয়ে অস্পষ্ট স্বরে বের হলো।

ইরা রিমোট টিপে একের পর এক টি.ভির চ্যানেল পরিবর্তন করছিলো আর বিছানায় একরকম ছটফট করছিলো। একসময় ইরার দু’চোখের পাতা বন্ধ হয়ে এলো, শরীরটা অবশ হয়ে গেলো। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সাথী নার্সারি। এই সাথী নার্সারিতে আছে জয় আর ইরার অনেক স্মৃতি। এই তো কয়েকবছর আগের কথা একদিন ইরা বললো, আমি আগামীকাল জয়পুরহাট যাবো।
জয় বললো, তাহলে আমার কাছে চলে এসো।
তোমার কাছে মানে? একেবারে?
একেবারে, বলে জয় হো হো করে হেসে উঠলো, তারপর বললো, মানে ফোন দিয়ে এসো।
ও তাই বলো আমি ভাবছিলাম বুঝি একেবারে তোমার কাছে যেতে বলছো।
পরদিন সকালবেলা ইরা জয়পুরহাট রওয়ানা দেয়ার আগে আরো কয়েক দফা ফোনে কথা হলো, ইরা কখন রওয়ানা দিবে, কোথায় দেখা করবে এসব নিয়ে।
জয় বললো, তুমি পাঁচুর মোড় থেকে রিকশা নিয়ে পাঁচবিবি রোড দিয়ে রওয়ানা দিও, আমি তোমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিবো।
পাঁচবিবি রোড দিয়ে কতদূর যাবো? কোথায় যাবো, জানবো না? অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখো কেনো? আমাকে বলো?
ভালোবাসা মানেই তো অনিশ্চয়তা ম্যাডাম, অনিশ্চয়তার পথে হেঁটে নিশ্চয়তা চাইবে তা কী করে হয়।
না, আমি অনিশ্চয়তা চাই না, নিশ্চয়তা চাই, গন্তব্য জানতে চাই।
নিশ্চয়তা তো আমিই। আমি রাস্তা দিয়ে যেতে বলেছি, তুমি যাবে, আমি তোমাকে মোটর সাইকেলে তুলে নিবো। নির্ভর করতে শেখো। মেয়েদের নিয়ে এই একটা সমস্যা, যারা নিজের পাঁয়ে দাঁড়িয়েছে তারা অন্যের ওপর নির্ভর করতে ভুলে গেছে আর যারা অন্যের পাঁয়ে ভর করে আছে তারা নিজেরা জানেই না যে তাদেরও পাঁ আছে।
ওকে বাবা, ওকে আর বলতে হবে না। আমি কিন’ বাসের মধ্যে ফোনে বার বার কথা বলতে পরবো না।
করতে হবে না, তুমি বাসে ওঠার সময় একটা ম্যাসেজ দিও।
ওকে।
নেমে আরেকটা ম্যাসেজ দিও।
ওকে।

ইরা বাসে ওঠার সময় এবং বাস থেকে নেমে আবারো ম্যাসেজ দিলো। তারপর পাঁচুর মোড়ে এসে একটা রিকশা নিলো। রিকশা এগিয়ে চলছে পাঁচবিবি রোড দিয়ে। ইরার সেদিন একটা অন্যরকম অনুভুতি। জীবনের এই মধ্যবয়সে এসে জীবনটা আরো রঙিন হবে একথা ইরা কোনোদিন কল্পনাই করেনি। সে তার বর্ণহীন জীবন শুভ’র লেখাপড়া, আর চাকরি করে জীবনটা কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলো। চলছেও সেভাবে তার সাথে যোগ হয়েছে জয়, জয়ের ভালোবাসা ইরাকে তারুণ্য দিয়েছে, প্রাণচাঞ্চল্য দিয়েছে, বাঁচার প্রেরণা যুগিয়েছে। ইরা আপনমনে মৃদু হেসে উঠলো।
একটা মোটর সাইকেল রিকশার একেবারে সামনে এসে ব্রেক করলো।
ওয়াও জয়, বলে ইরা রিকশা থেকে নেমে জয়ের মোটর সাইকেলে উঠলো।
জয় জোরে মোটর সাইকেল টান মারলো।
ভাগ্যিস ইরা জয়ের কাঁধে হাত রেখেছিলো নইলে হয়তো পড়েই যেতো।
ইরা বললো, এভাবে কেউ মোটর সাইকেল চালায়, আরেকটু হলে তো আমি পড়েই যেতাম।
পড়বে না, তোমাকে বলেছি না নির্ভর করতে শেখো। আমার মোটর সাইকেলে উঠেছো, আমার কাঁধে হাত রেখেছো তারপরও ভয় পাচ্ছো?
ইরা জয়ের পিঠের ওপর মাথা রেখে নিবিড়ভাবে মিশে গেলো, আমি ঠিক তোমার মতোই একজন মানুষ খুঁজছিলাম জয়।
কয়েকমিনিটের মধ্যে মোটর সাইকেল একটা নার্সারির সামনে এসে দাঁড়ালো। নার্সারির নাম সাথী নার্সারি। ইরা মোটর সাইকেল থেকে নেমেই জয়ের হাতে একটা গোলাপ ফুল দিলো, থ্যাঙ্ক ইউ ইরা।
ওয়েলকাম।
জয় ইরার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিলো। ইরা জয়ের হাতের মধ্যে একটা হাত রেখে তার সাথে গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে নার্সারির সরু রাস্তা দিয়ে ভিতরে ঢুকলো। রাস্তার দু’পাশে পাতাবাহার গাছ, ছোট ছোট আয়তাকারভাবে সাজানো জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল গাছ।
ইরা গোলাপ ফুলের কাছে এসে অনেকগুলো ফুল দেখে বললো, ওয়াও, এতো ফুল।
ইরা আর জয় বাগানে হাঁটতে হাঁটতে অনেকগুলো ছবি তুললো।
বাগানে একটা লোক কাজ করছিলো। সে একবার তাদের দিকে দেখে আবার না দেখার ভান করে কাজ করছিলো। ছবি তোলা শেষে জয় ডাক দিলো, এই যে ভাই।
লোকটি কাছে এলো, গাছ কিনবেন?
হ্যাঁ।
দেখেন, পছন্দ করেন।
জয় একে একে কয়েকটা ফুল গাছ কিনে ইরাকে বললো, এগুলো তোমার বাগানে লাগাবে।
ইরা বললো, অবশ্যই জনাব, গাছের দাম কিন্তু আমি দিবো।
না। আমি কিনেছি, দাম আমিই দিবো।
আমি তোমাকে দিলাম ফুল, আর তুমি দিলে পুরো ফুল গাছ। তবুও তোমাকে জিততেই হবে। তা না হলে তোমার নাম জয় হবে কেনো। তোমার নামটাকে তুমি সার্থক করে তুলবেই।
কাজের ফাঁকে, চাকরির সুযোগে একটু সময় পেলেই দু’জনে এই নার্সারিতে ছুটে আসতো। ইরা ফোন করে বলতো আসছি, বাস ছাড়লো। আর জয় সময় হিসেব করে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো।
কিন্তু আজ তো আমি তোমাকে আসতে বলিনি, তুমি বুঝলে কীভাবে যে আমি এখানে আসবো আজ?
জয় বললো, আমি বলেছিলাম না, মন থেকে চাইলেই তুমি আমাকে পাবে।
আজ ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে, তুমি মন থেকে আমাকে চাইবে আমি জানি, তাই চলে এসেছি।
চাপাবাজি, আমি যদি না আসতাম?
ভালোবাসায় বিশ্বাস থাকতে হয় ইরা। সেই বিশ্বাস নিয়েই আমি এসেছি। তুমি যদি না আসতে তবে আমি বুঝতাম তোমার ভালোবাসায় বিশ্বাসের অভাব আছে।
এক্সাক্টলি। এই নাও, তুমি যে গাছ কিনে দিয়েছিলে সেই গাছের ফুল।
থ্যাঙ্ক ইউ ইরা।
আজ অনেক ফুল ফুটেছে। গাছগুলোও হয়তো বুঝতে পেরেছে আজ তুমি আসবে।
ইরা জয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো কিন’ জয় তার হাত ধরলো না।
ইরা ফিসফিস করে ডাক দিলো, জয়, জয়, হাতটা দাও একটু, প্লিজ! জয়, আমার জয়।
জয় তবুও হাত বাড়ালো না।
জয় প্লিজ একটু হাতটা দাও, প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ! বলে জোরে চিৎকার করতে করতে ইরা বিছানা থেকে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো।
ইরা হাঁপাচ্ছে, বুকটা জোরে উঠানামা করছে, মেঝেতে পড়ে সে কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর ফিসফিস করে বললো, আমি কোথায়? আমি কি বাসায়? এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখলাম? জয়, জয় আসেনি?
ইরা একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো দুপুর সাড়ে বারোটা বাজে অথচ এখনো রান্না শুরুই করতে পারলো না। কিছুক্ষণের মধ্যে মোশারফ খেতে আসবে। কিন্তু রান্নার প্রতি ইরার মন নেই, সে সকাল থেকে নাস্তাই খায়নি, খিদে আছে কিন্তু মুখে রুচি নেই। ইরা কী ভেবে একবার মোবাইল ফোনটা হাতে নিলো, মোবাইলের বাটন টিপে কয়েকবার রিং করলো তারপর মোবাইল ফোনটা বিছানার উপর ছুঁড়ে মেরে বললো, যাহ…
তারপর কিচেনে ঢুকলো।
রান্না খুব সহজ কাজ না। খুব কম সময়েরও কাজ না। তরকারি কুটা, মসলা বাটা, ঠিক ঠিক মতো মরিচ মসলা দেয়া, ইত্যাদি, ইত্যাদি। রান্নার প্রস্তুতি নিতে নিতে মোশারফ বাসায় এলো। ইরা দরজা খুলে দিলো।
মোশারফ বাসায় ঢুকেই বললো, ইরা তাড়াতাড়ি ভাত দাও।
ইরা কৃত্রিম হাসির চেষ্টার করে বললো, একটু বসো রান্না করছি।
মোশারফ কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বললো, এখনো করছি মানে, তারপর ইরার পিছু পিছু রান্না ঘরে ঢুকে চিৎকার করে বললো, এখনো তরকারি কাটছো? উফ্‌ফ, কী করলে এতক্ষণ? আজ তো স্কুলেও যাওনি, বলতে বলতে সে ইরার রুমে গিয়ে তার মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ চেক করলো, নিশ্চয়ই এতক্ষণ ফোনে কথা বলেছো?
ইরাও মোশারফের সঙ্গে তার রুমে ঢুকে বললো, না।
অবশ্যই বলেছো, নিশ্চয়ই কথা বলে কল রেকর্ডও ডিলিট করে দিয়েছো।
একদম বাজে কথা বলবে না। একদিন রান্না দেরি হতে পারে না? তাই বলে তুমি আমাকে এভাবে কথা বলবে?
পারে কিন্তু দেরি হওয়ার একটা কারণ থাকে। কী করছিলে এতক্ষণ?
শুয়েছিলাম।
ইরা মোশারফের মুখের দিকে কয়েকমুহূর্ত চেয়ে রইলো তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো, ও আজ তো ভ্যালেন্টাইনস্‌ ডে, তাই না, তাই কারো স্মৃতিচারণ করছিলে নিশ্চয়ই?
ইরা মনে মনে বললো, জানোই তো।
ঠিক আছে আজ তারই স্মৃতিচারণ করো। আমি গেলাম, ক’দিন থেকেই বলছি চলো, বগুড়া চলো, তোমাকে সাইয়াক্রিয়াটিস্ট দেখিয়ে আনি, বলে মোশারফ দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেলো।
দরজা বন্ধ করতে করতে ইরার আপন মনে বললো, সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে হবে, না? দেখাতে হয় তোমাকে দেখাও। আমার সাইক্রিয়াটিস্ট আছে, তুমি তার কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে এনেছো, আমার সাইক্রিয়াটিস্টের হ্যালো কথাটাই আমাকে সুন্থ করে তুলবে। যদি এখনই আমাকে ফোন করে তবে এখনই আমি সুস’ হয়ে উঠবো।
ইরা কিছুক্ষণ বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। বারান্দার সামনেই জয়ের দেয়া ফুলগাছগুলো, প্রতিটি গাছ কেনার সময় জয়ের সঙ্গে তার কোনো না কোনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে সাথী নার্সারি, উর্বী নার্সারি।
চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাজমহল। না, সম্রাট শাহজাহান-মমতাজের তাজমহল না। জয়-ইরার তাজমহল। এই বিল্ডিংয়ের কাজ করতে এসেই জয়ের সঙ্গে ইরা পরিচয় হয়েছিলো। তাই ইরা এই বিল্ডিংয়ের নাম দিয়েছে তাজমহল। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ইরার চোখ দু’টো পানিতে ঝাপসা হয়ে এলো।
রাস্তা দিয়ে কত মানুষ আসছে, যাচ্ছে। ইরার মনে হচ্ছে এই বুঝি তার জয় এলো। কোনো মোটর সাইকেল যেতে দেখলেই তার বুকের মধ্যে কেঁপে উঠছে, জয়, আমার জয়, এসেছো?
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ইরার পা দু’টো অবশ হয়ে আসছে, এমনিতেই জয়পুরহাট থেকে আসার পর থেকেই ইরার শরীরটা ভালো নেই, তারওপর আজ সকাল থেকে না খেয়ে তার দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিটাই যেনো হারিয়ে গেছে। ইরা দেয়ালে হাত দিয়ে এক পা দু’পা করে কোনো রকমে তার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।
কয়েকমিনিট পর ইরার কানে বেজে উঠলো তার মোবাইল ফোনের রিং। ইরা ভেবেছিলো তার জয় হয়তো কোনোভাবে তার নাম্বার জোগাড় করে তাকে ফোন করেছে। কিন্তু না, তার স্কুলের এক কলিগ, সাহেদা ফোন করেছে।
ইরা ফোন রিসিভ করলো, হ্যালো আপা।
আপা একটা সুখবর আছে।
সুখবর কথাটা শোনার পরও ইরার কোনো কৌতূহল নেই, কণ্ঠে কোনো উচ্ছ্বাস নেই। যেনো স্কুলের কোনো সুখবর তার কাছে মূল্যহীন। তার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখবর হলো তার জয়ের খবর।
ইরা প্রাণহীন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, কী সুখবর আপা?
আপনি খুশি হোননি?
আগে বলুন আপা, না জানলে কীভাবে খুশি হবো?
আমি জানি, যা শুনলে আপনি সবচেয়ে খুশি হবেন। কল্পনা করুনতো।
আমাদের স্কুল সরকারি হয়েছে?
ধুর আপা, আপনি কী যে বলেন? স্কুল সরকারি হওয়া, বেতন বেশি হওয়া এগুলো আপনার কাছে কোনো সুখবরই না।
বলুন আপা, আমার ভালো লাগছে না। আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি, আমার খুব দুর্বল লাগছে।
সাহেদা বললো, জানি তো, সেজন্যই তো বলছি, সুখবরটা শুনলে আপনি এখনই সুস’ হয়ে উঠবেন, এখনই স্কুলে ছুটে আসবেন।
বলুন আপা প্লিজ!
আপনার জয় আপনাকে নিয়ে ফেসবুকে একটা গল্প লিখেছে, অসাধারণ!
জয়, আমার জয়, আমাকে নিয়ে গল্প লিখেছে, ভালো হয়েছে?
হালিম স্যার পড়েছে, তারপর সবাইকে দেখিয়েছে। সবাই তো লেখা পড়ে অবাক। সবাই বলছে এটা আপনাকে নিয়েই লেখা। লোকটা আপনাকে এখনো খুব ভালোবাসে আপা। প্রত্যেকটা লাইনে যেনো আপনার প্রতি তার ভালোবাসাই ফুটে উঠেছে।
আমি জানি আপা, পৃথিবীতে আমি ছাড়া ওর কেউ নেই। আমারো ও ছাড়া কেউ নেই। জয়পুরহাট থেকে আসার পর থেকে আমার ফোনটা নিয়ে নিয়েছে আপা। তাই আমি নেট ব্যবহার করতে পারি না, আমি আসছি আপা, আপনার মোবাইল ফোনে একবার পড়বো আমার জয়ের লেখা গল্প, আমি এখনই আসছি, বলে ইরা যে কাপড়ে ছিলো সে কাপড়ের ওপরই কোনো রকমে বোরকা চাপিয়ে ক্ষুধা-তৃঞ্চা ভুলে বাসা থেকে বের হলো।
সমাপ্ত।
আমার সব লেখা একসাথে পড়তে ভিজিট করুন:www.writerzillur.com
www.sheiboi.com
আমার বই কিনতে যোগাযোগ করুন:
নওরোজ কিতাবিস্তান, ০৬, বাংলাবাজার, ঢাকা, ফোন:০১৭১১৩২১০৮৫
www.rokomari.com