গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত
সাত

আমার মনে হয়, গড় বাঙালি পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছর পরমায়ু থেকে স্বেচ্ছায় রবীন্দ্রসংগীতের দিকে ঝোঁকে। তার আগে শ্রোতাজন্মের গু-মুত কেটে, খাইয়েপরিয়ে তাকে উপযুক্ত ক’রে তোলে যে মা-বাবাসকল তারা হিন্দি সিনেমার গান, বাংলা আধুনিক, পাশ্চাত্যের কিছু পপুলার মিউজিকও। তো, “ছোট” ঘর থেকে এসেছে বলে পুরনো ফ্যামিলির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখে না সদ্যবিবাহিত, অনেকে আরেক ধাপ জীবনসঙ্গী পালটে রবীন্দ্র থেকে দেশি-বেদেশি মার্গসংগীতের ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। এই জন্যেই অভিজাত সংগীততন্ত্র নিয়ে যেমন গবেষণা বা গভীর চর্চা হয়েছে, হিন্দি-বাংলা সিনেমার গান নিয়ে হয়নি — যেহেতু অনুধ্যান করার বয়েসে বা বোধে পৌঁছনোর আগেই সবাই এই স্রোতগুলো ছেড়ে ওইসব অবিকল্প দির্ঘীকায় সরে গেছে, যেহেতু জাতপাতের চেয়ে মানুষের শিল্পরুচি অনেক জটিল অন্তর্বিভাজনের জায়গা।

অথচ চিরকাল ক্রিকেটের কোচিং সেন্টারগুলোর মতো ‘বড়’ গানের লেভেলে শ্রোতা সাপ্লাই করে চলে এই হিন্দিগানের নার্সারি। সতেরো বছরের ছেলে-মেয়েকে ভোলানোর ক্ষমতা নেই ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের; কেননা যৌবন মূলত লৌকিক, পতিত, বিদ্রোহী, শ্রেণীহীন। শুধু দুঃখের কথাটা হল সেই সতেরো সাঁইত্রিশে পৌঁছে তার প্রাইমারি টিচারকে রাস্তায় দেখলে শরীর ভাঁজ করে না কিন্তু, চিনতে পারিনি ভাব দেখিয়ে পাশ কাটায়।

আট
হিন্দি ফিল্মি গানে কিশোরকুমারের যুগ ১৯৫৫ থেকে ১৯৮৫, তিরিশ বছর। তখন প্রেমিক-প্রেমিকা পরাধীন, সমাজ তাদের এক হতে দিচ্ছে না (উঁচি উঁচি দিওয়ারোঁ সি ইস দুনিয়া কি রসমেঁ — জুলি), এমনকি একবার দ্যাখা করতেই কালঘাম ছুটে যায়। ‘অচ্ছা তো হম চলতে হ্যায়’ গানে (আন মিলো সজনা): তোমাকে এখানে আসতে দ্যাখেনি তো কেউ? না না, আমি “ছুপতে-ছুপাতে” চলে এসেছি। আচ্ছা, ফির কব মিলোগি? যব তুমকো হোগি — পরিষ্কার কথা, ভাই। আর চাপ নেওয়া যাচ্ছে না।

সুতরাং কিশোরযুগে নায়কের প্রধান মাথাব্যথা প্রেম করা নয়, এগেইনস্ট অল অডস প্রেমিকাকে হস্তগত করা। যতদিন সেটা না হচ্ছে, নায়িকা দাঁতে দাঁত চেপে ভিলেন বাপের কাছে পড়ে থাকবে আর দেবে প্রেমের সচ্চাইয়ের দুটি পরীক্ষা — গৃহবন্দি ও খানা-বন্‌ধ। একটু কড়া লিকার-চা ক’রে বললে, মেয়েদের প্রেম মানে হোস্টাইল পুরুষতন্ত্রের খপ্পর থেকে বেরিয়ে ফের এক দয়াবান পুরুষের অধীনস্থ হওয়া। তাই কিশোরের সময়ে প্রেম ঠিক ওয়ান ইজ টু ওয়ান ব্যাপার নয়, একটা সোশ্যাল ইস্যু, এমনকি সামাজিক সমস্যাও। তখনকার প্রেমের গান প্রেমের গল্পও কিছুটা, মাঝেসাঝে যেখানে সসুরা হাজিরা দেবে, কখনও বোন বা ননদ — মানে, গোটা বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বসানো হচ্ছে সম্পর্ককে। আজকের দিনে “অ্যায় খুদা অ্যায় খুদা অ্যায়সা ম্যায় ক্যা কিয়া” (কিশোর: উল্টাসিধা, ১৯৮৫) বলে একটা গান শুরু হোক, আপনি সুফি ঘরানার বিরহগীত শুনবেন ব’লে গুছিয়ে বসেছেন, হঠাৎ অন্তরায় “বাচ্চা তড়পে জখমি রোয়ে মমতা” — পুরো রাজ্য-রাজনীতির দিকে বিষয়টা ঘুরে গেল! এখন নিতে পারবেন না, তখন দস্তুর ছিল দস্তুরমতো।

অতএব, কিশোর-সময়ের প্রেমের গানে বহুবচন জেগে আছে, সম্বোধন করা হচ্ছে একটা প্লুরালিটিকে। তুমি অপূর্ব রূপসী, আমাকে দিওয়ানা বানিয়েছ; তোমায় ছাড়া বাঁচবো না, বস; এবং চলে এসো তোমার আঁচল ভালোবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছি — এই তিনচারটে মেসেজে ধরা পড়ল প্রেমের তাপমান। গানের বাকি অংশটুকু মাটি ফেলে ভরাট করার জন্যে থাকছে জীবন বিষয়ে নানা পর্যবেক্ষণ, অনেক দার্শনিকতা — যদি আনন্দ বক্সি বা মজরুহ সুলতানপুরিকে আপনি দার্শনিক বলতে রাজি থাকেন। আমরাও দেখেছি, কিশোর আর ‘জিন্দগি’ এক লিথাল কম্বিনেশান; অমিতকুমারের পাপা-র গান শুরুর লাইনে একটা ‘জীবন’ বা ‘জিন্দগি’ পেয়ে গেছে মানে ক্রিস গেইলও আইপিএল ম্যাচের প্রথম ওভারেই ছক্কা মারল, আজ ফাটিয়ে খেলবে।

আমাদের এ-কথা না মানারও কোনও কারণ থাকতে পারে না যে সেই ১৯৫৫-৮৫ কালখণ্ডে প্রচুর অসংখ্য প্রেমের গান লেখা হয়েছে যারা নিখুঁত, দশে দশ পাওয়া। কিন্তু তৎসময়ের সমাজ-বাস্তবতায় নায়ককেই যেহেতু প্রেমিকা-উদ্ধারে নামতে হবে, সে-ই বেশি লাফাচ্ছে গানে ও ঢিসুমে, অতএব, এইবেলা লিরিক থেকে মেল ডিওডোরান্ট ভক ক’রে আপনার নাকেমুখে এসে লাগার খুব সুসম্ভাবনা।

ক) ‘আ চল কে তুঝে’ গানে কিশোর বলছে চলো আমি তোমায় খোলা আকাশের নিচে নিয়ে যাই (কারণ, আমি পুরুষ)। ওই গানেই একটু পরে এল ‘ব্যায়ঠে হোঙ্গে রস্তে পে ওহ আঁখ বিছায়ে’… মেয়েদের তো আসা-যাওয়ার পথের ওপর চক্ষু পেতে বসে থাকাই নিয়ম।
খ) ‘পল পল দিল কে পাস’ গানে পুরুষ নিশ্চিন্ত করছে তার নারীকে: তুম সোচোগি কিঁউ ইতনা, আমি তো তোমাকেই ভালোবাসবো।
গ) সিলসিলা ছবিতে লাইল্যাক ফুলের বাগানে লতা গাইছেন ‘মেরে দিল হ্যায় তেরি পনাহোঁ মেঁ’ আর কিশোর ঠিক পরের লাইনে ‘আ ছুপা লুঁ তুঝে ম্যায় বাহোঁ মেঁ’। এই প্রেম এক হিসেবে শরণার্থী আর সরকারি কলোনির।
ঘ) কিন্তু ছেলেদের হাত বা বাহু ব্যাপারটা এত এসেনশিয়াল যে এই দেখুন, কিশোর-কন্ঠ আবার গেয়ে উঠল ‘থামলো তুম মেরি বাহেঁ ম্যায় তুমহে সমহল লুংগা’, সেই সঙ্গে প্যাকেজে বাড়তি প্রতিশ্রুতি, রাস্তার কাঁটাও সব দূর করে দেবো। এ-গানের প্রথম লাইন ‘অ্যায়সে না মুঝে তুম দেখো’।

নায়ক আবারও খুব আন্তরিকভাবে গেয়েছেন ‘ও মেরে হমরাহী মেরী বাহ থামে চল না’ (‘গাতা রহে মেরা দিল’ থেকে)। কিন্তু যদি নায়িকা এত ক্লান্ত যে হাতও ধরতে পারছে না? ‘তুম যো থক গয়ি হো তো বাহোঁ মেঁ উঠালে’।
পুংহস্ত কী না পারে!
ঙ) আঁধি ফিল্মের ‘তেরে বিনা জিন্দগি সে কোই’ গানে কিশোরের সহগায়িকা লতা বলেন, ইচ্ছে করছে তোমার পদক্ষেপ থেকে বেছে আমি জীবনের লক্ষ্য নির্ণয় করি।
এখানে নিজের মন্তব্য বসিয়ে নিন।

নয়
নিশিতানি কেইজি (১৯০০-১৯৯০) জাপানের কিয়োতো স্কুলের দার্শনিক, নিশিদা-র প্রিয়তম ছাত্রদের একজন। নিশিদা দর্শনকে কখনও ধর্ম থেকে আলাদা করতে চাননি এবং এটাই কিয়োতো স্কুলের শিক্ষা। তার ধারণা ছিল পাশ্চাত্য দর্শন ঈশ্বর নামক পরম কেন্দ্রটি হারিয়ে ফেলে নিহিলিজমের পথে হাঁটছে। বৌদ্ধ নিশিতানি এই ভাবনাটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে বলছেন, পশ্চিমি আধুনিক দর্শন অনুযায়ী ওই সব দেশের মানুষের যে আত্মোপলব্ধি তা তাদের অহং-এর অনুভব ছাড়া আর কিছু নয়।

পাশ্চাত্যে মানুষের আত্মানুভব সংস্কৃতির ধর্মনিরপেক্ষতার ভেতর দিয়ে অর্জন করার চেষ্টা হয়েছে, যার ফলে মানুষ তার জীবনের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিযুক্ত হয়ে গেছে। সে হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাধীন, আত্মকেন্দ্রিক, আত্ম-অনুপ্রাণিত এক স্বশাসিত সত্তা। কিন্তু ,মানুষের এই অটোনমাস অস্তিত্ব ধর্মীয় শেকড় ছাড়াই বাঁচতে চাইছে বলে বিরোধ তৈরি করছে নিজের ভেতরেই। এখানেই থিয়োসেন্ট্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অ্যানথ্রোপোসেন্ট্রিক মনোভাবের তফাত। মানুষ নিজের ধর্মীয় সত্তা থেকে বেরিয়ে এসেছে মানে সে প্রেম থেকেও তফাত হল। নিজেকে বোঝার ক্ষেত্রে প্রেম সবচেয়ে দরকারি উপাদান, অথচ আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনে সেই ধর্মীয় প্রেম (agape) পালটে গিয়ে হল যৌন আকাঙ্খা (eros)।

নিশিতানি আরও বলেছেন, পাশ্চাত্য সভ্যতা মুক্তি চায় না, চায় স্বাধীনতা (লিবার্টি), আর সাম্য বলতে বোঝে সমানাধিকার। প্রেমের উপাদানহীন এই দুই ব্যাপার বড়জোর হিউম্যান রাইটসের মৌজাভুক্ত। আবার এদিকে প্রেমকে যুক্ত করা হল ফরাসি বিপ্লবের ফ্র্যাটারনিটির ধারণার সঙ্গে, লুডভিগ ফয়েরবাখ যাকে লাভ অফ হিউম্যানিটি বলেছেন। আধুনিক আমেরিকায় যেটা স্পিরিট অফ সার্ভিস।

ডঃ নিশিতানি কেইজি-র তত্বের সঙ্গে অনেক জায়গাতেই আমরা একমত হবো না, তবু মনে হয়েছে, কিশোরকুমারের হিন্দি গানে যে প্রেম, তার মকসদ ছিল লিবার্টি, পুরনো পুরুষতন্ত্রের খপ্পর থেকে বেরিয়ে যে আস্তে আস্তে সাম্য আর মানবিক সখ্যতার দিকে যেতে চায়।

(আশা রাখুন, শেষ হবে)

8 thoughts on “গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

  1. নিবন্ধটি পড়লাম প্রিয় চন্দন দা। যথার্থ বলেছেন … 'জাতপাতের চেয়ে মানুষের শিল্পরুচি অনেক জটিল অন্তর্বিভাজনের জায়গা।' পরবর্তী অংশের অপেক্ষায় রইলাম।

    1. অনেক ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানবেন, আজাদ ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  2. আলোচনাটি ফলো করে চলেছি। ভাল বিশ্লেষণ দাদা ভাই। সহমত।

  3. সাহিত্য, সংস্কৃতি ও দর্শন নিয়ে লেখটা অবশ্যই দর্শনীয় হয়েছে, লেখাটার মান যথেষ্ট সুন্দর, যার দরুন মনে হয়েছে লেখাটা পড়াই উচিৎ! তবে লেখাটার শুরু ও শেষটা একটা অসামঞ্জস্য মনে হয়েছে। এই বিষয়ে আপনার নিশ্চয় কিছু বলার আছে, আমি সেটা দেখার জন্য আপনার প্রতি মন্তব্যের দিকে চেয়ে থাকব!

    1. মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ, কবিরভাই। আপনি একদম ঠিক বলেছেন। আমারই দোষ যে পুরো লেখা আমি একটা ঠাস-বিনুনিতে বাঁধতে পারি না সব সময়। চাইও না হয়তো। 

      গান নিয়ে আমার কিছু চিন্তা আর পর্যবেক্ষণ বলতে শুরু করেছি । গণসংগীত, রবীন্দ্রনাথের গান আর হিন্দি ফিল্মি সং-এর কথাসুর — এই তিন পর্যায় কোথাও কি মিলবে এসে বা ঝগড়া শুরু করবে এই গদ্যে? এখনও জানি না।

      আপনার মতো সামঞ্জস্য খুঁজছি আমিও! 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।