গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত
ষোলো (ক)

ইউ টিউবে ভিডিয়োতে একটা কুড়ি-বাইশের মেয়ে, ছোট্ট উত্তরভারতীয়, আহ্লাদে ভাসতে ভাসতে বলেছিল, হি সিংগস হোয়াট উই গার্লস ওয়ন্ট টু হিয়ার।

সেই হঁসমুখ বাক্যের ‘হি সিংগস’ ফলাটা ক্যাঁত করে আমার ঘিলুতে গেঁথে যায় আর ‘ওয়ন্ট টু হিয়র’ তার বদ্রীলেজ কাঁপাতে থাকে জুলাই বাতাসে।

তিরিশ থেকে পঞ্চাশ বয়েসখণ্ড ধরলে ভারতীয় শিক্ষিত মেয়েদের এক প্রস্থচ্ছেদ পাবো যারা পুরুষতন্ত্রের হাত থেকে অনেকখানি ক্ষমতা স্বাধীনতা সমানাধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে; চাকরি করেছে, ডিভোর্স করেছে, সিঙ্গল পেরেনটিং, পছন্দসই পেশায় গেছে, অংশ নিয়েছে একাধিক প্রেমে যৌনতায়, নেশা করেছে, একা বেড়াতে গেছে, ইচ্ছেমতো পোশাক পরেছে, সমাজ-আন্দোলনে নেমেছে, অন্যায়কারী পুরুষকে টেনে নিয়ে গেছে পুলিশ-আদালত পর্যন্ত, সংসারে তাদের মতামতকে সমান গুরুত্ব দেওয়াতে বাধ্য করেছে।

এর কিছু কাজ নিশ্চয়ই করতে হয়েছে গুপ্তঘাতকের মতো, ফলস-ইমেজের আড়ালে ব’সে, যেহেতু তারা হাড়েমজ্জায় পুরুষতন্ত্রকে চিনেছিল। যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে চেনাটা আসল জরুরি।

তবু চেনা আর জানায় তফাত থেকেই যায়। স্কুলে যৌনশিক্ষার বই পড়ে তো আপনি সহপাঠির মন জানতে পারবেন না।

আরএসএস আর হিন্দু জনতা, মুসলিম ল’ বোর্ড আর মুসলমান সম্প্রদায়, মাওবাদি এবং পশ্চিম মেদিনীপুরবাসীর মতোই পুরুষতন্ত্র আর পুরুষ — একটা এমপ্লয়ার-এমপ্লয়ি সম্পর্ক। মেসমালিক-বোর্ডার রিলেশানশিপও বলতে পারেন। মাড়োয়ারি ফার্মে যখন রাজস্ব দপ্তরের ‘ছাপা’ পড়ে, মাসে ছ’হাজার টাকা মাইনের কেরানি মেয়েটার কোমরে তিনটে কাঁচা চালান-বই গুঁজে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাথরুমে, যেখানে সে অনন্তকাল দরজা টেনে বসে থাকবে। তবু কোম্পানির মালিককে চেনা আর কর্মচারিকে জানা (যে জানা থেকে বোঝা সমাগত) এক জিনিস নয়। এক নয় প্রতিক্রিয়া (reaction) দেখানো আর সাড়া (response) দেওয়া।

তবু ভারতে তিরিশ থেকে পঞ্চাশ উমরকালের মেয়েরা তাদের ঐতিহাসিক ভুরুগুলো কুঁচকে রেখেছে বলেই এখন ‘বচনা অ্যায় হসিনোঁ, লো ম্যায় আ গয়া’-র মতো গান রেকর্ড হয় না বলিউডে। তাদের ‘হর এক কে মুহ মেঁ আধা-আধা লিটার পেট্রোল’; পুরুষের আচরণে ‘কুছ উঁচনিচ হোয়েঙ্গা তো’ অটোমেটিক ভেতর থেকে নির্দেশ আসবে ‘থুক’, সঙ্গে সঙ্গে ‘মাচিস মারকে নিকল লেনে কা’!

এরা সন্দিগ্ধ আর অবিশ্বাসী; নখ মেরুদাঁড়া একসঙ্গে উঁচিয়ে রেখেছে-হেতু সন্তানের জীবনে পুরুষ-অত্যাচারের কোনও লিগ্যাসি-ফাইল বদলি হয়ে আসেনি। প্রজন্ম-পুরনো শোষণের লাগেজ পিঠে হাঁটছে না নতুন মেয়ে।

আর মেধাবী অকৃত্রিম আত্মনির্ভর নারীকে পেয়ে বেঁচে গেছে এখন-পুরুষ। সে তাকে একই সঙ্গে রক্তমাংসে, আবার শরীরের বাইরে গিয়ে আইডিয়া হিসেবেও দেখতে পাচ্ছে, যে যোগসাজশ সম্পর্কের পরিত্রাণের জায়গা।

অরিজিৎ গাইলঃ
তুম হো না হো, লগতা হ্যায়
অব জ্যায়সে কি তুম হী তো হো
(গানের নামঃ লাভ মি থোড়া অর)

অথবা
তূ হী তূ হ্যায় জো হর তরফ মেরে
তো তুঝসে পরে ম্যায় জায়ুঁ কঁহা
(গানের নামঃ ইশক মুবারক)

তো, দুটো গান প্রেমকে অ্যাপ্রোচ করছে পুব আর পশ্চিম, দুই উলটো দিক থেকে। সূর্যাস্তের পরেও সূর্যের থেকে যাওয়া সূর্যনিরপেক্ষ, বোধনির্ভর। তপনজ্যোতি, তুমি আছো নাকি নেই, এই বাস্তবতা একান্তই তোমার বিষয়। কিন্তু আমার কাছে শুধু ‘তুমি’ই আছো, কারণ ‘আমি’ লুপ্ত হয়ে গেছি সেই কবে!

অথবা আমার সমস্ত পাহাড়চুড়োয় তুমি জেগে উঠেছ ভোর পাঁচটায়, আমার বাইনোকুলারে, মাংকিটুপিতেও। বরং আমি দেখছি এখানে তোমার কাছ থেকে পালানোর রাস্তাটাই লা-পতা! তার ওপর কখন রবীন্দ্রনাথও গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেছেনঃ ‘যেথা আমি যাই নাকো/তুমি প্রকাশিত থাকো’ ব’লে। কানের কাছে ঘাড় নামিয়ে ফিসফিসোচ্ছেন — কখনো যদি তার হৃদয় বিপথে যেতে চায়, তৎক্ষণাত লজ্জা পেয়ে সরে আসে।

ভারতীয় মান সে আধ্যাত্মিকতাই অনুভবেই গভীরত ম বিন্দু, কারণ ইশ্বরের চেয়ে বড় ভাবকল্পনা এদেশে আজও কিছু হয় না। ‘সনম বে-ওয়াফা’ ছবিতে লতা গেয়েছিলেন ‘আল্লাহ করম করনা, লিল্লাহ করম করনা’, আর ‘সনম রে’ ছবির অরিজিৎসিংগীত ওই একই পুজোপ্রবচন ব্যবহার করল ভালোবাসাতেও, ‘সনম রে, সনম রে, তেরা মুঝপে করম হুয়া রে’। স্বানন্দ কিরকিরের লেখা ‘ফিতুর’ ছবিতে একটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং আর ফাটানো প্রেমের গান ‘পরবরদিগারা’, যে শব্দের মানে, খুব কম করে বললেও, ভগবান। এখানে আবার হালকা রবীন্দ্রনাথ পালন ক’রে নিচ্ছি — ‘এলিজে’ ছবির অরিজিতসংগীতটা দিয়েঃ

প্যার ম্যায়নে জো নিভায়া
তেরে রহতে তেরে সাথ ভী
সচ কহুঁ তো উসসে জ্যাদা
চাহা তুঝকো তেরে বাদ ভী

শুনতে শুনতে আপনি গুনগুনাতেই পারেন—
যে কথাটি বলবো তোমায় ব’লে/কাটলো জীবন নীরব চোখের জলে
সেই কথাটি সুরের হোমানলে/ উঠল জ্বলে একটি আঁধার ক্ষণে
তখন তুমি ছিলে না মোর সনে

ষোলো (খ)
ধুলোকপাল, জটপাকানো চুল, ক্লান্ত কিটোজুতো — ওই দেখুন অফিস-ফেরত পুরুষের কাঁপা কাঁপা হাত উঠছে রাত ন’টার কলিং বেলের দিকে। দরজা খুলতে দু’মিনিট দেরি, কিন্তু সে গলার ভেতর থেকে বাঘ বের করে আনলো না। একবার ফ্যাঁস পর্যন্ত করল না আজও পাঁচফোড়ন আনতে ভুলেছো!-র জবাবে। পুরুষ বিশ্রাম চাইছে, স্বপ্ন দেখছে একটা সহজচেয়ারের যেখানে তার গা ঘেঁষে হোমপোস্টিংয়ে থাকবে অঘ্রাণের রোদ্দুরও।

জো তুম না হোতে
হোতা হী ক্যা হার জানে কো
(গানঃ কভী ইয়াদোঁ মেঁ আয়ুঁ)

হেরে যাওয়ার জন্যে এত যত্ন, এত টেনশান, এত নির্ভরতা, এমন নমনীয় গর্দান…!

ফুটন্ত জলের পাত্রে বুদবুদ ভেসে ওঠে, নিচে নেমে যায়, অরিজিৎ গাইতে শুরু করে ‘তেরা ইয়ার হুঁ ম্যায়’-

“তুই যদি রেগে যাস, কে হাসবে তবে
তুই ছেড়ে গেলে কে থাকে শূন্য বৈভবে

আয় আবার ঝগড়া ক’রে পুতুল কেড়ে নিই
তুই জিতিস,আমি হেরে ভূত হবো
আয় ফের করি আগের সব শয়তানি
তুই পালাস, আমি নয় মারই খাবো
তোর ওই মিষ্টি বকুনি শুনবো ব’লে ছটফটাচ্ছি,
দিব্যি বলছি, কিরে!

তোর বন্ধু আমি রে…”

গানটার ভেতরে একটা দ্বিজনপথ বসানো দেখতে পাই। গানের তরুণতরুণী মাঠের মধ্যে মিশে যাচ্ছে হাঁটতে হাঁটতে…দুপায়ে বাতাসের প্রোটিন, শিশিরের জলসঞ্চয়। দেখি মরা ঘাসে বিখ্‌রে আছে দুটো মুকুট, ফুটো হয়ে যাওয়া পুরুষতন্ত্র আর আধাতৈরি নারীআগম।

(ষোলোকলা)

4 thoughts on “গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

  1. বিশাল একটি যুদ্ধকে জয় করেছেন দাদা ভাই। যুক্তি এবং আলোচনায় ভীষণ প্রাণবন্ত হয়েছে।

  2. অসাধারণ এই ষোলোকলা প্রিয় চন্দন দা। অসাধারণ এক বিশ্লেষণ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  3. * বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা ভালো লেগেছে…

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।