মায়াবন-বিহারিণী (৬-৮)

৬.
এ পর্যায়ে লেখালেখি হতে দূরে সরে যায় মিমি। তার ভাবনা ঘর-গৃহস্থালীতে মগ্ন হয়ে উঠে। দামী এপার্টমেন্ট, দামী গাড়ীর দিকে তার দৃষ্টি হারিয়ে যায়। তার স্বামী প্রকাশকের বিলটি পরিশোধ করে দেন। এভাবে সংসার তার হতাশায় মিমি’র লেখক স্বত্ত্বা হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু লেখালেখি এমন এক নেশা যা একবার কারো হৃদয়ে গভীরে ঢুকে গেলে আর কখনো ত্যাগ করা যায় না। আর সফল লেখকদের চাইতে ব্যর্থ লেখকদের লেখার প্রতি ভালবাসাটা প্রবল হয়। মিমি’র পুরানো ভালবাসা ফিরে আসছিল। আর কাকতালীয়ভাবে এখানে এসে বৈরাগীর অদৃশ্য ছোঁয়াতে নিজেকে আবার পুরানো অবস্থায় ফিরে পেল। বৈরাগীর প্রতি তার আগ্রহটা নানাভাবে প্রকাশিত হতে থাকল।

গৃহকর্ত্রীকে নানাভাবে প্রশ্ন করতে থাকল তার জবাবে তিনি বলেন,‘‘ খুব ভাল লেগেছে যে, তুমি কবির প্রতি খুব আগ্রহ দেখাচ্ছো। কিন্তু সে অন্তর্মূখী মানুষ। যদি তুমি তাকে সমনাসামনি দেখতে পেতে , বুঝতে কি লাজুক সে। আমিতো তাকে প্রায় দুই বছর যাবৎ দেখছি। সে লোকালয় এড়িয়ে চলে। এই রুম দু’টি সে সারা বছরের জন্য ভাড়া নিয়ে রেখেছে, যখন মন চায় চলে আসে, বুকে সমুদ্রের বাতাসের স্পর্শে কেপে উঠে, মুক্ত বিহঙ্গের মতো নেচে উঠে হয়ত তার মন। আর সারাক্ষন কেবল পড়ে বা লেখে। আর সত্যি বলছি এত বড় মনের মানুষ তুমি প্রতিদিন দেখতে পাবে না…..’’
-‘তিনি বড় মনের আর খুব ভাল!’
‘‘ হ্যাঁ, আমি যখন তার সাথে গল্প করতে চাই,’ গৃহকর্ত্রী বলেন,‘ সে সময় দেয়। তার কোন লেখা যা প্রকাশিত হয়নি, ভেবে দেখো, আমি পড়তে চাইলে তেমন লেখাও পড়তে দেয়। জানো একবার সে বলছে, কিছুই লিখতে পারছে না। আমি বললাম, স্থান পরিবর্তন করো, নতুন পরিবেশে যাও। তারপর প্রায় দুই তিন মাস তার দেখা মেলেনি। ফিরে এসে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল যে, আমার পরামর্শে সে দারুন গতিতে আছে….”

৭.
‘ও আচ্ছা, তাহলে তিনি একটি স্পর্শকাতর চরিত্র, কি বলেন?’
‘হ্যা, ঠিক আছে। তবে মাঝে মাঝে অদ্ভুত আচরন করে যা সত্যিই স্পর্শকাতর। স্পর্শকারত! বাহ ভাল শব্দ ব্যবহার করেছো। একদিন রাতে সম্ভবত কোন কবিতা শেষ করেছে সে তারপর সারারাত জোরে জোরে গলা ফাটিয়ে আবৃতি করে চলেছে। জানো তো, আমার থাকার জায়গা থেকে এখানকার যে কোন জোরে উচ্চারিত শব্দ শোনা যায়। তারপর হলো কি, সে আমাকে ডেকে আনলো, ঘুম জড়ানো চোখ আমার বুঝ অবস্থা…। আমাকে কিনা শুনতে হবে তার কবিতা.. এত রাতে!!…’’
একজন উঠতি কবিকে নিয়ে নানা কথোপকথোনের এসব অংশ বিশেষ মাত্র। একদিন গৃহকর্ত্রী মিমির দৃষ্টি আকর্ষণ করল ওয়াল পেপারের দিকে যা কিনা বিছানার পিছনে ছিল বলে দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিল। মিমি বলল,‘দেখি দেখি’।

‘এগুলো’ গৃহকর্ত্রী বললেন, মহিলাসুলভ চপলতা নিয়ে যেন গহীন গোপন ব্যাপারটি জেনে গেছেন,‘ যা ওয়াল পেপারে বা ও দেখ, ক্যালেন্ডারেও লিখা, এগুলো সবই তার কবিতার লাইনের প্রাথমিক অবস্থা। এগুলো আর এরকম থাকেনি কিন্তু ইচ্ছা করলে পড়ে দেখতে পারো। আমার ধারণা সে সারা রাত হেটে বেড়ায়, পায়চারি করতেই থাকে, কোন ভাবনা চলে এলে সাথে সাথে লিখে রাখে দাড়িয়ে দাড়িয়ে, সকালে আবার মাথা থেকে হারিয়ে যায় এই ভয়ে। আমি অনেক লাইন এখানে লেখা দেখেছি যা পরে ম্যাগাজিনে ছাপার অক্ষরে দেখেছি। আবার কোন কোনটি কোথাও দেখিনি। আর কিছু দেখছি নতুন। দেখো দেখো এগুলো আগে কোথাও দেখিনি। নিশ্চয়ই এগুলো কিছুদিন আগে লিখা।’’
‘ও আচ্ছা…’ মিমি বলে।

এসব কথা শুনতে শুনতে সে আরো আবেগ প্রবন হয়ে উঠল। লেখালেখির দিকে গভীর ভাবে ঝুকে পরে।,সে ভিতরের আবেগকে গভীর ভাবে উপলব্দি করতে লাগল।

৮.
হেলালউদ্দিন ঢালী ট্রলারে টেকনাফের দিকে যাওয়াটা বেশ উপভোগ করেন। চাদনী রাতে সমুদ্রের ঢেউয়ের যে অসাধারন রূপ ধরা দেয় সে দিকে তার খেয়াল নেই কিন্তু তিনি উপভোগ করেন যখন ঢেউয়ে এদিক ওদিক হেলে উঠে যানটি তখনকার ভয় পাওয়া মানুষগুলো, দেখতে তার বেশ ভাল লাগে। তিনি উপভোগ করেন প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী কিভাবে ভয়ে পরস্পর জড়িয়ে ধরে। তার ইচ্ছা করে মিমিকে নিয়ে পাবলিক ট্রলারে করে সমুদ্র ভ্রমনে যেতে। কিন্তু মিমি এসব পছন্দ করে না, কোন থ্রিল নেই তার মনে, সে আতংকগ্রস্থ হয়ে পরে। ফলে তাকে একাই যেতে হয়।

ভ্রমনে আনন্দ পাওয়া নিয়ে দুজনের মতবিরোধের কারনে মিমি সমুদ্রে স্নান আর সৈকতে হেটে তার দীর্ঘসময় কাটিয়ে দেয়। সন্তানদের দেখাশুনা করার বাইরে তার হাতে চলে আসে অনেক অলস সময়। তার ভিতরকার লেখক স্বত্ত্বাটি জেগে উঠে প্রবল ভাবে।

বৈরাগীর কবিতা তাকে কেবল টানতেই থাকে। মাঝে মাঝে তার কবিতাগুলো নিজে লেখার প্রতিদ্বন্ধী হিসাবে দাড় করায়। নিজের লেখাকে যখন তার লেখার সামজনে দাড় করায় তখন নিজেকে হাস্যকর মনে হয় আর গোমরে গোমরে ফুপিয়ে কেদে উঠে। তার ভোগবাদী জীবন, না এই উন্নত ভাববাদী জীবন , এই দুইয়ের সংকটে ভুগতে থাকে সে। হৃদয়ের এই অন্তর্দ্বন্ধের কারনে সে নিস্তব্ধ নিথর হয়ে গভীর মনোনিবেশ করে। তার কানে কানে বৈরাগী কথা কয়, প্রতি মুহুর্তে যেন এই ফিসফিসানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু এই কবিকে সে কখনো দেখেনি। সব ইমোশন কি বাস্তবতা খুজে পায়- নিজেই নিজেকে শুধায়।

এই দ্বিমূখী দ্বন্ধে তার স্বামীর ভোগ বিলাসপূর্ণ জীবন হেরে যায়, তার স্বামীর প্রতি ভালবাসাটুকু ক্ষীন হতে হতে শুণ্যতে নেমে আসে। এখন স্বামী-স্ত্রী যেন উপকারী বন্ধু পরস্পর, আর্থিক ও দৈহিক।

চলবে——

8 thoughts on “মায়াবন-বিহারিণী (৬-৮)

  1. পড়ে দেখলাম ভালোই এগুচ্ছে লিখাটি।
    কয়েকটি জায়গায় টাইপো চোখে পড়লো।
    ভুত বানানটি আমার কাছে সত্যই অসাধারণ লেগেছে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    1. কোন ছবি আপলোড করতে পারি না নহলে আমিও—–

      1. এখানে ছবি আপলোড এর ব্যবস্থা নেই।Photobucket বা অন্য কোথাও আপলোড করে ওখান থেকে লিংক দিতে হয় img এর ঘরে।

  2. কবিদের জীবন, তাদের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়ন পড়তে ভাল লাগছে।
    এখন যে বইটা পড়ছি সেটাও আমাদের এক কবি এবং তার মায়ের জীবন নিয়ে লেখা। বেশ লাগছে। চলতে থাকুক।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।