পঁচিশ
অনেক শেয়াল ডেকে উঠল এই প্রজনন-ঋতুতে। তাদেরই কয়েকজন রাতের নির্বাক রেললাইন ঘেঁষে, গোরুখাটালের পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে পাখির ডিম, ইঁদুর অথবা বেড়ালবাচ্চা খাবে ব’লে।
শব্দ পেয়েই ভোর অবতরণ শুরু করল আকাশ থেকে, তিন ঘন্টা পরে শেষবার বাঁশি বাজিয়ে শেয়ালরা তাদের বাড়ি-বাড়ি ঢুকিয়ে দিয়ে যাবে। “প্রহরে প্রহরে আমি গান গেয়ে জাগি” হয়ত এক গিধড়সংগীতই! এবং সকালবেলা আদাড়ে পড়ে থাকা রক্তমাখা ফর্দাফাঁই মার্জারশিশুদের কোনও কররেখা নেই, গ্রহশান্তিকবচ নেই…।
জ্যোতিষ নিয়ে বরুণের খোঁটা শুনে অন্য টিচাররা হাসে, তবু দুর্গরক্ষার দায়িত্বে আছে বলেই নির্মল স্বীকার করতে পারেনি, খনার বচনও প্রমাণের অভাবে ভুগেছে বহুবার। অনেক যুগ আগে তার বাবা বাণীনাথ বড় ছেলের কোষ্ঠী প্রস্তুত ক’রে দেখেছিলেন, জাতকের অতিপ্রবল সন্ন্যাসযোগ। কাজেই, আঠেরো বয়েস হতেই দাও বিশ্বদেবের বিয়ে, তিনটে বাচ্চা রেখে বউ মারা গেলে তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয় পরিবার ঘরে আনো। তারপর খুলনার বাতনাই নৌকোর মতো সংসার সুকলেবর হতে হতে শেষে পরেশান স্বামীস্ত্রীর মধ্যে খটরমটর লাগলে বিশ্বদেব ঠোঁট ওলটাতো : আমার তো সংসার করার কথাই না! গিন্নির ঝটাকসে উত্তর, হ্যাঁ সন্নিসি হবেন বলেই তো দুই বিয়ে আর ন’টা ছেলেমেয়ে। ব্যাস, জোঁকের মুখে একথোকা নুন।
বাণীনাথ কখনও মানেননি জ্যোতিষশাস্ত্র ভুল; গণকেরই ত্রুটি হয়ে থাকবে দণ্ড-পলের হিসেবে। তেমনি যদি কোনও বেদপন্থীকে জিগ্যেস করো, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ অনুযায়ী আয়ুস্তোম যজ্ঞ করেও কেন যজমান দীর্ঘজীবন পেল না — নিশ্চয়ই যাগের নিয়মপালনে গন্ডগোল হয়েছিল। যুক্তিটা এমনভাবে সাজানো আছে যে বৈদিক যজ্ঞ ফল দিক বা না দিক, মিথ্যে প্রমাণিত হবে না। একই প্যাটার্ন নির্মল লক্ষ করে বরুণের মধ্যেও। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার পানমুখো গান্ধিবাদী মহাদেব সেনগুপ্ত সারাদিনে তিনটে খবরের কাগজ মুখস্থ করে। বাড়ির রেডিয়োয় সারাক্ষণ বিবিসি নিউজ। সে বরুণকে পেলেই — ১/ সোভিয়েত রাশিয়ায় স্টালিন ইহুদিদের ওপরে যে অত্যাচারটা করেছে তারপর সে হিটলারের চেয়ে ভালো হয় কী করে? ২/ বিপ্লবের পরে সোভিয়েত চেয়ারম্যান কুলাক চাষি আর কবিসাহিত্যিকদের মারল কিম্বা নির্বাসনে পাঠালই বা কোন দর্শন মেনে? ৩/ বুলগেরিয়ার জার ব্রিটেন-আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায়নি ব’লে সীমান্ত পেরিয়ে রাশিয়ার রেড আর্মি ঢুকে সে-দেশে বিপ্লব ঘটিয়ে দিল, এটা কি মার্ক্সবাদ সম্মত? কিছুক্ষণ তাচ্ছিল্যভরে ‘বুর্জোয়া সংবাদপত্র’, ‘আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ’ বলাটলার পরে বরুণ ঘোষণা করত, মার্ক্সবাদের প্রয়োগে নেতৃত্বের ছোটখাটো বিচ্যুতি হতে পারে, কিন্তু সাম্যবাদী আদর্শে কোনও ভুল নেই।
— কী ক’রে বুঝলে?
— স্যার, এটা আপনাদের ভাববাদী দর্শন নয়, বিজ্ঞান। তাই সত্য।
টিচার্স রুমের জানলা দিয়ে পানের পিক ফেলে মহাদেববাবু :
— বিজ্ঞান সত্য তোমায় কে বলেছে? সে হল সত্যের খোঁজ, সত্যের জন্যে অভিযাত্রা।
ছাব্বিশ
জীববিদ্যার মাস্টার অশোক, যার পদবি মণ্ডল থেকে মেন্ডেল হয়ে গেছে বংশগতি সূত্রের অত্যাচারে, চেয়ার থেকে বাঁদিকে কাত হয়ে নির্মলের মুখের কাছে মুখ নেয় :
জ্যোতিষ নয়, জিন, বুঝেছ পণ্ডিত? মানে পূর্বপুরুষ যেমন জাতের হবে… আম গাছে তো বাতাবি লেবু ফলতে পারে না! আমাদের মা-মাসিরা জানত এসব — “আগের হাল যেদিকে যায়, পাছের হালও সেদিকে যায়” শোনোনি?
দুজনের মাঝখানে ব’সে আছে অতি-ফক্কড় বাংলা টিচার সচক্রবর্তী (কারণ সন্তোষ সারা জীবন এভাবেই নাম লেখে)। মেন্ডেল এবং মণ্ডলকে সে সমর্থন দিল ঘটা ক’রে মাথা নাড়িয়ে।
— হুঁ, বংশগতি খুব মারাত্মক জিনিস। বাবা যদি অপুত্রক হয়, ছেলেও অপুত্রক হবে!
মায়ার এক দাদামশাই হরিশংকর মাঝেমাঝেই বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে ঘরের সব টাকাপয়সা গয়নাগাঁটি হাতিয়ে নিয়ে দু’এক মাসের জন্যে বেরিয়ে পড়ত। নিজের ধুতিচাদরগুলো কাতার দড়ি দিয়ে বেঁধে নিত কোমরে, হাতে একখানি বদ্না। এবার বেগ চাপলে জঙ্গলে কাজটাজ সেরে বদ্নায় জল নিয়ে উবু হয়ে বসেছে, কিন্তু কটিদেশ হোল্ডঅলে পরিণত হওয়ায় বাঁ হাত কিছুতেই যথাস্থানে পৌঁছচ্ছে না। তখন খুব অবাক হয়ে বিড়বিড় করত — আমার হাত খাটো হইছে, না পাছা দূরি গেছে? বৌয়ের হাড়-জ্বালানো কড়িচণ্ডাল লোকটার ধাত হয়ত এখন চাঁদের রক্তে!
নির্মলের ছোটঠাকুর্দা পিনাকপাণি কুৎসিত দেখতে হেতুক বিয়ে করেনি। তার ভয় ছিল, বউ সৌম্যদর্শন ভাসুরদের অঙ্কশায়িনী হবে। সারা জীবন আত্মীয়-পড়শি যে-মেয়েই পাণিদাদুর পায়ে গড় করেছে, তাকে দুটো স্তন খামচে ধ’রে তুলত সে। শেষে মেয়েরা দূর থেকে জোড়হাতে প্রণাম সারত, বুড়ো করত মুখখিস্তি। বংশ-ধারামতে সেই লোচ্চামিও কি চাঁদের পিছু নিল?
প্রথম দেশলাইকাঠিতে আঙুল পুড়িয়ে দ্বিতীয়টায় মোমবাতি খুঁজে পায় নির্মল, ছেলের জন্মকুণ্ডলী টেনে নিয়ে আর একবার আয়ুর্গণনাসহ মারক-বিচারে বসে। দেখা যায় জৈমিনী, পরাশর, পারিজাত একই দৈব পরামর্শ পেয়ে নিধনভাব-বিবেকঃ অধ্যায়টি লিখে গেছেন — আয়ুর্দাতা যোগত্রয়ের সবক’টিই দুর্বল হওয়াতে অনধিক ত্রিশ বর্ষাদি বয়সে কেতুর দশায়, বৃহস্পতির অন্তরে, শনির প্রত্যন্তরে, বুধের সূক্ষ্ম দশায় এবং শুক্রের প্রাণদশায় জাতকের দফারফা নির্ধারিত আছে।
বুদ্ধিরহিত নির্মল পরাশরসংহিতাপথ ধ’রে ছুটতে থাকে যতক্ষণ না রেড সিগন্যালের মতো “পিতামাতার পাপে বিনষ্ট হয় সন্তান” — এই পরোক্ষ বংশগতি-নিয়মের মুখে পড়ছে! চোখে ফুটে ওঠে দৌলতপুর স্কুল, ভূগোলশিক্ষিকা ঢাকার মেয়ে পারমিতা শূর… তার শাড়ির ভাঁজ-কুশলতা, সহবতবুদ্ধি, সুরের জোয়ারিখেলা রূপ, উদাস কবিতাপাঠ, আশ্চর্য হাতের রান্না…! এক ছুটির দিনে দুজনেরই ভুল ক’রে স্কুলে চলে আসা আর বেলা গড়াতেই হঠাৎ শরীরের শিরাধমনী উপড়ে ফেলা ঝড়জলে একমাত্র ছাতার নীচে পেছল আলপথে হেঁটে ফিরতে ফিরতে টবের দুই ফুলগাছের মতো ঠোঁটে-ঠোঁটে অনিশ্চিত পাপড়িসংযোগ। নিজের অন্যায়ের আঙারে ঝলসে যাওয়া নির্মল মাঝরাস্তা থেকে ছুটে পালিয়ে আসে। এখন ভাবে, সেদিন কোনটা বেশি অপরাধ ছিল, ঐ পাপচুম্বন নাকি পারমিতাকে বৃষ্টিপ্রলয়ে মাঠের মধ্যে একা ছেড়ে যাওয়া!
সাতাশ
এক অক্ষর শব্দও না ক’রে দরজা খুলে উঠোনে নামে নির্মল। শুক্লাতিথির জ্যোৎস্না আমডালের ফাঁক দিয়ে বায়োস্কোপের আলোর মতো তার গায়ে-মাথায় ঘুরে বেড়ায়। ভটচাজবাড়ির কর্তা যদি নির্মল হয়, তবে নির্মলেরও অভিভাবক এই সুরোট বোম্বাই আমগাছখানা। দুটো ডাল চাঁদের বাড়ির দুটো ঘরের মাথায় এমন চাপিয়ে রেখেছে, ভূভারতে কোনও কালবোশেখির ক্ষমতা নেই টিনের চাল উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তার এক এক শাখায় এক এক জাতের আম আর এমন মিষ্টি, পেটে কৃমি থাকলে তোমার গা ঘুলিয়ে বমি হয়ে যাবে।
তখন চরাচরে একা নড়বড়ে পায়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে যাচ্ছে অবিরাম সাইকেলচালক। বাঁ কানে পৈতে জড়িয়ে বাথরুমে উবু হয়ে পেছছাপ সারে নির্মল, তারপর ছাদহীন বাথরুম থেকে রঘুনাথের মাঠে তাকিয়ে থ’ হয়ে যায়।
গোল ঘুরতে ঘুরতে বাবলু গিরি সাইকেল নিয়ে তাঁবুর পেছনে চলে এসেছে। সেখানে মাকে সোয়েটার খুলে দিয়ে ত্রিপলের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, আর ফুলপ্যান্ট-পরা মা ছেলের ঢলঢলে পুলওভার গায়ে গলিয়ে সাইকেলে চেপে বসল। আমতলার ছায়া-আবডালে দাঁড়িয়ে নির্মল দ্যাখে, মাথায়-টুপি বাবলুর মা ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে শুরু করল মাঠচক্কর, হাতের শাঁখাজোড়া জলজ্যোৎস্না মেখে চকচক করে।
গোটা রাতের রাগী শোক কেটে গেল নির্মলের। জীবনের এর চেয়ে দিলখুশ সংজ্ঞা হতে পারে না। শুধু চাঁদ তো নয়, প্রত্যেক রিফিউজির ভবিষ্যতের একটা এক্স-রে নিলে দেখা যাবে প্লেটটা সাদা হয়ে আছে মৃত্যুভয়ের ফুলকপি-মেঘে। তাহলে নৈতিকতা চুলোয় দিয়ে শেষ নিঃশ্বাসবিন্দু পর্যন্ত ভালোবাসো। মহৎ স্নেহের মতো ভালোবাসো। শুরুতে সেই ভিখারিমাসি আর এখন বাবলুর মা তাকে হাত ধ’রে শাস্ত্রবিধির বাইরে এনে আকাশ দেখাল।
শেষ সাতাশ
ফিরে আসা খড়মের খুটখুট কানে আসছে মায়ার। তাদের দু’ঘরের মাঝে ঘুমন্ত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল অন্যমনস্ক পাদুটো। তারপর দীর্ঘস্থায়ী কাগজ ছেঁড়ার শব্দ পেল মায়া। শুধু কাগজ নয়, ফরফর ক’রে কালিঅক্ষর ছিঁড়েকুটে যাচ্ছে, প্রজন্মগড়ানো রেওয়াজ আস্ত থাকল না, অলুক্ষুনে ঐতিহ্য হারিয়ে মুছে যাক — বেড়ার গায়ে আঁকা ভোটের ছবিতে সাপটে চুনকাম ক’রে দেওয়ার মতো। আহ, উথাল সমুদ্রে পিপেভর্তি তেল ঢেলে দিয়ে অবধারিত জলডুবি থেকে বাঁচা গেল। নমো শ্রীহরি!
.
(আর একটু লিখতে পারি?)
অসামান্য এই ধারাবাহিকের প্রতিটি পর্ব মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে চলেছি প্রিয় কবি।