শিরোনামহীন হৃদয়

কি জানি এত শীত কোথায় হতে আসে।
আসে হয়তো নামহীন কোন রাজার রাজ্য হতে।
আমার কথায় নাজ বাকা করে চোখ মারে আমাকে, আমি তাকে মিঠা একটা হাসি উপহার দিতে চেষ্টা করি।

এই শীতে আমার প্রিয় স্পেনের কমলা রংয়ের কম্বলটাই স্বর্গীয় মনে হয়। পাশে শুয়ে থাকা মেয়েটা স্বর্গের আরেক অনু উপাধান। মেয়েটার কপালে চুমু দেওয়ার জন্য উদ্যত হতে নাজ তার অংশীদার হতে চাইলো। বুকের মাঝে মেয়েটাকে জড়িয়ে শক্ত হাতে ধরতে এমনি স্বর্গের ছোট ছোট পরী আব্বু আব্বু ডাক দিতে থাকে। কম্বলের ভিতর সিকি সিকি সুখ হিমালয়ের সুউচ্চ হতে স্বর্গে যাওয়ার রাস্তাও দেখাতে থাকে। গ্রামে হিন্দু পাড়ায় কিত্তন কারণে সারা রাত প্রচন্ড আওয়াজে মাইকে রাম সীতার পুথি পড়ায় ঘুম হয়নি। ধর্ম বিশ্বাসের কাছে, নাকি টাকার কাছে কত সহজে ঠান্ডার মত সব কিছু হার মানে বুঝা দায়। খোলা জায়গায় কুয়াশার চাদরে ডাকা রাতে রামের নাম অবলীলায় মুখে আসার কথা না তারপরও আসছে দুটো টাকার জন্য যা দিয়ে পরিবারের অন্ন জোগাড় হবে। কখনো কখনো মাইকে মধু ‌হ‌ই হ‌ই বিষ খাওয়াইলি বাজে, আবার কখনো কখনো স্বমস্বরে নারীর কণ্ঠে উলুধ্বনিও বেজে উঠে। ভাবতে থাকি আমি কে, কোথায় যাব একদিনতো মরতে হবেই। শীতের রাতে বিছানাটা স্বর্গ হতে কম নয়।

দূর কোন গ্রাম হতে মোয়াজ্জিনের কণ্ঠ ভেসে আসে আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর। এই ভাবে চারদিক হতে কোরানের বানী শুনতে থাকি, শুনতে থাকি নানা ইসলামী গজল। এখন রাম সীতার পুঁথি পড়ার আওয়াজ বন্ধ। আমি আবার ভাবনায় পড়ি এই লোকগুলি নিয়ে যারা মসজিদে গিয়ে শীতের শেষ রাতে অজানা এক সুর সৃষ্টি করে। কুসুম কুসুম স্বর্গ ত্যাগ করে ঘুম হতে নামাজ উত্তম বলে। ভিয়ানা নাকি সুরের তীর্থস্থান আমার মনে হয় আমাদের দেশ‌ও তাই।

কম্বলটা টেনে মুখ ঢাকি, দেয়াল ঘড়ির ঠন ঠন শব্দে আমার বিরক্তি লাগে। ছয়টি শব্দে সকাল ছয়টা বাজে জানান দিল ঘড়িটা। জলদি উঠে বাথরুমে ঢুকে জলকুমারীর ভালবাসা পেতে চেষ্টা করি। শীত আমাকে মাঝ পথেই বাধাগ্রস্ত করে তারপরও নামাজ পড়েই গ্রামের সরু রাস্তায় হাটতে পা ফেলি। আকাশহীন কুয়াশার কাফনের মাঝে আকাশী গাছ নিরবে দাড়িয়ে আছে। দূর্বাঘাস আমার পায়ে জল ঢেলে অভিবাদন জানায়। দ্রুত পা চালাতে হয় কারণ ডায়াবেটিসের জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর হল হাটা-চলা। নিয়ম ও শৃঙ্খলা করে চললে এই রোগ আপনাকে পরাজিত করতে কষ্ট হবেই।

পীচ ঢালা রাস্তায় উঠতে মা কুকুরটা দুইটা বাচ্চা নিয়ে আমার পাশ দিয়ে ভৌদোড়ে চলে যায়। তিনটি শালিক হলুদ ঠোঁটে রাস্তায় ঠোকর মারে। সারি সারি নানা জাতের গাছ মাথা তুলে আকাশের খোঁজে, আমিও খুঁজি আকাশটা সাদা কাঁপন ছিদ্র করে লাল আভার সূর্যের আশায়।

এই গ্রাম‌কে এখন শহরতলীই বলা যায়, শহরের সব সুবিধা‌ই আছে এই গ্রামে। আমি চলতে চলতে বড় রাস্তা পার হয়ে যাই। তখন আকাশে‌ও লাল আভার বিচ্ছুরণ নজরে আসে কিন্তু জনমানবহীন যেন সব। এক হিন্দু বাড়ির ঠাকুর ঘরের সামনে থমকে যাই। দাঁড়িয়ে চেনার চেষ্টা করি ঠাকুর ঘর এবং পূজামণ্ডপ। আমার বাবার বাল্য বন্ধু, আমার প্রিয় শিক্ষক গোপাল চন্দ্র ভৌমিকের কথা মনে পড়ে। কয়েকটা তুলসী গাছ ঠাকুর ঘরের সামনে, একটা পাতা ধরতে তার উপর থাকা জল গড়িয়ে নিচের পাতায় পড়ে তারপর সব জল নিচে মাটিতে পড়ে মিশে যায়। একটা অজানা ভালো লাগায় দেহ শিহরিত হয়ে উঠে। মনে হল ঈশ্বরের করুণায় এক ফোটা শিশির দিলাম স্বর্গবাসী গোপাল স্যারের মুখে। লজ্জা পাই তার পরিবারের সাথে কোন সম্পর্ক না রাখায়। মানুষ যত টাকার মালিক হোক, যত বড় ক্ষমতাশালী কিংবা সম্পদশালী হোক, যত বড় রাজনৈতিক নেতা হোক, যত বড় সমাজপতি হোক আসলে প্রত্যেক মানুষ‌ই সন্তান কোন না লোকের কিংবা শিক্ষকের। আপনি বাবা হ‌লে‌ও কোন না কোন লোকের প্রিয় সন্তান তাই আপনার বিবেক দায়বদ্ধ রাখতেই হবে সমাজের প্রতি।

3 thoughts on “শিরোনামহীন হৃদয়

  1. এককথায় অসাধারণ নস্টালজিয়া বা অনুপম স্মৃতিচারণা পড়লাম। বিশ্বাস করলাম, বেশ লিখেন আপনি। চর্চাটি ধরে রাখলে আমরা পাঠক আপনার লিখা থেকে বঞ্চিত হবো না। অফুরান শুভেচ্ছা মি. ফয়জুল মহী। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. অবশ্যই অবশ্যই সমাজের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। আর তা না হলে আমি কিসের মান-হুশ! 

    ভালো লাগার একটা লেখা পড়ে মুগ্ধ হলাম। দাদার জন্য শুভকামনা থাকলো।      

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।