ভাবনায় অণু গল্পের আকার

অণুগল্প নিয়ে অনেকের জিজ্ঞাস্য – অণুগল্পের সার কথা কি? অণুগল্পই বা কি? কি চাইছে সাহিত্যের এই ধারা।
সাহিত্য ধারা বিষয়ে প্রথমেই জানতে হবে আমরা লিখি কেন? কেন না কিছু একটা পড়াতে চাই। আমরা লেখালেখি পড়ি কেন? কিছু একটা জেনে নিতে চাই। আমরা বলি কেন? কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করি। আমরা শুনি কেন? কিছু একটা বুঝে নিতে চাই। আমরা ভাবি কেন? কিছু একটা ভাবাতে চাই। সর্বোপরি স্বপ্ন দেখি কেন? আগামী আরও স্বচ্ছ চাই।
এই এত কেন-র রাস্তা অনেক। প্রবন্ধে গল্পে উপন্যাসে কবিতায় নাটকে ছবিতে নানাভাবে প্রকাশ করি। এই প্রকাশ ভাবনায় নতুন সংযোজন অণু। অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত অথচ বিশাল ব্যাপ্তি। এই চর্চা শুরু হয়েছিল অনেকদিন আগেই। শুধু তার পেছন ও সামনে ছিল অনেক কথা। সার কথা ছিল আরও স্পষ্ট ও নির্ধারিত।
যেমন ধরা যাক তেলের শিশি ভাঙল বলে/ খুকির পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব ধেড়ে খোকা/ ভারত ভেঙে ভাগ করো/ তার বেলা? কবিতাটির মূল ভাবনা কিছু এই কটা লাইন। এর পেছনে আরও যে বিস্তারিত ভাবনা তারও গুরুত্ব অপরিসীম।
আরও আছে। কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিলেন তিনি মরে নাই। এই গল্পের মূল ভাবনা কিন্তু একটুকুই। তার পেছন ও সামনে খুবই অপরিহার্য একথা অস্বীকার করার উপায় নাই। কেউ যদি এ রকম ভাবনা তার গল্প বা কবিতার মাধ্যমে আরও সংক্ষেপ করে বোঝাতে পারে তাহলে তা হবে অণু চর্চা। সে গল্প হোক বা কবিতা।
দূরবীন উপন্যাসে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বোঝাতে চেয়েছেন দূরের মানুষ কি করে কাছে হয়ে যায় আর কাছের মানুষ কিভাবে লক্ষ্য যোজন দূরে চলে যায়।
কিভাবে? কেন? এই ভাবনায় কেউ যদি সংক্ষিপ্তায়নে সহজেই বোঝাতে পারে। তা হবে অণু চর্চা।
প্যাঁচা কয় প্যাঁচানি খাস তোর চ্যাঁচানি; মাসি গো মাসি পাচ্ছে হাসি; ছিল নেই মাত্র এই – এ রকম হল কবিতা। আর বনফুলের হাত ধরে গল্প। বনফুলের বিস্তৃতি আরও সংক্ষিপ্তায়ন। অর্থাৎ ছোট গল্প থেকে অণুগল্প।
অর্থাৎ সার কথা, উপলব্ধি, সঠিক ভাবনা, নির্দিষ্ট জীবন দর্শন যতটা সম্ভব সহজ ভাবনায় আশেপাশে দেখা অথচ না-দেখা দৃষ্টিকোণ দেখিয়ে দেওয়া গল্পভাবনার নাম অণুগল্প।
অন্য অনেক গল্পের লেখার মত অণুগল্প লেখা সম্ভব নয়। কেন না ছোট গল্প বা বড় গল্পের ক্ষেত্রে কুশীলবদের নিয়ে লিখতে লিখতে এ সময় সেই লেখার ভাঁজে একটা উপলব্ধি প্রতিষ্ঠিত হয়। আগে থেকে সেই উপলব্ধি ভেবে নেয় অথবা নাও ভাবলে চলবে। কিন্তু অণুভাবনায় এই ভাবনা আরও স্পষ্ট হতে হবে। যতটা স্পষ্ট হবে অণু প্রকাশ ঠিক ততটাই পরিচ্ছন্ন হবে। কিন্তু ভাবনার ক্ষেত্রে কোন প্রকার জোর নয়। যতটা সম্ভব সহজ ও সাবলীল।
লেখকরা ভাবুক। এই ভাবুকতা যতটা সম্ভব কম কথায় প্রকাশ হয় কবিতায়। এখন উঠে আসছে গল্পে। যেমন খুঁড়োর কল, সৎ পাত্র, রামগরুড়ের ছানা, একুশে আইন, উলঙ্গ রাজা, কলকাতার যিশু, মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়, মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে এ সবই অনবদ্য উপলব্ধির অনন্য অমর প্রকাশ। সে রকমই উপলব্ধি গল্পে প্রকাশ হচ্ছে। অনেক পড়াশুনা ও সাহিত্যধারায় সম্পৃক্ত হয়ে তবেই এই উপলব্ধির অণু প্রকাশ সম্ভব।
এখন অণুগল্প কি? কিভাবে লেখা যায়? এটা নয় কেন? ওঠা হবে না কেন? ইত্যাদি। এখানে একটা জিনিস মনে রাখা দরকার, কবিতা লিখতে কাব্যিক হতে হবে আর গল্প লিখতে গল্প হতে হবে। কোথাও কোন ব্যাখ্যা কেউ চায় না। যেন অন্য কাওকে ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস/ ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’ এভাবে কবিতা বলতে পারি। এবং গোপাড় ভাঁড় বা কাবুলিওয়ালার মত অন্যকে এই গল্প যেন বলতে পারি।
অর্থাৎ গল্প হতেই হবে গল্পের ক্ষেত্রে আর কাব্যিক হতে হবে কবিতার ক্ষেত্রে। সে অণু হোক আর যাই হোক। কবিতায় বিশাল বিস্তৃতি অল্প শব্দে কাব্যে বাঁধার চেষ্টা। তেমনি গল্পের বিশাল বিস্তৃতি ধরে রাখার নাম অণুগল্প। স্বছ ভাবনা গড়ে তুলুন তারপর তাকে গল্পের আকারে উপস্থাপন করুন। অণু কিন্তু কোন বর্ণনা চায় না। সে চায় পরিপূর্ণ নিদির্ষ্ট লক্ষ্য। লক্ষ্য যেন গল্পের আকারে হয়। আর যেহেতু অণু তাই শব্দসংখ্যা খুব একটা বিচার্য নয়। বিচার্য হল বক্তব্য। সেই বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে যতটা প্রয়োজন ততটাই লিখতে হবে। এবং পাঠককে ধরে রাখতে হবে। তাহলেই হবে অণুচর্চা।
এর জন্য সবার আগে যেটা প্রয়োজন তা হল নিরীক্ষণ। জীবন ভাবনা নিরীক্ষণ। আন্দাজে রামের সাথে শ্যাম জুড়ে এগিয়ে গেলাম তারপর একটা অবস্থানে পৌঁছলাম তা কিন্তু হবে না।
অণুর ক্ষেত্রে অবশ্যই মেদবিহীন, সঠিক শব্দ, বক্তব্যের উল্ফন, ভাবনার নির্যাস থাকা দরকার। শুধু রসটুকু, কোন ছিবড়ে চলবে না। বাড়তি চলবে না। আর কিছু অচেনা অজানা পাঠকের জন্য ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা থাকা দরকার। আর পাঠক যেন পড়া শুরু করে পাঠে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তার জন্য ভাবনায় যেন কোন প্রকার জোর না থাকে। পড়ার পর পাঠক যদি মনে করে, কেন সময় নষ্ট করলাম তাহলে আপনার লেখা এই অণু নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারল না।
শুধু না লিখে ভাল ভাবুন, ভাল লিখুন। যতটুকু দরকার ততটুকু। অণুকবিতা। অণুগল্প।

6 thoughts on “ভাবনায় অণু গল্পের আকার

  1. গল্প হতেই হবে গল্পের ক্ষেত্রে আর কাব্যিক হতে হবে কবিতার ক্ষেত্রে। সে অণু হোক আর যাই হোক। কবিতায় বিশাল বিস্তৃতি অল্প শব্দে কাব্যে বাঁধার চেষ্টা। তেমনি গল্পের বিশাল বিস্তৃতি ধরে রাখার নাম অণুগল্প।

    বেশ খোলামেলা আলোচনা করেছেন। শিক্ষণীয় প্রবন্ধ মনে করি। ধন্যবাদ কবি।

  2. সার কথা, উপলব্ধি, সঠিক ভাবনা, নির্দিষ্ট জীবন দর্শন যতটা সম্ভব সহজ ভাবনায় আশেপাশে দেখ অথচ না-দেখা দৃষ্টিকোণ দেখিয়ে দেওয়া গল্পভাবনার নাম অণুগল্প- সুন্দর আলোচনা। ভালো লাগলো।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।