করোনায় একজন প্রবাসী

FB_IMG_1609669396488

সৌদি আরবের সাথে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা বহু পুরানো, পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতে বাণিজ্য ও অর্থনীতির অনেক বড় অংশীদার সৌদি আরব। এখন তা আস্তে আস্তে যেন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে তার সর্বশেষ নমুনা হলো পাকিস্তানকে ঋণ পরিশোধের জন্য সৌদি আরবের সময়সীমা বেধে দেওয়া। ২০১৮ সালে এক চুক্তিতে পাকিস্তানকে ঋণ ও তেল বাকি দেয় সৌদি আরব। ২০২০ সালের মাঝামাঝি সেই ঋণ পরিশোধ করতে চাপ দিতে থাকে বাদশাহ সালমানের সৌদি আরব এবং বাকিতে তেল বিক্রীও বন্ধ করে দেয়। অর্থনীতির মন্দার ভিতর এই ঋণ পরিশোধ করা পাকিস্তানের জন্য প্রচণ্ড দুরূহ হয়ে পড়ে এমন অবস্থায় পাকিস্তান দ্বারস্থ হয় চীনের দুয়ারে। এবং চীন হতে ঋণ নিয়েই সৌদি ঋণ পরিশোধ করে পাকিস্তান। মহা বিপদে এগিয়ে এসে চীন প্রকৃত বন্ধুর পরিচয় দিয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের আরেক ধনী দেশ আমিরাত তের দেশের যে ভিসা বন্ধ করেছে তার মধ্যে পাকিস্তানও একটা। তাই সাথে সাথে ছুটে যেতে হয়েছে পাকিস্তানি পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে, বিভিন্নজনের সাথে বৈঠক করে বলেন খুব তাড়াতাড়ি এই ভিসার সমস্যা সমাধান হবে। আসলে এইসব হয়রানির মূলে কিন্তু ইস্যু একটাই তা হলো ইসরায়েল। পাকিস্তান যদি সৌদি আরবের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে তাহলে ঋণ নিয়ে কোন জটিলতা সৃষ্টি করতো না রিয়াদ। এবং তেমনি ভিসা নিয়েও পাকিস্তানবাসী হয়রানি হতো না আমিরাতে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতে সৌদি আরবই সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী দেশ, ধর্মই দেশ দুইটির সম্পর্ক দৃঢ় করেছে অনেকে মনে করে। তাই সব বিপদ আপদে সবার আগে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ায় সৌদি আরব। এই সৌদি আরবই মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের সাহায্য করেছে পাকিস্তানকে। ২০০৫ সালে বেলুচিস্তানে ভূমিকম্পে দশ মিলিয়ন ডলার ২০১০ সালে বন্যার পর হতে একশ সত্তর মিলিয়ন ডলারের সাহায্য করে সৌদি আরব, এমন উদাহরণ বহু আছে। পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের সম্পর্ক আছে সামরিক খাতেও, সৌদি সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং মক্কা ও মদিনার পবিত্রতা রক্ষায় কাজ করছে পাকিস্তান সৈন্যদল। সৌদি নেতৃত্বে ইসলামি মিলিটারি এ্যানালাইন্সের প্রধান করা হয়েছে পাকিস্তানি সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল রাহিল শরীফকে।

অবশ্য এই সবের সুযোগ নিয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতিতে সৌদি আরব হস্তক্ষেপ করতো বলে কথা চালু আছে। আরব আমিরাতও পাকিস্তানের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্র, বিভিন্ন সময় প্রচুর অর্থ সাহায্য করেছে। পাকিস্তানে সোয়াতে শেখ জায়দ ব্রিজ কিংবা লাহোরে শেখ জায়েদ মেডিকেল কমপ্লেক্স এইসব তার উদাহরণ। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা চালানো পর যে দুইটি দেশ সর্ব প্রথম সমর্থন দিয়ে ছিলো তাহলো সৌদি আরব আর আরব আমিরাত। সেই সময় পাকিস্তানকে অবরোধ দিলে সৌদি আরব প্রতিদিন ৫০ ব্যারল তেল বিনা মূল্যে এক বছর পাকিস্তানকে দিয়ে ছিলো। পাকিস্তানের সবচেয় বড় রেমিটেন্সের বড় উৎস মধ্যপ্রাচ্যের এই দুইটি দেশ এইছাড়া শুধু সৌদি আরবে বাস করে পাকিস্তানের বিশ লাখ নাগরিক। এরা সৌদিতে গঠে তুলেছে পাকিস্তানি কলোনিসহ নানা ব্যবসা বাণিজ্য। বছরে আড়াই মিলিয়ন ডলার লেনদেন হয় সৌদি আর পাকিস্তানের ভিতর এবং আমিরাতেও প্রচুর পাকিস্তানি বাস করে। যাদের শ্রমে দাড়িয়ে আছে আমিরাত আর বাড়ছে পাকিস্তানের রেমিটেন্স।

এতকিছুর পরও এই দুইটি দেশের সাথে আস্তে আস্তে বাড়ে দূরত্ব পাকিস্তানের অথচ ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বেশ কয়েকবার সফর করেন এই দুই দেশ। সৌদি যুবরাজ ইমরান খানকে উষ্ণ সংবর্ধনা প্রদান করেন এবং বেশ কয়েকটি বিশাল বিশাল চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর পরে তিক্ততা বাড়ে একটু একটু করে, ভারত যখন কাশ্মীরিদের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে তখন সৌদি আরব ও আমিরাত কোন কথাই না বলে চুপ করে ছিলো। এই ছাড়া মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ইমরান খানের উচ্চ কণ্ঠ সহজভাবে মানতে পারিনি এই দুই ধনী দেশ।
(চলবে)।

করোনায় একজন প্রবাসী।
৪২তম পর্ব।

মুসলিমজগতের তীর্থস্থান মক্কা মদিনার খাদেম হলেও মুসলিমদের সমস্যা এবং ফিলিস্তিনের নিয়ে পুরানো নীতি হতে বর্তমানে সরে গিয়েছে সৌদি আরব। এমন অবস্থায় মহাথির মোহাম্মদ, এরদোয়ান এবং ইমরান খানের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মুসলিম বিশ্বের স্বার্থসম্পন্ন কিছু এজেন্ডা নিয়ে হাজির হলে আশার আলো দেখে মুসলিম বিশ্ব। এই তিন নেতা মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করতে কাজ শুরু করেন একে বলে বিকল্প ওআইসি গঠনের চেষ্টা আর এটা মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক সাড়া পেলে। এর সাথে কোন সম্পর্ক ছিলো না সৌদি আরবের তাহাছাড়া তুরস্কের সাথেও সৌদির সম্পর্ক তেমন ভালো না। সেই সময় এরদোয়ান ও মহাথিরের উদ্যোগে কুয়ালামপুর যে সম্মিলন করা হয়েছে তাতে যোগ দিতে যায়নি ইমরান খান কারণ সৌদির প্রচণ্ড চাপ ছিলো যোগ না দেওয়ার জন্য। এর আগে ২০১৯ সালে ভারত সরকার যখন কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করলো তখন ইমরান খান মুসলিম দেশসহ সারা বিশ্বের কাছে অনুরোধ করে ছিল কাশ্মীর নিয়ে কথা বলতে কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে এইটিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে আখ্যায়িত করে সৌদি আরব ও আরব আমিরাত। এরপরই সৌদিকে দোষারোপ করে একটি বিবৃতি দিয়ে ছিল পাকিস্তান।

যুক্তরাষ্ট্রের ওকালতিতে মধ্যপাচ্যের ধনী দেশ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আমিরাত ইসরায়েলকে স্বীকৃতি পাইয়ে দেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে তার বিরোধিতা করেছে ইমরান খান। সরাসরি দেশ দুইটিকে কিছু না বললেও ফিলিস্তিনের যুক্তিযুক্ত অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। পাকিস্তানি সাবেক এক সেনা প্রধান মনে করেন তুরস্কের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ায় সৌদি ও আমিরাতের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ারও একটা কারণ। সৌদি জোট এই সম্পর্ক ভালোভাবে মেনে নিতে পারিনি। ২০০২ সালে এরদোয়ান ক্ষমতায় আসার পর এই পর্যন্ত মোট চার বার পাকিস্তান সফর করেছেন। তাই দুই দেশের ব্যবসা বাণিজ্য বেড়েছে বহুগুণ। এইদিকে পাকিস্তানে ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর এই সম্পর্ক বিদ্যুৎ গতিতে বাড়তে থাকে। আর সৌদি আরব নাখোশ তুরস্কের উপর আরব বসন্ত এবং ইরানসহ বিভিন্ন কারণে।

পাকিস্তানের সাথে সৌদি আরবের শীতল সম্পর্কের কারণে পাকিস্তান যখন সৌদি ঋণ পরিশোধ করতে দৌড়াচ্ছে তখন মধ্যপাচ্যে লম্বা এক সফর দেন ভারতের সেনা বাহিনীর প্রধান। এই সফরে সেনা প্রধান প্রতিরক্ষাসহ নানা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কথা বলেন দেশ দুইটির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে অবশ্য এর আগে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সফর করেন আরব আমিরাত। আর এতে বুঝা যাচ্ছে মধ্যপাচ্যের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার সম্পর্কের পরিবর্তন হচ্ছে তবে এই দুই দেশের সাথে ভারতের গভীর বাণিজ্যিক সম্পর্ক আগে হতে কারণ দুই দেশের অপরিশোধিত তেলের বড় ক্রেতা হলো ভারত। তাহাছাড়া সৌদি আরবে রয়েছে সাতাশ লাখ ইন্ডিয়ান আর আরব আমিরাতে জনসংখ্যার শতকরা ত্রিশজনই ইন্ডিয়ান। এই সম্পর্ক বাণিজ্যকে ছাড়িয়ে সামরিক খাতে প্রভাবিত হতে থাকে ২০১৪ সাল হতে। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মৌদি তিনবার আমিরাতে এবং দুইবার সৌদি আরব সফর করেন। এই সফরে প্রতিরক্ষা চুক্তির আওতায় সৌদি ও ভারত একটি যৌথ কমিশন গঠন করেন এবং আমিরাত সেনাবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী যৌথ মহড়া পরিচালনা করেছেন একবার। একদিকে মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে দুরে সরিয়ে এই দুইটি দেশ ভারতকে যে নতুন মিত্র বানাতেছে তা আজ খুবই পরিষ্কার। তাই বলা যায় দক্ষিন এশিয়ার সাথে মধ্যপাচ্যের সম্পর্ক পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।

পাকিস্তানকে এই দুই দেশ বাদ দেওয়ায় পাকিস্তান বাধ্য হয়ে নতুন মিত্র খোজে নেয় তাই চীন, ইরান, কাতার ও তুরস্কের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতা। সময়ে বলে দিবে পাকিস্তান ঋণের ফাঁদে পড়ে থাকবে কিনা। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন পাকিস্তানের সাথে দেশ দুইটির যেতই দুরত্ব তৈরী হোক তবে পাকিস্তানকে একদম দুরে সরিয়ে দিবে না এই ধনী দেশদ্বয়। পাকিস্তানের সাথে আরব দেশের এমন সম্পর্ক রয়েছে যা কোন কিছু দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। তার প্রমাণ পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দুবাই সফর । তিনি দুবাই বসে সাংবাদিক সম্মিলন করে জানিয়ে দেন যে ভারত পাকিস্তানে হামলার যে পরিকল্পনা করছে তার সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে আরব দেশে। এতে বুঝা যায় পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রী আমিরাত হতে এই তথ্য পেয়েছেন তাই দুবাইতে বসে দুনিয়াকে জানিয়ে দেন।
(চলবে)।

করোনায় একজন প্রবাসী।
৪৩তম পর্ব।

সকল জল্পনা -কল্পনার অবসান করে সৌদি আরব এবং কাতার সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন হয়েছে। দীর্ঘ তিন বছরের অধিক সময় পর কাতারের উপর দেওয়া অবরোধ গত ৫ই জানুয়ারি প্রত্যাহার করে সৌদি জোট। সৌদিতে অনুষ্ঠিত জিসিসি সম্মিলনকে সামনে তাই বিবদমান দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন হয়। কুয়েতের ওকালতিতে দুই দেশের মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষর হয় যার ফলে মধ্যপাচ্যে শান্তি ফিরে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে । ১৯৮১ সালে উপসাগরে দেশগুলির মধ্য গঠন করা হয় গালফ কোং অপরেশান ক্যাউন্সিল (জিসিসি)। কুয়েত, কাতার সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ওমান ও বাহারাইন এই ছয়টি দেশ নিয়ে গঠন করা হয় জিসিসি মুলত এইটা আসলে একটা বাণিজ্য বক্ল। পারস্য উপসাগরের পশ্চিম পান্তে অবস্থিত ছোট দেশ কাতার যার আয়তন চার হাজার চারশ ঊনানব্বই মাইল, ১৯৭১ সালে বৃটেনের কাছ হতে কাতার পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। কাতারকে সর্ব প্রথম স্বীকৃতি দানকারী দেশের মধ্য আরব দেশগুলিই সামনের আসনে। একই বছর কাতার জাতি সংঘ ও আরব লীগের সদস্য পদ লাভ করে ১৯৮৮ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতন্ত্রী চীনের সাথে কূটনীতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।

আটাশ লাখ জনসংখ্যার এই দেশটির একমাত্র সৌদি আরবের সাথে স্থল যোগাযোগ রয়েছে। ইয়েমেনে বর্তমানে হুতি আর সরকারের সাথে যে যুদ্ধ চলছে তা নিয়েই সৌদির সাথে কাতারের বিরোধ তুঙ্গে উঠে। আগেই বলেছি ইয়েমেন সরকারকে মদদ দেয় সৌদি আরব আর হুতি (শিয়া) গোষ্ঠীকে মদদ দেয় ইরান। ইয়েমেন যুদ্ধে কাতার,সৌদি ও আমিরাতের পক্ষ নিতে অস্বীকৃতি জানায় শুধু তা নয় কাতার ইরানের সাথে সমানতালে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চলে এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কাতারকে অবরোধ আরোপ করে সৌদি জোট। শুধু অবরোধ নয় জল স্থল সব রাস্ত বন্ধ করে দেয় যোগাযোগের আর এতে সাময়িক বেকাদায় পড়ে কাতার। ২০১৭ সালে ৫ই জুন জেসিসি ভুক্ত দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের পাটল সৃষ্টি হয়। কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ করে সৌদি জোটভুক্ত আরব আমিরাত, বাহারাইন ও মিশর এবং অবরোধ আরোপ করে এইসব দেশ সকল প্রকার কূটনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। তাদের অভিযোগ ২০১৪ সালের জেসিসি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে কাতার। এই অবরোধে যোগ দেয় মালদ্বীপ, মৌরিয়া, তানিয়া, জিবুতি, লিবিয়া ও সেনেগাল তবে ওমান কোন পক্ষেই ছিলো না আর কুয়েত চেষ্টা করে মধ্যস্থতা করার তাই মুলত কুয়েতের কারণে এই সম্পর্ক আবার স্থাপন হলো।

ওমান ও কুয়েত কোন পক্ষকে সমর্থন না করে নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। সৌদি ও কাতারের বিরোধ মিটাইতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে কুয়েত আর এতে সমর্থন দেয় আরেক জিসিসিভুক্ত দেশ ওমান। বিশেষ করে কুয়েত শাসকের জন্য এইটা ছিলো বিরাট কূটনীতিক সাফল্য তাই মধ্যপাচ্যে বিরাট এক দ্বন্দ্ব মিটে যায়। কুয়েত ও ওমানের আন্তরিকতায় সৌদি ও কাতার আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হয় তবে এতে যুক্তরাষ্ট্র বিরুদ্ধে ছিলো। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের ডেমোক্রেট দলীয় বেশ কিছু সদস্য সৌদি যুবরাজের কর্মকাণ্ড ভালোভাবে নেয়নি।যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কিছু বিতর্কিত কাজ সৌদি ইমেজ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহনের পর জেসিসিভুক্ত দেশগুলি নিয়ে কি সিদ্ধান্ত নেয় তা নিয়েও চিন্তিত মধ্যপাচ্য। চুক্তি মোতাবেক জিসিসি সম্মিলনে যোগ দিতে সৌদি তার আকাশ, স্থল ও জল সব পথ খোলে দেয়, বিনিময় কাতার তার বিরুদ্ধে অবরোধকারি দেশসমূহের আইনি কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে রাজি হয়।

সৌদি আরব এবং কাতারের মধ্যে সম্পর্ক পুনরায় স্থাপনে জেসিসিভুক্ত দেশগুলির মধ্যে যে দ্বন্দ্ব পুরোপুরি মিটে যাবে তা এই মুহুত্বে বলা কঠিন। এবং সৌদি আর কাতারের দ্বন্ধ দুর না হলেও এই চুক্তির ফলে মধ্যপাচ্যের দেশগুলির মধ্যে স্থিতিশীলতা আসতে পারে হয়তো। তবে মধ্যপাচ্য গবেষকগণ মনে করেন এই দুই দেশের চুক্তি মধ্যপাচ্যে অতি তাড়াতাড়ি দ্বন্দ্ব সংঘাত দুর হবে তা বলা যায় না, তাহাছাড়া গত ৪০ বছরে তারা তাদের দেশের মধ্যে সামরিক বাহিনীর ভিতর আন্তরিকতা গড়ে তুলতে পারেনি এছাড়াও রয়েছে বাহিরের দেশের সাথে নানা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি। গত অবরোধে সৌদি জোট কাতারের সাথে সমঝোতা করার পূর্বশর্ত হিসাবে তেরটি শর্ত দিয়ে ছিলো গত তিন বছরে কাতার একটি শর্তও মেনে নেয়নি এমনকি বর্তমান সমঝোতার চুক্তিতে তের দফা মানতে কিংবা ভবিষ্যতে এমন হলে তখনও মানতে হবে এমন কথাও উল্লেখ করা হয়নি।
(চলবে)।

করোনায় একজন প্রবাসী।
৪৪তম পর্ব।

তারপরও সৌদি আরব সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছে ভূ-রাজনৈতিক চাপে পড়ে, আর এটি নিঃসন্দেহে কাতারের বিরাট কূটনীতিক সাফল্য বলা যায়। কাতারের সাথে সৌদি জোটের সমঝোতার ফলে এই অঞ্চলে ক্ষমতাবান দেশেগুলির কী লাভ-লোকসান হয়েছে বা ভবিষ্যতে হবে তা নিয়ে চলছে মধ্যপাচ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ক্ষমতাবান দেশ তুরস্কের জন্য খবরটি ইতিবাচক বলা চলে,২০১৭ সালে যখন কাতারের বিরুদ্ধে সৌদি জোট অবরোধ আরোপ করে তখন তুরস্ক খুব জোরালো ভাষায় কাতারের পক্ষে কথা বলে ছিলো এবং তুরস্ক তাড়াতাড়ি কাতারের পাশে দাড়িয়ে ছিলো। তুর্কী প্রসিডেন্ট এই অবরোধকে ইসলাম বিরোধী আখ্যা দিয়ে কাতারকে বলেছেন নিজের সামর্থ্য দিয়ে অবরোধ মোকাবিলা করার জন্য এবং নিজেদের স্বার্থে অটল থাকার জন্য। তুরস্ক সবসময় সৌদির সাথে সুসম্পর্ক গঠে তোলতে আপ্রাণ চেষ্টাও করে।

কিন্তু নানামুখি সংকট তুরস্কের এই প্রচেষ্টা বার বার বাধাগ্রস্ত করেছে। এখন সৌদি ও কাতার সম্পর্কের জোড়া লেগেছে আর তুরস্কের সাথে সৌদির জোরালো সম্পর্কের সুযোগ সৃষ্টি হয়ছে তাই এই বছর সৌদি ও তুরস্ক সম্পর্কে নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হয়েছে। তুরস্ক এখন কাতারের সাথে সম্পর্ক ঠিক রেখে সৌদির সাথে কূটনীতিক সম্পর্ক জোরালো করতে পারবে। তুরস্কের সহযোগিতার ফলে কাতার অবরোধকারি সৌদি জোটকে তোয়াক্কা করেনি এবং নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করেছে এতে সবাই মনে করে তুরস্কের রাজনীতি এই অঞ্চলে প্রভাবশালী অবশ্যই। সৌদি আর কাতারের সম্পর্ক পুনঃস্থাপন হওয়ায় কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরান। জিসিসি গঠনের পর হতে এই জোট ভাঙ্গতে বহু চেষ্টা করেছে ইরান কিন্তু সফল হয়নি। কাতারে অবরোধ দেওয়ার ফলে ইরান সবচেয়ে বেশী লাভবান হয়েছে এবং সুযোগ কাজে লাগিয়ে কাতারের সাথে সম্পর্ক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। ইরানের সব পথই ব্যবহার করেছে কাতার, এইছাড়া উপায়ও ছিল না কাতারের সামনে।

নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হলে তুরস্কের এবং ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়া ছাড়া উপায়ও ছিলো না। সৌদির সাথে চুক্তি করা হলেও ইরান বিরোধী কোন জোটে কাতার কখনোই যাবে না কারণ রিয়াদকে কখনো মন থেকে বিশ্বাস করবে না দোহা। আঞ্চলিক রাজনীতি ও ভূ-রাজনীতির কথা মাথায় রেখে কাতার কখনো ইরানকে কোণ-ঠাসা করতে চাইবে না এমনকি ইরান বিরোধী কোন শর্ত সৌদি এবং আমেরিকা চাপিয়ে দিলেও কাতার মানবে না। ইরানের সহযোগিতা আঞ্চলিক রাজনীতিতে কাতারের জন্য খুবই গুরত্বপূর্ণ। তবে মজার কথা হলো সৌদির এই চুক্তিতে আরব আমিরাত অনেক ক্ষুব্ধ। কাতারের সাথে আমিরাতের মুল দ্বন্দ্বটা হলো রাজনীতি ইসলাম । মধ্যপাচ্যে শক্তিধর রাষ্ট্র কোনটা হবে এই উপসাগরে দেশগুলি তা নিয়ে আছে দ্বন্দ্বে । জিসিসি সম্মিলনে মিলিত হলেও আমিরাতের কাতার নিয়ে কঠোর মনোভাবের কোন পরিবর্তন হবে না।

আদর্শিক মত বিরোধের বাহিরেও এই দুইটি দেশের আফ্রিকায় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বিরোধ আছে। বিরোধ আছে তুরস্কের সাথে সম্পর্ক নিয়েও। আরব আমিরাত তুরস্কের বিরুদ্ধে একটা জোট গঠনের চেষ্টা করছে বর্তমান পরিবর্তনশীল দুনিয়ায় আমিরাতের এই উদ্যোগ সফল হওয়ার সম্ভাবনা নাই। সৌদির সাথে তুরস্ক ও কাতারের সম্পর্ক উন্নত থাকলে লিবিয়া হতে শুরু করে পূর্ব ভূমধ্যসাগর এবং আফ্রিকা পর্যন্ত এই সম্পর্কের একটা বড় প্রভাব পড়তে বাধ্য।
(চলবে)।

করোনায় একজন প্রবাসী।
৪৫তম পর্ব।

আমরা সবাই জানি সাদ্দাম হোসেন ১৯৯১ সালে উপসাগরিয় যুদ্ধের সময় কুয়েত দখল করে ছিলেন। ঠিক সেইভাবে সৌদি আরব ও তার মিত্ররা কাতার দখল করতে চেয়ে ছিলেন। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনার কথা জেনে যান ট্রাম্প সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী। তেল ব্যবসায়ী হওয়ায় আমেরিকান মন্ত্রী টিলার চেনের সাথে কাতারের ছিলো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আমেরিকার শীর্ষ এই দুই মন্ত্রী কাতারে হামলার পরিকল্পনা বাদ দিতে সৌদি যুবরাজকে চাপ দিতে থাকেন। এরপর যেতই সময় গড়াতে থাকে তেতই কাতার পাক্কা হতে থাকে আবার তুরস্কের সৈন্যরাও কাতারে এসে পৌছে যায় এবং একটা শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে যাতে সৌদি সৈন্য কাতারে সহজে প্রবেশ করতে না পারে। ইরানের জল, স্থল ও আকাশ পথ ব্যবহার করে কাতার আগের চেয়েও আরো বেশী কাজকারবার চালাতে থাকে এতে সৌদি জোটের অবরোধ অকার্যকর হয়ে পড়ে। এক শক্তিশালী কাতারের জন্য তুরস্ক ও ইরানের পররাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন করে কাতারকে প্রধান্য দিতে থাকে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত কাতারের রাষ্ট্রদূত ইউচুপ আল ওথাইবা আমেরিকার সরকারি মহলে যোগাযোগ বাড়িয়ে দেন। এবং তিনি সেখানে সৌদি লবিষ্টদের হটিয়ে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেন ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে কাতারের সম্পর্ক জোরালো হয়ে উঠে এতে কাতারের প্রতি আমেরিকার সমর্থন বেড়ে যায়। তারপরও ট্রাম্প সৌদি জোটের কাতারের প্রতি অবরোধে সমর্থন অব্যাহত রাখেন। কাতারে মার্কিন সামরিক ঘাটি থাকায় আমেরিকার সেনা বাহিনীও ট্রাম্পের নীতি ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। সৌদি যুবরাজ ট্রাম্পের সমর্থনকে অতিরিক্ত গুরত্ব দিয়ে ফেলেন এবং মার্কিন সামরিক বাহিনী যে অনেক ক্ষমতাবান সে কথা উপেক্ষা করেছেন। যুবরাজ মোহাম্মদ কাতারকে শিক্ষা দিতে গিয়ে যে সীমাহীন বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন সেই কথা বুঝতে পারেনি যখন বুঝতে পারেন তখন সময় অনেক চলে যায়। আর এই দিকে কাতার নিজের অবস্থান প্রচণ্ড শক্ত করে ফেলেন এবং বন্ধুর সংখ্যা দ্রুত বাড়িয়ে ফেলেন।

ইতিমধ্যে ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ এবং তিনি নির্বাচনে পরাজিত হয়ছেন। এইদিকে সৌদি যুবরাজের নানা কর্মকাণ্ড ডেমোক্রেট পার্থী জো বাইডেন ভালো নজের নেননি। বাইডেনের জয়ে যুবরাজের হুশ ফিরে এবং তিনি তড়িঘড়ি করে কাতারের অবরোধ প্রত্যাহার করেন এবং চুক্তি করেন। মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড় সদস্যদের কাতারে আশ্রয় দেওয়া এবং আল জাজিরা টিভি বন্ধসহ কোন শর্তই কাতার মানেনি। পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তন কাতার করেনি বরং তুরস্ক ও ইরান এখন কাতারের পরীক্ষিত বন্ধু । দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অবিচল থাকায় নিজ দেশে কাতারের আমিরের মান মর্যদা জনগণের কাছে বেড়েছে আকাশচুম্বী। কাতারের জনগণেরও বেড়েছে অগাধ দেশ প্রেম ও জাতীয়তাবাদ এবং বেড়েছে আত্মবিশ্বাস। “দুবাইয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের এক অধ্যাপক আগে কাতারের উপর অবরোধ আরোপের কঠোর সমর্থক ছিলেন আর এখন সুর পাল্টিয়ে বলছেন বলা যায় এই অবরোধৈ কাতারই লাভবান । তিনি বলেন এই লড়াইয়ে কাতারই জিতেছে, এই সাড়ে তিন বছরের লড়াইয়ে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। আসলে কাতার হচ্ছে জিসিসির একটা দুষ্ট বালক তাকে মেনে নিয়ে সাথে চলতে হবে। তিনি আরো বলেন জিসিসির অধ্যায় এই বছরগুলি কালো হয়ে থাকবে”।

তাড়াহুড়ো করে সৌদির এই চুক্তিতে লাভ হয়েছে তা বলা যাচ্ছে না কারণ জিসিসি সম্মিলনে কাতার উপস্থিতিতে আরব আমিরাত, বাহারাইন ও মিশরের উচ্চ পর্যায়ের কেউই আসেনি। এমনকি সৌদি বাদশাহ সালমানও উপস্থিত ছিলেন না। কাতারের সাথে বাহারাইনের সীমানা নিয়ে জটিলতা রয়েছে আর মিশরের শাসক সিসি কাতারের সাথে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করতেও ইচ্ছুক নয়।
(চলবে)।

5 thoughts on “করোনায় একজন প্রবাসী

  1. অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে প্রিয়, অফুরন্ত ভালবাসা ও শুভেচ্ছা। শুভ কামনা সতত।

  2. দারুণ লিখেছেন, দাদা। আন্তর্জাতিক সমস্যার অনেককিছু আপনার এই ধারাবাহিক পর্বে থেকে জানা হলো। যা আগে তেমন ধারনাই ছিলো না। 

    শুভকামনা থাকলো। সাথে আছি সবসময়।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।