চার
মা কোনওদিন হেডমিস হতে পারবে না। হেডমিসের কেমন দূর-ময়না গলার আওয়াজ, যে-কোনও “ভাল্লাগে না” সারিয়ে দেওয়া হাসি, পাট-পাট শাড়ির কুচি, রাস্তা দিয়ে এক-ঢেউয়ে হেঁটে যাওয়া… আর মা তো ব্লাউজই পরে না। চাঁদের দিদি প্রতিদিন মিসের সঙ্গে স্কুলে যায়। চাঁদও হেডমিসের পাশাপাশি এক-ঘোরের মধ্যে হেঁটে যেতে চাইছে অল্প হোঁচট খেতে খেতে; শিবুকাকুর দোকানদার ছেলেরা, বটতলায় বসে আড্ডা মারা তার যত পায়ে-ঘা, প্যান্টের-ইলাসটিক-ঢিলে বন্ধু, সব হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। শিমূলগাছ, তৃণাঙ্কুর ঘাস আর তাতে দড়ি-বাঁধা ছাগল ফিসফিস ক’রে বলবে, ইশ খুব ভুল হয়ে গেছে আপনাকে “এই চেঁদো” ব’লে ডাকা-টা! চাঁদ তখন প্রভাতীদির ছাত্রবন্ধু, সেই বড়দিমনি রাস্তায় যার মুখোমুখি পড়ে গেলে প্রণাম করে কেটে পড়তে হয়।
সরস্বতী পুজোয় গিয়ে সে দেখে এসেছে এক চুপিসাড় অচেনা পৃথিবীকে যেখানে দিদি প্রতিদিন পাঁচ ঘন্টার জন্যে গুম হয়ে যায়। পুট পুট ক’রে ভেঙে যাওয়া চক, ধুলোময় ডাস্টার, তিন কাঠির স্ট্যান্ডে বসানো ব্ল্যাকবোর্ড, একসঙ্গে জোড়া চেয়ার-টেবিল আর বিরাট পেতলের ঘন্টায় নির্মিত সেই রহস্য অমনিবাস। প্রতিদিন সকালে উঠে চাঁদ মাকে জিগ্যেস করেছে, আজ আমারে ইশকুলি ভোত্তি ক’রে দেবা তো, আর মা জবাব দিয়েছে, আজকে না, কালকে। কিন্তু সেই চিরকালীন আজ-এর একদিন যখন দিদি দিদিমনির সঙ্গে রওনা দিচ্ছে, মা হাসছে সৌজন্যমূলক ঘোমটার ভেতর থেকে, চাঁদ পায়খানায় বসে কোঁৎ পাড়ার মতো ক’রে চেঁচাল — আমিও ইশকুলি যাব। পরিবেশে প্রভাব সৃষ্টি হচ্ছে না দেখে সে দ্বিতীয়বার চিৎকার শানালো বুনো গলায়, যেমন আর ডি বর্মন, আর তারপরেই ছেলেটার শরীরে ভেঙে পড়ল কান্না। উঠোনে আমগাছের ছায়ামুগ্ধ কোনে বড় বড় দুব্বোঘাস, তার ওপর শুয়ে পড়ে লুটোপুটি খেতে লাগল। শিশিরে জব্জবে নীল সোয়েটার, ছোট ঢিল আর খড়কুটো ফুটতে লাগল পিঠে। মা তার একটা ডানা ধরে টানছে, উঠোনের উনুনে ধানসেদ্ধ ফেলে দিদিমা ছুটে এল, ছোড়দা ভাবছে, ওহ, আজ যা পেটানি খাবে না…! চাঁদের মাথার চুলে আমের শুকনো পাতা; সর্দি, চোখের জল আর শিশিরে ধুয়ে গেছে মুখ; কোঁচকানো ভুরুর ওপরে ছোট্ট কপাল, লম্বা চোখদুটো, ঠোঁট, থুতনি … সব পুরোনো মধুর মতো বিষণ্ণ লাল।
পাঁচ
— ছেলেটারে শুদু শুদু কষ্ট না দিয়ে ইশকুলি ভোত্তি করে দিচ্ছিস না কেন, নাদু?
— যা বোজো না, তা নিয়ে কথা বোলতি আসে না, মা। ওর বয়েস হইছে ইশকুলি পড়ার?
— তালি মিথ্যে মিথ্যে আশা দিস ক্যান্?
— যার ছল তারে ভাবতি দাও। মার চেয়ে দরদ মাসির, তারে বলে সব্বোনাশী!
— মানলাম, ছল তোর। কিন্তু ওরম ঠাস ঠাস ক’রে কোনও মা’য় তার বাচ্চারে চড়ায় নাকি! ব্যাচারা কাঁদতি কাঁদতি বাড়িত্থেকে বেরোয় গ্যালো।
— তোমার মোতন গায়ে ফুঁ লাগায় ঘুল্লি আর একচোখোমি কল্লি আমার চলে না। দোষের শাস্তি মার। আমার পরিষ্কার কথা, খাওয়াবো তত্ত্ব, হাগাবো রক্ত।
— ওরে আমার তত্ত্ব-খাওয়ানি রে! সকাল থেকে বাচ্চাগুলোরে দিছিস তো এক কাপ চা আর এক খুরি মুড়ি।
— আমার মাথা গরম ক’রে দিয়ে না, মা। এতগুলো হাঁ ভরাতি হলি মা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেও টান পড়ে। তারপর যদি থাকেন একজন ঘরশত্রু বিভীষণ!
— তুই বিভীষণ কারে বোলিস, নাদু?
— যারে কওয়ার তারেই কোইছি! এক বেলার জন্যি বারাসাতে ছোট্ঠাকুরপোর কাছে গিছিলাম। আসে দেখি, সরষেত্তেলের বোতল অদ্দেক খালি! সাধের ছোট নাতিরে মুসুরির ডালের বড়া ভাজে খাওয়ানো হয়ে গেছে। আজ মাসের দশ তারিক, বাকি মাস এই তেলে চলবে কী করে? নিজির সংসার হলি এ-কাজ কত্তি পাত্তে?
— আমি বড়া ভাজিনি। তোর সরষেত্তেলের বোতলে হাতও দিইনি আমি।
— আর দুদিন পরে তো চোখ বোজবা, এখনও মিথ্যে কথা ছাড়তি পাল্লে না। বাচ্চাগুলোর স্বভাব বিগড়ে দিয়ে যাচ্ছ, ছোটোটার মাথা তো খাইছ এর মদ্দিই, সবক’টা অমানুষ হবে। তার ভোগ ভুগতি হবেনে আমার।
— আমি তোর চক্ষুশূল হয়ে উঠিছি, তাই না? অন্ন ধ্বংস করতিছি তোর! তো সে কথাডা অ্যাতো ঘুরোয়ফিরোয় কওয়ার দরকার কী? পাকিস্তান থে’ আসার সুমায় সঙ্গে না নিলিই পাত্তিস।
— তা তো কোইনি। খাবা-দাবা, সংসারের এক কোনে পড়ে থাকবা। গা-জ্বালানি কথা বোলতি আসো ক্যানো? এ-মাসে নিতাই টাকা পাঠায়নি, তোমার জামাইয়ের মাইনে হোতি আরও এক সপ্তা, কাল রবিবার র্যাোশান তোলার পয়সা নেই। তোমার আর কী! সেদিন বললাম, মা উনোনে কয়লা পুড়তিছে, আমার হাত আটকা, কলাইয়ের ডালটা চাপায় দ্যাও। কী কোলে? এখন পারব না, পোড়ে কয়লা পুড়ুকগে! এই কথাডা আমি জীবনেও ভোলবো ভাবিছো! পিঠে খাও পিঠের ফোঁড় গোনো না, না?
— পুরোনো বিত্তান্ত তুলে তুই আমার পায়ে পা বাদায় ঝগড়া কোত্তিছিস, নাদু! তোমার কোন পাকা ধানে মই দিছি যে কারণে-অকারণে খোসবা; আমি কথা বোল্লিই অপরাধ! বাড়িতি এট্টা গরু থাকলি সেও হাম্বা করে, অথচ এ-বাড়িতি আমার কিছু কওয়ার জো নেই! ওনুমোতি দে, আমি তোর সংসার ছাড়ে চলে যাই।
— আমি ওনুও দেব না, মোতিও দেব না। তোমার যা মোনে চায় কোত্তি পারো।
— এমন এট্টা দিন যায় না যেদিন তুই বালবিধবা মা’রে না কাঁদায় জল খাইছিস। যদি এক ফোঁটাও বাওনের রক্ত আমার গায়ে থাকে, তাহলি এই মুখ আর এ-জীবোনে দেখতি পাবি না।
— ওমা, আমি আবার কী বল্লাম তোমারে! আমি তো মুখ বুজেই আছি। সকাল থে’ তুমিই গাচ্ছো, তুমিই বাজাচ্ছো! বেরোয় একবার দেখে আসো, কোনও চুলোয় জায়গা হবে নানে। এই জামাইয়ের হোটেলেই ফিরে আসতি হবে।
ছয়
গাছি উঠেছে নারকোল গাছে; গাছ খোড়োনো হবে, পাড়া হবে ঝুনো নারকোল। গাছিভাইয়ের সারা গায়ে উদ্ভিদের গুঁড়ো গুঁড়ো আঁশ আর ঘাম মিলে ঝাঁঝালো গন্ধ। গোড়ালিতে একগাছি গোরুর দড়ি, এক ফালি ধুতি ল্যাঙোট ক’রে পরা, পাছার দুটো আঁটিই দেখা যায়। চাঁদ আর তার এক বছরের ছোট বোন গোপা, যাকে অজানা কোনও কারণে সে গোপু বলে ডাকে, হেসে এ ওর গায়ে পড়ে যাচ্ছে। বলা হয়নি, এক ঘন্টা আগে চাঁদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাড়ার আজাদ হিন্দ সংঘে একটা চেয়ারে হাঁটুতে থুতনি রেখে বসে শীতে ঠকঠক ক’রে কাঁপছিল। মায়ের নির্দেশে মনিদা ওই অবস্থাতেই তাকে পেছন থেকে ধ’রে তুলে আনে। এখন সে ঘি দিয়ে এক থাল ফ্যানাভাত খেয়ে দিদির ঘরে-পরার সোয়েটারটা গা’য় স্কুলে ভর্তি হতে না পারার দুঃখ ভুলে নারকোলনাড়ু খাওয়ার আশায় উঠোনময় দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
গাছি শুকনো ডেগো আর ফ্যাতরা কেটে ফেলছে নীচে আর চোখের সামনে ধক ধক ক’রে বড়ো হয়ে যাচ্ছে গাছটা! ফ্যাতরা দিয়ে ন্যাড়া পোড়া হবে দোলের আগের দিন। আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া/কাল আমাদের দোল/পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে/বলো হরিবোল। সব কবিতাতেই চাঁদের নাম, দেখেছ?
গাছি এক কাঁদি নারকোল মাটিতে নামিয়ে দিল দড়ি বেঁধে। আরে এ কী করলে গাছিভাই, এগুলো তো এখনও ঝুনো হয়নি, দুমড়ো! তখন মনিদা — দুমড়ো নারকোলের সেই গল্পটা বলো না, মা। আরে, আমার এখন অনেক কাজ। আচ্ছা, শোন। পাকিস্তানে আমাদের বাইরির কাজ করার, এই ধর ছাড়া-কাপড় কাচা, ঢেঁকিতে ধান ভানা এসবের এট্টা মুসলমান মেয়ে ছিল, আমারই বয়েসি, সালমা। তাকে একদিন জিগ্যেস করিছি, এই তোরা যে গোরুর মাংস খাস, খাতি কেমন লাগে রে! স্বাদ কেমন? তা সালমা বলে কী,
— ও ঠারোন, দুম্মো নায়েল খায়েসো?
— খাইছি তো!
— অ অ অ অ অ অয়, তবে তুমি গোরুর মাংসও খায়েসো।
— দূর হ’ মুখপুড়ি!
এই গল্পে হাসির কী আছে, চাঁদ বুঝতে না পেরে তাকিয়ে দ্যাখে বোন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ছোদ্দা জানিস, মা’র সঙ্গে দিদ্মার ঝগড়া হয়ে গেছে। মা বলল, তুমি রাবণ। দিদ্মা বলল, না, আমি বাওন। বলে বাড়িত্থেকে চলে গেল।
দিদিমা বিদায় নিলে চাঁদের অনেক ক্ষতি — প্রথম কথা শোয়া। সে খোপের ঘরে বুড়ির সঙ্গেই ঘুমোয় এবং যেটা পৃথিবীতে কেউ জানে না, ঘুমোনোর আগে তার কিশমিশের মতো শুকনো কচকচে মাই পুরে নেয় মুখে। তারপর রসগোল্লা-ক্ষতি তো আছেই। বাড়িতে মিষ্টি এলে দিদিমা নিজের ভাগেরটা রেখে দিয়ে মাকে লুকিয়ে তাকে খাইয়ে দেয়। মা দেখতে পেলেই ঘেন্না দেবে — খাসনে চাঁদ, তোর দিদ্মা ওটা বাঁধানো দাঁতের কৌটোয় রাখে দিছিল। সে আড়চোখে নারকোল-কাঁদির দিকে তাকিয়ে দুর্বল গলায় গোপুকে বলল, আমিও বাওন, আমিও চলে যাব।
(ধারাবাহিক)
পাঠবোদ্ধ সাবলীল ধারাবাহিক। মুগ্ধতা জানালাম প্রিয় কবি চন্দন দা।