বারো ঘন্টা প্লাস … (চতুর্থ পর্ব)

বারো ঘন্টা প্লাস
(চতুর্থ পর্ব)


তার চেয়ে বছর তিনেকের বড়, ডিভোর্সি মেয়েটার সঙ্গে বন্ধুর অফিসের খুব ঘিঞ্জি ক্যান্টিনে আলাপের পর থেকে তাদের সম্পর্কের অগ্রগতি এক কথায় ছিল দুর্ধর্ষ! মনে পড়ছে, ঠিক দ্বিতীয় দিনে দক্ষিণ কলকাতার এক আইসক্রিম পার্লারে দাঁড়িয়ে মিল্ক শেক খেতে খেতে মীন আঁখিকে দুর্ধর্ষের ব্যাসবাক্য শিখিয়েছিল — দুধ খেয়ে যে হর্ষ। ইম্মেডিয়েটলি আঁখির আকাশি রঙের শার্ট আপ্লুত হয়ে যায় মিল্ক শেকের অট্টহাসিতে।

সেই জমে ওঠা মিল্ক শেক উলটো পালটা ঝাঁকুনিতে কি নিরুচ্চারে এবং সশব্দে ছানা কেটে গেল!

নিজের চা নিয়ে সোফায় বসেছে আঁখি। তার পায়ের বেগুনি নখ, কবজির চারকোনা চুড়ি পেরিয়ে বাঁ হাতের খালি অনামিকায় দৃষ্টি চলে যেতে পারে, যেখানে মীন অনেকবার একটা আংটি পরাতে চেয়েছে সানুনয়ে। প্রায় সেই রকম বিনীতভাবে সে কথা শুরু করে।

— সোনা, আমাদের ভেতরের সমস্যাগুলো কি আর মেটার মতো নয়?
— আমার দিক থেকে তো কোনও প্রবলেম নেই! তুমিই নানারকম ভেবেটেবে জটিলতা ডেকে আনছ।
— সোনা, ভেবে দ্যাখো, গত দুবছরে তুমি আমাদের দ্যাখা হওয়া, ফিজিক্যালি মিট করা, একসঙ্গে বেড়াতে বেরনো, এমনকি ফোন করাটাও কীভাবে কমিয়ে এনেছ। কিন্তু আমি যে উইথড্র করতে পারছি না!
— শোনো মীন, আমাদের সম্পর্ক হওয়ার পরে এই পাঁচটা বছরে আমি বুড়ো হয়েছি আর বৈশাখী বড় হয়েছে। তোমার প্রসঙ্গ উঠলে, এমনকি মোবাইলে নম্বরটা বাজতে দেখলেও ও গম্ভীর হয়ে যায়। মা হয়ে আমি সেটা অন্‌দেখি করতে পারি, বলো?
— তাহলে মীনাক্ষি-প্রেমের গল্পের এটাই শেষ প্যারা?
— আমি কবে বললাম সে কথা? শুধু দুজনকে একটু সামলে চলতে হবে।
— আর মেয়ে যদি কাল বলে, বাবার কাছে ফিরে চল?

ঝটিতি ঘুরে তাকায় অগ্নিশুদ্ধা। চোখ তীক্ষ্ণ, সতর্ক। মীন জেনেছে, দিদির ফ্ল্যাটে আগের হাজব্যান্ডের সঙ্গে পারিবারিক মিলন হয় স্ত্রী-সন্তানের। কে জানে, হয়তো দাম্পত্য মিলনও। সেই পুরুষ, যাকে আঁখি একসময় ‘জানোয়ারটা’ ছাড়া অন্য সম্বোধন করত না।

—মেয়ের লাইফ, মেয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। আমি প্রভাব খাটাতে যাব না, প্রভাবিতও হবো না।
মীনকেতনের ঠোঁট মুচড়ে যায় প্যাঁচানো হাসিতে। নির্ভরতার দুটো হাতের বদলে আঁখি তার দিকে বাড়িয়ে চলেছে তৃতীয় এক হস্ত, যাকে অজুহাত বলে। কিন্তু ব্যাঙ্গের কাঁটা এবার মেয়েটার রক্ষণেও টোল ফেলল।

— তোমাকে খুশি করার ক্ষমতা আমার নেই, মীন!
অগ্নিশুদ্ধার গলা তীব্র। এক মুহূর্ত থেমে সে ঢোঁক গেলে।
— তাছাড়া…তাছাড়া জীবন বা মন কোনও অংক মেনে চলে না।

পদ্মের পাপড়ি সম্পূর্ণ খুলে গিয়ে গর্ভকেশর উন্মুক্ত হওয়ার মতো , অথবা রিভলভিং স্টেজ যেমন পেছন থেকে চক্কর কেটে সামনে দাঁড়ায়, আঁখি তার বর্তমান জীবনসত্যকে ছেড়ে দেয় মীনের চোখের সামনে — পারো তো সামলাও!
মাছের লেজের শেষ ঘাইটাও ঠান্ডা স্রোতে অদৃশ্য হওয়ার পর আস্তে আস্তে দৃশ্যের সম্পূর্ণ মানে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকে। যেন আঁখি এক দুরূহ ইংগিতপ্রধান কবি এবং মীন তার একনিষ্ঠ টীকাকার।

— জীবন অংক মেনে চলে বলেই আমার মনে হয়, সোনা। শুধু প্রত্যেকে জীবনের অংক তার নিজের মতো। যে-কোনও দুজন নারী-পুরুষের মধ্যে প্রেম হতেই পারে, কিন্তু দুজনের ভালোবাসা সম্পর্কে বেসিক ধারণাগুলো একদম উলটো হলে সেই প্রেম বাস্তবে টিঁকবে না। আমাদের সমস্যাও এখানে। কোনও পরিণত মানুষের মূল্যবোধ সারা জীবন একই থাকে না নিশ্চয়ই, পালটায়…।

— ওহ্‌, আবার সেই মূল্যবোধ! এরপর আসবে ‘স্বচ্ছতা’। পাঁচ বছর শুধু এই লেকচার গিলে আসছি। একার জীবনে আমাকেই সমস্যাগুলো ফেস করতে হয়, তুমি তো প্রেম করেই খালাস।
চাপা ঘেন্নায় ছটফট করে ওঠে আঁখি। কিন্তু মীন থামতে পারছে কই? শেষ অনুচ্ছেদটা সুলিখিত না হলে তার ভাষ্য সম্পূর্ণতা পাবে না। কীভাবে তবে ভবিষ্যত প্রজন্ম অগ্নিশুদ্ধার নতুন ও মৌলিক কাব্যরীতি থেকে শিক্ষা নেবে!

— তুমি যাই বলো, ভ্যালুজ ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না। মূল্যবোধহীনতাও একরকম মূল্যবোধ। তবে একটা ডাহা জিনিস মেনে নিতেই হবে। গাছ যেমন মাটির ওপরে দাঁড়ায়, জীবদেহ যেমন কোষের সমষ্টি, তেমনি চেতনারও আসল কথা তার সততা। তোমার ওপর যার জীবন নির্ভর করছে, তার সঙ্গে অন্তত প্রতারণা করো না।

মশালের আগুনে কুলকুচি করে কেরোসিন তেল ছেটালে যা হয়, তেমন আশঙ্কা করছিল মীন, কিন্তু আঁখি বসে থাকে মাথা ঝুঁকিয়ে।

— ব্যাস, আমাকে মিথ্যেবাদী আর চরিত্রহীন প্রমাণ করা হয়ে গেছে তো? এবার শোনো, আমি নিজের মতো বাঁচতে চাই, স্বাধীনভাবে। তোমরা পুরুষেরা নিয়ম বেঁধে দেবে,আর আমরা চলব তাতে পায়ের পাতা ডুবিয়ে, কীসের জন্যে?

—আমার আপত্তি নেই। তুমি অতীন্দ্রিয়র সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে জুড়তে পারো, বা তোমার অফিস ইউনিয়ানের নেতা, কী যেন নাম, তার সঙ্গে নাটক-টাটক দেখতে যাও। কিন্তু লুকোবে কেন? আমি ফোন করলে বলছো, ডাক্তারের চেম্বারে আছি, বা মোবাইল স্রেফ বন্ধ রেখে পরে জানালে নেট ওয়ার্কের গণ্ডগোল, … প্রেমিক হিসেবে তথ্যের অধিকারটুকু কেন কেড়ে নেবে আমার? আমি তো কোনওদিন তোমাকে ডিচ করিনি!

এতক্ষণে মশাল জ্বলে ওঠে। গলার মিষ্টি-নুপূর শব্দ স্ক্রুয়ের প্যাঁচ হয়ে মাথার ভেতরে ঢুকে যায়।
— বেশ করব, ঘুরব। তুমিও ঘোরো না, কে আপত্তি করেছে? আর আমার কৈফিয়ৎ চাওয়ার তুমি কে? কে তুমি!

‘কে’ শব্দটায় এত চাপ দিতে থাকে, যেন এই কাঠবাদামের খোলা ভাঙলেই তাদের ভালোবাসার অপদার্থতা বেরিয়ে আসবে। ‘কোনও দিন ছেড়ে যাবে না তো সোনা?’ — আদরের মুহূর্তে মহাসমারোহে শোনাতো যে, আজ আঙুল তুলে দরজা দেখিয়ে দিচ্ছে। খুলে রাখা জুতো পায়ে গলাতে চেষ্টা করল মীন সোফায় বসে বসেই। জুতোর ফিতে কীভাবে যেন বাঁধতে হয়! মাথা বেয়ে ঘাম গড়িয়ে নামছে, কিন্তু খুলির ভেতরটা শুকনো ঘাসে ভর্তি। কোনও রকমে উঠে দরজার ছিটকিনির দিকে হাত বাড়িয়েছে, তৎক্ষণাত প্রথমে পিঠের জামায়, তারপর বাঁ-কাঁধে টান খেয়ে পেছনে আধখানা ঘুরতে না ঘুরতেই আঁখির সম্পূর্ণ শরীর ঝাঁপাল গায়ের ওপর। ফলে ভারসাম্যের বারোটা বাজিয়ে দড়াম করে শোকেসে ধাক্কা খায় সে, ভ্রূক্ষেপহীন মেয়েটা তার বুকের ওপরেই কান্নায় ভাঙছে তখন।

— কোথায় যাচ্ছো? কোত্থাও যেও না। টেলিফোনে, দেখা হলে, এখন বাড়ি বয়ে এসেও অপমান করে যাচ্ছো। একে কি ভালোবাসা বলে, সোনা!

বুকের নিচে ভারি স্তনের ঠেসান পেয়ে মীনের দেড় মাসের খিদে জমানো শরীরের ছিলা টান খেল। কিন্তু মন অসমাধিত থাকলে স্পৃহা কাজ করবে কীভাবে?

তবু লক্ষ করো, আঁখি ঘাড় উঁচু করে একটা চুম্বন-চেষ্টা চালাচ্ছে। মেয়েটা চুমু খেতে জানে না — ভনিতা না ক’রে বলতে হবে। মুখের অনতিদূরে এসে প্রজাপতির ডানার মতো কেঁপে রেণু রেণু হয়ে যায় তার ওষ্ঠ। স্নায়ুর তীব্র তাড়নাতে হাঁ-মুখ বন্ধ করতে পারে না ব’লে পুরুষের গাল ও জিভের সঙ্গে মূলত তার ছোট ছোট সাজানো দাঁতের সাক্ষাৎকার ঘটে। আজও মীনের ঠোঁটের চারপাশটা শিশুর হামির মতো হালকা লালামাখা হল। সেই রুগ্ন, একপেশে চুমুর জন্যেই যেন আরও বেশি আত্মসমর্পণ আঁখির।

— একটুও আদর না করে চলে যাবে সোনা!
— তুমিই তো বারবার বললে, খুব টায়ার্ড?
— এখন পারবো।
বলেই সে দ্রুত জুড়ে দেয়,
— তোমার সঙ্গে ঝগড়া মিটে গেলেই আমার শরীর ভালো হয়ে যায়, জান না যেন?
চলো চলো, ফ্রেশ হয়ে নাও।
মীনের পিঠে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলে বাথরুমের দিকে, সেই অবস্থায় পেছন থেকে হুমড়ি খেয়ে খুলে দেয় ছিটকিনি। ওমনি ভক করে আবার রুম ফ্রেশনারের গন্ধ। আধো অন্ধকারে সাবান খুঁজতে খুঁজতে মীন অগ্নিশুদ্ধার গলা শুনতে পেল।

— দিদি, শরীরটা খুব খারাপ রে! মালতিমাসিকে বল না, তিন্নিকে স্কুল থেকে তুলে ও-বাড়িতে রাখতে। এই ঘন্টাখানেক পরে গিয়ে নিয়ে আসব। না না, তোকে আসতে …।

(চলছে)

1 thought on “বারো ঘন্টা প্লাস … (চতুর্থ পর্ব)

  1. পড়তে পড়তে সম্ভবত এই গল্পটির শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি।
    দারুণ একটি উপহার। অভিনন্দন প্রিয় চন্দন দা।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।